রাজা সাহেব (৩য় অংশ)/দ্বাদশ পরিচ্ছেদ

দ্বাদশ পরিচ্ছেদ।


রহস্য-ভেদ-অপরাধীর দণ্ড।

 কয়েক দিবস অনুসন্ধানের পর অনুসন্ধানকারী ইনস্পেক্টার বাবু তাঁহার অনুসন্ধান বিবরণী সর্ব্বপ্রধান কর্মচারীর নিকট প্রেরণ করিলেন। তাহার অনুসন্ধানের ফল ক্রমে প্রকাশ হইয়া পড়িল। সেক্রেটারী বাবু প্রভৃতি সকলেই তাহা জানিতে পারিলেন। অনুসন্ধানের ফল জানিতে পারিয়া এসিষ্টেণ্ট সেক্রেটারী বাবু বিশেষরূপে অসন্তুষ্ট ও হতাশ হইলেন। ক্রমে সংবাদ পত্র সম্পাদকদিগের নিকটও সেই সংবাদ গিয়া উপস্থিত হইল।

 যাহা হউক, ইনম্পক্টর বাবু অনুসন্ধান বিবরণীর সারমর্ম এইরূপ ছিল ঃ

 “যে বাড়ীতে রাজবাহাদুর ও তাঁহার লোকজন বাস করিত বলিয়া দরখাস্তে প্রকাশ আছে, সেই বাড়ীতে কখনও কোন রাজা বাস করেন নাই। কিছুদিবস পুর্বে সেই বাড়ী কয়েকজন জুয়াড়ি দ্বারা অধিকৃত হইয়াছিল। তাহাদিগের মধ্যে অনেকেই পুলিসের নিকট পরিচিত। এসিষ্টেণ্ট সেক্রেটারী বাবুরও বোধ হয়, একটু আধটু জুয়াখেলা করা অভ্যাস আছে; নতুবা তিনি সেইস্থানে গমন করিয়া জুয়াড়িদিগের সহিত মিলিত হইবেন কেন? এসিষ্টেণ্ট সেক্রেটারী বাবুর পাঁচ হাজার টাকা উহাদিগের কর্তৃক যে নষ্ট হইয়া গিয়াছে, তাহার আর কিছুমাত্র ভুল নাই। কিন্তু দরখাস্তে বিবৃত উপায় অবলম্বনে অর্থাৎ পাট ক্রয় করিতে তাহাকে নিযুক্ত করিয়া তাহার জামিনস্বরূপ পাঁচ হাজার টাকা যে উহারা গ্রহণ করিয়াছে, তাহা আমার বোধ হয় না। অনুসন্ধানে আমি যতদূর অবগত হইতে পারিয়াছি, তাহাতে আমি নিশ্চয় বলিতে পারি যে, এসিষ্টেণ্ট সেক্রেটারী বাবু জুয়াখেলা করিয়া তাহার পাঁচ হাজার টাকা নষ্ট করিয়াছেন এবং পরিশেষে লোক লজ্জার ভয়ে এই এক অভিনব মিথ্যা উপায় বাহির করিয়া জুয়াড়িগণের নিকট হইতে যাহাতে টাকাগুলি আদায় করিতে পারেন, তাহার নিমিত্ত এই মিথ্যা অভিযোগ উপস্থিত করিয়াছেন।”

 এইরূপ অনুসন্ধানের ফল জানিতে পারিয়া সর্ব্বপ্রধান পুলিস-কর্মচারী, সেক্রেটারী বাবু, সংবাদপত্রের সম্পাদকগণ কেহই সন্তুষ্ট হইলেন না। এসিষ্টেণ্ট সেক্রেটারী বাবু এ বিষয়ের পুনরায় ভালরূপ অনুসন্ধান হইবার নিমিত্ত পুনরায় আবেদন করিলেন। সংবাদপত্র সম্পাদকগণ, সেক্রেটারী বাবুর মতের পোষকতা করিয়া আপন আপন সংবাদপত্রে দীর্ঘ দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখিতে লাগিলেন! সর্বপ্রধান পুলিসকর্মচারীও কি জানি, কি ভাবিয়া সেই বিষয়ের পুনরায় অনুসন্ধানের ভার আমাদিগের হস্তে সমর্পণ করিলেন। আমরা এই অনুসন্ধানে লিপ্ত হইবার পরই পূর্ব অনুসন্ধানকারী কর্ম্মচারী সম্বন্ধে অনেক রহস্য বাহির হইয়া পড়িল। সেই সকল রহস্য এইস্থানে প্রকাশ করা এ পুস্তকের উদ্দেশ্য নহে বলি, তাহা পরিত্যক্ত হইল।

 অনুসন্ধানে যতদুর অগ্রবর্তী হইতে লাগিলাম, এসিষ্টেণ্ট সেক্রেটারী বাবুর দরখাস্ত-লিখিত বিবরণ সকল ততই প্রকৃত বলিয়া বোধ হইতে লাগিল। অনুসন্ধানে জানিতে পারিলাম, রাজা কে, মন্ত্রী কে, দাওয়ান কে, এবং অপরাপর রাজকর্মচারীই বা কাহারা। এই সমস্ত বিষয় অবগত হইয়া সেই জুয়াচোর দলের মধ্যস্থ সমস্ত লোকের নামে ম্যাজিষ্ট্রেট সাহেবের নিকট গ্রেপ্তারী ওয়ারেণ্ট প্রার্থনা করিলাম। ম্যাজিষ্ট্রেট সাহেব আমাদিগের প্রার্থনা মঞ্জুর করিয়া সকলকেই ধৃত করিবার নিমিত্ত ও সকলের থাকিবার স্থান অনুসন্ধান করিবার নিমিত্ত ওয়ারেণ্ট প্রদান করিলেন।

 সর্বপ্রথমেই ধৃত হইলেন—দওয়ানজী মহাশয়! ইহার বাসস্থান লক্ষনৌ জেলায়, জাতিতে ইনি মুসলমান! এইরূপ কার্যে হস্তক্ষেপ করিবার নিমিত্ত পূর্বেও ইনি দুই একবার ঘরও দর্শন করিয়াছেন। ইহার বাক্সের ভিতর হইতে সেক্রেটারী বাবুর পাট ক্রয় কর্মে নিযুক্ত হইবার আদেশপত্র, হাণ্ডনোট প্রভৃতি কয়েকখানি কাগজ পাওয়া গেল।

 দাওয়ানজী মহাশয় ধৃত হইবার পরই ধৃত হইলেন—মন্ত্রী মহাশয়। সেই সময় মাণিকতলায় একখানি বাড়ী ভাড়া করিয়া ইনি বাস করিতেছিলেন। ইহার জন্মস্থান কলিকাতায়। এইরূপ ভাবে জুয়াচুরি করিয়া ইনি আজীবন কাটাইয়া আসিয়াছেন, পুলিসের সর্বপ্রধান কর্মচারী হইতে সর্ব নিম্ন কর্মচারী পর্যন্ত সকলের নিকটই ইনি উত্তমরূপে পরিচিত। কিন্তু এ পর্যন্ত কখন ইনি ধরা ছোয়ার ভিতর যান নাই। ইতিপূর্বে ইনি যে সকল কার্য্য করিয়াছেন, তাহাতে ইনি ধৃত হইলেও কখন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন নাই, ইহার দলস্থিত অনেকেই কারাগার ভোগ করিয়াছে কিন্তু ইনি বরাবরই নিষ্কৃতি লাভই করিয়া আসিয়াছেন। ইহার বাচিয়া যাইবার কারণ, ইহার পয়সার জোর অনেক ছিল, এক এক মোকদ্দমায় বিস্তর পয়সা ইনি খরচ করিয়াছিলেন, এইরূপ শুনিতে পাওয়া যায়। ইহার বাসস্থান অনুসন্ধান করিয়া রাজা মহাশয়ের সেই রাজপরিচ্ছদ ও লক্ষ লক্ষ টাকা পরিপূর্ণ ক্যাসবাক্স প্রাপ্ত হইলাম। তাহার ভিতর তখনও দুই তাড়া নোট ছিল। পূর্ববর্ণিত ভাবে করেন্সী অফিসের নোটের তাড়ার মত ইহাও লাল সূতায় সেলাই করা; এবং উপরে এক একখানি হাজার টাকার নোট দেখা যাইতেছে। সেই তাড়া দুইটী হস্তে গ্রহণ করিয়া উহা উত্তমরূপে পরীক্ষা করিলাম। দেখিলাম যে, সেই হাজার টাকার নোট প্রকৃত নোট নহে, উহাও জাল নোট! এইরূপ অবস্থা দেখিয়া একটা নোটের তাড়া খুলিয়া ফেলিলাম। দেখিলাম, উহার মধ্যে একখানিও নোট নাই, সমস্তগুলিই তাড়াবান্ধা সাদা কাগজ!

 মন্ত্রী মহাশয় ধৃত হইবার পরই রাজা মহাশয়ও ধৃত হইলেন। সেই সময় সকলেই জানিতে পারিলেন যে, এ কার্যে রাজা মহাশয় এই প্রথম ব্রতী। ইনি একজন ভদ্রসন্তান; কিন্তু সঙ্গদোষে চরিত্র হারাইয়া, পরিশেষে সহরের প্রধান জুয়াচার মন্ত্রী মহাশয়ের সহিত মিলিত হইয়াছেন। ইহার পর এক এক করিয়া অপরাপর “রাজ-কর্মচারী মাত্রই ধৃত হইল; কিন্তু কাহারও নিকট হইতে নগদ অর্থ কিছুই পাওয়া গেল না।  দালাল ভগবান দাস পূর্ব হইতেই লুকায়িত হইয়াছিল সত্য, কিন্তু কলিকাতা পরিত্যাগ করে নাই। সুতরাং সেও কলিকাতায় ধৃত হইল।

 বড়বাজারের দোকানদারের নিকট হইতে হাজার টাকা মূল্যের যে কাপড় উহারা জুয়াচুরি করিয়া লইয়াছিল, তাহা স্থানে স্থানে বন্ধক রাখিয়াছিল, এবং কতক বিক্রয়ও করিয়াছিল, তাহাও পাওয়া গেল।

 যে ব্যক্তির নিকট হইতে গৃহ সাজাইবার আসবাব ভাড়া করিয়া লইয়াছিল ও যে সকল দ্রব্যের সহিত উহারা ঐ ঘর পরিত্যাগ করিয়া চলিয়া যায়, সেই সকল দ্রব্যও ক্রমে আমাদিগের হস্তগত হইল; উহার কতক কতক উহাদিগের বাসস্থানেই পাওয়া গেল, অবশিষ্ট যাহা বিক্রয় করিয়া ফেলিয়াছিল, তাহাও সেই সকল স্থান হইতে বাহির হইয়া পড়িল।

 আসামীগণের নিকট হইতে প্রাপ্ত দ্রব্যাদির সহিত রাজা, মন্ত্রী প্রভৃতি সকলেই পরদিবস ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের নিকট আনীত হইল। অমাত্যবর্গ-পরিবেষ্টিত মহারাজাকে দর্শন করিবার নিমিত্ত আদালত গৃহ পূর্ণ হইয়া গেল। উপর্যুপরি কয়েক দিবস পর্যন্ত ম্যাজিষ্ট্রেট সাহেব এই মোকদ্দমা শ্রবণ করিয়া পরিশেষে উহাদিগের সকলকেই উচ্চ আদালতে প্রেরণ করিলেন। দায়রায় উহাদিগের রাজকার্য্যের পর্যালোচনা (!) হইলে জুরিগণ উহাদিগের সকলকেই দোষী সাব্যস্ত করিলেন, আর বিচারক উহাদিগের প্রত্যেককেই কঠিন দণ্ডে দণ্ডিত করিলেন। অদলবলে রাজা মহাশয় এইরূপে কারাগারে গমন করিবার পর এরূপ অনুসন্ধানে আমাদিগকে আর হার্পণ করিতে হয় নাই।


সমাপ্ত।

.