রাজা সাহেব (৩য় অংশ)/নবম পরিচ্ছেদ

রাজা সাহেব।

(৩য় অংশ)

———--—

নবম পরিচ্ছেদ।


টাকা জমা।

 মন্ত্রী মহাশয় সেক্রেটরীকে কহিলেন, “আপনি যেরূপ অবস্থায় পতিত হইয়াছেন, তাহা আমি বেশ বুঝিতে পারিয়াছি, তাহার নিমিত্ত বিশেষ ক্ষতি হবে না, আমি একরূপ বন্দোবস্ত করিয়া দিব।” তৎপয়ে দাওয়ানজী মহাশয়কে কহিলেন, “আপনি একখানি আদেশপত্র লিখিয়া প্রস্তুত করিয়া রাখুন, রাজা মহাশয় আগমন করিবামাত্র উতে তাহার স্বাক্ষর করাইয়া দিব। আর সেক্রেটারী বাবু যে টাকা জমা দিতেছেন, তাহার নিমিত্ত একখানি পাঁচ হাজার টাকায় রসিদ লিখিয়া প্রস্তুত করুন, এবং ইহাকে এখনই যে লক্ষ টাকা প্রদান করিতে হইবে, তাহারও একখানি রসিদ প্রস্তুত হউক। রাজা মহাশয় আগমন করিবামাত্র যত শীঘ্ন পারি, সমস্ত কার্য শেষ করিয়া লইব।”

 মন্ত্রী মহাশয়ের কথা শ্রবণ করিয়া দাওয়ানজী মহাশয় তঠক্ষনাঠ উহার আদেশ প্রতিপালন করিলেন, এবং সমস্ত কাগজপত্র প্রস্তুত করিয়া রাজা মহাশয়ে প্রত্যাশায় বসিয়া রহিলেন।

 সময়-মত রাজা, মহাশয় দয়বার গৃহে আগমন করিয়া উপবেশন করিলেন ও অপরাপর রাজকার্যের অনেক কথাবার্তার পর কহিলেন, “পাট ক্রয় করিবার জন্য সেক্রেটারী মহাশর অদ্যই গমন করিতে সমর্থ হইবেন কি?

 মন্ত্রী। সেক্রেটারী মহাশয় প্রস্তুত হইয়াই আসিয়াছেন। এখন আপনার আদেশ প্রাপ্ত হইলেই গমন করেন।

 রাজা। ডিপজিটের টাকা জমা হইয়া গিয়াছে?

 মন্ত্রী। এখনও জমা হয় নাই। জমা দিবার অভিপ্রায়ে সেক্রেটারী মহাশয় টাকা সঙ্গে করিয়া আনিয়াছেন, আপনার আদেশ হইলে এখনই জমা করিয়া দেন।

 রাজা। টাকা জমা করিয়া দেওয়া হউক। দাওয়ানজী মহাশয়! আপনি টাকা জমা করিয়া লউন।

 মন্ত্রী। সেক্রেটারী মহাশয়! আর বিলম্বে প্রয়োজন নাই, টাকাগুলি জমা করিয়া দিন। |

 এই কথা শ্রবণ করিয়া এসিষ্টেণ্ট সেক্রেটাই মহাশয় কতকগুলি নোট বাহির করিয়া মন্ত্রী মহাশয়ের হন্তে প্রদান করিলেন। মন্ত্রী মহাশয় উহা দেখিয়া লইয়া রাজা মহাশয়ের হন্তে অর্পণ করিলেন, এবং দাওয়ানজী মহাশয়কে কহিলেন, “সাড়ে চারি হাজার টাকা সেক্রেটারী বাবুর নামে জমা করিয়া লউন।” রাজা মহাশয় উক্ত নোটগুলি গ্রহণ করিয়া গণিয়া আপনার কাজের ভিতর বন্ধ করিয়া রাখিলেন ও কহিলেন, “আর পাঁচশত টাকা?”  মন্ত্রী। সেক্রেটারী মহাশয় আর পাঁচ শত টাকা সংগ্রহ করিয়া উঠিতে পারেন নাই। |

 রাজা। এই সরকারে যে নিয়ম আছে, তাহার অন্যথাচরণ আমি কিরূপে করিতে পারি?

 মন্ত্রী। নিয়মের অন্যথাচরণ করিতে আমি বলিতে পারি না। কিন্তু যখন কেবলমাত্র পাঁচশত টাকা সংগৃহীত হয় নাই, তখন সাড়ে চার হাজার টাকা ফিরাইয়া দিলে সেক্রেটারী মহাশয়ের অবমাননা করা হয়। ইনি অপর কার্য্যের নিমিত্ত এইস্থানে আগমন করিয়াছেন; সুতরাং এত টাকা সঙ্গে করিয়া আনিবার ইহার কিছুমাত্র প্রয়োজন ছিল না। পূর্বে যদি ইনি জানিতে পারিতেন, ইহার হস্তে এইরূপ কার্যের ভার অর্পিত হইবে, তাহা হইলে পাঁচ হাজার কেন, দশ হাজার টাকা সঙ্গে করিয়া আনিতে পারিতেন। এরূপ অবস্থায় রাজ-সরকারের নিয়ম ভঙ্গ করিতে যদি মহারাজ, একান্তই অসম্মত হয়েন, তাহা হইলে সেক্রেটারী মহাশয় বক্রী পাচ শত টাকার নিমিত্ত একখানি হাণ্ডনোট লিখিয়া দিতেছেন, তাহা হইলেই রাজ-সরকারের নিয়ম রক্ষা হইল; অথচ এসিষ্টেণ্ট সেক্রেটারীর মান রক্ষা হইল।

 মন্ত্রী মহাশয়ের কথা শ্রবণ করিয়া রাজা মহাশয় যেন একটু অপ্রতিভ হইলেন ও কহিলেন, “আপনার বিবেচনায় বক্রী পাঁচশত টাকার হ্যাণ্ডনোট লিখিয়া লইলে যদি রাজসরকারের নিয়ম ভঙ্গ করা না হয়, তাহা হইলে আমার আর কোনরূপ আপত্তি নাই।” এই বলিয়া আপনার ক্যাসবাক্স খুলিয়া পূর্ববর্ণিতরূপ এক তাড়া নোট বাহির করিলেন। করেন্সী আফিস হইতে নূতন নোটের তাড়া বাহির হইবার সময় যেরূপ। ভাবে লাল সূতার দ্বারা সেলাই করা থাকে, ইহাও সেরূপ ভাবে সেলাই করা। সুতরাং বোধ হইল যে, উহার মধ্যে একশতখানি করেন্সী নোট আছে। তাড়ার উপরের যে নোটখানি দেখা যাইতেছিল, তাহা একখানি হাজার টাকার নোট বলিয়া বোধ হইল।

 রাজা মহাশয় উক্ত নোটের তাড়া আপনার ক্যাসবাক্স হইতে বাহির করিয়া সেইস্থানেই রাখিয়া দিলেন, এবং মন্ত্রী মহাশয়কে কহিলেন, “আপনাদিগের লেড়াপড়া শেষ হইলে এসিষ্টেণ্ট সেক্রেটারী মহাশয়কে এই লক্ষ টাকা প্রদান করিয়া এখনি বিদায় করিয়া দিউন। কারণ, আজ রাত্রিকালেই পাট ক্রয় করিবার নিমিত্ত ইহাকে গমন করিতে হইবে।”

 রাজা মহাশয় ও মন্ত্রী মহাশয়ের মধ্যে যে, কথা হইল, তাহা শুনিয়া ও লক্ষ টাকার নোটের তাড়া সম্মুখে দেখিয়া, এসিষ্টেণ্ট সেক্রেটারী মহাশয় বক্রী পাচশত টাকার নোট লিখিয়া দিতে সম্মত হইলেন।

 মন্ত্রী মহাশয়ের আদেশমত দাওয়ানজী মহাশয় আবশ্যক-মত লেখাপড়া করিতে আরম্ভ করিলেন। এদিকে রাজা মহাশয় এসিষ্টেণ্ট সেক্রেটারী মহাশয়কে নানাপ্রকার উপদেশ দিয়া কিরূপে কত পাট ক্রয় করিতে হইবে, কত দিবসের মধ্যে পাট ক্রয় শেষ হওয়া আবশ্যক, এই সকল বিষয় পরিষ্কাররূপে বুঝাইয়া দিতে লাগিলেন। “

 দরবার গৃহে বসিয়া সকলেই যখন এইরূপ ভাবে আপন জাপন কর্মে ব্যস্ত আছেন, সেই সময়ে অন্তঃপুরের মধ্য হইতে হঠাৎ এক ভয়ানক গেলযোগ উখিত হইল। এই গোলযোগ শুনিয়া রাজা মহাশয় অতিশয় বিস্মিত হইলেন; সেক্রেটারী বাবুকে দিবার নিমিত্ত যে নোটের তাড়া বাহির কক্সিয়া রাখিয়াছিলেন, তাহা আপনার ক্যাসবাক্সের ভিতর রাখিয়া উহাতে চাবি বন্ধ করিয়া গাত্রোত্থান করিলেন, এবং কি হইয়াছে, তাহা অবগত হইবার নিমিত্ত দ্রুতপদে অন্তঃপুরের ভিতর প্রবেশ করিলেন। ক্যাসবাক্সবাহীও ক্যাসবাক্স আপন হস্তে উঠাইয়া লইয়া রাজা মহাশয়ের পশ্চাৎ পশ্চাৎ অন্তঃপুরের ভিতর প্রবেশ করিল।

 অন্তঃপুরের ভিতর গোলযোগ ক্রমেই বৃদ্ধি হইতে লাগিল। হঠাৎ কিসের গোলযোগ উত্থিত হইল, তাহা জানিবার নিমিত্ত দরবারস্থিত সমস্ত লোকই ক্রমে অত্যন্ত ব্যস্ত হইয়া পড়িলেন। মন্ত্রী মহাশয়, দাওয়ানজী মহাশয় প্রভৃতি ক্রমে ক্রমে সকলেই দরবার গৃহ পরিত্যাগ করিয়া কিসের গোলযোগ, তাহা জানিবার নিমিত্ত, অন্তঃপুরের দিকে গমন করিতে প্রবৃত্ত হইলেন। কিন্তু রাজার বিনা-আদেশে কেহই অন্তঃপুরের ভিতর প্রবেশ করিতে না পারিয়া, নিতান্ত চিন্তিতান্তঃকরণে সকলেই সেইস্থানে দণ্ডায়মান রহিলেন। ইচ্ছা-অন্দরের দাস-দাসী প্রভৃতি কাহাকেও দেখিতে পাইলে জিজ্ঞাসা করিবেন যে, অন্দরের ভিতর কিসের গোলযোগ উপস্থিত হইয়াছে। কিন্তু তাহাদের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হইল না। কারণ, দাস-দাসী প্রভৃতি কাহাকেও দেখিতে পাইলেন না। এদিকে অন্তঃপুরের ভিতরে সেই গেলযোগ ক্রমেই বৃদ্ধি হইতে লাগিল; সুতরাং সকলেই বড় উৎকুণ্ঠিত হইয়া পড়িলেন।  সেই সময় মন্ত্রী মহাশয় কহিলেন, “রাজা মহাশয়ের অন্তঃপুরের ভিতর যখন এরূপ গোলযোগ হইতেছে, তখন নিশ্চয়ই বিশিষ্ট কোন বিপদ ঘটিয়াছে। এরূপ অবস্থায় আমি আর স্থির থাকিতে পারি না; কি হইয়াছে, তাহা অন্তঃপুরের ভিতর গিয়া দেখিয়া আসি।” এই বলিয়া মন্ত্রী মহাশয় যেমন অন্তঃপুরের ভিতর গমন করিবার উদ্যোগ করিতেছেন, এরূপ সময় সেই ক্যাসবাক্স-বাহী দ্রুতবেগে অন্দর মহল হইতে বহির্গত হইয়া মন্ত্রী মহাশয়কে কহিল, “সর্বনাশ হইয়াছে! কুমার বাহাদুর উপরের বারান্দা হইতে পড়িয়া গিয়াছেন। বোধ হইতেছে যে, তাহার হস্তপদ চূর্ণ হইয়া গিয়াছে, একজন ডাক্তার আনিবার নিমিত্ত কাহাকেও শীঘ্র পাঠাইয়া দিন।” .

 এই কথা শ্রবণ করিবামাত্র দাওয়ানজী মহাশয় কহিলেন, “আমি এখনই ডাক্তার লইয়া আসিতেছি।” এই বলিয়া কাগজ পত্র তাহার বাক্সের ভিতর বন্ধ করিয়া দ্রুতপদে বাড়ী হইতে বহির্গত হইয়া গেলেন।

 দাওয়ানজী মহাশয় বাড়ী হইতে বহির্গত হইবার অতি অল্প সময় পরেই একখানি ব্রুহাম গাড়ী রাজবাটীর ভিতর প্রবেশ করিল। গাড়ী দেখিয়া সকলেই কহিলেন, “ডাক্তার আসিয়াছেন, আর ভয় নাই।”

 গাড়ীখানি একবারে অন্তঃপুরের ভিতর প্রবেশ করিল, এবং অতি অল্প সময়ের মধ্যে আরও একখানি গাড়ী আসিয়া উপনীত হইল; কিন্তু তৎক্ষণাৎ উভয় গাড়ীই পুনরায় বাড়ীর বাহির হইয়া গেল। গাড়ী বাহির হইয়া যাইবার সঙ্গে সঙ্গে অন্তঃপুরের গোযোগও একবারে কমিয়া গেল। সেই সময় যে সকল ভৃত্য অন্তঃপুরের ভিতর ছিল, তাহার মধ্যে কোন কোন ব্যক্তি বাহিরে আসিয়া উপস্থিত হইল। তাহাদিগের মুখে সকলেই জানিতে পারিলেন যে, যে সময় রাজা মহাশয় দরবার গৃহে বসিয়াছিলেন, সেই সময় অন্তঃ পুরের ভিতর তাঁহার এক বৎসর বয়স্ক একমাত্র কুমার বাহাদুর উপরের বারান্দায় খেলা করিতেছিলেন। খেলা করিতে করিতে বালক হঠাৎ কিরূপে নিয়ে পড়িয়া যায়, এবং তাহাতে সাংঘাতিকরূপে আঘাত প্রাপ্ত হয়। তাহার এখনও কোনমতে চেতনা সঞ্চার হয় নাই। ডাক্তার সাহেব আসিয়া উহাকে দর্শন করিবামাত্র উপদেশ দেন যে, এইস্থানে এই বালককে রাখিলে কোনরূপেই ইহার চিকিৎসা হইবে না। ইহাকে এখনই হাসপাতালে লইয়া যাওয়া আবশ্যক। এই বলিয়া ডাক্তার সাহেব নিজেই তাহাকে ক্রোড়ে করিয়া আপন গাড়ীতে উঠাইয়া লরেন। রাজা মহাশয়ও ডাক্তার সাহেবের সহিত তাহার গাড়ীতে এবং রাণী ও এই বাটীর অপরাপর স্ত্রীলোকগণ সকলেই অপর আর একখানি গাড়ীতে উঠিয়া, এই বাড়ী পরিত্যাগ করিয়া চলিয়া গিয়াছেন। |

 এই সকল কথা শ্রবণ করিয়া সকলেই অতিশয় দুঃখিত হইলেন। কাহায় কাহারও চক্ষু দিয়া অশ্রুজল নির্গত হইল। কেহ হাসপাতালে যাইবার নাম করিয়া বাড়ী হইতে বহির্গত হইয়া গেল। সেই সময় মন্ত্রী মহাশয় এসিষ্টেণ্ট সেক্রেটারী মহাশয়কে কহিলেন, “হঠাৎ কি ভয়ানক বিপদ উপস্থিত হইল দেখিলেন! আমি এইস্থানে আর অপেক্ষা করিতে পারিতেছি না। আপনিও অদ্য গমন করুন, কল্য আগমন করিবেন। সেই সময় আপনার পাট ক্রয় করিতে যাইবার বন্দোবস্ত করিয়া দিব।” এই বলিয়া মন্ত্রী মহাশয় দ্রুতপদে বাহির হইয়া গেলেন। এসিষ্টেণ্ট সেক্রেটারী বাবুও নিতান্ত চিন্তিত অন্তঃকরণে আপন বাসায় প্রত্যাগমন করিলেন।