রাণী না খুনি? (প্রথম অংশ)/চতুর্থ পরিচ্ছেদ

চতুর্থ পরিচ্ছেদ।

 পরদিবস অতি প্রত্যূষে সেই কর্ম্মচারীকে সঙ্গে করিয়া আমি কালীবাবুর বাড়ীতে গিয়া উপস্থিত হইলাম। কালীবাবু এবং ত্রৈলোক্য উভয়েই সেই সময় তাহাদিগের গৃহে উপস্থিত ছিল। কালীবাবু আমাকে দেখিয়া, সম্পূর্ণরূপে চিনিতে পারিলেন কি না, তাহা বলিতে পারি না; কিন্তু আমি তাঁহাকে অতি উত্তমরূপে চিনিতে পারিলাম। কালীবাবু যে চরিত্রের লোক, ত্রৈলোক্যের সহিত মিলিত হইয়া নিতান্ত অসৎবৃত্তি অবলম্বন করিয়া সে একাল পর্য্যন্ত তাহাদের উভয়ের জীবিকা নির্ব্বাহ করিয়া আসিতেছিল, তাহা অতি উত্তমরূপেই অবগত ছিলাম। আমি জানিতাম, দশ হাজার টাকার মূল্যের জহরত খরিদ করিবার ক্ষমতা কালীবাবুর নাই। আরও জানিতাম, কালীবাবুকে যে জানিত, সে দশ হাজার টাকা ত দুরের কথা, দশ পয়সাও দিয়া কালীবাবুকে সহজে বিশ্বাস করিত না।

 আমি কালীবাবুর বাড়ীতে গমন করিয়া কেবল রামজীলাল সম্বন্ধে দুই একটী কথা জিজ্ঞাসা করিলাম মাত্র। সবিশেষ কোন কথা তাহার নিকট ভাঙ্গিলাম না, বা তাহার মনে কোনরূপ সন্দেহ হইতে পারে, এরূপ কোন কথাও তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম না। আমার কথায় কালীবাবু যে কোন উত্তর প্রদান করিলেন, তাহাতেই যেন আমি সত্তষ্ট হইয়া, রামজীলালের অনুসন্ধান করিবার ভান করিয়া সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিলাম।

 যে সময় কালীবাবু ও ত্রৈলোক্যের সহিত আমার দুই চারিটী কথা হইয়াছিল, সেই সময় উহারা যদি সবিশেষ মনোযোগের সহিত আমার দিকে লক্ষ্য রাখিত, তাহা হইলে উহারা সেই সময় আমার কথার উত্তর প্রদান করিতে পারিত কি না, তাহা বলিতে পারি না। কারণ, সেই সময় যেরূপ সতর্কতার সহিত আমি উহাদিগের আপাদ-মস্তক দর্শন করিতেছিলাম, উহারা যদি ঘৃণাক্ষরেও আমার সেই সূক্ষ্ম দর্শনের অর্থ বুঝিতে পারিত, তাহা হইলে আমি নিশ্চয় বলিতে পারি যে, সেই সময় উহারা আমার সম্মুখীন হইয়া কখনই আমার সহিত বাক্যালাপে প্রবৃত্ত হইতে পারিত না। তাহাদিগের পাপরাশীর ভয়ানক অবস্থা আমি বুঝিতে পারিয়াছি, সেই ভাবিয়া কখনই তাহারা কোন পুলিস-কর্ম্মচারীর সম্মুখীন হইতে সাহসী হইত না।

 আমার অভিসন্ধির বিষয় যদিও তাঁহারা পুর্ব্বে কিছুমাত্র বুঝিতে পারিয়াছিল না; কিন্তু পরিশেষে তাহারা আমার সেই সূক্ষ্ম দর্শনের অর্থ সবিশেষরূপে বুঝিতে সমর্থ হইয়াছিল।

 উহাদিগকে যে দুই চারিটী কথা আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, এবং তাহার উত্তরে উহারা আমাকে যাহা কিছু বলিয়াছিল, তাহার কোন কথাই আমি বিশ্বাস করিতে সমর্থ হইলাম না। অধিকন্তু উহাদিগের উপর নানারূপ সন্দেহে আসিয়া আমার মনে উদয় হইল। বস্তুতঃ আমার সমভিব্যাহারী কর্ম্মচারী যেরূপ ভাবে অনুসন্ধান করিয়া রামজীলালের উপর ওয়ারেণ্ট বাহির করিয়া রাখিয়াছিলেন, সেই অনুসন্ধানে আমি সন্তুষ্ট হইতে পারিলাম না।

 এ সম্বন্ধে আরও একটু সবিশেষরূপ অনুসন্ধান করা আবশ্যক, মনে মনে এইরূপ বিবেচনা করিলাম। কিন্তু কোন্‌ উপায় অবলম্বন করিলে, সেইরূপ অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইতে পারিব, ভাবিয়া চিন্তিয়া তাহার কিছুই স্থির করিতে না পারিয়া, আমরা উভয়েই থানায় আসিয়া উপস্থিত হইলাম।

 থানার আসিবার প্রায় দুই তিনঘণ্টা পরে হঠাৎ একটা বিষয় জানিবার ইচ্ছা আমার মনে উদয় হইল। এ সম্বন্ধে আমি কাহাকেও কিছু না বলিয়া, সেই কর্ম্মচারীকে সঙ্গে লইয়া করেন্‌সি আফিসে গিয়া উপস্থিত হইলাম। ইতিপূর্ব্বে যে কয়েকখানি নম্বরিনোট করেন্‌সি আফিসে ভাঙ্গাইয়া লইয়া রামজীলাল প্রস্থান করিয়াছে—সাব্যস্ত হইয়াছিল, করেন্‌সি আফিসের বড় সাহেবের সহিত সাক্ষাৎ করিয়া, সেই নোট কয়েকখানি একবার দেখিতে চাহিলাম। তিনি তাঁহার অধীনস্থ কর্ম্মচারীকে আদেশ প্রদান করিলেন, সেই কর্ম্মচারী অনুসন্ধান-পুর্ব্বক সেই নোট কয়েকখানি বাহির করিয়া আনিয়া আমার হস্তে প্রদান করিলেন। সেই নোট দেখিয়া আমি যে কতদূর বিস্মিত হইলাম, তাহা বলিতে পারি না। কারণ, যে সন্দেহের উপর নির্ভর করিয়া, আমি সেই নোটগুলি দেখিবার ইচ্ছা করিয়াছিলাম, এখন দেখিলাম, সেই সন্দেহ বিশ্বাসে পরিণত হইল। ইতিপূর্বে অনুসন্ধানে আমি অবগত হইতে পারিয়াছিলাম যে, রামজীলাল একজন পশ্চিমদেশীয় লোক, বঙ্গদেশে থাকিয়া ব্যবসা-কার্য্য করিয়া থাকেন বটে; কিন্তু বঙ্গভাষার সহিত তাঁহার কিছুমাত্র সংশ্রব নাই। তিনি না পারেন বাঙ্গালা কহিতে—না পারেন বাঙ্গালা লিখিতে। এখন দেখিলাম, সেই নোটগুলির উপর রামজীলালের নাম স্বাক্ষর আছে সত্য; কিন্তু উহা হিন্দীভাষায় নাই, বাঙ্গালা ভাষায়। রামজীলাল যখন বাঙ্গালা ভাষা একবারেই অবগত নহেন, তখন তিনি বাঙ্গালা ভাষায় আপনার নাম কিরূপে স্বাক্ষর করিলেন, তাহার কিছুই বুঝিয়া উঠিতে পারিলাম না। আরও ভাবিলাম, রামজীলাল যখন সেই সকল অর্থ অপহরণ করিয়া পলায়ন করিতেছে, তখন সে যে আপনার নাম ও ঠিকানা স্পষ্ট করিয়া লিখিয়া দিয়া তাহার বিপক্ষে প্রমাণ সংগ্রহ করিয়া রাখিয়া যাইবে, তাহাই বা সহজে বিশ্বাস করি কি প্রকারে?

 মনে মনে এইরূপ ভাবিলাম সত্য; কিন্তু কাহাকেও কিছু না বলিয়া, সেই নোটগুলি করেন্‌সি আফিসে প্রত্যর্পণ-পুর্ব্বক আস্তে আস্তে সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিলাম।

 কালীবাবুর অবস্থা আমি উত্তমরূপে জানিতাম। তাহার নিজের গাডিঘোড়া নাই, অথচ আড়গোড়া হইতে গাড়ি ভাড়া করিয়া তাহাতে চড়িবার ক্ষমতাও তাহার নাই। এরূপ অবস্থায় কাহার গাড়িতে চড়িয়া সে বাজারে আগমন করিয়াছিল, ক্রমে তাহা জানিবার প্রয়োজন হইয়া পড়িল। রাণীজিই বা কে? সেই জুড়িই বা কাহার? এবং কেইবা সেই জুড়ি আড়গোড়া হইতে ভাড়া করিয়া চড়িয়াছিল, তাহা জানিতে পারিলেই কালীবাবুর কথা যে কতদূর সতা, তাহা অনায়াসেই অনুমান করা যাইতে পারে। কালীবাবু যে জমিদার-পুত্ত্রের কথা বলিতেছে, তিনি যে কে, তাহা কালীবাবুর জানিতে না পারার কোনরূপ অসম্ভাবনা দেখিতেছি না। যে ব্যক্তি তাহারই রক্ষিতা স্ত্রীলোকের গৃহে আসিয়া আমোদপ্রমোদ করে, যে ব্যক্তি তাহারই গৃহে বসিয়া এত টাকা মূল্যের জহরতাদি খরিদ করে, তাঁহার পরিচয় কালীবাবু যে একবারেই জানে না, ইহা কিছুতেই বিশ্বাস হইতে পারে না। অন্ততঃ তিনি যে কোথায় থাকেন, তাহা কালীবাবু বা ত্রৈলোক্য যে একবারেই অবগত নহে, তাহাও আমি কোনরূপেই বিশ্বাস করিতে সমর্থ নহি। আমার অনুমান হইতেছে, কালীবাবু যে সকল কথা আমাদিগকে বলিয়াছে, তাহার অধিকাংশই মিথ্যা কথা। সুতরাং এ সম্বন্ধে আমাকে আরও একটু সবিশেষরূপ অনুসন্ধান করিতে হইবে।

 এইরূপ ভাবিতে ভাবিতে আমি আমার থানায় প্রত্যাবর্ত্তন করিলাম। থানার মধ্যে সেই সময় যে সকল ডিটেক্‌টিভ-কর্ম্মচারী উপস্থিত ছিলেন, তাঁহাদিগের মধ্য হইতে পশ্চিমদেশীয় এরূপ এক কর্ম্মচারীকে আমি আমার সঙ্গে লইলাম যে, তাঁহাকে সহিসের বেশ পরিধান করাইলে, ঠিক সহিসের মতই বোধ হয়।

 সেই কর্ম্মচারীকে আমি সামান্য সহিসের বেশে সজ্জিত হইয়া আমার সহিত আসিতে কহিলাম। তিনি আমার আদেশ মত মহিসের বেশ ধরিয়া আমার নিকট আসিয়া উপস্থিত হইলেন।

 বড়বাজারের যে দোকানে রাণীজির জুড়ি এবং কালীবাবুর কম্পাস গাড়ি গমন করিয়াছিল, সেই দোকানের লোকজনদিগের নিকট হইতে সেই গাড়ির সহিস-কোচবানগণের পোষাকের বিবরণ শুনিয়া আমি সেই সময়েই স্থির করিয়াছিলাম যে, সেই দুইখানি গাড়ি কোন আড়গোড়া হইতে আনীত হইয়াছে। কারণ, কলিকাতার পাঠকগণের মধ্যে অনেকেই অবগত আছেন যে, কলিকাতার প্রত্যেক আড়গোড়ার সহিস-কোচবানদিগের পরিচ্ছদ এক এক প্রকার।