রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ/সপ্তম পরিচ্ছেদ
১৮৩৩ সালে লাহিড়ী মহাশয় হিন্দুকালেজ হইতে উত্তীর্ণ হইয়াই ঐ কালেজে এক নিম্নতন শিক্ষকের কর্ম্ম পাইলেন। সে পদের বেতন ৩০৲ টাকার অধিক ছিল না। সেই বেতনেই তিনি নিজের ও ভ্রাতৃদ্বয়ের ভরণ পোষণ করিতে লাগিলেন। কেবল তাহা নহে, এই কর্ম্ম লইয়া বসিবা মাত্র তাঁহার বাসা নিরাশ্রয় ও আশ্রয়ার্থী ব্যক্তিগণের আশ্রয় স্থান হইয়া উঠিল। লাহিড়ী মহাশয় তাঁহার স্বভাব-সুলভ উদারতা ও অমায়িকতা গুণে কাহাকেও “না” বলিতে পারিতেন না। এইরূপে সর্ব্বদাই দুই একজন লোক আসিয়া তাঁহার ভবনে আশ্রয় লইয়া থাকিত। এই সময়ের আশ্রয়ার্থীদিগের মধ্যে একজনের নাম বিশেষ ভাবে উল্লেখ করা বাইতে পারে। তিনি উত্তয়কালে দেশের মধ্যে একজন মান্য গণ্য লোক হইয়াছিলেন। ইহার নাম শ্যামাচরণ শর্ম্ম-সরকার। ইনি হাইকোর্টের ইণ্টারপ্রিটার ও ব্যবস্থাদর্পণ-প্রণেতারূপে যশস্বী হইয়াছিলেন। প্রথম শর্ম্ম-সরকার মহাশয় খিদিরপুর ওৱাটগঞ্জে তাঁহার পিতার বন্ধু চার্লস রীড নামক এক ইংরাজের অধীনে দশ টাকা বেতনে কর্ম্ম করিতেন। যে কারণে ও যে ভাবে তিনি সে কর্ম্ম ছাড়িয়া রামতনু বাবুর আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছিলেন, তাহার বিবরণ বাবু বেচারাম চট্টোপাধ্যয় প্রণীত শ্যামাচরণ সরকারের জীবনবৃত্ত হইতে উদ্ধৃত করিয়া দিতেছি; —
“পূর্ণিয়া নিবাসী মণিলাল খোট্টা নামক তাঁহার (সাহেবের) একজন খাজাঞ্জী ছিল। তাঁহার স্বভাবগত কোনও দোষ দৃষ্টে কার্য্যের প্রতি সন্দিহান হইয়া, সাহেব তাহাকে কর্ম্মচ্যুত করেন। মণিলাল তাহার প্রাপ্য বেতনাদি লইরা রীড সাহেবের নামে রাজদ্বারে অভিযোগ উপস্থিত করিলেন। রীড সাহেব স্বপক্ষ সমর্থন জন্য শ্যামাচরণ বাবুকে সাক্ষী মানিলে, কি জানি সাহেবের অনুরোধে পাছে মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে হয়, এই ভয়ে তাহার তৎকালীন ১০ টাকা বেতনের দুর্লভ চাকরিটী ধর্ম্মের অনুরোধে অম্লানবদনে পরিত্যাগ করিয়া, তাহার পূর্ব পরিচিত বন্ধু এবং হিন্দুকালেজের সুবিখ্যাত ছাত্র রামতনু লাহিড়ী মহাশয়ের পটলডাঙ্গার বাসায় উপস্থিত হইলেন; এবং তাঁহাকে পুর্ব্ববৃত্তান্ত অবগত করাইলেন। ন্যায়পরায়ণ রামতনু বাবু তৎশ্রবণে আহ্লাদের সহিত তাঁহাকে নিজ প্রবাস গৃহে রাখিয়া সহোদর নির্ব্বিশেষে প্রতিপালন করিতে লাগিলেন।”
“যখন তিনি রামতনু বাবুর নিকটে অবস্থান করেন, সেই সময়েই ভারতপ্রসিদ্ধ রামগোপাল ঘোষ মহাশয়ের সহিত তাঁহার আলাপ পরিচয় হয়। রামগোপাল বাবু যত্ন চেষ্টা করিয়া জোসেফ কোম্পানির আফিসের অধ্যক্ষ জোসেফ সাহেবকে হিন্দী পড়াইবার জন্য শ্যামাচরণ বাবুকে মাসিক ১০ টাকা বেতনে নিযুক্ত করিয়া দেন। তিনি তৎপরে ক্যাল্সেল সাহেবকে হিন্দী পড়াইবার জন্যও নিযুক্ত হন। সাহেবদিগকে হিন্দী পড়াইবার সময়েই তাঁহার বিশেষ হৃদয়ঙ্গম হইল যে কিছু ইংরাজী না জানিলে বিষয় কার্য্য লাভ করা দুষ্কর, তজ্জন্য যখন তাহার বয়ঃক্রম প্রায় ২২ বৎসর তখন তিনি রামতনু বাবুর নিকটে ইংরাজী ভাষার বর্ণমালা শিক্ষা করিতে আরম্ভ করিলেন।”
পূর্ব্বোক্ত কয়েক পংক্তিতে আমরা লাহিড়ী মহাশয়ের সদাশয়তার কি সুন্দর দৃষ্টান্ত দেখিতে পাইতেছি। তিনি ৩০৲ টাকা বেতন হইতে নিজের ও ভ্রাতৃদ্বয়ের ব্যয় নির্ব্বাহ করিয়া এবং দেশে পিতামাতার পারিবারিক ব্যয়ের যথাসাধ্য সাহায্য করিয়াও নিরাশ্রয় ব্যক্তিদিগের জন্য দ্বার উন্মুক্ত রাখিতেন। কেবল আশ্রয় দান নহে, তাহাদিগকে পড়াইবার ভার লইয়া তাহাদের ভাবীজীবনের উন্নতির পথ খুলিয়া দিবার চেষ্টা করিতেন। দেওয়ান কার্ত্তিকেয় চন্দ্র রায় মহাশয়ের স্বলিখিত জীবন চরিতে উল্লেখ দেখিতে পাই, যে তিনিও ইহার কয়েক বৎসর পরে, নবপ্রতিষ্ঠিত মেডিকেল কালেজে পড়িবার অভিপ্রায়ে আসিয়া লাহিড়ী মহাশয়ের ভবনে আশ্রয় লইয়াছিলেন। দেওয়ানজী একস্থানে বলিতেছেন, “কলিকাতায় আমি কালীর (রামতনু বাবুর কনিষ্ঠ কালীচরণ লাহিড়ী) আত্মীয়দের অতি প্রিয়পাত্র হইলাম। নুতন বান্ধবগণের মধ্যে মদনমোহন তর্কালঙ্কার ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়দ্বয়ের মিত্রতা লাভে বড়ই সুখী হইলাম। ঠনঠনিয়ার একটী বৃহৎ বাটীর কোনও অংশে রামতনু বাবু থাকিতেন, কোনও অংশে মদন তাঁহার দুই পিতৃব্যের সহিত অবস্থান করিতেন। আমি রামতনু বাবুর অংশের এক প্রকোষ্ঠে কালীর সহিত একত্রে থাকিতাম।”
এইরূপে আত্মীয় স্বজনে বেষ্টিত হইয়া রামতনু বাবু তাঁহার প্রবাসভবনে বাস করিতেন। কিন্তু শুনিয়াছি তাঁহাদিগকে অতি ক্লেশে থাকিতে হইত। সকলকে পালা করিয়া স্বহস্তে হাট-বাজার করা জলতোলা, বাটন কুটনা, রন্ধন প্রভৃতি সমুদয় করিতে হইত। এরূপও শুনিয়াছি যে এত কষ্ট সহিতে না পারিয়া শ্যামাচরণ সরকার মহাশয় একটু অবস্থার উন্নতি করিতে পারিলেই চলিয়া যান; এবং দেওয়ানজী যে অল্পদিন ছিলেন তাহাতেই তাঁহার শরীর ভাঙ্গিয়া যায়; এবং তাঁহাকে মেডিকেল কালেজ ছাড়িতে বাধ্য হইতে হয়। দেশে গিয়া এক মাস সাবধানে থাকিয়া তবে তাঁহার শরীর সারে।
যাঁহারা তাঁহার আশ্রয়ে থাকিতেন তাঁহাদের প্রতি লাহিড়ী মহাশয়ের স্নেহ যত্নের পরিসীমা ছিল না। কালীচরণ লাহিড়ী মহাশয় উত্তরকালে বন্ধুবান্ধবকে একটী ঘটনার কথা সর্ব্বদা বলিতেন, এবং বলিবার সময়ে তাঁহার চক্ষু জলে পূর্ণ হইত। একবার পরীক্ষার কয়েক মাস পূর্ব্বে কালীচরণ বাবুর চক্ষে এক প্রকার পীড়া হয়, যেজন্য তাঁহাকে চক্ষুদ্বয় ব্যবহার করিতে নিষেধ করিয়া দেওয়া হয়। পরীক্ষা সন্নিকট, অথচ পড়িতে নিষেধ, এই সঙ্কটে ভ্রাতৃবংসল রামতনু বাবু এক উপায় অবলম্বন করিলেন। তিনি প্রতিদিন কালেজ হইতে পড়াইয়া আসিয়া ঘণ্টার পর ঘণ্টা কালীচরণের শষ্যাপার্শ্বে বসিয়া তাঁহার পাঠ্য সমুদয় গ্রন্থ পড়িয়া শুনাইতেন; ক্লাস্তি বোধ করিতেন না। এইরূপে কালীচরণ বাবু পরীক্ষাতে উত্তীর্ণ হইতে সমর্থ হইয়াছিলেন।
এই সময়ের আর একটা স্মরণীয় ঘটনা, তাহার জ্যেষ্ঠ সহোদর কেশব চন্দ্রের যশোহর গমন। কেশব জজের শেরেস্তাদারের পদে উন্নীত হইয়া আলিপুর হইতে যশোহরে গমন করেন। ঠিক কোন সালে যশোহর গিয়াছিলেন তাহা জানা যার না; কিন্তু সেখানে গিয়া অধিক দিন সুখে যাপন করিতে পারেন নাই। এরূপ শোনা যায়, তিনি সেখানে গিয়া অল্পদিন পরেই ম্যালেরিয়া জ্বরে আক্রান্ত হইয়া নিজের কার্ষ্যের সাহায্যার্থ রাধাবিলাসকে যশোহরে লইয়া যান। ১৮৩৫ কি ১৮৩৬ সালে যশোহরে ম্যালেরিয়া জ্বর প্রথম দেখা দেয়। অতএব তিনি ১৮৩৪ কি ১৮৩৫ সালে সেখানে গিয়া থাকিবেন।
যশোহরে ম্যালেরিয়া জ্বরের প্রথম প্রাদুর্ভাবের ইতিবৃত্ত এই যে ১৮৩৫ কি ১৮৩৬ সালের শীতকালে পাঁচ শত কি সাত শত কয়েদী যশোহরের সন্নিকটে একটা রাস্তা নির্ম্মাণ কার্য্যে নিযুক্ত ছিল। ঐ রাস্তাটা যশোহর হইতে মহম্মদপুর দিয়া ঢাকার অভিমুখে যাইবে এইরূপ স্থির ছিল। মহম্মদপুরে নদীর অপর পারের কাজ শেষ হইলে, পৱ বৎসর জানুয়ারি মাসে কয়েদগণ নদী পার হইয়া মহম্মদপুরের পারে কাজ আরম্ভ করিল। তাহারা রামসাগর ও হরেকৃষ্ণপুরের মধ্যস্থিত রাস্তা প্রস্তুত করিতেছে, এমন সময়ে মার্চ মাসে হঠাৎ তাহাদের মধ্যে এক প্রকার জ্বর দেখা দিল; এবং অল্পদিনেই প্রায় দেড়শত মজুরের মৃত্যু হইল। যাহার মজুর খাটাইতেছিল তাহারা প্রাণ ভয়ে, কাজ ছাড়িয়া পলাইল; রাস্তা নির্ম্মাণ পড়িয়া রহিল। ঐ জ্বর ক্রমে মহম্মদপুর নগরে ও যশোহরে প্রবেশ করিয়া সহর নিঃশেষ করিতে লাগিল। এই জ্বরই কয়েক বৎসরের মধ্যে নদীয়া জেলাতে প্রবেশ করিয়া উলা (বীরনগর) গ্রামকে উৎসন্ন করিয়া দিল। পরে গঙ্গাপার হইয়া হুগলী বৰ্দ্ধমান প্রভৃতিকেও উৎসন্ন করিয়াছে।
এই ম্যালেরিয়া জ্বরে অগ্রে রাধাবিলাসের প্রাণ গেল; পরে কেশবচন্দ্রও তাহাতে আক্রান্ত হইলেন। তিনি শেরেস্তাদারি কর্ম্ম পাইয়াই পৈতৃক বাসভবনের শ্রীবৃদ্ধি ও পিতামাতার আর্থিক অবস্থার উন্নতি সাধনে প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন। কিন্তু সে সংকল্প সম্পূর্ণরূপে চরিতার্থ করিবার পূর্বেই তাঁহাকে ভবধাম পরিত্যাগ করিতে হইল। তিনি অনেক দিন জ্বরে ভুগিয়া অনুমান ১৮৪১ কি ১৮৪২ সালে পরলোক গমন করেন।
কিন্তু লাহিড়ী মহাশয় যখন এই সকল পারিবারিক ঘটনার মধ্যে আন্দোলিত হইতেছিলেন, তখন নানা কারণের সমাবেশ হইয়া সমগ্র বঙ্গসমাজকে বিশেষরূপে আন্দোলিত করিতেছিল। এই কালকে ইংরাজী-শিক্ষার প্রতিষ্ঠা কাল বলা যাইতে পারে। কথা উঠিয়াছিল এদেশীয়দিগকে কোন রীতিতে শিক্ষা দেওয়া যায়, প্রাচ্য কি প্রতীচ্য? এই প্রশ্ন লইয়া কমিটী অব পবলিক ইনষ্ট্রক্শনের সভ্যগণের মধ্যে ঘোর বিবাদ উপস্থিত হইয়াছিল। উভয়দলেই প্রায় সম-সংখ্যক ব্যক্তি, সুতরাং কোন মতই নিশ্চিতরূপে স্থিরীকৃত হয় না; কাজকর্ম্ম একপ্রকার বন্ধ হইয়া গেল। প্রাচ্যশিক্ষা পক্ষপাতীদিগের পরামর্শানুসারে বৃত্তি দিয়া সংস্কৃত কলেজে ও মাদ্রাসাতে ছাত্র আকৃষ্ট করা হইতে লাগিল, সংস্কৃত ও আরবী গ্রন্থ সকল মুদ্রিত করিয়া স্তূপাকার বন্ধ রাখা হইতে লাগিল; দেশপ্রসিদ্ধ পণ্ডিত ও মৌলবীদিগকে আনিয়া উক্ত কালেজদ্বয়ে প্রতিষ্ঠা করা হইতে লাগিল; তথাপি প্রাচ্য শিক্ষা সম্বন্ধে দেশের লোকের অনুরাগ দৃষ্ট হইল না। “ইংরাজী শিক্ষা চাই, ইংরাজী শিক্ষা চাই” এই রব যেন দেশের সর্ব্বত্র ধ্বনিত হইতেছিল। ইংরাজী শিক্ষা প্রচলনের জন্য সংস্কৃত কালেজের ছাত্রগণ শিক্ষা কমিটীর নিকট এক দরখাস্ত প্রেরণ করিল। কিন্তু পূর্ব্বোক্ত কারণে সকল প্রশ্নই বন্ধ রহিল। ১৮৩৪ সালে লর্ড উইলিয়াম বেণ্টিঙ্ক রামমোহন রায়ের বন্ধু মিষ্টর উইলিয়াম এডামকে দেশীয় শিক্ষার অবস্থা পরিদর্শন করিবার জন্য নিযুক্ত করিলেন। তিনি ভিন্ন ভিন্ন জেলাতে, ভ্রমণ করিয়া বিবরণ সংগ্রহ করিতে লাগিলেন। ওদিকে সুবিখ্যািত লর্ড মেকলে আসিয়া বিবাদক্ষেত্রে অবতীর্ণ হইলেন। তিনি গবর্ণর জেনেরালের প্রথম ব্যবস্থাসচিবরূপে নিযুক্ত হইয়া এদেশে আসিলেন। তাঁহাকে পাইয়া লর্ড উইলিয়াম বেটিঙ্ক যেন দক্ষিণ হস্ত পাইলেন।
কোর্ট অব ডাইরেক্টারস্দিগের ১৮১৩ সালের শিক্ষাসম্বন্ধীয় আদেশ ইংরাজী শিক্ষা সম্বন্ধে খাটে কি না, জানিবার জন্য ঐ নির্দ্ধারণ পত্র নূতন ব্যবস্থা-সচিব মেকলের বিচারার্থ অৰ্পণ করা হইল। মেকলে বিশেষ বিবেচনা করিয়া ১৮৩৫ সাল ২রা ফেব্রুয়ারি দিবসে এক সুযুক্তিপূর্ণ মন্তব্য পত্র লিপিবদ্ধ করিলেন। সেই মন্তব্যপত্রের উপসংহারে লিখিলেন;
“To sum up what I have said: I think it clear that we are not fettered by any pledge expressed or implied; that we are free to employ our funds as we choose; that we ought to employ them to teaching what is best worth knowing; that English is better worth knowing than Sanskrit or Arabic; that the natives are desirous to be taught English and are not desirous to be taught Sanskrit or Arabic; that, neither as the language of law nor as the language of religion, have the Sanskrit and Arabic any peculiar claim to our encouragement; that it is possible to make natives of this country thoroughly good English scholars; and that to this end our efforts ought to be directed.”
মেকলের পৃষ্ঠপোষকতা পাইয়া লর্ড উইলিয়াম বেটিঙ্ক মহোদয় সাহসের সহিত কার্য্যক্ষেত্রে অগ্রসর হইলেন। ঐ বৎসরের ৭ই মার্চ দিবসে তিনি এক বিধি প্রচার করিলেন, তাহাতে এই আদেশ করিলেন যে,—১৮১৩ সালে কোর্ট অব ডাইরেক্টারগণ যে লক্ষ টাকা এদেশীয়দিগের শিক্ষার জন্য ব্যয় করিতে আদেশ করিয়াছিলেন, এবং যাহা সে সময় পর্যন্ত প্রধানতঃ প্রাচ্য শিক্ষার উন্নতিবিধানে ব্যবহৃত হইতেছিল, তাহা অনন্তর কেবল “ইউরোপীয় সাহিত্য-বিজ্ঞানাদি শিক্ষার জন্য বায়িত হইবে, এবং ইংরাজী ভাষাতেই সে শিক্ষা দেওয়া হইবে।”
এই আদেশ প্রচার হইবামাত্র কমিট অব পাবলিক ইন্ষ্ট্রাক্শনের মধ্যে ঘোর বিপ্লব উপস্থিত হইল। প্রাচ্য ও প্রতীচ্য শিক্ষা পক্ষপাতীদিগের মধ্যে বহুদিন যে বিবাদ চলিতেছিল, তাহা ঘোরতর ব্যক্তিগত বিদ্বেষে পরিণত হইয়া পড়িল। প্রাচ্য-শিক্ষা পক্ষীয়গণ মেকলের সুযুক্তিপূর্ণ মন্তব্যপত্রের উত্তর দিতে পারিলেন না; পরন্তু মেকলের প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ হইয়া গেলেন। তাহার একটু কারণও ছিল। মেকলেকে যাঁহারা জানেন, তাঁহারা জানেন যে; মেকলে মৃদুভাবে আপনার মত প্রকাশ করিবার লোক, ছিলেন না। তিনি ঐ মন্তব্য পত্রেরই একস্থানে লিখিয়াছিলেন;—“
“I have no knowledge of either Sanskrit or Arabic. But I have done what I could to form a correct estimate of their values, I have read translations of the most celebrated Ara bic and Sanskrit works. I have conversed both here and at home with men distinguished by their proficiency in Eastern tongues. I am quite ready to take the oriental learning at the valuation of the orientalists themselves. I have never found one among them, who could deny that a single shelf of a good European library was worth the whole native literature of India and Arabia.”
“এক শেল্ফ ইউরোপীয় গ্রন্থে যে জ্ঞানের কথা আছে, সমুদয় ভারতবর্ষ ও আরবদেশের সাহিত্যে তাহা নাই”—এই কথাটা প্রাচ্য শিক্ষা-পক্ষীয়দিগের গাত্রে তপ্তজলের ছড়ার ন্যায় পড়িল। তাঁহারা ক্ষেপিয়া আগুন হইয়া গেলেন। পাবলিক ইনষ্ট্রাক্শন কমিটীর সভাপতি মেঃ সেক্সপিয়ার ও সেক্রেটারি মেঃ জেম্স প্রিন্সেপ পদত্যাগ করিলেন। গভর্ণর জেনারেল মেকলেকে উক্ত কমিটীর সভাপতির পদে বরণ করিলেন। এদেশীয়দিগের শিক্ষা সম্বন্ধে মেকলের রাজ্য আরম্ভ হইল।
বলা বাহুল্য, কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, রসিককৃষ্ণ মল্লিক, রামগোপাল ঘোষ, তারাচাঁদ চক্রবর্ত্তী, শিবচন্দ্র দেব, প্যারীচাঁদ মিত্র, রামতনু লাহিড়ী প্রভৃতি হিন্দুকালেজ হইতে নবোর্ত্তীর্ণ যুবকদল সর্ব্বাস্তঃকরণের সহিত মেকলের শিষ্যত্ব গ্রহণ করিলেন। তাঁহারা যে কেবল ইংরাজী শিক্ষার পক্ষপাতী হইয়া সর্ব্বত্র ইংরাজী শিক্ষা প্রচলনের চেষ্টা করিতে লাগিলেন তাহা নহে, তাহারাও মেকলের ধূয়া ধরিলেন। বলিতে লাগিলেন, যে,—এক সেলফ ইংরাজী গ্রন্থে যে জ্ঞানের কথা আছে, সমগ্র ভারতবর্ষ বা আরবদেশের সাহিত্যে তাহা নাই। তদবধি ইহাদের দল হইতে কালিদাস সরিয়া পড়িলেন, সেক্সপিয়ার সে স্থানে প্রতিষ্ঠিত হইলেন; মহাভারত, রামায়ণাদির নীতির উপদেশ অধঃকৃত হইয়া Edgeworth's Tales সেই স্থানে আসিল; বাইবেলের সমক্ষে বেদ বেদান্ত গীত প্রভৃতি দাঁড়াইতে পারিল না।
মানুষ ষে আলোক পায় তদনুসারেই যদি চলে তবেই তাহার প্রশংসা। আমরা এক্ষণে এই যুবকদলের অতিরিক্ত প্রতীচ্য-পক্ষপাতিতার অনুমোদন করিতে পারি না সত্য, কিন্তু তাঁহারা যে অকপটচিত্তে স্বীয় স্বীয় হৃদয়ের আলোক অনুসারে চলিবার প্রয়াস পাইয়াছিলেন তাহার প্রশংসা না করিয়া থাকিতে পারি না। নব্যবঙ্গের তিন প্রধান দীক্ষাগুরুর হস্তে তাঁহাদের দীক্ষা হইয়াছিল। প্রথম দীক্ষাগুরু ডেভিড হেয়ার, দ্বিতীয় দীক্ষাগুরু ডিরোজিও, তৃতীয় দীক্ষাগুরু মেকলে। তিন জনই তাঁহাদিগকে একই ধূয়া ধরাইরা দিলেন;—প্রাচীতে যাহা কিছু আছে তাহা হেয়, এবং প্রতীচীতে যাহা আছে তাহাই শ্রেয়ঃ। এই অতিরিক্ত প্রতীচ্য-পক্ষপাতিতার ঝোঁকে বঙ্গসমাজ বহুকাল ঢলিয়া আসিয়াছে। তাহার বিবরণ পরে প্রদত্ত হইবে।
রামগোপাল ঘোষের ভবনে এই যুবকদলের এক আড্ডা ছিল। তাঁহার বন্ধুগণের মধ্যে রামতনু লাহিড়ী তাঁহার অতিশয় প্রিয় ছিলেন। লাহিড়ী মহাশয়কে তিনি আদর করিয়া “তনু” “তনু” বলিয়া ডকিতেন। প্রায় প্রত্যেক দিন সন্ধ্যাকালে লাহিড়ী মহাশয় প্রিয়বন্ধু রামগোপালের ভবনে যাইতেন; এবং অনেক দিন সেইখানে রাত্রি যাপন করিতেন। এই বন্ধুবর্গের সমাগমকাল অতি সুখেই কাটিত। মধ্যে মধ্যে শেরী শ্যাম্পেন চলিত বটে, কিন্তু সদ্গ্রন্থ পাঠ ও সৎপ্রসঙ্গেই অধিকাংশ সময় অতিবাহিত হইত। রামগোপাল ঘোষের দৈনিক লিপিতে দেখিতেছি যে এই যুবকদল একত্র সমবেত হইলেই কোন না কোন হিতকর প্রসঙ্গ উপস্থিত হইত ও সদালাপে সময় চলিয়া যাইত। সকলেরই মনে জ্ঞান-স্পৃহা অতিশয় উদ্দীপ্ত ছিল। পরস্পরের জ্ঞানোন্নতির জন্য তাঁহারা নানাবিধ উপায় অবলম্বন করিয়াছিলেন। তাহার কতকগুলি অগ্রে উল্লেখ করা গিয়াছে; যথা “জ্ঞানান্বেষণ” পত্রিকা। রসিককৃষ্ণ মল্লিক এই দ্বিভাষী পত্রিকায় প্রথম সম্পাদক ছিলেন। তিনি কর্ম্মস্থত্রে সহর পরিত্যাগ করিলে তাঁহার যুবক বন্ধুগণ তাঁহার সম্পাদনের ভার গ্রহণ করেন।
ডিরোজিওর মৃত্যুর পর “একাডেমিক এসোসিএশন” স্কোরের স্কুলে, উঠিয়া আসে। এই যুবকদল মহামতি হেয়ারকে তাঁহার সভাপতিরূপে বরণ করিয়া সভার কার্য্য চালাইতে থাকেন। দুঃখের বিষয় ১৮৪৩ সালের মধ্যে ঐ সভা উঠিয়া যায়। এই নব্যৱঙ্গের নেতৃগণ নিরুদ্যম না থাকিয়া, আপনাদের জ্ঞানোন্নতির জন্য নিজেদের মধ্যে একটী সার্কুলেটিং লাইব্রেরী ও একটা এপিষ্টোলারি এসোশিএশন স্থাপন করেন। লাইব্রেরী হইতে উংকৃষ্ট উংকৃষ্ট গ্রন্থ ক্রয় করিয়া বন্ধুগণের পাঠের জন্য বিতরণ করা হইত; এবং এপিষ্ট্রোলারি এসোসিএশনের যোগে কে কি পড়িলেন, সে বিষয়ে চিঠি পত্রে আলাপ হইত। রামগোপাল ঘোষ ও লাহিড়ী মহাশয় এই দুই কার্য্য প্রধানভাবে দেখিতেন। এই সকল ক্ষুদ্র চেষ্টা অবশেষে মহৎ ফল প্রসব করিল। ইঁহারা অনুভব করিতে লাগিলেন যে নিজেদের জ্ঞানোন্নতির জন্য একটা সভা স্থাপন করা আবশ্যক। তদনুসারে তারিণীচরণ বাঁড়ুয্যে, রামগোপাল ঘোষ, রামতনু লাহিড়ী, তারাচাঁদ চক্রবর্ত্তী ও রাজকৃষ্ণ দে, এই কয়েকজনে স্বাক্ষর করিয়া ১৮৩৮ সালের ২০শে ফেব্রুরারি দিবসে এক অনুষ্ঠান-পত্র বাহির করিলেন। তাহাতে এক নূতন সভার প্রস্তাব করিয়া বলা হইল যে সর্ব্ববিধ জ্ঞান উপার্জ্জনে পরম্পরের সহায়তা করা ও পরস্পরের মধ্যে প্রতিবদ্ধন করা উক্ত সভার উদ্দেশ্য। এই অনুষ্ঠানপত্রের মধ্যে উল্লেখযোগ্য অপর কথা এই তাঁহারা প্রস্তাব করিলেন যে এই নিয়ম করা উচিত যে যিনি বক্তৃতা দিব বলিয়া সমুচিত কারণ ভিন্ন বক্তৃতা না দিবেন, তাঁহাকে জরিমানা দিতে হইবে। এরূপ নিয়ম কোনও সভাতে পূর্ব্বে দেখা যায় নাই। ইহাতেই বুঝা যাইতেছে তাঁহারা কিরূপ চিত্তের একাগ্রতার সহিত উক্ত কার্য্য আরম্ভ করিরাছিলেন। সংস্কৃত কালেজের তদনীন্তন সেক্রেটারী রাম কমল সেন মহাশয়ের নিকট হইতে উক্ত কলেজের হল চাহিয়া লইয়া সেখানে নবাশিক্ষিত দলের এক সভা আহবান করা হইল। উক্ত আহবানানুসারে ১২ই মার্চ দিবসে ঐ হলে উক্ত সভার অধিবেঃন হয়। সেই সভাতে তারাচাঁদ চক্রবর্ত্তীকে সভাপতি করিয়া “Society for the Acquisition of General Knowledge, অর্থাৎ “জ্ঞানাৰ্জ্জনসভা” নামে এক সভা স্থাপিত হয়। ঐসভা কয়েকবৎসর জীবিত থাকিয়া যুবক সভ্যগণের জ্ঞানবৃদ্ধির বিশেষ সহায়তা করিয়াছিল। ঐ সভাতে কিরূপ বিষয় সকলের আলোচনা হইত, তাহার ভাব পাঠকগণের গোচর করিবার জন্য কয়েকজন বক্তার ও তাঁহাদের আলোচিত বিষয়ের নাম উদ্ধৃত করিতেছিঃ—
K. M. Banerjea—Reform—civil and social—among educated natives.
Hurro Chunder Ghose—Topographical and statistical sketch of Bankurah.
Mahesh Chunder Deb—Condition of Hindu women.
Govind Ch. Sen—Brief outline of the History of Hindustan.
Govind Ch. Bysak—Descriptive notices of Chittagong.
Peary Chandra Mitra—State of Hindustan under the Hindus.
Govind Ch. Bysak—Descriptive notices of Tipperah.
Prosonno Kumar Mitra—The Physiology of Dissection, এই সভা সম্বন্ধে একটা স্মরণীয় ঘটনা আছে। তারাচাঁদ চক্রবর্ত্তী এই সভার একজন প্রধান উৎসাহী সভ্য ছিলেন। একদিন দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়ের এক বক্তৃতাতে প্রসিদ্ধ ডি, এল, রিচার্ডসন সাহেব উপস্থিত ছিলেন। তিনি রাজনীতিতে টোরীদলভুক্ত লোক ছিলেন। যুবকদলের অতিরিক্ত স্বাধীন চিন্তা তাঁহার ভাল লাগিত না। তিনি উক্ত বক্তৃতাতে বিরক্ত হইয়া তাহা থামাইয়া দেন; এবং এই যুবকদলকে চক্রবর্ত্তী ফ্যাকশন, (Chuckerbutty Faction) বলিয়া ডাকিতে আরম্ভ করেন। ১৮৪৩ সালে যখন জর্জ টমসন এদেশে আসেন তখন ইঁহারা চক্রবর্ত্তী ফ্যাকশন নামে প্রসিদ্ধ।
বক্তাদিগের মধ্যে প্রসন্ন কুমার মিত্র এই সময়কার নব-প্রতিষ্ঠিত মেডিকেল কলেজের প্রথম ছাত্রদলের মধ্যে একজন বিশেষ লব্ধপ্রতিষ্ঠ ব্যক্তি ছিলেন। ইংরাজী শিক্ষা প্রচলনের ন্যায় মেডিকেল কলেজ স্থাপনও এই সময়কার একটা প্রধান ঘটনা। অগ্রে এদেশীয়দিগকে চিকিৎসা বিদ্যা শিক্ষা দিবার জন্য বিশেষ আয়োজন ছিল না। ইংরাজ ডাক্তারগণের সঙ্গে সঙ্গে এদেশীয় হস্পিটাল এসিষ্টাণ্ট প্রেরণ করা আবশ্যক হইত। তাই একদল এদেশীয় হস্পিষ্টাল এসিষ্টাণ্ট প্রস্তুত করিবার জন্য “মেডিকেল ইনষ্টিটিউশন” নামে একটা সামান্য বিদ্যালয় স্থাপিত হইয়াছিল। সেখানে হিন্দুস্থানী ভাষাতে ইংরাজী চিকিৎসা শাস্ত্রের কতকগুলি ঔষধ ও তাহার গুণাবলী বিষয়ে সপ্তাহের মধ্যে কয়েকদিন উপদেশ দেওয়া হইত মাত্র। ডাক্তার টাইটলার (Dr. Tytler) ঐ বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ ছিলেন। যে ১৮৩৪ সালের কথা বলিতেছি, তখন Dr. Ross ঐ বিদ্যালয়ে রসায়ন ও পদার্থবিদ্যার উপদেষ্টা ছিলেন। ছাত্রদিগকে তিনি যে উপদেশ দিতেন তাহাতে সোডার গুণ সর্ব্বদাই ব্যাখ্যা করিতেন। ফলতঃ বোধ হয় তিনি সোডা-তত্ত্ব ব্যতীত অপর পদার্থতত্ত্ব বড় অধিক জানিতেন না। যখন তখন সোডার মহিমা শুনিয়া শুনিয়া ছাত্রের এমনি বিরক্ত হইয়া গিয়াছিল যে তাহারা তাঁহার নাম সোডা রাখিয়াছিল! নব্যবঙ্গের নেতৃগণ এই সোডাকে লইয়া সর্ব্বদা কৌতুক করিতেন। কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় এই সময়ে প্রকাশ্য সংবাদপত্রে “Soda and his Pupils” এই শীর্ষক একট প্রবন্ধ- লিখিয়া ছিলেন। Dr. Tytler একজন প্রাচ্যপক্ষপাতী ও উৎকেন্দ্র লোক ছিলেন। এদেশীয়দিগকে ইংরাজী ভাষাতে চিকিৎসাবিদ্যা শিখাইতে তাঁহার ইচ্ছা ছিল না। এই কারণে কর্ত্তমান মেডিকাল কলেজ স্থাপনের সময় তিনি বড় বাধা দিয়াছিলেন।
যাহা হউক সে সময়ে পূর্ব্বোল্লিখিত মেডিকেল ইনষ্টিটিউশন চিকিৎসা বিদ্যা শিক্ষার একমাত্র স্থান ছিল না। পাঠকগণ অগ্রেই জানিয়াছেন যে সংস্কৃতকালেজে চরক ও সুশ্রুতের শ্রেণী এবং মাদ্রাসাতে আবিসেন্নার শ্রেণী খুলিয়া দেশীয় বৈদ্যকশাস্ত্র শিক্ষা দিবার নিয়ম প্রবর্ত্তিত করা হইয়াছিল। মেডিকেল কালেজ স্থাপন পর্য্যন্ত এই নিয়ম প্রবর্ত্তিত ছিল। কিন্তু ইংরাজ রাজ্য বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে ইংরাজী প্রণালীতে শিক্ষিত চিকিৎসকের প্রয়োজন দিন দিন বৃদ্ধি পাইতে লাগিল। বিলাত হইতে বহু অর্থ দিয়া এত ডাক্তার আনা কঠিন বোধ হইতে লাগিল। সুতরাং কর্ত্তৃপক্ষ এদেশীয়দিগকে ইংরাজী প্রণালীতে চিকিৎসা বিদ্যা শিক্ষা দেওয়া আবশ্যক বোধ করিতে লাগিলেন। লর্ড উইলিয়াম বেটিঙ্কের প্রকৃতি এই ছিল যে তিনি সহজে কোনও নুতন পথে পা দিতে চাহিতেন না; কিন্তু কর্ত্তব্য একবার নির্দ্ধারিত হইলে, বীরের ন্যায় অকুতোভয়ে সে পথে দণ্ডায়মান হইতেন, তখন আর বাধা বিপত্তি গ্রাহ করিতেন না। তাঁহার চরিত্রের এই গুণের প্রমাণ মেডিকেল কালেজ স্থাপনেও পাওয়া গেল।
১৮৩৪ সালে লর্ড বেটিঙ্ক দেশীয় চিকিৎসা বিদ্যার অবস্থা অবগত হইবার জন্য সে সময়ের কতিপয় বিশিষ্ট ব্যক্তিকে লইয়া এক কমিশন নিয়োগ করিলেন। সুবিখ্যাত রামকমল সেন মহাশয় ঐ কমিশনের একজন সভ্য ছিলেন। সভ্যগণ নানা জনের সাক্ষ্য লইয়া ও নানা স্থান হইতে সংবাদ সংগ্রহ করিয়া এই সিদ্ধান্তে উপনীত হইলেন যে, এদেশীয়দিগকে ইউরোপীয় প্রণালীতে ইউরোপীয় চিকিৎসা শাস্ত্র শিক্ষা দিবার জন্য একটা মেডিকেল কালেজ স্থাপিত হওয়া আবশ্যক। তদনুসারে ১৮৩৫ সালের জুনমাসে মেডিকেল কলেজ খোলা হয়। ডাক্তার ব্রাম্লি (Dr. Bramley) ইহার প্রথম অধ্যক্ষ হন। তাঁহার মৃত্যু হইলে ১৮৩৭ সালে মহামতি হেয়ার ইহার সম্পাদক হন। তাঁহারই প্ররোচনাতে তাঁহার ছাত্র মধুসূদন গুপ্ত সর্ব্বপ্রথমে মৃতদেহব্যবচ্ছেদ করিবায় জন্য অগ্রসর হন। সে কালের লোকের মুখে শুনিয়াছি এই মৃতদেহ ব্যবচ্ছেদ লইয়া সে সময়ে তুমুল আন্দোলন উপস্থিত হইয়াছিল। বেটিঙ্ক মহোদয় সে সময়ে এ দেশে ছিলেন না। তৎপূর্ব্ববর্তী মার্চ মাসের শেষে তিনি কার্য্যভার ত্যাগ করিয়া স্বদেশে প্রত্যাবৃত্ত হন। লাহিড়ী মহাশয় হেয়ারের পরামর্শে তাঁহার কনিষ্ঠ ভ্রাতা কালীচরণকে ঐ কালেজে ভর্ত্তি করিয়া দেন এবং বিধিমতে তাঁহার সহায়তা করিতে প্রবৃত্ত হন। নব্যবঙ্গের নেতৃবৃন্দ শব-ব্যবচ্ছেদকারী ছাত্রগণকে রীতিমত উৎসাহ দিয়া এই নবপ্রতিষ্ঠিত কালেজকে সবল করিতে লাগিলেন। এই সময়ে আরও কতকগুলি শুভানুষ্ঠানের সুত্রপাত হয়, তাহার সহিত নব্যবঙ্গের নেতৃবৃন্দের অল্পাধিক পরিমাণে যোগ ছিল। তাহার কতকগুলির উল্লেখ করা যাইতেছে।
প্রথম, ১৮৩৪ সালে সহরের বড় বড় ইংরাজ ও বাঙ্গালী ভদ্রলোক সম্মিলিত হইয়া টাউনহলে মহাত্মা রাজা রামমোহন রায়ের জন্য এক সভা করেন। তাহাতে নব্যবঙ্গের অন্ততম নেতা রসিককৃষ্ণ মল্লিক একজন বক্তা ছিলেন। অতএব দেখা যাইতেছে ১৮৩৪ সাল হইতেই তাঁহারা সহরের বড় বড় কাজে হাত দিতে আরম্ভ করিয়াছিলেন।
দ্বিতীয়, ১৮৩৬ সালে কলিকাতাবাসী ইংরাজ ও ভদ্রলোকদিগের সাহায্যে বর্তমান “কলিকাতা পাবলিক লাইব্রেরি” স্থাপিত হয়। এই শুভানুষ্ঠান হওয়াতে ডিরোজিওর শিষ্যদল আনন্দে প্রফুল্লিত হইয়া উঠিলেন এবং সর্ব্বদা লাইব্রেরিতে গতায়াত ও পাঠ করিতে আরম্ভ করিলেন। সেই দলের অন্যতম সভ্য প্যারীচাঁদ মিত্র লাইব্রেরির প্রথম দেশীর কর্ম্মচারীরূপে নিযুক্ত হইলেন। ইহাই তাঁহার ভবিষ্যতের সর্ব্ববিধ উন্নতির কারণ হইল। ১৮৪৪ সালে লর্ড মেটকাফের স্মরণার্থ বর্ত্তমান মেটকাফ হল নির্ম্মিত হইলে উক্ত লাইব্রেরি সেখানে উঠিয়া আসে।
তৃতীয় শুভানুষ্ঠান ইংলণ্ডে ব্রিটিশ ইণ্ডিয়া সোসাইটী স্থাপন। রামমোহন রায়ের বন্ধু আডাম সাহেবের সহিত এই যুবকদলের বড় মিত্রতা ছিল। রামমোহন রায়ের মৃত্যুর পর তিনি ইহাদের সঙ্গে মিশিয়া অনেক কাজ করিতেন। তাঁহার ভবনে মধ্যে মধ্যে যুবকদলের সন্মিলন হইত। আডাম ঠিক কোন সালে স্বদেশে ফিরিয়াছিলেন তাহা বলিতে পারি না। কিন্তু তিনি ইংলণ্ডে গিয়াও ভারতবর্ষকে বিস্মৃত হইতে পারেন নাই। ১৮৩৯ সালের জুলাই মাসে, প্রধানতঃ. তাঁহারই উদ্যোগে, ইলেণ্ডে ব্রিটিশ ইণ্ডিয়া সোসাইটী নামে একটী সভা স্থাপিত হয়। ভারতবাসীর সুখ দুঃখ ইংলণ্ডের লোকের গোচর করা তাঁহার উদ্দেশ্য ছিল। এই সভা জর্জ টমসন, উইলিয়াম এডনিস, মেজর জেনারেল ব্রিগ্স্থ প্রভৃতিকে নিযুক্ত করিয়া ইংলণ্ডের নানাস্থানে ভারতবর্ষ বিষয়ে বক্তৃতা দেওয়াইতে আরম্ভ করেন; এবং ১৮৪১ সালে British Indian Advocate নামে এক মাসিক পত্রিকা বাহির করেন। এডাম সাহেব তাহার সম্পাদক হন। এই সভা স্থাপিত হইলেই রামগোপাল ঘোষ প্রভৃতি পত্রযোগে আডামকে উৎসাহ দিতে আরম্ভ করিলেন এবং বোধ হয় প্রচুর অর্থ সাহায্য করিতেও ক্রটী করেন নাই।
চতুর্থ অনুষ্ঠান বাঙ্গালা পাঠশালা স্থাপন। দেশে ইংরাজী শিক্ষা প্রচলিত হইলে এবং হিন্দুকালেজের উন্নতি হইলে, কালেজ কমিটী অনুভব করিতে লাগিলেন যে তাঁহাদের শিশুশিক্ষা শ্রেণীটী স্বতন্ত্র করিয়া একটী বাঙ্গালা পাঠশালা রূপে স্থাপন করিলে ভাল হয়। মহামতি হেয়ার এ বিষয়ে অতিশয় উৎসাহিত হইলেন এবং রামগোপাল ঘোষ প্রভৃতিকে ও উৎসাহিত করিয়া তুলিলেন। তাঁহাদের সকলের চেষ্টাতে ১৮৩৯ সালের ১৪ই জুন দিবসে বাঙ্গাল পাঠশালার গুহের ভিত্তি স্থাপিত হয়। হেয়ার ভিত্তি স্থাপন করেন এবং প্রসন্নকুমার ঠাকুর প্রভৃতি উপস্থিত ব্যক্তিগণ বক্তৃত করেন।
পঞ্চম অনুষ্ঠান মেকানিকাল ইনষ্টিটিউট নামে একটা বিদ্যালয় স্থাপন। সহরের বড় বড় ইংরাজ ও বাঙ্গালি ভদ্রলোকগণ উহার উদ্যোগী ছিলেন। ১৮৩৯ সালের প্রথম ভাগে টাউন হলে একটা মহাসভা হইয়া ঐ বিদ্যালয় স্থাপিত হইয়াছিল। এদেশীয়দিগকে শ্রমজাত শিল্প শিক্ষণ দেওয়া ঐ বিদ্যালয়ের উদ্দেশ্য ছিল। বিদ্যালয়টী মহাআড়ম্বর করিয়া আরম্ভ হইয়াছিল বটে, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ অধিক দিন টেকে নাই। নব্যবঙ্গের নেতৃবৃন্দ যে এ বিষয়ে উৎসাহী হইয়াছিলেন তাহাতে সন্দেহ নাই। এই কালের উল্লেখযোগ্য সর্ব্বপ্রধান ও সর্ব্বশেষ অনুষ্ঠান মুদ্রাষন্ত্রের স্বাধীনতা প্রদান। এই মহাকার্য্যে যুবকদলের প্রধান হাত ছিল। তাঁহারা ইহার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন, এবং মুদ্রাষন্ত্রের স্বাধীনতা প্রদানের পূর্ব্বে এই ১৮৩৪ সালের ৫ই জানুয়ারি দিবসে গবর্ণমেণ্টের নিকটে আবেদন করিবার জন্য যে সভা হয়, তাহাতে রসিককৃষ্ণ মল্লিক একজন বক্তা ছিলেন। সুতরাং সে আন্দোলনে নব্যবঙ্গের নেতৃবৃন্দ সম্পূর্ণ যোগ দিয়াছিলেন। এই মুদ্রাষন্ত্রের স্বাধীনতার ইতিবৃত্ত একটি জ্ঞাতব্য বিষয়।
১৭৮৭ সালে সর্ব্ব প্রথমে “হিকীয় গেজেট” (Hickey's Gazette) নামে একখানি ইংরাজ-সম্পাদিত সংবাদপত্র বাহির হয়। তৎপরেই বেঙ্গল জর্ণাল (Bengal Journal) আর একখানি কাগজ প্রকাশিত হয়। এই দুই খানিতেই এরূপ অভদ্র ভাষা ব্যবহৃত হইত যে, ১৭৯৪ সালে কোম্পানির কর্তৃপক্ষ বেঙ্গল জর্নালের সম্পাদক মেং উইলিয়াম ডুইএনকে (W. Duane) ধরিয়া বন্দী করিয়া স্বদেশে প্রেরণ করিতে বাধ্য হন। তৎপরে কিছুদিন যায়। পরে যখন টিপু সুলতানের সহিত যুদ্ধ বাঁধে এবং সেই যুদ্ধ সম্বন্ধে ইংরাজদের মধ্যে মতভেদ উপস্থিত হয়, তখন গবর্ণর জেনেরাল লর্ড ওয়েলেসলি বিধিমতে সংবাদ পত্র পরীক্ষার রীতি (Censorship) স্থাপন করেন। এই বিধি অনুসারে প্রত্যেক প্রবন্ধ গবর্ণমেণ্টের নিযুক্ত কর্ম্মচারীকে দেখাইয়া মুদ্রিত করিতে হইত। ১৮১৩ সালে এই নিয়মকে আরও কঠিন করা হয়। ১৮১৮ সালে লর্ড হেষ্টিংস এই নিয়ম এক প্রকার রহিত করেন। তাহার ফলস্বরূপ নুতন নূতন কাগজ দেখা দেয়। তন্মধ্যে এই ১৮১৮ সালে কলিকাতা জর্ণাল (Calcutta Journal) নামে এক কাগজ বাহির হয়। বকিংহাম (Buckingham) নামক একজন ইংরাজ তাহার সম্পাদক ও স্যাণ্ডফোর্ড, আর্ণট (Sandford Arnot) নামে একজন ইংরাজ সহকারী সম্পাদক নিযুক্ত হন। তদানীন্তন গবর্ণমেণ্টের ইংরাজ কর্ম্মচারিগণ সংবাদপত্রের সমালোচনা দ্বারা উত্তেজিত হইয়া লর্ড হেষ্টিংসকে মুদ্রাযন্ত্রের শাসনের জন্য বার বার উত্তেজিত করিতে থাকেন; কিন্তু সেই উদারনৈতিক রাজপুরুষ তাহাতে কর্ণপাত করিতেন না। এই পরামর্শদাতাদিগের মধ্যে একজন ছিলেন জন এডাম, ইনি পরে কিছুকালের জন্য গবর্ণর জেনেরালের পদে উন্নীত হইয়াছিলেন।
১৮২৩ সালে যখন জন এডাম গবর্ণর জেনেরালের পদে প্রতিষ্ঠিত, তখন সংবাদপত্রের স্বাধীনতা লইয়া আবার গোলযোগ উঠে। ডাক্তার ব্রাইস, (Dr. Bryce) নামক গবর্ণমেণ্টের নিযুক্ত একজন কর্ম্মচারীকে আক্রমণ করাতে গবর্ণর জেনেরাল কলিকাতা জর্ণাল নামক পত্রেয় সম্পাদক বকিংহাম সাহেবকে দুই মাসের মধ্যে ভারত ত্যাগ করিতে আদেশ করেন। ইহার কিছুদিন পরে ঐ পত্রের সহকারী সম্পাদক (Sandford Arnot) কে ধরিয়া অব্যবহিত পরগামী জাহাজে তুলিয়া বিলাতে রওয়ানা করা হয়। ইহার পরেই এই প্রশ্ন উঠে, ইংরাজকে যেন স্বদেশে ফিরিয়া পাঠান হইল, কিন্তু ইদ্রুঁস, পিদ্রুঁস, বা গমিস নামক কোনও ফিরিঙ্গী সম্পাদক ঐরূপ অপরাধ করিলে কি করা হইবে? তাহাকে কি গবর্ণমেণ্টের ব্যয়ে বিলাত দেখাইয়া আনা হইবে? এই সংকট মোচনের উদ্দেশে এডাম মুদ্রা যন্ত্রের শাসনার্থ তাড়াতাড়ি এক কড়া আইন প্রণয়ন করেন; এবং তদানীন্তন সুপ্রিম কোর্টের দ্বারা অনুমোদিত করাইয়া লন। যখন এই নুতন বিধি প্রণীত হয় তখন রামমোহন রায় মুদ্রাযন্ত্রের স্বাধীনতা লোপ হইতেছে দেখিয়া স্বদেশবাসৗদিগকে এই নুতন রাজবিধির বিরুদ্ধে উত্থিত করিবার চেষ্টা করেন। তাহাতে অকৃতকার্য্য হইয়া অবশেষে তিনি ও দ্বারকানাথ ঠাকুর মিলিয়া বারিষ্টারের সাহায্যে, সুপ্রিমকোর্টে বিচার উপস্থিত করেন; এবং যাহাতে সুপ্রিমকোর্টের অনুমোদিত না হয় তাহার চেষ্টা করেন। সেখানে অকৃতকার্য্য হইয়া ইংলণ্ডাধিপতির নিকট এক আবেদন প্রেরণ করেন। কিছুতেই কিছু হয় নাই।
তৎপরে লর্ড উইলিয়াম বেটিঙ্ক মহোদয় যখন রাজ্যভার গ্রহণ করেন, এবং ইংলণ্ডের কর্তৃপক্ষের আদেশানুসারে সাহসের সহিত সৈন্যবিভাগের বাটার হ্রাস করিতে প্রবৃত্ত হন, তখন ইংরাজগণের মধ্যে তুমুল আন্দোলন উঠে। বেটিঙ্ক ইংরাজগণের অপ্রিয় হইয়া পড়েন। ইংরাজ সম্পাদিত সংবাদপত্র সকল তাঁহার প্রতি অতি অভদ্র গালাগালি বর্ষণ করিতে আরম্ভ করে। সে সময়ে অনেকে বেটিঙ্ক মহোদয়কে মুদ্রাযন্ত্রের শাসনের জন্য পরামর্শ দিয়ছিলেন; কিন্তু তিনি তদনুসারে কার্য্য করেন নাই। তাঁহার বিশ্বাস ছিল যে, ভারতবর্ষের ন্যায় বহুবিস্তীর্ণ সাম্রাজ্যকে সুশাসন করিতে গেলে মুদ্রাযন্ত্রের স্বাধীনতা একান্ত প্রয়োজনীয়। তিনি স্বাস্থ্যের হানিবশতঃ মুদ্রাযন্ত্রের স্বাধীনতা দিয়া যাইতে পারিলেন না। সে কার্য্যের ভার তাঁহার পরবর্তী গবর্ণর জেনেরাল লর্ড মেটকাফের জন্য রাখিয়া গেলেন। যে আইনের দ্বারা মুদ্রাযন্ত্রকে স্বাধীন করা হয়, তাহা লর্ড মেকলে প্রণয়ন করিয়াছিলেন। লর্ড মেটকাফের প্রশংসার্থ একথা বলা আবশ্যক যে মুদ্রাযন্ত্রের স্বাধীনতা প্রদান করাতে গবর্ণর জেনেরালের পদে প্রতিষ্ঠিত থাকা কঠিন হইবে, ইহা জানিয়াও তিনি ঐ সাহসের কার্য্যে অগ্রসর হইয়াছিলেন; এবং সত্যসত্যই তাহাই তাঁহার উক্ত পদে সুপ্রতিষ্ঠিত থাকিবার পথে অন্তরায় স্বরূপ হইয়াছিল। মুদ্রযন্ত্রের স্বাধীনতা-প্রদ আইন ১৮৩৫ সালের এপ্রিল মাসে প্রণীত হইয়া ১৫ই সেপ্টেম্বর হইতে জারি হয়।
মুদ্রাযন্ত্রের স্বাধীনতা ঘোষণা হইলেই বঙ্গ দেশে এক নবযুগের সুত্রপাত হইল। নূতন নুতন সংবাদপত্র সকল দেখা দিতে লাগিল; নবপ্রাপ্ত স্বাধীনতার ভাব সর্বশ্রেণীর মানুষের মনে প্রবিষ্ট হইয়া চিন্তা ও কার্য্যে এক নূতন তেজস্বিতা প্রবিষ্ট করিল; এবং সর্ব্বপ্রকার উন্নতিকর কার্য্যের উৎসাহ যেন দশগুণ বাড়িয়া গেল। সেই নব উৎসাহ ও নব উত্তেজনাতে ডিরোজিওর শিষ্যদল নানা বিভাগে নানা কার্য্যে প্রবৃত্ত হইলেন। বলা বাহুল্য যে এই সময়ে জুরি-বিচার প্রবর্ত্তিত করিবার জন্য, মরীশশ দ্বীপের কুলীদিগের প্রতি অত্যাচার নিবারণের জন্য ও মফঃস্বল আদালত সকলে ওকালতিতে পারস্যভাষার পরিবর্ত্তে ইংরাজী ভাষা প্রচলিত করিবার জন্য, হেয়ার যে সকল চেষ্টা করিয়াছিলেন, যুবকদল সে সকল বিষয়ে তাহার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন।
ক্রমে আমরা ১৮৪২ সালে উপস্থিত হইতেছি। ঐ সালের প্রারম্ভে সুপ্রসিদ্ধ দ্বারকানাথ ঠাকুর তাঁহার ভাগিনেয় চন্দ্রমোহন চট্টোপাধ্যায় ও তাহার প্রাইভেট সেক্রেটারি পরমানন্দ মৈত্রকে সঙ্গে লইয়া বিলাতযাত্রা করিলেন। মহাত্মা রাজা রামমোহন রায়ের পর দেশের বড়লোকদিগের মধ্যে এই প্রথম বিলাত-যাত্রা। তখন দ্বারকানাথ ঠাকুর কলিকাতার ভদ্র ও শিক্ষিত হিন্দুসমাজের সর্ব্বাগ্রগণ্য ব্যক্তি ছিলেন বলিলে অত্যুক্তি হয় না। সর্ব্ববিধ দেশহিতকর কার্য্যে এরূপ মুক্তহস্ত দাতা আর দেখা যায় নাই। ডিষ্ট্রক্ট চ্যারিটেবল সোসাইটী স্থাপন, মেডিকেল কালেজ হাঁসপাতাল নির্ম্মাণ প্রভৃতি কার্য্যের ন্যায় সাধারণের হিতকর অপরাপর অনুষ্ঠানেও তিনি অকাতরে সহস্ৰ সহস্র মুদা দান করিয়া গিয়াছেন। তাঁহার সদাশয়তার অনেক গল্প দেশে প্রচলিত আছে। সে সকলের উল্লেখ নিম্প্রয়োজন। তাঁহার সদাশয়তার একটা মাত্র নিদর্শন প্রদর্শন করা যাইতেছে। তিনি শৈশবে (Sherburne) শার্বয়ণ নামক যে ফিরিঙ্গী শিক্ষকের নিকট ইংরাজী শিক্ষা করিয়াছিলেন, শুনিতে পাওয়া যায় তাঁহার বাৰ্দ্ধক্য দশা পর্যন্ত চিরদিন তাঁহাকে প্রতিপালন করিয়াছিলেন। দ্বারকানাথের সদাশয়ত স্বদেশীয় বিদেশীয় গণনা করিত না; যেখানেই সাহায্যের প্রয়োজন সেইখানেই তাঁহার দক্ষিণ হস্ত প্রসারিত ছিল। এই সদাশয় মুক্তহস্ত পুরুষ যে শ্রেণীর লোকের প্রীতি ও শ্রদ্ধাভাজন হইবেন, তাহাতে বিচিত্র কি? তাহার ইংলণ্ড-গমন যে সর্ব্ব শ্রেণীর লোকের মধ্যে একটা আন্দোলন ও সমালোচনা উত্থিত করিয়াছিল তাহাতে সন্দেহ নাই। তিনি দেশে যেমন সম্মানিত ছিলেন, ইংলণ্ডেও সেইরূপ বহু সন্মান লাভ করিয়াছিলেন। সেখানে মহারাণী ভিক্টোরিয়া ও তাঁহার পতি প্রিন্স এলবার্ট, ফ্রান্সের রাজা ও রাণী প্রভৃতি সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিগণের বন্ধুতা লাভ করিয়াছিলেন। ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির কর্ত্তৃপক্ষও তাঁহার প্রতি সমান প্রদর্শন করিতে ক্রটী করেন নাই। বলিতে কি তিনি সর্ব্বত্রই রাজোচিত সম্ভ্রম প্রাপ্ত হইয়াছিলেন।
দ্বারকানাথ ঠাকুরের ইংলণ্ড-যাত্রার পর তৎপরবর্ত্তী এপ্রিল মাসে রাম গোপাল ঘোষ, প্যারীচাঁদ মিত্র প্রভৃতি সমবেত হইয়া বেঙ্গল স্পেক্টেটর (Bengal Spectator) নামে এক সংবাদপত্র বাহির করিলেন। এই পত্র ইংরাজী ও বাঙ্গালী দুই ভাষাতে লিখিত হইত এবং প্রথম প্রথম মাসে একবার প্রকাশিত হইত। এই পত্রে নব্য যুবকদল সাধ মিটাইয়া আপনাদের উদার মত সকল প্রচার করিতে লাগিলেন। এই পত্র ১৮৪৩ সালে মার্চ্চ মাস হইতে সাপ্তাহিক আকারে পরিণত হয়; পরে নবেম্বর হইতে সাহায্যাভাবে উঠিয়া যায়।
কিন্তু আর এক কারণে এই ১৮৪২ সাল বঙ্গদেশের পক্ষে চিরস্মরণীয় দুর্ব্বৎসর। ঐ বৎসরে মহামতি হেয়ার ভবধাম পরিত্যাগ করিলেন। সেকালের লোকের মুখে যখন তাঁহার মৃত্যুদিনের বিবরণ শ্রবণ করি তখন শরীর কণ্টকিত, চক্ষুদ্ধয় অশ্রুতে প্লাবিত, এবং হৃদয় ভক্তি ও কৃতজ্ঞতা রসে আপ্লুত হয়। পূর্ব্বে বলা হইয়াছে যে হেয়ার সাহেব আপনার ঘড়ির কারবার গ্রে (Grey) নামক তাঁহার এক বন্ধুকে বিক্রয় করিয়া তাঁহারই সঙ্গে বর্ত্তমান কয়লাঘাটের নিকটস্থ এক ভবনে বাস করিতেন। সেখানে ১৮৪২ সালের ৩১ শে মে দিবসে রাত্রি ১টার সময়ে তিনি হঠাৎ দারুণ ওলাউঠা রোগে আক্রান্ত হন। তিনি আমরণ কৌমার্য্য ব্রত ধারণ করিয়াছিলেন, সুতরাং সে সময়ে তাঁহার প্রিয় বেহারা ব্যতীত আর কেহ তাহার সঙ্গী ছিল না। দুই একবার দাস্ত ও বমন হওয়াতেই হেয়ার বুঝিলেন যে কালশক্র তাঁহাকে ধরিয়াছে। নিজের বেহরাকে বলিলেন—“গ্রে, সাহেবকে গিয়া আমার জন্য কফিন (শবাধার) আনাইতে বল”। প্রাতঃকালে ডাক্তার ডাকা হইল। তাঁহার প্রিয় ছাত্র মেডিকেল কলেজের উত্তীর্ণ সুযোগ্য ডাক্তার প্রসন্নকুমার মিত্র আসিয়া উপস্থিত হইলেন; এবং বিধিমতে তাঁহার প্রাণ রক্ষা করিবার চেষ্টা করিতে লাগিলেন। চিকিৎসা বিদ্যাতে যাহা হয়, ঔষধে যাহা করিতে পারে; বন্ধুজনের যত্ন, আগ্রহ ও চেষ্টাতে যাহা সম্ভব, কিছুই বাকি রহিল না। কিন্তু কিছুতেই রোগের উপশম হইল না। রোগ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাইতে লাগিল। তখন ওলাউঠা হইলে সর্ব্বাঙ্গে ব্রিষ্টার লাগাইত। তদনুসারে হেয়ারের গাত্রে ব্রিষ্টার দেওয়া হইয়াছিল। পরদিন অপরাহ্নে তিনি বীরভাবে প্রসন্ন মিত্রকে বলিলেন—"প্রসন্ন! আর ব্রিষ্টার দিও না; আমাকে শাস্তিতে মরিতে দেও”। এই বলিয়া জীবনের অবশিষ্ট কয়েক ঘণ্টা শান্তভাবে যাপন করিয়া ১লা জুন সন্ধ্যার প্রাক্কালে মানবলীলা সম্বরণ করিলেন। পরদিন প্রাতে হেয়ার চলিয়া গিয়াছেন এই সংবাদ কলিকাতা সহরে প্রচার হইলে উত্তরবিভাগে ঘরে ঘরে হায় হায় ধ্বনি উঠিল। তিনি যে সকল দরিদ্র পরিবারের পিতা মাতা ছিলেন, সেই সকল পরিবারে হিন্দুরমণীগণ আর্ত্তনাদ করিয়া ক্রন্দন করিতে লাগিলেন; তিনি যে সকল দরিদ্র বালককে পালন করিতেন, তাহারা কাঁদিতে কাঁদিতে গ্রে সাহেবের ভবনের অভিমুখে ছুটিল। গ্রে সাহেবের ভবনে ছোট বড় বাঙ্গালি ভদ্রলোকে লোকারণ্য! হিন্দুসমাজের শীর্ষস্থানীয় রাধাকান্ত দেব হইতে স্কুলের ছোট ছোট বালক পর্য্যন্ত কেহ আর আসিতে বাকি থাকিল না। কথা উঠিল তাঁহার সমাধি কোথার হইবে? তিনি খ্রীষ্টীয়ধর্ম্মে বিশ্বাসী ছিলেন না বলিয়া খ্রীষ্টীয় সমাধিক্ষেত্রে তাঁহার সমাধি লাভ করা কঠিন হইল। অবশেষে তাহারই প্রদত্ত, ও হিন্দুকালেজের সংলগ্ন, ভূমিখণ্ডে তাঁহাকে সমাহিত করা স্থির হইল। তাঁহার শব যখন গ্রে সাহেবের ভবন ত্যাগ করিল তখন গাড়ীতে ও পদব্রজে হাজার হাজার লোক সেই শবের সঙ্গে সঙ্গে চলিল। কলিকাতা সেদিন যে দৃশ্য দেখিয়াছিল তাহা আর দেখবে না! বহুবাজারের চৌরাস্তা হইতে মাধব দত্তের বাজার পর্য্যন্ত সমগ্র রাজপথ জনতার প্লাবনে নিমগ্ন হইয়া গেল। একদিকে সহরের পথে যেমন শোকের বন্যা, অপরদিকেও তেমনি আকাশ-ভাঙ্গিয়া পড়িল। মূষলধারে বৃষ্টি ও ঝড় হইতে লাগিল। মনে হইল দেবগণও প্রচুর অশ্রুবারি বর্ষণ করিতেছেন। এইরূপে সুরনরে মিলির হেয়ারের জন্য শোক করিলেন। হেয়ারকে সমাহিত করা হইল; ওদিকে প্রলয় ঝড়ে কলিকাতা সংর কাঁপিয়া গেল।
লাহিড়ী মহাশয় সেদিন প্রাণে কি আঘাত পাইলেন তাহা বলিবার নহে। যে হেয়ার: তাঁহার, পিতার কাজ করিয়াছিলেন, যে হেয়ার আপদে বিপদে তাঁহার সাহায্যের জন্য মুক্তহস্ত ছিলেন, যে হেয়ার কেবল তাঁহার নহে তাঁহার ভ্রাতাদেরও শিক্ষা বিষয়ে সহায়তা করিয়াছিলেন, যে হেয়ার তিনি পীড়িত হইলে মাতার ন্যায় আসিয়া রোগশয্যার পার্শ্বে বসিয়া থাকিয়াছেন, সেই হেয়ার চলিয়া গেলেন। আমরা সহজেই অনুমান করিতে পারি এ দারুণ শোক তাঁহার প্রাণে কিরূপ বাজিল। উত্তরকালে হেয়ারের নাম করিলেই তাঁহার চক্ষু অশ্রুতে সিক্ত হইত। শরীরে যত দিন চলিবার শক্তি ছিল, মৃত্যুর অব্যবহিত পূর্ব্বকাল পর্য্যস্ত, প্রতি বৎসর ১লা জুন হেয়ারের সমাধিক্ষেত্রের নিকটে গিয়া বন্ধুবান্ধবকে ডাকিয়া তাঁহার স্মরণার্থ সভা করিয়াছেন। উপকারীর প্রতি কৃত-জ্ঞতা ও সাধু-ভক্তি লাহিড়ী মহাশয়ের চরিত্রের দুইটা প্রধান গুণ ছিল।
কেবল যে রামতনু লাহিড়ী হেয়ারের শোকে শোকার্ত্ত হইলেন তাহা নহে, রামগোপাল প্রমুখ যৌবন-সুহৃদগণ ও সকলে সেই শোকে অধীর হইয়া পড়িলেন। সে সময়ে রামগোপাল ঘোষ, প্যারীচাঁদ মিত্র, তারাচাঁদ চক্রবর্ত্তী প্রভৃতি বেঙ্গল স্পেক্টেটরের সম্পাদন কার্য্যে নিযুক্ত ছিলেন। তাহাতে তাঁহার হেয়ারের জন্য শোক প্রকাশ করিয়া তাঁহার স্মৃতিচিহ্ন স্থাপনের প্রস্তাব করিলেন। তদনুসারে কাশিমবাজারের রাজা কৃষ্ণনাথ রায় এক সভা আহ্বান করিলেন। ১৭ই জুন মেডিকেল কলেজে ঐ সভার অধিবেশন হইল। তাহাতে হেয়ারের স্মৃতিচিহ্ন স্থাপনে জন্য এক কমিটী নিযুক্ত হইল। রামগোপাল ঘোষ ঐ কমিটীতে ছিলেন। এই কমিটীর চেষ্টাতে হেয়ারের এক সুন্দর, শ্বেত-প্রস্তর-নির্ম্মিত প্রতিমূর্ত্তি গঠিত হইল। তাহাই এক্ষণে প্রেসিডেন্সি কালেজ ও হেয়ার স্কুলের প্রাঙ্গণকে সুশোভিত করিতেছে।
১৮৪২ সালের শেষভাগে দ্বারকানাথ ঠাকুর ইংলণ্ড হইতে ফিরিয়া আসিলেন। তিনি ফিরিয়া আসিবার সময় স্বপ্রসিদ্ধ জর্জ্জ টমসনকে সঙ্গে করিয়া আসিলেন। ইঁহার মত বাগ্মী ও তেজস্বী লোক অল্পই এদেশে আসিয়াছেন। ইংলণ্ড ও আমেরিকাতে ক্রীতদাস প্রথার বিরুদ্ধে তিনি অগ্নিময় বক্তৃতা করিয়া আপনাকে যশস্বী করিয়াছিলেন। আমেরিকা হইতে ইংলণ্ডে ফিরিয়া আসিয়া তিনি মিষ্টর উইলিয়াম এডামের প্রতিষ্ঠিত ব্রিটিশ ইণ্ডিয়া সোসাইটীর সহিত যোগ দেন। সেই সূত্রে দ্বারকানাথ ঠাকুরের সহিত তাঁহার পরিচয় হয়। দ্বারকানাথ বাবু নিজ সহৃদয়তা ও দেশহিতৈষিতা গুণে, এদেশের লোকদিগকে উদ্বুদ্ধ করিবার মানসে, তাঁহাকে এখানে আনয়ন করেন।
জর্জ্জ টমসন এদেশে পদার্পণ করিবামাত্র নব্যবঙ্গের নেতৃবৃন্দ একেবারে আনন্দে উৎফুল্প হইয়া উঠিলেন। যেমন চুম্বুকে লোহা লাগিয়া যায়, তেমনি রামগোপাল ঘোষ, তারাচাঁদ চক্রবর্ত্তী, প্যারীচাঁদ মিত্র, প্রভৃতি জর্জ্জ টমসনের সহিত মিশিয়া গেলেন। নানা স্থানে নানা সভা সমিতিতে বক্তৃতা হইয়া অবশেষে কলিকাতার ফৌজদারী বালাখানা নামক স্থানে একটা ভবনে টমসনের বক্তৃতা আরম্ভ হইল; এরূপ বাগ্মিতা এদেশে কেহ কখনও শুনে নাই। সেই সময়ে বালাহিসারে ইংরাজদিগের যুদ্ধ চলিতেছিল। তাহার উল্লেখ করিয়া শ্রীরামপুরস্থ মিশনারি সম্পাদিত ফ্রেণ্ড অব ইণ্ডিয়া নামক সাপ্তাহিক পত্রের সম্পাদক একবার লিখিলেন—“এখন দুইদিকে ঘন ঘন কামানের ধ্বনি হইতেছে। পশ্চিমে বালাহিসারে ও পূর্ব্বে ফৌজদারী বালাখানাতে।” বাস্তবিক জর্জ্জ টমসনের বক্তৃতা সামরিক তোপধ্বনির ন্যায় উন্মাদকারিণী ছিল।
জর্জ্জ টমসনের বাগ্মিতার ফলস্বরূপ ১৮৪৩ সালের ২০শে এপ্রিল দিবসে, ইংলণ্ডের ব্রিটিশ ইণ্ডিস্থ সোসাইটির অনুকরণে কলিকাতাতেও বেঙ্গল ব্রিটিশ ইণ্ডিয়া সোসাইটি স্থাপিত হইল; শিক্ষিত যুবক দল একেবারে মাতিয়া উঠিলেন। লাহিড়ী মহাশয় ও তাঁহাদের পশ্চাতে পশ্চাতে ছিলেন তাহা বলা বাহুল্য মাত্র। পশ্চাতে পশ্চাতে এই জন্য বলিতেছি যে তাঁহার স্বভাব এই ছিল যে তিনি অধিক কথা কহিতেন না; সর্ব্বদা বিনয়ে মৌনী থাকিতেন; নিজের বয়স্যদিগকে অনেক বিষয়ে আপনার অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ বলিয়া মনে করিতেন; এবং সকলের মধ্যে মৌনী থাকিয়া উহাদের কথোপকথনের মধ্যে যাহা ভাল থাকিত তাহাই গ্রহণ করিতেন। তাঁহার বয়স্যগণের মধ্যে যখনি তাহাকে দেখি, দেখি তিনি মৌনী ও তিনি সকলের পশ্চাতে। এই স্বভাব-সুলভ বিনয় আমরা স্বচক্ষে দেখিয়াছি। তাঁহার এই স্বাভাবিক বিনয়ের প্রমাণ স্বরূপ ১৮৩৯ সালে লিখিত রামগোপাল ঘোষের দৈনিক লিপি হইতে কিয়দংশ উদ্ভূত করিতেছিঃ—
“20th Nov. 1839. In the evening Callachand, Peary, Ramtonoo, Ramchunder and were here to make arrangements for the conducting of Gnanaraweshan. It appeared from what tic two latter said, that it was a losing concern. This they never before gave me to understand, which they should have dune before calling the meeting. Every body spoke 'freely on the subject, with the exception of Tonoo, who was silent.”
পাঠকগণ দেখিতে পাইতেছেন, কোনও গুরুতর বিষয়ে আলোচনা করিবার জন্য বয়স্যগণের সম্মিলন হইলেই লাহিড়ী মহাশয় তন্মধ্যে থাকিতেন; তাঁহাকে বাদ দিয়া কোনও কাজ হইত না; কিন্তু তিনি অধিকাংশ সময় মৌনী থাকিতেন। ইহাতে কিছুমাত্র সন্দেহ নাই যে নবপ্রতিষ্ঠিত ব্রিটিশ ইণ্ডিয়া সোসাইটীর সভাতে গরম গরম বক্তৃতা করিয়া বয়স্যগণ যখন রামগোপালের ভবনে আসিয়া “ভারতের শুভদিন সন্নিকট” বলিয়া আনন্দ করিতেন এবং শ্যাম্পেনের বোতল খুলিয়া সে আনন্দের উপসংহার করিতেন, তখন লাহিড়ী মহাশয়ও তাঁহাদের সহিত পূর্ণমাত্রায় স্বদেশের নবযুগের আকাঙ্ক্ষা হৃদয়ে ধারণ করিতেন এবং সেই মহোল্লাসে যোগ দিতেন।
ফৌজদারী বালাখানাতে ব্রিটিশ ইণ্ডিয়া সোসাইটী স্থাপিত হইলে, সেই ভবনে যুবকদলের জ্ঞানার্জ্জন সভাও উঠিয়া আসিল। পুর্ব্বেই বলিয়াছি হিন্দুকালেজের অধ্যক্ষ ডি এল, রিচার্ডসন সাহেব দক্ষিণারঞ্জনের এক রাজনীতি সম্বন্ধীয় বক্তৃতা শুনিয়া বিরক্ত হইয়া এই যুবকদলের চক্রবর্তী ফ্যাকশন নাম দিয়াছিলেন। তাহার কারণ এই, তারাচাঁদ চক্রবর্ত্তী সে সময়ে “The Quill” নামে এক কাগজ বাহির করিতেন; তাহাতে রাজনীতি সম্বন্ধে গরম গরম প্রবন্ধ সকল বাহির হইত; এবং তারাচাঁদ ইহাদের দলের একজন অগ্রণী ছিলেন।
অনুমান ১৮০৪ সালে কলিকাতার যোড়াশাঁকো নামক স্থানে তারাচাঁদ চক্রবর্ত্তীর জন্ম হয়। ইনি বারেন্দ্রশ্রেণীর ব্রাহ্মণ। মহাত্মা হেয়ারের প্রতিষ্ঠিত পাঠশালাতে ইহার বিদ্যা শিক্ষা আরম্ভ হয়। সেখান হইতে ফ্রী ছাত্ররূপে নবপ্রতিষ্ঠিত হিন্দুকালেজে প্রেরিত হন। কালেজ হইতে উত্তীর্ণ হইয়া কিছুদিন শিক্ষকতা করেন। তৎপরে অপরাপর কাজ করিয়া শেষে সদর দেওয়ানী আদালতের ডেপুটী রেজিষ্ট্রারের কর্ম্ম গ্রহণ করেন। সেখান হইতে মুনসেফের পদ প্রাপ্ত হইয়া জাহানাবাদে গমন করেন। কেন যে সে পদে বহুদিন প্রতিষ্ঠিত থাকেন নাই তাহা বলিতে পারি না। কিছুদিন পরে সে কার্য্য হইতে অবসৃত হইয়া তিনি সংস্কৃত মনুসংহিতার ইংরাজী অনুবাদ করিতে আরম্ভ করেন; এবং একখানি ইংরাজী ও বাঙ্গালা ডিকশনারি বাহির করেন। এই সময়েই তিনি “The Quill” নামে একখানি সংবাদ পত্র প্রকাশ করিতেন এবং তাহাতে গবর্ণমেণ্টের রাজকার্য্যের দোষ গুণ বিচার করিতেন। তাহা গবর্ণমেণ্ট পক্ষীয় ব্যক্তিগণের অপ্রিয় হইয়া উঠিয়াছিল।
তিনি যে কেবল জ্ঞানালোচনা ও জ্ঞান বিস্তারে নিযুক্ত থাকিতেন তাহাতাঁরাচাদ চক্রবর্ত্তী
এই লেখায় এই অংশে একটি চিত্র থাকা উচিৎ। যদি আপনি তা দিতে পারেন, তবে, দয়া করে সাহায্য:চিত্র দেখুন। |
নহে, দেশহিতকর সর্ব্ববিধ কার্য্যে যুবকবন্ধুগণের সঙ্গী হইতেন তাহা পূর্ব্বেই উক্ত হইয়াছে। তিনি রামমোহন রায়ের একজন প্রধান শিষ্য ছিলেন; এবং ১৮২৮ সালে রাজা যখন ব্রাহ্মসমাজ প্রথম প্রতিষ্ঠিত করেন, তখন তিনিই তাহার প্রথম সম্পাদক নিযুক্ত হন।
জীবনের শেষভাগে তিনি বৰ্দ্ধমান-রাজের ম্যানেজারি কার্য্যে নিযুক্ত হন। শুনিতে পাই বৰ্দ্ধমানাধিপতি মহতাপ চন্দ বাহাদুর তাঁহার কার্য্যে প্রীত হইয়া তাহাকে দাদা বলিয়া সম্বোধন করিতেন, এবং সর্ব্ববিষয়ে তাঁহার পরামর্শ লইয়া কাজ করিতেন। এই সম্মানিত পদে প্রতিষ্ঠিত থাকিতে থাকিতে তাঁহার দেহান্ত হয়। ১৮৪৩ সালে যে সকল ব্যক্তি নব্যবঙ্গের নেতৃরূপে দণ্ডায়মান ছিলেন, তন্মধ্যে ইনি একজন প্রধান।
আর এক কারণে এই ১৮৪৩ সাল বঙ্গদেশের ইতিবৃত্তে চিরস্মরণীয়। এই সালে ভক্তিভাজন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাশয় ব্রাহ্মধর্ম্মে দীক্ষিত হইয়া ব্রাহ্মসমাজকে নবজীবন ও নবশক্তি প্রদান করেন। তাহার সংক্ষিপ্ত বিবরণ নিম্নে প্রদত্ত হইতেছে;—
দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাশয় দ্বারকানাথ ঠাকুরের জ্যেষ্ঠপুত্র। অনুমান ১৮১৭ সালে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। শৈশবে তিনি মহাত্মা রাজা রামমোহন রায়ের প্রতিষ্ঠিত স্কুলে কিছুদিন অধ্যয়ন করেন। তৎপরে হিন্দুকালেজে আসেন। হিন্দুকালেজে আসিয়া লাহিড়ী মহাশয়ের সহাধ্যায়ীদিগের মধ্যে পরিগণিত হন। এরূপ বোধ হয় ডিরোজিওর শিষ্যদলের সহিত তাঁহার বিশেষ ঘনিষ্টতা হয় নাই। যদিও তাঁহার পিতা রামমোহন রায়ের একজন বন্ধু ও রাজার প্রতিষ্ঠিত ব্রাহ্মসমাজের একজন প্রধান পৃষ্ঠ-পোষক ছিলেন, তথাপি গৃহস্থিত প্রাচীন মহিলাগণের শিক্ষার গুণে দেবেন্দ্রনাথ বাল্যকালে প্রাচীন ধর্ম্মেই আস্থাবান ছিলেন। কিন্তু কতকগুলি আশ্চর্ষ্য ঘটনা ঘটিয়া তাঁহার হৃদয় পরিবর্ত্তিত হয়। সে সমুদয় কথার এখানে উল্লেখ নিম্প্রয়োজন।
বিষয় সুখকে হেল্পজ্ঞান করিয়া যখন তিনি প্রাচীন বেদান্ত ধর্ম্মের অনুশীলনে যত্নবান হইলেন, তখন, ১৮৩৮ সালে, ‘তত্ত্ববোধিনী সভা’ নামে এক সভা স্থাপন করিয়া সেই উদ্দেশ্য সাধন করিতে অগ্রসর হইলেন।
দুই তিন বৎসরের মধ্যে তত্ত্ববোধিনী সভার সভ্য সংখ্যা বহুগুণ বৃদ্ধি পাইল। ১৮৪০ সালে তিনি তত্ত্ববোধিনী পাঠশালা নামে একটী বিদ্যালয় স্থাপন করিলেন। তাহাতে ছাত্রদিগকে রীতিমত বেদান্ত শিক্ষা দেওয়া হইত। তাঁহার প্রকৃতির বিশেষত্ব ও মহত্ত্ব এই যে যখন দেশের শিক্ষিত দলের মধ্যে প্রতীচ্যানুরাগ প্রবল, সকলেই পশ্চিমদিকে চাহিয়া রহিয়াছে, তখন তিনি এদেশের প্রাচীন জ্ঞান-সম্পত্তির প্রতি মুখ ফিরাইলেন; এবং বেদ বেদান্তের আলোচনার জন্য তত্ত্ববোধিনী সভা ও তত্ত্ববোধিনী পাঠশালা স্থাপন করিলেন। তিনি ধর্ম্মসংস্কারে প্রবৃত্ত হইলেন; কিন্তু আপনার কার্য্যকে জাতীয়তারূপ ভিত্তির উপর স্থাপিত রাখিতে ব্যগ্র হইলেন। এই বিশেষত্ব তিনি চিরদিন রক্ষা করিয়াছেন।
একদিকে যখন প্রাচীন ধর্ম্মশাস্ত্র অনুশীলনের চেষ্টা চলিতে লাগিল, অপরদিকে ১৮৪৩ সালের ৭ই পৌষ দিবসে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাশয় প্রায় বিংশতিজন বয়স্যের সহিত প্রকাশ্যভাবে ব্রাহ্মধর্ম্মে দীক্ষিত হইলেন; এবং ব্রাহ্মসমাজের উন্নতি ও ব্রাহ্মধর্ম্ম প্রচার কল্পে আপনার সমগ্র হৃদয় মন নিয়োগ করিলেন; তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা প্রকাশিত হইল; সুবিখ্যাত অক্ষয়কুমার দত্ত মহাশয় তাহার সম্পাদকতা ভার গ্রহণ করিলেন; এবং রাজেন্দ্রলাল মিত্র, পণ্ডিতবর ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রভৃতি অনেক লব্ধপ্রতিষ্ঠ ব্যক্তি. তাহার লেখকশ্রেণী-গণ্য হইলেন।
ইহার পূর্ব্বে ব্রাহ্মসমাজের অবস্থা অতি শোচনীয় হইয়া দাঁড়াইয়াছিল। ১৮৩০ সালে রামমোহন রায় বিলাতযাত্রা করিলে ব্রাহ্মসমাজের কার্য্যভার প্রধানতঃ ইহার প্রথম আচার্য্য রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশ মহাশয়ের উপরে পতিত হয়। সে বৃদ্ধ ব্রাহ্মণের অনুরাগের অল্পতা ছিল না; কিন্তু কতিপয় বৎসরের মধ্যেই সমাজের সভ্যগণ অনেকেই ইহাকে পরিত্যাগ করিলেন। তখন কেবল একমাত্র দ্বারকানাথ ঠাকুর ও অপর কতিপয় ব্যক্তি বৃদ্ধ আচার্য্যের পৃষ্ঠপোষক হইয়া সমাজকে রক্ষা করিতে লাগিলেন। এরূপ শুনিতে পাই সমাজের সমগ্র মাসিক ব্যয় এক দ্বারকানাথ ঠাকুর দিতেন। সুতরাং এই ১৮৪৩ সালকেই ব্রাহ্মসমাজের পুনরুত্থানের বৎসর বলিতে হইবে। দেবেন্দ্র নাথ ঠাকুর ইহাকে পুনৰ্জ্জীবিত করিলেন। তাঁহার প্রতিষ্ঠিত তত্ত্ববোধিনী পাঠশালা কয়েক বৎসর পরে কলিকাতা হইতে বাঁশবেড়িয়া গ্রামে উঠিয়া যায়, পরে ১৮৪৬ সালে ইংলণ্ডে তাঁহার পিতার মৃত্যু হইলে বিলোপ প্রাপ্ত হয়। তত্ত্ববোধিনী পাঠশালা হইতে তিনি চারিজন ব্রাহ্মণকে চারিবেদ পাঠ করিবার জন্য কাশীতে প্রেরণ করিয়াছিলেন, পূর্ব্বোক্ত কারণে তাঁহাদিগকেও ফিরিয়া আসিতে হয়। ১৮৪৪ সালে দুইটী ঘটনা ঘটে। প্রথম, বর্ত্তমান মেটকাফ হলের নির্ম্মাণকার্য্য শেষ হইলে পাবলিক লাইব্রেরী সেই ভবনে উঠিয়া আসে। নব্যবঙ্গের অন্যতম নেতা প্যারীচাঁদ মিত্র মহাশয় উহার লাইব্রেরীয়ান নিযুক্ত হওয়াতে লাইব্রেরিটী রামগোপাল ঘোষ, তারাচাঁদ চক্রবর্ত্তী, রামতনু লাহিড়ী প্রভৃতি যুবকদলের একটা সম্মিলন ও জ্ঞানালোচনার ক্ষেত্র হইয়া উঠে। বিশেষতঃ রামগোপাল ঘোষ এই লাইব্রেরীর একজন প্রধান উৎসাহদাতা ও অধ্যক্ষ হন।
দ্বিতীয় ঘটনা, দ্বারকানাথ ঠাকুর মহাশয়ের দ্বিতীয়বার বিলাত গমন। এবার তিনি বিলাত যাত্রার সময় নিজের উদার হৃদয় ও দেশহিতৈষিতার অনুরূপ একটী সৎকার্য্য করেন। কলিকাতা মেডিকেল কালেজ স্থাপনে তিনি যে বিশেষ সহায়তা করিরাছিলেন তাহা অগ্রেই বলিয়াছি। উক্ত কালেজের বর্তমান হাসপাতালটী নির্ম্মাণের জন্য অনেক টাকা দিয়াছিলেন, তাহারও উল্লেখ করিয়াছি। কিন্তু তাঁহার স্বদেশহিতৈষিতা বা দানশক্তি তাহাতেও পর্য্যবসিত হয় নাই। ১৮৪৪ সালে তিনি দ্বিতীয়বার ইংলণ্ড-যাত্রার অভিপ্রায় করিলেন; সেই সঙ্গে সঙ্গে সংকল্প করিলেন যে নিজের ব্যয়ে মেডিকেল কালেজের কয়েকজন ছাত্রকে ইংলণ্ডে লইয়া গিয়া শিক্ষিত করিয়া আনিবেন। তদনুসারে এডুকেশন কাউন্সিলের নিকট স্বীয় অভিপ্রায় ব্যক্ত করিলেন। উক্ত কাউন্সিলের চেষ্টাতে চারিজন ছাত্র জুটিল। তন্মধ্যে শ্রীমান ভোলানাথ বসু ও শ্রীমান্ সূর্য্যকুমার চক্রবর্ত্তীর ব্যয় তিনি দিলেন; এবং শ্রীমান দ্বারকানাথ বসু ও শ্রীমান্ গোপাল লাল শীলের ব্যয় গবর্ণমেণ্ট দিলেন। এই চারিজন ছাত্র ডাক্তার এডোয়ার্ড গুডিভের তত্ত্বাবধানে দ্বারকানাথ ঠাকুরের সমভিব্যাহারে ইংলণ্ডে গমন করেন। দুঃখের বিষয় এই বিলাত যাত্রাই দ্বারকানার্ ঠাকুর মহাশয়েয় শেষ যাত্রা হইল। সেখানে ১৮৪৬ সালে তাঁহার দেহান্ত হয়; এবং তাঁহার দেহ লণ্ডন সহরের এক সুপ্রসিদ্ধ সমাধিক্ষেত্রে সমাহিত রহিয়াছে।
এদিকে এই সময়ে দেশের শিক্ষিত সমাজের অবস্থা দিন দিন শোচনীয় হইয়া উঠিতেছিল। ডিরোজিও যে স্বাধীন চিন্তার স্রোত প্রবাহিত করিয়া দিয়া গিয়াছিলেন তাহা এই সময়ে বঙ্গসমাজে পুর্ণামাত্রায় কাজ করিতেছিল। শিক্ষিতদলের মধ্যে সুরাপানটা বড়ই প্রবল হইয়া উঠিয়াছিল। হিন্দুকালেজের ষোল সতের বৎসরের বালকের সুরাপান করাকে শ্লাঘার বিষয় মনে করিত। বঙ্গের অমর কৰি মধুসূদন দত্ত, ভূদেব মুখোপাধ্যায়, সুপ্রসিদ্ধ রাজনারায়ণ বসু প্রভৃতি এই সময়ে হিন্দুকালেজে পাঠ করিতেছিলেন। সে সময়কার লোকের মুখে শুনিয়াছি যে কালেজের বালকের গোলদিঘীর মধ্যে প্রকাশ্য স্থানে বসিয়া মাধবদত্তের বাজারের নিকটস্থ মুসলমান দোকানদারের দোকান হইতে কাবাব মাংস কিনিয়া আনিয়া দশজনে মিলিয়া আহার করিত ও সুরাপান করিত। যে যত অসমসাহসিকতা দেখাইতে পারিত তাহার তত বাহাদুরি হইত, সেই তত সংস্কারক বলিয়া পরিগণিত হইত!
একদিকে যুবক বয়স্যদিগের মধ্যে এইরূপে দেশীয় রীতিবিরুদ্ধ আচরণ ওদিকে কালেজ গৃহে ডি এল রিচার্ডসন সাহেবের সেক্সপীয়ার পাঠ। এরূপ সেক্স্পীয়ার পড়িতে কাহাকেও শোনা যায় নাই। তিনি সেক্সপীয়ার পড়িতে পড়িতে নিজে উন্মত্ত-প্রায় হইয়া যাইতেন, এবং ছাত্রগণকেও মাতাইয়া তুলিতেন। তিনি যে অনেক পরিমাণে মধুসূদনের কবিত্ব শক্তি স্ফুরণের কারণ হইয়াছিলেন, তাহাতে সন্দেহ নাই। তাঁহার মুখে সেক্সপীয়ার শুনিয়া ছাত্রগণ সেক্সপীয়ায়ের ন্যায় কবি নাই, ইংরাজী সাহিত্যের ন্যায় সাহিত্য নাই, এই জ্ঞানেই বৰ্দ্ধিত হইত। দেশের কোনও বিষয়ের প্রতি আর দৃকপাত কল্পিত না। স্বজাতি-বিদ্বেষ অনেক বালকের মনে অত্যন্ত প্রবল হইয়া উঠিয়াছিল। এই ভাবাপন্ন ছাত্রগণের মধ্যে সুরাপান অবাধে চলিত। অতিরিক্ত সুরাপান বশত: অনেক শিক্ষিত যুবকের শরীর একেবারে ভগ্ন হইয়া গিয়াছিল, এবং অনেকে অকালে কালগ্রাসে পতিত হইয়াছিলেন।
সময় বুঝিয়া এই সময়ে সুবাগী খ্রীষ্টীয় প্রচারক ডফ তাঁহার মধ্য বয়সের অদম্য উদ্যমের সহিত কার্য্য করিতেছিলেন। ডিরোজিওর শিষ্য ও রামতনু লাহিড়ী মহাশয়ের যৌবন-সুহৃদ মহেশ্চন্দ্র ঘোষ ও কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় খ্রীষ্টধর্ম্ম অবলম্বন করার পর দেশমধ্যে যে আন্দোলন উঠিয়াছিল বলিতে গেলে তাহা আর থামে নাই। এই সময়ে বা ইহার কয়েক বৎসর পরে পাথুরিয়াঘাটার প্রসন্নকুমার ঠাকুর মহাশয়ের একমাত্র পুত্র জ্ঞানেন্দ্রমোহন ঠাকুর খ্রীষ্টধর্ম্মে দীক্ষিত হইয়া, কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের কন্যা কমলমণিকে বিবাহ করেন। এতদ্ব্যতীত গুরুদাস মৈত্র প্রভৃতি আরও কয়েকজন ভদ্রঘরের ছেলে খ্রীষ্টধর্ম্মাবলম্বন করেন। তন্মধ্যে ১৮৪৫ সালে একজনকে লইয়া তুমুল আন্দোলন উপস্থিত হয়। ঠাকুর বাবুদের দেওয়ানের পুত্র উমেশচন্দ্র সরকার খ্রীষ্টধর্ম্ম-গ্রহণের আশয়ে সস্ত্রীক পলাইয়া মিশনারিদিগের ভবনে আশ্রয় গ্রহণ করে। তাহাকে মিশনারিদিগের হাত হইতে ছিড়িয়া লইবার জন্য তাহার পিতা বিস্তর চেষ্টা করেন। ডফ সাহেব সে পথে অন্তরায় স্বরূপ দণ্ডায়মান হন। ইহা লইয়া হিন্দু সমাজ মধ্যে ঘোরতর আন্দোলন উপস্থিত হয়। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, অক্ষয়কুমার দত্ত প্রভৃতি ব্রাহ্মসমাজের অগ্রণীগণও এই আবর্ত্তে পড়িয়া খ্রীষ্টীয়-বিরোধীদলের অগ্রণী হইয়া দাঁড়ান। কলিকাতার ভদ্র গৃহস্থগণ এক মহাসভা করিয়া অনেক টাকা সংগ্রহ করেন। হিন্দু-হিতার্থী বিদ্যালয় নামে একটা বিদ্যালয় স্থাপিত হয়; এবং কিছুদিন মহা উৎসাহে তাহার কাজ চলিতে থাকে। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাশয় তাহার প্রথম সম্পাদক নিযুক্ত হন। তাঁহার মুখে শুনিয়াছি যে উক্ত বিদ্যালয়ের জন্য সংগৃহীত টাকা যাঁহাদের হস্তে গচ্ছিত ছিল, তাহদের কারবারে ক্ষতি হওয়াতে ঐ সমুদয় টাকা নষ্ট হয়, তাহাতেই কয়েক বৎসর পরে ঐ বিদ্যালয় উঠিয়া যায়।
একদিকে হিন্দুহিতার্থী বিদ্যালয় স্থাপিত হইল, অপরদিকে ব্রাহ্মসমাজের মুখপাত্র তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা খ্রীষ্টীয়ধর্ম্মের প্রতি গোলাগুলি বর্ষণ করিতে আরম্ভ করিলেন। খ্রীষ্টানগণ ও ব্রহ্মসমাজের ধর্ম্ম বিশ্বাসকে ভিত্তিহীন বলিয়া আক্রমণ করিতে লাগিলেন। তাহাতে তত্ত্ববোধিনী আপনার অবলম্বিত ধর্ম্মকে বেদান্তধর্ম্ম ও বেদকে তাহার অভ্রান্ত ভিত্তি বলিয়া প্রচার করিতে প্রবৃত্ত হইলেন। ইহা হইতে বেদ অভ্রান্ত ঈশ্বরদত্ত গ্রন্থ হইতে পারে কি না? এই বিচার ব্রাহ্মসমাজের ভিতর ও বাহিরে উপস্থিত হইল। ভিতরে অক্ষয়কুমার দত্ত প্রভৃতি ইহার প্রতিবাদ উপস্থিত করিলেন; এবং বাহির হইতে রামগোপাল ঘোষ প্রমুখ শিক্ষিত ব্যক্তিগণ ব্রাহ্মদিগকে কপট ও ভণ্ড বলিয়া বিদ্রুপ করিতে লাগিলেন।
এই সকল সামাজিক আন্দোলনের মধ্যে লাহিড়ী মহাশয়ের পরিবারে কয়েকটা ঘটনা ঘটে। প্রথম, লাহিড়ী মহাশয়ের জ্যৈষ্ঠ কেশবচন্দ্রের মৃত্যু। কনিষ্ঠ ভ্রাত রাধাবিলাস তাঁহার অগ্রেই গিয়াছিলেন, তৎপরে যখন কেশবের যাইবার সময় উপস্থিত হইল, তখন কৃষ্ণনগরের লোক সাধু পিতা রামকৃষ্ণের ভাব দেখিয়া অবাক হইয়া গেল। এরূপ শুনিতে পাই কেশবচন্দ্রকে সজ্ঞানে গঙ্গাযাত্রা করান হইয়াছিল। যখম তাঁহাকে গঙ্গাতে লইয়া যাওয়া হয়, কেশবচন্দ্র পিতার পদধূলি-প্রার্থী হইলেন। তদনুসারে রামকৃষ্ণ ধীর গম্ভীরভাবে অগ্রসর হইয়া পুত্রের মস্তকে নিজের পদধূলি দিয়া বিদায় করি লেন। সেই সাধুর মুখে কোনও শোক বা বিকারের চিহ্ন পরিলক্ষিত হইল না। কেশবচন্দ্রর দেহত্যাগের পরেই সমুদয় সংসারের ভার কনিষ্ঠভ্রাতা রামতনুর স্বন্ধে পড়িয়া গেল। তিনি যথাসাধ্য সে ভারবহন করিতে লাগিলেন।
দ্বিতীয়, এই ঘটনার অল্পকাল পরেই বোধ হয় তাহার তৃতীয়বার দ্বার পরিগ্রহ হয়। তিনি যখন হিন্দুকালেজের তৃতীয় কি দ্বিতীয় শ্রেণীতে পাঠ করেন তখন কাঁদবিলা গ্রামে এক ব্রাহ্মণ কন্যার সহিত তাঁহার প্রথম পরিণয় হয়। ঐ পত্নী চারি পাঁচ বৎসরের অধিক জীবিত ছিলেন না। তৎপরে পাবনার অন্তর্গত মথুরা নামক গ্রামের এক ব্রাহ্মণের কন্যাকে পুনরায় বিবাহ করেন। এরূপ শুনা যায়, এই বিবাহে তাঁহাকে কিঞ্চিৎ ক্লেশ পাইতে হইয়াছিল। কি কারণে জানি না, বোধ হয় তিনি ডিরোজিওর শিষ্যদলের সহিত সংসৃষ্ট ছিলেন বলিয়াই হইবে, তাঁহার দ্বিতীয় শ্বশুর স্বীয় কন্যাকে পতিগৃহে প্রেরণ করিতে চাহিতেন না। ইহা লইয়া দুই পরিবারে মনান্তর ঘটে; এবং সে কারণে লাহিড়ী মহাশয়কে মানসিক অশাস্তি ভোগ করিতে হইয়াছিল। বোধ হয় এই পত্নীকেই লক্ষ্য করিয়া রামগোপাল ঘোষ তাঁহার দৈনিক লিপিতে এক স্থানে লিখিতেছেনঃ—
April 4th, 1839—But our conversation did not thicken till we touched the subject of women—bright women! We spoke of the peculiarities of each other's wives. * * * Poor Ramtonoo appeared to be worried by his wife. But I should not indulge myself in writing the secrets of my friends in this book.”
ঘোষজ মহাশয় আপনার ভদ্রতার দ্বারা আপনাকে বাধা না দিলে, বোধ হয় লাহিড়ী মহাশয়ের মানসিক অশাস্তির সমগ্র কারণটা ব্যক্ত হইয়া পড়িত।
যাহা হউক দ্বিতীয় বিবাহ লাহিড়ী মহাশয়ের সুখের কারণ হয় নাই। আর সে পত্নীকেও শ্বশুর ঘরে আসিতে হয় নাই। তিন চারি বৎসরের মধ্যে তিনিও গত হন। তৎপরে এই সময়ে কি ইহার কিঞ্চিৎ পূর্ব্বে হাবড়ার সন্নিহিত সাঁতরাগাছি গ্রামের স্বৰ্গীয় কৃষ্ণকিশোর চৌধুরীর কনিষ্ঠ কন্যার সহিত তাঁহার তৃতীয়বার পরিণয় হয়। ইনিই তাঁহার সস্তানগণের জননী।
তৃতীয়, তাঁহার আরাধ্য জননীদেবী এই সময়ে কঠিন পীড়াতে আক্রাস্ত হন। কৃষ্ণনগরে রাখিলে তাঁহার চিকিৎসার সুব্যবস্থা হইবার আশা না দেখিয় তাঁহাকে কলিকাতাতে আনা হয়। যে মাতাকে কেশবচন্দ্র পুষ্প চন্দন দ্বারা পূজা করিতেন, যাঁহাকে প্রতিবেশিগণ সাক্ষাৎ লক্ষ্মী বলিয়া সম্বোধন করিতেন, যিনি নিতান্ত দারিদ্র্যে বাস করিয়াও অপেক্ষাকৃত সম্পন্ন পিতৃকুলের আশ্রয় গ্রহণ করিতেন না, যিনি সতত, তেজস্বিত ও সত্যনিষ্ঠার দৃষ্টান্ত স্বরূপ ছিলেন, সেই জননীর সেবা তাঁহার পুত্রগণ কিরূপে করিয়াছিলেন, তাহা বলা নিম্প্রয়োজন। লাহিড়ী মহাশয় এ সময়ে যেরূপ মাতৃসেবা করিয়াছিলেন সেরূপ মাতৃসেবা কেহ কখনও দেখে নাই। তাঁহার সহধর্ম্মিণী তখন বালিকা, কিন্তু ঐ মাতৃসেবার কথা চিরদিন তাঁহার স্মৃতিতে মুদ্রিত ছিল। চিরদিন পুলকিতচিত্তে নিজের সন্তানগণের নিকট সেই মাতৃসেবার বিষয় বর্ণন করিতেন।
জননী কলিকাতায় আসা অবধি লাহিড়ী মহাশয়ের আহার নিদ্রা রহিত হইয়াছিল। কোনও প্রকারে স্কুলে গিয়া স্বীয় কর্ত্তব্য সমাধা করিয়া দিন রাত্রি মায়ের পার্শ্বে যাপন করিতেন; ভূত্যের ন্যায় তাঁহার আদেশ পালন করিতেন; পুত্রের ন্যায় তাঁহার চিকিৎসার ব্যবস্থা করিতেন; মেথরের ন্যায় তাঁহার মলমূত্র দক্ষিণ হস্তে পরিষ্কার করিতেন; এবং কন্যার ন্যায় তাঁহার রোগশয্যাকে আরামের স্থান করিবার প্রয়াস পাইতেন। দুঃখের বিষয় জননী আর সে পীড়া হইতে উত্তীর্ণ হইতে পারিলেন না। সেই রোগে কলিকাতা সহরেই তাঁহার মৃত্যু হয়।
তৎপরে ১৮৪৬ সালের প্রারম্ভে কৃষ্ণনগর কালেজ খোলা হইলে লাহিড়ী মহাশয় তাহার স্কুল ডিপার্টমেণ্টের দ্বিতীয় শিক্ষক হইয়া গমন করিলেন। তাঁহার কৃষ্ণনগর গমন স্থির হইলে, তাঁহার যৌবন-সুহৃদগণ আপনাদের মধ্য হইতে চাঁদা করিয়া নিজেদের গভীর প্রীতি ও শ্রদ্ধার চিহ্ন স্বরূপ তাঁহাকে একটা ঘড়ি উপহার দিলেন। যে কয়জন বন্ধুর প্রতি ঐ ঘড়ি লাহিড়ী মহাশয়ের হস্তে অর্পণ করিবার ভার ছিল, কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁহাদের অগ্রণী ছিলেন। লাহিড়ী মহাশয় ঐ, ঘড়িটী মহামূল্য সম্পত্তি জ্ঞানে চিরদিন রক্ষা করিয়া আসিয়াছেন।