8

 মস্কৌ থাকতে সােভিয়েট ব্যবস্থা সম্বন্ধে দুটো বড়াে বড়াে চিঠি লিখেছিলুম। সে চিঠি কবে পাবে এবং পাবে কিনা কী জানি।

 বর্লিনে এসে একসঙ্গে তােমার দু-খানা চিঠি পাওয়া গেল। ঘন বর্ষারচিঠি, শান্তিনিকেতনের আকাশে শালবনের উপরে মেঘের ছায়া এবং জলের ধারায় শ্রাবণ ঘনিয়ে উঠেছে সেই ছবি মনে জাগলে আমার চিত্ত কী রকম উৎসুক হয়ে ওঠে সে তােমাকে বলা বাহুল্য।

 কিন্তু এবারে রাশিয়া ঘুরে এসে সেই সৌন্দর্যের ছবি আমার মন থেকে মুছে গেছে। কেবলি ভাবছি আমাদের দেশজোড়া চাষীদের দুঃখের কথা। আমার যৌবনের আরম্ভকাল থেকেই বাংলাদেশের পল্লী-গ্রামের সঙ্গে আমার নিকট-পরিচয় হয়েছে। তখন চাষীদের সঙ্গে আমার প্রত্যহ ছিল দেখাশােনা—ওদের সব নালিশ উঠেছে আমার কানে। আমি জানি, ওদের মতাে নিঃসহায় জীব অল্পই আছে, ওরা সমাজের যে-তলায় তলিয়ে সেখানে জ্ঞানের আলাে অল্পই পৌঁছয়, প্রাণের হাওয়া বয় না বললেই হয়।

 তখনকার দিনে দেশের পলিটিক্স নিয়ে যাঁরা আসর জমিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে একজনও ছিলেন না যাঁরা পল্লীবাসীকে এ-দেশের লােক বলে অনুভব করতেন। আমার মনে আছে পাবনা কনফারেন্সের সময় আমি তখনকার খুব বড়ো একজন রাষ্ট্রনেতাকে বলেছিলুম, আমাদের দেশের রাষ্ট্রীয় উন্নতিকে যদি আমরা সত্য করতে চাই তাহলে সব-আগে আমাদের এই তলার লােকদের মানুষ করতে হবে। তিনি সে-কথাটাকে এতই তুচ্ছ বলে উড়িয়ে দিলেন যে, আমি স্পষ্ট বুঝতে পারলুম যে আমাদের দেশাত্মবােধীরা দেশ বলে একটা তত্ত্বকে বিদেশের পাঠশালা থেকে সংগ্রহ করে এনেছেন, দেশের মানুষকে তাঁরা অন্তরের মধ্যে উপলব্ধি করেন না। এই রকম মনােবৃত্তির সুবিধে হচ্ছে এই যে, আমাদের দেশ আছে বিদেশীর হাতে এই কথা নিয়ে আক্ষেপ করা, উত্তেজিত হওয়া, কবিতা লেখা, খবরের কাগজ চালানাে সহজ, কিন্তু দেশের লােক আমাদের আপন লােক, এ-কথা বলবামাত্র তার দায়িত্ব তখন থেকেই স্বীকার করে নিতে হয়, কাজ শুরু হয় সেই মুহূর্তে।

 সেদিনকার পরেও অনেক দিন চলে গেল। সেই পাবনা কনফারেন্সে পল্লীসম্বন্ধে যা বলেছিলুম তার প্রতিধ্বনি অনেকবার শুনেছি—শুধু শব্দ নয় পল্লীর হিতকল্পে অর্থ সংগ্রহ হয়েছে—কিন্তু দেশের যে-উপরিতলায় শব্দের আবৃত্তি হয় সেইখানটাতেই সেই অর্থও আবর্তিত হয়ে বিলুপ্ত হয়েছে, সমাজের যে গভীরতলায় পল্লী তলিয়ে আছে সেখানে তার কিছুই পৌঁছল না।

 একদা আমি পদ্মার চরে বােট বেঁধে সাহিত্যচর্চা করেছিলুম। মনে ধারণা ছিল, লেখনী দিয়ে ভাবের খনি খনন করব এই আমার একমাত্র কাজ, আর কোন কাজের আমি যােগ্যই নই। কিন্তু যখন এ-কথা কাউকে বলে-কয়ে বােঝাতে পারলুম না যে, আমাদের স্বায়ত্তশাসনের ক্ষেত্র হচ্ছে কৃষিপল্লীতে, তার চর্চা আজ থেকেই শুরু করা চাই, তখন কিছুক্ষণের জন্যে কলম কানে গুঁজে এ-কথা,আমাকে বলতে হল—আচ্ছা, আমিই এ-কাজে লাগব। এই সংকল্পে আমার সহায়তা করবার জন্যে সেদিন একটি মাত্র লােক পেয়েছিলুম, সে হচ্ছে কালীমােহন। শরীর তার রােগে জীর্ণ, দু-বেলা তার জ্বর আসে, তার উপরে পুলিসের খাতায়, তার নাম উঠেছে।

 তারপর থেকে দুর্গম বন্ধুর পথে সামান্য পাথেয় নিয়ে চলেছে সেই ইতিহাস। চাষীকে আত্মশক্তিতে দৃঢ় করে তুলতে হবে এই ছিল আমার অভিপ্রায়। এ সম্বন্ধে দুটো কথা সর্বদাই আমার মনে আন্দোলিত হয়েছে—জমির স্বত্ব ন্যায়ত জমিদারের নয়, সে চাষীর; দ্বিতীয়ত সমবায়নীতি অনুসারে চাষের ক্ষেত্র একত্র করে চাষ না করতে পারলে কৃষির উন্নতি হতেই পারে না। মান্ধাতার আমলের হাল লাঙল নিয়ে আল-বাঁধা টুকরাে জমিতে ফসল ফলানাে আর ফুটো কলসীতে জল আনা একই কথা।

 কিন্তু এই দুটো পন্থাই দুরূহ। প্রথমত চাষীকে জমির স্বত্ব দিলেই সে-স্বত্ব পরমুহূর্তেই মহাজনের হাতে গিয়ে পড়বে, তার দুঃখতার বাড়বে বই কমবে না। কৃষিক্ষেত্র একত্রীকরণের কথা। আমি নিজে একদিন চাষীদের ডেকে আলােচনা করেছিলুম। শিলাইদহে আমি যে-বাড়িতে থাকতুম, তার বারান্দা থেকে দেখা যায় খেতের পর খেত নিরন্তর চলে গেছে দিগন্ত পেরিয়ে। ভােরবেলা থেকে হাল লাঙল এবং গােরু নিয়ে একটি-একটি করে চাষী আসে, আপন টুকরাে খেতটুকু ঘুরে ঘুরে চাষ করে চলে যায়। এই রকম ভাগ-করা শক্তির যে কতটা অপচয় ঘটে প্রতিদিন সে আমি স্বচক্ষে দেখেছি। চাষীদের ডেকে যখন সমস্ত জমি একত্র করে কলের লাঙলে চাষ করার সুবিধের কথা বুঝিয়ে বললুম তারা তখনই সমস্ত মেনে নিলে। কিন্তু বললে, আমরা নির্বোধ, এতবড় ব্যাপার করে তুলতে পারব কী করে। আমি যদি বলতে পারতুম, এ ভার আমিই নেব তাহলে তখনই মিটে যেতে পারত। কিন্তু আমার সাধ্য কী। এমন কাজের চালনাভার নেবার দায়িত্ব আমার পক্ষে অসম্ভব—সে শিক্ষা সে শক্তি আমার নেই।

 কিন্তু এই কথাটা বরাবর আমার মনে জেগেছিল। যখন বােলপুরের কো-অপারেটিভের ব্যবস্থা বিশ্বভারতীর হাতে এল তখন আবার একদিন আশা হয়েছিল এইবার বুঝি সুযােগ হতে পারবে। যাদের হাতে আপিসের ভার তাদের বয়স অল্প, আমার চেয়ে তাদের হিসাবী বুদ্ধি এবং শিক্ষা অনেক বেশি। কিন্তু আমাদের যুবকেরা ইস্কুলে-পড়া-ছেলে, তাদের বই মুখস্থ করার মন। যে-শিক্ষা আমাদের দেশে প্রচলিত তাতে করে আমাদের চিন্তা করার সাহস, কর্ম করবার দক্ষতা থাকে না, পুঁথির বুলি পুনরাবৃত্তি করার পরেই ছাত্রদের পরিত্রাণ নির্ভর করে।

 বুদ্ধির এই পল্লবগ্রাহিতা ছাড়া আমাদের আর-একটা বিপদ ঘটে। ইস্কুলে যারা পড়া মুখস্থ করেছে আর ইস্কুলের বাইরে পড়ে থেকে যারা পড়া মুখস্থ করে নি, তাদের মধ্যে শ্রেণীবিভাগ ঘটে গেছে,—শিক্ষিত এবং অশিক্ষিত। ইস্কুলে-পড়া মনের আত্মীয়তাবোধ পুঁথি-পোড়োদের পড়ার বাইরে পৌঁছতে পারে না। যাদের আমরা বলি চাষাভুষো, পুঁথির পাতার পর্দা ভেদ করে তাদের প্রতি আমাদের দৃষ্টি পৌছয় না, তারা আমাদের কাছে অস্পষ্ট। এইজন্যেই ওরা আমাদের সকল প্রচেষ্টা থেকে স্বভাবতই বাদ পড়ে যায়। তাই কো-অপারেটিভের যোগে অন্য দেশে যখন সমাজের নিচের তলায় একটা সৃষ্টির কাজ চলছে, আমাদের দেশে টিপে টিপে টাকা ধার দেওয়ার বেশি কিছু এগোয় না। কেননা ধার দেওয়া, তার সুদ কষা এবং দেনার টাকা আদায় করা অত্যন্ত ভীরু মনের পক্ষেও সহজ কাজ, এমন কি ভীরু মনের পক্ষেই সহজ, তাতে যদি নামতার ছল না ঘটে তাহলে কোনো বিপদ নেই।

 বুদ্ধির সাহস এবং জনসাধারণের প্রতি দরদবোধ এই উভয়ের অভাব ঘটাতেই দুঃখীর দুঃখ আমাদের দেশে ঘোচোনো এত কঠিন হয়েছে; কিন্তু এই অভাবের জন্য কাউকে দোষ দেওয়া যায় না। কেননা কেরানি-তৈরির কারখানা বসার জন্যেই একদা আমাদের দেশে বণিক-রাজত্বে ইস্কুলের পত্তন হয়েছিল। ডেস্ক-লোকে মনিবের সঙ্গে সাযুজ্যলাভই আমাদের সদ্গতি। সেইজন্যে উমেদারিতে অকৃতার্থ হলেই আমাদের বিদ্যাশিক্ষা ব্যর্থ হয়ে যায়। এইজন্যেই আমাদের দেশে প্রধানত দেশের কাজ কংগ্রেসের পাণ্ডালে এবং খবরেব কাগজের প্রবন্ধমালায় শিক্ষিত সম্প্রদায়ের বেদনা উদ্ঘােষণের মধ্যেই পাক চ্ছিল। আমাদের কলমে-বাঁধা হাত দেশকে গড়ে তােলবার কাজে এগােতেই পারলে না।

 ঐ দেশের হাওয়াতেই আমিও তো মানুষ, সেইজন্যেই জোরের সঙ্গে মনে করতে সাহস হয় নি যে, বহু কোটি জনসাধারণের বুকের উপর থেকে অশিক্ষা ও অসামর্থ্যের জগদ্দল পাথর ঠেলে নামানাে সম্ভব। অল্পস্বল্প কিছু করতে পারা যায় কিনা এতদিন এই কথাই ভেবেছি। মনে করেছিলুম, সমাজের একটি চির-বাধাগ্রস্ত তলা আছে সেখানে কোনােকালেই সূর্যের আলাে সম্পূর্ণ প্রবেশ করানাে চলবে না, সেই জন্যেই সেখানে অন্তত তেলের বাতি জ্বালাবার জন্যে উঠে পড়ে লাগা উচিত। কিন্তু সাধারণত সেটুকু কর্তব্যবােধও লোকের মনে যথেষ্ট জোরের সঙ্গে ধাক্কা মারতে চায় না, কারণ যাদের আমরা অন্ধকারে দেখতেই পাই নে, তাদের জন্যে যে কিছু করা যেতে পারে এ-কথা স্পষ্ট করে মনে আসে না।

 এই রকম স্বল্পসাহস মন নিয়েই রাশিয়াতে এসেছিলুম, শুনেছিলুম এখানে চাষী ও কর্মিকদের মধ্যে শিক্ষাবিস্তারের পরিমাণ অনেক বেড়ে চলেছে। ভেবেছিলুম তার মানে ওখানে পল্লীর পাঠশালায় শিশুশিক্ষার প্রথম ভাগ বড়ােজোর দ্বিতীয় ভাগ পড়ানাের কাজ সংখ্যায় আমাদের চেয়ে বেশি হয়েছে। ভেবেছিলুম ওদের সাংখ্যিক তালিকা নেড়েচেড়ে দেখতে পাব ওদের কজন চাষী নাম সই করতে পারে আর কজন চাষীর নামতা দশের কোঠা পর্যন্ত এগিয়েছে।

 মনে রেখাে, এখানে যে-বিপ্লবে জারের শাসন লয় পেলে সেটা ঘটেছে ১৯১৭ খ্রীষ্টাব্দে। অর্থাৎ তেরাে বছর পার হল মাত্র। ইতিমধ্যে ঘরেবাইরে এদের প্রচণ্ড বিরুদ্ধতার সঙ্গে লড়ে চলতে হয়েছে। এরা একা, অত্যন্ত ভাঙাচোরা একটা রাষ্ট্রব্যবস্থার বোঝা নিয়ে। পথ পূর্বতন দুঃশাসনের প্রভূত আবর্জনায় দুর্গম। যে-আত্মবিপ্লবের প্রবল ঝড়ের মুখে এরা নবযুগের ঘাটে পাড়ি দিলে সেই বিপ্লবের প্রচ্ছন্ন এবং প্রকাশ্য সহায় ছিল ইংলণ্ড এবং আমেরিকা। অর্থসম্বল এদের সামান্য—বিদেশের মহাজনী গদিতে এদের ক্রেডিট নেই। দেশের মধ্যে কলকারখানা এদের যথেষ্ট পরিমাণে না থাকাতে অর্থ-উৎপাদনে এরা শক্তিহীন। এইজন্যে কোনোমতে পেটের ভাত বিক্রি করে চলছে এদের উদ্যোগপর্ব। অথচ রাষ্ট্রব্যবস্থায় সকলের চেয়ে যে অনুৎপাদক বিভাগ—সৈনিক-বিভাগ—তাকে সম্পূর্ণরূপে সুদক্ষ রাখার অপব্যয় এদের পক্ষে অনিবার্য। কেননা আধুনিক মহাজনী যুগের সমস্ত রাষ্ট্রশক্তি এদের শত্রুপক্ষ এবং তারা সকলেই আপন আপন অস্ত্রশলা কানায় কানায় ভরে তুলেছে।

 মনে আছে এই লীগ অফ নেশনসে অস্ত্রবর্জনের প্রস্তাব পাঠিয়ে দিয়ে কপট শান্তিকামীদের মনে চমক লাগিয়ে দিয়েছিল। কেননা নিজেদের প্রতাপ বর্ধন বা রক্ষণ সোভিয়েটদের লক্ষ্য নয়—এদের-সাধনা হচ্ছে জনসাধারণের শিক্ষা-স্বাস্থ্য-অনুসম্বলের উপায়-উপকরণকে প্রকৃষ্ট প্রণালীতে ব্যাপক করে গড়ে তোেলা, এদেরই পক্ষে নিরুপদ্রব শান্তির দরকার সবচেয়ে বেশি। কিন্তু তুমি তো জানো, লীগ অফ নেশনসের সমস্ত পালোয়ানই গুণ্ডাগিরির বহুবিস্তৃত উদ্যোগ কিছুতেই বন্ধ করতে চায় না কিন্তু শান্তি চাই বলে সকলে মিলে হাঁক পাড়ে। এইজন্যেই সকল সাম্রাজ্যিক দেশেই অস্ত্রশস্ত্রের কাঁটাবনের চাষ অন্নের চাষকে ছাপিয়ে বেড়ে চলেছে। এর মধ্যে আবার কিছুকাল ধরে রাশিয়ায় অতি ভীষণ দুর্ভিক্ষ ঘটেছিল—কত লোক মরেছে তার ঠিক নেই। তার ধাক্কা কাটিয়ে সবেমাত্র আট বছর এরা নূতন যুগকে গড়ে তোলবার কাজে লাগতে পেরেছে, বাইরের উপকরণের অভাব সত্ত্বেও।

 কাজ সামান্য নয়— য়ুরোপ-এশিয়া জুড়ে প্রকাণ্ড এদের রাষ্ট্রক্ষেত্র। প্রজামণ্ডলীর মধ্যে যত বিভিন্ন জাতের মানুষ আছে, ভারতবর্ষেও এত নেই। তাদের ভূপ্রকৃতি মানরপ্রকৃতির মধ্যে পরস্পর পার্থক্য অনেক বেশি। বস্তুত এদের সমস্যা বহুবিচিত্র জাতি-সমাকীর্ণ, বহুবিচিত্র অবস্থা-সংকুল বিশ্বপৃথিবীর সমস্যারই সংক্ষিপ্ত রূপ।

 তোমাকে পূর্বেই বলেছি বাহির থেকে মস্কৌ শহর যখন চোখে পড়ল দেখলুম য়ুরোপের অন্য সমস্ত ধনী শহরের তুলনায় অত্যন্ত মলিন। রাস্তায় যারা চলেছে তারা একজনও শৌখিন নয়,সমস্ত শহর আটপৌরে কাপড়-পর। আটপৌরে কাপড়ে শ্রেণীভেদ থাকে না, শ্রেণীভেদ পোশকী কাপড়ে। এখানে সাজে পরিচ্ছদে সবাই এক। সবটা মিলেই শ্রমিকদের পাড়া—যেখানে দৃষ্টি পড়ে সেইখানেই ওরা। এখানে শ্রমিকদের কৃষাণদের কী রকম বদল হয়েছে তা দেখবার জন্যে লাইব্রেরিতে গিয়ে বই খুলতে অথবা গাঁয়ে কিংবা বস্তিতে গিয়ে নোট নিতে হয় না। যাদের আমরা ‘ভদ্দর লোক ’বলে থাকি তারা কোথায় সেইটেই জিজ্ঞাস্য।

 এখানকার জনসাধারণ ভদ্রলোকের আওতায় একটুও ছায়াঢাকা পড়ে নেই, যারা যুগে যুগে নেপথ্যে ছিল তারা আজ সম্পূর্ণ প্রকাশ্যে। এরা যে প্রথম ভাগ শিশুশিক্ষা পড়ে কেবলমাত্র ছাপার অক্ষর হাতড়ে বেড়াতে শিখেছে এ-ভুল ভাঙতে একটুও দেরি হল না। এরা মানুষ হয়ে উঠেছে এই কটা বছরেই।

 নিজের দেশের চাষীদের মজুরদের কথা মনে পড়ল। আরব্য উপন্যাসের জাদুকরের কীর্তি। বছর দশেক আগেই এরা মনে হল আমাদেরই দেশের জনমজুরদের মতোই নিরক্ষর নিঃসহায় নিরন্ন ছিল, তাদেরই মতো অন্ধসংস্কার এবং মুঢ় ধার্মিকতা। দুঃখে বিপদে এরা দেবতার দ্বারে মাথা খুঁড়েছে, পরলোকের ভয়ে পাণ্ডাপুরুতদের হাতে এদের বুদ্ধি ছিল বাঁধা আর ইহলোকের ভয়ে রাজপুরুষ মহাজন ও জমিদারদের হাতে; যারা এদের জুতাপেটা করত তাদের সেই জুতো সাফ করা এদের কাজ ছিল। হাজার বছর থেকে এদের প্রথাপদ্ধতির বদল হয় নি, যানবাহন চরকাঘানি সমস্ত প্রপিতামহের আমলের, হালের হাতিয়ারে হাত লাগাতে বললে বেঁকে বসত। আমাদের দেশের ত্রিশ কোটির পিঠের উপরে যেমন চেপে বসেছে ভূতকালের ভূত, চেপে ধরেছে তাদের দুই চোখ—এদেরও ঠিক তেমনিই ছিল। কটা বছরের মধ্যে এই মূঢ়তার অক্ষমতার পাহাড় নড়িয়ে দিলে যে কী করে সে-কথা এই হতভাগ্য ভারতবাসীকে যেমন একান্ত বিস্মিত করেছে এমন আর কাকে করবে বলো? অথচ যে-সময়ের মধ্যে এই পরিবর্তন চলছিল সে-সময়ে এ-দেশে আমাদের দেশের বহুপ্রশংসিত ‘ল অ্যাণ্ড অর্ডার’ ছিল না।

 তোমাকে পূর্বেই বলেছি এদের জনসাধারণের শিক্ষার চেহারা দেখবার জন্যে আমাকে দূরে যেতে হয় নি কিংবা স্কুলের ইনস্পেক্টরের মতো এদের বানান তদন্ত করবার সময় দেখতে হয় নি “কান”-এ “সোনা”য় এর মূর্ধন্য ণ লাগায় কিনা। একদিন সন্ধ্যাবেলা মস্কো শহরে একটা বাড়িতে গিয়েছিলুম, সেটা চাষীদের বাসা, গ্রাম থেকে কোনো উপলক্ষ্যে যখন তারা শহরে আসে তখন সস্তায় ঐ বাড়িতে কিছুদিনের মতো থাকতে পায়। তাদের সঙ্গে আমার কথাবার্তা হয়েছিল। সে-রকম কথাবার্তা যখন আমাদের দেশের চাষীদের সঙ্গে হবে সেইদিন সাইমন কমিশনের জবাব দিতে পারব।

 আর কিছু নয়, এটা স্পষ্ট দেখতে পেয়েছি সবই হতে পারত কিন্তু হয় নি—না হোক আমরা পেয়েছি ‘ল অ্যাণ্ড অর্ডার’। আমাদের ওখানে সাম্প্রদায়িক লড়াই ঘটে বলে একটা অখ্যাতি বিশেষ ঝোঁক দিয়ে রটনা হয়ে থাকে—এখানেও য়িহুদি সম্প্রদায়ের সঙ্গে খ্রীষ্টান সম্প্রদায়ের লড়াই আমাদের দেশেরই আধুনিক উপসর্গের মতো অতিকুৎসিত অতিবর্বর ভাবেই ঘটত—শিক্ষায় এবং শাসনে একেবারে তার মূল উৎপাটিত হয়েছে। কতবার আমি ভেবেছি আমাদের দেশে সাইমন কমিশন যাবার আগে একবার রাশিয়ায় তার ঘুরে যাওয়া উচিত ছিল।

 তোমার মতো ভদ্রমহিলাকে সাধারণ ভদ্রগোছের চিঠি না লিখে এ রকম চিঠি যে কেন লিখলুম তার কারণ চিন্তা করলেই বুঝতে পারবে দেশের দশা আমার মনের মধ্যে কী রকম তোলপাড় করছে, জালিয়ানওয়ালাবাগের উপদ্রবের পর একবার আমার মনে এই রকম অশান্তি জেগেছিল। এবার ঢাকার উপদ্রবের পর সেই রকম দুঃখ পাচ্ছি। সে-ঘটনার উপর সরকারি চুনকামের কাজ হয়েছে কিন্তু এ-রকম সরকারি চুনকামের যে কী মূল্য তা রাষ্ট্রনীতিরৎ সবাই জানে। এই রকম ঘটনা যদি সোভিয়েট রাশিয়ায় ঘটত তাহলে কোনো চুনকামেই তার কলঙ্ক ঢাকা পড়ত না। সুধীন্দ্র, আমাদের দেশের রাষ্ট্রীয় আন্দোলনে যার কোনো শ্রদ্ধা কোনদিন ছিল না, সেও এবারে আমাকে এমন চিঠি লিখেছে যাতে বোঝা যাচ্ছে সরকারী ধর্মনীতির প্রতি ধিক্কার আজ আমাদের দেশে কতদূর পর্যন্ত পৌছেছে। যা হোক তোমার চিঠি অসমাপ্ত রইল—কাগজ এবং সময় ফুরিয়ে এসেছে, পরের চিঠিতে এ চিঠির অসম্পূর্ণ অংশ সম্পূর্ণ করব। ইতি সেপ্টেম্বর ২৮, ১৯৩০।