লেখকের কথা/উপন্যাসের ধারা
উ প ন্যা সে র ধা রা
লিখতে শুরু করার আগে শুধু আশা নয়, দৃঢ় প্রতিজ্ঞাও ছিল যে, একদিন আমি লেখক হবো। তবু নিজের স্বাধীন ইচ্ছায় সাগ্রহে ছাত্র হয়েছিলাম বিজ্ঞানের, অনার্স নিয়েছিলাম অঙ্কশাস্ত্রে। আজ চর্চা নেই সময় আর সুযোগের অভাবে; কিন্তু বিজ্ঞানকে আজও সমানভাবেই ভালোবাসি।
লিখতে শুরু করেই আমার উপন্যাস লেখার দিকে ঝোঁক পড়লো। কয়েকটি গল্প লেখার পরেই গ্রাম্য এক ডাক্তারকে নিয়ে আরেকটি গল্প ফাঁদতে বসে কল্পনায় ভিড় করে এল ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’র উপকরণ এবং কয়েকদিনে একটি গল্প লিখে ফেলার বদলে দীর্ঘদিন ধরে লিখলাম এই দীর্ঘ উপন্যাসটি― এ ব্যাপারের সঙ্গে সাধ করে বিজ্ঞানের ছাত্র হওয়ার সম্পর্ক অনেকদিন পর্যন্ত অনাবিষ্কৃত থেকে যায়। মোটামুটি একটা ধারণা নিয়েই সন্তুষ্ট ছিলাম যে, সাহিত্যিকেরও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি থাকা প্রয়োজন, বিশেষ করে বর্তমান যুগে, কারণ তাতে অধ্যাত্মবাদ ও ভাববাদের অনেক চোরা মোহের স্বরূপ চিনে সেগুলি কাটিয়ে ওঠা সহজ হয়।
পরে নিজের জীবনের অভিজ্ঞতাকে ভালো করে তলিয়ে বুঝে ‘কেন লিখি?’ তত্ত্বগত দিকটার সঙ্গে মিলিয়ে নেবার প্রয়োজন জরুরী হয়ে উঠলো সমাজ ও সাহিত্যের সম্পর্ক নিয়ে নানা এলোমেলো থিয়োরি ও তার ব্যাখ্যার আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষার প্রয়োজনে। তখন অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে একটা আশ্চর্য কথাও স্পষ্ট হয়ে উঠলো যে, লিখতে আরম্ভ করার আগেও বলে দেওয়া সম্ভব ছিল —যদি কোনদিন আমি লিখি ঝোঁকটা আমার পড়বে উপন্যাস লেখার দিকে।
আমার বিজ্ঞান-প্রীতি, জাত বৈজ্ঞানিকের কেন-ধর্মী জীবন-জিজ্ঞাসা, ছাত্রবয়সেই লেখকের দায়িত্বকে অবিশ্বাস্য গুরুত্ব দিয়ে ছিনিমিনি লেখা থেকে বিরত থাকা প্রভৃতি কতগুলি লক্ষণে ছিল সুস্পষ্ট নির্দেশ যে, সাধ করলে কবি হয় তো আমি হতেও পারি; কিন্তু ঔপন্যাসিক হওয়াটাই আমার পক্ষে হবে উচিত ও স্বাভাবিক!
কথাটা কী দাঁড় করাচ্ছি? আনুষ্ঠানিকভাবে বিজ্ঞানের ছাত্র না হলে, কিঞ্চিৎ বিজ্ঞান চর্চা না করলে, উপন্যাস লেখা যায় না? আজ পর্যন্ত যাঁরা উপন্যাস লিখেছেন তাঁরা সকলেই—?
যেহেতু বিজ্ঞানের ছাত্র হয়েও আমি দু’চারখানা উপন্যাস লিখেছি সেই হেতু ওটাই হবে উপন্যাস লেখার একটা সর্ত—যেটুকু বলেছি তার এরকম যান্ত্রিক ও হাস্যকর তাৎপর্য কারো কারো মনে আসা আশ্চর্য নয়। কথাটা এখানেই পরিষ্কার করা দরকার। সরাসরি বিজ্ঞানের কিছু শিক্ষা পাওয়া নয়, উপন্যাস লেখার জন্য দরকার খানিকটা বৈজ্ঞানিক বিচারবোধ। বিজ্ঞান-শাস্ত্রের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে কিছুমাত্র পরিচয় না থাকলেও এ বিচারবোধ মানুষের আয়ত্ত হতে পারে। সমাজ ও জীবনে বিজ্ঞানের প্রত্যক্ষ প্রভাব ওতোপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। এই প্রভাবের জন্য সাধারণ অশিক্ষিত মানুষের চিন্তাজগতে, তার দৃষ্টিভঙ্গিতে বৈজ্ঞানিকের চিন্তাপদ্ধতির, বৈজ্ঞানিকের দৃষ্টিভঙ্গির ছাপ পড়েছে,—যত কম আর অস্পষ্টই সেটা হোক। বিজ্ঞানচর্চা না করেও এবং সম্পূর্ণরূপে নিজের অজ্ঞাতসারে হলেও, ঔপন্যাসিক খানিকটা বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি অর্জন করবেন তাতে বিস্ময়ের কিছুই নেই।
প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বিজ্ঞান-প্রভাবিত মন উপন্যাস লেখার জন্য অপরিহার্যরূপে প্রয়োজন। পৃথিবীর যে কোন দেশের যে কোন যুগের যে কোন উপন্যাস ধরে বিশ্লেষণ করলে লেখকের এই বৈশিষ্ট্য, বৈজ্ঞানিকের সঙ্গে এই বিশেষ ধরনের মানসিক সমতা খুঁজে পাওয়া যাবে।
সাহিত্য ও বিজ্ঞান সম্পর্কহীন নয়। সমাজের মাধ্যমে সে সম্পর্কের সূত্রগুলি পাওয়া যায়। সাহিত্যের তথাকথিত সবচেয়ে অবৈজ্ঞানিক অঙ্গ কবিতার গতিপ্রকৃতি বিজ্ঞানের সমকালীন বিকাশের সাথে কি ভাবে জড়িত তা খুঁজে বার করা কষ্টসাধ্য কাজ, কিন্তু উপন্যাসের সঙ্গে বিজ্ঞানের সম্পর্ক অনেক বেশি স্পষ্ট ও ঘনিষ্ঠ। সাহিত্যের ক্ষেত্রে উপন্যাস হলো সভ্যতার অগ্রগতির ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের প্রত্যক্ষ অবদান।
বিজ্ঞানের ক্রমবিকাশের একটা স্তর পর্যন্ত সাহিত্য ছিল, উপন্যাস ছিল না। বিজ্ঞানের ক্রমোন্নতি সমাজ জীবন ও মানুষের চেতনায় বিশেষ পরিবর্তন ঘটানোর ফলেই সাহিত্যে উপন্যাসের আঙ্গিক প্রয়োজনীয় এবং আদরণীয় হয় ।
কাব্য ও নাটকের আঙ্গিকে ভাববাদ অবাধে আত্মপ্রকাশ করেছে। কার্য ও কারণকে রাখা গিয়েছে ভাববাদেরই স্তরে, মানে খোঁজা সম্ভব হয়েছে জীবন ও জগতের। অধ্যাত্মবাদকে টেনে আনা গিয়েছে যতখানি প্রয়োজন। কিন্তু বিজ্ঞান তো ছেড়ে কথা কয় না। বিজ্ঞানকে যে যুগে যাই ভেবে থাকুক মানুষ, বিজ্ঞানের ভিত্তি চিরদিনই স্বীকৃত বা অস্বীকৃত বস্তুবাদ । যে বিশ্বাস নিয়েই বৈজ্ঞানিক চিন্তা ও গবেষণা করে থাকুন, বস্তুজগতে মানবতার বাস্তব অগ্রগতিই চিরদিন তাঁর একমাত্র লক্ষ্য।
নিত্য নতুন আবিষ্কারে বিজ্ঞান বদলে দিয়ে চলে সমাজ ও জীবনকে, বদলে দিয়ে চলে মানুষের চেতনাকে। এই চেতনায় জাগে সাহিত্যের কাছে নতুন চাহিদা এবং এই চেতনা প্রতিফলিত হয় নতুন আঙ্গিকে উপন্যাস রচনায়।
গদ্য ভাষায় সাহিত্যে এল বাস্তব জীবনের পরিবেশ, চরিত্র ও ঘটনা; নতুন পদ্ধতিতে মানুষের জীবন বোধের আকাঙ্ক্ষা মেটাতে আরম্ভ করলো উপন্যাস।
বিজ্ঞানকে, মানুষের বস্তুবাদী চেতনার ক্রমবিকাশকে, একেবারে আর উপেক্ষা করতে না পেরে সাহিত্যকে নতুন একটি বিভাগ খুলতে হলো: অধ্যাত্মবাদের জের এবং ভাববাদ আত্মরক্ষার খাতিরে যুক্তিবাদের সাহায্যে বাস্তবতাকে কাজে লাগিয়ে শুরু করলো উপন্যাসের ধারা।
যুক্তিবাদ খাঁটি দর্শনে বিশেষ খাতির পায়নি—ইতিহাস দর্শনকে যে মূল ভাগে ভাগ করেছে (অধ্যাত্মবাদ, ভাববাদ ও বস্তুবাদ) তারই নানারকম আলতো বাদ হিসাবে অনেক শাখাপ্রশাখা গজিয়েছে, যুক্তিবাদ তারই একটা।
যুক্তিবাদ কারণ দেখায় না, যুক্তি দেয়।‘এরকম হওয়া উচিত’ এটাও যুক্তিবাদের যুক্তি।
দর্শন ও বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে যুক্তিবাদের অবদান খুবই সামান্য, সাহিত্যে উপন্যাসের নব-বিধান যেন যুক্তিবাদেরই জয়গান—আপাতদৃষ্টিতে তাই মনে হয়। আসলে সেটা বস্তুবাদেরই অগ্রগতি। অধ্যাত্মবাদ, ভাববাদ এবং বস্তুবাদ কোনটাই সমসাময়িক সুবিধাবাদের নীতি মানেনি। মানবতার বিকাশের মূলনীতি ক্ষয়বৃদ্ধি এগোনো পিছানোর বাস্তব কার্যকরী নীতিকেই মেনে এসেছে।
বাদ নিয়ে বাদানুবাদের প্রবন্ধ লিখতে চাইনি। এটুকু ভূমিকা মাত্র। আমার অভিজ্ঞতায় এটুকু যাচাই হয়ে গিয়েছে গোড়াতেই। খুব সহজ করে বলতে গেলে বলা যায় যে, লেখক যে ভাব আর ভাবনাই সাজিয়ে দিন উপন্যাসে, ভিত্টা তাঁকে গাঁথতেই হবে খাঁটি বাস্তবতার। যতই খাপছাড়া উদ্ভট হোক উপন্যাসেরই চরিত্র, মাটির পৃথিবীর মানুষ হয়ে তাকে খাপছাড়া উদ্ভট হতে হবে। যত অসম্ভব ঘটনাই ঘটুক উপন্যাসে, সম্ভাব্য ঘটনাকে আশ্রয় করেই তাকে কাল্পনিক অসম্ভবতার স্তরে উঠতে হবে। উপন্যাসেও কাব্য সৃষ্টি করা যায়, কল্পনা পার হয়ে যেতে পারে বাস্তবতার সীমা, গড়ে উঠতে পারে এমন এক মানস জগৎ যার অস্তিত্ব লেখকের মন ছাড়া কোথাও নেই; কিন্তু বাস্তব মানুষ বাস্তব জীবন বাস্তব পরিবেশ অবলম্বন করেই এসব ঘটাতে হবে।
কবি-বন্ধুর মনে কথা জাগতো, কথায় তিনি তা প্রকাশ করে দেখতেন! কবিতা লিখতেন কিম্বা লিখতেন ছোটগল্পরূপী গদ্য-কবিতা। আমার মনেও কথা জাগতো, কথা তুলে রাখতাম মনেরই তাকে। বাস্তবতার আশ্রয় ছাড়া আমার কথা দাড়াবে কিসে? আরও বয়স বাড়ুক, অভিজ্ঞতা হোক, বাস্তবতাকে আরও ভালো করে জেনে চিনে আমার কথার ভিত্ গাঁথতে শিখি, তারপর মনের কথাকে বাইরে আনবো। একদিন উপন্যাস লিখবো ভাবতাম কি? মোটেই না। সোজাসুজি ভাবতাম যে, লিখতে শুরু করার আগে আমাকে আরও পাকতে হবে? উপন্যাস লিখতেই যে এই পাকামি দরকার হয় সেটা জেনেছি অনেক পরে।
প্রথম লিখলাম একটি গল্প—তাও লেখার খাতিরে নয়, কয়েকটি ছাত্রবন্ধুর সঙ্গে তর্কের ফলে সাধারণ একটা বাস্তব সত্যকে হাতে নাতে প্রমাণ করার জন্য। এ ঘটনার মধ্যেও প্রকাশ পেয়েছিল আমার ঔপন্যাসিকের ধাত,—সাধারণ যুক্তিবোধ, বাস্তব-বোধ। তর্কটা ছিল মাসিকের সম্পাদক মশাইদের অবিবেচনা, উদাসীনতা, পক্ষপাতিত্ব ইত্যাদি দোষ নিয়ে। সম্পাদকেরা কিরকম জীব কিছুই জানতাম না, কিন্তু ভালো একটা লেখা হাতে পেলেও শুধু লেখকের নাম নেই বলেই লেখাটা তাঁরা বাতিল করে দিয়ে থাকেন, এটা কোনমতেই মানতে পারিনি। কোন যুক্তিই খুঁজে পাইনি সম্পাদকদের এই অর্থহীন অদ্ভুত আচরণের। ভালো লেখার কদর নেই কদর আছে শুধু নাম করা লেখকের এ তো স্রেফ পরস্পরবিরোধী কথা। যদি ধরা যায় যে, ভালো গল্প লেখা অতি সহজ, গাদাগাদা ভালো গল্প তৈরি হওয়ায় সম্পাদকের কাছে তার বিশেষ কোন চাহিদা নেই— তা হলে নাম-করা লেখকের নামেরও কোন মানেই থাকে না। এত সোজা কাজ করার জন্য নাম হয় কিসে?
ভালো লেখা অন্যান্য কারণে সম্পাদকীয় অবজ্ঞা লাভ করতে পারে, লেখক নতুন বলে কখনোই নয়! এই সত্যটা প্রমাণ করার জন্য নিজে একটি গল্প লিখেছিলাম।
সাহিত্যজগতের সঙ্গে কোনরকম যোগাযোগ না থাকলেও উপলব্ধি করেছিলাম যে, সাহিত্যের জগৎও মানুষেরই জগৎ, সংসারে সাধারণ নিয়মকানুন সাহিত্যের জগতে বিপরীত হয়ে যেতে পারে না। মোটামুটি ভালো এক গল্প লিখলে যে কোন সম্পাদক যে সেটা নিশ্চয় সাগ্রহে ছাপবেন এ বিষয়ে এমনই দৃঢ় ছিল আমার বিশ্বাস যে তখনকার সেরা তিনটি মাসিকের যে কোন একটিতে ছ'মাসের মধ্যে আমার গল্প বার করা নিয়ে বাজী রাখতে দ্বিধা জাগেনি। কবি মনের ঝোঁক নয়, ঔপন্যাসিকের প্রতীতি—যা আসে বাস্তব হিসাব নিকাশ থেকে।
গল্পটা লেখার মধ্যে ছিল এই বাস্তব বিচার বিবেচনা, কি হয় আর কি না হয় তার হিসাব। এর মধ্যেও সন্ধান পাওয়া যাবে যে, ভবিষ্যৎ ঔপন্যাসিক একদিকে কিরকম নির্বিকার নিরপেক্ষভাবে বাস্তবতার সমগ্রতাকে ধরবার চেষ্টা করেন, অন্যদিকে তারই মধ্যে বজায় রেখে চলেন আবেগ অনুভূতির সততা—মোহহীন মমতাহীন বিশ্লেষণে সত্যকে যাচাই করে নিয়ে তার মধ্যে প্রাণের সঞ্চার করেন (যার যেমন বিশ্লেষণ ও যার যেমন প্রাণ!)। প্রথমে হিসাব করেছিলাম কি ধরনের গল্প লিখবো। সবদিক দিয়ে নতুন ধরনের নিশ্চয় নয়! একেবারে আনাড়ি, হঠাৎ একদিন কলম ধরে নতুন টেকনিকে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে নতুন বিষয়ের গল্প খাড়া করা সম্ভবও নয়, বেশি ‘নতুনত্ব’ সম্পাদকের পছন্দ নাও হতে পারে। ভেবেচিন্তে স্থির করেছিলাম যে, রোমাণ্টিক গল্প লেখাই সবচেয়ে সহজ, এরকম গল্প জমে গেলে সম্পাদকেরও চট করে পছন্দ হয়ে যাবে।
আদর্শ অপার্থিব প্রেমের জমকালো গল্প ফাঁদতে হবে। কিন্তু সমস্তটাই আজগুবি কল্পনা হলে তো গল্প জমবে না, বাস্তবের ভিত্তিও থাকা চাই গল্পের। কি হবে এই ভিত্তি? কাহিনী যদি দাঁড় করাই প্রেমাত্মক অবান্তর কল্পনার, গল্পের চরিত্রগুলিকে করতে হবে বাস্তব রক্ত-মাংসের মানুষ।
অতিজানা অতিচেনা মানুষকে তাই করেছিলাম ‘অতসী মামী’র নায়ক নায়িকা। সত্যই চমৎকার বাঁশি বাজাতেন চেনা মানুষটি, বেশি বাজালে মাঝে মাঝে সত্যই তাঁর গলা দিয়ে রক্ত পড়তো এবং সত্যই তিনি ছিলেন আত্মভোলা খেয়ালী প্রকৃতির মানুষ। ভদ্রলোকের বাঁশি বাজানো সত্যই অপছন্দ করতেন তাঁর স্ত্রী, মাঝে মাঝে কেঁদে কেটে অনর্থ করতেন।
শুধু এটুকু নয়। সত্যই দু'জনে তাঁরা একেবারে মশগুল ছিলেন পরস্পরকে নিয়ে। এঁদের দেখেছিলাম খুবই অল্প বয়সে, সেই বয়সেও শুধু এঁদের কথা বলা, চোখে চোখে চাওয়া দেখে টের পেতাম অন্যান্য অনেক জোড়া চেনা স্বামী-স্ত্রীর চেয়ে এঁদের মধ্যে বাঁধনটা ঢের বেশি জোরালো, সাধারণ রোগে ভুগে ভদ্রলোক মারা গেলে কিছুকালের জন্য তাঁর স্ত্রী পাগল হয়ে গিয়েছিলেন।
অতসী মামী লিখবার সময় এঁদের দু’জনকে আগাগোড়া মানস চোখের সামনে রেখেছিলাম। শুধু তাই নয়। সোজাসুজি কাহিনীটা লিখে না গিয়ে নিজে আমি অল্পবয়সী একটি ছেলে হয়ে গল্পের মধ্যে ঢুকে তার মুখ দিয়ে গল্পটা বলেছিলাম।
আমার এই প্রথম গল্পের কাহিনী হাস্যকর রকমের রোমাণ্টিক কল্পনা। আজও যখন ট্রেন দুর্ঘটনার রাত্রে প্রতিবছর অতসী মামীর রেললাইনের ধারে নির্জন মাঠে একাকিনী সারা রাত মৃত প্রিয়ের সঙ্গ অনুভব করতে যাওয়ার কথা ভাবি, আমার নিজেরই হাসি পায়। এমনি ভাবতে গেলে হাসি পায়, কিন্তু আজও গল্পটি প্রথম থেকে পড়ে গেলে আর মনে মনেও হাসবার সাধ্য হয় না।
কারণ, কাহিনী রূপকথা হলেও নায়ক-নায়িকা জীবন্ত মানুষ, উদ্ভটভাবে হলেও কাহিনীতে প্রতিফলিত হয়েছে মাটির পৃথিবীর ছুটি মানুষের বাস্তব প্রেম।
আমার এই আদি গল্পের মোট কথা আর সাহিত্যের আদিম উপন্যাসের মোট কথা একই—কল্পনার রূপায়নের জন্য বাস্তবকে আশ্রয় করা। উপন্যাসে বাস্তবের ক্ষেত্র হয় আরও ব্যাপক ও প্রসারিত― অনেক রকমের অনেক মানুষকে তাদের বাস্তব জীবন ও পরিবেশ সমেত টেনে এনে কাহিনী ফাঁদতে হয়। এই বৈশিষ্ট্যের জন্যই কবিতার চেয়ে উপন্যাসে ভাববাদী কল্পনার স্থান বস্তুবাদী কল্পনা অনেক সহজে ও দৃঢ়ভাবে দখল করছে।