লেখকের কথা/নতুন জীবন
নতুন জীবন
‘নতুন জীবন’ যৌনতত্ত্ব ও স্বাস্থ্য সম্পর্কিত মাসিক পত্রিকা। অনেকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, এত এত সাহিত্য পত্রিকা থাকতে যৌনতত্ত্ব ও স্বাস্থ্যবিষয়ক পত্রিকার প্রসঙ্গ কি জন্য?
একটি কারণ এই যে, নতুন জীবনের পৃষ্ঠাগুলি প্রধানতঃ যা দিয়েই ভরা থাক, এটিও সাহিত্য পত্রিকাই। আমার বিবেচনায়, কেবল গল্প কবিতা উপন্যাস বোঝাই অনেক তথাকথিত সাহিত্য পত্রিকার চেয়ে উচ্চাঙ্গেরও বটে। গল্প উপন্যাসও নতুন জীবনে কিছু কিছু স্থান পেয়ে আসছে, যদিও সেগুলি একটু বিশেষ ধরনের, উদ্দেশ্যমূলক।
আর একটি কারণ, নতুন জীবনই একমাত্র পত্রিকা যা বাংলা ভাষায় এই ধরনের সাময়িকপত্রের অভাব মেটাবার আদর্শ সামনে রেখে সক্রিয় প্রচেষ্টা করে আসছে বলা যেতে পারে। যৌন ও স্বাস্থ্যবিজ্ঞান সম্পর্কে প্রথম শ্রেণীর একটি জনপ্রিয় সাময়িক পত্রের অভাব নতুন জীবন মেটাতে পেরেছে বলতে পারি না, কিন্তু ভালো জিনিষ পরিবেশন করে সত্যসত্যই পাঠকের উপকার করার আন্তরিক প্রেরণা এই পর্যায়ের মাসিকগুলির মধ্যে নতুন জীবনেই খুঁজে পেয়েছি। অন্য যে পত্রিকা আমি দেখেছি তাতে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির এবং যৌন ও স্বাস্থ্য বিষয়ে সাধারণ মানুষের প্রয়োজনীয় জ্ঞান পরিবেশনের ভানটাই শুধু আছে—বিকারগ্রস্ত মানুষের মনে নিষিদ্ধ অশ্লীল বিষয় নিয়ে নাড়াচাড়া করার যে চুলকানি আছে সেটা উস্কে পত্রিকা চালনাই অনেকের আসল উদ্দেশ্য। এমন কি বিজ্ঞানপন্থী পত্রিকা বলে ঘোষিত হলেও যৌনব্যাধি ও স্বাস্থ্যহানির হাতুড়ে ওষুধ আর মাছলি তাবিজের লোকঠকানো স্পষ্ট জুয়াচুরির বিজ্ঞাপনও এই সমস্ত পত্রিকায় অনায়াসে স্থান পায়।
এবিষয়ে নতুন জীবনের সম্পাদকের নিষ্ঠা প্রশংসনীয়। ফাঁকিবাজি বিজ্ঞাপন—পয়সা যাতে বেশি মেলে তাঁর কাগজে ছাপা হয় না। অতি সহজে আইন বাঁচিয়ে বিজ্ঞাপনের এই ঘৃণিত ব্যবসায়ের বিরুদ্ধে নতুন জীবন জেহাদ ঘোষণা করেছে। সমস্যাটা সত্যই তুচ্ছ নয়। শুধু লক্ষ লক্ষ রুগ্ন হতাশ মানুষের জীবনটাই এই প্রবঞ্চকে দল ব্যর্থ করে দিচ্ছে না, সমাজের নৈতিক জীবনের ভিত্তিমূলেও এরা আঘাত হানছে। এ দুর্ভাগা দেশের অন্য বড় বড় সমস্যাগুলির মতো এ সমস্যারও আসল মীমাংসা অবশ্য রাষ্ট্র ও সমাজের সেই পরম সংস্কারে। কিন্তু কাগজে কাগজে এদের বিরুদ্ধে লড়বার, মানুষকে এদের সম্বন্ধে সচেতন করে তুলবার চেষ্টার প্রয়োজনও কম নয়। কুৎসিত বিজ্ঞাপনের আলোচনাও কুৎসিত হবে—এই আশঙ্কাতেই কি বড় বড় পত্রিকায় অন্য সব বিষয়ে আলোচনা থাকলেও এবিষয়ে কখনো আলোচনা হয় না? অথবা অন্য কারণ আছে? যৌন বিষয়ে কতগুলি প্রাথমিক জ্ঞানের অভাব মানুষের পক্ষে যেমন ক্ষতিকর, অজ্ঞ সংস্কারবদ্ধ ভাবপ্রবণ মানুষকে সেই যৌনজ্ঞান দেবার প্রক্রিয়া ভুল হলে তাও কম বিপজ্জনক হয় না। এ বিষয়ে সম্পাদক ও পরিচালকদের দায়িত্ব গুরুতর। অল্পবিদ্যা ভয়ংকরী হবার সম্ভাবনাই থাকে বেশি এবং নতুন জীবনের মতো সাধারণের উপযোগী পত্রিকার পক্ষে পাঠক-পাঠিকাকে অল্পবিদ্যার বেশি কিছু দেওয়া চেষ্টা করেও সম্ভব নয়। তাই কঠোর নিষ্ঠা ও অখণ্ড সতর্কতার প্রয়োজন অত্যন্ত বেশি যাতে লব্ধ জ্ঞানটুকু পাঠক-পাঠিকার সত্যই কাজে লাগে, তাদের বিভ্রান্ত না করে দেয়।
নতুন জীবনের অনেকগুলি লেখায় একটি মূলনীতি অনুসরণ করা হয়েছে বোঝা যায়, যা থেকে এই অপরিহার্য সতর্কতা সম্পর্কে সম্পাদককে সচেতন মনে হয়। লেখকদের দায়িত্বজ্ঞানেরও পরিচয় মেলে। আমাদেরই প্রাত্যহিক ব্যবহারিক জীবনে কার্যকরী জানবার কথায় আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখার প্রচেষ্টা লেখাগুলিতে করা হয়েছে। শিশুর যৌনবোধ নিয়ে আলোচনার উদ্দেশ্য স্পষ্টতঃ এই যে, শিশুর যৌনবোধের অস্তিত্ব ও স্বরূপকে ছেলেমেয়ে মানুষ করার জন্য বড়দের যতখানি মানা ও জানা দরকার ততখানিই মানিয়ে ও জানিয়ে দেওয়া। এ লেখায় অনায়াসে জটিলতা এসে সংশয় ও ভ্রান্তির সৃষ্টি করা চলতো। স্বাভাবিক যৌনশক্তি লাভের কয়েকটি সহজ ও প্রত্যক্ষ ফলপ্রদ উপায় শিরোনামা দেখে আতঙ্ক হয়েছিল। সংক্ষিপ্ত প্রবন্ধটি পড়ে খুশি হলাম, লেখককে মনে মনে ধন্যবাদও জানালাম। সহজ ও স্পষ্টভাবে কাজের কথা লেখা কঠিন, বিষয়টি নিয়ে ফেনিল আলোচনার প্রলোভন সত্যই প্রবল।
সব লেখায় এ নীতি বজায় থাকেনি। সহজ জানবার কথার সঙ্গে মিশ্রণ ঘটেছে কঠিন তথ্যের। ফলে লেখাগুলি সামঞ্জস্য হারিয়েছে। কেবল সহজ বোধ্য কথা নিয়েই আলোচনা থাকবে, উঁচুস্তরের জ্ঞান বিজ্ঞানের কথা থাকবে না, তা বলছি না। কিন্তু একই লেখার খানিকটা সাধারণ পাঠকের বোধগম্য করতে চেয়ে বাকিটা দুর্বোধ্য রেখে পাঠকের মনে বিপর্যয় সৃষ্টি করা অসঙ্গত মনে হয়। কঠিন বিষয়ে লেখায় একটি নিয়ম অবশ্য পালনীয়: যে শ্রেণীর পাঠকের জন্য লেখা রচনাটি যেন সেই এক শ্রেণীর পাঠকেরই উপযোগী হয়। একটি লেখাকে অজ্ঞ ও জ্ঞানী সকলেরই পাঠযোগ্য করতে চাওয়ার মানে হয় না। একই বিষয়ে ছুটি লেখা প্রকাশ করাও বরং তার চেয়ে শ্রেয়। তা যদি সম্ভব না হয়, লেখার আগা গোড়া অধিকাংশ পাঠকের জ্ঞান বুদ্ধির অভিজ্ঞতার পক্ষে গ্রহণযোগ্য করা না যায়, তবে প্রবন্ধটি মুষ্টিমেয় সেই ক'জনের জন্যই লেখা হোক—গ্রহণ করার ক্ষমতা যাদের আছে। সাময়িক পত্রে এরকম দু'একটি লেখা থাকা দোষের কিছু নয়। সাধারণ পাঠকের গ্রহণযোগ্য আরও রচনা তো আছে। ছুটি একটি দুর্বোধ্য লেখা সাধারণ পাঠকের উপকার ছাড়া অপকার করে না। লেখাটি বুঝবার জন্য কারো কারো মনে ও-বিষয়ে পড়াশোনা করে নিজেকে তৈরি করে নেবার আকাঙ্ক্ষা জন্মে। কিন্তু কিছু বোঝা আর কিছু না-বোঝা তার পক্ষে প্রায়ই ক্ষতিকর। কিন্তু বোঝাটাই অর্থহীন। কোন জ্ঞাতব্য বিষয়েই খানিকটা টুকরা ভেঙে নিয়ে মানুষ আত্মসাৎ করতে পারে না। কিছু বোঝার মানে তার ভুল ধারণার সৃষ্টি হওয়া যে সে সব বুঝেছে। 'নিজের ধারণা ও কল্পনা দিয়ে সে তারপর সমগ্র ভ্রান্তি গড়ে তুলবে। ‘সঙ্কর রক্ত কি সত্যই প্রতিভার সৃষ্টি করে?′ লেখাটিতে সামঞ্জস্যের এই অভাব।
বরং ‘সঙ্গীতে যৌনতা’র বিষয় বস্তু আরও বেশি সূক্ষ্ম ও গভীর হলেও লেখাটিতে অনেকটা সামঞ্জস্য আছে—যতখানি বিদ্যা বুদ্ধি সম্পন্ন পাঠককে সামনে ধরে লেখক লিখতে শুরু করেছেন শেষ পর্যন্ত মোটামুটি তাকেই সামনে খাড়া রেখেছেন। ‘আধুনিক প্রেমের কবিতা’র সম্বন্ধে এ কথা বলতে পারলাম না। পুরুষ কি নারীতে তৃপ্ত?' প্রবন্ধটিতে বহু বিতর্কের উপাদান থাকলেও পাঠকের মনে নতুন ভ্রাস্তি সৃষ্টির সহায়তা করে না।
নতুন জীবনের পথ নতুন। সাহিত্য ও সমাজপ্রীতির আদর্শ যত জোরালো হবে পথ ততই প্রশস্ত ও দীর্ঘ হবে।