লেখকের কথা/প্রতিভা
প্র তি ভা
প্রতিভা সম্পর্কে সাধারণ লোকের—এবং স্বয়ং প্রতিভাবানদেরও—ধারণা আছে ওটা এক ঈশ্বরদত্ত রহস্যময় জিনিস। প্রতিভাকে এরকম রহস্যময় পদার্থ মনে করার ফলে লেখক-কবিদের এ জিনিসটার ওপর প্রায় একচেটিয়া অধিকার জন্মে গিয়েছে। বড় বৈজ্ঞানিকের ‘বৈজ্ঞানিক প্রতিভা’ থাকে কিন্তু বড় একজন কবি নিজেই প্রতিভা। বৈজ্ঞানিকের বেলা প্রতিভার অর্থ বিশেষ ক্ষমতা, কবির বেলা প্রতিভার অর্থ দুর্বোধ্য একটা গুণ। এর কারণটা অনুমান করা সহজ—লেখক-কবিদের সাধারণ লোক মানুষের পঙক্তি থেকে তফাতে সরিয়ে এক বিশেষ শ্রেণীর রহস্যময় জীব করে রেখেছে। এরকম ধারণা সৃষ্টির জন্য দায়ী অবশ্য লেখক-কবিরাই।
কিন্তু সেটা কে খেয়াল রাখে? লেখক-কবিরা তো খুশি হয়ে গর্বের সঙ্গে তাঁদের সম্বন্ধে সাধারণের এই ধারণাকে গ্রহণ করে নিজেদের সম্পর্কে নিজেদের ধারণায় পরিণত করে নিয়েছেন—তাঁদের প্রতিভা স্বতন্ত্র, অন্য সবরকম গুণী থেকে তাঁরা পৃথক। বৈজ্ঞানিক, দার্শনিক, নেতা, গায়ক, অভিনেতা, চিত্রশিল্পী সকলে গুণী—লেখক-কবি গুণীর মধ্যে গুণী, তাঁর জাতই আলাদা। তা, একথা কে অস্বীকার করবে যে, ছবি আঁকতে পারা আর কবিতা লিখতে পারা দু’রকমের গুণ। লেখক-কবিরা এটুকু মানতেও রাজী নন। ছবি আঁকা যদি গুণ হয়, তবে কবিতা গল্প-লেখা গুণই নয়, দুর্লভ দুর্বোধ্য একটা কিছু ! কেন, মানুষ কি যুগ যুগ ধরে মেনে আসছে না সাধারণ কোন সংজ্ঞাই তাঁদের প্রতি প্রযোজ্য হতে পারে না ?
তাঁরা ঠিক মানুষ নন, তাঁদের প্রতিভার মানে নেই। অথচ, কথাটা যে কি সাংঘাতিক তলিয়ে বুঝতে গেলে গা শিউরে উঠবে !
যুগ যুগ ধরে মানুষের রহস্যময় অন্তর্লোকের সন্ধান জানিয়ে জানিয়ে, সাধারণ বুদ্ধিতে অগম্য অনাগত ভবিষ্যৎকে অনুভূতির সঙ্কেতে প্রকাশ করে করে, হৃদয়ে হৃদয়ে আনন্দ বেদনার হিল্লোল জাগিয়ে জাগিয়ে এবং নিজেকে সযত্নে লোকচক্ষুর আড়ালে লুকিয়ে রেখে ও মাঝে মাঝে শুধু অসাধারণ অলোকসামান্য কথাবার্তা চালচলন ব্যবহারের মধ্যে খানিক খানিক আত্মপ্রকাশ করে জনতার মধ্যে নিজেদের সম্পর্কে যে মিথ্যা মোহ, ভ্রান্তধারণা বহুকাল ধরে লেখক-কবিরা সৃষ্টি করে এসেছেন, আজ বৈজ্ঞানিক বাস্তবতার যুগে সেই জালে আটক পড়ে তাঁদের বিপদের সীমা নেই। কাব্য সাহিত্যের আসরে পর্যন্ত বিজ্ঞান এসে জুড়ে বসছে, ঠুনকো রঙীন কাঁচের মতো ভেঙে পড়ছে ঈশ্বরের দুর্গের দেয়াল থেকে কাব্যলক্ষ্মীর অন্দরমহলের দেয়াল, জীবন থেকে ঝেঁটিয়ে সাফ করা হচ্ছে ভ্রান্তির জঞ্জাল, বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি ছাড়া আজ আর কলম ধরার উপায় নেই। কিন্তু পুরুত-মোল্লা-পাদরীদের মতো লেখক-কবিদের হয়েছে বিষম বিপদ। যুগ যুগ ধরে সযত্নে সৃষ্টি করা জনতার যে সংস্কার ভিত্তি করে এতকাল তাঁরা দাঁড়িয়ে ছিলেন, আজ নিজের হাতে কেমন করে সে ভিত্তি ভেঙে দেবেন, দাড়াবেন কোথায়! ভিত্তি কিন্তু ভেঙে যাচ্ছে, কে ঠেকাবে? নতুন ভিত্তিও তৈরি হচ্ছে। জনতার যে সংস্কারের প্রতিক্রিয়া ছিল, লেখক-কবিরও পুরনো সংস্কার, একটাতে ভাঙন ধরার সঙ্গে স্বভাবতঃই অন্যটাতেও ভাঙন ধরে। কিন্তু সমস্যা এখনো মেটেনি—এখনই বরং সমস্যাটার সবচেয়ে উৎকট অবস্থা। জনতার পুরনো ধারণা ভাঙতে শুরু করায় গোড়ার দিকে বরং লেখক-কবির পক্ষে সম্ভব ছিল নিজের ধারণা না বদলিয়েও পুরনো কায়দাতেই জনতাকে খুশি রাখা—গণ-বিক্ষোভের গোড়ার দিকে যেমন রাজা মহারাজা মালিকের পক্ষেও দেশভক্ত সেজে জনসভায় বক্তৃতা দিয়ে জনতাকে খুশি করা সম্ভব। আজ আর সে অবস্থা নেই। আজ লেখক-কবিকে নিজের সম্পর্কে নিজেরই পুরনো ধারণা ও বিশ্বাস ছেঁটে ফেলতেই হবে, নতুবা তাঁর ব্যবসা চলে না।
মনের জগতে জনসাধারণকে মোহগ্রস্ত প্রজা করে রেখে পরম মাননীয় রাজা সেজে রাজত্ব করা আজ অসম্ভব হয়ে গিয়েছে। রাজসিংহাসন ত্যাগ করে রাজার মনোভাব নিয়ে নেতা হবার পর্যন্ত উপায় নেই।
মানুষের সমাজে নিজেদের আজ মানুষ বলেই ভাবতে হবে, প্রতিভাকে দেখতে হবে প্রতিভা বলেই। আজ তাই লেখক-কবির পক্ষেও দরকার হয়ে পড়েছে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টি নিয়ে নিজেকে আর নিজের প্রতিভাকে যাচাই করা—সত্য যেমনি হোক অভিমানে কাতর না হয়ে তা মেনে নিতে হবে। মাথা নিচু করে এই মূল সত্যটিকে মেনে নিতে হবে যে, কবিতা লেখাও কাজ, ছবি আঁকাও কাজ, গান করাও কাজ, চাকা ঘোরানোও কাজ, তাঁত চালানোও কাজ এবং কাজের দক্ষতা শুধু কাজেরই দক্ষতা—মানুষ হয়ে জন্মে কারো সাধ্য নেই অমানুষিক প্রতিভার পরিচয় দিয়ে অতিমানব হয়ে যাবে। কি ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি!
তবে হ্যাঁ, কাজের তারতম্য আছে। দক্ষতারও তারতম্য আছে। শুধু এইটুকু।
প্রতিভা ওই দক্ষতা অর্জনের বিশেষ ক্ষমতা। আর কিছুই নয়।
কোন বিশেষ প্রতিভা নিয়ে কেউ জন্মায় না। ভ্রূণে প্রতিভার বীজ—অর্থাৎ বিশেষ দক্ষতার জন্য বিশেষ শক্তি অর্জনের যে ভবিষ্যৎ পরিণতি তার সম্ভাবনা—থাকতে পারে কিন্তু ওটা নিছক বীজ। এবং এমনই বীজ যে তা কোন্ নির্দিষ্ট গাছে পরিণত হবে সেটা অনির্দিষ্টই থাকে। সাধারণ গাছের বেলায় তা অনির্দিষ্ট নয়,—বীজটা বট গাছেরই তবে কিনা দেখে চিনতে পারা যাচ্ছে না। প্রতিভার বেলায় অন্য। সে বীজ থেকে যে-কোন গাছ হতে পারে। আঁতুড়ে রবীন্দ্রনাথকে দেখে কারো পক্ষে বলে দেওয়াই অসম্ভব ছিল যে, এককালে তিনি প্রতিভাবান কবি হবেন; শুধু তাই নয়, কবিই যে তিনি হবেন এমন কোন সুনির্দিষ্ট সম্ভাবনাই ছিল না। আইনস্টাইন হতে পারতেন, জওহরলাল হতে পারতেন—আবার কিছু নাও হতে পারতেন! কবিতা লেখায় দক্ষতা অর্জনের পথে তাঁর প্রতিভার বিকাশ হয়েছে পরে, তাঁরই জীবনযাপনের সর্বাঙ্গীন প্রক্রিয়ার মধ্যে।
আসল কথাটা এই: দুটি জিনিস নিয়ে প্রতিভা—দেহের উপকরণাদির উৎকর্ষ এবং আঁতুড় থেকে (হয়তো ভ্রূণের অবস্থা থেকেই—ভ্রূণের ওপর মায়ের মারফতে বাইরের প্রভাব কতটা হয় এখনো বেশি জানা যায়নি) প্রতিটি মুহূর্তের প্রভাব—ঘরের বাইরের কাজের অকাজের প্রত্যেক মুহূর্ত। সব মিলিয়ে এই প্রভাব কিভাবে একদিকে হৃদয় মনের বিশেষ গড়ন দেয় আর অন্যদিকে হৃদয়-মনের চলতি ক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করে, আজকের অসম্পূর্ণ মনোবিজ্ঞান তার যতগুলি নিয়মকানুন আবিষ্কার করেছে প্রতিভার স্বরূপ জানার পক্ষে আজ তাই যথেষ্ট। শিশুকাল থেকে দুরন্ত অবাধ্য অমনোযোগী ছেলে হঠাৎ বদলে গিয়ে যখন অসাধারণ প্রতিভাবান বৈজ্ঞানিকে পরিণত হয় তখন স্বভাবতঃই আমাদের বিশ্বাস করতে ইচ্ছা হয়—বৈজ্ঞানিকের প্রতিভা ছেলেটির মধ্যে ‘লুকিয়ে’ ছিল, যেদিন থেকে সে ভালো ছেলে হয়েছিল সেদিন থেকে ওই প্রতিভার বিকাশ শুরু হয়। কিন্তু খুঁজলে দেখা যাবে প্রতিভার বিকাশ তার হচ্ছিল ছেলেবেলা থেকেই, যতই দুরন্ত হোক আর স্কুলের পড়ায় মন দিতে না চাক, মন তার জিজ্ঞাসু হয়েই উঠছিল ক্রমে ক্রমে, জবাব পাবার জিদটাও চড়ছিল দিন দিন। মানুষ বদলায় কিন্তু হঠাৎ বদলায় না, হঠাৎ কোন যোগাযোগে বদলাবার প্রেরণাটাই শুধু আসা সম্ভব। বদলটাও শুধু এই নীতিতেই ঘটতে পারে যে, ছেলেটির গাছের ডালে পাখির বাসায় কি আছে খুঁজে বার করবার প্রবৃত্তিটা বইয়ে কি লেখা আছে জানবার ইচ্ছায় এবং তা থেকে অণু ভেঙে লুকনো শক্তি কি করে বার করা যায় তার পরীক্ষা করার সাথে পরিণত হতে পারে। মানুষ কেন হাসে কাঁদে ভালোবাসে ঘৃণা করে জানবার সাধ জেগে দার্শনিক বা কবি বা লেখকও ছেলেটি হতে পারতো।
অবশ্য শুধু জিজ্ঞাসু মন নয়, আরও অনেক কিছুই নিয়ন্ত্রণ করতো তার প্রতিভাবান বৈজ্ঞানিক বা দার্শনিক বা কবি-লেখক হওয়াটা। প্রতিভাবিহীনদের চেয়ে খানিকটা বেশি মস্তিষ্ক থাকারও প্রয়োজন হতো। জন্মাবামাত্র রবীন্দ্রনাথ কিংবা আইনস্টাইনের স্থানে আরেকটি নবজাত শিশুকে এনে বসিয়ে দিলে এবং সে এক তিল এদিক ওদিক না করে অবিকল ওদের জীবনের অনুকরণ করে বড় হলেই যে একদিন রবীন্দ্রনাথ বা আইনস্টাইন হয়ে উঠতো তা নয়। অণুগুলি যেভাবে সংযোজন করে দেহটি গঠিত হয়েছে,— সেটুকুকেও যদি প্রতিভার ঈশ্বরদত্ত দিক বলা হয়, আমি তাও মানতে রাজী হবো না—পূর্বপুরুষদত্ত এই বিশেষণ প্রয়োগ করবো।
প্রতিভা আসলে এক। বৈজ্ঞানিক আর কবির প্রতিভার মৌলিক পার্থক্য কিছুই নেই—পার্থক্য শুধু বিকাশ আর প্রকাশে। স্কুলে কলেজে লেবরেটরিতে বৈজ্ঞানিকের শিক্ষা, গবেষণা, আবিষ্কার। জীবনের স্কুলে লেখক-কবির শিক্ষা, হৃদয়মনের লেবরেটরিতে চিন্তা আর অনুভূতিকে শব্দে রূপান্তরিত করার পরীক্ষা, কবিতা সৃষ্টি। বৈজ্ঞানিকের কাজে মনের চর্চাটা বেশি, লেখক-কবির হৃদয়ের চর্চা। প্রতিভার যা মূল কথা, মনোনিবেশের শক্তি, সেটা কারো কম নয়। লেখক-কবির কাজে যে হৃদয়টা বেশি লাগে বলেছি ওটা শুধু কথার কথা, আসলে সবই মনের খেলা। মনের কতকগুলি বিশেষ ব্যাপারকেই হৃদয় বলা হয়, হৃদয় বলে স্বতন্ত্র কোন পদার্থই নেই। বুকের যেখানটায় হৃদয় আছে বলা হয়, বিশেষ অবস্থায় যেখানটা টন টন বা ধুপ্ ধুপ্ করে, সেখানে শরীরের একটা বিশেষ অংশ অবস্থা বিশেষে কমবেশি সাড়া দেয়- ব্যথা, না ভয়, না প্রেম কিসে সাড়া দিলো না জেনেই। মন বলি বা বুদ্ধি বলি বা মস্তিষ্ক বলি, বৈজ্ঞানিকও সেটাই খাটান, কবিও সেটাই খাটান—নিজের নিজের কাজে। চিন্তায় মগ্ন বৈজ্ঞানিক আর লেখায় মগ্ন লেখক-কবির আশেপাশের জগৎ ভুলে যাওয়া মগ্নতা, সাধারণ জীবনে অন্যমনস্ক ভাব, ইত্যাদি এক জিনিস। আজ লেখক-কবি বৈজ্ঞানিকের আরও ঘনিষ্ঠ হওয়া নয়, একাকার হয়ে যাবার দিন এসেছে। জনতার তাই দাবি। লেবরেটরিতে পরমাণুর শক্তিকে মুক্তি দিতে পারার মধ্যেই বৈজ্ঞানিককে তার কর্তব্য শেষ করতে দিতে মানুষ আর রাজী নয়। মানুষ আজ দাবি করতে শুরু করেছে, আণবিক বোমা নয়, তোমার ওই পরমাণুর শক্তি আমার কি কাজে লাগে বাতৎলিয়ে দাও। বৈজ্ঞানিক টের পাচ্ছেন, দাবি হুকুম হয়ে উঠলো বলে,—সে হুকুম অমান্য করা চলবে না। নিছক বৈজ্ঞানিক হয়ে থাকা আর চলবে না বেশি দিন, লেখক-কবির মতো মানুষকে ভালোবাসতে শিখতে হবে, গবেষণার খাতিরে গবেষণা চালাতে হবে। আর লেখক-কবিও টের পাচ্ছেন যে, নিছক হাসি-কান্নার আরক আর ভূমার মূলধনে প্রেম চলবে না মানুষের সঙ্গে, বৈজ্ঞানিকের মতো মানুষের রোগ উপবাস লড়াই নিয়ে গবেষণা করা ছাড়া উপায় নেই ।
সেজন্য নিজেকে সাধারণ মানুষ ভাবা ছাড়াও আমার পথ নেই। জনসাধারণ সাধারণ আর আমি অসাধারণ, কারণ আমি লেখক, এ ধারণা নিয়ে ভালোবাসতে গেলে মানুষ কাছে ঘেঁষতে দেবে না, মানবপ্রেমে বুক ফেটে যাওয়া বেদনার সৃষ্টিও গ্রহণ করবে না। তাই সাহিত্যে প্রগতি আনার খাতিরে, গণসাহিত্য সৃষ্টির জন্য প্রাণের ছটফটানি মেটানোর জন্য অগত্যাই আজ সবার আগে লেখক-কবিকে এই চিন্তাটা স্বভাবে পরিণত করতে হবে—আমি দশ জনের একজন।
তাতে দোষের কিছু নেই। প্রতিভাও তো জনসাধারণের সম্পত্তি। জনসাধারণ না থাকলে কারখানার উৎপাদনের যেমন মানে হয় না, প্রতিভার উৎপাদনও তেমনি অর্থহীন হয়ে যায়। প্রতিভার মালিককে জনসাধারণ কত যে শ্রদ্ধা সম্মান দিয়েছে তার সীমা হয় না, ভবিষ্যতেও চিরকাল দিয়ে যাবে, কিছু শ্রদ্ধা সম্মান ফিরিয়ে দেওয়াই তো উচিত। তবে মুস্কিল এই, যাকে নিচু ভাবি তাকে ঠিক ভালোবাসাও যায় না, শ্রদ্ধা ও সম্মানও করা যায় না। সেজন্য আগে নিজের মিথ্যা অহঙ্কারটা ছাঁটা দরকার।