লেখকের কথা/প্রেস মালিকদের ষড়যন্ত্র

প্রেস মালিকদের ষড়যন্ত্র


 বাংলার সংস্কৃতিকে বেঁচে থাকতে হয়েছে রাষ্ট্রশক্তির চরম ঔদাসীন্য ও সক্রিয় প্রতিকূলতা এবং প্রতিক্রিয়াপন্থীদের গোপন ও প্রকাশ্য শত্রুতার সঙ্গে সংগ্রাম করে। আজ যখন সংস্কৃতির সংকট ও সংগ্রাম চরমে উঠেছে গৃহযুদ্ধের বীভৎস আবহাওয়ায়, শোষণে পেষণে স্বাধীনতা হরণে ও অদূর ভবিষ্যতে বঙ্গ-ভঙ্গরূপী অপমৃত্যু দাবির সম্ভাবনায়, তখন পিছন থেকে অতর্কিত এক আক্রমণ এল। প্রেস মালিক সমিতির পক্ষ থেকে ছাপার চার্জ বাড়াতে বাড়াতে ১৯৪৬ সালে যেখানে ঠেকেছিল (যুদ্ধের আগেকার হারের তা তিনগুণ হলেও) সম্প্রতি হঠাৎ প্রেস মালিক সমিতি তা ডবল করে দিয়েছেন। হাজার বিরোধী শক্তিও বাংলায় যে সাংস্কৃতিক ঐক্যে ভাঙন ধরাতে পারেনি, অগ্রগতি ঠেকাতে পারেনি, এমন সহজ সরল মোক্ষম উপায়ে তার বিনাশসাধনের ব্যবস্থা করতে আমলাতন্ত্রও কখনো সাহস পায়নি—তাহলে আর কোথায় কোন ছাপা বইয়ে রাজদ্রোহের স্ফুলিঙ্গ আছে তা সতর্কভাবে খুঁজে খুঁজে বেছে বেছে বইকে নিষিদ্ধ বাজেয়াপ্ত করার কোন দরকার হতো না।

 হঠাৎ বই ছাপাবার খরচ অবাস্তব অসম্ভব রকম বাড়িয়ে দিয়ে একটি অস্ত্রে বাঙালী লেখক প্রকাশক সাধারণ পাঠককে ও ছাত্রছাত্রীকে কাবু করে প্রেস মালিক সমিতি বাঁচার যুদ্ধে বাঙালীর বৈপ্লবিক চেতনার অদ্ভুত জাগরণে ভীতগ্রস্ত শত্রুদের খুশি ও নিশ্চিন্ত করে দিয়েছেন। লিখে কোনদিন বাঙালী লেখকের পেট ভরেনি, বইয়ের লাভের যে সামান্য অংশ লেখকের জুটতো, এবার তা প্রেস মালিকদের গ্রাসে যাবে। তবু যদি সাহিত্য-ব্রতী না লেখা ছাড়েন —জীবিকার জন্যই তাঁকে অপচয় করতে হবে বেশির ভাগ শক্তি ও সময়। অখ্যাত উদীয়মান ও অল্পখ্যাত লেখকদের পাণ্ডুলিপি পচবে, প্রকাশকের সাহস হবে না তাদের বই ছাপিয়ে প্রকাশ করতে, বই মার খেলেও অন্তত মোটামুটি খরচ উঠে আসার নিশ্চয়তা শেষ হয়েছে। উৎসাহী প্রকাশক নিত্য নূতন বই প্রকাশের প্রচেষ্টা গুটিয়ে আনবেন, সাহিত্যিক মূল্য আছে এমন বইয়ের বদলে নজর দেবেন সস্তা চটকদার বই প্রকাশের দিকে, বেশি দাম দিয়ে টাকাওলা খদ্দেররা যে বই কিনবে উপহারের জন্য, যৌন বা ডিটেকটিভ থ্রিলের নেশা মেটাতে। যুদ্ধের বাজারে কাগজের দুর্মূল্যতা ও দুষ্প্রাপ্যতা, ছাপা বাঁধাইয়ের দর বৃদ্ধি, সরকারী কনট্রাক্টের মুনাফার দম্ভে বাংলা বই ছাপানো সম্পর্কে প্রেস মালিকদের নির্লজ্জ অবজ্ঞা এবং আরো নানা অসুবিধা সত্ত্বেও পুস্তক প্রকাশের ব্যবসায়ে নবজীবনের সূচনা দেখা দেয়। বাঙালী বই কেনে না অপবাদ মিথ্যা প্রমাণিত করেছিল শিক্ষিত বাঙালী উপার্জনের দুযোগ পেয়েই। ১৯৪৬ সালে প্রেস মালিক সমিতি যুদ্ধপূর্ব হারের তুলনায় ছাপার চার্জ তিনগুণ করায় বইয়ের দাম বেড়ে যাওয়াতেও বইয়ের বাজারে মন্দা আসেনি। বরং কাগজ একটু বেশি পাওয়া যেতে থাকায় প্রকাশিত পুস্তক ও সাময়িক পত্রিকার সংখ্যা অনেক বেড়ে যায়। যুদ্ধোত্তর ব্যাপক ছাঁটাই ও অর্থ নৈতিক অবনতিও শিক্ষিত বাঙালীর বই কিনে পড়ার নবজাগ্রত ক্ষুধার চাহিদাকে দমাতে পারেনি। দাঙ্গাহাঙ্গামার কলঙ্কিত অধ্যায় শুরু না হলে বই বিক্রির সংখ্যা থেকেই প্রমাণ হয়ে যেতো সন্দেহ নেই যে, গরীব বাঙালীর মনের খোরাক সংগ্রহেরও অনিবার্য প্রয়োজনীয়তা বোধ কমার বদলে দিন দিন বেড়েই চলেছে। কিন্তু খাদ্যের দাম বাড়তে বাড়তে একটি সীমা ছাড়িয়ে গেলে সাধারণ লোক দুর্ভিক্ষে না খেয়ে মরে। মালিকদের রেটে ছাপাতে হলে বইয়ের দামও সেই সীমা ছাড়িয়ে গিয়ে সাধারণ মানুষকে মানসিক দুর্ভিক্ষ বরণ করতে বাধ্য করবে। অনেক ছাত্রকে পাঠ্য পুস্তকের অত্যধিক দামের জন্য পড়া ছাড়তে হবে, স্কুল কলেজের শিক্ষার খরচের চাপে যে অসংখ্য ছাত্রও তাদের পরিবারকে অনেক কিছু 'ত্যাগ' স্বীকার করতে হয়, আরও খানিকটা ত্যাগের প্রয়োজন দেখা দেবে তাদের দুর্বহ জীবনে।

 প্রেস মালিক সমিতি ছাপার হার এভাবে বাড়াবার কোন কারণ দেখাননি। দেখাবার মতো কোন কারণ নেই। প্রেস কর্মীদের বেতন বাড়েনি, সরঞ্জামের দাম বাড়েনি, সরকারী কোন নতুন ট্যাক্স ঘাড়ে চাপেনি,— এমনও নয় যে, বাংলার প্রতি প্রীতি বশতঃ প্রেস মালিকরা এতকাল লোকসান দিয়ে বাংলা বই ছেপে আসছিলেন। বাংলা বই ছাপাবার জন্য মুনাফার হার কমেনি, বরং বইয়ের সংখ্যা বাড়ায় কাজের চাপের অজুহাতে একান্ত অবহেলার সঙ্গে যেমন তেমন করে খুশিমতো ছাপিয়ে দেবার স্বাধীনতা জুটেছে। যুদ্ধকালীন কনট্র্যাক্টের মোটা মুনাফা কমেছে কিন্তু বাংলা বইয়ের ঘাড় ভেঙে কি যুদ্ধোত্তর কালেও মুনাফার সেই স্ফীতি বজায় রাখার চেষ্টা চলবে? স্টেট্সম্যানে শ্রীযুক্ত 'বুদ্ধদেব বসুর প্রতিবাদ পত্রের জবাবে প্রেস মালিক যে সংক্ষিপ্ত ও অর্থহীন কৈফিয়ত দিয়েছেন তাতে ১৯৪৬ সালের মোট হার ১৯৪৭ সালে ডবল করা হলো কেন তার কোন উল্লেখযোগ্য যুক্তি নেই, বরং আত্মসমর্থনে একটি মজার কথা আছে। প্রকাশকেরা বই বিক্রি করে অন্যায়রকম লাভ করেন, যে লাভ একটু কমালেই নাকি বইয়ের দাম বেশি না বাড়ালেও চলবে, লেখক বা সাধারণের ক্ষতি হবে না। কোন কোন প্রকাশক বই থেকে অন্যায় লাভ করেন সত্য, কিন্তু সেটা করেন লেখকের ন্যায্য পাওনা ফাঁকি দিয়ে। একটি সংস্করণের সমস্ত বই বিক্রি হবে ধরে নিয়েও (যে সৌভাগ্য খুব অল্পসংখ্যক বইয়ের ঘটে) যদি হিসাব করা যায়, দেখা যাবে প্রকাশককে সামান্য লাভ রাখতে হলেও বইয়ের দাম অসম্ভব বেশি করতে হয়, যে দামে বই যে শুধু বিক্রি হবে না তা নয়, বিক্রি করতে যাওয়াও প্রকাশ্যভাবে পাঠকের পকেট মারতে চাওয়ার সামিল। বাঙালীর সাহিত্যপ্রীতির কুৎসিত অপব্যবহার।

 বিশ্বভারতী সর্বাগ্রে এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে সক্রিয় প্রতিবাদ ঘোষণা করে বাঙালীর কৃতজ্ঞতা অর্জন করেছেন। প্রেস মালিক সমিতির লাভের অঙ্ক বাড়াতে বাঙালীর রবীন্দ্র-ভক্তির ওপর ট্যাক্স বসাতে তাঁরা অস্বীকার করেছেন। রবীন্দ্র সাহিত্যের পুনর্মুদ্রণ বন্ধ রইলো।

  বাংলা দেশ প্রেস মালিক সমিতির এই স্বেচ্ছাচারিতাকে প্রশ্রয় দেবে না, মানুষের তৈরি বইয়ের দুর্ভিক্ষে সাংস্কৃতিক অপমৃত্যু মেনে নেবে না।