লেখকের কথা/লেখকের সমস্যা

লে খ কে র স ম স্যা

 গল্প উপন্যাসের লেখক-লেখিকার জীবিকার প্রশ্নটা সব দেশে সমান সমস্যা নয়—কোন কোন দেশে এটা কোন সমস্যাই নয়।

 লেখক নাম করা না হলেও যে ভাষায় লেখা একখানা বই-এর ভালো বলে নাম হলে হাজার হাজার কপি হু হু করে বিক্রি হয়ে যায়, সেই ভাষার লেখককে স্বভাবতঃই জীবিকার জন্য চিন্তা করতে হয় না। অথবা যে দেশে প্রতিভার পরিচয় দিলে লেখকের জীবিকার ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে সে দেশেও এ চিন্তার প্রয়োজন হয় না।

 জীবিকাটা সাহিত্যিকের সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় বাংলার মতো দেশে যেখানে বিখ্যাত লেখকের নাম করা বই-এর বিক্রি এত কম এবং বিক্রিটাও এমন ধীরে সুস্থে এতদিন ধরে হয় যে, চার পাঁচখানা নাম করা বই লেখার পরেও লেখকের জীবিকার সমস্যা ঘোচে না। বাংলায় তবু লিখে কিছু পয়সা মেলে, ভারতে অনেক প্রাদেশিক ভাষার লেখকদের লেখা থেকে একরকম কিছুই জোটে না।

 বাংলার সমস্যাটাই একটু নাড়াচাড়া করা যাক। সত্যই কি নাম করার পরেও বাংলায় শুধু লিখে দিন চালানো যায় না? যায়। লেখাকে পেশায় পরিণত করলে অর্থাৎ সাহিত্যিকের পালনীয় প্রথম ও প্রধান নীতিটা বাতিল করে দিয়ে নিজেকে পেশাদার লেখকে পরিণত করলে সপরিবারে মোটামুটি বেঁচে থাকার মতো অর্থ উপার্জন করা যায়।

 সাহিত্যের আদর্শ বিক্রয় করে, আত্মবিক্রয় করে করা যায়। এইজন্যই তো জীবিকাটা সমস্যা। নইলে সাহিত্য সৃষ্টির জন্য লড়াই করতে করতে নাম হলে অনেক দিকেই আত্মবিক্রয়ের সুযোগ সাহিত্যিকের জুটে যায়।

 শিল্প সাহিত্যকে পেশা হিসাবে গ্রহণ করলে খাঁটি শিল্প সাহিত্য সৃষ্টি করা যায় না—আমি এই মূলনীতির কথাই বলছি। স্বেচ্ছায় হোক আর অনিচ্ছায় হোক টাকার জন্য লিখলে লেখকের ক্ষমতা অনুসারে লেখার যে মান হওয়া উচিত লেখা তার চেয়ে নিচু স্তরের হয়ে যাবেই। সকল সাহিত্যিকের পক্ষে এই নীতি প্রযোজ্য।

 এই নীতিটাকে ‘আর্ট ফর আর্টস সেক’ দুর্নীতিটার সঙ্গে অনেকে একাকার করে ফেলেন। টাকার জন্য না লেখার মানে দাঁড় করান নিছক সাহিত্যের জন্য সাহিত্য করা! এটা ভুল ধারণা। মূলনীতিটা মোটেই ফাঁকা আদর্শবাদিতা থেকে আসে না। খাঁটি বাস্তব কারণেই নিজের সাধ্যমতো খাঁটি সাহিত্য সৃষ্টি করতে চাইলে সাহিত্যিককে এই নীতি মানতে হয়।

 সাহিত্যকে পেশা করা মাত্র সাহিত্যিক তার সাহিত্য চর্চার জন্য প্রয়োজনীয় স্বাধীনতা অনেকখানিই হারিয়ে ফেলেন। যথেষ্ট সময় দিয়ে এবং অন্য হিসাব না করে এবং নিজের জীবন দর্শনের সত্যটিকে রূপায়িত করার স্বাধীনতা সঙ্কীর্ণ হয়ে যায়। কতটা সময় দিয়ে কতটা লিখলে পেট চলবে শুধু এই হিসাব নয়, যারা তাকে পেট চালাবার টাকা দেবে তারা তার বক্তব্য কিভাবে নেবে এই ভাবনাও ভাবতে হয়।

 বাস্তবতাটা একটু খোলসা করি।

 যে সমাজে যে অর্থ নৈতিক ব্যবস্থা, সাহিত্যিক তার আওতার বাইরে যেতে পারেন না,—এই নির্ভুল যুক্তি থেকে নির্ভুল সিদ্ধান্ত আসে যে মালিকানা স্বার্থের সমাজে সাহিত্যিক মজুরি নিয়েই শ্রম বিক্রয় করেন।

 সাহিত্যকে পেশা করা না করার প্রশ্নে এই সঠিক সিদ্ধাস্ত যান্ত্রিকভাবে প্রয়োগ করতে গিয়ে অনেকে কিন্তু বেঠিক সিদ্ধান্তে গিয়ে পৌঁছান। সাহিত্যকে পেশা করা কেন উচিত নয় তার পক্ষে যুক্তি দাঁড় করান: সাহিত্যিক মালিকশ্রেণীর স্বার্থ রক্ষার উপযোগী সাহিত্য রচনা না করলে মালিকশ্রেণী তাকে বাঁচার মতো মজুরি দেবে না। কাজেই, সাহিত্য করে বাঁচতে চাইলে মালিকশ্রেণীর স্বার্থের পক্ষে প্রচার করতেই হবে।

 কি অপরূপ ছেলেমানুষী যুক্তি! মালিকের মুনাফার জন্য খাটলে, মজুর কেরানী খেটে যাওয়ার জন্য কোন মতে বেঁচে থাকার মতো মজুরি পান বলেই মজুর কেরানীরা যেন মালিকদের মুনাফার দায় ঘাড়ে নিয়ে মালিকশ্রেণীর পক্ষ নিয়ে খাটেন!

 বেঁচে থাকার মতো মজুরি নিয়ে খাটলেই যেন তাই সাহিত্যিককে মালিকশ্রেণীর পক্ষ নিতে হবে!

 কোনও দেশে কোনও কালে মজুর মালিকের স্বার্থে খাটেনি।

 মজুর কেরানীর মতো কোন মতে বাঁচার মতো মজুরি নিয়ে খেটে পেশাদার সাহিত্যিক হলে তার খাটুনিটা কেন মালিকশ্রেণীর স্বার্থের পক্ষে প্রচার হতেই হবে?

 এই কারণে সাহিত্যিকের কেন পেশাদার হওয়া চলবে না? মজুর কেরানীর মতোই তো তিনি শুধু তার শ্রমটুকু বিক্রি করবেন, পক্ষপাতিত্ব নয়।

 মজুর বেচেন কায়িক শ্রম। কেরানীও প্রায় তাই। দিনের পর দিন, ঘণ্টার পর ঘণ্টা একই মাথার কাজ বারবার করে যেতে যেতে সেটা আর মাথার কাজ থাকে না, মজুরের কায়িক শ্রমে দেহ ক্ষয় করার ঠিক বিপরীত প্রক্রিয়ায় মর্চে ধরে দেহ ক্ষয় করার কায়িক পরিশ্রমে দাঁড়িয়ে যায়।

 কায়িক শ্রম আর মানসিক শ্রমের মধ্যে কৃত্রিম গুণগত ও মূলগত তারতম্য দু’ রকম শ্রমের মজুরিদাতারাই সৃষ্টি করেছে। কিন্তু মজুরিদাতাদের কেরামতি হলেও ইতিহাসের সুনিয়মিত ধারার অঙ্গ হিসাবেই অনিয়মও সাময়িক বাস্তবতার মর্যাদা পায়। সমসাময়িক অবস্থার সুযোগ নিয়ে জুয়াড়ীর মরি-বাঁচি প্রাণান্তকর চেষ্টায় একটা যুদ্ধ বাধিয়ে মুনাফা বেলুনের মতো ফাঁপিয়ে তোলাও যেমন একটা সর্বগ্রাসী সাময়িক বাস্তবতা হয়ে ওঠে।

 পক্ষপাতিত্ব বিক্রয় না করে শুধু শ্রমটুকু বিক্রয় করে একজন অল্প বেতনের কেরানীর মতো বেঁচে থাকতে চেয়ে সাহিত্যকে পেশা করা কেন অপরাধ হবে সাহিত্যিকের?

 অপরাধ হবে এইজন্য যে, লেখক মজুর বা অল্প বেতনের কেরানী নন, শ্রমটাই তাঁর একমাত্র পণ্য নয়। তাঁর পক্ষপাতিত্বের মূল্য এত বেশি যে, তাঁর শ্রমের মূল্য বিচার তুচ্ছ হয়ে যায়।

 লেখকের পক্ষপাতিত্বের মূল্য কিন্তু তার শ্রম দিয়েই নির্ধারিত হয়। লেখকের শ্রম এমন এক ধরনের যে, সেটা খাটুনির ঘণ্টার হিসাবে বা উৎপন্ন পণ্যের হিসাবে মাপা যায় না।

 নিজস্ব একটা জীবন-দর্শন ছাড়া সাহিত্যিক হওয়া সম্ভব নয়। এইজন্য তাঁর শুধু বসে বসে লেখার বা প্রুফ সংশোধন করার শ্রম নয়—সব সময় সর্বত্র জীবনকে দর্শন করার বিরামহীন শ্রমও তাকে চালাতে হয়।

 একটা উদাহরণ দিই।

 লেখক একপোয়া মাছ কিনতে বাজারে গিয়েছেন। আজকের দিনে ওটুকু মাছ কিনতে বাজারে যেতে পারাটাই সৌভাগ্য সন্দেহ নেই—সেটা শ্রম নয়। কিন্তু দরদস্তুর করে একপো মাছ কিনেই কি রেহাই আছে লেখকের? সতর্ক চোখ মেলে তাকে দেখতেই হবে অন্য কারা মাছ কিনতে এসেছে, কেমন মানুষেরা কিভাবে কতটা মাছ কিনছে, যদি পোষায় তবেই একটু কিনবে বলে কারা শুধু মাছের দরই জিজ্ঞাসা করে চলেছে ঘুরে ঘুরে, তেল ছোঁয়ানো কড়ায় পোড়া পোড়া করে খাবার জন্য কারা কিনছে পচন—ধরা সস্তা মাছ, কারা এসেছে শুধু ফেলে দেওয়া কাঁটাকুটো কাণকো কুড়োতে!

 মাছের বাজারে যারা এসেছে তাদের সঙ্গে মিলিয়ে মনের চোখে তাদেরও দেখে নিতে হয় যারা এ বাজারে কদাচিৎ আসে, যারা একেবারেই আসে না।

 এত দেখেও কি রেহাই আছে? মাছ যারা বেচছে তাদেরও তো দেখতে হবে! মেছুনীটির পরনে কি শাড়ি, হাতের সোনার বালা ছাড়াও কোন অঙ্গে কি গয়না ইত্যাদি থেকে শুরু করে তার বসার, মাছ কাটার, কথা বলার ভঙ্গির খুঁটিনাটি না দেখে রাখলে তো ওর কাছ থেকে কেনা মাছ অন্দরের যে বৌটি কেটেকুটে রান্না করবে তাকে এবং একে পৃথক ও সম্পূর্ণ একটা জীবন্ত মানুষ হিসাবে মনের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যাবে না কলম চালাবার সময়। দু’জনেই স্ত্রীলোক, একজন বাজারে মাছ বেচে, আরেকজন বাড়ির মধ্যে রান্নাঘরে সেই মাছ রাঁধে—শুধু এইটুকু দেখে আর জেনে তো লেখকের চলে না।

 ঘরে শিল্প-সাহিত্য জ্ঞান-বিজ্ঞানের পুঁজি ঘাঁটা আর ঘরে বাইরে সর্বত্র সব সময় মানুষকে আর জীবনকে তন্ন তন্ন করে দেখা ও জানা এবং মনের মধ্যে তাই নিয়ে তোলপাড় করা, যোগ বিয়োগ করা, মিলিয়ে দেখা আর অমিল খোঁজা ও সব কিছুর মানে বোঝার চেষ্টা—লেখকের বিরামহীন এই শ্রম মাপাই বা হবে কিসে, দামই বা কষা হবে কোন নিরিখে?

 শ্রমটা লেখকের ধাতে দাঁড়িয়ে যায়। পুরোই হোক আর খানিকটাই হোক, এরকম ধাত ছাড়া লেখক হওয়া যায় না। কিন্তু সাধনা ধাতস্থ হলেও সেটা শ্রম বৈকি। সহজেই বোঝা যায়, যে সমাজে লেখকের এই শ্রমের মূল্য দেবার ব্যবস্থা নেই, সে সমাজে লেখাকে পেশা করার অর্থ শুধু কলম চালিয়ে লেখার শ্রমটুকু পণ্য করা। জীবিকার জন্য লেখার শ্রমটার উপর নির্ভর করলে স্বভাবতঃই এই শ্রমটাই প্রধান হয়ে উঠবে, সাধনার শ্রমটা গুরুত্ব হারাবে।

 যত বড়ই প্রতিভা থাক, সাধনায় ঢিল পড়ার অর্থই লেখক ও লেখার অধঃপতন।

 বাংলার বিশেষ বাস্তব অবস্থায় প্রক্রিয়াটা কিভাবে ঘটে দেখা যাক।

 প্রথমেই বলে রাখি লেখক বলতে আমি শুধু সৎ ও আদর্শনিষ্ঠ লেখকদেরই ধরছি, পুরস্কার ও সুবিধার বিনিময়ে অর্থাৎ সোজাসুজি ঘুষ খেয়ে যারা নাম ও প্রতিভা, জনসাধারণের শোষকদের স্বার্থে স্বেচ্ছায় কাজে লাগান তাদের নয়।

 একজন গরীব বাঙালী লেখক। সাময়িকপত্রে লেখার দক্ষিণা এবং বই-এর রয়ালটিই তার প্রধান আয় । সাময়িকপত্রের মালিক লেখা ছেপে এবং প্রকাশক বই ছেপে টাকা দেন বলে অনেকের একটা ভুল ধারণা আছে যে, নামকরা লেখকেরও সাহিত্যকে পেশা করার ওরাই বোধ হয় প্রধান অন্তরায়। সাহিত্যকে পেশা করলে বাধ্য হয়ে কাগজের মালিক ও প্রকাশকের মন যুগিয়ে সাহিত্য করতে হবে—এইজন্যই সাহিত্যকে পেশা হিসাবে গ্রহণ করা চলে না।

 নামকরা লেখকের কাছে কাগজের মালিক ও প্রকাশক সত্যই সমস্যা—কিন্তু সমস্যাটা এই নয় যে, তাঁকে ওঁদের মন যুগিয়ে সাহিত্য করতে হবে। এদের সম্পর্কিত সমস্যাটা হলো সম্পূর্ণ অর্থ নৈতিক অর্থাৎ দেনা পাওনার ব্যাপার। লেখকের নাম থাকলে এবং বই বিক্রি হলে বিশেষ গোষ্ঠীর সঙ্গে জড়িত দু'চারজন ছাড়া নিজেদের স্বার্থেই কাগজের মালিক তাঁর লেখা ছাপবেন এবং প্রকাশক বই প্রকাশ করবেন।

 এঁদের নিয়ে ফ্যাসাদ হলো এই যে, কাগজের মালিকের চেষ্টা যত পারা যায় কম টাকা দিয়ে ভালো লেখা আদায় করা আর প্রকাশকের চেষ্টা লেখকের ন্যায্য পাওনা ফাঁকি দেওয়া। সব প্রকাশক যে গোপনে চুক্তির চেয়ে বেশি বই ছাপিয়ে নিয়ে এই ধরনের জুয়াচুরি করে লেখককে ঠকান তা নয় । হিসাবপত্র ঠিক থাকা সত্ত্বেও নানাভাবে লেখক ফাঁকিতে পড়ে যান। যেমন, একখানা বই-এর সংস্করণ ফুরিয়ে গেল কিন্তু প্রকাশক অন্য কয়েকখানা বই ছাপছেন, কয়েক মাসের মধ্যে আরেকখানা বেশি বই প্রকাশ করার সুবিধে নেই—সংস্করণ শেষ হওয়ার খবরটা প্রকাশক স্রেফ চেপে যাবেন। বইটার নতুন সংস্করণের জন্য পাওনা টাকাটা লেখক পাবেন অনেক দেরিতে।

 সাহিত্যকে পেশা করলে লেখককে কম বেশি মন যোগাতে হয় পাঠক পাঠিকার! বাংলার পাঠক পাঠিকারাই পেশাদার সাহিত্যিকের লেখার স্বাধীনতা হরণ করেন। কাগজের মালিক ও প্রকাশকের মারফতে আসলে তারাই তো লেখককে পয়সা দেন।

 এই সহজ বাস্তবতাটুকু খেয়াল না করায় অনেকেই সাহিত্যিকের শ্রমের প্রকৃত স্বরূপ এবং সমাজের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সঙ্গে প্রকৃত সম্পর্ক সঠিক ধরতে পারেন না। লেখককে সাধারণভাবে ‘বুদ্ধিজীবী’ আখ্যা দিয়ে কেরানী শিক্ষক ইত্যাদির সঙ্গে একাকার করে দেওয়া হয়।

 লেখক বুদ্ধিজীবী কিন্তু বেতনভোগী বুদ্ধিজীবী নয়—তিনি বুদ্ধিজীবী উৎপাদক। বুদ্ধি খাটিয়ে তিনি সাহিত্য উৎপাদন করেন এবং নিজেই হোক বা অংশীদার প্রকাশকের সাহায্যেই হোক তাকে সম্পূর্ণ পণ্যের রূপ দিয়ে বাজারে ছাড়েন ।

 সাহিত্যিককে বুদ্ধিজীবী উৎপাদন হিসাবে না ধরলে সাহিত্য সাধনার প্রয়োজনীয় নিয়মনীতি ও অর্থনৈতিক দিকটার বাস্তবতা ধারণা করা সম্ভব নয়।

 উৎপাদক বলেই তার সম্পর্কটা ক্রেতার সঙ্গে। বাজারে চললেই উৎপণ্য পণ্যের অর্থনৈতিক সার্থকতা। কাজেই সাহিত্যের চাহিদাটাই পেশাদার সাহিত্যিকের কাছে প্রধান কথা হয়ে দাঁড়ায়।

 বাংলার পাঠকশ্রেণী নানা স্তরে ভাগ করা । বাংলা সাহিত্যের সমগ্র রূপটাও তাই অতি বিচিত্র। চালু সাময়িক পত্রিকাগুলি একসঙ্গে মিলিয়ে দেখলেই এই বিচিত্র রূপ ধরা পড়বে। এই কারণেই সেকেলে ধাঁচের লেখা থেকে প্রগতিশীল লেখা পর্যন্ত পাঁচমিশেলী লেখা যে পত্রিকায় মেলে তার বিক্রিই সবচেয়ে বেশি!

 বাংলার পেশাদার সাহিত্যিকের অবস্থাটা কি দাঁড়ায়? আগেই বলেছি সাময়িকপত্রের দক্ষিণা সামান্য। টাকার জন্য তাই অনেকগুলি কাগজে তাকে লিখতে হবে। বই বিক্রি হয় কম—সুতরাং বেশি বইও তাকে লিখতে হবে।

 দু'দিক দিয়ে তার ফল হবে মারাত্মক।

 নাম আছে সুতরাং কাগজের মালিকের কথা না ভাবলেও চলে—কিন্তু ওই যে পাঁচখানা কাগজের পাঁচরকম রুচির পাঠক পাঠিকা, তাদের রুচির কথা না ভাবলে তো চলবে না! পাঁচরকমের পাঁচমিশেলী লেখার খিচুড়ি সাহিত্যে বোঝাই পত্রিকাটির বিক্রির মধ্যে যে বাস্তব সত্যের প্রকাশ তাকে খাতির না করলে অর্থাৎ বেশি সংখ্যক লোকের কাছে রুচিকর হয়, খানিকটা এই ধরনের বই না লিখলে তো চলবে না!

 ব্যস্, খতম হয়ে গেল লেখকের স্বাধীন সৃষ্টির স্বাধীনতা!

 এই গেল ক্রেতা বাড়াবার জন্য নিজের চেতনা ও প্রতিভার যোগ্য ব্যবহার ছাঁটাই করার দিক! অন্য দিকটা হলো বেশি বেশি লিখতে বাধ্য হওয়ার দিক।

 হলেন বা নাম-করা লেখক, নতুন চিন্তা আর অভিজ্ঞতার কতই বা তার পুঁজি! পুঁজি খরচ করে বই লিখে তবেই তো নাম-করা লেখক হয়েছেন! পুঁজি ফুরিয়ে গেলে উপায়? পুঁজি বাড়াবার উপায় নেই, বেশি লিখে নতুন চিন্তা ও অভিজ্ঞতার পুঁজি সঞ্চয় করার সময় কই!

 অগত্যা বলা কথাই আবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নতুনভাবে বলার চেষ্টা।

 ব্যস্, খতম হয়ে গেল সাহিত্য সাধনা।

 ‘পেশাদার’ সাহিত্যিক বলে তাই কোন জীব হয় না। যে ‘পেশাদার’ সে সাহিত্যিক নয়। পৃথিবীর সর্বত্র এই নিয়ম।যে দেশে প্রচুর সাহিত্য বিক্রি হয়, নাম হলে লেখকের জীবিকার চিন্তা করতে হয় না—বাংলা দেশের সাহিত্যিকের সঙ্গে সে দেশের সাহিত্যিকের তফাত শুধু এই যে, পেটের চিন্তায় বিব্রত না হয়ে অকাজে সময় নষ্ট না করে সাহিত্যিক সাহিত্য-সাধনা চালিয়ে যেতে পারেন।

 টাকার জন্য লিখলে সে দেশের সাহিত্যিকের ও সাহিত্যের অপমৃত্যু অবধারিত। সাহিত্য সৃষ্টি করে যে অর্থ মেলে তাতে সন্তুষ্ট না থেকে বেশি টাকা চাওয়া মানে এ ক্ষেত্রেও ক্রেতার মন যোগানো এবং বেশি লেখা।

 বহুদিন ধরে অনেক বই লেখার পর পুরানো বইয়ের নতুন নতুন সংস্করণ হওয়া, সিনেমা রাইট বিক্রি হওয়া ইত্যাদি কারণে কোন বিশেষ সাহিত্যিকের ক্ষেত্রে হয়তো জীবিকার জন্য অন্য কিছু না করলেও চলে এটা কিন্তু মূলনীতির ব্যতিক্রমের নিদর্শন নয়। বাংলা দেশে শুধু লিখে কোন সাহিত্যিকের জীবিকা জোটে না এ নীতি এখানেও খাটছে।

 বাস্তবতা ঠিকভাবে বিচার করে প্রয়োগ না করলে নীতির যান্ত্রিক প্রয়োগের আশঙ্কা থাকে। টাকার জন্য হলে খাঁটি সাহিত্য সৃষ্টি করা যায় না—এই নীতি থেকে কারো কারো বিভ্রান্তিকর সিদ্ধান্তে পৌঁছান আশ্চর্য নয় যে টাকার জন্য সাহিত্যিকের লেখাটাই নিষিদ্ধ, টাকার জন্য লিখলেই সাহিত্যিকের পতন ঘটে।

 সাহিত্য জীবিকা দেয় না মানেই বাংলায় সাহিত্যিক অন্যভাবে জীবিকার জন্য পরিশ্রম ও সময় খরচ করতে বাধ্য। চাকরি করুন, জীবনবীমার দালালী করুন, জিনিষ ফিরি করুন—বাঁচার জন্য একটা কিছু সাহিত্যিককে করতেই হবে। এ বাস্তবতা মানতেই হবে।

 আপিসে কলম পিষতে পারলে টাকার জন্য সাহিত্যিক লিখতে পারবেন না কেন? যে কাজ করে তাঁর অভ্যাস আছে, যে কাজের কলাকৌশল ভালোভাবে আয়ত্ত করা আছে, অন্য কাজের বদলে সে কাজ করলে অপরাধ কি?

 ফাঁকা আদর্শবাদিতা থেকে, ভাববাদী আদর্শ নিষ্ঠার অনমনীয় সংস্কার থেকে এই মনোভাব আসে।

 জীবিকার জন্য সাহিত্য না করার নীতিতে অবিচলিত থাকার জন্যই জীবিকার জন্য লেখককে যে শ্রম ও সময় দিতেই হবে, সেই শ্রম আর সময় টাকার জন্য লেখার কাজে দিলে শুধু যে দোষ হয় না তা নয়, দেওয়াটাই লেখকের কর্তব্য। বিশেষত বাংলা দেশের বিশেষ সামাজিক অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক অবস্থায়।

 পিছিয়ে থাকা মানুষদের জন্য যে পত্রিকা সেই পত্রিকায় খানিকটা তাদের গ্রহণের উপযোগী করে লেখা দিলে ক্ষতিটা কার? আমার হিসাবে তো লাভটাই ষোল আনা মানুষকে এগিয়ে নেবার জন্য যাঁর সাহিত্য সাধনা, জীবিকার প্রয়োজনে লেখা হয়ে থাকলেও ঐ লেখায় কি কিছু কিছু নতুন কথা থাকবে না, নতুন চেতনা পরিবেশিত হবে না? পিছিয়ে পড়া পাঠক পাঠিকার চেতনায় নতুনের ছোঁয়াচ লাগবে না?

 খাঁটি সাহিত্যিক ওই পত্রিকায় না লিখলে বেচারীরা আরও কতদিন ওই আলোটুকু থেকেও বঞ্চিত হয়ে থাকবে কে জানে!

 প্রশ্ন উঠবে: বাস্তবে এটা করা কি সম্ভব লেখকের পক্ষে? সাহিত্য সাধনা ঠিকমতো বজায় রেখে জীবিকার জন্য অন্য কাজে যতটা সময় আর পরিশ্রম দিতে হতো হিসাব করে শুধু সেইটুকুই অন্যরকম লেখার জন্য দেওয়া? বেশি লেখার একঘেয়েমি এসে যাবে না তার আসল সৃষ্টিতে? আরও লিখে পয়সা করে একটু স্বাচ্ছন্দ্যের লোভ জাগবে না তার?

 এসব ছেলেমানুষী সংশয় ও প্রশ্ন। কঠোর নিষ্ঠার সঙ্গে যে সাহিত্যিক মূলনীতি পালন করতে পারবেন তার কাছে এটুকু কি আশা করা যাবে না যে, তিনি জীবিকা আর পিছানো মানুষকে জীবন ও সাহিত্যের নতুন দিগন্তের সন্ধান দেবার মিলিত উদ্দেশ্যে কতটা কলম চালাবেন, সে বিষয়ে নিয়ম রাখতে পারবেন! দশটা পাঁচটা আপিস করা, অন্যভাবে জীবিকা অর্জনের ক্লান্তি কি সাহিত্য চর্চার কম বিঘ্ন? নিজের নিয়ম ও সুবিধামতো লেখার কাজ করে সাহিত্যিক বরং দেশের পশ্চাৎপদ মানুষের জন্য সাহিত্যিক কর্তব্য পালনের উদ্দীপনা পাবেন। স্বাচ্ছন্দ্যের লোভ যাকে সহজে কাবু করবে নীতি ও আদর্শের প্রতি তার নিষ্ঠার কোন প্রশ্নই তো ওঠে না!

 সাহিত্যিকের আসল মুস্কিলটা বরং হবে অন্যরকম। সাধারণ ও পিছানো মানুষের জন্য লেখা পড়ে সমালোচক, বন্ধুবান্ধব ও বিদগ্ধ পাঠক সোরগোল তুলবেন; তুমি বাজে লেখা লিখছ! কিন্তু নিন্দা বা প্রশংসায় বিচলিত হলে বস্তুবাদী সাহিত্যিকের চলবে কেন?