১২

শেষ সন্ধ্যা

আহার শেষ হলে অমিত বললে, 'কাল কোলকাতায় যাচ্ছি মাসিমা। আমার আত্মীয়স্বজন সবাই সন্দেহ করছে আমি খাসিয়া হয়ে গেছি।'

 ‘আত্মীয়স্বজনরা কি জানে কথায় কথায় তোমার এত বদল সম্ভব?'

 'খুব জানে, নইলে আত্মীয়স্বজন কিসের? তাই বলে কথায় কথায় নয়, আর খাসিয়া হওয়া নয়; যে বদল আজ আমার হল এ কি জাত-বদল, এ যে যুগ-বদল, তার মাঝখানে একটা কল্পান্ত। প্রজাপতি জেগে উঠেছেন আমার মধ্যে এক নূতন সৃষ্টিতে। মাসিমা, অনুমতি দাও, লাবণ্যকে নিয়ে আজ একবার বেড়িয়ে আসি। যাবার আগে শিলঙ পাহাড়কে আমাদের যুগল প্রণাম জানিয়ে যেতে চাই।'

 যোগমায়া সম্মতি দিলেন। কিছু দূরে যেতে যেতে দুজনের হাত মিলে গেল, ওরা কাছে কাছে এল ঘেঁষে। নির্জন পথের ধারে নীচের দিকে চলেছে ঘন বন। সেই বনের একটা জায়গায় পড়েছে ফাঁক, আকাশ সেখানে পাহাড়ের নজরবন্দি থেকে একটুখানি ছুটি পেয়েছে; তার অঞ্জলি ভরিয়ে নিয়েছে অন্তসূর্যের শেষ আভায়। সেইখানে পশ্চিমের দিকে মুখ করে দুজনে দাঁড়াল। অমিত লাবণ্যর মাথা বুকে টেনে নিয়ে তার মুখটি উপরে তুলে ধরলে। লাবণ্যর চোখ অর্ধেক বোজা, কোণ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। আকাশে সোনার রঙের উপর চুনি-গলানো পান্না-গলানো আলোর আভাসগুলি মিলিয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে; মাঝে মাঝে পাৎলা মেঘের ফাঁকে ফাঁকে সুগভীর নির্মল নীল, মনে হয় তার ভিতর দিয়ে যেখানে দেহ নেই শুধু আনন্দ আছে সেই অমর্তজগতের অব্যক্তধ্বনি আসছে। ধীরে ধীরে অন্ধকার হল ঘন। সেই খোলা আকাশটুকু, রাত্রিবেলায় ফুলের মতো, নানা রঙের পাপড়িগুলি বন্ধ করে দিলে।

 অমিতর বুকের কাছ থেকে লাবণ্য মৃদুস্বরে বললে,‘চলো এবার।’

 কেমন তার মনে হল, এইখানে শেষ করা ভালো।

 অমিত সেটা বুঝলে, কিছু বললে না। লাবণ্যর মুখ বুকের উপর একবার চেপে ধরে ফেরবার পথে খুব ধীরে ধীরে চলল। বললে, ‘কাল সকালেই আমাকে ছাড়তে হবে, তার আগে আর দেখা করতে আসব না।’

 ‘কেন আসবে না?’

 ‘আজ ঠিক জায়গায় আমাদের শিলঙ পাহাড়ের অধ্যায়টি এসে থামল—— ইতি প্রথমঃ সর্গঃ, আমাদের সয়ে বয়ে স্বর্গ।’

 লাবণ্য কিছু বললে না, অমিতর হাত ধরে চলল। বুকের ভিতর আনন্দ, আর তারই সঙ্গে সঙ্গে একটা কান্না স্তব্ধ হয়ে আছে। মনে হল, জীবনে কোনোদিন এমন নিবিড় করে অভাবনীয়কে এত কাছে পাওয়া যাবে না। পরমক্ষণে শুভদৃষ্টি হল এর পরে আর কি বাসরঘর আছে? রইল কেবল মিলন আর বিদায় একত্র মিশিয়ে একটি শেষ প্রণাম। ভারি ইচ্ছে করতে লাগল অমিতকে এখনই সেই প্রণামটি করে বলে, ‘তুমি আমাকে ধন্য করেছ।’ কিন্তু সে আর হল না।

 বাসার কাছাকাছি আসতেই অমিত বললে, ‘বন্যা, আজ তোমার শেষ কথাটি একটি কবিতায় বলল, তা হলে সেটা মনে করে নিয়ে যাওয়া সহজ হবে। তোমার নিজের যা মনে আছে এমন একটা-কিছু আমাকে শুনিয়ে দাও।’

 লাবণ্য একটুখানি ভেবে আবৃত্তি করলে—

‘তোমারে দিই নি সুখ, মুক্তির নৈবেদ্য গেনু রাখি
রজনীর শুভ্র অবসানে। কিছু আর নাই বাকি,
নাইকো প্রার্থনা, নাই প্রতি মুহূর্তের দৈন্যরাশি,
নাই অভিমান, নাই দীন কান্না, নাই গর্বহাসি,
নাই পিছু-ফিরে দেখা। শুধু সে মুক্তির ডালাখানি
ভরিয়া দিলাম আজি আমার মহৎ মৃত্যু আনি।’

 ‘বন্যা, বড়ো অন্যায় করলে। আজকের দিনে তোমার মুখে বলবার কথা এ নয়, কিছুতেই নয়। কেন এটা তোমার মনে এল? তোমার এ কবিতা এখনই ফিরিয়ে নাও।’

 ‘ভয় কিসের মিতা? এই আগুনে-পোড়া প্রেম এ সুখের দাবি করে না, এ নিজে মুক্ত বলেই মুক্তি দেয়, এর পিছনে ক্লান্তি আসে না, ম্লানতা আসে না; এর চেয়ে আর কিছু কি দেবার আছে?’

 ‘কিন্তু আমি জানতে চাই, এ কবিতা তুমি পেলে কোথায়?’

 ‘রবি ঠাকুরের।’  ‘তার তো কোনো বইয়ে এটা দেখি নি।’  ‘বইয়ে বেরোয় নি।’

 ‘তবে পেলে কী করে?’

 ‘একটি ছেলে ছিল, সে আমার বাবাকে গুরু ব'লে ভক্তি করত, বাবা দিয়েছিলেন তাকে তার জ্ঞানের খাদ্য। এ দিকে তার হৃদয়টিও ছিল তাপস। সময় পেলেই সে যেত রবি ঠাকুরের কাছে, তাঁর খাতা থেকে মুষ্টিভিক্ষা করে আনত।’

 ‘আর নিয়ে এসে তোমার পায়ে দিত।’

 ‘সে সাহস তার ছিল না। কোথাও রেখে দিত, যদি আমার দৃষ্টিতে পড়ে, যদি আমি তুলে নিই।’

 ‘তাকে দয়া করেছ?’

 ‘করবার অবকাশ হল না। মনে মনে প্রার্থনা করি— ঈশ্বর যেন তাকে দয়া করেন।’

 ‘যে কবিতাটি আজ তুমি পড়লে, বেশ বুঝতে পারছি এটা সেই হতভাগারই মনের কথা।’

 ‘হাঁ, তারই কথা বৈকি।’

 ‘তবে তোমার কেন আজ এটা মনে পড়ল।’

 ‘কেমন করে বলব? ওই কবিতাটির সঙ্গে আর-এক টুকরো কবিতা ছিল, সেটাও আজ আমার কেন মনে পড়ছে ঠিক বলতে পারি নে—

সুন্দর, তুমি চক্ষু ভরিয়া
এনেছ অশ্রুজল।
এনেছ তোমার বক্ষে ধরিয়া
দুঃসহ হোমানল।

দুঃখ যে তায় উজ্জ্বল হয়ে উঠে,
মুগ্ধ প্রাণের আবেশবন্ধ টুটে,
এ তাপে শ্বসিয়া উঠে বিকশিয়া
বিচ্ছেদশতদল।’

অমিত লাবণ্যর হাত চেপে ধরে বললে, ‘বন্যা, সে ছেলেটা আজ আমাদের মাঝখানে কেন এসে পড়ল? ঈর্ষা করতে আমি ঘৃণা করি, এ আমার ঈর্ষা নয়, কিন্তু কেমন একটা ভয় আসছে মনে। বলে, তার দেওয়া ওই কবিতাগুলো আজই কেন তোমার এমন করে মনে পড়ে গেল?’

 ‘একদিন সে যখন আমাদের বাড়ি থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেল তার পরে যেখানে বসে সে লিখত সেই ডেস্কে এই কবিতাদুটি পেয়েছি। এর সঙ্গে রবি ঠাকুরের আরো অনেক অপ্রকাশিত কবিতা, প্রায় এক খাতা ভরা। আজ তোমার কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছি, হয়তো সেইজন্যেই বিদায়ের কবিতা মনে এল।’

 ‘সে বিদায় আর এ বিদায় কি একই?’

 ‘কেমন করে বলব? কিন্তু, এ তর্কের তো কোনো দরকার নেই। যে কবিতা আমার ভালো লেগেছে তাই তোমাকে শুনিয়েছি, হয়তো এ ছাড়া আর কোনো কারণ এর মধ্যে নেই।’

 ‘বন্যা, রবি ঠাকুরের লেখা যতক্ষণ না লোকে একেবারে ভুলে যাবে ততক্ষণ ওর ভালো লেখা সত্য করে ফুটে উঠবে না। সেইজন্যে ওর কবিতা আমি ব্যবহারই করি নে। দলের লোকের ভালো-লাগাটা কুয়াশার মতো, যা আকাশের উপর ভিজে হাত লাগিয়ে লাগিয়ে তার আলোটাকে ময়লা করে ফেলে।'

 ‘দেখো মিতা, মেয়েদের ভালো-লাগা তার আদরের জিনিসকে আপন অন্দর-মহলে একলা নিজেরই করে রাখে, ভিড়ের লোকের কোনো খবরই রাখে না। সে যত দাম দিতে পারে সব দিয়ে ফেলে, অন্য পাঁচজনের সঙ্গে মিলিয়ে বাজার যাচাই করতে তার মন নেই।'

 ‘তা হলে আমারও আশা আছে বন্যা। আমার বাজারদরের ছোট্ট একটা ছাপ লুকিয়ে ফেলে তোমার আপন দরের মস্ত একটা মার্কা নিয়ে বুক ফুলিয়ে বেড়াব।'

 ‘আমাদের বাড়ি কাছে এসে পড়ল মিতা। এবার তোমার মুখে তোমার পথশেষের কবিতাটা শুনে নিই।'

 'রাগ কোরো না বন্যা, আমি কিন্তু রবি ঠাকুরের কবিতা আওড়াতে পারব না।'

 'রাগ করব কেন?'

 ‘আমি একটি লেখককে আবিষ্কার করেছি, তার স্টাইল—'

 ‘তার কথা তোমার কাছে বরাবরই শুনতে পাই। কোলকাতায় লিখে দিয়েছি তার বই পাঠিয়ে দেবার জন্যে।'

 ‘সর্বনাশ! তার বই। সে লোকটার অন্য অনেক দোষ আছে, কিন্তু কখনো বই ছাপতে দেয় না। তার পরিচয় আমার কাছ থেকেই তোমাকে ক্রমে ক্রমে পেতে হবে। নইলে হয়তো—'

 ‘ভয় কোরো না মিতা, তুমি তাকে যে ভাবে বোঝ আমিও তাকে সেই ভাবেই বুঝে নেব এমন ভরসা আমার আছে। আমারই জিত থাকবে।'  ‘কেন?'

 ‘আমার ভালো-লাগায় যা পাই সেও আমার, আর তোমার ভালো-লাগায় যা পাব সেও আমার হবে। আমার নেবার অঞ্জলি হবে দুজনের মনকে মিলিয়ে। কোলকাতায় তোমার ছোটো ঘরের বইয়ের আলমারিতে এক শেলফেই দুই কবির কবিতা ধরাতে পারব। এখন তোমার কবিতাটি বলো।'

 ‘আর বলতে ইচ্ছে করছে না। মাঝখানে বডডো কতকগুলো তর্কবিতর্ক হয়ে হাওয়াটা খারাপ হয়ে গেল।'

 ‘কিছু খারাপ হয় নি, হাওয়া ঠিক আছে।'

 অমিত তার কপালের চুলগুলো কপালের থেকে উপরের দিকে ঠেলে দিয়ে খুব দরদের সুর লাগিয়ে পড়ে গেল—

‘সুন্দরী তুমি শুকতারা।
সুদূর শৈলশিখরান্তে,
শর্বরী যবে হবে সারা।
দর্শন দিয়ো দিক্‌ভ্রান্তে।'

  বুঝেছ বন্যা? চাঁদ ডাক দিয়েছে শুকতারাকে, সে আপনার রাত পোহাবার সঙ্গিনীকে চায়। নিজের রাতটার 'পরে ওর বিতৃষ্ণা হয়ে গেছে।—

ধরা যেথা অম্বরে মেশে
আমি আধো-জাগ্রত চন্দ্র,
আঁধারের বক্ষের 'পরে
আধেক আলোকরেখা-রন্ধ্র।

  ওর এই আধখানা জাগা, ওই অল্প একটুখানি আলো, আঁধারটাকে সামান্য খানিকটা আঁচড়ে দিয়েছে। এই হল ওর খেদ। এই স্বল্পতার জালে ওকে জড়িয়ে ফেলেছে, সেইটে ছিঁড়ে ফেলবার জন্যে ও যেন সমস্ত রাত্রি ঘুমোতে ঘুমোতে গুমরে উঠছে। কী আইডিয়া! গ্র্যাণ্ড্!

আমার আসন রাখে পেতে
নিদ্রাগহন মহাশূন্য।
তন্ত্রী বাজাই স্বপনেতে,
তন্দ্রা ঈষৎ করি ক্ষুণ্ণ।

 কিন্তু, এমন হালকা করে বাঁচার বোঝাটা যে বড্‌ডো বেশি; যে নদীর জল মরেছে তার মন্থর স্রোতের ক্লান্তিতে জঞ্জাল জমে, যে স্বল্প সে নিজেকে বইতে গিয়ে ক্লিষ্ট হয়। তাই ও বলছে—

মন্দচরণে চলি পারে,
যাত্রা হয়েছে মোর সাঙ্গ।
সুর থেমে আসে বারে বারে,
ক্লান্তিতে আমি অবশাঙ্গ।

 কিন্তু, এই ক্লান্তিতেই কি ওর শেষ? ওর ঢিলে তারের বীণাকে নতুন করে বাঁধবার আশা ও পেয়েছে, দিগন্তের ওপারে কার পায়ের শব্দ ও যেন শুনল। ―

সুন্দরী ওগো শুকতারা,
রাত্রি না যেতে এসো তূর্ণ।
স্বপ্নে যে বাণী হল হারা
জাগরণে করো তারে পূর্ণ।

 উদ্ধারের আশা আছে, কানে আসছে জাগ্রত বিশ্বের বিপুল কলরব, সেই মহাপথের দূতী তার প্রদীপ হাতে করে এল ব'লে।—

নিশীথের তল হতে তুলি
লহো তারে প্রভাতের জন্য।
আঁধারে নিজেরে ছিল ভুলি,
আলোকে তাহারে করো ধন্য।
যেখানে সুপ্তি হল লীনা,
যেথা বিশ্বের মহামন্দ্র,
অর্পিনু সেথা মোর বীণা
আমি আধো-জাগ্রত চন্দ্র।

 এই হতভাগা চাঁদটা তো আমি। কাল সকালবেলা চলে যাব। কিন্তু, চলে যাওয়াকে তো শূন্য রাখতে চাই নে। তার উপরে আবির্ভাব হবে সুন্দরী শুকতারার, জাগরণের গান নিয়ে। অন্ধকার জীবনের স্বপ্নে এতদিন যা অস্পষ্ট ছিল সুন্দরী শুকতারা তাকে প্রভাতের মধ্যে সম্পূর্ণ করে দেবে। এর মধ্যে একটা আশার জোর আছে, ভাবী প্রত্যুষের একটা উজ্জ্বল গৌরব আছে। তোমার ওই রবি ঠাকুরের কবিতার মতো মিইয়ে-পড়া হাল-ছাড়া বিলাপ নয়।

 ‘রাগ করো কেন মিতা? রবি ঠাকুর যা পারে তার বেশি সে পারে না, এ কথা বার বার বলে লাভ কী?'

 ‘তোমরা সবাই মিলে তাকে নিয়ে বড়ো বেশি—'

 ‘ও কথা বলো না মিতা। আমার ভালো-লাগা আমারই —তাতে যদি আর-কারো সঙ্গে আমার মিল হয়, বা তোমার সঙ্গে মিল না হয়, সেটাতে কি আমার দোষ? নাহয় কথা রইল, তোমর সে পঁচাত্তর টাকার বাসায় একদিন আমার যদি জায়গা হয় তা হলে তোমার কবির লেখা আমাকে শুনিয়ো, আমার কবির লেখা তোমাকে শোনাব না।'

 ‘কথাটা অন্যায় হল যে। পরস্পর পরস্পরের জুলুম ঘাড় পেতে বহন করবে, এইজন্যেই তো বিবাহ।'

 ‘রুচির জুলুম তোমার কিছুতেই সইবে না। রুচির ভোজে তোমরা নিমন্ত্রিত ছাড়া কাউকে ঘরে ঢুকতে দাও না, আমি অতিথিকেও আদর করে বসাই।'

 ‘ভালো করলুম না তর্ক তুলে। আমাদের এখানকার এই শেষ সন্ধেবেলার সুর বিগড়ে গেল।'

 ‘একটুও না। যা-কিছু বলবার আছে সব স্পষ্ট করে বলেও যে সুরটা খাঁটি থাকে সেই আমাদের সুর। তার মধ্যে ক্ষমার অন্ত নেই।'

 ‘আজ আমার মুখের বিস্বাদ ঘোচাতেই হবে। কিন্তু বাংলা কাব্যে হবে না। ইংরেজি কাব্যে আমার বিচারবুদ্ধি অনেকটা ঠাণ্ডা থাকে। প্রথম দেশে ফিরে এসে আমিও কিছুদিন প্রোফেসারি করেছিলুম।'

 লাবণ্য হেসে বললে, 'আমাদের বিচারবুদ্ধি ইংরেজ-বাড়ির বুল্‌ডগের মতো— ধুতির কোঁচাটা দুলছে দেখলেই ঘেউ ঘেউ করে ওঠে। ধুতির মহলে কোন্‌টা ভদ্র ও তার হিসেব পায় না। বরঞ্চ খানসামার তকমা দেখলে লেজ নাড়ে।'  ‘তা মানতেই হবে। পক্ষপাত জিনিসটা স্বাভাবিক জিনিস নয়। অধিকাংশ স্থলেই ওটা ফর্মাশে তৈরি। ইংরেজি সাহিত্যে পক্ষপাত কানমলা খেয়ে খেয়ে ছেলেবেলা থেকে অভ্যেস হয়ে গেছে। এই অভ্যাসের জোরেই এক পক্ষকে মন্দ বলতে যেমন সাহস হয় না অন্য পক্ষকে ভালো বলতেও তেমনি সাহসের অভাব ঘটে। ধাক্ গে, আজি নিবারণ চক্রবর্তীও না, আজ একেবারে নিছক ইংরেজি কবিতা— বিনা তর্জমায়।’

 ‘না না মিতা, তোমার ইংরেজি থাক্‌, সেটা বাড়ি গিয়ে টেবিলে বসে হবে। আজ আমাদের এই সন্ধেবেলাকার শেষ কবিতাটি নিবারণ চক্রবর্তীর হওয়াই চাই। আর-কারো নয়।’

 অমিত উৎফুল্ল হয়ে বললে, ‘জয় নিবারণ চক্রবর্তীর। এতদিনে সে হল অমর। বন্যা, তাকে আমি তোমার সভাকবি করে দেব। তুমি ছাড়া আর-কারো দ্বারে সে প্রসাদ নেবে না।’

 ‘তাতে কি সে বরাবর সন্তুষ্ট থাকবে?'

 ‘না থাকে তো তাকে কান মলে বিদায় করে দেব।’

 ‘আচ্ছা, কান মলার কথা পরে স্থির করব, এখন শুনিয়ে দাও।’

 অমিত আবৃত্তি করতে লাগল—

কত ধৈর্য ধরি
ছিলে কাছে দিবসশর্বরী।
তব পদ-অঙ্কনগুলিরে
কতবার দিয়ে গেছ মোর ভাগ্য-পথের ধূলিরে।
আজ যবে

দূরে যেতে হবে
তোমারে করিয়া যাব দান
তব জয়গান।

কতবার ব্যর্থ আয়োজনে
এ জীবনে
হোমাগ্নি উঠে নি জ্বলি,
শূন্যে গেছে চলি
হতাশ্বাস ধূমের কুণ্ডলী!
কতবার ক্ষণিকের শিখা
আঁকিয়াছে ক্ষীণ টিকা
নিশ্চেতন নিশীথের ভালে!
লুপ্ত হয়ে গেছে তাহা চিহ্নহীন কালে।

এবার তোমার আগমন
হোমহুতাশন
জ্বেলেছে গৌরবে।
যজ্ঞ মোর ধন্য হবে।
আমার আহুতি দিনশেষে
করিলাম সমর্পণ তোমার উদ্দেশে।

লহো এ প্রণাম
জীবনের পূর্ণ পরিণাম

এ প্রণতি-'পরে
স্পর্শ রাখো স্নেহভরে।
তোমার ঐশ্বর্য-মাঝে
সিংহাসন যেথায় বিরাজে
করিয়ো আহ্বান,
সেথা এ প্রণতি মোর পায় যেন স্থান।'