শেষ লীলা/তৃতীয় পরিচ্ছেদ

তৃতীয় পরিচ্ছেদ।

 আমাদিগের এই সকল ব্যাপার দেখিয়া, ত্রৈলোক্য যে স্থানে বসিয়াছিল, সেই স্থান হইতে গাত্রোত্থান করিয়া, আমার পার্শ্বে আসিয়া দাঁড়াইল, এবং আমাকে কহিল, “আমি নির্জ্জনে আপনাকে দুই একটী কথা বলিতে চাহি।”

 ত্রৈলোেক্যের কথা শুনিয়া আমিও গাত্রোত্থান করিলাম, এবং তাহার সহিত সেই বাড়ীর ভিতর একটু অন্তরালে গমন করিলাম।

 সেই স্থানে ত্রৈলোক্য কহিল, মহাশয়! হরি আমার পুত্ত্র, তাহা আপনি অবগত আছেন, এবং তাহাকে আমি কিরূপ প্রাণের সহিত ভালবাসি, তাহাও আপনি জানেন। আপনি যে অপরাধের নিমিত্ত হরিকে বন্ধন করিয়াছেন, এবং যাহার বিপক্ষে বাড়ীর সকলেই সাক্ষ্য প্রদান করিতেছে, সেই হরির দ্বারা সেই হত্যাকাণ্ড ঘটে নাই; নিরপরাধ হইয়াও হরি আমার মারা যাইতেছে।

 আমি। হরি যদি এই হত্যা না করিল, তাহা হইলে বাড়ীর সমস্ত লোকেই উহার বিপক্ষে বলিতেছে কেন? আর কেইবা রাজকুমারীকে হত্যা করিল?

 ত্রৈলোক্য। বাড়ীর সকলে যে কেন হরির বিপক্ষে বলিতেছে, তাহা আমি কিছুই বুঝিয়া উঠিতে পারি না। প্রকৃতপক্ষে কেবল একটী মাত্র স্ত্রীলোক ভিন্ন অপরে ইহার কিছুই অবগত নহে।

 আমি। সেই স্ত্রীলোেকটী কে?

 ত্রৈলোক্য। প্রিয়।

 আমি। প্রিয় কি জানে?

 ত্রৈলোক্য। প্রিয় জানে যে, আমার দ্বারা এই হত্যাকাণ্ড হইয়াছে। প্রিয় জানে যে, এই হত্যাকাণ্ডে সেই আমাকে সহায়তা করিয়াছে।

 আমি। আপন পুত্ত্রকে বাঁচাইবার নিমিত্ত কেন মিথ্যা কথা বলিতেছ?

 ত্রৈলোক্য। মিথ্যা কথা নহে, আমি সম্পূর্ণরূপ সত্য কথা কহিতেছি।

 আমি। যদি তুমি প্রকৃত কথা বলিতে চাহ, তাহা হইলে গোপনে আমাকে বলিবার কিছুমাত্র প্রয়োজন নাই। প্রকৃতপক্ষে যাহা তুমি অবগত আছ, বা নিজে তুমি যাহা করিয়াছ, তাহা সকলের সম্মুখে প্রকাশ কর। তোমার সমস্ত কথা শুনিলে তখন আমরা বুঝিতে পারিব যে, তোমার কথা কতদূর প্রকৃত। বুঝিব, এই হত্যা তোমার দ্বারা হইয়াছে কি না,মিথ্যা কথা বলিয়া তুমি হরিকে বাঁচাইবার চেষ্টা করিতেছ কি না।

 ত্রৈলোক্য। আমি মিথ্যা বলিয়া হরিকে বাঁচাইবার চেষ্টা করিতেছি না। চলুন, আমি যাহা জানি, তাহা সর্ব্বসমক্ষে বলিতেছি। আমার সকল কথা শুনিলে নিশ্চয়ই আপনারা আমার প্রাণের হরিকে ছাড়িয়া দিবেন।

 এই বলিয়া ত্রৈলোক্য পুনরায় আপনার স্থানে আসিয়া উপবেশন করিল, আমিও আপন স্থানে প্রত্যাবর্ত্তন করিলাম।

 সেই স্থানে উপবেশন করিয়া, ত্রৈলোক্য আমাকে লক্ষ্য করিয়া কহিল, “আপনি আমার অনেক বিষয় অবগত আছেন। সুতরাং মনোযোগ দিয়া শ্রবণ করিলে, আপনি আমার অবস্থা যতদূর বুঝিতে পারিবেন, ততদুর আর কেহই বুঝিয়া উঠিতে পারিবেন না!”

 এই বলিয়া ত্রৈলোক্য বলিতে আরম্ভ করিল,—“যে হত্যাপরাধে আপনি আমাকে বিচারার্থ প্রেরণ করিয়াছিলেন, আমি প্রকৃতুই সেই অপরাধে অপরাধী ছিলাম; কিন্তু ইংরাজের আইনের বলে ও বিচারকের বিচারের গুণে, আমি সে যাত্রা পরিত্রাণ পাই। বিচারে অব্যাহতি পাইয়া, যে স্থানে আমি পূর্ব্বে বাস করিতাম, সেই স্থানে গিয়া পুনরায় বাস করিতে আরম্ভ করি। আমার দুষ্কার্য্যের প্রধান সহায় সেই বোবা, তাহা বোধ হয়, আপনি জানেন; তাহার সেই সময় মৃত্যু হওয়ায়, আমি পুনরায় সেইরূপ কার্য্য করিতে একবারে অসহায় হইয়া পড়ি। এদিকে সেই পাড়ার লোকেই ক্রমে আমার চরিত্রের বিষয় অবগত হইয়া পড়ে; সুতরাং আমার কথায় আর কেহই বিশ্বাস করিত না। এমন কি আমার সঙ্গে অনেকেই বাক্যালাপ পর্য্যন্তও করিত না। তখন সেই স্থানে আর বাস করা যুক্তিযুক্ত নহে, বিবেচনা করিয়া, আমি আমার সমস্ত দ্রব্যসামগ্রী এবং আমার প্রাণের পুত্ত্র হরিকে লইয়া সেই স্থান পরিত্যাগ করি। পরিশেষে পাঁচুধোপানির গলির এই বাড়ীতে আসিয়া একখানি ঘর ভাড়া করিয়া লই। এই স্থানের কোন লোকেই আমাকে চিনিত না, বা কোন স্ত্রীলোকের সহিত আমার আলাপ-পরিচয়ও ছিল না। সুতরাং এই স্থানে এতদিবস আমি নির্ব্বিবাদে বাস করিয়া আসিতেছিলাম। আমি এই বাড়ীতে উঠিয়া আসিবার কিছুদিবস পরে, প্রিয় আসিয়াও এই বাড়ীতে একখানি ঘর ভাড়া লয়, এবং সেই পর্য্যন্ত সেও এই স্থানে অবস্থিতি করিতেছে। যে সময় প্রিয় এই বাড়ীতে উঠিয়া আইসে, সেই সময় হইতেই তাহার উপর কেমন আমার একটু ভালবাসা জন্মায়। পরে কিছুদিন থাকিতে থাকিতে প্রিয়ও আমাকে সবিশেষরূপ যত্ন করিতে আরম্ভ করে, এবং ক্রমে আমার সবিশেষ অনুগত হইয়া পড়ে।

 “যে সময় আমি এই বাড়ীতে উঠিয়া আসিয়াছিলাম, সেই সময় আমার চলাচলের সবিশেষ কোন কষ্ট ছিল না। পূর্ব্বে নানারূপ অসৎ উপায়ে যে সকল অর্থ উপার্জ্জন করিয়াছিলাম, এখন পর্য্যন্তও তাহার কিছু অর্থ আমার নিকট ছিল; কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই সকল অর্থ ক্রমে নিঃশেষিত হইয়া গেল। পুনরায় আমার অর্থের প্রয়োজন হইতে লাগিল।

 “এই বাড়ীতে যতগুলি স্ত্রীলােক আছে, তাহাদের সকলের অপেক্ষা রাজকুমারীই কিছু দরিদ্র ভাবে থাকিত; কিন্তু সকলের যাহা নাই, রাজকুমারীর তাহা ছিল। তাহার কতকগুলি উৎকৃষ্ট উৎকৃষ্ট সােণার অলঙ্কার ছিল। কিন্তু তাহার অধিকাংশই সে ব্যবহার করিত না, উহা তাহার বাক্সের মধ্যে প্রায়ই আবদ্ধ থাকিত।

 “সেইসকল অলঙ্কার দেখিয়া পর্য্যন্ত উহার উপর আমার অতিশয় লােভ হইল। কিরূপে সেই অলঙ্কারগুলি আমার হস্তগত হইতে পারে, সর্ব্বদা কেবল তাহারই চিন্তা করিতে লাগিলাম; কিন্তু মনের চিন্তা অধিক দিবস গােপনে রাখিতে পারিলাম না। কথায় কথায় একদিবস আমার মনের ভাব প্রিয়র নিকট প্রকাশ করিয়া ফেলিলাম। দেখিলাম, প্রিয়ও আমার ইচ্ছার অনুগামিনী হইল। তখন কিরূপ উপায়ে রাজকুমারীর অলঙ্কারগুলি অপহরণ করিতে সমর্থ হই, উভয়ে মিলিয়া তাহার পরামর্শ করিতে আরম্ভ করিলাম। পরিশেষে ইহা সাব্যস্ত হইল যে, উহাকে কোনরূপে অজ্ঞান করিয়া তাহার গহনাগুলি অপহরণ করিব। যেরূপ পরামর্শ হইল, কার্য্যেও তাহার সেইরূপ সংগ্রহ করিলাম; কিয়দ্দিন পরে ধুতুরার বীজ সংগ্রহ করিয়া তাহা উত্তমরূপে চূর্ণ করিয়া রাখিলাম।”

 আমি। ধুতুরার বীজ সংগ্রহ করিলে কিরূপে?

 ত্রৈলােক্য। আমার পূর্ব্ব বাসস্থান ছিল পাড়াগাঁয়ে; সুতরাং ধুতুরা যে কি জিনিষ, তাহা আমি বেশ জানি। উহার গুণ আমি অবগত আছি, এবং কোথায় যে উহা পাওয়া যায়, তাহাও আমার জানিতে বাকী নাই। একদিবস সহরের বাহিরে একখানি বাগানে কতকগুলি ধুতুরার গাছ দেখিতে পাই। উহা হইতে কয়েকটা ফল আনিয়া, তাহা চূর্ণ করিয়া আপন গৃহে রাখিয়া দি।

 আমি। তাহার পর কি হইল?

 ত্রৈলােক্য। ধূতুরার গুড়া সংগ্রহ করিয়া রাখিলাম সত্য; কিন্তু রাজকুমারীকে উহা প্রয়ােগ করিবার সুযোগ কয়েকদিবসের মধ্যে করিয়া উঠিতে পারিলাম না। আমি পরে জনিয়াছিলাম যে, যেরূপ করিয়া তামাকু সাজিয়া খাইতে হয়, সেরূপ করিয়া সিদ্ধি সাজিয়া খাইলে অতিশয় নেসা হয়; সুতরাং কিছু সিদ্ধিও আমি সংগ্রহ করিয়া রাখিয়া দিয়াছিলাম। এই সমস্ত দ্রব্য সংগ্রহ করিয়া আমি চারি পাঁচদিবস রাখিলাম; কিন্তু কোনরূপ সুযােগ করিতে পারিলাম না।

 “একদিবস রাজকুমারী তাহার একটী পরিচিত স্ত্রীলোেকর সহিত সাক্ষাৎ করিতে গমন করিয়াছিল। আমিও তাহার সহিত গিয়াছিলাম। যখন আমরা উভয়ে সেই স্থান হইতে প্রত্যাগমন করি, সেই সময় কিছু সন্দেশ আমি খরিদ করিয়া আনিয়াছিলাম। সেই সন্দেশ যে আমি নিজে ভােজন করিব বলিয়া আনিয়াছিলাম, তাহা নহে, উহার দ্বারাই আমি রাজকুমারীর সর্ব্বনাশ সাধন করিব, এই অভিপ্রায়ই আমি উহা আনিয়াছিলাম।

 “আমি পূর্ব্বেই বলিয়াছি যে, আমি কতকটা ধূতুরার গুঁড়া সংগ্রহ করিয়া রাখিয়া দিয়াছিলাম। এখন আমি এবং প্রিয় উভয়ে মিলিয়া সেই সন্দেশের কতকগুলিতে সেই গুঁড়া মিশ্রিত করিয়া দিলাম, কতকগুলি সন্দেশ ভাল রহিল। তখন উহা আমরা পৃথক পাত্রে, আমার ঘরের ভিতরে যে একটা আলমারি আছে, তাহার মধ্যে চাবি-বদ্ধ করিয়া রাখিয়া দিলাম। আলমারির ভিতর উহা বদ্ধ করিয়া রাখিবার কারণ এই যে, পাছে হরি জানিতে পারিয়া সেই সন্দেশ খাইয়া ফেলে।

 “যে দিবস প্রাতঃকালে রাজকুমারীর মৃতদেহ পাওয়া যায়, তাহার পূর্ব্ব দিবস সন্ধ্যার সময় রাজকুমারী আমার গৃহে আসিয়া উপবেশন করে, এবং সন্ধ্যার অনেকক্ষণ পর পর্য্যন্ত আমার গৃহে বসিয়া নানারূপ গল্প-গুজবে নিযুক্ত হয়। প্রিয়ও সেই সময় আমার গৃহে ছিল। সেই সময় মনে করিয়াছিলাম বিষমিশ্রিত সন্দেশ কোনরূপে সেই স্থানে রাজকুমারীকে খাওয়াইব। কিন্তু কার্য্যে তাহা করিয়া উঠিতে পারি নাই। কারণ আমার মনে হয়, যদি রাজকুমারী অজ্ঞান হইয়া আমারই গৃহে পতিত হয়, তাহা হইলে গোলযোগ হইয়া পড়িবে; সুতরাং আমার মনোবাঞ্ছা কোনরূপেই পূর্ণ করিতে সমর্থ হইব না। এই ভাবিয়া যতক্ষণ পর্য্যন্ত সে আমার গৃহে ছিল, ততক্ষণ পর্য্যন্ত তাহাকে সেই সন্দেশ খাওয়াইবার নিমিত্ত কোনরূপ উদ্‌যোগ করিলাম না। পরিশেষে সে যখন উঠিয়া আমার গৃহ হইতে তাহার নিজের গৃহে গমন করিল তখন আমি ও প্রিয় উভয়েই তাহার সহিত গমন করিয়া তাহার গৃহে গিয়া উপবেশন করিলাম। যে একখানি মাজুরের উপর রাজকুমারীর মৃতদেহ পাওয়া গিয়াছিল, আমাদিগের বসিবার নিমিত্ত রাজকুমারী সেই মাজুর বিছাইয়া দেয়। আমরা তাহার উপর উপবেশন করিলে, সেও উহার উপর আমাদিগের সন্নিকটে উপবেশন করে। সেই গৃহে বসিয়া বসিয়া ক্রমে রাত্রি এগারটা বাজিয়া গেল।

 রাত্রি আন্দাজ সাড়ে এগারটার সময় আমি প্রিয়কে কহিলাম, ‘ভাই! বড় ক্ষুধা লাগিয়াছে, কিছু খাইতে ইচ্ছা করিতেছে।’

 “প্রিয় আমার মনের ভাব বুঝিতে পারিল ও কহিল, ‘আমারও ক্ষুধা লাগিয়াছে। রাজকুমারী ত আমাদিগকে কিছু খাইতে দিবে না, চল আমরা গিয়া আমাদের গৃহে আহার করিয়া আসি।’

 “উত্তরে রাজকুমারী কহিল, ‘কেন আমার কি কিছুই নাই যে, তোমাদিগকে কিছু আহার করিতে দিতে পারিব না? কি খাইতে চাও, বল না।’

 “আমি কহিলাম, ‘আর কিছুই খাইব না। অনেক দিন ফলার করি নাই, আজ মনটা বলিতেছে ফলার করি।’

 “এই বলিয়া প্রিয়কে কহিলাম, ‘বোন, দই-চিড়া ও কিছু মিষ্ট দ্রব্য যদি এখন খরিদ করিয়া আনিতে পার, তাহা হইলে খরিদ করিয়া আন না কেন। আমরা তিনজনেই এই স্থানে বসিয়া ফলার করিব এখন?’

 “আমার কথা শুনি রাজকুমারী গাত্রোত্থান করিল, এবং প্রিয়কে সেই স্থানে বসিতে বলিয়া কয়েকটী পয়সা লইয়া সে বাহিরে গমন করিল। আমরা তাহার গৃহে বসিয়া নানারূপ দুরভিসন্ধির উপায় স্থির করিতে লাগিলাম। সেই সময় বাড়ীর অপর আর কেহই জাগরিত ছিল না। কিয়ৎক্ষণ পরে রাজকুমারী কিছু চিড়া, দই ও মিষ্টান্নের সহিত প্রত্যাবর্ত্তন করিল। আমরা সেই সকল দ্রব্য দুইখানি পাত্রে রাখিয়া তাহাতেই আহারের বন্দোবস্ত করিলাম। একখানি পাত্রে রাজকুমারীকে দিলাম, সে সেই পাত্রে আহার করিতে লাগিল; আর একখানি পাত্রে আমি ও প্রিয় উভয়ে আহার করিতে বসিলাম। সেই সময় প্রিয় কহিল, ‘ফলারে মিষ্টতা কিছু কম হইয়াছে।’ প্রিয়র কথার উত্তরে আমি প্রিয়কে কহিলাম, ‘আমার এই চাবি লইয়া যাও, আলমারির ভিতর সন্দেশ ছিল, যদি থাকে, তাহা হইলে উহা আন।’

 “প্রিয় আমার অভিসন্ধি বুঝিতে পারিয়া আমার আলমারি হইতে বিষমিশ্রিত এবং বিষ-অমিশ্রিত সমুদায় সন্দেশ আনিয়া আমার নিকট রাখিয়া দিল। উহা হইতে যে সন্দেশে বিষমিশ্রিত ছিল না, তাহার কিয়দংশ আমি গ্রহণ করিলাম, অবশিষ্ট প্রিয়কে দিলাম। আর যাহাতে বিষমিশ্রিত ছিল তাহা রাজকুমারীকে প্রদান করিলাম। রাজকুমারী তাহার কিয়ৎ পরিমাণে ভোজন করিল; খাইতে ভাল লাগিতেছে না বলিয়া সকল খাইয়া উঠিতে পারিল না। কিন্তু সে যাহা আহার করিল, তাহাতেই তাহার নেসা হইল; তবে একবারে হতজ্ঞান হইয়া পড়িল না।

 “এই ব্যাপার দেখিয়া আমি প্রিয়াকে এক ছিলুম তামাকু সাজিতে কহিলাম। প্রিয় আমার দুরভিসন্ধি বুঝিতে পারিয়া তামাকুর পরিবর্ত্তে সিদ্ধি সাজিয়া আনিল। তামাকু বলিয়া রাজকুমারীকে সেই সিদ্ধির ধূমও পান করাইলাম; কিন্তু তাহাতেও রাজকুমারী একবারে সংজ্ঞাশূন্য হইয়া পড়িল না। আমার ইচ্ছা ছিল যে, রাজকুমারী অজ্ঞান হইয়া পড়িলে পর, উহার সমস্ত অলঙ্কার চুরি করিয়া লইব। কিন্তু সেও অজ্ঞান হইল না, আমিও আমার অভিলষিত উপায়ে তাহার অলঙ্কারগুলি হস্তগত করিতে সমর্থ হইলাম না। তখন আমি অনন্যোপায় হইয়া উহার বুকের উপর বসিয়া জোর করিয়া উহার গলা টিপিয়া ধরিলাম; প্রিয়কে কহিলাম, ‘উহার পা দুইখানি চাপিয়া ধর।’ প্রিয় তাহাই করিল, জোর করিয়া তাহার পা চাপিয়া ধরাতে রাজকুমারী আর জোর করিতে পারিল না। দেখিতে দেখিতে তাহার প্রাণবায়ু বাহির হইয়া গেল। তখন আমরা উহার সমস্ত অলঙ্কার বাহির করিয়া লইয়া উহার গৃহের দরজা ভেজাইয়া রাখিয়া উহার গৃহ হইতে বাহির হইয়া আসিলাম। আমার ইচ্ছা ছিল না যে, উহাকে হত্যা করিয়া উহার যথাসর্ব্বস্ব অপহরণ করিয়া লইব; কিন্তু কার্য্যের গতিতে এবং লোভের বশবর্ত্তী হইয়া, পরিশেষে আমি উহাকে হত্যা করিয়া ফেলিলাম।

 “মহাশয়! এখন ত জানিতে পারিলেন যে, রাজকুমারীকে কে হত্যা করিয়াছে। এখন ত আপনি আপনি বুঝিতে পারিলেন যে, এই হত্যাকাণ্ডের কিছুই হরি অবগত নহে। এখন আপনি হরিকে অব্যাহতি প্রদান করুন। নির্দ্দোষ হরিকে আর কষ্ট দিবেন না। এ খুন হরি করে নাই, হরির এ কার্য্য করিবার ক্ষমতাও নাই। বাড়ীর সকলে মিথ্যা কথা বলিয়া হরির সর্ব্বনাশ করিতে বসিয়াছে। এই মহাপাপের নায়িকা আমি। আমার দ্বারাই এই মহাপাপ সম্পাদিত হইয়াছে। আমিই রাজকুমারীকে হত্যা করিয়াছি। এই মহাপাপের নিমিত্ত যে দণ্ড আপনারা আমার উপর বিধান করিবেন, আমি সেই দণ্ড গ্রহণ করিতে সম্মত আছি।

 “মহাশয়। আমি যে সকল কথা আপনাদিগের নিকট স্বীকার করিলাম, তাহা আমি এ পর্য্যন্ত স্বীকার করিয়াছিলাম না, এবং কখনও করিতাম না; কিন্তু হরির উপর যেরূপ প্রমাণ সংগ্রহ হইয়াছে, দেখিতে পাইতেছি, গহনা পাওয়া যাউক, আর না যাউক, তাহার ফাঁসি নিশ্চয়। এই ব্যাপার দেখিয়া আমার প্রাণ হু হু করিয়া কাঁদিয়া উঠিতেছে! আমার পাপে নির্দ্দোষ হরির প্রাণ যায় দেখিয়া, মন একবারে অধীর হইয়া পড়িতেছে। প্রবল পুত্ত্রস্নেহ আসিয়া আমার মন অধিকার করিতেছে। পূর্ব্বে আমার যেরূপ মনের গতি ছিল, এখন আর তাহা নাই, উহা একবারে পরিবর্ত্তিত হইয়া পড়িতেছে। হরির প্রাণ অপেক্ষা এখন আমার প্রাণকে নিতান্ত তুচ্ছ জ্ঞান করিতেছি। তাই আপনাকে বলিতেছি, যখন আপনি প্রকৃত দোষীকে প্রাপ্ত হইয়াছেন, তখন হরিকে আর নিরর্থক কষ্ট প্রদান করিতেছেন কেন? আমার সম্মুখে তাহাকে মুক্তি প্রদান করুন। তাহার কষ্ট আর ক্ষণমাত্রও দেখিতে পারিতেছি না!”

 ত্রৈলােকের এই কথা শুনিয়া, সেই স্থানে যে সকল কর্ম্মচারী উপস্থিত ছিলেন, সকলেই একবারে বিস্মিত হইয়া পড়িলেন। বাড়ীর অপরপর স্ত্রীলোকগণ যাহারা ইতিপূর্ব্বে হরির বিপক্ষে সাক্ষ্য প্রদান করিয়াছিল, তাহারা মস্তক অবনত করিয়া সেই স্থানে বসিয়া রহিল; এবং মধ্যে মধ্যে, এক একবার বক্রদৃষ্টি করিয়া ত্রৈলােক্যকে দেখিতে লাগিল।

 আমি কহিলাম, আপনার পুত্ত্রকে বাঁচাইতে কে না চেষ্টা করিয়া থাকে? তুমি তােমার পুত্ত্র হরিকে বাঁচাইবার নিমিত্ত যে এইরূপ মিথ্যা কথা কহিবে, তাহার আর আশ্চর্য্য কি? আমি যেরূপ প্রমাণ পাইতেছি, তাহাতে রাজকুমারী যে হরি কর্ত্তৃক হত হইয়াছে, তাহা আমরা একরূপ স্থিরই করিয়া লইয়াছি। কিন্তু তুমি এখন বলিতেছ, সেই হত্যা হরির দ্বারা হয় নাই, তােমার দ্বারাই হইয়াছে। কেবল তােমার কথার নির্ভর করিয়া, আমি কার্য্য করিতে পারি না। এই খুন যে তুমি করিয়াছ, তােমার নিজের কথা ব্যতীত তাহার আর প্রমাণ কি?—যে, সেই প্রমাণের উপর নির্ভর করিয়া, আমি হরিকে অব্যাহতি প্রদান করিতে পারি?”

 ত্রৈলোক্য। এই খুন যে আমি করিয়াছি, তাহার যথেষ্ট প্রমাণ আছে। প্রথমতঃ এই কথা আমি সর্ব্বসমক্ষে মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করিতেছি। দ্বিতীয়তঃ, ওই প্রিয় ইহার সমস্ত অবগত আছে, উহাকে ঈশ্বরের দিব্য দিয়া জিজ্ঞাসা করুন; ও প্রকৃত কথা বলিলে, আপনাদিগের মনে আর কোনরূপ সন্দেহ থাকিবে না, আপনারা সমস্ত বিষয়ই জানিতে পারিবেন। আমার বিশ্বাস যে, প্রিয় এখন আমাকে বাঁচাইবার অভিপ্রায়ে আর মিথ্যা কথা কহিবে না। তৃতীয়তঃ, যে বিষমিশ্রিত সন্দেশের কিয়দংশ রাজকুমারীকে খাইতে দিয়াছিলাম, তাহার অবশিষ্ট সন্দেশ এখনও আমার আলমারির ভিতর আছে। যে সকল কর্ম্মচারী আমার আলমারি অনুসন্ধান করিয়াছেন, তাঁহারা সকলেই সেই সন্দেশ দেখিয়াছেন। সেই সন্দেশ পরীক্ষা করিয়া দেখুন যে উহাতে ধূতুরা চূর্ণ আছে কি না। সিদ্ধির কাগজও, বোধহয় আমার ঘরে পড়িয়া আছে। ইহা অপেক্ষা অধিক প্রমাণ আর কি চাহেন?

 আমি। অধিক প্রমাণ আর কিছুই চাহি না; যদি তুমি রাজকুমারীকে হত্যা করিয়া, তাহার অলঙ্কারগুলি অপহরণ করিয়া থাক, তাহা হইলে সেই অপহৃত অলঙ্কারগুলি সর্ব্বসমক্ষে বাহির করিয়া দেও। তাহা হইলে বুঝিতে পারিব যে, এই হত্যা হরির দ্বারা হয় নাই, তোমার দ্বারাই এই হত্যা হইয়াছে। তখন হরিকে অব্যাহতি প্রদান করিতে আমাদিগের আর কিছু মাত্র আপত্তি থাকিবে না।

 ত্রৈলোক্য। উত্তম কথা, যদি ইহাতেও আপনারা আমার কথা বিশ্বাস না করেন, নির্দ্দোষ হরিকে ছাড়িয়া না দেন, তাহা হইলে আপনারা আমার সঙ্গে আসুন, আমি সেই সকল অপহৃত অলঙ্কার বাহির করিয়া আপনাদিগের হস্তে অর্পণ করিতেছি। তাহা হইলে হরিকে ছাড়িয়া দিতে আপনাদিগের ত আর কোনরূপ আপত্তি থাকিবে না?

 আমি। তাহা হইলে আর আমাদিগের আপত্তি থাকিবে কেন? কিন্তু তুমি অলঙ্কারগুলি কোথায় রাখিয়াছ, বল দেখি।

 ত্রৈলোক্য। কোথায় আর রাখিব? আমার ঘরেতেই আছে।

 অপরাপর কর্ম্মচারীগণ। ঘরের কোথায় আছে?

 ত্রৈলোক্য। আমার ঘরে আলমারির মধ্যেই আছে।

 অপরাপর কর্ম্মচারীগণ। মিথ্যা কথা। সেই আলমারি আমরা প্রত্যেকেই এক একবার করিয়া দেখিয়াছি। উহার ভিতর সেই সকল অলঙ্কার কোনরূপেই থাকিতে পারে না।

 ত্রৈলোক্য। পারে না পারে, তাহা লইয়া তর্ক করিবার প্রয়োজন নাই। আপনারে আমার সঙ্গে আসুন, দেখুন, সেই আলমারির ভিতর হইতে রাজকুমারীর সমস্ত অলঙ্কার আমি বাহির করিয়া দিতে পারি কি না।

 এই বলিয়া ত্রৈলোক্য আমাদিগের সকলের সমভিব্যাহারে তাহার গৃহের ভিতর প্রবেশ করিল এবং আমাদিগকে কহিল “যে স্থানে আলমারিটী স্থাপিত আছে, সেই স্থান হইতে উহা একটু সম্মুখের দিকে সরাইয়া দিন।” এই কথা বলিবামাত্র, সেই আলমারি আমার প্রায় এক হস্ত সম্মুখ ভাগে সরাইয়া দিলাম। ত্রৈলোক্য সেই আলমারির পশ্চাৎ ভাগে গমন করিয়া, উহার পশ্চাদ্‌ভাগে যে একটী দেরাজের মত অংশ ছিল, তাহা খুলিয়া, তাহার মধ্য হইতে রাজকুমারীর সমস্ত অলঙ্কারগুলি বাহির করিল, এবং আমাদিগের হস্তে প্রদান করিল। এই ব্যাপার দেখিয়া কর্ম্মচারী মাত্রেই, একবারে বিস্মিত হইয়া পড়িলেন; কারণ তাঁহারা প্রত্যেকেই সেই আলমারি এক একবার অনুসন্ধান করিয়াছিলেন।

 সেই আলমারির ভিতর হইতে কর্ম্মচারীগণ যে সেই সকল অলঙ্কার পূর্ব্বে বাহির করিতে পারেন নাই, তাহাতে তাঁহাদিগের কিছু মাত্র দোষ ছিল না। কারণ সেই আলমারির গঠন স্বতন্ত্ররূপ ছিল। আলমারির সর্ব্ব-উপরিস্থিত তক্তার ছয় ইঞ্চি নিম্নে, অথচ কার্ণিসের ভিতরে আর একখানি তক্তা এরূপ ভাবে বসান ছিল যে, ভিতর হইতে দেখিলে বোধ হইত, সেই তক্তা খানিই আলমারির সর্ব্ব-উপরের তক্তা। উপরের তক্তা খানি যেরূপ ভাবে কার্ণিসের সহিত আবদ্ধ থাকে, উহাও ঠিক সেইরূপ ভাবে সম্মুখ হইতে আবদ্ধ ছিল; কিন্তু আলমারির কার্ণিশের মধ্যে উপর্য্যুপরি দুই খানি তক্তার ভিতর দুই ইঞ্চি পরিমিত ব্যবধান ছিল। তাহার ভিতর দ্রব্যাদি রাখিবার বা উহা হইতে দ্রব্যাদি বাহির করিয়া লইবার নিমিত্ত আলমারির পশ্চাৎ একটী দরজা ছিল। এক খানি কাছে উহা এরূপ আড়ভাবে বসান যে, পশ্চাৎ হইতে দেখিলেও কেহ সহজে বুঝিতে পারিতেন না যে, উহার মধ্যে একটা দেরাজের মত স্থান আছে। সেই এড়ে কাষ্ঠখানি আলমারির যে পার্শ্বে শেষ হইয়াছে, সেই পার্শ্বে সেই কাষ্ঠের গায়ে একটু সামান্য ফাটা দাগ ছিল মাত্র। সেই দাগের ভিতর নখ বসাইয়া এক পার্শ্বে সরাইয়া দিলে সেই এড়ো কাষ্ঠ খানি সরিয়া যাইত; সুতরাং সেই দেরাজের মুখ ফাঁক হইয়া পড়িত। তখন তাহার মধ্যে ইচ্ছানুযায়ী দ্রব্য রাখিয়া দিয়া বা তাহা হইতে কোন দ্রব্য বাহির করিয়া লইয়া, সেই এড়ো কাষ্ঠ সরাইয়া দিলে ঠিক আপন স্থানে আসিয়া উপস্থিত হইত। তখন উহার মধ্যে দ্রব্যাদি রাখিবার যে একটী স্থান আছে, তাহা আর কাহারও অনুমান করিবার সাধ্য থাকিত না।

 পরিশেষে দেখা গেল যে, ত্রৈলোক্য আপন পুত্ত্রকে বাঁচাইবার নিমিত্ত যাহা যাহা বলিয়াছে, তাহার সমস্তই প্রকৃত। সন্দেশে বাস্তবিকই বিষ পাওয়া গেল, তাহার ঘর অনুসন্ধান করিয়া, কিছু সিদ্ধির সহিত এক খানি কাগজও বাহির হইল। প্রিয়ও পরিশেষে সমস্ত কথা স্বীকার করিয়া, তাহার বিপক্ষে সাক্ষ্য প্রদান করিল। তখন আমরা হরিকে অব্যাহতি প্রদান করিলাম, এবং বন্দীরূপে ত্রৈলোক্যকে মাজিষ্ট্রেট সাহেবের নিকট পাঠাইলাম। মাজিষ্ট্রেট সাহেব তাহার বিপক্ষে সাক্ষ্য-প্রমাণাদি গ্রহণ করিয়া, বিচারার্থ তাহাকে হাইকোর্টে প্রেরণ করিলেন।

 এই সময় ত্রৈলোক্য আমাদিগের জুয়াচুরি বুঝিতে পারিয়াছিল। সেই সময় সে আমাকে এক দিবস কহিল, “এত দিবসের মধ্যে আমি কখনও কাহারও কথায় ভুলি নাই, বা কাহারও কৌশলে কখনও পতিত হই নাই; কিন্তু আপনার কৌশল-জাল আমি ছিন্ন করিতে পারিলাম না। সেই সময় আমি একবার স্বপ্নেও ভাবি নাই যে, আপনি আমার মত শঠের উপরেও শঠতা বিস্তার করিয়াছেন। এখন আমি জানিতে পারিয়াছি যে, সেই সময় আপনি যাহা করিয়াছিলেন, তাহার সমস্তই আপনার চাতুরী। আপনি বাড়ীর সমস্ত লোককে শিখাইয়া, আমাকে চাতুরী-জালে জড়ীভূত করিবার মানসেই তাহাদিগের দ্বারা মিথ্যা বলাইয়াছিলেন, এবং প্রকাশ্যরূপে সকলকেই দেখাইয়াছিলেন যে, আমার নির্দ্দোষ পুত্ত্র হরিই এই ভয়ানক অপরাধে অপরাধী, সে-ই রাজকুমারীর প্রাণহন্তা। উঃ আপনাদিগের কি ভয়ানক চাতুরী! কি ভয়ানক কৌশল!! যদি আমি সেই সময় আপনার ভয়ানক চাতুরী-জালে না পড়িতাম, পুত্ত্রস্নেহের ভয়ানক পীড়নে পীড়িত না হইতাম, এবং আপনার ভয়ানক কৌশলে আমি হতবুদ্ধি না হইয়া রাজকুমারীর অপহৃত অলঙ্কারগুলি আমার আলমারির ভিতর হইতে বাহির করিয়া আপনাদিগের হস্তে প্রদান না করিতাম, তাহা হইলে আজ আমি যে ভয়ানক অবস্থায় পড়িয়াছি, সেইরূপ অবস্থায় কখনই পতিত হইতাম না। আপনারা সকলে মিলিয়া অনেক বার আমার আলমারি অনুসন্ধান করিয়াছিলেন; কিন্তু উহার ভিতর হইতে রাজকুমারীর অপহৃত অলঙ্কারগুলি কোনরূপেই বাহির করিতে সমর্থ হন নাই এবং আমার বিশ্বাস যে, আপনারা বিধিমত চেষ্টা করিলেও সেই গহনার কোনরূপ সন্ধান করিয়া উঠিতে পারিতেন না। কেবল আমিই আমার সর্ব্বনাশ সাধন করিয়াছি, আমিই আমার নিজের পায় সবলে কুঠারাঘাত করিয়াছি। যদি আপনারা সেইরূপ কৌশলজালে আমাকে নিপাতিত না করিয়া, আমার নিকট হইতে সেই সকল অলঙ্কারগুলি বাহির করিয়া লইতে সমর্থ না হইতেন, তাহা হইলে আপনারা আমার কিছুই করিয়া উঠিতে পারিতেন না; পূর্ব্বে যেরূপ অসংখ্য হত্যা করিয়া, অসংখ্য স্ত্রীলোকের সর্ব্বস্ব অপহরণ করিয়া, বিনা-দণ্ডে নিষ্কৃতি লাভ করিয়াছিলাম, এ যাত্রাও আমি সেইরূপ ভাবে আপন জীবন রক্ষা করিতে সমর্থ হইতাম; আপনারা বিধিমতে চেষ্টা করিয়াও, আমার মস্তকের এক গাছি কেশও উৎপাটিত করিতে সমর্থ হইতেন না। যে পর্য্যন্ত আমি আপন মুখ খুলি নাই, সেই পর্য্যন্ত প্রিয়ও কোন কথা বলে নাই; এবং সহজে সে কোন কথা প্রকাশও করিত না। প্রিয় মনে মনে জানিত, আমি রাজকুমারীর যে সকল অলঙ্কার অপহরণ করিয়াছিলাম, সেই সকল অলঙ্কার আমি একাকী কখনই গ্রহণ করিব না। তুল্যাংশ না হউক, সে যে উহার কোন না কোন অংশ প্রাপ্ত হইত, তাহার আর কিছুমাত্র সন্দেহ ছিল না। বিশেষতঃ রাজকুমারীকে হত্যার নিমিত্ত আমিও যেরূপ দোষে দোষী, তাহার অপরাধও আমার সেই দোষ অপেক্ষা কোন অংশে ন্যূন নহে। সে বেশ জানিত, এই কথা তাহার মুখ দিয়া প্রকাশ পাইলে, আমার দশা এবং তাহার দশা সমানই হইবে, তখন সে কোনরূপেই এই সকল কথা আপনাদিগের নিকট প্রকাশ করিত না। কিন্তু যখন সে দেখিল যে, আমি সমস্ত গুহ্য কথা প্রকাশ করিয়া ফেলিলাম, তখন সে বুঝিল যে, সমস্ত কথা প্রকাশ করিয়া দেওয়া তাহার পক্ষেও মঙ্গল। কারণ, যখন তাহাকেও আমার সহিত ফাঁসি কাষ্ঠে ঝুলিতে হইবে, তখন যদি সমস্ত কথা প্রকাশ করিয়া কোনরূপে সে আপনাদিগের অনুগ্রহ-প্রার্থী হইতে পারে, তাহা সে না করিবে কেন? প্রকৃত কথা বলিলে আপনারা তাহার জীবন রক্ষা করিবেন, এই কথা যখন আপনারা সকলে মিলিয়া তাহাকে বুঝাইলেন, তখন সে তাহার অনিচ্ছা সত্তায়ও প্রকৃত কথা কহিল। আর প্রকৃত কথা না বলিলেই বা তাহার উপায় কি? আপনাদিগের কথা শুনিয়া সে সমস্ত প্রকৃত কথা প্রকাশ করিয়া দিয়াছিল বলিয়াই, আজ আপনারা তাহার জীবন রক্ষা করিলেন, সে কেবল মাত্র আমার বিপক্ষে সাক্ষ্য দিয়া পরিত্রাণ পাইল। নতুবা আজ আমার যে দশা, তাহারও ঠিক সেই দশা ঘটিত। এই কার্য্যের নিমিত্ত আমি প্রিয়কে দোষ দিই না, তাহার বুদ্ধিরই প্রশংসা করি। কারণ, আপনাদিগের কথা শুনিয়া, এই একমাত্র উপায় অবলম্বন না করিলে, তাহার আর কোনরূপেই বাঁচিবার উপায় ছিল না। আর আপনারাও যে, আমাকে ভয়ানক কৌশল-জালে ফেলিয়া আমার নিকট হইতে সমস্ত কথা বাহির করিয়া লইয়াছিলেন, তাহার নিমিত্তও আমি আপনাদিগের উপর কোনরূপ দোষার্পণ করি না। কারণ দোষীগণকে দণ্ড দেওয়াই আপনাদিগের কার্য্য।

 “হরি যে নিরপরাধ, তাহা আপনারা পূর্ব্ব হইতেই জানিতেন, আপনারা কৌশল-জাল বিস্তার করিয়া, বাড়ীর সমস্ত লোকদিগের দ্বারা মিথ্যা কথা বলাইয়া, হরি যে এই ভয়ানক হত্যা করিয়াছে, তাহা লোক-দেখানমত প্রমাণ করিতেছিলেন সত্য; কিন্তু বলুন দেখি, যদি আমার নিকট হইতে প্রকৃত কথা প্রাপ্ত না হইতেন, তাহা হইলে নিরপরাধ হরিকে মিথ্যা করিয়া কি কখনও ফাঁসি কাষ্ঠে ঝুলাইতে পারিতেন? কখনই না, বাধ্য হইয়া আপনারা হরিকে যে নিশ্চয়ই ছাড়িয়া দিতেন, তাহার আর কিছু মাত্র সন্দেহ নাই। নিজ বুদ্ধির দোষে যাহা করিয়া ফেলিয়াছি, তাহার নিমিত্ত এখন আর পরিতাপ করিলে ফল কি? এ পর্য্যন্ত যে সকল মহাপাপ করিয়াছি, তাহার উপযুক্ত দণ্ড পাওয়াই আমার সর্ব্বতোভাবে কর্ত্তব্য।”

 যাহা হউক, হাইকোর্টে জজসাহেব জুরির সাহায্যে ত্রৈলােকের বিচার করিলেন। বিচার কার্য্যে যাহা ঘটিয়াছিল, এবং বিচার ফল যাহা হইয়াছিল, তাহা স্বতন্ত্র করিয়া বর্ণন করিবার আর আমার প্রয়ােজন নাই; আমি তৎ-কাল-প্রকাশিত একখানি সংবাদপত্র হইতে ত্রৈলােক্যের বিচার-ফল নিম্নে উদ্ধৃত করিয়া দিলাম।


FIFTH CRIMINAL SESSIONS.—

SEPTEMBER £.

(Before the Hon’ble Mr. Justice Norris)

SECOND DAY.

 EMPRESSvs.TROYLUCKO RAUR.— Prisoner was indicated for murder, and is being tried by a special jury.

 Mr. Phillips, with Mr. Dunne, prosecuted.

 Mr. G. L. Fagan defended the prisoner.

 Mr. Phillips in opening the case to the jury, said that it was certainly a singular one. He would first relate to them the external circumstances. The deceased, Rajcooomaree Raur, a woman of the town, lived in the same house as the prisoner, where other women of similar character, also lived, in Panchoo Dhobani's gully. On the evening of the 9th August, the prisoner asked the deceased procure for her certain food— parched rice and gur and that she would pay her later. The prisoner was expecting the man in whose keeping she was, and she intended paying for the articles when he come. He came and left, and after midnight prisoner paid the deceased. They, that is, the prisoner, the deceased, and a woman named Preeo Raur, then procured other food; and when the prisoner and Preeo Raur ate from one cop, the deceased ate from another. After eating the food, the deceased complained of being unwell, and went downstairs to her own room, the other two women going with her. And here the story ended. It was not until they came to a later stage at night, that one of the women seeing the prisoner, coming out of the room of the deceased, questioned her, and the prisoner replied, that she had gone there to get some food which Rajcoomaree had purchased for her. The evidence would show that she was the last person seen coming out of the room of the deceased. Matters stood thus till the following morning, when one of the women, seeing the door of Rajcoomaree's room open, called out to her, and receiving no answer, looked in and found her lying dead on the floor. The police were then called in, and the post mortem examination, held on the body of the deceased, resulted in the medical officer giving it as his opinion that the deceased had died from strangulation. On her (the deceased's) neck were marks of finger-nails, and the question arose, who had killed her? As the learned Standing Counsel had told the jury, there was one other woman, besides the prisoner, who had _____ of the food with the deceased. This woman said that after the deceased had eaten, she complained of a bad taste and smell, when she was recommended by the prisoner to have a smoke; and her evidence as regards this, was that the prisone bought her a hookah containing some sort of opiam known as bhang, which made the deceased feel wane. For these facts, the prosecution relied on the evience of the woman Preeo, who was first charged as an accomplice, but during the course of the proceedings at the Police Court, the Magistrate tendered her a pardon, when she made the following statement. According to the statement, after the deceased complained of feeling unwell, Preeo herself went to bed. Afterwards she says, she saw the prisoner coming upstairs with the deceased's ornaments. Seeing this she asked her what she had done, and if she had killed the deceased. The prisoner replied that, she had; that she had done for others before, and that if she did not hold her peace, she would do for her also. Of course, it would be a serious question for the jury to decide, if they could place any reliance on the evidence of Preeo. The statement of an approver could not be acted upon unless it was corroborated in every particular. In the interests of public safety it was necessary at times to resort to the evidence of such persons—accomplices in the crime—possibly to the fullest extent. It was of the utmost importance to know, that the ornaments of the deceased were found in a cheffonier belonging to prisoner and in her room. Evidence would also be given to prove that when the prisoner was taken into custody, her nails were long, but that a sort time after they were found to be cut. The doctor who held the post mortem examination would also tell them, that the prisoner was a more powerful woman than the deceased and Preeo and from these and other surrounding circumstances which would come to light during the trial, the jury would have to arrive at their verdict.

 Dr. S. C. Mackenzie, the Police Surgeon, who held the post mortem examination, was the only witness examined, after which the Court rose for the day.


FIFTH CRIMINAL SESSIONS,—

SEPTEMBER 3.

(Before the Hon’ble Mr. Justice Norris)

THIRD DAY.

EMPRESS vs. TROYLUCKO RAUR.— On the case being resumed yesterday, the remaining evidence for the prosecution was gone into, when Mr. Fagan, addressing the jury in defence of the prisoner, said, that he believed the jury would be glad if they could honestly arrive at a verdict of not guilty. In cases of this kind, the great difficulty the prisoner had to contend against was that the evidence was all on one side. A large mass of evidence was gathered together by the Crown, with great difficulty, and at some expense, to convict the prisoner; while on the other hand, there was nothing except the prisoner's own statement. While all the ingenuity of the Police was arrayed against her, it should never forgotten that she was a native woman, without any kowledge of law, and from the circumstances of her social position, without any friends. It might be said that, if she was innocent, she may have nailed evidence. But how was she to compel these men to come and give evidence on her behalf? They had no interest in the case. The only interest they took in the matter was to keep clear of the Police and thus it was that it came about, that while there was a long and elaborate statement on one side there was no evidence of contradiction on the other. Learned counsel briefly recapitulated the statement of Preeo and commenting on it, said that the law on the subject was that the evidence of an accomplice may be believed, but the presumption was strongly against its being true.

 His Lordship interposed, by saying that he intended to ask the Jury if they thought the woman Preeo was an accomplice. It was true she had obtained a pardon from the Magistrate on the condition of her speaking the truth; but as far as he could see, it was no account of the accusation brought against her by the prisoner.

 Mr. Fagan, continuing his address, asked, by whom Preeo's evidence, supposing it to be true, had been corroborated?—by two or three women of her own walks of life. It was perfectly fair to contend that evidence of this kind, got first of all from a woman, who at one time, at any rate, was under strong suspicion of being an accomplice, could be got by the bushel, for such women were as pliant in the hands of the Police, as they could possibly be. They knew exactly what the Police wanted, they did not care a straw for the prisoner, and they gave the evidence that was wanted from them. Such evidence had been given by the Police before, where a man, supposed to have then murdered, walked into Court during the trial. He would leave it to the jury to say what the case must be which was to be decided on the value of such evidence. He would submit, that it was utterly worthless, and before they gave their verdict, they should take it well and strongly into their consideration as to who gave the evidence. The witnesses cared absolutely nothing for the life of the prisoner, their only interest being to get rid of the Police. The drugging theory, learned counsel went on to say, was an after-thought, and the case and the evidence had been built upon that suggestion afterwards. Besides, he would ask the jury to remember that the prisoner had ample opportunity to go away, or hide the ornaments, but what she did was to give the ornaments up voluntarily to the Police, or at all events, without their being looked for in any way. In conclusion, Mr. Fagan would ask the jury to remember that the prisoner was a woman, and if it was right to feel pity for a prisoner, it was doubly right to feel pity for a woman. He would therefore ask them to give her every chance they could, and not to be astonished by the fact of the evidence for the prosecution being consistent, as it was bound to be so.

 His Lordship having summed up, the jury retired to consider their verdict. They returned after about half-an-hour, when the foreman said, that eight of them were of one mind, and one jury man was of arbitrary opinion.

 His Lordship—I understand, gentlemen, that one of your number is of opinion; that in order to convict a person of murder, there should be eye-witnesses of the offence. That I think, SIR, in your view, is it not?

 Mr. Abdool Hai (dissenting Juror)— That is so my Lord.

 His Lordship—Then it is my duty to tell you that it is not the law of the land and that the obligation you have taken upon yourself is to deliver a verdict in this case, according to the law of the country, in which you live and in where you are governed, and it is my duty to lay down the law to you, and your duty to accept that law as laid down by me; and the law of the land does not require— and one cannot conceive how any person or persona could be safe, if the law require that in every case there should be eyewitnesses to an offence. If that, were so, crimes of enormous magnitude, and of unparallelled atrocity would go undiscovered, it may be— certainly unpunished. The law is that you must take the whole of the evidence which has been given on the part of the prosecution into your careful consideration, weighing carefully and attentively, with every desire to consider the prisoner's case as favourably as you possibly can. But if you are of opinion that the evidence is true, then you have but one duty to perform. I must tell you, SIR, that watever your peculiar religious scruples and conscientious convictions may be, they ought to be set aside, and you ought to deliver your verdict in this case acoording to the law of the land. That is the direction I have to give you. If you still entertain an objection of course I must accept the verdict of the majority but I shall be glad, if you, after the directions I have given you, can see your way to concur with your fellows.

 After a short consultation, the foreman addressing His Lordship, said the juryman wishes me to explain that he has been able to follow most of what your Lordship said, although he is not sufficiently master of English to be able to take any reply; but he is still of the same mind, that he was before, and is not prepared to accept the verdict of the majority.”

 His Lordship said that, under the circumstances, he would accept the verdict of the majority.

 The Clerk of the Crown then asked the foreman what the verdict was, and was told that it was a verdict of guilty.

 Prisoner was then asked if she had anything to say why sentence of death should not be passed upon her.

 The prisoner through the interpreter said that she had nothing more to say than that she had not committed the murder.

 His Lordship thereupon passed the following sentence:—Prisoner at the bar, after a very patient investigation, and after having had the advantage of being defended by learned counsel, who has done his utmost on your behalf with the material he had before him, the Jury have found you guilty of the crime of wilful murder; and I fail to see how they would have come to on other conclusion, I don't know what truth there maybe in the statement which you are said to have made to girl Preeo, that you had previously top this, committed four দুষ্পাঠ্য murders. It is plain to my mind, and it has দুষ্পাঠ্য plain to the mind of the jury, that you murdered thiss unfortunate girl. What your motive was is দুষ্পাঠ্য plain. Sedaced by lustful desire to দুষ্পাঠ্য to your own possession those ornaments দুষ্পাঠ্য adorned her body during her life-time, you foully did her to death cruel and most atrocious দুষ্পাঠ্য. I feel it may bounden duty to pass upon yon the extreme sentence of the law, and the sentence that this Court adjudges is that you be taken hence in the place from whence you came, and from thence to the place of execution, there to be hanged by the neck until you be dead.

 The prisoner, who took the দুষ্পাঠ্য very calmly, was then romoved from the dock.

 This closed the Sessions.”

 The Statesman and Friends of India, 4th September, 1884.

সম্পূর্ণ।


কার্ত্তিক মাসের সংখ্যা,

“ছেলে-ভুল।”

(অর্থাৎ অপহৃত বালক উদ্ধারের অদ্ভুত রহস্য!