শেষ সপ্তক/ছেচল্লিশ
ছেচল্লিশ
তখন আমার বয়স ছিল সাত।
ভােরের বেলায় দেখতেম জানলা দিয়ে
অন্ধকারের উপরকার ঢাকা খুলে আসছে,
বেরিয়ে আসছে কোমল আলাে
নতুন-ফোটা কাঁটালি চাঁপার মতাে।
বিছানা ছেড়ে চলে যেতেম বাগানে
কাক ডাকবার আগে,
পাছে বঞ্চিত হই
কম্পমান নারকেল-শাখাগুলির মধ্যে
সূর্যোদয়ের মঙ্গলাচরণে।
তখন প্রতি দিনটি ছিল স্বতন্ত্র, ছিল নতুন।
যে প্রভাত পূর্বদিকের সােনার ঘাট থেকে
আলােতে স্নান করে আসত
রক্তচন্দনের তিলক এঁকে ললাটে,
সে আমার জীবনে আসত নতুন অতিথি,
হাসত আমার মুখে চেয়ে।
আগেকার দিনের কোনাে চিহ্ন ছিল না তার উত্তরীয়ে।
তার পরে বয়স হল
কাজের দায় চাপ মাথার 'পরে।
দিনের পরে দিন তখন হল ঠাসাঠাসি।
তারা হারালাে আপনার স্বতন্ত্র মর্যাদা।
এক দিনের চিন্তা আর-এক দিনে হল প্রসারিত,
এক দিনের কাজ আর-এক দিনে পাতল আসন।
সেই একাকার-করা সময় বিস্তৃত হতে থাকে,
নতুন হতে থাকে না-
একটানা বয়েস কেবলই বেড়ে ওঠে,
ক্ষণে ক্ষণে শমে এসে
চিরদিনের ধুয়ােটির কাছে
ফিরে ফিরে পায় না আপনাকে।
আজ আমার প্রাচীনকে নতুন করে নেবার দিন এসেছে।
ওঝাকে ডেকেছি, ভূতকে দেবে নামিয়ে।
গুণীর চিঠিখানির জন্যে
প্রতিদিন বসব এই বাগানটিতে-
তাঁর নতুন চিঠি
ঘুমভাঙার জানলাটার কাছে।
প্রভাত আসবে
আমার নতুন পরিচয় নিতে,
আকাশে অনিমেষ চক্ষু মেলে
আমাকে সুধাবে
'তুমি কে'।
আজকের দিনের নাম
খাটবে না কালকের দিনে
সৈন্যদলকে দেখে সেনাপতি,
দেখে না সৈনিককে—
দেখে আপন প্রয়ােজন,
দেখ না সত্য,
দেখে না স্বতন্ত্র মানুষের
বিধাতাকৃত আশ্চর্য রূপ।
এতকাল তেমনি করে দেখেছি সৃষ্টিকে,
বন্দিদলের মতাে
প্রয়ােজনের এক শিকলে বাঁধা।
তার সঙ্গে বাঁধা পড়েছি
সেই বন্ধনে নিজে।
আজ নেব মুক্তি।
সামনে দেখছি সমুদ্র পেরিয়ে
নতুন পার।
তাকে জড়াতে যাব না
এ পারের বােঝার সঙ্গে।
এ নৌকোয় মাল নেব না কিছুই,
যাব একলা
নতুন হয়ে নতুনের কাছে।