ব্যবহারকারী:Subrata Roy/শ্রীশ্রীচৈতন্যচরিতামৃত/আদিলীলা/তৃতীয় পরিচ্ছেদ


শ্রীচৈতন্যপ্রভুং বন্দে যৎপাদাশ্রয়বীর্য্যতঃ।
সংগৃহ্ণাত্যাকরব্রাতাদজ্ঞঃ সিদ্ধান্ত-সম্মণীন্‌।।১

অন্বয়ঃ।- অজ্ঞ (মূর্খ ব্যক্তি) যৎপাদাশ্রয়বীর্য্যতঃ (যাঁহার চরণাশ্রয়প্রভাবে) আকরব্রাতাৎ (শাস্ত্ররূপখনিসমূহ হইতে) সিদ্ধান্ত-সম্মণীন্ (সিদ্ধান্তরূপ উৎকৃষ্ট মণিসকল) সংগৃহ্ণাতি (সংগ্রহ করিতে সমর্থ হয়) [তং] শ্রীচৈতন্য-প্রভুং বন্দে (সেই শ্রীচৈতন্যপ্রভুকে বন্দনা করি)।

অনুবাদ।- শ্রীচৈতন্য প্রভুকে বন্দনা করি। তাঁর চরণ আশ্রয় করলে অজ্ঞজনও শাস্ত্র থেকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে - খনি থেকে মণি চয়নের মত।।১।।

জয় জয় শ্রীচৈতন্য জয় নিত্যানন্দ।
জয়াদ্বৈতচন্দ্র জয় গৌরভক্তবৃন্দ।।
তৃতীয় শ্লোকের অর্থ কৈল বিবরণ।
চতুর্থ শ্লোকের অর্থ শুন ভক্তগণ।।
তথাহি - বিদগন্ধমাধবে ১।২
অনর্পিতচরীং চিরাৎ করুণয়াবতীর্ণঃ কলৌ
সমর্পয়িতুমুন্নতোজ্জ্বলরসাং স্বভক্তিশ্রিয়ম্‌।
হরিঃ পুরটসুন্দর-দ্যুতিকদম্ব-সন্দীপিতঃ
সদা হৃদয়কন্দরে স্ফুরতু বঃ শচীনন্দনঃ।।২

ইহার অন্বয় ও অনুবাদ প্রথম পরিচ্ছেদে ৪র্থ শ্লোকে দ্রষ্টব্য।।২।।

পূর্ণ ভগবান্‌ কৃষ্ণ ব্রজেন্দ্র-কুমার।
গোলোকে ব্রজের সহ নিত্য বিহার (১)।।
ব্রহ্মার এক দিনে তিহোঁ একবার।
অবতীর্ণ হঞা করেন প্রকট বিহার।।
সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর, কলি, চারিযুগ জানি।
সেই চারিযুগে দিব্য একযুগ মানি।।
একাত্তর - চতুর্যুগে এক মন্বন্তর।
চৌদ্দ মন্বন্তর ব্রহ্মার দিবস ভিতর (২)।।
বৈবস্বত নাম এই সপ্ত মন্বন্তর।
সাতাইশ চতুর্যুগে তাহার অন্তর।।
অষ্টাবিংশ চতুর্যুগে - দ্বাপরের শেষে।
ব্রজের সহিতে (৩) হয় কৃষ্ণের প্রকাশে।।
দাস্য, সখ্য, বাৎসল্য, শৃঙ্গার - চারি রস।
চারি ভাবের ভক্ত যত কৃষ্ণ তার বশ।।
দাস সখা পিতা মাতা কান্তাগণ লঞা।
ব্রজে ক্রীড়া করে কৃষ্ণ প্রেমাবিষ্ট হঞা।।
যথেচ্ছা বিহরি কৃষ্ণ করে অন্তর্দ্ধান।
অন্তর্দ্ধান করি মনে করে অনুমান।।
চিরকাল নাহি করি প্রেম-ভক্তি দান।
ভক্তি (৪) বিনা জগতের নাহি অবস্থান।।
সকল জগতে মোরে করে বিধি ভক্তি।
বিধিভক্ত্যে (৫) ব্রজ-ভাব পাইতে নাই শক্তি।।
ঐশ্বর্য্য জ্ঞানে সব জগৎ মিশ্রিত।
ঐশ্বর্য্য-শিথিল প্রেমে নাহি মোর প্রীত (৬)।।

(১) গোলোকে - বৈকুণ্ঠের উপরিতন স্বনামপ্রসিদ্ধ শ্রীকৃষ্ণলোকে; ব্রজের - অচিন্ত্যশক্তিদ্বারা মর্ত্তালোকে আবির্ভূত স্বনামপ্রসিদ্ধ মথুরা-মণ্ডলরূপে প্রতীয়মান শ্রীকৃষ্ণলোকের। সহ - একই সময়ে। অনাদিকাল হইতে শ্রীকৃষ্ণলীলা চলিতেছে, ঐ লীলার পরিসমাপ্তি নাই, সুতরাং শ্রীকৃষ্ণলীলা নিত্য। অথবা ব্রজের - ব্রজপরিকরগণের।

(২) চৌদ্দ মন্বন্তর - স্বায়ম্ভুব, স্বারোচিষ, উত্তম, তামস, রৈবত, চাক্ষুষ, বৈবস্বত, সাবর্ণি, দক্ষসাবর্ণি, ব্রহ্মসাবর্ণি, ধর্ম্মসাবর্ণি, রুদ্রসাবর্ণি, দেবসাবর্ণি এবং ইন্দ্রসাবর্ণি - এই চতুর্দ্দশ মনুর অধিকারকাল।

(৩) ব্রজের সহিত - ব্রজমণ্ডল ও ব্রজস্থিত পরিকরের সঙ্গে।

(৪) ভক্তি - প্রেমভক্তি।

(৫) বিধিভক্তে - অনুরাগশূন্য হইয়া শাস্ত্রের শাসনে নরক-ভয় নিবারণের জন্য যে ভজন তদ্দারা।

(৬) শ্রীকৃষ্ণকে ততক্ষণই আত্মীয় ভাবিয়া ভালবাসা যায় যতক্ষণ মনে তাঁহার ঐশ্বর্য্যের বিষয় উদিত না হয়। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অধিপতিকে ক্ষুদ্র জীব আপনার জন বলিয়া ভাবিতে এবং ভালবাসিতে পারে না। সুতরাং ভগবান্‌ ঐশ্বর্য্যজ্ঞানশূন্য প্রীতিরই অভিলাষী, কারণ সেই প্রীতিই যথার্থ প্রীতি।

ঐশ্বর্য্য-জ্ঞানে বিধিমার্গে ভজন করিয়া।
বৈকুণ্ঠেতে যায় চতুর্ব্বিধ মুক্তি পাঞা।।
সার্ষ্টি সারূপ্য আর সামীপ্য সালোক্য (১)।
সাযুজ্য (২) না লয় ভক্ত যাতে ব্রহ্ম ঐক্য।।
যুগধর্ম্ম প্রবর্ত্তাইমু নাম সংকীর্ত্তন।
চারিভাব (৩) ভক্তি দিয়া নাচাইমু ভুবন।।
আপনে করিমু ভক্ত-ভাব অঙ্গীকারে।
আপনি আচরি ধর্ম্ম শিখাইমু সভারে।।
আপনে না কৈলে ধর্ম্ম শিখান না যায়।
এইত সিদ্ধান্ত গীতা ভাগবতে গায়।।

(১) সার্ষ্টি - সমান ঐশ্বর্য্যপ্রাপ্তি। সারূপ্য - সমান রূপপ্রাপ্তি। সামীপ্য - সমীপে অবস্থানপ্রাপ্তি। সালোক্য - সমান লোকপ্রাপ্তি।

(২) সাযুজ্য - ভগবানে লয়প্রাপ্তি।

(৩) চারিভাব - দাস্য, সখ্য, বাৎসল্য ও মধুর।

শ্রীমদ্ভাগবদগীতায়াং (৪।৮)
পরিত্রাণায় সাধুনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম্‌।
ধর্ম্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে।।৩

অন্বয়ঃ।- [শ্রীকৃষ্ণ অর্জ্জুনকে কহিতেছেন] সাধুনাং (স্বধর্ম্মনিষ্ঠ পূণ্যাত্মাদিগের) পরিত্রাণায় (পরিত্রাণের জন্য) চ (পুনঃ) দুষ্কৃতাং (দুষ্কৃতকারীগণের) বিনাশায় (বধের জন্য) ধর্ম্মসংস্থাপনার্থায় (ধর্ম্মসংস্থাপনের জন্য) যুগে যুগে সম্ভবামি (প্রতিযুগে অবতীর্ণ হইয়া থাকি)।

অনুবাদ।- সাধুদিগের পরিত্রাণ, দুর্জনের বিনাশ, ধর্ম্মের সংস্থাপন - এই তিন উদ্দেশ্যে যুগে যুগে আমি অবতীর্ণ হই।।৩।।

তত্রৈব (৩।২৪)
উৎসীদেয়ুরিমে লোকা
ন কুর্য্যাং কর্ম্ম চেদহম্‌।।
সঙ্করস্য চ কর্ত্তা স্যা-
মূপহন্যামিমাঃ প্রজাঃ।।৪

অন্বয়ঃ।- [শ্রীকৃষ্ণ অর্জ্জুনকে কহিতেছেন] চেৎ (যদি) অহং (শ্রীকৃষ্ণ) কর্ম্ম ন কুর্য্যাং (কার্য্য না করি) [তদা (তাহা হইলে)] ইমে লোকাঃ উৎসীদেয়ুঃ (এই সকল লোক ধর্ম্মভ্রষ্ট হইয়া বিনষ্ট হইবে) চ (তাহা হইলে) সঙ্করস্য (বর্ণসঙ্করের) কর্ত্তা স্যাৎ (কর্ত্তা হইব) ইমাঃ প্রজাঃ উপহন্যাম্‌ (এই প্রজাগণকে মলিন করিব বা ধর্ম্মভ্রষ্ট করিব)।

অনুবাদ।- আমি যদি কর্ম্ম না করি তাহ'লে এই লোকজগৎ বিনষ্ট হবে। আমিও বর্ণসঙ্করের কর্ত্তা হব, সৃষ্টিও লুপ্ত হবে।।৪।।

তথাহি - শ্রীমদ্ভাগবতে (৬।২।৪)
যদ্‌যদাচরতি শ্রেয়ানিতরস্তত্তদীহতে।
স যৎ প্রমাণং কুরুতে লোকস্তদনুবর্ত্ততে।।৫

অন্বয়ঃ।- [যমদূতের প্রতি বিষ্ণুদূতের বাক্য] শ্রেয়ান্‌ (শ্রেষ্ঠ জন) যৎ যৎ আচরতি (যাহা যাহা আচরণ করেন) ইতরঃ তৎ তৎ ঈহতে (অন্য প্রাকৃত লোকও তাহাই করিতে চেষ্টা করে) সঃ যৎ প্রমাণং কুরুতে (সেই শ্রেষ্ঠজন যাহাকে প্রমাণ মনে করেন) লোকঃ তৎ অনুবর্ত্ততে (সাধারণ লোকে তাহারই অনুসরণ করে)।

অনুবাদ।- শ্রেষ্ঠ ব্যক্তির আচরণ দেখেই অন্য সকলে আচরণ শেখে। তিনি যা প্রমাণ ব'লে নির্দ্দেশ ক'রে যান - অন্যেরা তারই অনুসরণ করে।।৫।।

যুগ-ধর্ম্ম প্রবর্ত্তন হয় অংশ হৈতে।
আমা বিনা অন্যে নারে ব্রজ-প্রেম দিতে।।
তথাহি - লঘুভাগবতামৃতে পূর্ব্বখণ্ডে (৫।৩৭)
সন্ত্ববতারা বহবঃ পঙ্কজনাভস্য
সর্ব্বতোভদ্রাঃ
কৃষ্ণাদন্যঃ কো বা লতাস্বপি
প্রেমদো ভবতি।।৬

অন্বয়ঃ।- পঙ্কজনাভস্য (পদ্মনাভ শ্রীকৃষ্ণের) বহবঃ (বহু) সর্ব্বতঃ ভদ্রাঃ (সকলের সর্ব্বমঙ্গলপ্রদ) অবতারা সন্ত্তু (অবতার থাকুন না কেন) কৃষ্ণাদন্যঃ কঃ বা (কৃষ্ণব্যতীত আর কে) লতাসু অপি প্রেমদঃ ভবতি (লতাকে পর্য্যন্ত প্রেমদান করিতে পারে?)।

অনুবাদ।- পদ্মনাভ ভগবানের সর্ব্বকল্যাণজনক থাকুক আরো অনেক অবতার, কিন্তু কৃষ্ণ ভিন্ন আর কেই বা লতাকে পর্য্যন্ত প্রেমদান করেছেন?।।৬।।

তাহাতে আপন ভক্তগণ করি সঙ্গে।
পৃথিবীতে অবতরি করিব নানারঙ্গে।।
এত ভাবি কলিকালে প্রথম সন্ধ্যায়।
অবতীর্ণ হৈলা কৃষ্ণ আপনি নদীয়ায়।।
চৈতন্য সিংহের নবদ্বীপে অবতার।
সিংহগ্রীব সিংহবীর্য্য সিংহের হুঙ্কার।।
সেই সিংহ বসুক জীবের হৃদয়-কন্দরে।
কল্মষ-দ্বিরদ (১) নাশে যাহার হুঙ্কারে।।
প্রথম লীলায় তাঁর বিশ্বম্ভর নাম।
ভক্তি-রসে ভরিল ধরিল ভূতগ্রাম (২)।।
"ডুভৃঞ্‌" ধাতুর অর্থ ধারণ পোষণ।
ধরিল পোষিল প্রেম দিয়া ত্রিভুবন।।
শেষ লীলায় নাম ধরে শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য (৩)।
কৃষ্ণ জানাইয়া সব বিশ্ব কৈল ধন্য।।
তাঁর যুগাবতার জানি গর্গ মহাশয়।
কৃষ্ণের নামকরণে করিয়াছেন নির্ণয়।।

(১) কল্মষ-দ্বিরদ - দুর্ব্বাসনাদিরূপ মত্তহস্তী, পাপরূপ হস্তী। কল্মষ - "ভক্তির বিরোধিকর্ম্ম ধর্ম্ম বা অধর্ম্ম। তাহার কল্মষ নাম সেই মহাতম।।"

(২) ভূতগ্রাম - জীবসমূহ।

(৩) শ্রীকৃষ্ণং চেতয়তি যঃ সঃ, শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যঃ। চিৎ ধাতুর অর্থ সংজ্ঞান, যিনি শ্রীকৃষ্ণকে বোধ করান তিনি শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য। অথবা শ্রীকৃষ্ণস্য চৈতন্যং সম্যক্‌ জ্ঞানং যতঃ সঃ, শ্রীকৃষ্ণের সম্যক্‌ জ্ঞান যাহা হইতে হয় তিনি শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য।

তথাহি - শ্রীমদ্ভাগবতে (১০।৮।৯)
আসন্‌ বর্ণাস্ত্রয়ো হ্যস্য
গৃহ্ণতোহনুযুগং তনূঃ।
শুক্লো রক্ত স্তথা পীত
ইদানীং কৃষ্ণতাং গতঃ।।৭

অন্বয়ঃ।- [শ্রীকৃষ্ণের নামকরণ সময়ে গর্গমুনি কহিতেছেন] অনুযুগং (যুগে যুগে) তনূঃ গৃহ্ণতঃ (তনুগ্রহণকারী) অস্য (এই বালকের) হি (নিশ্চিত) শুক্লঃ রক্তঃ তথা পীতঃ ইতি ত্রয়ঃ বর্ণাঃ আসন্‌ (শুক্ল, রক্ত ও পীত এই তিনটি বর্ণ ছিল) ইদানীং কৃষ্ণতাং গতঃ (সম্প্রতি ইতি কৃষ্ণবর্ণ ধারণ করিয়াছেন)।

অনুবাদ।- ইনি প্রতিযুগেই তনু গ্রহণ করেন। ইনি তিন যুগে শুক্ল, রক্ত ও পীত এই তিনটি বর্ণ দেহে ধারণ করেছিলেন - এখন এই দ্বাপরে কৃষ্ণবর্ণ ধারণ করেছেন।।৭।।

শুক্ল-রক্ত-পীতবর্ণ এই তিন দ্যুতি।
সত্য-ত্রেতা-কলিকালে ধরেন শ্রীপতি।।
ইদানীং দ্বাপরে তিহোঁ হৈলা কৃষ্ণবর্ণ।
এই সব শাস্ত্রাগম পুরাণের মর্ম্ম।।
শ্রীমদ্ভাগবতে (১১।৫।২৫)
দ্বাপরে ভগবান্‌ শ্যামঃ
পীতবাসা নিজায়ুধঃ।
শ্রীবৎসাদিভিরঙ্কৈশ্চ
লক্ষণৈরুপলক্ষিতঃ।।৮

অন্বয়ঃ।- দ্বাপরে (দ্বাপরযুগে) ভগবান্‌ শ্যামঃ (শ্যামবর্ণ) নিজায়ুধঃ (নিজের চক্রাদি অস্ত্রধারী) শ্রীবৎসাদিভিঃ (শ্রীবৎসাদি) অঙ্কৈঃ লক্ষণৈঃ (শারীরিক চিহ্নের দ্বারা ও কৌস্তুভাদি লক্ষণের দ্বারা) উপলক্ষিতঃ (চিহ্নিত হইয়া থাকেন)।

অনুবাদ।- দ্বাপরে ভগবান্‌ শ্যামবর্ণ, পীতবসন ও চক্রধারী ও কৌস্তুভ প্রভৃতি চিহ্নে উপলক্ষিত হন।।৮।।

কলিকালে যুগধর্ম্ম নামের প্রচার।
তথি লাগি পীতবর্ণ চৈতন্যাবতার।।
তপ্তহেম-সম কান্তি প্রকাণ্ড শরীর।
নবমেঘ জিনি কণ্ঠধ্বনি যে গম্ভীর।।
দৈর্ঘ্যে বিস্তারে যেই আপনার হাথে।
চারি হস্ত হয় মহাপুরুষ বিখ্যাতে।।
"ন্যগ্রোধপরিমণ্ডল" হয় তার নাম।
ন্যগ্রোধ-পরিমণ্ডল-তনু চৈতন্য গুণধাম।।
আজানুলম্বিত ভুজ-কমল-লোচন।
তিলফুলজিনি নাসা - সুধাংশু বদন।।
শান্ত দান্ত কৃষ্ণ-ভক্তি-নিষ্ঠা-পরায়ণ।
ভক্তবৎসল, সুশীল, সর্ব্বভূতে সম।।
চন্দনের অঙ্গদ বালা, চন্দন ভূষণ।
নৃত্যকালে পরি করেন কৃষ্ণ-সংকীর্ত্তন।।
এই সব গুণ লঞা মুনি বৈশস্পায়ন।
সহস্র নামে কৈল তাঁর নামের গণন।।
দুই লীলা চৈতন্যের আদি আর শেষ।
দুই লীলায় চারি চারি নাম বিশেষ।।
তথাহি - মহাভারতে দানধর্ম্মে (বিষ্ণুসহস্রনাম-স্তোত্রে) ১২৭-৭৫
সুবর্ণবর্ণো হেমাঙ্গো
বরাঙ্গশ্চন্দনাঙ্গদী।
সন্ন্যাসকৃচ্ছমঃ শান্তো
নিষ্ঠাশান্তি-পরায়ণঃ।।৯

অন্বয়ঃ।- সুবর্ণবর্ণঃ (শোভনবর্ণ বা 'কৃষ্ণ' এই দুইবর্ণ, তাহা যিনি বর্ণনা করেন) হেমাঙ্গঃ (কাঞ্চনদেহ) বরাঙ্গঃ চন্দনাঙ্গদী (যাঁহার শ্রেষ্ঠ অঙ্গ চন্দনের অঙ্গদধারী বা আনন্দময় কেয়ূলধারী) সন্ন্যাসকৃৎ (যিনি সন্ন্যাসধর্ম্মাবলম্বী) শমঃ (ভগবন্নিষ্ঠবুদ্ধিযুক্ত) শান্তঃ (সুশীল) নিষ্ঠাশান্তিপরায়ণঃ (নিবৃত্তিপরায়ণ)।

অনুবাদ।- যিনি কৃষ্ণকথাশ্রয়ী - যাঁর কান্তি সোনার মত, তনু সুন্দর, বাহুভূষণ যাঁর চন্দন এবং যিনি সন্ন্যাসী, স্থিরচিত্ত, দৃঢ়নিষ্ঠ ও শান্তিপরায়ণ [তিনিই স্বয়ং কৃষ্ণ, শ্রুতিতে যাকে বলেছে হিরণ্ময় পুরুষ ও আনন্দস্বরূপ ব্রহ্ম]।।৯।।

ব্যক্ত করি ভাগবতে কহে আরবার।
কলিযুগের যুগধর্ম্ম যুগ অবতার।।
তথাহি - শ্রীমদ্ভাগবতে (১১।৫।৩১।৩২)
ইতি দ্বাপর উর্ব্বীশ
স্তুবন্তি জগদীশ্বরম্‌।
নানাতন্ত্রবিধানেন,
কলাবপি তথা শৃণু।।১০

অন্বয়ঃ।- হে উর্ব্বীশ (হে পৃথিবীপতি) ইতি দ্বাপরে জগদীশং স্তুবন্তি (দ্বাপরে জগদীশ্বরের এইরূপ ভাবে স্তব করিয়া থাকেন) কলাবপি (কিন্তু কলিকালেও) নানাতন্ত্রবিধানেন (নানাতন্ত্রের বিধান অনুসারে) [যথা যজন্তি] তথা শৃণু (যেরূপভাবে উপাসনা করিয়া থাকেন তাহা শ্রবণ কর)।

অনুবাদ।- রাজন্‌! সাধুজনেরা ভগবানের স্তব এইভাবেই ক'রে থাকেন। কলিযুগেও নানান্‌ তন্ত্রের বিধান অনুসারে যেমন করা হবে - তাও শুনুন।।১০।।

কৃষ্ণবর্ণং ত্বিষাকৃষ্ণং
সাঙ্গোপাঙ্গাস্ত্র-পার্ষদম্‌
যজ্ঞৈঃ সংকীর্ত্তন-প্রায়ৈ-
র্যজন্তি হি সুমেধসঃ।।১১

অন্বয়ঃ।- সুমেধসঃ (সুবুদ্ধিগণ) কৃষ্ণবর্ণং (কৃষ্ণের বর্ণনা করেন এমন) সাঙ্গোপাঙ্গাস্ত্রপার্ষদং (যিনি অঙ্গ ও উপাঙ্গরূপ অস্ত্র ও পার্ষদগণের সহিত বিদ্যমান) ত্বিষা অকৃষ্ণং (এবং অঙ্গকান্তিতে গৌরবর্ণ) সংকীর্ত্তনপ্রায়ৈঃ যজ্ঞৈঃ [তাঁহাকে] (সঙ্কীর্ত্তন প্রধান পূজোপকরণের দ্বারা) হি (নিশ্চিত) যজন্তি (অর্চ্চনা করিয়া থাকেন)।

অনুবাদ।- যাঁর মুখে কৃষ্ণনাম, বর্ণ যাঁর গৌর এবং অঙ্গ ও উপাঙ্গরূপ অস্ত্র ও পার্ষদ নিয়তই যাঁর বর্ত্তমান তাঁকেই পণ্ডিতজনেরা সঙ্কীর্ত্তনপ্রধান উপকরণ দিয়ে অর্চ্চনা ক'রে থাকেন।।১১।।

শুন ভাই এই সব চৈতন্য-মহিমা।
এই শ্লোকে কহে তাঁর মহিমার সীমা।
"কৃষ্ণ" এই দুই বর্ণ সদা যাঁর মুখে।
অথবা কৃষ্ণকে তিহোঁ বর্ণে নিজ সুখে।।
কৃষ্ণবর্ণ শব্দের অর্থ দুইত প্রমাণ।
কৃষ্ণ বিনা তাঁর মুখে নাহি আইসেন আন।।
কেহ তাকে বলে যদি কৃষ্ণ-বরণ।।
আর বিশেষণে তার করে নিবারণ।। (১)
দেহ-কান্ত্যে হয় তিহোঁ অকৃষ্ণ-বরণ।
অকৃষ্ণ-বর্ণ শব্দে কহে পীত-বরণ।।

(১) ১০ম শ্লোকে যে 'কৃষ্ণবর্ণ' শব্দ আছে তাহার অর্থ 'যিনি সর্ব্বদা কৃষ্ণের বর্ণনা করেন', 'কাল বর্ণযুক্ত', নহে; কারণ 'ত্বিষা অকৃষ্ণম্‌' অর্থাৎ 'গৌরকান্তিযুক্ত' এই বিশেষণ দ্বারাই দ্বিতীয় অর্থের খণ্ডন হইতেছে।

স্তবমালায়াং শ্রীচৈতন্যদেবস্য দ্বিতীয়াষ্টকে ১ম শ্লোকঃ
কলৌ যং বিদ্বাংসঃ স্ফুটমভিযজন্তে দ্যুতিভরা-
দকৃষ্ণাঙ্গং কৃষ্ণং মখবিধিভিরুৎকীর্ত্তনময়ৈঃ।
উপাস্যঞ্চ প্রাহুর্য্যমখিলচতুর্থাশ্রমজুষাম্‌।
স দেবশ্চৈতন্যাকৃতিরতিতরাং নঃ কৃপয়তু।।১২

অন্বয়ঃ।- বিদ্বাংসঃ (তত্ত্বদর্শী পণ্ডিতগণ) কলৌ স্ফুটং (কলিযুগে ব্যক্ত) দ্যুতিভরাং অকৃষ্ণাঙ্গং (কান্তির আধিক্যবশতঃ যিনি অকৃষ্ণাঙ্গ বা গৌরবর্ণ) যং কৃষ্ণং (যেই কৃষ্ণকে) উৎকীর্ত্তনময়ৈঃ মখবিধিভিঃ (উচ্চ সংকীর্ত্তনপ্রধান যজ্ঞবিধির দ্বারা) অভিযজন্তে (অর্চ্চনা করেন) চ (পুনঃ) যং চতুর্থাশ্রমজুষাম্‌ উপাস্যম্‌ প্রাহুঃ (পুনরায় যাঁহাকে সকল সন্ন্যাসিগণের উপাস্য বলিয়া থাকেন) সঃ চৈতন্যাকৃতিঃ দেবঃ (সেই চৈতন্যাকৃতি দেব) নঃ অতিতরাং কৃপয়তু (আমাদিগকে অতিশয় কৃপা করুন)।

অনুবাদ।- চৈতন্যদেব আমাদের অপার করুণা করুন। জ্যোতিঃপুঞ্জে উজ্জল দেহ তাঁর অকৃষ্ণ যদিও তিনি স্বয়ং কৃষ্ণ। তিনিই সমস্ত সন্ন্যাসিগণের উপাস্য দেবতা। তাঁকেই কলিযুগে জ্ঞানিজনেরা উচ্চ সংকীর্ত্তন ক'রে স্পষ্টতঃই অর্চ্চনা ক'রে থাকেন।।১২।।

প্রত্যক্ষ তাহার তপ্ত কাঞ্চনের দ্যুতি।
যাহার ছটায় নাশে অজ্ঞান-তমস্ততি (১)।।
জীবের কল্মষ-তমো নাশ করিবারে।
অঙ্গ উপাঙ্গ-নাম নানা অস্ত্র ধরে।।
ভক্তির বিরোধী কর্ম্ম ধর্ম্ম বা অধর্ম্ম।
তাহার কল্মষ নাম সেই মহাতম।।
বাহু তুলি হরি বলি প্রেমদৃষ্ট্যে চায়।
করিয়া কল্মষ নাশ প্রেমেতে ভাসায়।।

(১) অজ্ঞান-তমস্ততি - অজ্ঞানান্ধকাররাশি।

তথাহি - স্তবমালায়াং (২।৮)
স্মিতালোকঃ শোকং
হরতি জগতাং যষ্য পরিতো,
গিরান্তু প্রারম্ভঃ
কুশলপটলীং পল্লবয়তি।
পদালম্ভঃ কং বা
প্রণয়তি ন হি প্রেমনিবহং,
স দেবশ্চৈতন্যা-
কৃতিরতিতরাং নঃ কৃপয়তু।।১৩

অন্বয়ঃ।- যশ্য স্মিতালোকঃ (যাঁহার ঈষৎ হাস্যসমন্বিত দৃষ্টি) জগতাং পরিতঃ শোকং হরতি (জগতের সকলেরই শোক হরণ করে) তু যষ্য গিরাং প্রারম্ভঃ (পরন্তু যাঁহার কথা বলিবার উপক্রমে) কুশলপটলীং পল্লবয়তি (কল্যাণ-রাশি বিস্তার করে) যশ্য পদালম্ভঃ (যাঁহার চরণাশ্রয়) কং বা প্রেমনিবহং হি ন প্রণয়তি (কাহাকে শ্রীকৃষ্ণ-প্রেমরাশি প্রাপ্ত করায় না) সঃ চৈতন্যাকৃতিঃ দেবঃ নঃ অতিতরাং কৃপয়তু (সেই চৈতন্যাকৃতি দেব আমাদিগকে অতিশয় কৃপা করুন)।

অনুবাদ।- শ্রীচৈতন্যরূপ দেবতা আমাদের অপার কৃপা করুন। তাঁর স্মিত-দৃষ্টি জগতের সমস্ত শোক হরণ করে। তাঁর কথা জগতে কল্যাণ-বিস্তার করে। তাঁহার পদাশ্রয় নিলে কে না জগতে প্রেমসম্পদ লাভ করে?।।১৩।।

শ্রীঅঙ্গ শ্রীমৃখ যেই করে দরশন।
তার পাপ ক্ষয় হয় পায় প্রেমধন।।
অন্য অবতারে সব সৈন্য-শস্ত্র সঙ্গে।
চৈতন্যকৃষ্ণের সৈন্য অঙ্গ উপাঙ্গে।।
তথাহি - স্তবমালায়াং (১।১)
সদোপাস্যঃ শ্রীমান্‌
ধৃতমনুজকায়ৈঃ প্রণয়িতাং
বহদ্ভির্গীর্ব্বাণৈ-
গিরিশপরমেষ্ঠিপ্রভৃতিভিঃ।
স্বভক্তেভ্যঃ শুদ্ধাং
নিজভজনমুদ্রামুপদিশন্‌
স চৈতন্যঃ কিং মে
পুনরপি দৃশোর্যাস্যতি পদম্‌।।১৪

অন্বয়ঃ।- প্রণয়িতাং বহদ্ভিঃ ধৃতমনুজকায়ৈঃ (প্রীতিযুক্ত জনগণ মনুষ দেহ ধারণ করিয়া) গিরিশপরমেষ্ঠিপ্রভৃতিভিঃ র্গীর্ব্বাণৈঃ সদা উপাস্যঃ (শিব ব্রহ্মা প্রভৃতি দেবগণ সতত যাঁহার উপাসনা করেন) স্বভক্তেভ্যঃ শুদ্ধাং নিজ-ভজন-মুদ্রাম্‌ উপদিশন্‌ (আর নিজ প্রিয় ভক্তগণকে যিনি নিজের শুদ্ধা ভজন-পদ্ধতির উপদেশ দান করেন) শ্রীমান্‌ স চৈতন্যঃ পুনরপি কিং মে দৃশোঃ পদং র্যাস্যতি (সেই শ্রীমান্‌ চৈতন্যদেব কি পুনরায় আমার নয়ন-পথের পথিক হইবেন?)

অনুবাদ।- সেই সুন্দর শ্রীচৈতন্য কি আবার আমার দৃষ্টিগোচর হবেন? শিব ব্রহ্মা প্রভৃতি দেবতারা মানুষের দেহধারণ ক'রে সর্ব্বদা তাঁরই উপাসনা করেন এবং তিনিও স্বীয় ভক্তদের ভক্তি-সম্পদ বিতরণ করেন।।১৪।।

অঙ্গোপাঙ্গ অস্ত্র করে স্বকার্য্য সাধন।
'অঙ্গ' শব্দের আর অর্থ শুন দিয়া মন।।
'অঙ্গ' শব্দে অংশ কহে শাস্ত্রপরমাণ।
অঙ্গের অবয়ব তার 'উপাঙ্গ' ব্যাখ্যান।।
তথাহি - শ্রীভাগবতে (১০।১৪।১৪)
নারায়ণস্ত্বং ন হি সর্ব্বদেহিনা-
মাত্মাস্যধীশাখিল-লোকসাক্ষী।
নারায়ণোদঙ্গং নরভূজলায়না-
ত্তচ্চাপি সত্যং ন তবৈব মায়া।।১৫।।

এই শ্লোকের অন্বয় ও অনুবাদ দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে - নবম শ্লোকে দ্রষ্টব্য।।১৫।।

জলশায়ী অন্তর্য্যামী যেই নারায়ণ।
সেহো তোমার অংশ তুমি মূল নারায়ণ।।
অঙ্গ শব্দে অংশ কহে সেহো সত্য হয়।
মায়া কার্য্য নহে সব চিদানন্দময়।।
অদ্বৈত নিত্যানন্দ চৈতন্যের দুই অঙ্গ।
অঙ্গের অবয়বগণ কহিয়ে 'উপাঙ্গ'।।
অঙ্গোপাঙ্গ তীক্ষ্ণ অস্ত্র প্রভুর সহিতে।
সেই সব অস্ত্র হয় পাষণ্ড দলিতে।।
নিত্যানন্দ গোসাঞি সাক্ষাৎ হলধর (১)।
অদ্বৈত আচার্য্য গোসাঞি সাক্ষাৎ ঈশ্বর।।
শ্রীবাসাদি পারিষদ-সৈন্য সঙ্গে লঞা।
দুই সেনাপতি বুলে (২) কীর্ত্তন করিঞা।।
পাষণ্ড দলন বানা (৩) নিত্যানন্দ রায় (৪)।
আচার্য্য হুঙ্কারে পাপ-পাষণ্ডী পলায়।।
সংকীর্ত্তন প্রবর্ত্তক শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য।
সংকীর্ত্তন-যজ্ঞে তাঁরে ভজে সেই ধন্য।।
সেইত সুমেধা আর কুবুদ্ধি সংসার।
সর্ব্ব যজ্ঞ হৈতে কৃষ্ণনাম-যজ্ঞ সার।।
কোটি অশ্বমেধ এক কৃষ্ণনাম সম।
যেই কহে সে পাষণ্ডী, দণ্ডে তারে যম।।
ভাগবতসন্দর্ভ (৫) গ্রন্থের মঙ্গলাচরণে।
এই শ্লোক জীব গোসাঞি করিয়াছেন ব্যাখ্যানে।।

(১) হলধর - বলরাম।

(২) বুলে - ভ্রমণ করে।

(৩) বানা - ধর্ম্ম সম্প্রদায়ের চিহ্ন অর্থাৎ ধ্বজাবিশেষ।

(৪) যিনি আনন্দ প্রদান করেন, তাঁহাকে রায় কহে।

(৫) ভাগবতসন্দর্ভ - ষট্‌-সন্দর্ভ।

তথাহি - ভাগবতসন্দর্ভে (২)
অন্তঃ কৃষ্ণং বহির্গৌরং
দর্শিতাঙ্গাদিবৈভবম্‌।
কলৌ সংকীর্ত্তনাদ্যৈঃ স্মঃ
কৃষ্ণচৈতন্যমাশ্রিতাঃ।।১৬

অন্বয়ঃ।- কলৌ (কলিযুগে) অন্তঃ কৃষ্ণং বহিঃ গৌরং দর্শিতাঙ্গাদিবৈভবং (যিনি ভিতরে কৃষ্ণ এবং বাহিরে গৌরাঙ্গরূপে অঙ্গাদিদ্বারা নিজ মহিমা প্রকাশক) কৃষ্ণচৈতন্যম্‌ সংকীর্ত্তনাদ্যৈঃ আশ্রিতাঃ স্মঃ (আমরা সংকীর্ত্তনাদির দ্বারা সেই শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যদেবকে আশ্রয় করিতেছি)।

অনুবাদ।- যিনি অন্তরে কৃষ্ণ, বাহিরে গৌর, যাঁর মহিমা অন্তরঙ্গ ভক্তবৃন্দে সুপ্রকাশিত, সেই শ্রীকৃষ্ণ-চৈতন্যকে কলিযুগে সংকীর্ত্তন যজ্ঞে ভজনা করি।।১৬।।

উপপুরাণেতে শুনি শ্রীকৃষ্ণ-বচন।
কৃপা করি ব্যাস প্রতি কহিয়াছেন কথন।।
তথাহি - উপপুরাণে
সন্ন্যাসাশ্রমমাশ্রিতঃ
অহমেব ক্কচিদ্ব্রহ্মন্‌!
হরিভক্তিং গ্রাহয়ামি
কলৌ পাপহতান্নরান্।।১৭

অন্বয়ঃ।- হে ব্রহ্মন্‌ ক্কচিৎ কলৌ অহম্‌ এব (হে ব্রহ্মন্‌ আমি কোনও কলিযুগে) সন্ন্যাসাশ্রমম্‌ আশ্রিতঃ (সন্ন্যাসধর্ম্ম আশ্রয় করিয়া) পাপহতান্‌ নরান্ হরিভক্তিং গ্রাহয়ামি (পাপহত মনুষ্যদিগকে হরিভক্তি গ্রহণ করাইব)।

অনুবাদ।- হে ব্রহ্মন্‌! কলিযুগে সন্ন্যাস গ্রহণ ক'রে আমিই পাপহত মানুষকে হরিভক্তি বিলাব।।১৭।।

ভাগবত ভারত শাস্ত্র আগম পুরাণ।
চৈতন্য কৃষ্ণ অবতারে প্রকট প্রমাণ।।
প্রত্যক্ষ দেখহ নানা প্রকট প্রভাব।
অলৌকিক কর্ম্ম, অলৌকিক অনুভাব।।
দেখিয়া না দেখে যত অভক্তের গণ।
উলূকে না দেখে যেন সূর্য্যের কিরণ।।
তথাহি যামুনাচার্য্যস্তোত্রে
ত্বাং শ্রীলরূপচরিতৈঃ পরমপ্রকৃষ্ট-
সত্ত্বেন সাত্ত্বিকতয়া প্রবলৈশ্চ শাস্ত্রৈঃ।
প্রখ্যাতদৈবপরমার্থবিদাং মতৈশ্চ
নৈবাসুরপ্রকৃতয়ঃ প্রভবন্তি বোদ্ধুম্‌।।১৮

অন্বয়ঃ।- অসুরপ্রকৃতয়ঃ (অসুরপ্রকৃতিশালী) পরমপ্রকৃষ্টসত্ত্বেন (অত্যুৎকৃষ্ট সত্ত্বের বা বলের দ্বারা) শ্রীলরূপচরিতৈঃ (স্বভাব, রূপ ও চরিতের দ্বারা) সাত্ত্বিকতয়া (সাত্ত্বিক ভাবের দ্বারা) প্রবলৈঃ শাস্ত্রৈঃ চ (অভ্রান্তযুক্তি শাস্ত্রপ্রমাণ দ্বারা) প্রখ্যাত-দৈব-পরমার্থবিদাং মতৈঃ চ (প্রসিদ্ধ পরমার্থতত্ত্বজ্ঞগণের মতের আলোচনা করিয়াও) ত্বাং বোদ্ধুং প্রভবন্তি (তোমাকে জানিতে সমর্থ হয় না)।

অনুবাদ।- তোমার অত্যুৎকৃষ্ট বল, স্বভাব, রূপ ও চরিত দেখেও, অতিনির্ম্মল ও দৃঢ় শাস্ত্রাদি প'ড়েও, প্রখ্যাত পরমার্থবেত্তাদের মত শুনেও - অসুর-প্রকৃতির লোকেরা তোমাকে জানতে পারে না।।১৮।।

আপনা লুকাইতে প্রভু নানা যত্ন করে।
তথাপি তাঁহার ভক্ত জানয়ে তাঁহারে।।
তথাহি - তত্রৈব (১৮শঃ শ্লোকঃ)
উল্লঙ্ঘিত-ত্রিবিধসীমসমাতিশায়ি-
সম্ভাবনং তব পরিব্রঢ়িমস্বভাবম্‌।
মায়াবলেন ভবতাপি নিগুহ্যমানং
পশ্যন্তি কেচিদনিশং ত্বদনন্যভাবাঃ।।১৯

অন্বয়ঃ।- কেচিৎ (কেহ কেহ) ত্বদনন্যভাবাঃ (যাঁহারা তোমাতে অনন্যভক্তিযুক্ত) ভবতা মায়াবলেন নিগুহ্যমানমপি (মায়াবলে তুমি গোপন করিলেও) উল্লঙ্ঘিত-ত্রিবিধসীমসমাতিশায়ি-সম্ভাবনম্‌ (ত্রিলোকের মধ্যে সর্ব্বাপেক্ষা অতুলনীয়) তব পরিব্রঢ়িমস্বভাবম্‌ (তোমার প্রভুত্বপূর্ণ স্বভাবকে) অনিশং পশ্যন্তি (সর্ব্বদা জ্ঞাত হইয়া থাকে)।

অনুবাদ।- তোমার স্বরূপ অসীম - দেশকাল-পাত্রাতীত। তোমার সমানও কেউ নেই, তোমার থেকে শ্রেষ্ঠও কেউ নেই। তোমার এই স্বরূপ মায়াবলে তুমি গোপন করেছ। কিন্তু তা সত্ত্বেও যারা তোমার ভক্ত - অবিরত তোমারই ধ্যান করে, তারা তোমার এই স্বরূপ সর্ব্বদাই অনুভব করে।।১৯।।

অসুর স্বভাবে কৃষ্ণে নাহি জানে।
লুকাইতে নারে কৃষ্ণ ভক্তজন স্থানে।।
তথাহি-পাদ্মে
দ্বৌ ভূতসর্গৌ লোকেহস্মিন্‌
দৈব আসুর এব চ।
বিষ্ণুভক্তঃ স্মৃতো দৈব
আসুরস্তদ্বিপর্য্যয়ঃ।।২০

অন্বয়ঃ।- অস্মিন্‌ লোকে (এই জগতে) দৈব আসুর এব চ দ্বৌ ভূতসর্গৌ (প্রাণিগণের দৈব ও আসুর এই দুই প্রকার সৃষ্টি আছে)। বিষ্ণুভক্তঃ দৈব তদ্বিপর্য্যয়ঃ আসুরঃ স্মৃতঃ (ইহার মধ্যে বিষ্ণুভক্ত দৈব ও তাহার বিরোধীকে আসুর বলে)।

অনুবাদ।- এই সৃষ্টজগতে দ্বিবিধ জীব আছে - এক দৈব, অপর আসুর। যারা ভক্ত তারা দৈব, যারা ভক্তিহীন তারা আসুর।।২০।।

আচার্য্য গোঁসাঞি প্রভুর ভক্ত অবতার।
কৃষ্ণ-অবতার-হেতু যাঁহার হুঙ্কার।।
কৃষ্ণ যদি পৃথিবীতে করেন অবতার।
প্রথমে করেন গুরুবর্গের সঞ্চার।।
পিতা-মাতা-গুরু আদি যত মান্যগণ।
প্রথমে করেন সবার পৃথিবীতে জনম।।
মাধব ঈশ্বরপুরী শচী জগন্নাথ।
অদ্বৈত-আচার্য্য প্রকট হৈলা সেই সাথ।।
প্রকটিয়া (১) দেখে আচার্য্য সকল সংসার।
কৃষ্ণভক্তি-গন্ধহীন বিষয়-ব্যবহার (২)।।
কেহো পাপে কেহো পুণ্যে করে বিষয়-ভোগ।
ভক্তি-গন্ধ নাহি যাতে যায় ভবরোগ।।

(১) প্রকটিয়া - আবির্ভূত হইয়া অর্থাৎ পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করিয়া।

(২) বিষয়-ব্যবহার - সাংসারিক ব্যবহার, সাংসারিক লোকের কার্য্যাবলী।

লোকগতি (১) দেখি আচার্য্য করুণ-হৃদয়।
বিচার করেন লোকের কৈছে হিত হয়।।
আপনি শ্রীকৃষ্ণ যদি করেন অবতার।
আপনে আচরি ভক্তি করেন প্রচার।।
নাম বিনু কলিকালে ধর্ম্ম নাহি আর।
কলিকালে কৈছে হবে কৃষ্ণ-অবতার।।
শুদ্ধভাবে করিব কৃষ্ণের আরাধন।
নিরন্তর সদৈন্যে করিব নিবেদন।।
আনিয়া কৃষ্ণেরে করোঁ (২) কীর্ত্তন সঞ্চার।।
তবে সে অদ্বৈত নাম সফল আমার।।
কৃষ্ণ বশ করিবেন কোন্‌ আরাধনে।
বিচারিতে এক শ্লোক আইল তাঁর মনে।।

(১) লোকগতি - লোকের অবস্থা।

(২) করোঁ - করিব।

হরিভক্তিবিলাসশ্য একাদশবিলাসে দশাধিকশতাঙ্কধৃতং গৌতমীয়তন্ত্রে নারদবচনম্‌।
তুলসীদলমাত্রেণ।
জলস্য চুলুকেন বা।
বিক্রীণীতে স্বমাত্মানং
ভক্তেভ্যো ভক্তবৎসলঃ।।২১

অন্বয়ঃ।- ভক্তবৎসলঃ (ভক্তের প্রতি কৃপাপরায়ণ ভগবান্‌) তুলসীদলমাত্রেণ (তুলসীদল দ্বারা) জলস্য চুলুকেন বা (অথবা জলগণ্ডূসের দ্বারা) স্বম্‌ আত্মানম্‌ ভক্তেভ্যঃ বিক্রীণীতে (নিজের আত্মাকে ভক্তগণের নিকট বিক্রয় করেন)।

অনুবাদ।- একটি তুলসীপত্র কি এক গণ্ডূষ জল পেলেই ভক্তবৎসল ভগবান্‌ ভক্তের কাছে বিকিয়ে যান।।২১।।

এই শ্লোকার্থ আচার্য্য করেন বিচারণ।
কৃষ্ণকে তুলসী-জল দেয় যেই জন।।
তার ঋণ শোধিতে কৃষ্ণ করেন চিন্তন।
জল-তুলসীর সম কিছু ঘরে নাহি ধন।।
তবে আত্মা বেচি করে ঋণের শোধন।
এত ভাবি আচার্য্য করেন আরাধন।।
গঙ্গাজল তুলসী-মঞ্জরী অনুক্ষণ।
কৃষ্ণ-পাদপদ্ম ভাবি করেন সমর্পণ।।
কৃষ্ণের আহ্বান করেন করিয়া হুঙ্কার।
এমতে কৃষ্ণেরে করাইল অবতার।।
চৈতন্যের অবতারে এই মুখ্য হেতু।
ভক্তের ইচ্ছায় অবতার ধর্ম্মসেতু (৩)।।

(৩) ধর্ম্মসেতু - ধর্ম্মমর্য্যাদারক্ষক।

তথাহি - শ্রীমদ্ভাগবতে ৩।৯।১১
ত্বং ভক্তিযোগপরিভাবিতহৃৎসরোজ
আস্‌সে শ্রুতেক্ষিপতপথো ননু নাথ! পুংসাম্‌।
যদ্‌যদ্ধিয়া ত উরুগায় বিভাবয়ন্তি
তত্তদ্বপুঃ প্রণয়সে সদনুগ্রহায়।।২২

অন্বয়ঃ।- [ব্রহ্মা শ্রীভগবানকে স্তব করিতেছেন] ননু নাথ! (হে প্রভো) ত্বং শ্রুতেক্ষিপতপথঃ (তুমি ভক্তগণের বেদবিহিত মার্গ) পুংসাং ভক্তিযোগপরিভাবিত-হৃৎ-সরোজে (লোকের ভক্তিযোগপরিভাবিত হৃদয়-পদ্মে) আস্‌সে (অবস্থান করিয়া থাক)। হে উরুগায় (হে উরুগায়!) তে ধিয়া যৎ যৎ বিভাবয়ন্তি (ভক্তগণ নিজ নিজ ধীশক্তির দ্বারা তোমার যে যে রূপের ধ্যান করিয়া থাকে) তত্ তৎ বপুঃ সদনুগ্রহায় প্রণয়সে (তুমি সেই সেই রূপ সাধুগণের প্রতি অনুগ্রহপূর্ব্বক প্রকট করিয়া থাক)।

অনুবাদ।- তুমি ভক্তের প্রেমভক্তি-নির্ম্মল হৃদয়-কমলে বাস কর। বেদ প্রভৃতি শাস্ত্র শ্রবণ করলে তোমাকে পাওয়া যায়। শ্রবণ বিনাও ভক্তেরা তোমাকে যে যে ভাবে ধ্যান করে তার কাছে করুণাবশতঃ তুমি সেই সেই রূপেই প্রকাশিত হও।।২২।।

এই শ্লোকের অর্থ কহি সংক্ষেপের সার।
"ভক্তের ইচ্ছায় কৃষ্ণের সর্ব্ব অবতার।।"
চতুর্থ শ্লোকের অর্থ হৈল সুনিশ্চিতে।
অবতীর্ণ হৈলা গৌর প্রেম প্রকাশিতে।।
শ্রীরূপ রঘুনাথ-পদে যার আশ।
চৈতন্যচরিতামৃত কহে কৃষ্ণদাস।।

ইতি চৈতন্যচরিতামৃতে আদিলীলায়াং আশীর্ব্বাদ-
মঙ্গলাচরণে চৈতন্যাবতার-সামান্য-কারণং
নাম তৃতীয়ঃ পরিচ্ছেদঃ