ষষ্ঠীতৎপুরুষনামা/২০
২০
প্রতি গ্রামে স্বদেশি কর্মকাণ্ড বেড়েই চলেছে। কনিষ্ঠ ভ্রাতার নেতৃত্বের মানুষের আস্থা আছে এটা লক্ষ করে রায়বাহাদুর ভেতরে ভেতরে খুশি হলেও বাইরে প্রকাশ নেই। আক্ষেপ একটা তো আছেই, এত প্রতিশ্রুতিবান ভাইটা জেনেবুঝে এই অনিশ্চিতির পথে পা বাড়াল। চরকা, গুপ্ত বৈঠক, পদযাত্রা, সংগীত নাটক এমনকী ধর্মীয় অনুষ্ঠানেও স্বদেশিয়ানার প্রচার নিয়ে যতি একেবারে মত্ত। ওদিকে কলিকাতা থেকে যামিনী শিখে এসেছে নতুন নাট্যকলা। কিনে এনেছে মঞ্চনাটকের সাজসরঞ্জাম, দৃশ্যপট। দুর্গাপূজার অষ্টমী আর নবমীতে বিপিনচন্দ্রকে ডেকে নিয়ে বসানো হয়েছে দর্শকাসনে। ‘বঙ্গেবর্গী’, ‘সিরাজউদ্দোল্লা’ নাটকের ভেতর যে আরেকটি নাটক চলছে তা আর বুঝতে বাকি নেই কারও। ইণ্ডিয়ান থিয়েটার দেখতে আসা চা বাগানের সাহেবরাও দর্শকাসনে বসে মুচকি হাসেন। কথায় কথায় বিদেশিদের প্রতি এত প্রচ্ছন্ন আক্রোশ দেখে এরা যে একটু বিব্রতও হচ্ছেন না তা নয়। তবে বিপিনচন্দ্র বোঝাচ্ছেন This is nothing but a historical play which combines facts and fictions। ওঁরা যা বোঝার তো বুঝলেনই, তবে লর্ড ক্লাইভের মুখে ইঙ্গবঙ্গ ডায়লগ শুনে ওঁরা হেসে কুটিকুটি।
স্বদেশিয়ানা যে তলে তলে এতদূর এগিয়েছে সেটা বিপিনচন্দ্র ভালো করেই বুঝলেন দিনের বেলা মেয়েদের কণ্ঠে গীত শুনে। সংগীতে যে তাঁর খুব রুচি তা অবশ্য নয়, কিন্তু ভগ্নী ব্রহ্মময়ীর উচ্চকণ্ঠ, সঙ্গে ভাগ্নী স্মৃতিকণা, আর ভাইজিদের দোহার তাঁর কানকে সচকিত করে তুলল। গানের পদগুলো কেমন যেন অন্যরকম ঠেকছে—
আজি গো ভারতমাতা
তোমায় সাজাইব রাজরাণী
তোমার রাজ রাজেশ্বরী রূপ
হেরব মা ভুবনমোহিনী
যতিকে ডেকে নিয়ে মায়ের মণ্ডপের পাশে বসে মন দিয়ে শুনলেন ওঁরা কী গায়। পদগুলো তো বুকের ভেতর পর্যন্ত কাঁপিয়ে দেবার মতোই। যতির চোখ একবার অগ্রজের দিকে আর একবার মেয়েদের দিকে। ওঁরা গেয়েই চলেছে—
কী দিয়ে পুজিব মা গো বলো গো জননী
দিবানিশি এই কথা মনে মনে গণি॥
রায়বাহাদুর বুঝতে পারছেন গানগুলো একটা ভয়ঙ্কর রাজনৈতিক বার্তা নিয়ে আসছে—
তোমারে পরাইতে মাগো বস্ত্র কোথা পাই
তোমার সন্তানের ঘরে দেশি বস্ত্র নাই।
অন্নবস্ত্র খাদ্য আদি সবই যাহা ছিল
বিদেশি বাণিজ্যের ফেরে সবই হারা হল॥
জার্মানি রূপাতে এখন পূজার ঘণ্টা হয়
দীপদার কি মোমের বাতি কিছুই দেশের নয়।
তাঁর মনে পড়ল পদ্মনাথ বিদ্যাবিনোদের জার্মান জাতির প্রতি তীব্র আক্রোশের কথা। কথাটা তো মিথ্যাও নয়, মহাযুদ্ধ বাঁধিয়ে ব্যাটারা আমাদের দেশে তাঁদের দেশের নিজেদের জিনিসপত্রের হাট খুলে বসেছে। হঠাৎ রায়বাহাদুরের মনে হল রূপার চেন দিয়ে বাঁধা জার্মান পকেট ওয়াচটি যেন বুকে পাথর চাপা দিয়ে রেখেছে, আর চেনটি ফাঁসির দড়ির মতো চেপে ধরেছে গলাটিকে। অস্থির হয়ে তিনি চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন। গানের কথাগুলো তাঁর কানে তীরের মতো বিঁধছে—
অন্ন ব্যঞ্জন মা গো ঘরে নাই লবণ
বিলাতি লবণ নহে পবিত্র কখন।
এ তো মহাত্মা গান্ধির হুমকি, ধ্বনিত হচ্ছে গ্রাম কাছাড়ের পূজা মণ্ডপে।