২২

তারিখটি ছিল উনিশ শো একুশের ২৪ এপ্রিল। রাজা গোবিন্দচন্দ্র ইশকুলের সামনে খোলা মাঠে আয়োজিত হল অসহযোগ এবং খিলাফত আন্দোলনের যৌথ সভা। কংগ্রেস সভাপতি কামিনীকুমার চন্দ এবং প্রাদেশিক খিলাফত কমিটির শিলচর মহকুমা শাখার সভাপতি, কনকপুরের বসারত আলি মজুমদার, সম্পাদক মৌলবি তবারক আলি, উধারবন্দ, এবং সহ-সম্পাদক রাশিদ আলি আর অন্যান্য সাঙ্গপাঙ্গদের উপস্থিতিতে এ সভায় যোগদান করলেন বাবু যতীন্দ্রমোহন, তারাচরণ চক্রবর্তী এবং মুন্সি ওয়াজেদ আলি। সভা থেকে সরাসরি স্কুলের ছাত্রদের ক্লাস বর্জন করে আন্দোলনে নামবার আহ্বান জানানো হলে তৎক্ষণাৎ ১২ জন ছাত্র বই খাতা নিয়ে বেরিয়ে এল। এরা জানতে পারল না ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে সেদিন থেকেই তাঁদের গ্রামটির ভবিষ্যৎ জুড়ে গেল, এরাও হয়ে গেল এক মহান ইতিহাসের সাক্ষী এবং কুশীলবও।

 সরকারি নির্দেশ এল জেলা সদর থেকে যে, গ্রামের তিনজন ব্যক্তি, যাঁরা আবার স্কুল পরিচালন সমিতির সদস্যও বটে, এদের সদস্যপদ খারিজ করা হোক। পরদিন থেকে স্কুলের ছাত্র সংখ্যা কমতে থাকল। গ্রামে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গড়ে উঠল। ‘বন্দে মাতরম’ ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে উঠল নির্জন জনপদটি।

 মহাত্মা গান্ধি পরিচালিত অসহযোগ এবং খিলাফত আন্দোলন ইতিমধ্যেই সিলেটে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। উত্তর ভারতে দেওবন্দি আলেম এবং দেওবন্দ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ‘কওমি মাদ্রাসা’র আলেমদের প্রভাবে আন্দোলনের ঢেউ কাছাড়-করিমগঞ্জেও এসে লেগেছে। বিশ্বযুদ্ধের অবসানে ভারতীয় মুসলমানের সঙ্গে ব্রিটিশরাজের ওয়াদা ভঙ্গের ফলে সারা দেশের সঙ্গে সিলেটের মুসলমানরাও বুঝতে পেরেছে ভারতের হিন্দু-মুসলিম সেনারা যুদ্ধে প্রাণ দিল, কিন্তু এ যুদ্ধ মুসলমানদের শক্তির প্রতীক তুরস্ক-খিলাফতের বিলুপ্তি ঘটিয়ে দিল, ঘটিয়ে দিল অটোমান সাম্রাজ্যেরও পতন। করিমগঞ্জে সুরমাভ্যালি রাষ্ট্রীয় সম্মিলনীর চতুর্থ অধিবেশনে খিলাফত ও অসহযোগ কমিটির যৌথ সভায় উপস্থিত হলেন মৌলানা শওকত আলি এবং বিপিনচন্দ্র পাল। হিন্দু আর মুসলিমদের সমবেত শক্তিকে ধ্বংস করার জন্য ব্রিটিশ শাসকরা একদিকে মুসলিমদের মনে হিন্দুদের সঙ্গে একযোগে অসহযোগ আন্দোলনে নামার বিরুদ্ধে যুক্তি খাড়া করার প্রয়াস পায় এবং পক্ষান্তরে হিন্দুদের মনে প্যান-ইসলামিজম ভীতি জাগিয়ে তোলার চেষ্টাও শুরু করে। এটা বুঝতে পেরেই মৌলানা আবুল কালাম আজাদ সমস্ত দ্বিধাদ্বন্দ্ব অবসানকল্পে শরিয়তের ব্যাখ্যা করে এক বার্তা পাঠালেন—

 “ভারত যদি স্বাধীন হয় এবং এমন কোন সরকারের দ্বারা শাসিত হয় যে-সরকার অন্যান্য সম্প্রদায়ের সাথে মুসলমান সম্প্রদায়কে সমান স্বাধীনতা দেবে, সে ক্ষেত্রে ইসলামের নির্দেশ হল, মুসলমানরা বিদেশি আক্রমণ থেকে ভারতকে রক্ষা করবে। সে আক্রমণকারী মুসলমান বা স্বয়ং খলিফা হলেও।”

 সিলেট সম্মেলনে কালাম আজাদ সাহেবের বক্তব্যটি পাঠ করে শোনানো হলে শ্রোতারা উল্লসিত হয়ে ওঠেন।

 দুই খিলাফত নেতা মৌলানা শওকত ভ্রাতৃদ্বয় সহ মহাত্মা গান্ধি কাছাড় পরিক্রমায় এলে আন্দোলনে নতুন প্রাণ সঞ্চার হল। ফাটকবাজারের সামনে মুক্ত জায়গায় গান্ধি আর শওকত ভাইদের বক্তৃতা শুনতে গ্রাম শহর ভেঙে মানুষ জমায়েত হল। গ্রামের গঞ্জে হাটে ঘাটে সর্বত্র গান্ধি আর গান্ধি। গ্রামের মেয়েদের ধামাইল গানে উঠে এলেন মহাত্মা গান্ধি—

গান্ধি বড় লোক গো সখি, গান্ধি বড় লোক
গান্ধি রাজে বানাইছইন পথ চলতে বড় সুখ।

 রায়বাহাদুর বিপিনচন্দ্র লক্ষীপুর কাছারি বাড়িতে বসে সব খবরই পাচ্ছেন। কামিনীবাবুর বাড়িতেই যে মহাত্মাজির অধিষ্ঠান এ তো জানা কথা। ওদিকে মধুরা ভ্যালি, জাটিঙ্গা ভ্যালি আর হারাং ভ্যালিতে তাঁর ভ্রাতা স্বদেশি গান গেয়ে আলোড়ন লাগিয়ে দিয়েছে— এসব খবর, এমনকী গানের কয়েক কলি পদও তাঁর কানে পৌঁছে গেছে। সে গাইছে—

ভয় কি মরণে, রাখিতে সন্তানে
মাতঙ্গী মেতেছে আজ সমর রঙ্গে।
তা থৈ তা তৈ থৈ দ্রিমি দ্রিমি দ্রং দ্রং
ভূত পিশাচী নাচে যোগিনী সঙ্গে॥

 সাঙ্গপাঙ্গরা সঙ্গে ততোধিক উচ্চরবে দোহার দিচ্ছে—

দানব দলনী হয়ে উন্মাদিনী
আর কি দানব থাকিবে বঙ্গে।
সাজোরে সন্তান, হিন্দু মুসলমান
নিতে হয় মুকুন্দেরে নিও গো সঙ্গে॥

 প্রবল জলতরঙ্গ উঠেছে সব দিকে। রায়বাহাদুর বিপিনচন্দ্র দূর থেকে সবই লক্ষ করে যাচ্ছেন। তাঁর অবস্থান সত্যিই সংকটজনক। তিনি বিধান পরিষদে সরকারি মনোনীত সদস্য। আর এদিকে তাঁরই ভ্রাতা ইংরেজ বিরোধী আন্দোলনে পালের গোদা।

 গ্রাম কাছাড়ে বিদেশি বর্জন কার্যসূচির সঙ্গে স্বদেশি উৎপাদনের আওয়াজও ধ্বনিত হল। রমেশ ভট্টাচার্য সাহিত্যসরস্বতী মহোদয়ের তৎপরতায় ইতিমধ্যেই তাঁত এবং সূতাকাটা শুরু হয়েই গিয়েছিল, এবার এলেন বিজ্ঞানসাধক রমেশচন্দ্র ভট্টাচার্য। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় আর রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর শিষ্য শিলচর নর্মাল স্কুলের এ শিক্ষক দশ বছর আগে শ্রীহট্টের জলসুখায় অনুষ্ঠিত ‘জাতীয় সম্মেলন’ থেকে ‘মোর্স কোডে’বাংলা হরফে এক তারবার্তা প্রেরণ করে ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন। এবার তিনি রসায়ন বিদ্যাকে কাজে লাগিয়ে স্বদেশি সাবান, স্বদেশি ঔষধ তৈরি করে তরুণ প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করলেন। গ্রামেগঞ্জে স্বদেশি দ্রব্য ব্যবহারের বার্তা ছড়িয়ে গেল, তা সে সাবানে ফেনা কতটুকু হয়, ‘সেরাম অয়েলে’ কাটা-ছেঁড়ার উপসমই বা কতটুকু হয় এসব বিবেচনাকে দূরে সরিয়েই।

 এই যখন পরিস্থিতি, তখন এক শীতের সন্ধ্যায় পুবের বাড়ির চারিদিকে শোনা গেল পুলিশের বুটের আওয়াজ। ঘোড়া চড়ে গোরা সৈন্যদের বিচরণও দেখা গেল। সারা গ্রাম আজ থমথমে। দৃষ্টিহীন পিতা বুঝতে পারলেন, তাঁর পুত্রকে আর ঘরে রাখা যাবে না। বাড়ির চাকরকে পশ্চিমের বাড়িতে পাঠাতে গেলে সে ধমক খেয়ে ফিরে এল। ‘বাইরে যাইবার অ-র-ডা-র নাই।’ কিন্তু যাঁকে নিয়ে এত কিছু, তাঁর কোন ভাবান্তর নেই। সান্ধ্যকালীন প্রার্থনা গীতি শেষ করে যতীন্দ্র এ-ঘর ওঘর বিচরণ করে সবার সঙ্গে খুব স্বাভাবিক ভাবে কথাও বলছেন। রান্নাঘরে চুপি দিয়ে দেখে এসেছেন মায়ের তত্ত্বাবধানে ওদিকে কী আয়োজন চলছে। পিতৃদেবের ঘরে এসে বিছানার পাশে বসলে বৃদ্ধ লোকটি সাহস দিয়ে বললেন,

 —তোমার কোনও বিপদ ঘটতে পারে না। মনোবল অটুট রাখো। নিজের বিশ্বাসে স্থির থাকো।

 এর বেশি কোন কথা বলার প্রয়োজন হল না। শুধু একবার দিদিকে পাঠানোর নির্দেশ দিয়ে তিনি নির্বাক বসে রইলেন।

 রাতের আহারান্তে পিতৃদেব শয্যায় উঠেছেন দেখে যতীন্দ্রমোহন লণ্ঠন টেনে একটি বই খুলে বসলেন, এটা তাঁর বহুদিনের অভ্যাস। ওদিকে কাদের আনাগোনার শব্দ শুনে বাড়ির মেয়ে বউরা আতঙ্কিত হলে রুদ্রমূর্তি ধারণ করলেন দিদি ব্রহ্মময়ী,

 —তোমরা কা’রা? ঘরে কি মা বোন নেই তোমরার, বাড়ির আনাচে কানাচে চোখ রাখো? দূর হও এই মুহূর্তে, নইলে এই দেখ আমার হাতে।

 তিনি হাতে করে যে জিনিসটি উঁচিয়ে ধরলেন সেটা কোন লাঠি বা বন্দুক কিছুই নয়, ঘরদোর পরিষ্কার করতে প্রাত্যহিক ব্যবহারের মুড়া ঝাড়ু, গ্রামে বলে হুরইন। এর স্পর্শে যতটা না চোট লাগে এর চাইতে অনেক বেশি ক্ষতবিক্ষত করে দেয় মানসম্ভ্রম।

 পরদিন ভোর হতে না হতেই বাড়ি জেগে উঠেছে। বৈঠকখানায় এসে বসেছেন দারগা আর দুজন সেপাই। খুব বিনীত ভাবেই তাঁরা তাঁদের উদ্দেশ্য ব্যক্ত করে জানালেন যতিবাবুর স্নান আহারাদি শেষ করে তৈরি হতে যতটুকু সময় চাই তাঁরা দেবেন।

 স্নান সেরে দুটো ভাত মুখে দিয়ে খুব পরিপাটি করে পোশাক পরে, ততোধিক পরিপাটি করে চুল আঁচড়ে ছেলে যখন বাবার পা ছুঁয়ে প্রণাম করতে এলেন, বাবা তাঁকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন,

 —ওরে, কে আছিস? দে মালাছড়া আমার হাতে ধরিয়ে দে, ছেলের গলায় পরিয়ে দেই।

 জ্যেষ্ঠা কন্যা তাঁর কথামতো ইতিমধ্যেই ফুল তুলে মালা গেঁথে রেখেছে। ঘরের ভেতরের সমবেত উলুধ্বনি আর কান্নার ধ্বনিতে সৃষ্ট অদ্ভুত এক পরিস্থিতির মধ্যে যতীন্দ্রমোহন বীরের বেশে বাইরের মণ্ডপে এসে দাঁড়ালেন,

 —কোথায় আপনাদের লোকজন? নিন, শিকল পরান।

 নমস্কার দিয়ে পুলিশ অফিসার মার্জনা চাইলেন এবং এসব কিছুই লাগবে না বুঝিয়ে দিলেন।

 সারা গ্রাম আজ উজাড় হয়ে এসেছে। জমিদার বাড়িতে তিল ধারণের জায়গা আর অবশিষ্ট নেই। ছুটে এসেছেন তারাচরণ, মুন্সি ওয়াজেদ আলি, গ্রামের হিন্দু মুসলমান জনগণ। ব্রাহ্মণবাড়ির মেয়েরা, বউরাও আজ অকুতোভয়। ঘন ঘন উলুধ্বনিতে মুখরিত করে তুললেন সারা গ্রাম। এরই সঙ্গে উঠল ‘বন্দে মাতরম’ ধ্বনি। নদীর ওপার থেকে রণচণ্ডীবাড়ির লাগোয়া ডিমাসা গ্রাম উজাড় হয়ে এসেছে এ দৃশ্য প্রত্যক্ষ করতে। কীর্তনীয়া নকুলরাম বর্মনের সদ্য স্কুলে যাওয়া পুত্র নলিনী বিস্ময় বিমূঢ় হয়ে সব কিছু প্রত্যক্ষ করে গেল সে কি জানত পরিণত বয়সে ঐতিহাসিক হিসেবে এ দৃশ্যটা ধরা দেবে তাঁর কলমে একদিন?

 আজ আর কেউই যেন বাড়ি যাবে না। ধীর পায়ে এগিয়ে চলা যতীন্দ্রমোহনের পিছনে পিছনে চলছে জনস্রোত। কণ্ঠে তাঁদের ‘বন্দে মাতরম’ ধ্বনি। সমস্ত কুণ্ঠা জড়তা ঝেড়ে ফেলে দিদি ব্রহ্মময়ী গেয়ে উঠলেন—

বয়স উনিশ বছর মাত্র
তাঁরে দেখতে লাগে রাজপুত্র
সে যে হেসে হেসে ফাঁসিকাষ্ঠে
দাঁড়াইল বীরের বেশে
ভারতবাসীর কী ক্ষমতা গেল রে প্রকাশি।

 মেয়েরা সমবেত কণ্ঠে দোহার দিল—

বড়ো অবিচারে হইলরে আমার
ক্ষুদিরামের ফাঁসি।
ভুলিবে কি প্রাণান্তে
ও ভারতবাসী॥

 কুরঙ্গিনী ঠাকরুণ, লবঙ্গবালা, মোক্ষদা আর দিদির ধামাইল গানের সহচরীরা, সঙ্গে বিবাহিতা ভগ্নী শারদা, সদা মেজমামার পায়ে পায়ে ঘোরাঘুরি করা ভাগ্নি স্মৃতিকণা উচ্চকণ্ঠে দোহার দিতে দিতে চলল। অবাক হয়ে গ্রামের পুরুষেরা এক অভাবনীয় দৃশ্য প্রত্যক্ষ করল, রাজপথে মহিলাদের মিছিল। সনটা উনিশ শো একুশ।