ষষ্ঠীতৎপুরুষনামা/২৭
২৭
জাটিঙ্গাপারের এই গ্রামটিতে স্বদেশ, স্বরাজ আর বয়কট এ তিনটি শব্দ প্রাত্যহিক কথোপকথনে এসে সংযোজিত হল। যতিবাবু জেল থেকে শিখে এসেছেন ব্রহ্মসংগীত, শুদ্ধ উচ্চারণে গীতা পাঠ, দীক্ষিত হয়েছেন রবীন্দ্রকাব্যে, স্বদেশি সাহিত্যে। সন্ধ্যাবেলা বাড়ির মণ্ডপে এসবের অনুশীলন শুরু হল নিয়ম করে। সামিল হলেন প্রতিবেশী সহ অন্যান্য গ্রামবাসীও। কয়েকটি নাম কীর্তনের পর জেলের আসরের মতো একটি বিষয় নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত করে দিলে তো বয়স্করাও বেশ অংশ নিচ্ছেন। অরুণাচল আশ্রমের দয়ানন্দ সরস্বতীও নাকি এ আসরে উপস্থিতি দিয়ে গেছেন। সিলেটে পুলিশের তাড়না খেয়ে এদিকে এসে নতুন উদ্যমে তিনি স্বদেশি কাজ শুরু করেছেন। আশ্রমের তত্ত্বাবধায়ক মুক্তিকুমার ঘন ঘনই হাজির হচ্ছেন।
এরই মাঝে স্বেচ্ছাসেবী দল গঠিত হয়েছে ডলু, ধুমকর, উজান নগর, জারৈলতলা, সোনাপুর, বিক্রমপুর, ভাঙ্গারপার, জাটিঙ্গামুখ এবং নদী পেরিয়ে অরুণাচল পর্যন্ত। গ্রামে ঘন ঘন পদযাত্রা, মাদক দ্রব্য নিবারণী অভিযান, পুকুর ও জলাশয় সংস্কার, মশক নিবারণ অভিযান তো আছেই। এদিকে কাছারি বস্তিতে আফিমের ব্যাপক ব্যবহার দেখে ওঁরা নিজেরাও আতঙ্কিত। স্বেচ্ছাসেবীদের দলে নাম লেখানো হল যজ্ঞ বর্মন, সম্পূর্ণ বর্মন, নিশিকান্ত বর্মনের। এরা উজানগ্রাম, চন্দ্রপুর, ডলু, বড়রামপুর, ধুমকর ঘুরে ঘুরে তালিকা বানালেন, কারা এর গ্রাহক। সত্তর আশি উর্ধ্বের আফিমসেবীদের আবগারি লাইসেন্সের ব্যবস্থা রেখে বাকি সবাইকে এ থেকে দূরে থাকার প্রচারাভিযান নিয়ে এখন ব্যস্ততা।
সস্ত্রীক রমেশচন্দ্র ভট্টাচার্য সাহিত্যসরস্বতীর উৎসাহে জাতীয় বিদ্যালয়ের কাজ আবার শুরু হল। মেয়েদের লেখাপড়া, আত্মনির্ভরতার প্রশিক্ষণ পরিকল্পনায় অনুজপ্রতীম যতীন্দ্রমোহন এগিয়ে এলেন। নিজ বাড়িতে তো বটেই গ্রামেও একাধিক বাড়িতে বসল তাঁত। মেয়েরা সূতা কাটার সঙ্গে সঙ্গে একটু একটু করে লেখাপড়াও শুরু করলেন। ঘরে কনিষ্ঠ ভ্রাতার তত্ত্বাবধানে বাড়ির বউরা নতুন উদ্যমে লেখা পড়ায় মন দিলেন। যতীন্দ্রমোহনের স্ত্রী তো বাংলা লিখতেনই। এবার চিঠির খামে ইংরেজিতে বারনামা লিখে ডাকবাক্সে পাঠাতে শুরু করলেন। বাড়ির মেয়েদের মধ্যে ‘দামোদর গ্রন্থাবলী’, ‘রূপের মূল্য’ প্রভৃতি বই নিয়ে গোপনে কাড়াকাড়িও চলল।
এতসব কিছুর মধ্যে যামিনীমোহনের কলিকাতা গিয়ে পরীক্ষা দেওয়া আর হয়ে উঠছে না। ডাক্তারি সার্টিফিকেট হাতে না এলেও প্রয়োজনে টুকটাক ঔষধ দেওয়া শুরু করতেই হল। বাড়ির একটি কক্ষ ঔষধের বাক্স, আলমারি, বই, নানা সাইজের শিশি দিয়ে সাজানোও হল। সঙ্গে সহকারি হিসেবে জুটল গ্রামের খেয়ালি ব্যক্তি রূপনাথ দেবের পুত্র রক্ষনাথ।
যামিনীবাবুর সহকারি, তবে যতিবাবুর সঙ্গে প্রয়োজনে এখানে ওখানে যেতে সে এক পায়ে খাড়া।
দৃষ্টিহীন পিতা দুই পুত্রের কর্মতৎপরতায় অতিশয় আনন্দিত। ইচ্ছা প্রকাশ করলেন এবার দুর্গাপূজা হবে আরও ধুমধাম করে। তিন দিন সারা গ্রাম প্রসাদ পাবে, নিমন্ত্রণ যাবে দূর গ্রামেও, জেলা সদর এবং ইউরোপীয় চা’কর সাহেবদেরও নিমন্ত্রণ থাকবে। মহানবমীতে হবে পৌরাণিক পালা। গ্রামের যুবকরা ভাদ্রর শুরু থেকেই মহড়া দিচ্ছে মণ্ডপে। এ জমায়েতে যতীন্দ্রমোহন স্বদেশি বার্তা প্রচারের সুযোগ ছাড়তে নারাজ। কনিষ্ঠ ভ্রাতার সঙ্গে পরামর্শক্রমে পালার শুরুতে এবং ভেতরেও স্বদেশি গানের সংস্থান রাখার কথা হচ্ছে।
অষ্টমীর সন্ধ্যাবেলা সঙ্গীসাথী নিয়ে হাজির হলেন চা বাগানের ম্যানেজার সাহেব। পূজার প্রসাদে আপ্যায়িত হতে কোন অসুবিধা নেই তাঁদের। প্রসাদের প্রতিটি পদই তাঁদের কাছে ডেলিসিয়াস। সব কিছুতেই তাঁদের অদম্য কৌতূহল। মায়ের মণ্ডপের সামনে চেয়ার পেতে বসতে দিলে যতীন্দ্রমোহনকেও পাশে বসতে হল। তাঁদের এত প্রশ্নের উত্তর আর কে দেবে? দুর্গার কেন দশটি হাত? মিউজিক্যাল ইনস্ট্রুমেণ্ট হাতে ওই চার্মিং deity কি গ্রিক গডেস মিউজের সঙ্গে কোন ভাবে রিলেটেড? কার্তিককে ওয়ার ডিটি হিসেবে সনাক্ত করতে কোনও আসুবিধা হচ্ছে না, কিন্তু who is this Old God- seemingly an idiot?
যতীন্দ্রমোহনের বুদ্ধিদীপ্ত উত্তর, He is the philosopher in the divine pantheon. And you know - philosophy amounts to idiocy।
বোঝা গেল এ সাহেব একেবারে আনপড় সাদা চামড়াওয়ালা নয়। তবে জমিদারবাড়ির সন্তান, এই rebel young man এর প্রতি তাঁরও মুগ্ধবোধ বেড়ে গেল।
ওদিকে খোলকর্তাল সহযোগে একদল কীর্তনীয়া পদাবলি গান করেই যাচ্ছেন। এদিকেও সাহেবের কৌতূহল। যখন জানলেন এরা রাধা-কৃষ্ণের গান গাইছে, তখন তাঁর অট্টহাসি,
—No—Babu you are worshipping a grand deity warring against the mighty Demon—but the songs are all about the fluit player in amorous tryst with the milk maidens!
এর কোনও সদুত্তর নেই যতিবাবুর কাছে। সত্যিই তো মা দুর্গার অনেক গীত রয়েছে, রয়েছে—রামপ্রসাদ—কমলাকান্তের পদ, আগমনী গান। তৎক্ষণাৎ মনে এল কাজি নজরুল ইসলামের একটি পদ, কলের গানে শুনেছিলেন। মণ্ডপে উঠে হারমোনিয়ম টেনে নিয়ে গানটি ধরলেন—
ওমা দনুজদলনী মহাশক্তি
নমো অনন্ত কল্যাণদাত্রী।
ইংরেজিতে বুঝিয়ে দিলেন এখানে দীনতা ভীরুতা দূর করে, হিংসার অবসান ঘটিয়ে মা দুর্গা দেশের উপর ঘনায়মান অন্ধকার দূর করুন, এই প্রেয়ারই করা হচ্ছে। বিমূঢ় সাহেব অতটা আশা করেনি। যাবার আগে বার বার হ্যণ্ডশেক করে বলেছে,
—I must carry this message to my countrymen for 10 air ai sure—Babu।