ষষ্ঠীতৎপুরুষনামা/৫
৫
মহামহোপাধ্যায়ের সঙ্গে সন্ধ্যের মজলিশে জমে উঠল পুরনো দিনের গল্প। সৌখিন রায়বাহাদুর বিপিনচন্দ্র নিজেও ইতিপূর্বে কিছু কিছু ইতিহাস নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করেছেন। তাই মহামহোপাধ্যায়ের কথাগুলো তাঁর প্রাণে আলোড়ন তুলল। তিনি ‘ভাটেরা তাম্রশাসনে’র প্রসঙ্গ উত্থাপন করলেন। সিলেটত্রিপুরার একাধিক তাম্রশাসনের কথাও বললেন। ত্রিপুরার আদি ধর্মাফার একটি শাসনের উল্লেখ তো রায়বাহাদুরের মাথা ঘুরিয়ে দিল। কী বলছেন পণ্ডিতপ্রবর? ‘ত্রিপুরা চন্দ্রবানাব্দে’ প্রায় দেড় হাজার বছর পূর্বে কুশিয়ারা নদীর তীরে পাঁচজন ব্রাহ্মণকে কোনও এক ‘মকরন্দ রবৌ শুক্লপক্ষে পঞ্চমী দিনে’ এ নৃপতি একখণ্ড ভূমি দান করেন। হবে?
—‘ত্রিপুরা চন্দ্রবানাব্দ’? এটা বুঝি একটি সন? আমাদের হিসাবে কত হবে?
—৬৪১ খ্রিস্টাব্দ।
দুই মনীষী রায়সাহেব কনকলাল বরুয়া আর রাধাগোবিন্দ বসাক এ সন নির্ধারণ করেছেন। তিনি এও জানালেন, সপ্তম শতকের কুটিলাক্ষরে লিখিত ওই তাম্রশাসনটি ত্রিপুরা মহারাজের সুপারিনটেনডেণ্ট মারফত এশিয়াটিক সোসাইটিতে এসেছিল।
বিস্ময়ের বুঝি আরও বাকি ছিল। বিদ্যাবিনোদ পর্শি হুঁকোর নলে একটা দীর্ঘ টান দিয়ে ঘরময় খাম্বিরার গন্ধ ছড়িয়ে দিয়ে শুরু করলেন,
—যে কারণে আজ সকালে আমরা এতটা পথ পাড়ি দিয়ে সুবঙ্গ বাগান পর্যন্ত ঘুরে গেলাম এ কথাটি আজ ‘ফাল্গুন মাসের শুক্লপক্ষের সপ্তমী তিথিতে’ এই গ্রামে বসে আপনাকে বলারই মোক্ষম সময়।
বিদ্যাবিনোদের বর্ণনায় মূর্ত হয়ে উঠল ইতিহাসের আরেক অন্ধকারাচ্ছন্ন অধ্যায়। আসন্ন দোল উৎসবকে সামনে রেখে গ্রামের প্রান্তে কারা যেন ঢোলক কাল সহযোগে হোলি গাইছে আর টুকরো টুকরো পদগুলো ভেসে এসে ঘরের ভেতর সবাইকে উন্মনা করে দিচ্ছে, ‘আইজ হোরি খেলব রে শ্যাম তোমার সনে’।
বিদ্যাবিনোদ একটু থেমে আবার সপ্তম শতাব্দীতে দক্ষিণ-পূর্ব বঙ্গ-সমতটের সামন্ত রাজা লোকনাথের ত্রিপুরী তাম্রশাসনে উল্লিখিত ‘জয়তুঙ্গবর্ষের অন্তর্গত ‘সুবঙ্গ বিষয়া’য় শ্রীশ্রীঅনন্ত নারায়ণের মন্দির এবং একশো বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণের বসতির জন্য একখণ্ড নিষ্কর ভূমিদানের কথা শুরু করেছেন।
বিমূঢ় বিপিনচন্দ্রের প্রশ্ন,
—আজ্ঞে এই ‘জয়তুঙ্গবর্ষ’টি কোথায়? ‘সুবঙ্গ বিষয়া’র অর্থই বা কী? বিদ্যাবিনোদের উত্তর,
—এর উত্তর কি এত সহজে দেওয়া যায়? কত কত মনীষী এ অনুসন্ধানে কালাতিপাত করছেন।
আমি বলি, রায়বাহাদুর মশাই, জয়তুঙ্গবর্ষ কি জাতিঙ্গা বা জাটিঙ্গার পোশাকি নাম হতে পারে না? আপনার বিষয় সম্পত্তির একাংশ নিয়েই হয়তো বা এ ‘সুবঙ্গ বিষয়া’, যা আপনার বদৌলতে আজ দেখে এলাম। সে অর্থে এই গ্রামের নাম জয়তুঙ্গ বা জয়তুঙ্গবর্ষ হওয়াই সঙ্গত।
রাত বেড়ে চলল। অতিথিশালার রন্ধন পর্বও শেষ অনেকক্ষণ। ঠাকুরঘরের দিকে যেতে যেতে পণ্ডিতমশাই মনে করিয়ে দিলেন আগামীকাল তাঁর বিদায় নেবার কথা। তবে যাবার আগে গ্রামের দুই দেবী রণচণ্ডী আর নির্মাতার কথা তাঁকে শোনাতে হবে। '