ষষ্ঠীতৎপুরুষনামা/৯
৯
তখনও ডিমাসা রাজপাট মাইবঙ থেকে খাসপুরে স্থানান্তরিত হয়নি। আহোমরাজ রুদ্র সিংহের সেনার হাতে বিধ্বস্ত মাইবঙ রাজপ্রাসাদ। মহারাজ তাম্রধ্বজনারায়ণ রাজধানী ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছেন সমতল কাছাড়ে বিক্রমপুর পরগনার এক গ্রামে। গ্রামের নাম দিলেন হাওয়ারমা, অর্থাৎ বিস্তৃত মাঠ। নিরাপত্তার জন্য স্থানীয় ব্যক্তিদের সহায়তায় সুদৃঢ় গড় বেঁধে অস্থায়ী রাজপাট গড়ে তোলা হল। স্থানটি পরিচিতি পেল ‘গড়ের ভিতর’ নামেও।
ইতিপূর্বে রায়বাহাদুর বিপিনচন্দ্রের আদিপূর্বপুরুষ, লক্ষ্মীচরণের সন্তান চান্দলস্কর ভাগ্যান্বেষণে এসে এই বিক্রমপুর-সোনাপুর অঞ্চলেই উপস্থিত হয়েছিলেন। শোনা যায় তিনি বঙ্গদেশের তরফ পরগনার লস্করপুর গ্রামের সন্তান, তাই নামের সঙ্গে এ লস্কর উপাধি। এই ব্যক্তির সঙ্গে মহারাজ তাম্রধ্বজনারায়ণের সখ্য গড়ে উঠল। একজন গৃহত্যাগী ভাগ্যান্বেষী, অপরজন রাজ্যহারা, দিশাহারা, দুর্ভাবনায় আক্রান্ত।
অবশেষে কোচ রাজদুহিতা মহারানি চন্দ্রপ্রভার দৌত্যে মহারাজ নিজ রাজধানীতে ফিরে গেলেও চান্দলস্করের সঙ্গে তাঁদের সম্পর্ক চুকে যায়নি। প্রমাণ হিসেবে পাওয়া গেল ১৬৫৬ শকাব্দের ২৯ ভাদ্র তারিখে মহারাজ কীর্তিচন্দ্র প্রেরিত একখানি সনন্দ, সঙ্গে একখানি অভয়পত্র। মাইবঙের এ মহারাজ চান্দলস্করের পুত্র মণিরামকে রাজ্যের প্রশাসন এবং রাষ্ট্র পরিদর্শনকল্পে উজির পদে নিযুক্তি দিলেন।
প্রাচীন লিখনপদ্ধতি এবং বাক্যগঠনের কুহেলি সরিয়ে বিদ্যাবিনোদ এ লিপির যা কিছু পাঠোদ্ধার করতে পেরেছেন এতে বোঝা গেল মহারাজ উজির মণিরামকে প্রভূত সম্পত্তি এবং প্রশাসনিক ক্ষমতার অধিকারী করে রাজ্যের ভিত্তি সুদৃঢ় করার প্রয়াস পান:
আমার বংশেত জত দিবস রার্জশ পদ আছে
অত দিবস জদ বুনিয়াদ বংশাবলি হাকিমইতি
তুমারে দিলাম
এতে তুমার আইল শিমা বিশএত যে হিংশা করে
তার প্রাণ রৈক্ষা না করিমু
বিপিনচন্দ্র আরও পুলকিত হলেন এটা বুঝতে পেরে যে, এ অভয়পত্রের বয়ান বলছে—
আমার বংশে তুমার বংশরে পালন করিব
মহা ২ অপরাধ পাইলে ৭ শাঠা
অপরাধ খেমিআ উছিত দণ্ড করিমু।
কী বলছে এই অভয়পত্র? এটা তো ‘সাতখুন মাফে’র ফরমান। সম্পাদিত গ্রন্থটিতে সহজ আধুনিক বোধগম্য হরফে এই বয়ান পড়তে পড়তে বিপিনচন্দ্রের মন বিদ্যাবিনোদের প্রতি অসীম কৃতজ্ঞতায় ভরে উঠল। এত দিন লোহার সিন্দুকে সযত্ন রক্ষিত নথিগুলোর মর্মোদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। তিনি নিজেকেই বলতে লাগলেন,
—সাত সাতটি ‘মহাঅপরাধ’ মানে উকিলদের ভাষায় ‘সেভেন হোমিসাইড’। এটা তো কম কথা নয়।
শরীর রীতিমতো রোমাঞ্চিত হয়ে উঠল। এ ক্ষমতার অধিকারী তো তিনিও হতে পারতেন যদি সেই রাজ্যপাট আজ বহাল থাকত:
এখন অবধি তুমার উজিরর বেটা ও নাতি ও
পরিনাতি তার ধারাসুত্র ক্রমে
এই উজির হৈআ জাইব আর ইত্যাদি।
হায় হায়! সেই রাজা নাই, রাজ্য নাই, আছে এ অভয়পত্র। আছে সেই দৃপ্ত অঙ্গীকার—
(যত দিন) তুমার বংশে আমার নুণ যে কবুল করে
শ্রীরঁ এই খাতিলজমা না ডুলিম
(এই) সাত সত্য এ তধক্তে খাতিলজমা পত্র দিলাম
ই [তি শক ১৬] ৫৮ তারিক ২৯ ভাদ্র অস্য।
কিন্তু হায়! এই বিশ্বস্ততা কি আমরা রক্ষা করতে পেরেছি? বিপিনচন্দ্র লজ্জিতই হলেন যখন দেখলেন কে যে সেদিন ওই রাজকীয় সনন্দ দুটোর গায়ে টমাস ফিশার সাহেবের সিল সই করিয়ে এনেছেন। বুকের মধ্যে খচ্খচ্ করে উঠল স্বাক্ষরিত ওই পঙক্তিটি দেখে—
Produced before me— the 24th March 1831—T.Fisher— In Charge of Cachar
মনে হল সাতকরাকান্দির জমিদারের পরাজিত হওয়ার মধ্যেও একটা গৌরব আছে। তবে জলে থেকে কুমিরের সঙ্গে বিবাদ করা খুব সহজ কর্ম নয় তাও জানি। সাহেবরা সোনামিঞাঁ চৌধুরীকে অবশ্য সাত ঘাটের জল খাইয়েই ছেড়েছে। প্রজা নির্যাতন, বলপূর্বক ধর্মান্তর করণ ইত্যাদি মামলায় তাঁকে জেরবার করে ছেড়েছে। এরও আগে আরেক বিদ্রোহী নবাব গুলু মিঞাঁকেও দমন করা হয়েছিল কঠোর হাতে। সেটা অবশ্য সাহেব নয়, মহারাজ গোবিন্দচন্দ্রের আমলের কথা।
প্রায় এক শতাব্দী পর এই সাহেবদের বদান্যতায় বিপিনচন্দ্র সোনাপুর বনরাজ পরগনার মৌজাদারি লাভ করে সাতকরাকান্দি এলে সোনামিঞাঁ সম্বন্ধে কত কথাই না শুনলেন লোকমুখে। এ বিদ্রোহী নিজের বাড়িতে নাকি কামান বসিয়েছিলেন। জমিদারি এলাকায় লেনদেনের জন্য ধাতুর মুদ্রাও গড়িয়ে নিয়েছিলেন। এক বৃদ্ধের মুখে শুনলেন,
—“সোনামিঞাঁ চৌধরিয়ে কইলা ‘হাওরর পানি কাইত’, সবাই কইলা উচ্চ রবে ‘হাওরর পানি কাইত’।”
দশ দশটি হাতি গিয়েছিল জিল্লা ফাটকে, যেদিন এই ব্যক্তি খালাস হলেন ইংরেজের জেল থেকে। সে সব আজ আশি বছর আগেকার কথা। মানুষ বলেন যেন এই সেদিনের ঘটনা।
সরকারি খেতাব লাভের পরও বিপিনচন্দ্র এ সাহসী জমিদারের প্রশংসা না করে পারেননি। অনুজ ভ্রাতার তীব্র ইংরেজ বিদ্বেষ দেখে মনে মনে বলেন, কেমন হত যদি সেদিন জমিদারির ভার থাকত এই যতির হাতে? লর্ড উইলিয়ম বেণ্টিঙ্ক আর তাঁর অধস্তন ডেভিড স্কট আর তস্য অধস্তন ক্যাপ্টেন টমাস ফিশার কি এত সহজে, একেবারে বিনা যুদ্ধে এ মুলুকের মালিক হয়ে যেতেন?