(পৃ. ৫০-৫১)
◄  
১১  ►
১০

 সতীর মৃত্যুতে দক্ষের অন্তঃপুরীতে হাহাকার রব উত্থিত হইল। সতী যে এ ভাবে প্রাণত্যাগ করিবেন, দক্ষ এতটা মনে করেন নাই। সুতরাং সেই স্থানের সকলেই মনঃপীড়া প্রাপ্ত হইলেন। ভৃগু নিশ্চলভাবে যজ্ঞমন্ত্র পাঠ করিতে লাগিলেন। পূষা হোমানলে হব্য ঢালিতে লাগিলেন। দক্ষ মনকে প্রবোধ দিবার জন্য আত্মকর্ম্মের সমর্থন-যোগ্য যুক্তিগুলি মনে মনে আলোচনা করিতে লাগিলেন। এমন সময় সহসা ধূলিপটলে দিঙ্মণ্ডল সমাচ্ছন্ন হইল, বীরভদ্র সেইস্থানে এক বিশাল লৌহস্তম্ভের ন্যায় উপস্থিত হইয়া বেদীমূলে দাঁড়াইলেন। ভৃগু যে বক্ষবিলম্বিত শ্মশ্রুরাজি দোলাইয়া দক্ষের নিন্দা অনুমোদন করিয়াছিলেন, তাহা করদ্বারা মার্জ্জনা পুর্ব্বক ভ্রূকুঞ্চিত করিয়া পুনরায় যজ্ঞানলে আহুতি দিতে যাইবেন, এমন সময় বীরভদ্র তাঁহার শ্মশ্রুরাজি দৃঢ়-মুষ্টিতে ধরিয়া সগ্রীব মুখমণ্ডলটি চক্রাকারে ঘুরাইতে লাগিলেন এবং ধূমরেখার ন্যায় ভ্রূরোমরাজি ও গঙ্গাযমুনার মিশ্রিততরঙ্গ-নিন্দিত শ্মশ্রুরাজি উৎপাটিত করিয়া হোমানলে অর্পণ করিলেন। ভর্গদেব যে চক্ষুর্দ্বয়ের ইঙ্গিত করিয়া দক্ষকে উৎসাহিত করিয়াছিলেন, সেই চক্ষু দু’টি বিস্ফারিত করিয়া সভয়ে বীরভদ্রের কার্য্যকলাপ প্রত্যক্ষ করিতেছিলেন, চক্ষু দু’টি বীরভদ্রের নখাগ্রে উৎপাটিত হইল। মহর্ষি পূষা যজ্ঞস্থলে বসিয়া স্রুক নামক যজ্ঞপাত্র হইতে অগ্নিতে হব্য নিক্ষেপ করিতেছিলেন। যে কোন বিষয় উপলক্ষেই তাঁহার দন্তপংক্তি বিকাশ পাইত—দক্ষের নিন্দায় পরম পরিতোষ পাইয়া সেই দ্বাত্রিংশ দন্তের সমস্তগুলিই যজ্ঞস্থলীর উপস্থিত ব্যক্তিগণের দর্শনীয় হইয়াছিল, শিব-কিঙ্কর চণ্ডেশ বিনা বাক্যব্যয়ে সেই দন্তগুলি উৎপাটন করিয়া ফেলিলেন। ঋষিগণ কমণ্ডলু ও অজিনাসন করে ধারণ করিয়া পলায়নপর হইলেন। রুদ্রপার্ষদ মণিমান্‌ সূর্য্যদেবতা ও যমকে বাঁধিয়া ফেলিলেন; সহস্র চক্ষু বিস্ফারিত করিয়া দেবরাজ ইন্দ্র ঊর্দ্ধমুখে পলায়ন করিয়া আত্মরক্ষা করিলেন। প্রতিহারী ও সশস্ত্র সৈনিকবর্গ কে কোথায় ছুটিয়া পলাইয়া গেল, তাহার ঠিকান পাওয়া গেল না; সেই যজ্ঞশালা ভূতপ্রেতের তাণ্ডব-নৃত্যে শ্মশানের ন্যায় হইয়া গেল।

 দাম্ভিক দক্ষ স্বীয় দেব-শক্তি নেত্রকনীনিকায় পুঞ্জীভূত করিয়া দৃষ্টিদ্বারা যে অগ্নি প্রজ্বালিত করিলেন, তাহা সহ্য করিতে অসমর্থ হইয়া চণ্ডেশ দূরে সরিয়া গেল, কিন্তু বীরভদ্রের দেহে যে কালানলপ্রভ দ্যুতি ছিল, তাহার স্পর্শে দক্ষের নেত্রাগ্নি মন্দীভূত হইয়া লয় পাইল। বীরভদ্র দক্ষের গ্রীবাধারণ পূর্ব্বক তাঁহাকে পশুহননের হাড়িকাষ্ঠে বাঁধিয়া ফেলিলেন এবং ক্ষণপরে পশুহননের অস্ত্রদ্বারা তাঁহার মস্তক দ্বিখণ্ডিত করিয়া ফেলিলেন।

 যজ্ঞ পণ্ড হইয়া গেল, ব্রহ্মা ও বিষ্ণুর নিকট এই সংবাদ পৌঁছিল, তাঁহারা শিবের নিকট উপস্থিত হইলেন।