সমাজ/বিলাসের ফাঁস

বিলাসের ফাঁস

 ইংরেজ আত্ম পরিতৃপ্তির জন্য পূর্ব্বের চেয়ে অনেক বেশি খবচ করিতেছে, ইহা লইয়া ইংরেজি কাগজে আলোচনা দেখা যাইতেছে। একথা তাহাদের অনেকেই বলিতেছে যে, বেতনের ও মজুরির হার আজকাল উচ্চতর হইলেও তাহাদের জীবনযাত্রা এখনকার দিনে পূর্ব্বের চেয়ে অনেক বেশী দুরূহ হইয়াছে। কেবল যে তাহাদের ভোগস্পৃহা বাড়িয়াছে তাহা নহে, আড়ম্বরপ্রিয়তাও অতিরিক্ত হইয়া উঠিয়াছে। কেবলমাত্র ইংলণ্ড এবং ওয়েল্‌সে বৎসরে সাড়ে তিন লক্ষের অধিক লোক দেনা শোধ করিতে না পারায় আদালতে হাজির হয়। এই সকল দেনার অধিকাংশই আড়ম্বরের ফল। পূর্ব্বে অল্প আয়ের লোকে সাজে সজ্জায় যত বেশি খরচ করিত, এখন তাহার চেয়ে অনেক বেশি করে। বিশেষত মেয়েদের পোষাকের দেনা শোধ করিতে গৃহস্থ ফতুর হইতেছে। যে স্ত্রীলোক মুদির দোকানে কাজ করে, ছুটীর দিনে তাহার কাপড় দেখিয়া তাহাকে আমীর ঘরের মেয়ে বলিয়া ভ্রম হইয়াছে, এমন ঘটনা দুর্লভ নহে। বৃহৎ ভূসম্পত্তি হইতে যে-সকল ড্যুকের বিপুল আয় আছে, বহুব্যসসাধ্য নিমন্ত্রণ আমন্ত্রণে তাহাদেরও টানাটানি পড়িয়াছে—, যাহাদের অল্প আয়, তাহাদের ত কথাই নাই। ইহাতে লোকের বিবাহে অপ্রবৃত্তি হইয়া তাহার বহুবিধ কুফল ফলিতেছে।

 এই ভোগ এবং আড়ম্বরের ঢেউ আমাদের দেশেও যে উত্তাল হইয়া উঠিয়াছে, সে-কথা কাহারো অগোচর নহে। অথচ আমাদের দেশে আয়ের পথ বিলাতের অপেক্ষা সঙ্কীর্ণ। শুধু তাই নয়। দেশের উন্নতির উদ্দেশে যে-সকল আযোজনের আবশ্যক আছে, অর্থাভাবে আমাদের দেশে তাহা সমস্তই অসম্পূর্ণ।

 আড়ম্বরের একটা উদ্দেশ্য লোকের কাছে বাহবা পাওয়া। এই বাহবা পাইবার প্রবৃত্তি এখনকার চেয়ে পূর্ব্বকালে অল্প ছিল, সে-কথা মানিতে পারি না। তখনও লোকসমাজে খ্যাত হইবার ইচ্ছা নিঃসন্দেহ এখনকার মতই প্রবল ছিল। তবে প্রভেদ এই—তখন খ্যাতির পথ একদিকে ছিল, এখন খ্যাতির পথ অন্যদিকে হইয়াছে।

 তখনকার দিনে দানধ্যান, ক্রিয়াকর্ম্ম, পূজাপার্ব্বণ ও পূর্ত্তকার্য্যে ধনী ব্যক্তির খ্যাতিলাভ করিতেন। এই খাতির প্রলোভনে নিজের সাধ্যাতিরিক্ত কর্ম্মানুষ্ঠানে অনেক সম্পন্ন গৃহস্থ নিঃস্ব হইয়াছেন এমন ঘটনা শুনা গেছে।

 কিন্তু, এ-কথা স্বীকার করিতে হইবে যে, যে আড়ম্বরের গতি নিজের ভোগলালসা তৃপ্তির দিকে নহে, তাহা সাধারণত নিতান্ত অসংযত হইয়া উঠে না, এবং তাহাতে জনসাধারণের মধ্যে ভোগের আদর্শকে বাড়াইয়া তুলিয়া চতুর্দ্দিকে বিলাসের মহামারী সৃষ্টি করে না। মনে কর, যে ধনীর গৃহে নিত্য অতিথিসেবা ছিল, তাঁহার এই সেবার ব্যয় যতই বেশী হউক্ না অতিথিরা যে আহার পাইতেন তাহাতে বিলাসিতার চর্চ্চা হইত না। বিবাহাদি কর্ম্মে রবাহূত অনাহূতদের নিষেধ ছিল না বটে, কিন্তু তাহার ফলে যজ্ঞের আয়োজন বৃহৎ হইলেও যথেষ্ট সরল হইত। ইহাতে সাধারণ লোকের চাল চলন বাড়িয়া যাইত না।

 এখনকার দিনে ব্যক্তিগত ভোগের আদর্শ বাড়িয়া উঠিয়াছে, এই জন্য বাহবার স্রোত সেই মুখেই ফিরিয়াছে। এখন আহার পরিচ্ছদ, বাড়ি গাড়ি জুড়ি, আসবাবপত্রদ্বারা লোকে আপন মাহাত্ম্য ঘোষণা করিতেছে। ধনীতে ধনীতে এখন এই লইয়া প্রতিযোগিতা। ইহাতে যে কেবল তাহাদের চাল বাড়িয়া যাইতেছে তাহা নহে, যাহারা অশক্ত তাাদেরও বাড়িতেছে। আমাদের দেশে ইহাতে যে কতদূর পর্য্যন্ত দুঃখ সৃষ্টি করিতেছে, তাহা আলোচনা করিলেই বুঝা যাইবে। কারণ, আমাদের সমাজের গঠন এখনো বদলায় নাই। এ সমাজ বহুসম্বন্ধবিশিষ্ট। দূর নিকট, স্বজন পরিজন, অনুচর পরিচর, কাহাকেও এ সমাজ অস্বীকার করে না। অতএব এ সমাজের ক্রিয়াকর্ম্ম বৃহৎ হইতে গেলেই সরল হওয়া অত্যাবশ্যক। না হইলে মানুষের পক্ষে অসাধ্য হইয়া পড়ে। পূর্ব্বেই বলিয়াছি এ পর্য্যন্ত আমাদের সামাজিক কর্ম্মে এই সরলতা ও বিপুলতাব সামঞ্জস্য ছিল, এখন সাধারণের চাল চলন বাড়িয়া গেছে অথচ এখন আমাদের সমাজের পরিধি সে পরিমাণে সঙ্কুচিত হয় নাই, এই জন্য সাধারণ লোকের সমাজকৃত্য দুঃসাধ্য হইয়া পড়িয়াছে।

 আমি জানি, এক ব্যক্তি ত্রিশ টাকা বেতনে কর্ম্ম করে। তাহার পিতার মৃত্যু হইলে পর পিতৃবিয়োগের অপেক্ষা শ্রাদ্ধের ভাবনা তাহাকে অধিক পীড়িত করিতে লাগিল। আমি তাহাকে বলিলাম, “তোমার আয়ের অনুপাতে তোমার সাধ্য অনুসারে কর্ম্ম নির্ব্বাহ কর না কেন?” সে বলিল, তাহার কোনো উপায় নাই— গ্রামের লোক ও আত্মীয় কুটুম্বমণ্ডলীকে না খাওয়াইলে তাহার বিপদ্ ঘটিবে। এই দরিদ্রের প্রতি সমাজের দাবী সম্পূর্ণই রহিয়াছে অথচ সমাজের ক্ষুধা বাড়িয়া গেছে! পূর্ব্বে যেরূপ আয়োজনে সাধারণের তৃপ্তি হইত এখন আর তাহা হয় না। যাঁহারা ক্ষমতাশালী ধনী লোক, তাঁহারা সমাজকে উপেক্ষা করিতে পারেন। তাঁহারা সহরে আসিয়া কেবলমাত্র বন্ধুমণ্ডলীকে লইয়া সামাজিক ক্রিয়া সম্পন্ন করিতে পারেন, কিন্তু যাঁহারা সঙ্গতিপন্ন নহেন, তাঁহাদের পলাইবার পথ নাই।

 আমরা বীরভূম জেলায় একজন কৃষী গৃহস্থের বাড়ি বেড়াইতে গিয়াছিলাম। গৃহস্বামী তাহার ছেলেকে চাকরী দিবার জন্য আমাকে অনুরোধ করাতে আমি বলিলাম—“কেনরে ছেলেকে চাষবাস ছাড়াইয়া পরের অধীন করিবার চেষ্টা করিস্ কেন?” সে কহিল—“বাবু, একদিন ছিল যখন জমী জমা লইয়া আমরা সুখেই ছিলাম। এখন শুধু জমি জমা হইতে আর দিন চলিবার উপায় নাই।” আমি জিজ্ঞাসা করিলাম— “কেন বল্‌ত?” সে উত্তর করিল,—“আমাদের চাল্ বাড়িয়া গেছে। পূর্ব্বে বাড়িতে কুটুম্ব আসিলে চিঁড়া গুড়েই সন্তুষ্ট হইত, এখন সন্দেশ না পাইলে নিন্দা করে। আমরা শীতের দিনে দোলাই গায়ে দিয়া কাটাইয়াছি, এখন ছেলেরা বিলাতি র‍্যাপার না পাইলে মুখ ভারি করে। আমরা জুতা পায়ে না দিয়াই শ্বশুরবাড়ি গেছি। ছেলেরা বিলাতী জুতা না পরিলে লজ্জায় মাথা হেঁট করে। তাই চাষ করিয়া আর চাষার চলে না।”

 কেহ কেহ বলিবেন, এ-সমস্ত ভাল লক্ষণ; অভাবের তাড়নায় মানুষকে সচেষ্ট করিয়া তোলে। ইহাতে তাহার সম্পূর্ণ ক্ষমতা বিকাশের উত্তেজনা জন্মে। কেহ কেহ এমনও বলিবেন, বহুসম্বন্ধবিশিষ্ট সমাজ ব্যক্তিত্বকে চাপিয়া নষ্ট করে। অভাবের দায়ে এই সমাজের বহুবন্ধনপাশ শিথিল হইয়া গেলে মানুষ স্বাধীন হইবে। ইহাতে দেশের মঙ্গল।

 এ সমস্ত তর্কের মীমাংসা সংক্ষেপে হইবার নহে। য়ুরোপে ভোগের তাগিদ দিয়া অনেকগুলি লোককে মারিয়া কতকগুলি লোককে ক্ষমতাশালী করিয়া তোলে। হিন্দু সমাজতন্ত্রে কতকগুলি লোককে অনেকগুলি লোকের জন্য ত্যাগ করিতে বাধ্য করিয়া সমাজকে ক্ষমতাশালী করিয়া রাখে, এই উভয় পন্থাতেই ভাল মন্দ দুইই আছে। য়ুরোপীয় পন্থাই যদি একমাএ শ্রেয় বলিয়া সপ্রমাণ হইত, তাহা হইলে এ বিষয়ে কোনো কথাই ছিল না। য়ুরোপের মনীষিগণেব কথায় অবধান করিলে জানা যায় যে, এ সম্বন্ধে তাহাদের মধ্যেও মতভেদ আছে।

 যেমন করিযা হৌক্‌, আমাদের হিন্দুসমাজের সমস্ত গ্রন্থি যদি শিথিল হইয়া যায, তবে ইহা নিশ্চয় যে, বহু সহস্র বৎসরে হিন্দুজাতি যে অটল আশ্রয়ে বহু ঝড় ঝঞ্ঝা কাটাইয়া আসিয়াছে, তাহা নষ্ট হইয়া যাইবে। ইহার স্থানে নূতন আর কিছু গড়িয়া উঠিবে কি না, উঠিলেও তাহা আমাদিগকে কিরূপ নিভব দিতে পারিবে, তাহা আমরা জানি না। এমন স্থলে আমাদের যাহা আছে, নিশ্চিন্তমনে তাহার বিনাশদশা দেখিতে পাবিব না।

 মুসলমানের আমলে হিন্দুসমাজের যে কোনো ক্ষতি হয় নাই, তাহার কারণ সে আমলে ভাবতবর্ষের আর্থিক পরিবর্ত্তন হয় নাই। ভারতবর্ষের টাকা ভারতবর্ষেই থাকিত, বাহিরের দিকে তাহার টান না পড়াতে আমাদের অন্নের স্বচ্ছলতা ছিল। এই কারণ আমাদের সমাজব্যবহার সহজেই বহুব্যাপক ছিল। তখন ধনোপার্জ্জন আমাদের প্রত্যেক ব্যক্তির চিন্তাকে এমন করিয়া আকর্ষণ করে নাই। তখন সমাজে ধনের মর্যাদা অধিক ছিল না এবং ধনই সর্ব্বোচ্চ ক্ষমতা বলিয়া গণ্য ছিল না। ধনশালী বৈশ্যগণ যে সমাজে উচ্চস্থান অধিকার করিয়াছিলেন তাহাও নহে। এই কারণে, ধনকে শ্রেষ্ঠ আসন দিলে জন সাধারণের মনে যে হীনতা আসে, আমাদের দেশে তাহা ছিল না।

 এখন টাকাসম্বন্ধে সমাজ সকলেই অত্যন্ত বেশি সচেতন হইয়া উঠিয়াছে। সেই জন্য আমাদের সমাজেও এমন একটা দীনতা আসিয়াছে যে, টাকা নাই ইহাই স্বীকার করা আমাদের পক্ষে সকলের চেয়ে লজ্জাকর হইয়া উঠিতেছে। ইহাতে ধনাড়ম্বরের প্রবৃত্তি বাড়িয়া উঠে, লোকে ক্ষমতার অতিরিক্ত ব্যয় করে, সকলেই প্রমাণ করিতে বসে যে, আমি ধনী। বণিক্‌জাতি রাজসিংহাসনে বসিয়া আমাদিগকে এই ধনদাসত্বের দারিদ্র্যে দীক্ষিত করিয়াছে।

 মুসলমানসমাজে বিলাসিতা যথেষ্ট ছিল এবং তাহা হিন্দসমাজকে যে একেবারে স্পর্শ করে নাই তাহা বলিতে পারি না। কিন্তু বিলাসিতা সাধারণের মধ্যে ব্যাপ্ত হয় নাই। তখনকার দিনে বিলাসিতাকে নবাধী বলিত। অল্প লোকেরই সেই নবাবী চাল ছিল। এখনকার দিনে বিলাসিতাকে বাবুগিরি বলে; দেশে বাবুর অভাব নাই।

 এই বাবুয়ানার প্রতিযোগিতা উত্তরোত্তর বাড়িয়া উঠায় আমবা যে কতদিক্ হইতে কত দুঃখ পাইতেছি, তাহার সীমা নাই। ইহার একটা দৃষ্টান্ত দেখ। একদিকে আমাদের সমাজবিধানে কন্যাকে একটা বিশেষ বয়সে বিবাহ দিতে সকলে বাধ্য, অন্যদিকে পূর্ব্বের ন্যায় নিশ্চিন্ত চিত্তে বিবাহ করা চলে না। গৃহস্থজীবনের ভারবহন করিতে সবকগণ সহজেই শঙ্কা বোধ করে। এমন অবস্থায় কন্যার বিবাহ দিতে হইলে পাত্রকে যে পণ দিয়া ভুলাইতে হইবে, ইহাতে আশ্চর্য্য কি আছে? পণের পরিমাণও জীবনযাত্রার বর্ত্তমান আদর্শ অনুসারে যে বাড়িয়া যাইবে, ইহাতেও আশ্চর্য্য নাই। এই পণ লওয়া প্রথার বিরুদ্ধে আজকাল অনেক আলোচনা চলিতেছে; বস্তুত ইহাতে বাঙালী গৃহস্থের দুঃখ যে অত্যন্ত বাড়িয়াছে তাহাতেও সন্দেহ মাত্র নাই—কন্যার বিবাহ লইয়া উদ্বিগ্ন হইয়া নাই এমন ক্ন্যার পিতা আজ বাংলাদেশে অল্পই আছে। অথচ, এজন্য আমাদের বর্ত্তমান সাধারণ অবস্থা ছাড়া ব্যক্তিবিশেষকে দোষ দেওয়া যায় না। একদিকে ভোগের আদর্শ উচ্চ হইয়া সংসারযাত্রা বহুব্যয়সাধ্য ও অপর দিকে কন্যামাত্রকেই নির্দ্দিষ্ট বয়সের মধ্যে বিবাহ দিতে বাধ্য হইলে পাত্রের আর্থিক মূল্য না বাড়িয়া গিয়া থাকিতে পারে না। অথচ এমন লজ্জাকর ও অপমানকর প্রথা আর নাই। জীবনের সর্ব্বাপেক্ষা ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ দোকানদারী দিয়া আরম্ভ করা, যাহারা আজ বাদে কাল আমার আত্মীয় শ্রেণীতে গণ্য হইবে আত্মীয়তার অধিকার স্থাপন লইয়া তাহাদের সঙ্গে নির্লজ্জভাবে নির্ম্মমভাবে দরদাম করিতে থাকা—এমন দুঃসহ নীচতা যে সমাজে প্রবেশ করিয়াছে, সে সমাজের কল্যাণ নাই, সে সমাজ নিশ্চয়ই নষ্ট হইতে আরম্ভ করিয়াছে। যাঁহারা এই অমঙ্গল দূর করিতে চান তাঁহারা ইহার মূলে কুঠারাঘাত না করিয়া যদি ডাল ছাঁটিবার চেষ্টা করেন তবে লাভ কি? প্রত্যেকে জীবনযাত্রাকে সরল করুন, সংসারভারকে লঘু করুন, ভোগের আড়ম্বরকে খর্ব্ব করুন, তবেই লোকের পক্ষে গৃহী হওয়া সহজ হইবে, টাকার অভাব ও টাকার আকাঙ্ক্ষাই সর্ব্বোচ্চ হইয়া উঠিয়া মানুষকে এতদূর পর্য্যন্ত নিলর্জ্জ করিবে না। গৃহই আমাদের দেশের সমাজের ভিত্তি, সেই গৃহকে যদি আমরা সহজ না করি, মঙ্গল না করি, তাহাকে ত্যাগের দ্বারা নির্ম্মল না করি, তবে অর্থোপার্জ্জনের সহস্র নূতন পথ আবিষ্কৃত হইলেও দুর্গতি হইতে আমাদের নিষ্কৃতি নাই।

 একবার ভাবিয়া দেখ, আজ চাকরী সমস্ত বাঙালী ভদ্রসমাজের গলায় কি ফাঁসই টানিয়া দিয়াছে! এই চাকরী যতই দুলর্ভ হইতে থাক্, ইহার প্রাপ্য যতই স্বল্প হইতে থাক্‌, ইহার অপমান যতই দুঃসহ হইতে থাক্‌, আমরা ইহারই কাছে মাথা পাতিয়া দিয়াছি। এই দেশব্যাপী চাকরীর তাড়নায় আজ সমস্ত বাঙালিজাতি দুর্ব্বল, লাঞ্ছিত, আনন্দহীন। এই চাকরীর মায়ায় বাংলার বহুতর সুযোগ্য শিক্ষিত লোক কেবল যে অপমানকেই সম্মান বলিয়া গ্রহণ করিতেছে তাহা নহে, তাহারা দেশের সহিত ধর্ম্মসম্বন্ধ বিচ্ছিন্ন করিতে বাধ্য হইতেছে। আজ তাহার দৃষ্টান্ত দেখ। বিধাতার লীলাসমুদ্র হইতে জোয়ার আসিয়া আজ যখন সমস্ত দেশের হৃদয়স্রোত আত্মশক্তির পথে মুখ ফিরাইয়াছে তখন বিমুখ কারা? তখন গোয়েন্দাগিরি করিয়া সত্যকে মিথ্যা করিয়া তুলিতেছে কারা? তখন ধম্মাধিকরণে বসিয়া অন্যায়েব দণ্ডে দেশপীডনের সাহায্য করিতেছে কারা? তখন, বালকদের অতি পবিত্র গুরুসম্বন্ধ গ্রহণ করিয়াও তাহাদিগকে অপমান ও নির্যাতনের হস্তে অনায়াসে সমর্পণ করিতে উদ্যত হইতেছে কারা? যারা চাকরীর ফাঁস গলায় পরিয়াছে। তারা যে কেবল অন্যায় করিতে বাধ্য হইতেছে তাহা নয়—তারা নিজেকে ভুলাইতেছে—তারা প্রমাণ করিতে চেষ্টা করিতেছে যে দেশের লোক ভুল করিতেছে। বল দেখি, দেশের যোগ্যতম শিক্ষিতসম্প্রদায়ের কণ্ঠে এই যে চাকরী-শিকলেব টান, ইহা কি প্রাণান্তকর টান! এই টানকে আমরা প্রত্যহই বাড়াইয়া তুলিতেছি কি কবিয়া? নবাবিয়ানা, সাহেবিয়ানা, বাবুয়ানাকে প্রত্যহই উগ্রতর করিয়া মনকে বিলাসের অধীন কবিয়া আপন দাসখতের মেয়াদ এবং কড়ার বাড়াইয়া চলিয়াছি।

 জীবনযাত্রাকে লঘু করিবামাত্র দেশব্যাপী এই চাকরীর ফাঁসি এক মুহূর্ত্তে আল্লা হইয়া যাইবে। তখন, চাষবাস বা সামান্য ব্যবসায় প্রবৃত্ত হইতে ভয় হইবে না। তখন এত অকাতরে অসমান সহ্য করিয়া পড়িয়া থাকা সহজ হইবে না।

 আমাদের মধ্যে বিলাসিতা বাড়িয়াছে বলিয়া অনেকে কল্পনা করেন যে ইহা আমাদের ধনবৃদ্ধির লক্ষণ। কিন্তু এ-কথা বিচার করিয়া দেখিতে হইবে যে, পূর্ব্বে যে অর্থ সাধারণের কার্য্যে ব্যয়িত হইত, এখন তাহা ব্যক্তিগত ভোগে ব্যয়িত হইতেছে। ইহাতে ফল হইতেছে দেশের ভোগবিলাসের স্থানগুলি সমৃদ্ধিশালী হইয়া উঠিতেছে—সহরগুলি ফাঁপিয়া উঠিতেছে—কিন্তু পল্লীগুলিতে দারিদ্র্যের অবধি নাই। সমস্ত বাংলাদেশে পল্লীতে দেবমন্দির ভাঙিয়া পড়িতেছে, পুষ্করিণীর জল স্নান-পানের অযোগ্য হইতেছে, গ্রামগুলি জঙ্গলে ভরিয়া উঠিয়াছে, এবং যে দেশ বারো মাসে তেরো পার্ব্বণে মুখরিত হইয়া থাকিত, সে দেশ নিরানন্দ নিস্তব্ধ হইয়া গেছে। দেশের অধিকাংশ অর্থ সহরে আকৃষ্ট হইয়া কোঠাবাড়ি, গাড়িঘোড়া, সাজসরঞ্জাম, আহারবিহারেই উড়িয়া যাইতেছে। অথচ যাঁহারা এইরূপ ভোগবিলাসে ও আড়ম্বরে আত্মসমর্পণ করিয়াছেন তাঁহারা প্রায় কেহই সুখে স্বচ্ছন্দে নাই;—তাঁহাদের অনেকেরই টানাটানি, অনেকেরই ঋণ, অনেকেরই পৈতৃক সম্পত্তিকে মহাজনের দায়মুক্ত কবিবার জন্য চিরজীবন নষ্ট হইতেছে—কন্যার বিবাহ দেওয়া, পুত্রকে মানুষ করিযা তোলা, পৈতৃক কীর্ত্তি রক্ষা করিয়া চলা, অনেকেরই পক্ষে বিশেষ কষ্টসাধ্য হইয়াছে। যে ধন সমস্ত দেশের বিচিত্র অভাব মোচনেব জনৃ। চারিদিকে ব্যাপ্ত হইত, সেই ধন সঙ্কীর্ণ স্থানে আবদ্ধ হইয়া যে ঐশ্বর্য্যের মায়া সৃজন করিতেছে তাহা বিশ্বাসযোগ্য নহে। সমস্ত শরীবকে প্রতারণা করিয়া কেবল মুখেই যদি রক্ত সঞ্চার হয়, তবে তাহাকে স্বাস্থ্য বলা যায় না। দেশের ধর্ম্মস্থানকে, বন্ধুস্থানকে, জন্মস্থানকে কৃশ করিয়া কেবল ভোগস্থানকে স্ফীত করিয়া তুলিলে, বাহির হইতে মনে হয় যেন দেশেব শ্রীবৃদ্ধি হইতে চলিল। সেই জন্যই এই ছদ্মবেশী সর্ব্বনাশই আমাদের পক্ষে অতিশয় ভয়াবহ। করিবার শক্তিই ধন, বিলাস ধন নহে।

 ১৩১২