সমাজ/সমুদ্রযাত্রা

সমুদ্রযাত্রা

 বাংলা দেশে সমুদ্রযাত্রার আন্দোলন প্রায় সমুদ্র-আন্দোলনের তুল্য হইয়া দাঁড়াইয়াছে। সংবাদপত্র এবং চটি পুঁথি বাক্যোচ্ছাসে ফেনিল ও স্ফীত হইয়া উঠিয়াছে—পরস্পর আঘাত প্রতিঘাতেরও শেষ নাই।

 তর্কটা এই লইয়া যে, সমুদ্রযাত্রা শাস্ত্রসিদ্ধ, না শাস্ত্রবিরুদ্ধ। সমুদ্রযাত্রা ভাল কি মন্দ তাহা লইয়া কোনো কথা নহে। কারণ যাহা অন্যহিসাবে ভাল অথবা যাহাতে কোনো মন্দর সংস্রব দেখা যায় না, তাহা যে শাস্ত্রমতে ভাল না হইতে পারে একথা স্বীকার করিতে আমাদের কোনো লজ্জা নাই।

 যাহাতে আমাদের মঙ্গল, আমাদের শাস্ত্রের বিধানও তাহাই একথা আমরা জোর করিয়া বলিতে পারি না। তাহা যদি পারিতাম, তবে সেই মঙ্গলের দিক হইতে যুক্তি আকর্ষণ করিয়া শাস্ত্রের সহিত মিলাইয়া দিতাম। আগে দেখাইতাম অমুক কার্য্য আমাদের পক্ষে ভাল এবং অবশেষে দেখাইতাম তাহাতে আমাদের শাস্ত্রের সম্মতি আছে।

 সমুদ্রযাত্রার উপকারিতার পক্ষে ভূরি ভূরি প্রমাণ থাক না কেন, যদি শাস্ত্রে তাহার বিরুদ্ধে একটিমাত্র বচন থাকে, তবে সমস্ত প্রমাণ ব্যর্থ হইবে। তাহার অর্থ এই, আমাদের কাছে সত্যের অপেক্ষা বচন বড়, মানবের শাস্ত্রের নিকট জগদীশ্বরের শাস্ত্র ব্যর্থ।

 শাস্ত্রই যে সকলসময়ে বলবান তাহাও নহে। অনেকে বলেন বটে, ঋষিদের এমন অমানুষিক বুদ্ধি ছিল যে, তাঁহারা যে-সকল বিধান দিয়াছেন, সমস্ত প্রমাণ তুচ্ছ করিয়া আমরা অন্ধবিশ্বাসের সহিত নির্ভয়ে তাহা পালন করিয়া যাইতে পারি। কিন্তু সমাজে অনেক সময়েই শাস্ত্রবিধি ও ঋষিবাক্য তাঁহারা লঙ্ঘন করেন এবং তখন লোকাচার ও দেশাচারের দোহাই দিয়া থাকেন।

 তাহাতে এই প্রমাণ হয় যে, শাস্ত্রবিধি ও ঋষিবাক্য অভ্রান্ত নহে। যদি অভ্রান্ত হইত, তবে লোকাচার তাহার কোনোরূপ অন্যথা করিলে লোকাচারকে দোষী করা উচিত হইত। কিন্তু দেশাচার ও লোকাচারের প্রতি যদি শাস্ত্রবিধি-সংশোধনের ভার দেওয়া যায়, তবে শাস্ত্রের অমোঘতা আর থাকে না—তবে স্পষ্ট মানিতে হয়, শাস্ত্রশাসন সকল কালে সকল স্থানে খাটে না।

 তাহা যদি না খাটিল, তবে আমাদের কর্ত্তব্যের নিয়ামক কে? শুভবুদ্ধিও নহে, শাস্ত্রবাক্যও নহে। লোকাচার। কিন্তু লোকাচারকে কে পথ দেখাইবে? লোকাচার যে অভ্রান্ত নহে, ইতিহাসে তাহার শতসহস্র প্রমাণ আছে। লোকাচার যদি অভ্রান্ত হইত, তবে পৃথিবীতে এত বিপ্লব ঘটিত না, এত সংস্কারকের অভ্যুদয় হইত না।

 বিশেষত যে লোকসমাজের মধ্যে জীবনপ্রবাহ নাই সেখানকার জড় লোকাচার আপনাকে আপনি সংশোধন করিতে পারে না। স্রোতের জল অবিশ্রাম গতিবেগে নিজের দূষিত অংশ ক্রমাগত পরিহার করিতে থাকে। কিন্তু বদ্ধ জলে দোষ প্রবেশ করিলে তাহা সংশোধিত হইতে পারে না, উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাইতে থাকে।

 আমাদের সমাজ বদ্ধ সমাজ। একে ত আভ্যন্তরিক সহস্র আইনে বদ্ধ, তাহার পরে আবার ইংরাজের আইনেও বাহির হইতে অষ্টেপৃষ্ঠে বন্ধন পড়িয়া গেছে। সমাজ-সংশোধনে স্বদেশীয় রাজার স্বাভাবিক অধিকার ছিল এবং পূর্ব্বকালে তাঁহারা সে-কাজ করিতেন। কিন্তু অনধিকারী ইংরাজ আমাদের সমাজকে যে অবস্থায় হাতে পাইয়াছে ঠিক সেই অবস্থায় দৃঢ়ভাবে বাঁধিয়া রাখিয়াছে। সে নিজেও কোনো নূতন নিয়ম প্রচলিত করিতে সাহস করে না, বাহির হইতেও কোনো নূতন নিয়মকে প্রবেশ করিতে দেয় না। কোনটা বৈধ, কোন্‌টা অবৈধ তাহা সে অন্ধভাবে নির্দ্দিষ্ট করিয়া দিয়াছে। এখন সমাজের কোনো সচেতন স্বাভাবিক শক্তি সহজে কোনোরূপ পরিবর্ত্তন সাধন করিতে পারে না।

 এমন বাঁধা-সমাজের মধ্যে যদি লোকাচার মানিতে হয়, তবে একটা মৃত দেবতার পূজা করিতে হয়। সে কেবল একটা নিশ্চল নিশ্চেষ্ট জড়-কঙ্কাল। সে চিন্তা করে না, অনুভব করে; সময়ের পরিবর্ত্তন উপলব্ধি করিতে পারে না। তাহার দক্ষিণে বাঁয়ে নড়িবাব শক্তি নাই। সমস্ত হতভাগ্য জাতি, তাহার সমস্ত ভক্ত উপাসক, যদি তাহার সম্মুখে পড়িয়া পলে পলে আপনার মরণব্রত উদযাপন করে, তথাপি সে কল্যাণ-পথে তিলার্দ্ধমাত্র অঙ্গুলি নির্দ্দেশ করিতে পারে না।

 যাহারা শাস্ত্র হইতে বিধি সংগ্রহ করিয়া লোকাচারকে আঘাত করিতে চেষ্টা করেন, তাঁহারা কি করেন? তাঁহারা মৃতকে মারিতে চাহেন। যাহার বেদনাবোধ নাই তাহার প্রতি অস্ত্র প্রয়োগ করেন, যে অন্ধ, তাহাব নিকট দীপশিখা আনয়ন করেন। অস্ত্র প্রতিহত হয়, দীপশিখা বৃথা আলোকদান করে।

 তাঁহাদের আর একটা কথা জানা উচিত। শাস্ত্রও এক সময়ের লোকাচার। তাঁহারা অন্যসময়ের লোকাচারকে স্বপক্ষভুক্ত করিয়া বর্ত্তমানকালের লোকাচারকে আক্রমণ করিতে চাহেন। তাঁহারা বলিতে চাহেন, বহুপ্রাচীনকালে সমুদ্রযাত্রার কোনো বাধা ছিল না। বর্ত্তমান লোকাচার বলে, তখন ছিল না এখন আছে, ইহার কোনে। উত্তর নাই।

 এ যেন এক শত্রুকে তাড়াইবার উদ্দেশে আর এক শত্রুকে ডাকা। মোগলের হাত হইতে রক্ষা পাইবার জন্য পাঠানের হাতে আত্মসমর্পণ কথা। যাহার নিজের কিছুমাত্র শক্তি আছে সে এমন বিপদের খেলা খেলিতে চাহে না।

 আমাদের কি নিজের কোনো শক্তি নাই? আমাদের সমাজে যদি কোনো দোষের সঞ্চার হয়, যদি তাহার কোনো ব্যবস্থা আমাদের সমস্ত জাতির উন্নতি-পথের ব্যাঘাতস্বরূপ আপন পাষাণ-মস্তক উত্তোলন করিয়া থাকে, তবে তাহা দূর করিতে গেলে আমাদিগকে খুঁজিয়া বাহির করিতে হইবে, বহু প্রাচীনকালে তাহার কোনো নিষেধ-বিধি ছিল কি না? যদি দৈবাৎ পাওয়া গেল, তবে দিনকতক পণ্ডিতে পণ্ডিতে শাস্ত্রে শাস্ত্রে দেশব্যাপী একটা লাঠালাঠি পড়িয়া গেল— আর যদি দৈবাৎ অনুস্বর বিসর্গবিশিষ্ট একটা বচনার্দ্ধ না পাওয়া গেল, তবে আমরা কি এমনই নিরুপায় যে, সমাজের সমস্ত অসম্পূর্ণতা সমস্ত দোষ শিরোধার্য্য করিয়া বহন করিব, এমন কি, তাহাকে পবিত্র বলিয়া পূজা করিব? দোষও কি প্রাচীন হইলে পূজ্য হয়?

 আমরা কি নিজের কর্ত্তব্যবুদ্ধির বলে মাথা তুলিয়া বলিতে পারি না— পূর্ব্বে কি ছিল এবং এখন কি আছে তাহা জানিতে চাহি না, সমাজেব যাহা দোষ তাহা দূর করিব, যাহা মঙ্গল তা আবাহন কবিয়া আনিব? আমাদেব শুভাশুভ জ্ঞানকে হস্তপদ ছেদন কবিয়া পঙ্গু করিয়া রাখিয়া দিব, আর একটা গুরুতর আবশ্যক পড়িলে, দেশের একটা মহৎ অনিষ্ট, একটা বৃদ্ধ অকল্যাণ দূর করিতে হইলে, সমস্ত পুরাণ সংহিতা আগম নিগম হইতে বচনখণ্ড খুঁজিয়া খুঁজিয়া উদ্ভ্রান্ত হইতে হহবে—সমাজের হিতাহিত লইয়া বয়স্ক লোকের মধ্যে এরূপ বাল্যখেলা আর কোনো দেশে প্রচলিত আছে কি?

 আমাদের ধর্ম্মবুদ্ধিকে সিংহাসনচ্যুত করিয়া, যে লোকাচারকে তাহার স্থলে অভিষিক্ত করিয়াছি, সে আবার এমনি মূঢ় অন্ধ যে, সে নিজের নিয়মেরও সঙ্গতি রক্ষা করিতে জানে না। কত হিন্দু যবনের জাহাজে চড়িয়া উড়িষ্যা, মাদ্রাজ, সিংহল ভ্রমণ করিয়া আসিতেছে— তাহাদের জাতি লইয়া কোনো কথা উঠিতেছে না, এদিকে সমুদ্রযাত্রা বিধিসঙ্গত নহে বলিয়া লোকসমাজ চীৎকার করিয়া মরিতেছে। দেশে শত শত লোক অখাদ্য ও যবনান্ন খাইয়া মানুষ হইয়া উঠিল, প্রকাশ্যে যবনের প্রস্তুত মদ্যপান করিতেছে, কেহ সেদিকে একবার তাকায়ও না, কিন্তু বিলাতে গিয়া পাছে অনাচার ঘটে এজন্য বড় শঙ্কিত! কিন্তু যুক্তি নিষ্ফল। যাহার চক্ষু আছে তাহার নিকট এ-সকল কথা চোখে আঙুল দিয়া দেখাইবার আবশ্যক ছিল না। কিন্তু লোকাচার নামক প্রকাণ্ড জড় পুত্তলিকার মস্তকের অভ্যন্তরে ত মস্তিষ্ক নাই, সে একট নিশ্চল পাষাণপাত্র। কাককে ভয় দেখাইবাব নিমিত্ত গৃহস্থ হাড়ি চিত্রিত করিয়া শস্যক্ষেত্রে খাড়া করিয়া রাখে, লোকাচার সেইরূপ চিত্রিত বিভাষিকা। যে তাহার জড়ত্ব জানে সে তাহাকে ঘৃণা করে, যে তাহাকে ভয় করে তাহার কর্ত্তব্যবুদ্ধি লোপ পায়।

 আজকাল অনেক পুস্তক ও পত্রে আমাদের বর্ত্তমান লোকাচারে অসঙ্গতি দোষ দেখান হয়। বলা হয়, একদিকে আমরা বাধ্য হইয়া অথবা অন্ধ হইয়া কত অনাচাব করি, অন্যদিকে সামান্য আচার বিচার লইয়া কত কড়াকড়ি। কিন্তু হাসি পায় যখন ভাবিয়া দেখি, কাহাকে সে কথাগুলা বলা হইতেছে। শিশুরা পুত্তলিকার সঙ্গেও এমনি করিয়া কথা কয়। কে বলে লোকাচার শক্তি অথবা শাস্ত্র মানিয়া চলে? সে নিজেও এমন মহা অপরাধ স্বীকার করে না। তবে তাহাকে শক্তির কথা কেন বলি?

 সমাজের মধ্যে যে কোনো পরিবর্ত্তন ঘটিয়াছে তাহা বিনা যুক্তিতেই সাধিত হইয়াছে। গুরুগোবিন্দ, চৈতন্য যখন এই জাতিনিগড়বদ্ধ দেশে জাতিভেদ কথঞ্চিৎ শিথিল করেন তখন তাহা শক্তিবলে করেন নাই, চরিত্রবলে করিয়াছিলেন।

 আমাদের যদি এরূপ মত হয় যে সমুদ্রযাত্রার উপকার আছে, মনুর কোন নিষেধ বিনা কারণে ভাবতবর্ষীয়দিগকে চিরকালের জন্য কেবল পৃথিবীর একাংশেই বদ্ধ করিয়া রাখিতে চাহে, সেই কারাদণ্ডবিধান নিতান্ত অন্যায় ও অনিষ্টজনক, দেশে বিদেশে গিয়া জ্ঞান অর্জ্জন ও উন্নতিসাধন হইতে কোনো প্রাচীন বিধি আমাদিগকে বঞ্চিত করিতে পারে না, যিনি আমাদিগকে এই সমুদ্রবেষ্টিত পৃথিবীতে প্রেরণ করিয়াছেন, তিনি আমাদিগকে সমস্ত পৃথিবী ভ্রমণের অধিকার দিয়াছেন—তবে আমবা আর কিছু শুনিতে চাহি না, তবে কোনো শ্লোকখণ্ড আমাদিগকে ভয় দেখাইতে, কোনে। লোকাচার আমাদিগকে নিষেধ করিতে পারে না।

 বাঁধও ভাঙ্গিয়াছে। কেহ শাস্ত্র ও লোকাচারের মুখ চাহিয়া বসিয়া নাই। বঙ্গগৃহ হইতে সন্তানগণ দলে দলে সমুদ্রপার হইতেছে। এবং ক্ষীণবল সমাজ তাহার কোনো প্রতিবিধান করিতে পারিতেছে না। সমাজের প্রধান বল নীতিবল যখন চলিয়া গিয়াছে, তখন তাহাকে বেশিদিন কেহ ভয় করিবে না। যে সমাজ মিথ্যাকে, কপটতাকে মার্জ্জনা করে, অর্দ্ধগুপ্ত অনাচারের প্রতি জানিয়া শুনিয়া চক্ষু নির্মীলন কবে, যাহার নিয়মের মধ্যে কোনো নৈতিক কারণ, কোনো যৌক্তিক সঙ্গতি নাই, সে যে নিতান্ত দুর্ব্বল। সমাজের সমস্ত বিশ্বাস যদি দৃঢ় হইত, যদি সেই অগণ্ড বিশ্বাস অনুসারে সে নিজের সমস্ত ক্রিয়াকলাপ নিয়মিত করিত, তবে তাহাকে লঙ্ঘন করা বড় দুরূহ হইত।

 যাঁহারা শুভ বুদ্ধির প্রতি নির্ভর না করিয়া শাস্ত্রের দোহাই দিয়া সমুদ্রযাত্রা করিতে চান, তাঁহারা দুর্ব্বল। কাবণ, তাঁহাদের পক্ষে কোনো যুক্তি নাই—সমাজ শাস্ত্রমতে চলে না।

 দ্বিতীয় কথা এই, লোকাচার যে সমুদ্রযাত্রা নিষেধ করে তাহার একটা অর্থ আছে। হিন্দুসমাজের অনেকগুলি নিয়ম পরস্পর দৃঢসম্বন্ধ। একটা ভাঙ্গিতে গেলে আর একটা ভাঙ্গিয়া পড়ে। রীতিমত স্ত্রীশিক্ষা প্রচলিত করিতে গেলে বাল্যবিবাহ তুলিয়া দিতে হয়। বাল্যবিবাহ গেলে ক্রমশই স্বাধীনবিবাহ আসিয়া পড়ে। স্বাধীনবিবাহ প্রচলিত করিতে গেলে সমাজের বিস্তর রূপান্তর অবশ্যম্ভাবী হইয়া পড়ে এবং জাতিভেদের মূল ক্রমে জীর্ণ হইয়া আসে। কিন্তু তাই বলিয়া এখন স্ত্রীশিক্ষা কে বন্ধ করিতে পারে?

 সমুদ্রপার হইয়া বিদেশযাত্রাও আমাদের বর্ত্তমান সমাজ রক্ষার পক্ষে সম্পূর্ণ অনুকূল নহে। আমাদের সমাজে কোনো প্রকার স্বাধীনতার কোনো অবসব নাই। আমরা নিশ্চেষ্ট, নিশ্চল, অন্ধভাবে সমাজের অন্ধকূপে এক অবস্থায় পড়িয়া থাকিব, লোকাচারের এই বিধান। মৃত্যুর ন্যায় শান্ত অবস্থা আর নাই, সেই অগাধ শান্তি লাভ কবিবার জন্য যতদূব সম্ভব আমাদের জীবনীশক্তি লোপ করা হইয়াছে। একটি সমগ্র বৃহৎ জাতিকে সম্পূর্ণ নিশ্চেষ্ট ও নির্জ্জীব করিয়া ফেলিতে অল্প আয়াজন করিতে হয় নাই। কারণ, মনুষ্যত্বের অভ্যন্তরে একটি অমর জীবনের বীজ নিহিত আছে যে, সে যদি কোনো ছিদ্র দিয়া একটুখানি স্বাধীন সূর্য্যালোক ও বৃষ্টিধারা প্রাপ্ত হয়, অমনি অঙ্কুরিত, পল্লবিত, বিকশিত হইয়া উঠিতে চেষ্টা করে। সেই ভয়ে আমাদের হিন্দুসমাজ কোথাও কোনো ছিদ্র রাখিতে চাহে না।

 সমুদ্রপার হইয়া নূতন দেশে নূতন সভ্যতাব নূতন নূতন আদর্শলাভ করিয়া আমাদের মনের মধ্যে চিন্তার বন্ধন মুক্তি হইবে তাহার সন্দেহ নাই। সে-সমস্ত নিয়ম আমরা বিনা সংশয়ে আজন্মকাল পালন করিয়া আসিয়াছি, কখনও কারণ জিজ্ঞাসাও মনে উদয় হয় নাই, সে-সম্বন্ধে নানা যুক্তি তর্ক ও সন্দেহের উদ্ভব হইবে। সেই মানসিক আন্দোলনই হিন্দুসমাজের পক্ষে সর্ব্বাপেক্ষা আশঙ্কার কারণ। বাহ্যত ম্লেচ্ছ-সংসর্গ ও সমুদ্রপাব হওয়া কিছুই নহে কিন্তু সেই অন্তরের মধ্যে স্বাধীন মনুষ্যত্বের সঞ্চার হওয়াই যথার্থ লোকাচার-বিরুদ্ধ।

 কিন্তু হায়! আমরা সমুদ্রপার না হইলেও মনু সংহিতা অন্য জাতিকে সমুদ্রপার হইতে নিষেধ করিতে পারে নাই। নূতন জ্ঞান, নূতন আদর্শ, নূতন সন্দেহ, নূতন বিশ্বাস জাহাজবোঝাই হইয়া এদেশে আসিয়া পৌঁছিতেছে। আমাদের যে গোড়াতেই ভ্রম। সমাজরক্ষার জন্য যদি আমাদের এত ভয়, এত ভাবনা, তবে গোড়ায় ইংরাজি শিক্ষা হইতে আপনাকে সযত্নে রক্ষা করা উচিত ছিল। পর্ব্বতকে যদি মহম্মদের নিকট যাইতে নিষেধ কর, মহম্মদ যে পর্ব্বতের কাছে আসে, তাহার উপায় কি? আমরা যেন ইংলণ্ডে না গেলাম কিন্তু ইংবাজি শিক্ষা সে আমাদের গৃহে গৃহে আসিয়া প্রবেশ করিতেছে। বাঁধটা সেই ত ভাঙ্গিয়াছে। আজ যে এত বাকচাতুবী, এত শাস্ত্র-সন্ধানের ধূম পড়িয়াছে, মনে আঘাত না পড়িলে ত তাহার কোনো আবশ্যক ছিল না।

 কিন্তু মূঢ় লোকাচার এমনি অন্ধ অথবা এমনি কপটাচারী যে, সে-দিকে কোনো দৃক্‌পাত নাহ। অতি বড় পবিত্র হিন্দুও শৈশব হইতে আপন পুত্রকে ইংরাজি শিখাইতেছে। এমন কি মাতৃভাষা শিখাইতেছে না। এবং শিক্ষাসমিতি-সভায় যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে মাতৃভাষাশিক্ষার প্রস্তাব উঠিতেছে তখন স্বদেশের লোকই ত তাহাতে প্রধান আপত্তি করিতেছে।

 কেরাণীগিরি না করিলে যে উদরপূর্ণ হয় না। পাশ করিতেই হইবে। পাশ না করিলে চাকরী চুলায় যাক, বিবাহ করা দুসাধ্য হইয়াছে। ইংরাজি শিক্ষার মর্য্যাদা দেশের আপামর সাধারণের মধ্যে এমনি বদ্ধমূল হইয়াছে।

 কিন্তু এ কি ভ্রম, এ কি দুরাশা! ইংবাজি শিক্ষাতে কেবলমাত্র যতটুকু কেরাণীগিরির সহায়তা করিবে ততটুকু আমরা গ্রহণ করিব, বাকীটুকু—আমাদের অন্তরে প্রবেশ লাভ কবিবে না! এ কি কখনো সম্ভব হয়। দীপশিখা কেবল যে আলো দেয় তাহা নহে, পলিতাটুকুও পোড়ায়, তেলটুকুও শেষ করে। ইংরাজিশিক্ষা কেবল যে মোটামোটা চাক্‌রি দেয় তাহা নহে, আমাদের লোকাচারের আবহমান সূত্রগুলিকেও পলে পলে দগ্ধ করিয়া ফেলে।

 এখন যতদিন এই শিক্ষা চলিবে এবং ইহার উপর আমাদের জীবিকানির্ব্বাহ নির্ভর করিবে, ততদিন যিনি যেমন তর্ক করুন, শাস্ত্র মৃতভাষায় যতই নিষেধ ও বিভীষিকা প্রচার করুক, বাঙালী সমুদ্র পার হইবে, পৃথিবী সমস্ত উন্নতিপথের যাত্রীদের সঙ্গ ধরিয়া একত্রে যাত্রা করিতে প্রাণপণ চেষ্টা করিবে।

 ১২৯৯