সাবাইস বুদ্ধি/দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ।
আমার কথার উত্তরে সেই জহুরি কহিলেন, “আজ সন্ধ্যার পর আমি আমার দোকানে বসিয়া আছি, এরূপ সময়ে একটী এদেশীয় স্ত্রীলোক দোকানের ভিতর প্রবেশ করিল। ইনি একখানি ব্রুহাম গাড়ীতে করিয়া আগমন করেন। ব্রহামখানি নূতন বলিয়া অনুমান হয়, ঘোড়াটাও বিশেষ মূল্যবান ওয়েলার। তিনি ঐ গাড়ীতে একাকীই আসিয়াছিলেন, আজকাল এদেশীয় বিলাত ফেরত যুবকগণের শিক্ষিত মহিষীগণ বা ব্রাহ্মিকাগণ, যেরূপভাবে বস্ত্রাদি পরিধান করিয়া থাকেন, উনিও সেইরূপ ভাবে সজ্জিত ছিলেন। তিনি গাড়ী হইতে অবতরণ করিয়া, পুরুষের ন্যায় অথবা মেমসাহেবদিগের ন্যায় একাকী আমার দোকানের ভিতর প্রবেশ করিয়া আমাকে কহিলেন, আপনি আমাকে চিনেন কি? উত্তরে আমি কহিলাম, না, আমি আপনাকে ইতিপূর্ব্বে কখন দেখিয়াছি বলিয়া অনুমান হয় না। পরিচয় পরে হইবে, এখন আমার দুইটা জিনিষের আবশ্যক আছে, যদি আপনার দোকানে থাকে, তাহা হইলে দেখান দেখি।”
আমি। কি কি দ্রব্যের অবশ্যক?
স্ত্রীলোক। একজোড়া উৎকৃষ্ট হীরক-বলয় ও একছড়া মতির মালা।
তাঁহার কথা শুনিয়া আমার দোকানে যে সকল হীরকবলয় প্রস্তুত ছিল, তাহা এক এক করিয়া তাহাকে দেখাইলাম, ও কয়েক ছড়া মতির মালাও তাহাকে দেখাইলাম। দেখিয়া দেখিয়া তিনি উহার মধ্য হইতে একজোড়া বলয় ও এক ছড়া মালা পছন্দ করিলেন। সেই সঙ্গে দুইটা হীরার ও একটী মাণিকের আংটীও তাঁহার পছন্দ হইল। তিনি ঐ সমস্ত দ্রব্যের মূল্য আমাকে জিজ্ঞাসা করিলে আমি কহিলাম, উহার মূল্য পনর সহস্র টাকা হইবে। ঐ সকল দ্রব্যের প্রকৃতমূল্য দশ হাজার টাকা; কিন্তু তাহার সহিত অনেক কসা মাজা করিয়া বার হাজার টাকা উহার মূল্য অবধারিত হইল। তখন তিনি তাঁহার পকেট হইতে একটা রূপার কার্ডকেস বাহির করিয়া তাহার মধ্য হইতে একখানি কার্ড বাহির করিয়া আমার হস্তে অর্পণ করিলেন। কার্ডে যে নাম মুদ্রিত ছিল, তাহা দেখিয়া আমি বুঝিলাম যে, উনি কলিকাতা হাইকোর্টের একজন বিখ্যাত কৌন্সলির স্ত্রী। বার হাজার কেন, সেই কৌন্সলি সাহেব যদি বিশ হাজার টাকার অলঙ্কার দেনায় চাহেন, তাহা আমি অনায়াসেই দিতে পারি।
ঐ স্ত্রীলোকের পরিচয় পাইয়া আমি কহিলাম, “এই অলঙ্কার গুলি কি আপনি নিজে লইয়া যাইবেন, কি আমি উহা আপনার বাড়ীতে পাঠাইয়া দিব।” আরও জিজ্ঞাসা করিলাম, “ইহার মূল্য এখন আপনি প্রদান করিবেন, না বাকী থাকিবে, পরে ইহার বিল পাঠাইয়া দিব।”
“ইহার মূল্য আপনি নগদ পাইবেন, কিন্তু এত টাকার অলঙ্কার আমার স্বামীকে একবার না দেখাইয়া লওয়া কর্তব্য নহে, অদ্যই রাত্রির গাড়ীতে কোন একটী মোকদ্দমা উপলক্ষে তাঁহাকে বাহিরে যাইতে হইবে। তিনি তাঁহার নিমিত্ত একটু ব্যস্ত আছেন বলিয়া, আমার সহিত আসিতে পারিলেন না। আপনি গহনাগুলি আমার সহিত লইয়া আসুন, আমার স্বামীকে দেখাইয়া ইহার মূল্য লইয়া আসিবেন।
উহার কথায় আমার অবিশ্বাস করিবার কিছুমাত্র কারণ ছিল না, একে তিনি, যাহার স্ত্রী বলিয়া পরিচয় প্রদান করিতেছেন, তিনি আমার উত্তমরূপ পরিচিত-তাহার উপর নিয়মিত লাভের উপর দুই সহস্রমুদ্রা অধিক লাভের প্রলোভন ছাড়িয়া দেওয়া ব্যবসায়ীর পক্ষে অসম্ভব। সুতরাং ঐ সকল অলঙ্কার তাহার স্বামীর নিকট পাঠাইয়া দিতে প্রস্তুত হইলাম। আমার দোকানের বিশেষ বিশ্বাসী ও সর্ব্বপ্রধান কর্মচারী যিনি ছিলেন, তাঁহাকেই ঐ অলঙ্কারগুলি লইয়া তাহার সহিত পাঠাইয়া দিলাম। গাড়ীতে উঠিবার সময় আমার কর্মচারী একটু ইতস্ততঃ করিতে লাগিলেন। কারণ, ব্রুহাম গাড়ীতে কেবল একপার্শ্বে ভিন্ন বসিবার স্থান নাই, সেইস্থানে ঐ স্ত্রীলোকটা উপবেশন করিবেন, সুতরাং তাঁহার পার্শ্বে তিনি কিরূপে বসেন, এইরূপ একটু ইতস্ততঃ করিয়া ঐ কর্মচারী আমার দ্বারবানকে একখানি গাড়ী আনিতে কহিলেন। ইহা শুনিয়া ঐ স্ত্রীলোকটী কহিলেন, আর গাড়ী আনিবার প্রয়োজন নাই। আমার গাড়ীতেই আইস, আমার পার্শ্বে বসিয়া গমন করিলে, তাহাতে আমি অবমাননা বোধ করিব না। উহার কথা শুনিয়া আমার কর্মচারী কি একটু ভাবিলেন ও পরিশেষে তাঁহার প্রস্তাবে সম্মত হইয়া ঐ গাড়ীতেই আরোহণ করিয়া, তাঁহার পাণে উপবেশন করিয়া গমন করিলেন। বলা বাল্য, অলঙ্কারগুলি তাঁহার সঙ্গে রহিল।
একঘণ্টার মধ্যে তাহার অগমন করিবার কথা ছিল, কিন্তু ক্রমে দুই ঘণ্টাকাল অতিবাহিত হইয়া গেল, তিনি প্রত্যা-
গমন করিলেন না বা কোনরূপ সংবাদও প্রদান করিলেন না। সুতরাং আমার মনটা একটু ব্যস্ত হইয়া পড়িল। বাসায় যাইবার নিমিত্ত আমার গাড়ী প্রস্তুত ছিল, ঐ গাড়ীতে আরোহণ করিয়া আমি সেই কৌন্সলি সাহেবের বাড়ীতে গমন করিলাম। তাঁহার সহিত সাক্ষাৎও হইল, কিন্তু তাহার নিকট জানিতে পারিলাম যে, তাহার স্ত্রী এখন কলিকাতায় নাই, তিনি এখন দার্জিলিংয়ে আছেন ও অপর কোন স্ত্রীলোককে তিনি কোন অলঙ্কারাদি খরিদ করিবার নিমিত্ত কোন স্থানে প্রেরণ করেন নাই, ও ঐরূপের কোন স্ত্রীলোককে তিনি জানেন না, অথবা অলঙ্কারাদি লইয়া কেহ তাঁহার বাড়ীতে আগমনও করে নাই।
কৌন্সলি সাহেবের কথা শ্রবণ করিয়া আমার বুদ্ধি লোপ পাইয়া গেল, কিছুক্ষণের নিমিত্ত আমি হিতাহিতজ্ঞান-বিবর্জিত হইয়া পড়িলাম। সেই সময় কি করা কর্তব্য, “তাহার কিছুই স্থির করিতে না পারিয়া, আমি আমার দোকানে ফিরিয়া আসিলাম। দোকানের অপরাপর কর্মচারীগণের সহিত পরামর্শ করিয়া ইহাই স্থির হইল যে, আর কালবিলম্ব না করিয়া থানায় গিয়া এই সংবাদ প্রদান করা হউক। ঐ সংবাদ লইয়া থানায় যে লোক গমন করিতেছিল, আপনি তাহাকেই ধৃত করিয়া এখানে আনিয়াছেন।
আমি। তাহা হইলে এখনও থানায় সংবাদ দেওয়া হয় নাই?
জহরি। না।
আমি। শীঘ্র সংবাদ পাঠাইয়া দিন।
আবার কথা শুনিয়া সেই ব্যক্তি থানায় সংবাদ দিতে দ্রুতপদে গমন করিল। আমি। আপনি এত বড় চতুর লোক হইয়া একটা স্ত্রীলোকের নিকট এইরূপে প্রবঞ্চিত হইলেন?
জহুরি। স্ত্রীলোক বলিয়াই তাহার নিকট আমি প্রবঞ্চিত হইয়াছি, পুরুষ হইলে বোধ হয়, আমাকে এইরূপ প্রতারিত করিতে পারি না। সে যাহা হউক, আমার অর্থের অদৃষ্টে যাহা হয় হউক, অর্থ পুনরায় উপার্জিত হইবে। কিন্তু আমার বিশ্বস্ত প্রধান কর্ম্মচারীর যদি কোনরূপে জীবন নষ্ট করিয়া ফেলে, তাহা হইলে কি সর্ব্বনাশ হইবে বলুন দেখি?
আমি। আপনার সেই বিশ্বস্ত কর্ম্মচারী তোঐ স্ত্রীলোকটীর সহিত মিলিত হইয়া, এইরূপ কার্য্যে হস্তক্ষেপ করে নাই?
জহুরি। না মহাশয়, তাহা কোনরূপেই হইতে পারে না। তাঁহার দ্বারা এরূপ কার্য্য কিছুতেই সম্পন্ন হইবে না।
আমি। তাঁহার বাসা কোথায়? সেই স্থানের সংবাদ লইয়াছেন কি, তিনি ত বাসায় প্রত্যাগমন করেন নাই?
জহুরি। তিনি তাঁহার বাসায় যাইবেন না। কারণ তিনি অবগত আছেন যে, তাঁহার অপেক্ষায় আমি এখানে বসিয়া আছি। তদ্ব্যতীত তাহার বাসার সংবাদও লওয়া হইয়াছে, তিনি বাসায় আসেন নাই। জীবিত থাকিলে ত বাসায় প্রত্যাগমন করিবেন।
জহুরি। তাঁহার জীবন সম্বন্ধে কোন ভাবনা নাই। যাহার বার এই কার্য্য হইয়াছে, সে কাহাকেও হত্যা করিবার জন্য এই কার্য্য করে নাই। সে অর্থ অপহরণ করিবার মানসেই এই কার্য্য করিয়াছে।
জহুরি। তাহা হইলেই ভাল, উহাকে জীবিত অবস্থায় প্রাপ্ত হইলেই আমি সন্তুষ্ট। অলঙ্কারের ভাগ্যে যাহা হয় হউক। আমি। আপনার কর্মমচারীকেও প্রাপ্ত হইবেন, অলঙ্কারও পাইবেন। তবে আমাদিগের অদৃষ্টে যে কষ্ট আছে, সেই কষ্ট আমাদিগকে সহ্য করিতে হইবে।
আমাদিগের মধ্যে এইরূপ কথাবার্তা হইতেছে, এরূপ সময়ে থানা হইতে কর্ম্মচারীগণ আসিয়া উপস্থিত হইলেন।