সাহিত্যে প্রগতি/সাহিত্যে সমাজ-চিত্র (২)
সাহিত্যে সমাজ-চিত্র
( ২ )
এক্ষণে জার্ম্মান সাহিত্যের যংকিঞ্চিৎ অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হওয়া যাউক। প্রাচীন টিউটনদের জনশ্রুতি (saga) বলে যে, ঋক (Rik) দেবতা—যোদ্ধাঅভিজাত (Jarl), কৃষক (Karl) এবং অর্দ্ধ-গোলাম দাস (thrall) নামক তিনটি বিভিন্ন আকৃতির লোক সৃষ্টি করেন (Rigsthule বা Heimdall saga দ্রষ্টব্য)। এই তিনজন তিনটি শ্রেণীর আদিপুরুষ (এই জনশ্রুতির সহিত হিন্দুর বর্ণবিভাগের কাহিনীর অনেকটা সাদৃশ্য আছে, এ-বিষয়ে Bluntschliর “The Theory of the State” দ্রষ্টব্য)। এই গল্পের মধ্যে টিউটন জাতির প্রাচীনকাল হইতে শ্রেণী-বিভাগের সংবাদ প্রাপ্ত হওয়া যায়। . সুইডিস্ সাগা-সমূহে (sagas) এবং জার্ম্মান নেবুলিঙ্গেন গীতসমূহে (Nebulingen lieder) বিভিন্ন কৌমের সর্দ্দার-বংশের যুদ্ধবিগ্রহ ও প্রেমের সংবাদই পাওয়া যায়। সিগফ্রিড ও ব্রুনহিল্ডের মধ্যে পারস্পরিক আকর্ষণ ও প্রত্যাখ্যানের মধ্যে বর্ব্বর-যুগের বীর ও বীরাঙ্গনাদেরই সংবাদ পাওয়া যায় (J. J. Meyer তাঁহার The Sexual life of the ancient Indians নামক পুস্তকে [ ইংরেজী অনুবাদ ] উপরোক্ত উভয়কে দ্রৌপদী ও কর্ণের সহিত তুলনা করিয়াছেন)। এইসব জনশ্রুতিতে জনসাধারণের কোন পরিচয় পাওয়া যায় না। এক একটি কৌমের সর্দ্দার বা রাজা অপর একটি কৌমকে পরাজিত করিয়া কি প্রকারে গোলামী অথবা অর্দ্ধ-দাসত্বে (serf) পরিণত করিল এবং বিজিতদের কি দশা হইল সাহিত্যে তাহার কোন নিদর্শন নাই। এইসব বিষয়ে অনুসন্ধান করিয়া যে-সব রাজনীতিক পুস্তক পরে রচিত হইয়াছে তন্মধ্যে অনেক রাজনীতিক তথ্য পাওয়া যায়।
অতঃপর টিউনিক জাতিসমূহ খৃষ্টান হয় এবং রোমীয় সভ্যভার সংস্পর্শে আসে। এই সময় ইউরোপের অন্ধকার যুগ কাটিয়া গিয়া সামন্ততান্ত্রিক পদ্ধতি যেমন জার্ম্মান অধ্যুষিত ফ্রান্সে তেমনি জার্ম্মানীতে শিকড় গাড়ে। সেখানেও ব্যারণদের যুদ্ধ-বিগ্রহ সম্বন্ধে অনেক চারণ-গাথা রচিত হয় এবং স্বামি-ধর্ম্ম তথায়ও প্রামান্য লাভ করে। এইসব গাথা ও গল্পের মধ্যে ব্যারণ ও তাহাদের প্রণয়িনীদের কার্য্যের সংবাদই মিলে; ইহাতে chivalry, gallantry প্রভৃতির পরিচয় পাওয়া যায়। উহাতে দেখা যায়, এক যুবতীর প্রেমলাভের জন্য দুই ‘নাইট’ যোদ্ধা লড়িতেছে; এবং যুদ্ধে যে জয়লাভ করে যুবতী তাহারই কণ্ঠলগ্ন হইতেছে। এতদ্বারা এই মনস্তত্বই প্রকাশ পায় যে জার্ম্মান-যুবতী প্রেম বিষয়ে aggressive, এ-বিষয়ে আজকালকার ন্যায় সে passive ও coyish নয় (পরলোকগত অধ্যাপক ভিন্টারনিটস বলিয়াছেন এই ভাবটা ভারতীয় সাহিত্য হইতে ফরাসী সাহিত্যের মধ্য দিয়া অবশেষে জার্ম্মাণ সাহিত্যে প্রবেশ করিয়াছে। এ বিষয়ে তাঁহার History of Sanskrit Literature দ্রষ্টব্য)। ইহার পর শিল্প-সমূহের উদ্ভব হয়। শিল্পীরা ধর্ম্মের ধারণা-সমূহকে রূপ দিবার জন্য চেষ্টা করে। ধর্ম্ম তথন উচ্চশ্রেণীর লোকদের দ্বারাই অধ্যুষিত। ইহারই ফলে মধ্যযুগীয় Gothic style-এর ভাস্কর্য্যের সৃষ্টি হয়। এই সময় Church জনকতক উচ্চবর্ণের ও অভিজাতবংশীয় লোকদের দ্বারা পরিচালিত হইত। রোমান ক্যাথলিক ধর্ম্মমণ্ডলী (Church) কেবল বনিয়াদী স্বার্থের (vested interests) তরফদারী করিত। ইহা ‘জন’ বা ‘গণে’র কোন তোয়াক্কা রাখিত না। সাধারণ লোক হয় গরীব শিল্পী নয় অর্দ্ধগোলাম সার্ফ (serf) ছিল। তাহাদের মধ্যেই খৃষ্টীয়-কম্যুনিস্ট মত-সমূহ প্রচারিত হয়। পোপ এবং ইতিহাস ইহাদিগকে heretic sects বলিয়া চিত্রিত করিয়াছে! ইহাদের উপর পোপ ও ধনিকশ্রেণীর ঘোর অন্যায় ও অত্যাচার অনুষ্ঠিত হইত। আবার এই সময়েই অতীন্দ্রিয়বাদীদের (mystic) সংবাদ জার্ম্মান সাহিত্যে পাওয়া যায়। Rosacrucians প্রভৃতি অতীন্দ্রিয়বাদীর দল এই মধ্যযুগে উত্থিত হয়। ইতিহাসে দেখা যায় যে, জাতীয় হা-হুতাশের ও অবসাদের দিনেই মিষ্টিকদের আবির্ভাব হয়! এতদ্বারা মানুষের মনকে ইহ জগতের দুঃখ-দুর্দ্দশা হইতে সরাইয়া পর-জগতের সুখ-সম্ভোগের আশা-আকাঙ্ক্ষায় মস্গুল করিয়া রাখা হয়। বিভিন্ন রাজা, অভিজাত ও ধর্ম্মযাজকদের দ্বারা শোষিত ও নিষ্পেষিত শ্রেণী সমূহের মধ্যেই রোমান ক্যাথলিক ধর্ম্ম-বিরুদ্ধ মত-সমূহ সমর্থিত হইত।
এই যুগের শেষে অর্থাৎ Renaissance-এর যুগে একটা ব্যবসায়ী-শ্রেণী উত্থিত হইয়াছে। তখন আমেরিকা ও ভারতের মধ্যে যাতায়াতের রাস্তা আবিষ্কৃত হইয়াছে। পশ্চিম ইউরোপে একটা বিশিষ্ট ব্যবসায়ীশ্রেণী প্রতিষ্ঠা লাভ করিয়াছে। তাহাদের পরিস্থিতির প্রতীক হইলেন মার্টিন লুথার ও জন ক্যাল্ভিন। প্রটেষ্টাণ্ট, অর্থাৎ ধর্ম্মসংস্কার আন্দোলন এই মধ্যবিত্তশ্রেণীর অনুকূলেই পরিচালিত হয়। এইজন্য প্রটেষ্টাণ্ট সাহিত্য সম্রাট, বড় বড় রাজা, পোপ ও কার্ডিনালদের প্রতিকূলেই লিখিত হইতে দেখা যায়। এই আন্দোলনে ‘গণে’র সম্বন্ধ কি সেই সম্পর্কে Engels-এর “The Peasant Revolt in Germany” পুস্তক পাঠ করিলেই তাহা সম্যক্ হৃদয়ঙ্গম হইবে।
অতঃপর আসে অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ ও ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রাক্কাল। এই সময় ফরাসী বিপ্লবের যুগ। ইউরোপের সর্ব্বত্রই মধ্যবিত্তশ্রেণী জাতীয়তার (Nationalism) মাদকতায় বিভোর। তখনকার জার্ম্মান শিক্ষিত লোকদের আকাঙ্ক্ষা ছিল, কি প্রকারে জার্ম্মানীকে একরাষ্ট্রাধীন করিয়া একজাতীয়তা-সম্পন্ন করা যায়। রুশোর মত—দেশ “এক এবং অবিভাজ্য” (one and indivisible)। তাহা ফরাসী বিপ্লবের মধ্য দিয়া সমস্ত জাতীয়তাবাদীদের হৃদয়ে তৎকালে গ্রথিত হইয়াছিল; জার্ম্মানীকেও তদ্রূপ করিতে হইবে ইহাই ছিল তখনকার জার্ম্মান স্বদেশপ্রেমিকের আদর্শ। আর ফ্রান্স বরাবরই এই পুণ্যকর্ম্মের শত্রু, বিশেষতঃ নেপোলিয়ন জার্ম্মানীকে পুনঃ পুনঃ আক্রমণ করিতেছে। তখনকার হ্যাস্বুর্গ (Hapsburg) এবং আধুনিক হোহেন্জোলারন Hohenzollern) বংশদ্বয়ের বিবাদের মধ্যে স্বদেশপ্রেমিকেরা তাঁহাদের আদর্শ খুঁজিয়া পান নাই। এইজন্য তাঁহারা অতি প্রাচীন স্যাক্সন বীর হেরম্যানকে (ল্যাটিন Arminius-যিনি রোমানদের পরাজিত করিয়াছিলেন) স্মরণ করিয়া গীতি রচনা করিতে লাগিলেন। আবার শিলার (Schiller), গেটে (Goethe)—William Tell, Egmont প্রভৃতি লেখক মধ্যযুগীয় বীরগণের কীর্ত্তিকলাপ অবলম্বন করিয়া নাটক ও গীতিকাব্য রচনা করেন। মুলার জার্ম্মান অতীত ইতিহাসের আলোচনায় প্রবৃত্ত হন। জার্ম্মানীর ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রাক্কালে রচিত সাহিত্যের মধ্যে এই সময়ের জার্ম্মান ন্যাশন্যালিজমের ও বিপ্লবীদের কর্মপ্রণালীর পরিচয় পাওয়া যায়। ফরাসীবিপ্লব এবং নেপোলিয়নের প্রতি বিতৃষ্ণা ছিল সেই যুগের সাহিত্যের ভঙ্গী। জার্ম্মানীতে মধ্যযুগীয় রাজা ও ব্যারণরা সেই সময়ে রাজশক্তি করায়ত্ত করিয়া সমাজের শীর্ষদেশে অবস্থিত ছিল বলিয়া জার্ম্মান জাতীয়তাবাদ সাধারণতঃ ফ্রান্সের মত গণতন্ত্রবাদী হইতে পারে নাই। যে-সব রাজনীতিক ও অর্থনীতিক সংস্কার প্রুশীয় মন্ত্রী হেরডার কর্তৃক সংসাধিত হয় (প্রুশিয়াতে সার্ফদের মুক্তিদান) তাহা ফরাসী আক্রমণের চাপেই হইয়াছিল। সেইজন্য তখনকার সাহিত্যে অভিজাতশ্রেণীর বিরুদ্ধে কোন কথা পাওয়া যায় না।
ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমাংশের একজন বড় দার্শনিক ছিলেন হেগেল (Hegel)। ইনি প্রুশীয় তথা জার্ম্মান স্বজাতিপ্রেমিকদের তৎকালীন চিন্তাধারার একটী উৎকৃষ্ট নজীর। প্রাচীন রাষ্ট্র, ধর্ম্ম ও সমাজপদ্ধতিকে ঊনবিংশ শতাব্দীর যুক্তিতত্ত্বের আবহাওয়ায় খাপ-খাওয়াইবার জন্য তিনি যে-সব যুক্তিতর্কের অবতারণা করিয়াছিলেন তাহা আজ অগ্রাহ্য হইলেও উহাই একটি প্রকৃষ্ট প্রমাণ যে নিজের দেশের সমস্ত পদ্ধতিকে মানবজাতির শ্রেষ্ঠ দান বলাই ছিল জার্ম্মান স্বজাতিপ্রেমিকদের গর্ব্ব। হেগেল “দর্শনশাস্ত্রের ইতিহাস” (History of Philosophy) নামক পুস্তকে তাঁহার Thesis, Antithesis এবং Synthesis নামক dogmaটি প্রয়োগ করেন। এই dogmaটি তিনি চীন হইতে প্রুশিয়া তথা জার্ম্মানী পর্য্যন্ত সমস্ত দেশে প্রয়োগ পূর্ব্বক দেখান যে প্রুশিয়ায় জার্ম্মান জাতিই এই dogmaটির পরিপূর্ণ অভিব্যক্তি করিতে সমর্থ হইয়াছে এবং জীবনে Subjective ও Objective-এর সম্মিলন করিয়া মানবজীবনের পূর্ণতা লাভ করিয়াছে। অবশ্য তিনি ইহাও বলিয়াছেন যে ভারতবর্ষ তাহার বেদাস্ত-দর্শনশাস্ত্র দ্বারা সেই সত্যে উপনীত হইয়াছে; কিন্তু উহা Sensuous ও Superficial! এই কারণ-বশতঃ তিনি জার্ম্মানদের মানবকূলের শ্রেষ্ঠজাতি বলিয়া ব্যক্ত করিয়াছেন। তিনিই প্রথম Germanism নামক মতবাদ সৃষ্টি করেন; এই মতবাদই আজ জার্ম্মানীতে Nordicism বলিয়া চলিতেছে। এই গর্ব্ব প্রকাশ পায় যখন নেপোলিয়নের জার্ম্মানী-নিপীড়ন কাহিনী লোকের মনের মধ্যে জাগ্রত ছিল! পরে নিট্শে (Nietzsche) ও তাঁহার শিষ্য ট্রাইট্স্কে (Treitschke) উক্ত মতকে Blonde boast theory নাম দিয়া জার্ম্মানদের শ্রেষ্ঠমানব বলিয়া ঘোষণা করেন। ইহার পশ্চাতে ছিল—শতধা-বিচ্ছিন্ন জার্ম্মানদের উৎকট জাতীয়তাবাদ দ্বারা জগতে বড় জাতিরূপে খাড়া করা। এই সকল দার্শনিক সাহিত্য আদৌ প্রগতিশীল নহে।
তৎপর উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে শ্রমশিল্পের বিবর্ত্তনের সঙ্গে একটা নূতন সমস্যা উদ্ভূত হইতে দেখা যায়—এই সমস্যাটি হইল শ্রমিক আন্দোলন। মুক্ত সার্ফদের পুত্রেরা সর্ব্বহারা শ্রমিকে পরিণত হইতে থাকে। সামন্ততান্ত্রিক সমাজ-পদ্ধতির উপর কারখানার মালিকদের শোষণনীতি (exploitation) চাপিল! এই সময়েই সাম্যবাদরূপ মতবাদটি অভিব্যক্ত হয়! League of the Just, Communist League প্রভৃতি সমুখিত হইয়া রাজনীতিক ক্ষেত্রে এক নূতন আবহাওয়া সৃষ্টি করে। এই আবহাওয়ার প্রকৃষ্ট সাহিত্যিক নজীর হইতেছে মার্ক্স (Marx) ও এঙ্গেল্সের (Engels) ‘সাম্যবাদীর ফতোয়া’ (Communist Manifesto)। মার্ক্স, এঙ্গেলস্, লাসাল, বেবেল ও অন্যান্য সোস্যালিষ্টদের লিখিত পুস্তকসমূহ তৎকালীন নূতন পরিস্থিতিপ্রসূত সমস্যার নিদর্শন; অন্যদিকে অধ্যাপক ডুরিং (Duehring), স্মলার, এড্লফ্, ভাগনার ও তাহাদের দলের সমাজতাত্ত্বিক ও অর্থনীতি-বিশারদ্গ্ণের পুস্তকসমূহ বিপক্ষদলের সাহিত্যের নজীর! ডুরিং-এর নিজেকে সোস্যালিষ্ট বলিয়া জাহির করা এবং এঙ্গেলসের “Herr Duehrings umwalzung” বা “Anti-Duehring” নামক পুস্তক উক্ত দ্বন্দ্বের পরিচয় প্রদান করে। এস্থলে ইহা উল্লেখযোগ্য যে সোশ্যালিষ্টদের সাহিত্যে প্রগতির আভাস প্রাপ্ত হওয়া যায়; কিন্তু অধ্যাপক স্মলার তাঁহার Historical School নামক দলের সাহিত্য দ্বারা এই মতটি জাহির করিতে থাকেন যে, একটা জাতির ইতিহাস পর্য্যবেক্ষণ করিলে দেখা যায় যে উহার কায্য-ক্ষমতা (Race capacity) সীমাবদ্ধ, ঐ সীমার বাহিরে সেই জাতি অভিব্যক্ত হইতে পারে না। এতদ্বারা তিনি একটী জাতির কর্ম্মক্ষমতার বিবর্ত্তনের ধারাকে সীমাবদ্ধ বলিয়া নির্দ্দিষ্ট করিতে চাহেন। উক্ত মতবাদটি আন্তর্জ্জাতিক ভাবাপন্ন সোশ্যালিষ্টদের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করিয়া তিনি দেশবাসীকে বুঝাইতে চাহিয়াছিলেন যে জার্ম্মানদের প্রাচীনকে আঁকড়াইয়া ধরিয়া থাকা ছাড়া গত্যন্তর নাই! অবশ্য সোস্যালিষ্টদের আন্দোলনকে প্রতিনিবৃত্ত করিবার জন্য তিনি কিছু সংস্কার চাহিয়াছিলেন; সেই জন্য তাঁহার দলকে উপহাস করিয়া পুঁজিবাদীরা Cathedra (chair) Socialists বলিত! এই জন্য “ঐতিহাসিক স্কুল” ও ‘আরাম কেদারার সাম্যবাদীদের’ সাহিত্যকে প্রতিক্রিয়াশীল বলিয়া অভিহিত করা যাইতে পারে।
ইতিমধ্যেই অন্যক্ষেত্রে যে সাহিত্য প্রকাশিত হইতে থাকে, তাহাতে নবোত্থিত মধ্যশ্রেণীয় ‘জনের’ কথঞ্চিৎ সন্ধান প্রাপ্ত হওয়া যায়। থিওডোর ষ্টোরমের ‘Immensee’ ও অন্যান্য নভেলগুলি মধ্যবিত্তশ্রেণীর নায়ক ও নায়িকা লইয়া লিখিত হইয়াছে; কিন্তু তাহা প্রাচীন আচার ও সংস্কার-বিমুক্ত নহে। পক্ষান্তরে ‘Germelhausen’ নামক নভেলে মধ্যযুগীয় ভূতুড়ে গল্পের অবতারণা করা হইয়াছে। ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যকাল পর্য্যন্ত জার্ম্মানীতে মধ্যযুগীয় যাদু ও ভূতুড়ে গল্পের বিশেষ প্রচলন ছিল। তাহারই অবতারণা করা হইয়াছে উপরোক্ত নভেলে। রুশ সাহিত্যের আদি ঔপন্যাসিক গোগল এই প্রকারে দক্ষিণ রুশ বা উক্রেনীয়ার ভূতুড়ে গল্প সমূহ রচনা করিয়াছেন। ইহার পর আসেন, আইসেনডর্ফ। ইনি বহু উপন্যাস লিখিয়াছেন। তাহাতে এক দিকে যেমন সাধারণ লোকের কিঞ্চিৎ সংবাদ পাওয়া যায় অন্যদিকে তেমন খেতাবধারী অভিজাত সমাজেরও কিঞ্চিতৎ চিত্র পাওয়া যায়। তাঁহার ‘Wanderung eines Taugenicht-এ’(নিষ্কর্ম্মা ভবঘুরের পরিভ্রমণ) এই চিত্র কিঞ্চিৎ প্রদান করিয়াছেন। তাঁহাদের সাহিত্যে জন ও গণের সম্বন্ধে বিশেষ সংবাদ পাওয়া যায় না। তখনও জার্ম্মানী প্রাচীন অভিজাত সমাজের দিকে মুখ চাহিয়া আছে এবং নূতন মধ্যবিত্তশ্রেণীর ধনীরা অভিজাতদের সমাজে মিলিতেছে; সেইজন্যই উভয় শ্রেণীর ছাপ এই সাহিত্যে স্পষ্ট প্রতিভাত হয়। এই কারণ বশতঃ একটা যথার্থ মধ্যবিত্তশ্রেণীর বা বুর্জ্জোয়া সাহিত্য বিবর্ত্তিত হয় নাই। ইহার পরে আসেন হফ্ম্যান ও স্বল্পখ্যাত বহু সাহিত্যিকদল। তখন জার্ম্মানী শ্রমশিল্প ও ব্যবসায়ে জগতের একটি উচ্চস্তরে অবস্থান করিতেছে। সেই সময়ের সাহিত্যিকেরা মধ্যবিত্তশ্রেণীর উকিল, ডাক্তার ও অধ্যাপকদের জীবনী অবলম্বনে উপন্যাস লিখিতেছেন। সেইজন্য নায়িকাগণ প্যারিসের পোষাক পরিধান করিতেছেন, কথায় বার্ত্তায় দুই চারিটি ফরাসী শব্দ ব্যবহার করিতেছেন, “5’O clock Tea” পান করিতেছেন,—কারণ, ইহাই ছিল বিগত মহাসমরের পূর্ব্বে বিত্তশালী শিক্ষিতদের মধ্যে চল্তি ফ্যাসান! এই সাহিত্যে জনের সম্বন্ধে সংবাদ কিছু কিছু পাওয়া যায় বলিয়া অপেক্ষাকৃত প্রগতিশীল বলা যাইতে পারে, কিন্তু ইহা তৎকালীন আমেরিকান বা ফরাসী বুর্জ্জোয়া সাহিত্যের ন্যায় নহে। এই সাহিত্য প্রাচীন সমাজের আদর্শের পানে চাহিয়া ছিল। ইহার দৃষ্টিভঙ্গী আদৌ বুর্জ্জোয়া-শ্রেণীর বিপ্লবী দৃষ্টিভঙ্গী নয়। জার্ম্মানীর “Police State” লোকের সকল প্রকার কর্ম্মের উপরই প্রথর দৃষ্টি রাখিত বলিয়া, লোকের মস্তিষ্কে “ঈশ্বর ও কাইসার” ব্যতীত অপর কোন আদর্শ প্রবেশ করিবার সুবিধা পাইত না।
ইতিমধ্যে শ্রমিকদল বিশেষ শক্তিশালী হইয়া উঠে। আদর্শ-ঘটিত এই পরিস্থিতির প্রতিপক্ষে সোস্যালিষ্ট দল Proletarian Culture (প্রলেটারীয় সংস্কৃতি) নামক এক আন্দোলন শুরু করেন। তাঁহারা শ্রমিকশ্রেণীর সাহিত্য, থিয়েটার, সংবাদপত্র প্রভৃতি সৃষ্টি করিতে আরম্ভ করেন। তাঁহারা ‘গণে’র কথা কহিতে লাগিলেন। কিন্তু তাঁহারা প্রথিতযশা কোন সাহিত্যিক সৃষ্টি করিতে পারেন নাই। যে-সব সাহিত্যিক জনসাধারণের সম্বন্ধে কিছু সংবাদ সাহিত্য দ্বারা প্রকাশ করিতেন তাঁহাদের অন্যতম ছিলেন—“জিমার ম্যান”। ইনি ১৯১৮ সালে জার্ম্মান বিপ্লবের পর ‘Die Revolution’ নভেলে বিপ্লব বিষয়ে গরীব সাধারণের মনস্তত্ত্ব বর্ণনা করিয়াছেন। তাঁহার পুস্তকসমূহে অপেক্ষাকৃত প্রগতিশীলতার পরিচয় পাওয়া যায়। বিপ্লবের পর সোস্যালিষ্ট ও কমিউনিস্ট দল হইতে গীতি কবিতা প্রভৃতি রচিত হইয়াছে; কিন্তু উহা রাজনীতিক দ্বন্দ্ব সাহিত্য হইলেও প্রগতিশীল। পক্ষান্তরে Remarque-এর ‘Nitcht neues im Westen’ (All Quiet in Western Front) পুস্তকে শুধু যুদ্ধের নৃশংসতাই বর্ণিত হইয়াছে—ইহাতে কোন আদর্শ নাই। ইহা একটা প্রোপাগ্যাণ্ডা (প্রচার) সাহিত্য মাত্র। এইজন্য ইহাকে স্বদেশপ্রেমিকেরা Defeatist mentality-র (পরাজিত মনোভাব) পরিচায়ক বলিয়া নিন্দা করেন।
জার্ম্মানীর রাজনীতিক পরিস্থিতির জন্য সমাজ এখনও প্রাচীন পদ্ধতির আওতায় আছে। সেইজন্য একটী যথার্থ বুর্জ্জোয়া সাহিত্য সেখানে গড়িয়া উঠিতে পারে নাই। কিন্তু জিমারম্যান ও অন্যান্যদের রচিত পুস্তক-সমূহে যে কিঞ্চিৎ প্রগতিশীলতার পরিচয় পাওয়া যায় তাহা বিপ্লবের পর সোস্যালিষ্ট ও মধ্যবিত্তশ্রেণী দ্বারা সংগঠিত গবর্ণমেণ্ট এবং মধ্যবিত্ত ও গরীব মধ্যবিত্তশ্রেণীদ্বয়ের হস্তে শাসনভার আসিয়াছিল বলিয়াই তাহা সম্ভবপর হইয়াছিল।
এবার ভারতের সাহিত্যের বিষয়ে কিছু অনুসন্ধান করিয়া দেখা যাউক। বৈদিকযুগের কৌমগুলির (tribes) রাজাদের চারণেরা ছন্দোবদ্ধ ভাষায় যে-সকল গীতস্তুতির কবিতা লিখিত সেগুলিই ‘বেদ’ নামে পরিচিত। বেদের প্রথমাবস্থায় দেখা যায় যে একদল চারণ-গায়ক সর্দ্দার বা রাজার স্তুতিগায়ক ছিল; তাহারাই ব্রাহ্মণ নামে অভিহিত হইত। শাসকদের “রাজন্” এবং তাহার স্বগোষ্টীকে “রাজন্য” বলা হইত। সাধারণ লোকসমূহ “বিশ্” নাম দ্বারা অভিহিত হইত। এই প্রকারে ঋগ্বেদের সময়ে সমাজে তিনটি শ্রেণীর সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। সমাজের যে অবস্থায় বেদ বিরচিত হয় তাহা বৈদিক অতএব কৌমগুলির যৌবনাবস্থা। তখন “রাজন” যুক্তরাষ্ট্র ও শ্রেণীবিভাগে বিভক্ত সমাজ বিবর্ত্তিত হইয়াছে । ঋগ্বেদের “দানস্তুতি” ও “দাশ রাজন্য” যুদ্ধে ব্রাহ্মণ চারণদের দ্বারা ক্ষত্রিয় রাজাদের গুণগ্রাম কীর্ত্তিত হইতে দেখা যায়। দাশ রাজার যুদ্ধে চারণ বশিষ্ঠকে ভারত রাজা সুদাসের গুণ কীর্ত্তন করিতে দেখা যায়। বেদের ঋক্গুলি ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যদের দ্বারা লিখিত হয়, ঐগুলিতে উক্ত তিন শ্রেণীর কথার উল্লেখ আছে। তখন জন ও গণের মধ্যে বিভাগ ছিল কিনা এক্ষণে তাহাই বিবেচ্য। ঋকে শূদ্রের উল্লেখ নাই; কিন্তু যজুর্ব্বেদে চারিবর্ণেরই উল্লেখ আছে। শূদ্র যদি ‘গণ’ হয় তাহা হইলে সেই গণের সংবাদ বেদে পাওয়া যাইবে কিনা সেই বিষয়ে সন্দেহের যথেষ্ট অবকাশ আছে। বেদে শূদ্র রাজা, শূদ্র মন্ত্রী ও ধনী শূদ্র প্রভৃতির উল্লেখ আছে। অতএব পরিষ্কার বোধগম্য হয় যে শূদ্র বলিলেই কেবল ‘গণ’কে বুঝাইত না। কিন্তু “ব্রহ্মজায়া” ও “ব্রহ্মগাভী” স্তোত্রসমূহে ভীষণ শ্রেণী-সংগ্রামের পরিচয় পাওয়া যায়। এই সকল স্তোত্রে যে-সব ক্ষত্রিয় ব্রাহ্মণের শয্যা হইতে তাহার স্ত্রীকে অপহরণ করিত এবং ব্রাহ্মণের গরু কাটিয়া খাইত তাহাদের উপর অভিসম্পাত আছে! এই যুগে পুরুরবা কর্ত্তৃক ব্রাহ্মণদের ধন অপহরণ, এক সহস্র ব্রাহ্মণ কর্তৃক নহুষের রথ টানাইবার উল্লেখ দেখা যায়। ক্ষত্রিয়ের সহিত দ্বন্দ্বে আঁটিয়া উঠিতে না পারিয়া ব্রাহ্মণদের বৈশ্য ও শূদ্রকে তাহাদের বিরুদ্ধে উস্কাইতে দেখা যায়। আর বৈদিক সাহিত্যে দেখা যায় যে, কখন বলা হইতেছে ব্রাহ্মণেরা বড় ও শ্রেষ্ঠ, আবার, কথন বলা হইতেছে ক্ষত্রিয়েরা শ্রেষ্ঠ। বৈদিকযুগের শেষের দিকে ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়ের মধ্যে ভীষণ শ্রেণীসংগ্রাম বাঁধিয়া উঠে। এই প্রকারে বেদে কেবল ধর্ম্মের মাহাত্ম্য কীর্ত্তিত হইতে না দেখিয়া শ্রেণী-মাহাত্ম্য কীর্ত্তিত হইতে দেখা যায়। অধ্যাপক ব্লুমফিল্ড যথার্থই বলিয়াছেন যে বেদ কেবল ধনী ক্ষত্রিয় ও ব্রাহ্মণদের ক্রিয়াকাণ্ডের সংবাদ সম্বলিত পুস্তক মাত্র। মহাকাব্যগুলিতে ক্ষত্রিয়প্রাধান্য স্বীকৃত হইয়াছে; পুরাণসমূহে ক্ষত্রিয় রাজগোষ্ঠিগুলির কীর্ত্তি-কাহিনী বর্ণনা করা হইয়াছে। পক্ষান্তরে নাটক ও কাব্যসমুহে সামন্ততান্ত্রিক সমাজের শাসকবর্গের পরিচয় পাওয়া যায়, আর পাওয়া যায় স্বামি-ধর্ম্মের মহিমা বর্ণনা। গীতায় এই স্বামিধর্ম্মের বিশেষ ব্যাখ্যা আছে। বৌদ্ধ ও জৈন পুস্তকসমূহে দেখা যায় যে একদিকে ক্ষত্রিয়বর্ণের প্রাধান্য স্বীকৃত হইয়াছে, অপরদিকে ব্যবসায়ী সঙ্ঘসমূহ (Trade Guilds) ও বিদেশীয় বাণিজ্যের বিষয় উল্লেখ আছে। ভারতের প্রাচীন সাহিত্যেও এই শ্রেণীভেদ দেখিতে পাওয়া যায়। পার্জিটারের মত এই যে প্রাচীনকালে ভারতবর্ষে দুই প্রকারের ব্রাহ্মণদল ছিল। একদল ক্ষত্রিয় রাজাদের গুণকীর্ত্তন করিত; তাহারা পুরাণসমূহ লিখিয়াছিল। ইহারা নিজেদের ক্ষত্রিয় মনিবের কীর্ত্তিকাহিনী গাথায় লিপিবদ্ধ করিত! আর একদল স্বীয় শ্রেণীর উৎকর্ষ ও শ্রেষ্ঠত্বের বড়াই করিযা নিজের সম্বন্ধে অতিরঞ্জিত করিয়া লিখিত। ইহারাই বেদ রচনা করিয়াছিল এবং সংস্কৃত সাহিত্যে ব্রাহ্মণপ্রাধান্যের বিষয়ে লিখিয়া যায় । এইমত সর্ব্ববাদীসম্মত না হইলেও ইহা অবশ্য সত্য যে সংস্কৃত সাহিত্য শ্রেণীগত সাহিত্য। ইহা রাজা ও সামন্তবর্গের স্তব-স্তুতিতে পরিপূর্ণ। এই সাহিত্য উপরের স্তরের লোকদের মাহাত্ম্য–বর্ণনায় ভরপুর। হিন্দুর প্রাচীন দর্শন, সাহিত্য ও চারু শিল্প উচ্চ স্তরের স্বার্থেই নিয়োজিত হইয়াছে; জন ও গণের মনস্তত্ত্বের পরিচয় তাহাতে আদৌ পাওয়া যায় না। এই জন্যই স্বামী বিবেকানন্দ বলিয়াছেন—তুমি তোমার দর্শনশাস্ত্র বিষয়ে অহঙ্কার কর, কিন্তু তাহা শ্রেণীগত দর্শনশাস্ত্র! প্রাচীন ভারতে হিব্রু পয়গম্বরদের ন্যায় গরীবের উপর উচ্চ স্তরের লোকের অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে কেহই দণ্ডায়মান হয় নাই, এবং কেহই তাহাদের নিন্দা তিরস্কার করে নাই। প্রাচীনকাল হইতে আজ পর্য্যন্ত সকল ধর্ম্ম-প্রবর্ত্তক বা ধর্ম্ম-ব্যবসায়ীরা এবং সামাজিক নেতারা রাজা অথবা ধনীর স্তুতিগায়ক সাজিয়াছেন। এইজন্য ভারতের সাহিত্যে বোমর্খেস, চেনিয়ে, ভিক্টর হুগো, আনাটোল ফ্রান্স ও গর্কির ন্যায় লেখকের এখনও উদয় হয় নাই। ভারতীয় সমাজ হিন্দু রাজত্বকালে সামন্ততান্ত্রিক যুগে অবস্থিত ছিল—এমন কি আজও অবধি ইহা অধিকাংশ স্থলে তদবস্থায়ই অবস্থিত। মুসলমান যুগের অবস্থাও ‘তথৈব চ’ ছিল। ভারতের অর্থনীতি পূর্ব্বে সামন্ততান্ত্রিক যুগে অবস্থিত ছিল এবং আজও অধিকাংশ স্থানেই পূর্ব্বাবস্থায়ই রহিয়াছে। এইজন্যই আমাদের আদর্শ এখনও আধুনিক যুগোপযোগী আদর্শানুযায়ী বিবর্ত্তিত হয় নাই।
খাস বাংলা সাহিত্যেও অনুসন্ধানের ফলে দেখা যায় যে প্রাচীন বাঙ্গলা সাহিত্যের যেটুকু নষ্ট-কোষ্ঠীর পুনরুদ্ধার হইয়াছে তাহাতে বৌদ্ধ সম্প্রদায় বিশেষের ধর্ম্মবিষয়ই বর্ণিত আছে। “সরোরুহপদে” পাওয়া যায় ‘গুরুবাদ’ এবং তাহার অন্বয় বজ্রটীকার শেষ কথায় পাওয়া যায় “শুভমস্ত্ত সর্ব্বজগতম্”। বৌদ্ধধর্ম্ম আন্তর্জ্জাতিক আদর্শ-ভাবাপন্ন। এইজন্যই লেখক জগদ্বাসী সকলেরই মঙ্গল কামনা করিতেছেন। কিন্তু নাথ-ধর্ম্মের মধ্যে অনুসন্ধান করিলে ‘গণে’র সম্বন্ধে কথঞ্চিৎ সন্ধান মিলে। হাড়ীপ্পা প্রভৃতি হাড়ী জাতীয় লোক গুরু হইয়া রাণীকে শিষ্যা করিতেছেন এবং মীননাথ, মচ্ছেন্দ্রনাথ ধীবর-বংশীয় হইয়া নাথ-ধর্ম্ম প্রতিষ্ঠা করিতেছেন। এই সমস্ত বিষয়ে দেখা যায় যে বৌদ্ধযুগে বাঙ্গলার আজকালকার পতিত জাতিসমূহের পূর্ব্ব পুরুষগণ তৎকালীন বাঙ্গালী সমাজে হেয়-স্থানীয় ছিলেন না; বরং বৌদ্ধ সমাজে ইহাদের অনেকেই “কেষ্ট-বিষ্টু” ছিলেন। কিন্তু ব্রাহ্মণ্যধর্ম্মের উত্থানের সহিত বাঙ্গলায় একটা ঘোর শ্রেণী-বিরোধ বাঁধিয়া উঠে। অবশ্য প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় প্রথা অনুযায়ী এই শ্রেণীসংগ্রাম (Class Struggle) ধর্ম্ম–সংগ্রামের রূপ ও আকার ধারণ করে। দশম শতাব্দীর এই দ্বন্দ্ব ছড়া ও পাঁচালীর মধ্যে আবদ্ধ থাকিয়া তাহার স্মৃতি জাগাইয়া রাখিয়াছে:
“আগডোম বাগডোম ঘোড়াডোম সাজে,
ডাল গাগর মৃগল বাজে,
বাজতে বাজতে পড়ল সাড়া,
সাড়া গেল বামুন পাড়া”...
এই ছড়ার অর্থ স্বর্গীয় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয় ধরাইয়া দিবার পূর্বে কয়জন তাহা বুঝিয়াছিলেন? রামাই পণ্ডিতের ধর্ম্মমঙ্গলে “নিরঞ্জনের রুক্ষ্মা” কাব্যে বাঙ্গলার ব্রাহ্মণ ও বৌদ্ধের দ্বন্দ্ব এবং তাহার পরিণতিতে যে “ধর্ম্ম হৈল যবনরূপী, মাখা এতে কাল টুপী” দিয়া যাযপুর প্রবেশ করিয়া, “দেউলদেহড়া ভাঙ্গে” তাহার সংবাদ পাই। এই দ্বন্দ্ব হইতে এইটুকু অনুমান করিতে পারি যে বাঙ্গলা কি প্রকারে এতটা অল্পায়াসে মুসলমানদের কুক্ষিগত হইয়াছিল।
ইহার কয়েক শতাব্দী পর যখন বাঙ্গলার রাষ্ট্রীয় ভাগ্যবিপর্যয় ঘটে তখন আর সদ্ধর্ম্মী বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণের বিরধের সংবাদ পাওয়া যায় না; পরন্তু হিন্দু ও মুসলমানের দ্বন্দ্বের সংবাদ প্রাপ্ত হওয়া যায়।চন্ডীদাস হইতে সমস্ত বৈষ্ণব কবিদের হা-হুতাশের মধ্যে বাঙ্গালীর অবিদিত মন (Sub-conscious mind) হইতে পরাধীনতা জনিত ক্রন্দনই শ্রীমতীর বিরহ ও ক্রন্দনের রূপে ফুটিয়া উঠিতে দেখা যায়। এই সময়ের আর একজন বড় কবি মুকুন্দরাম তৎকালীন সমাজের আলেখ্য আমাদিগকে দিয়া গিয়াছেন। কবিকঙ্কণ জনশ্রেণীর লোক; তিনি তাঁহার গ্রামের মুসলমান কর্ম্মচারীর অত্যাচারে জর্জরিত হইয়া গ্রাম ত্যাগ করেন। এইজন্য জন ও গণের প্রতি তাঁহার এটা দরদ! তিনি রূপকের সাহায্যে তৎকালীন জমিদার ও রাজকর্ম্মচারীদের অত্যাচারচিত্রটি বর্ণনা করিয়াছেন। চণ্ডীর সমস্ত পশু সমবেত হইয়া অভিযোগ করে: “চৌধুরী নেউগী নহি না রাখি তালুক”—তবু কেন তাহাদের অত্যাচার হয় ইত্যাদি! গণের সম্বন্ধে বর্ণনা প্রসঙ্গে ব্যাধ কালকেতুর স্ত্রীর দুর্দ্দশা বর্ণনা করিয়া কবি বলিতেছেন যে বারমাসই “অভাগী ফুল্লরা করে উদরের চিন্তা।” জাতির মধ্যে পূর্ব্বকালের সঙ্ঘ-পদ্ধতি অনুযায়ী সাম্যের পরিবর্ত্তে ধনের শ্রেষ্ঠত্ব যে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে তাহা ধনপতি সদাগর তাঁহার পিতৃশ্রাদ্ধ উপলক্ষে দেখাইয়াছেনঃ
“ধনে শীলে কুলে মানে চাঁদ নহে বাঁকা,
বাহির দুয়ারে যার সাত ঘড়া টাকা।”
মুকুন্দরাম Subjective-ভাবে তখনকার সামাজিক চিত্র অঙ্কিত করিলেও পারিপার্শ্বিক অবস্থার উর্দ্ধে উঠিতে পারেন নাই। এই কারণে তিনি কালকেতুকে গুজরাটে রাজারূপে অধিষ্ঠিত করান; এবং গুজরাট সহরকে তৎকালীন ফ্যাসানে হিন্দু মুসলমান নানা জাতির লোকের আবাসস্থল রূপে চিত্রিত করেন। এইজন্য মুকুন্দরামকে জনের অথবা গণের প্রতীক বলা চলিতে পারে না। অতঃপর আসেন বাঙ্গলার বড় কবি “অন্নদা–মঙ্গল”-রচয়িতা ভারতচন্দ্র রায় গুণাকর। তাঁহার রচনার মধ্যে কেবলমাত্র সামন্ততান্ত্রিক রাজারাজড়ার সংবাদই পাওয়া যায়। তিনি রাজোপাধিধারী এক জমিদারের সন্তান এবং একজন সামন্ত রাজার আশ্রয়ে জীবন অতিবাহিত করেন। তিনি রাজাদের অন্দর মহলের কথা, যুদ্ধ-বিগ্রহের বর্ণনায় স্বীয় কবি-প্রতিভা নিয়োজিত করিয়াছিলেন। মুসলমানের অধীন সামন্ত রাজাদের আশ্রয়ে থাকিয়া এবং ঐ পারিপার্শ্বিক অবস্থার মধ্যে প্রতিপালিত ও বর্দ্ধিত হইয়া তাঁহার তৎকালীন হিন্দুজনোচিত পরাভব-মনোবৃত্তি (defeatist mentality) প্রতাপাদিত্যের যুদ্ধ-বর্ণনায় ফুটিয়া উঠিয়াছে। এই বর্ণনার মধ্যে তৎকালীন বাঙ্গলার হিন্দুসমাজের মনস্তত্ত্ব বেশ পরিস্ফুট। এই সংক্ষিপ্ত যুদ্ধবর্ণনা হইতে সেই সময়ের বাঙ্গলার হিন্দুর ইতিহাস ও মনোভাব অনেক কিছুই অনুমান করা যাইতে পারে। কবি প্রথমেই বলিতেছেন—
“বুঝিয়া অহিত গুরু পুরোহিত
মিলে মানসিংহ সনে।”
পরেই আবার কবি বলিতেছেন—
“পাতশাহী ঠাটে কেব কেবা আঁটে।...
বিমুখী অভয়া কে করিবে দয়া
প্রতাপাদিত্য হারে”॥
ইহা মুসলমানদের দ্বারা দুইবার বিজিত হিন্দুর পরাভব-মনোবৃত্তির পরিচয় প্রদান করে। দিল্লীর সম্রাট্ অজেয়, তাঁহার পল্টন সমূহ কখন পরাজিত হয় না; আর ভগবানের কৃপা না হইলে কে কখন বড় হইতে পারে—এই যুক্তি গোলাম জাতিরই মুখ হইতে বাহির হয়। ছোটবেলায় বিশিষ্ট লোকদের মুখে শুনিতাম: ভারতের স্বাধীনতা—যদি ভগবানের অভিপ্রেত হয় তবে তাহা হইবে। এরূপ উক্তি গোলাম জাতেরই উক্তি। আজকালকার ঐতিহাসিকেরা বলেন যে মানসিংহ সামন্ততান্ত্রিক বাঙ্গলাকে ভাঙ্গিয়া কেন্দ্রীভূত মোগল-শাসন প্রবর্তন করেন। এতদ্বারা একদিকে যেমন তিনি বাঙ্গালী জাতির শৌর্য্য-বীর্য্য ঠাণ্ডা করিয়া দেন তদ্রূপ অন্যদিকে একটা ভীষণ শ্রেণী-সংগ্রাম (হিন্দুর‘শ্রেণী’ জাতি রূপে রূপান্তরিত হওয়ায় শ্রেণী-সংগ্রামকে জাতি-সংগ্রামরূপে দেখিতে ও বুঝিতে হইবে) বাধাইয়া তাহার ফলস্বরূপ বাঙ্গলাকে মোগল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেন। স্বর্গীয় শ্রীযুক্ত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ও রজনীকান্ত চক্রবর্ত্তী মহোদয়গণ বলিয়াছেন যে বাঙ্গলার কায়স্থ ও বারেন্দ্র ব্রাহ্মণদের শক্তি বিনষ্ট করিয়া মোগলেরা বাঙ্গলা বিজয় করিতে সক্ষম হইয়াছে। ইহারা বলেন যে বাঙ্গলার কায়স্থ ও বারেন্দ্র ব্রাহ্মণেরা গৌড়ের তথাকথিত পাঠান সুলতানদের স্বার্থের সহিত ওতঃপ্রোতভাবে মিশিয়া গিয়াছিল। ইহার ফলে মোগলদের পক্ষে বাঙ্গলা বিজয় অনায়াস-সাধ্য হয় নাই। মুনিম খাঁ ও টোডরমোল দাউদ খাকে পরাজিত করিলেও বাঙ্গলার সামন্ত রাজাদের জয় করা সহজ হয় নাই। আইন-ই-আকবরীর মতে তখনকার জমিদারেরা সকলেই কায়স্থ। কিন্তু মানসিংহ আসিয়া ভেদবুদ্ধি প্রবর্তন করিয়া বাঙ্গলার সর্বত্র পশ্চিমের হিন্দুদের জমিদারী প্রদান করিয়া বাস করান; আর পশ্চিমবঙ্গে রাঢ়ী ব্রাহ্মণদের জমি প্রভৃতি দিয়া হাত করেন। আজ পূর্ব্ব ও পশ্চিমবঙ্গে হাজার হাজার লোক ক্ষত্রিয় বলিয়া পরিচয় প্রদান করেন, এবং মানসিংহ কর্তৃক স্থাপিত ঔপনিবেশিকদের বংশধর বলিয়া পরিচয় দেন। ইহা হইতে মানসিংহের রাজনীতিক চাল বোঝা যায়। এইজন্যই কবি বলিয়াছেন,—
“বুঝিয়া অহিত গুরু পুরোহিত
মিলে মানসিংহ সনে।”
কথাটা এই যে কায়স্থ প্রাধান্যে ব্রাহ্মণেরা সন্তুষ্ট ছিল না। সেই জন্য ব্রাহ্মণেরা বিদেশীর সঙ্গে সম্মিলিত হয় আর মানসিংহকে ক্ষত্রিয় রাজা বলিয়া পূজা করে। এই সুযোগের ফলে বাঙ্গলার কায়স্থদের পতন হয় এবং উত্তর বঙ্গের বারেন্দ্র ব্রাহ্মণদের বড় বড় জমিদারী মোগলেরা বাজেয়াপ্ত করিয়া নেয়। মুঘল যুগ হইতে বাঙ্গলার জমিদারের মধ্যে অধিকাংশ লোকই ব্রাহ্মণ। বাঙ্গলার কায়স্থ ও ব্রাহ্মণদের শ্রেণী-বিরোধের পরিণামের ইহাই হইতেছে প্রকৃষ্ট প্রমাণ। কবি পঁচাত্তর মানসিংহের অনুগ্রহভোজী রাঢ়ী ব্রাহ্মণ রাজা (এই ব্রাহ্মণ রাজার উত্তর-পুরুষই প্রতাপাদিত্যের শত্রুতা করিয়াছিলেন) কর্ত্তৃক প্রতিপালিত, কাজেই দুই এক কথায় তখনকার ইতিহাসের তথ্যগুলি বর্ণনা করিয়াছেন। ভারতচন্দ্রের সময়েই পলাশীর প্রাঙ্গণে বাঙ্গলার ভাগ্য-বিপর্য্যয় ঘটে। এই যুদ্ধে বাঙ্গলার কয়েকজন মাতব্বর হিন্দু যে লীলাভিনয় করিয়াছিলেন হালের স্বদেশপ্রেমিক লেখকরা উহার নিন্দা করিয়া থাকেন। কিন্তু সেই সময় আর এমন কোন বড় সাহিত্যিকের আবির্ভাব হয় নাই যাঁহার লেখা হইতে তৎকালের লোকের মনোভাব বুঝিতে পারা যায়। কিন্তু সেই সময় বহু গ্রাম্য কবিতা রচিত হুইয়াছিল, ঐ-গুলিতে পলাশীর যুদ্ধের বর্ণনা আছে এবং অনেক কবিতা রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের অতিবুদ্ধিরও নিন্দা করিয়াছে। বাঙ্গলার ভাগ্যে যে পরিবর্ত্তন ঘটে তাহা কয়েকজন সামন্ত্রতান্ত্রিক লোকের স্বার্থের জন্যই সংঘটিত হয়। বোধ হয় জনসাধারণ তদ্বারা সুখী হইতে পারে নাই, কারণ ইহার পর নানা প্রকারের প্রজা-বিদ্রোহ, জমিদার-বিদ্রোহ, দুর্ভিক্ষ প্রভৃতি সংঘটিত হইয়া ভীষণ অরাজকতার সৃষ্টি হয়। এই সময়ের প্রকৃত ইতিহাস আজও লিখিত হয় নাই বলিয়া উহার গুরুত্ব সম্যক উপলব্ধি করা সম্ভবপর হইতেছে না। একমাত্র বঙ্কিমচন্দ্র এই সময়ের ঘটনা অবলম্বনে “আনন্দ মঠ” ও “দেবী চৌধুরাণী” প্রভৃতি কয়েকটি উপন্যাস লিখিয়াছেন। পলাশীর যুদ্ধের পর হইতে পঞ্চাশ বৎসর বাঙ্গলায় এই অরাজকতা বিরাজ করে। এই সময়েই ১৮১৮ সালের বিনাবিচারে আটক রাখিবার Ordinance (Regulation III Act of 1818) আইন ইষ্টইণ্ডিয়া কোম্পানী কর্ত্তৃক রচিত ও বিধিবদ্ধ হয়। উক্ত আইন কাহাদের উপর প্রয়োগ করা হইত তা কি ভাবিবার কথা নয়? নিশ্চয়ই এই অরাজকতা নিবারণের জন্য ইহা (উক্ত আইন) প্রয়োগ করা হইত? কেহ কেহ অনুমান করেন যে তখনকার দিনে যে সকল বিদ্রোহী জমিদার খাজনা ও কর প্রদান করিত না এবং অরাজকতা সৃষ্টি করিত তাহাদেরই বিরুদ্ধে ইহা প্রয়োগ করা হইত।