সাহিত্যে প্রগতি/সাহিত্যে সমাজ-চিত্র (৩)

সাহিত্যে সমাজ-চিত্র

(৩)

উনবিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগে নবীন ভারতের প্রথম উন্মেষ বাঙ্গলায়ই দৃষ্ট হয়। উনবিংশ শতাব্দীর পাশ্চাত্য সভ্যতার ঢেউ আসিয়া প্রথম লাগে বাঙ্গলায়ই; ইহার প্রথম ধাক্কাটা রাজা রামমোহন রায় ও তাঁহার শিষ্যবর্গের আন্দোলনের মধ্যে প্রত্যক্ষভাবেই অনুভব করা যায়। ইউরোপে তখন ফরাসী বিপ্লবের ফল-প্রসূত সভ্যতার মধ্যে মধ্যযুগীয় কোন ভাব ও লক্ষণ দেখিতে পাওয়া যায় না, পাওয়া যায় কেবল খাঁটি নিছক বুর্জ্জোয়া সংস্কার! কিন্তু যে সংস্কারের ঢেউ বাঙ্গলায় আসে তাহা প্রকৃত ফরাসী-বর্জ্জোয়া সংস্কার নয়, বরং ইংরেজ-বুর্জ্জোয়া সংস্কার—ক্রমওয়েলের Puritan ও তাহাদের সন্ততি একেশ্বরবাদীদের (Unitarin) সংস্করণ এবং তৎপরে, উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগের মধ্য-ভিক্টোরীয় যুগের (Mid-Victorian Age) সংস্কার; ইহাকে “মাঞ্চেষ্টার স্কুলের ভাবধারা” বলিয়া অভিহিত করা হয়। এই সময়ের শিক্ষিত বাঙ্গালী ইংরেজী-নবিশীতে বিশেষ পারদর্শী হইয়া উঠিয়াছিল। কেবল ইংরেজী শিখিয়া তাহার “intellectual isolation” বেশ পাকা রকমেরই হইয়াছিল। সেই সময় হইতে ইংলণ্ডই ভারতের পক্ষে স্বর্গরাজ্য বলিয়া গৃহীত হ‍ইয়াছে। সুতরাং অপরাপর দেশের খবর শিক্ষিত ভারতবাসী রাখিতে বড় একটা চায় নাই! ভারতবর্ষের শিক্ষাক্ষেত্রের গণ্ডীবদ্ধতা কতখানি পাকাপোক্ত হইয়া গিয়াছিল তাহা নিম্ন ঘটনা দ্বারাই বেশ পরিষ্কার বুঝা যায়। এই সময় হইতে বিগত পৃথিবীব্যাপী মহাসমরের পূর্ব্ব পর্যন্ত লণ্ডনে ইউরোপের বড় বড় মনীষী এবং চিন্তা ও ভাবরাজ্যের বিপ্লবীগণের সমাগম হইত এবং তাহাদের মধ্যে অনেকেই আবার তথায় বহুদিন ধরিয়া অবস্থান করিতেছিলেন। ভারতীয়দের মধ্যে অনেকেই কব্‌ডেন, জন ব্রাইট্‌, জন ষ্টুয়ার্ট মিল, গ্ল্যাড্‌স্টোন, হাব্বাট স্পেন্সার, মার্টিনো প্রভৃতির সাক্ষাৎ লাভ করিয়াছেন এবং স্বদেশে প্রত্যাবর্ত্তন করিয়া তাঁহাদের ভাবধারা প্রচার করিতে থাকেন। সে সময়ে কার্ল মার্কস্, ম্যাট্‌সিনি লণ্ডনে বাস করিতেন। তাহাদের সঙ্গে কোন ভারতবাসীর সাক্ষাৎকারের সংবাদ কখনও শোনা যায় না। রুশ নেতা ক্রপট্‌কিন্ লণ্ডনে বহুকাল পর্য্যন্ত বাস করিয়াছিলেন। তাঁহার সঙ্গে ভারতীয়দের (একমাত্র স্বামী বিবেকানন্দ ব্যতীত) সাক্ষাৎকার সম্বন্ধে কোনও বিবরণ পাওয়া যায় নাই। তখন ভারতীয় বুর্জ্জোয়াশ্রেণী ইংলণ্ডের বুর্জ্জোয়াশ্রেণীর অনুগ্রহপ্রার্থী ছিল। সেই কারণে মানবের মুক্তিকামী অন্যান্য ভাবধারার সহিত পরিচিত হইবার ইচ্ছা প্রকাশ করে নাই। যখন ব্রাহ্মসমাজ প্রবলভাবে আন্দোলন চালায় তখন তাহার প্রতিক্রিয়াস্বরূপ ভূদেবচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রভৃতির সাহিত্যিক প্রচেষ্টা প্রকট হয়। ইহাদের লেখার মধ্যে অতীতকে শ্রদ্ধা করিবার ভাব অধিক প্রবল। অতীতের সমুদয় সভ্যদেশই সামন্ততান্ত্রিক সভ্যতার সহিত সংশ্লিষ্ট। এইজন্যই বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসের ও ব্রাহ্মসমাজের লেখকদের উপন্যাসের প্রতিপাদ্য বিভিন্ন।

বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসে জন বা গণের সম্বন্ধে কোন সংবাদই পাওয়া যায় না। মধ্যবিত্ত এবং শ্রমজীবী কৃষক ও শ্রমিকদের জীবন অবলম্বনে তাঁহার সাহিত্য সৃষ্টি হয় নাই। ধনী জমিদার বাড়ীর ঘটনাবলী অবলম্বন করিয়াই তাঁহার বিখ্যাত উপন্যাসগুলি রচিত হইয়াছে। বঙ্কিমচন্দ্রের যুগে যে-সাহিত্য বাঙ্গলায় সৃষ্টি হইয়াছে তাহা সামন্ততান্ত্রিক সমাজের প্রভাবমুক্ত হইতে পারে নাই; এমন কি বর্ত্তমান সাহিত্যও সেই নিগড় সম্পূর্ণরূপে ভাঙ্গিতে পারে নাই। ইহার কারণ বাঙ্গলার নবোত্থিত মধ্যবিত্তশ্রেণী সামন্ততান্ত্রিক সভ্যতার আওতায় বর্দ্ধিত ও পরিপুষ্ট। এখনও সমাজে আদর্শ হইতেছে মধ্যযুগীয় জমিদার। বাঙ্গলার সমাজে এখনও ব্যবসায়ীদের প্রাধান্য ও সম্মান গৃহীত হয় নাই। এইজন্যই পরাশর ও মোগল-পাঠানের সনদপ্রাপ্ত জমিদার এখনও সমাজের শীর্ষদেশে অবস্থিত। বাঙ্গলার অর্থনীতিকক্ষেত্রে Industrialisation এখনও বহুদূরে। সকলেই জমি আঁকড়াইয়া ধরিয়া পড়িয়া আছেন; অধিকন্তু রাজ্যব্যবস্থাও তাহার অনুকূলে। কাজেই যথার্থ বুর্জ্জোয়া সমাজ বাঙ্গলায় বিবর্ত্তিত ও সংগঠিত হইতে পারিতেছে না বলিয়াই পূর্ণ বুর্জ্জোয়া আদর্শ এখনও সাহিত্যে ফুটিয়া উঠিতে পারিতেছে না। এক্ষণে বিচার্য্য, ‘জন’ ও ‘গণ’ বলিলে কি বুঝা যায়? ‘গণ’ অর্থে যদি masses বা working class (শ্রমজীবী শ্রেণী) বুঝা হয় তাহা হইলে তাহাদের সমাজের প্রলেটারিয়েট বা শ্রমিকশ্রেণী বুঝাইবে; আর ইহার বাহিরের জনসাধারণ অর্থাৎ Peopleকে যদি ‘জন’ ধরা হয় তাহা হইলে অভিজাত ও শ্রমিকদের বাহিরে সকল প্রকার শ্রেণীদেরই ‘জন’ অর্থে বুঝাইবে। এখানে অভিধান বা ইতিহাস ধরিয়া শব্দের অর্থ নির্দ্দিষ্ট করা হইতেছে না। প্রাচীন গ্রীস ও রোমে Aristocrat ও Patricianশ্রেণী ছিল Populue অর্থাৎ People. ইহাদিগেরই নাগরিক অধিকার ছিল এবং তাহারাই ছিল জনসাধারণ। প্রাচীন ভারতে ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য ছিল আর্য্য, তাহারাই রাষ্ট্রের সমস্ত সুখভোগের অধিকারী ছিল। পরে শূদ্র রাজত্বের সময় চন্দ্রগুপ্তের মন্ত্রী কৌটিল্য শূদ্রকে ‘আর্য্য’ বলিয়া স্বীকার করিয়া নেন। তিনি আবার গোলামের পুত্রকেও ‘আর্য্য’ বলিয়া স্বীকার করিয়াছেন এবং গোলাম তাহার গোলামিত্ব হইতে বিমুক্ত হইলে তাহার আর্য্যত্ব ফিরিয়া পাইবার অনুশাসন দিয়াছেন। শূদ্র হইলেই সে দাস বা গণশ্রেণীর লোক হইত না। এখানে এই সকল ঐতিহাসিক তথ্য দেওয়ার কারণ এই যে, শব্দের মূল ধরিয়া উহার ব্যবহারিক অর্থ সকল সময় ঠিক থাকে না। চলতি ভাষায় যদি ধরিয়া লওয়া যায় “জন” অর্থে অভিজাত ও শ্রমজীবী এই দুই শ্রেণীর বাহিরের লোক সমূহ, তাহা হইলে তাহাদের উপরের স্তরের ও নিম্নস্তরের মধ্যবর্ত্তী মধ্যবিত্তশ্রেণী বলিয়া ধরিয়া লইতে হইবে; তদ্রূপ ‘গণে’র প্রাচীন সংস্কৃত অর্থ গ্রহণ না করিয়া ‘গণ’ অর্থে masses বা proletariat ধরিতে হইবে। এই প্রবন্ধে উক্ত অর্থেই শব্দ দুইটি ব্যবহৃত হইতেছে।

জনসাধারণ অর্থাৎ ‘জন’ মধ্য হইতে আজিকার ভারতে শিক্ষিত স্ত্রী ও পুরুষের উদ্ভব হইতেছে। প্রকৃত ভারতের Demos এখনও শিক্ষিত সম্প্রদায়। তাহারা অধিকাংশই মধ্যবিত্তশ্রেণী হইতে উদ্ভুত এবং এইশ্রেণীই রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠাস্থাপন প্রয়াসী; বর্ত্তমান ভারতের শিক্ষা-দীক্ষা, আশা-ভরসা এবং কর্ম্মপ্রচেষ্টা এখনও তাহাদিগকে লইয়াই। এই মধ্যবিত্তশ্রেণীর আদর্শ দ্বারাই ভারত এখনও পরিচালিত হইতেছে; কাজেই কর্ম্মক্ষেত্রে ‘জনে’র প্রাধান্য এখনও প্রবল। এই মধ্যবিত্তশ্রেণীকেই ফরাসী ভাষায় “বর্জ্জোয়া” (bourgeois) বলা হয়। ইউরোপের মধ্যযুগে দাসত্ব-মুক্ত গোলামের পুত্রগণ একজন ব্যারণের (baron) আশ্রয়ে থাকিয়া অথবা তাহার সহরে আসিয়া বাস করিলে তাহাকে ‘বুর্জ্জোয়া’, অর্থাৎ বুর্গের (কেল্লার) লোক বলিয়া অভিহিত করা হইত। ক্রমে ইহার অর্থ দাঁড়ায় সহরের লোক—যে অভিজাতও নহে এবং সার্ফ-দাস অথবা গোলাম নহে। এইজন্য রাষ্ট্রে তাহার স্থান ছিল না। ক্রমে শিক্ষালাভ এবং অর্থোপার্জ্জন করিয়া সহরের এই শ্রেণীর লোকেরা তৃতীয় শ্রেণীরূপে (Third Estate) বিবর্ত্তিত হয়। ইংলণ্ডে ও ফ্রান্সে রক্তাক্ত বিপ্লব দ্বারা তাহারা রাষ্ট্রযন্ত্র করায়ত্ত করিয়া ‘জাতিতে’ উঠে। এক্ষণে ইউরোপে যাহারা প্রলেটারিয়েট নয় তাহারা ‘বুর্জ্জোয়া’ বলিয়া অভিহিত হয়। এই অর্থের একটি বিশেষ কারণ এই যে, অভিজাতশ্রেণী ও ধনী বুর্জ্জোয়া শ্রেণীর লোকেরা ক্রমশঃ মিশিয়া গিয়া শ্রমিকের প্রতিপক্ষ ‘ধনী শ্রেণী’ বিবর্ত্তন করিতেছে।

কিন্তু ভারতে বিপ্লবী ব্যবসায়ী বুর্জ্জোয়াশ্রেণী এখনও সম্পূর্ণরূপে উদ্ভূত হইতেছে না। বিশেষতঃ বাঙ্গলায় ইংলণ্ডের Squirearchyর ন্যায় একটী জমিদার শ্রেণীর সৃষ্টি হওয়ার Land Capitalism এখনও বিশেষভাবে প্রবল। এইজন্য Industrial Capitalism বাঙ্গলায় ভালভাবে ক্রমবিকশিত হইতেছে না। এখানে মধ্যযুগীয়, সামন্ততান্ত্রিক বারভূঁইয়া দল আর নাই। মোগলপাঠানের সনদধারী অভিজাতের সংখ্যা কম; বরং ইংরাজের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাহাত্ম্যে জমিদার দল সৃষ্ট হইয়াছে এবং সমাজ এখনও তাহাদের আওতায় আছে। বাঙ্গলার গরীব মধ্যবিত্ত শ্রেণী তাহাদের মুখাপেক্ষী। এইজন্য এখনও বাঙ্গলায় বিপ্লবী বুর্জ্জোয়ার আবির্ভাব হয় নাই। এক্ষণে কথা উঠে, বুর্জ্জোয়ার কার্য্য কি? ইতিহাসে দেখা যায় যে সমাজের ক্রমবিকাশের পর্য্যায় কৌমাবস্থার (tribal stage) পর একরাটত্ব (kingship), তৎপর যথেচ্ছাচারী একরাটের অধীনে সামন্ততন্ত্র বিবর্ত্তিত হইতেছে। এই অভিজাত সামন্ততন্ত্রকে ধ্বংস করিয়া ব্যবসায়ী মধ্যবিত্তশ্রেণী শুধু রাষ্ট্র দখল করে না, পূর্ব্বের সমাজের রূপও পরিবর্ত্তন করিয়া দেয়। পূর্ব্বে ফরাসী দেশে এই বুর্জ্জোয়াবিপ্লব সম্পূর্ণরূপে সংঘটিত হইয়াছে, আর অধুনা হইয়াছে কামালের তুর্কীতে। ইংলণ্ডে ক্রমওয়েলের অধীনে বুর্জ্জোয়াশ্রেণী বিপ্লব করিয়া জাতে উঠিলেও অভিজাত রাজতন্ত্র পুনঃ প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় বুর্জ্জোয়াশ্রেণী দ্বারা সমাজের পরিবর্ত্তন ক্রমশঃ সংসাধিত হইয়াছে। ইহার ফলে ইংলণ্ড আর প্ল্যাণ্টাজেনেট বংশের (Plantagenet Dynasty) অধীন হয় নাই।

বুর্জ্জোয়া বিপ্লবের সঙ্গে একটা নূতন কথা রাজনীতিক্ষেত্রে সৃষ্ট হইয়াছে: Functions of a bourgeois–democratic revolution (বুর্জ্জোয়াসাম্যবাদী করণীয় পরিবর্ত্তন)। এই শব্দ লেনিন ও তাঁহার দল কর্ত্তৃক সৃষ্ট হইয়াছে বলিয়া মনে হয়। ইহার অর্থ বুর্জ্জোয়াশ্রেণীর রাষ্ট্রযন্ত্র করায়ত্ত করিয়া সামন্ততান্ত্রিক সমাজের আমূল পরিবর্ত্তন সাধনের জন্য যে-সব সংস্কার প্রয়োজন তাহার সংসাধন। ইহারই ফলে বর্ত্তমান আন্তর্জ্জাতিক সভ্যতার বিবর্ত্তন ও ক্রমবিকাশ হইয়াছে। অবশ্য শ্রেণীস্বার্থ প্রণোদিত হইয়াই ইহা করা হয়। কিন্তু এতদ্বারা অতীতের প্রাচীনত্ব বিনাশ করিয়া হালের জাতীয় রাষ্ট্র গঠিত হয়। এই সংস্কার সাধন না হওয়া পর্য্যন্ত মানব সমাজ ভবিষ্যৎ উন্নতির পথে অগ্রসর হইতে পারে না। ঊনবিংশ শতাব্দীতে ইউরোপের প্রায় সমস্ত দেশে এই প্রকার জাতীয় রাষ্ট্র সংগঠিত হইয়া সেখানকার মানব কৌমাবস্থা ও সাম্প্রদায়িকতা এবং মধ্যযুগীয় সভ্যতার স্তর অতিক্রম করিয়াছে। বর্ত্তমান যুগে এসিয়ার স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহ সেই ধারা অবলম্বনে জাতীয় রাষ্ট্র গঠন করিতেছে। ভালই হউক আর মন্দই হউক, জগতে এই ধারাই চলিতেছে। এই সভ্যতা সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতার নামে মানব মনকে ভোলায় এবং নানা শক্তির সংঘাত ও সংঘর্ষের ফলে বুর্জ্জোয়া সভ্যতা, রাজনীতিক সাম্য অর্থাৎ সকলের ভোটাধিকার পর্য্যন্ত অগ্রসর হয়। অবশ্য এই বুর্জ্জোয়াতন্ত্রের অধীনে পুঁজিবাদ (capitalism), সাম্রাজ্যবাদ (imperialism) স্বার্থপর ব্যক্তিত্ববাদ (individualism) প্রভৃতি দেখা দেয়। ফলে সমাজে মুষ্টিমেয় ধনীর প্রভুত্ব ও প্রতিপত্তি সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু আজকালকার কাহারও কাহারও মত এই যে, সমাজের রাজনীতিক সাম্যবাদ সম্মত সংস্কার সাধিত না হইলে প্রকৃত অর্থনীতিক সাম্য বিবর্ত্তিত হইতে পারে না। একদল সমাজতাত্ত্বিকের মত এই যে, প্রাচীন অবস্থা হইতে একটা দেশকে “আধুনিক” সভ্য অবস্থায় উন্নীত করিতে হইলে, ইহাকে এবম্প্রকারের সমস্ত সংস্কার সমূহের মধ্য দিয়া অগ্রসর হইতে হইবে।

এক্ষণে আমাদের বিচারের বিষয়বস্তু হইতেছে—ভারত বর্ত্তমানে কোন অবস্থায় অবস্থিত আছে। ভারতে আদিম অবস্থার লোকও আছে এবং অতি আধুনিক কৃষ্টিসম্পন্ন লোকও আছে। ভারতীয়দের মধ্যে কৌমাবস্থার (tribal stage) লোকসমষ্টিও আছে, বুর্জ্জোয়া আদর্শে গঠিত সমাজও রহিয়াছে, স্থান বিশেষে বহুস্বামীত্বও (polyandry), বহুপত্নীত্ব (polygamy) এবং একপত্নীত্বও আছে। ভারতীয়েরা জন্মগত বিভিন্ন জাতি (caste), ধর্ম্মের দ্বারা গণ্ডীবদ্ধ বিবিধ সম্প্রদায়ে বিভক্ত। এই সকল কারণে তাহাদের মধ্যে মূলজাতিগত একতাবোধ (racial unity) নাই; রাজনীতি ও অর্থনীতিগত এবং ঐতিহাসিক একতাবোধ-জনিত একজাতীয়তা (Nationality) বোধ এখনও সম্যক উদ্বুদ্ধ হয় নাই। সাধারণের মধ্যে এখনও মধ্যযুগীয় মনোভাব বর্ত্তমান; তজ্জন্য ধর্ম্মের একতা দ্বারা একজাতীয়তা সংস্থাপনের কথা মধ্যে মধ্যে শোনা যায়। আবার ভাষার গণ্ডী দ্বারা প্রাদেশিক একজাতীয়তা সংগঠনের প্রস্তাবও মাঝে মাঝে শোনা যায়। এই প্রকারে ভারত ঐক্যের পরিবর্ত্তে অনৈক্যের দিকে অগ্রসর হইতেছে বলিয়াই মনে হইতেছে।

ভারতে ভাষা ও মূলজাতিগত (racial) পার্থক্য ও বিভিন্নতা চিরকালই রহিয়াছে; ধর্ম্মের বৈষম্য হেতু সাম্প্রদায়িক প্রভেদ বরাবরই আছে। তথাপি মৌর্য্য ও গুপ্তযুগে ভারত রাজনীতিক একজাতীয়তা সংগঠন করিয়াছিল এবং তৈমুরের বংশের অধীনে হিন্দু ও মুসলমান লইয়া একটা ভারতীয় একজাতীয়তা বিবর্ত্তনের প্রয়াস চলিতেছিল। এই প্রয়াসকে অধিকতর সফলকাম করিবার উদ্দেশ্যে সম্রাট আকবর “দীন ইলাহি”[](Din-Ilahi)ধর্ম্ম প্রবর্ত্তনে বিশেষভাবে প্রয়াসী হন।

আকবরের “দীন ইলাহী” ধর্ম্ম সফল হইতে পারে নাই সত্য, কিন্তু তৈমুরবংশের নেতৃত্বাধীনে যে নূতন সভ্যতা ক্রমবিকশিত হইতেছিল তাহাতে হিন্দু-মুসলমান উভয়ের দানই ছিল। এতদ্বারা উহা ঐক্যের পথেই অগ্রসর হইতেছিল। ফলে উর্দ্দুভাষা ও সাহিত্যের গোড়াপত্তন হয় এবং তৎসঙ্গে ভারতে একই ধরনের চাল-চলনের প্রচলন হয়। কিন্তু আওরঙ্গজেবের সময় হইতেই প্রতিক্রিয়া সুরু হয়, এবং শেষ পর্য্যন্ত গোঁড়ামীই জয়ী হয়। বাঙ্গলায় হিন্দুর পুনরুত্থানের প্রচেষ্টা অঙ্কুরেই বিনাশ হওয়ায় বাঙ্গলা সাহিত্যে উহার কোন প্রতিধ্বনি পাওয়া যায় না, সীতারামের প্রচেষ্টার বিবরণ এতদিন শুধু গ্রাম্য গল্পের মধ্যেই আবদ্ধ ছিল; শোভাসিংহ ও উদিতনারায়ণের বিদ্রোহও কেবল লোকের স্মৃতিপটেই অঙ্কিত ছিল। এইসকল ঘটনাবলীর কোন সংবাদ সাহিত্যে পাওয়া যায় না। কিন্তু মগ ও পর্ত্তুগীজ বোম্বাটিয়াদের অত্যাচার কাহিনী সাহিত্যের আনাচে-কানাচে সন্ধান করিলে পাওয়া যায় (“রাত্রিদিন বহে যায় হাম্মাদার ডরে”—মুকুন্দরাম)।

ইহার পর ইংরেজ আমলে সমগ্র ভারত এক শাসনাধীন হইলে ভারতে একটা রাজনীতিক একত্ব সম্পাদিত হয়। এতৎসঙ্গে যাতায়াতের সুবিধা, এক ভাষা শিক্ষা প্রভৃতি দ্বারা ভারতের বাহ্যিক একত্ব কথঞ্চিৎ সম্পন্ন হইতে থাকে। ভারত আবার এক রাজনীতিক, অর্থনীতিক ও ঐতিহাসিক যন্ত্রের মধ্য দিয়া পিষ্ট হইয়া একজাতীয়তার দিকে অগ্রসর হইতে থাকে । ফলস্বরূপ ভারতের সকল প্রদেশের লোকেরা আপনাদিগকে ‘ইণ্ডিয়ান’ (Indian) নামে অভিহিত করিতে শিখে, সকলের সুখ-দুঃখের স্বার্থ যে এক ও অভিন্ন—একথা বুঝিতে সক্ষম হয়।

এই নিখিল ভারতীয় একত্ববোধ ভারতের শিক্ষিত বুর্জ্জোয়া অথবা মধ্যবিত্তশ্রেণীর মধ্যেই জাগে। ইংরেজ শাসনের আওতায় উদ্ভূত মধ্যবিত্তশ্রেণী কৌমগত (tribal), ধর্ম্মগত অথবা ভাষাগত গণ্ডীর মধ্যে আবদ্ধ থাকিয়া বিবর্ত্তিত হয় নাই । সমগ্র ভারত তাহার কর্ম্মস্থল; ভাষা ও প্রদেশের ব্যবধান তাহার কর্ম্মক্ষেত্রকে সীমাবদ্ধ করিতে পারে নাই। এইজন্য বাঙ্গলার রামমোহন, কেশবচন্দ্র ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে বিশেষভাবে সমাদৃত এবং শিষ্য ও অনুবর্ত্তী প্রাপ্ত হন। এই কারণ গুজরাটের মূলশঙ্কর ওরফে স্বামী দয়ানন্দ পাঞ্জাবেই বিশেষভাবে গৃহীত হন। ভাবের এই আদান প্রদানের ফল বাঙ্গলা সাহিত্যে বিশেষভাবে প্রতিভাত হয়। বাঙ্গলা সাহিত্যে রাজপুতনার বীরগাথা স্থান পাইয়া প্রতাপ সিংহ, হল্দীঘাট, কৃষ্ণকুমারীর নাম বাঙ্গালীর নিকট সুপরিচিত হয়। পঞ্জাবের গুরুগোবিন্দ সিংহ ও পঞ্জাব কেশরী রণজিৎ সিংহ প্রভৃতির কীর্ত্তিকাহিনী বাঙ্গলা সাহিত্যে স্থান লাভ করে। এই সময়ে বাঙ্গলা সাহিত্যে অখিল ভারতীয় স্বদেশপ্রেম বিশেষভাবে প্রকাশ পায় । হেমচন্দ্রের “ভারত সঙ্গীত”, “ভারত বিলাপ”, ভূদেবচন্দ্রের “স্বপ্নলব্ধ ভারতের ইতিহাস”, গিরীশচন্দ্রের “হল্দী‌ঘাটের যুদ্ধ”, রমেশ চন্দ্রের, “রাজপুত জীবন সন্ধ্যা”, “মহারাষ্ট্র জীবন প্রভাত” প্রভৃতির দ্বারা নিখিল ভারতীয় ভাব বৃদ্ধি প্রাপ্ত হইতে থাকে।

এই সময়ে প্রাদেশিক স্বদেশপ্রেম কাহারও মনে স্থান পায় নাই। এই যুগে ইটালীর বিপ্লবী নেতা ম্যাট্সি‌নী ছিলেন বুর্জ্জোয়া স্বদেশ প্রেমের আদর্শ। তাঁহার “Italia Uni” (যুক্ত ইটালী) ভাব এদেশের তরুণ বুর্জ্জোয়া নেতাদের হৃদয়ে অঙ্কিত হয়। পরলোকগত সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় তাঁহার আত্মজীবনীতে স্পষ্ট লিখিয়াছেন যে ম্যাট্‌সিনির আদর্শে তাহারা “যুক্ত ভারত” গঠনের ব্যাপারে অনুপ্রাণিত হন। ঠিক এই সময়েই শিক্ষিত লোকেরা মধ্যবিত্তশ্রেণীর স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করিবার জন্য একটা প্রতিষ্ঠান স্থাপনের ইচ্ছা প্রকাশ করে। তাহারই ফলে “India League” ভারতের বিভিন্নস্থানে স্থাপিত হয়। পর বৎসর মধ্যবিত্ত শ্রেণীর রাজনীতিক আন্দোলন পরিচালনা করিবার জন্য “জাতীয় মহাসমিতি” (Indian National Congress) স্থাপিত হয়। এতদিন নবোদ্ভূত জাতীয় বুর্জ্জোয়াশ্রেণী ধর্ম্ম ও সমাজ-সংস্কার আন্দোলন দ্বারা আপনাদিগকে প্রকট করিতেছিল। এক্ষণে সেই শক্তি রাজনীতিক্ষেত্রে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর আকাঙ্ক্ষা ও আশা রাজনীতিক্ষেত্রে প্রকাশের প্রয়ান আরম্ভ করিলে সাহিত্যেও উহা প্রতিবিম্বিত হইতে থাকে। স্বদেশ প্রেমোদ্দীপক গানগুলিতেই তাহা বিশেষভাবে প্রকাশ পায়। শ্রীযুক্তা সরলা দেবীর “নমো হিন্দুস্থান” নামক জাতীয় সঙ্গীত ভারতীয় একত্ব প্রচেষ্টার পরিচয় প্রদান করে। তৎপর “বঙ্গভঙ্গ” ও “স্বদেশী” আন্দোলনে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মনোভাব সাহিত্যে বিশেষভাবে প্রকট হয়। মধ্যবিত্তশ্রেণীর রাজনীতিক বুলি হইতেছে জাতীয়তা (Nationalism)। এই সময় জাতীয়তাবাদের চরমরূপ প্রদর্শিত হয় গরমপন্থী স্বদেশপ্রেমিকদের সাহিত্যে। গান, সংবাদ পত্র দ্বারা উক্ত মনোভাব বিশিষ্টরূপে ধারণ করে। “সন্ধ্যা”, “নবশক্তি”, “যুগান্তর” এইভাব প্রচারের ভার গ্রহণ করে। যুগান্তর সোজাসুজি জাতীয় স্বাধীনতার আদর্শ প্রচার করিতে থাকে। এইযুগে নাটকেও জাতীয়তাবাদের ভবিষ্যৎ কিঞ্চিৎ প্রকাশ পায়। ক্ষীরোদচন্দ্র বিদ্যাবিনোদের “প্রতাপাদিত্য”, গিরিশচন্দ্রের “অযোধ্যার বেগম” তাহার সাক্ষ্য প্রদান করে। সখারাম দেউস্করের লিখিত ‘দেশের কথা’ প্রভৃতি পুস্তকে ভারতীয়দের দেশের লোকের অর্থনীতিক ও রাজনীতিক অবস্থার বিষয় আলোচনা করিয়া তাহা সাধারণের গোচরীভূত করা হয়। এই সঙ্গে গরমপন্থী দল জাতীয়তার ব্যাখ্যার সহিত রামায়ণ কথকতার উদ্ভব করে; সঙ্গে সঙ্গে মুকুন্দদাসের “স্বদেশী যাত্রা”র সৃষ্টি হয়। এই “স্বদেশী যুগই” জাতীয়তাবাদ বিকাশের অনাবিল অবস্থা। বাঙ্গলার এই “Storm and Stress Period” (ঝটিকা ও গুরুত্বের যুগ)–এ militant nationalism (আক্রমণশীল জাতীয়তাবাদ) উদ্ভূত হয় এবং বাংলার মনে উহার ছাপ স্থায়ীভাবে অঙ্কিত হইয়া থাকে। এই যুগেই বিপিনচন্দ্র পাল, “The spirit of nationalism” নামক পুস্তিকা লিখিয়া জাতীয়তাবাদের দর্শন প্রদান করে।

যদি কেহ মনে করেন যে ‘জন’ লোকের ভাবোচ্ছ্বাস, জ্বালাময়ী বক্তৃতা ও উন্মাদনাপূর্ণ লেখার জন্ম বাঙ্গলার মরা গাঙ্গে (নদী) নূতন তেজের বন্যা আসিয়াছিল তাহা হইলে তাঁহারা আসল কারণটা ধরিতে পারেন নাই। বঙ্গ-ভঙ্গ দ্বারা বাঙ্গলার গরীব কৃষক ও শ্রমিক যাহারা ‘গণ’ সমূহ নামে অভিহিত, তাঁহাদের কি লোকসান হইত তাহা আজও অবধি কাহারও বোধগম্য হয় নাই। কিন্তু এতদ্বারা ধনিকশ্রেণী সমূহের বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার বিশেষ সম্ভাবনা ছিল বলিয়া প্রবল আন্দোলন উঠে। বঙ্গভঙ্গের পর জমিদারদের সহিত জমিবিষয়ক চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত (Permanent Settlement) গভর্ণমেণ্ট প্রত্যাহার করিয়া লইতে পারেন—এই আশঙ্কা ও ভয়ই বাঙ্গলায় জমিদার, তালুকদার প্রভৃতিদের হৃদয় উদ্বেলিত করিয়া তোলে! অবশ্য এই শ্রেণীগুলি সংখ্যায় অধিকাংশই হিন্দু; সেইজন্য হিন্দুদের প্রতিবাদ ও ক্ষোভ এত তীব্র হইয়া উঠিয়াছিল। মধ্যবিত্ত শ্রেণীদ্বয় ধনীদের তাঁবেদার; কাজেকাজেই হৈ-চৈ করিবার লোকের অভাব হয় নাই। এইজন্যই হিন্দুর প্রতিবাদ এরূপ বিশাল আকার ধারণ করে। হিন্দু বনিয়াদী স্বার্থে (vested interests) আঘাত পড়িবার বিশেষ আশঙ্কা উপস্থিত হওয়ার তদ্বারাই এই বিরাট আন্দোলন সংঘটিত হয়। কিন্তু উপরের স্তরগুলি গরমপন্থী হয় নাই; নিম্নস্তরের বুর্জ্জোয়া শ্রেণীই এই পন্থা অবলম্বন করে। ভারতে বিশেষতঃ বাঙ্গলায় বুর্জ্জোয়া শ্রেণী তখন নিজেকে শিক্ষা দীক্ষায় ইংরাজ বুর্জ্জোয়ার সমকক্ষ বলিয়া মনে করিতে সুরু করিয়াছে, তাহারা আর “আবেদন নিবেদনের থালা” হাতে বহন করিয়া নতশির হইতে চায় নাই। এইজন্যই Autonomy (স্বায়ত্তশাসন) তাহাদের কাম্য বলিয়া নির্দ্ধারিত হয়। পরে, “Swaraj is our birth right” (স্বরাজ আমাদের জন্মগত অধিকার)—এই বুলি জাতীয় কংগ্রেসের কলিকাতা অধিবেশনে গৃহীত হয়; সেই সময় হইতে বুর্জ্জোয়া শ্রেণীদ্বয় এই বুলির মক্স করিতেছে; কিন্তু ইহার অর্থ কি, ইহার স্বরূপ কি, সে সম্বন্ধে আজও অবধি নানা মুনির নানা মত। এইজন্য স্বরাজের কর্ম্মপদ্ধতি পরিষ্কাররূপে বিবৃত করিয়া কোন সাহিত্য প্রকট হয় নাই। তৎপর আসে ১৯২০-২১ সালের অসহযোগ আন্দোলন। ইহা গুটিকয়েক চরখার ও “অসহযোগের” মাহাত্ম্য বর্ণনা করা ব্যতীত বিশিষ্ট কোন সাহিত্য উদ্ভব করিতে পারে নাই। শিক্ষিত ও বুর্জ্জোয়া শ্রেণীর পরিস্থিতি ও আদর্শের আবিলতাই ইহার জন্য দায়ী। উপস্থিত সময়ে, একটি কৃষক ও শ্রমিক আন্দোলন ভারতে সংগঠিত হইয়াছে। তজ্জন্য মধ্যবিত্ত শ্রেণীর লেখকদের দ্বারা “জন” ও ‘গণ’ বিষয়ে লিখিত খানকতক নভেলও প্রকাশিত হইয়াছে। অবশ্য ইহা বুর্জ্জোয়া বা প্রলেটারীয় শ্রেণীর অন্তর্গত সাহিত্য নহে। বুর্জ্জোয়া আদর্শ পরিষ্কার নহে বলিয়া বুর্জ্জোয়া স্বার্থ প্রণোদিত সাহিত্যের উদ্ভব হয় নাই। আর বর্ত্তমানের ‘গণ সাহিত্য’ অর্থে গণের জীবনী অবলম্বন করিয়া উপরি স্তরের লোকদের দ্বারা লিখিত নভেল। ইহা হইতে দৃষ্ট হয়, সমাজের পরিস্থিতি যে প্রকারের, সাহিত্যও তদ্রূপ তাহার প্রতিবিম্ব বহন করিতেছে।

  1. প্রাচীন ইজিপ্তে ইথ্ নাটনের একেশ্বরবাদের উৎপত্তির পশ্চাতেও যে-প্রেরণা ছিল আক্‌বরের এই নবধর্ম্ম “দীন ইলাহি” ধর্ম্মের পশ্চাতেও সেই একই প্রেরণা ছিল। “আইন-ই-আকবরী”র প্রথম ভাগে “দীন ইলাহি”র উৎপত্তি ও মতসমূহ পাঠ করিলে এই ধারণা জন্মে, যে-“ইতিহাসের অর্থনীতিক ব্যাখ্যা” (Materialistic Interpretation of History) উক্ত প্রচেষ্টার মূলে কার্য্য করিয়াছিল; তাহা হইতেছে—একটা নূতনধর্ম্ম সৃষ্টি করিয়া সকল প্রজাদের উহা গ্রহণ করাইয়া এক অখণ্ড অ-হিন্দু অ-মুসলমান ভারতীয় রূপে সংঘবদ্ধ সমগ্র দেশের লোকদের তৈমুরবংশের অধীনে একটা একজাতীয়তা বিবর্ত্তন করা।