সুনির্মল বসুর শ্রেষ্ঠ কবিতা/চৈতী-হাওয়া
চৈতী-হাওয়া
চৈতী-হাওয়া বইতে শুরু অনেক দিনের পর—
ও ভাই অনেক দিনের পর,—
রং জাগে নি গগন-তলে,
ঝুরু কুরু বাতাস চলে,
ঝাপসা ভোরের আবছা আলোয় এলাম ছেড়ে ঘর;
চৈতী-হাওয়া বইতে শুরু অনেক দিনের পর।
মৌমাছিরা মৌতাতী আজ, লুটছে পরিমল—
ফল্সা গাছে জল সা করে আল্সে পাখীর দল;
গাং-শালিখের গান জেগেছে,
উল্লাসে মন উঠছে নেচে,—
বুল্বুলি আজ বিল্কুলি তার ভাঙলো গলার স্বর;
চৈতী-হাওয়া বইতে শুরু অনেক দিনের পর।
ময়না তিতির রয় না নীড়ে; পিক-বধু আজ কৈ?
শিউরে-ওঠা শিউলী-ডালে শিস্ দিয়ে যায় ঐ!
ঝাঁক্ড়া ঝাউএর ঝোপড়া-ঝাড়ে
ঝট্কা এসে ঝাপটা মারে,—
গহন বনে সঙ্গোপনে ডাকছে ‘কবুতর’।
চৈতী-হাওয়া বইতে শুরু অনেক দিনের পর।
টগর ফুলের ডাগর আঁখি দেখবি যদি আয়;
মল্লিকা, তুই কর্লি কি, তোর ঘুম ভাঙে নি, হায়?
আর কারো নাই উঠতে বাকি,
ফুল্ল গাঁদা খুললো আঁখি,—
নিদ্মহলে সিঁদ কেটেছে কোন্ সে ধুরন্ধর!
চৈতী-হাওয়া বইতে শুরু অনেক দিনের পর।
দোপাটি তোর খোঁপাটি বাঁধ্ আসবে আগন্তুক—
শিশির দিয়ে বেশ করে মাজ্ নোংরা ও তোর মুখ;
দম্কা হাওয়া চলছে উড়ি,
চম্কে ওঠে ঝুমকো-কুঁড়ি,—
ঘোমটা তুলে কূর্চি-বধু হাসছে মনোহর,
চৈতী-হাওয়া বইতে সুরু অনেক দিনের পর।
উপচে পড়ে সব যে আহা সবজে-ফুলী মৌ—
কোথায় গেল তালকানা সব ভোমরাগুলোর বৌ?
নিমফুলে আজ হিম লেগেছে,
ঘুম্-কাতুরের ঘুম্ ভেঙেছে,
থল কমলের পাপড়ি পাতা কাঁপছে রে থর্ থর্;
চৈতী-হাওয়া বইতে শুরু অনেক দিনের পর।
লাল্চে ফুলের গাল্চে পাতা কাদের উঠানে,
যার খুশি আয় পলাশতলায়, মুঠা মুঠা নে।
বন-মেহেদির জংলা ফুলে
কে দিল আজ আলতা গুলে’!
চাল্তা পাতায় গীত উঠেছে, ওই শোনো শর্ শর্—
চৈতী-হাওয়া বইতে শুরু অনেক দিনের পর।
কেয়া-পাতায় মেটে-সিঁদুর লাগায় কে আবার?
প্রজাপতির রেশ্মী ডানায় ছোপ লেগেছে তার;
খুন্-খারাবী কৃষ্ণচূড়ায়
চৈতী-হাওয়া পরাগ উড়ায়,
থোপা-থোপা আমের বউল ঝরছে রে ঝর্ ঝর্—
চৈতী হাওয়া বইতে শুরু অনেক দিনের পর।
খুন্সুড়িতে দিক মাতালো টুন্টুনিদের ঝাঁক,—
পোড়ো-বাড়ির খোড়ো চালে আকুল হ’ল কাক;
জাগলো এবার ঘাটের মাঝি,
উদাস সুরে চেঁচায় আজি—
‘দুর মোহানায় কে যাবি ভাই, আয় চলে সত্বর।’
চৈতী-হাওয়া বইতে শুরু অনেক দিনের পর।
হাল্কা হাওয়ায় দুলছে দোদুল দোলন-চাঁপা ফুল,
মৌ পিয়ে তার অলির আঁখি নেশায় ঢুলুঢুল্;
কাজলা-দীঘির বিজন পারে
ফুল ফুটেছে ধুতরো-ঝাড়ে,
সর্ষে ক্ষেতের হলদে ফুলে উঠলো মৃদু ঝড়্,—
চৈতী-হাওয়া বইতে শুরু অনেক দিনের পর।
নামবে এবার আলোর জোয়ার, তাই এ আয়োজন,
ভোরের বাঁশি ভৈরবীতে তান ধরেছে শোন্।
চৈতী-হাওয়া বইতে শুরু,
প্রাণখানি মোর উড়ু উড়ু,
আজকে আমার মন মাতালো বিশ্বচরাচর।
চৈতী-হাওয়া বইতে শুরু অনেক দিনের পর।