সুনির্মল বসুর শ্রেষ্ঠ কবিতা/বন্ধুর দান

বন্ধুর দান

জানে নিবারণ—
দীনুর সহিত মেশা তাহার বারণ।
দীনু সে দীনের ছেলে বড়ই ইতর—
বাস করে বস্তিতে কুঁড়ের ভিতর।
নিবারণ ধনীদের স্নেহের দুলাল,
আদুরে গোপাল।

দীনু বড় ছোটলোক, হীন জানোয়ার—
অতি কদাকার।
ভূতের মতন তার চেহারা যেমন,
স্বভাব তেমন।
তার সাথে যেন নিবারণ
নাহি মেশে, পিতার বারণ।

রাস্তার এক পাশে দীদের ঘর,—
ভাঙা কুঁড়ে গলির ভিতর।
বিপরীত দিকে তার বিরাট বিশাল—
নিবারণদের বাড়ি আছে বহুকাল।
চুপে চুপে নিবারণ দীনু সাথে করে গিয়ে ভাব,
শিশু কিনা,—সরল স্বভাব।
দীনুর যে বাপ নাই,—
দুখিনী মা তার
কোনোরূপে ভিক্ষা ক’রে
জোগায় আহার।
বহু কষ্টে আছে দুই জন,
শুনে ব্যথা পায় নিবারণ।

বড়ই গরীব দীনু, তেলহীন রুক্ষ তার কেশ,
অন্ন বিনা শীর্ণ দেহ, জীর্ণ তার বেশ,
চেয়ে চেয়ে দেখে নিবারণ,—
ব্যাকুল হইয়া ওঠে মন।
লুকিয়ে নিজের যত খাবারের ভাগ—
দীনুরে সে দিয়ে আসে, জানায় সোহাগ;
মুখে তার দেয় নিজ হাতে
চুপি চুপি অতি নিরালাতে।
দেখিলে দীনুর চোখে জল—
তারও চোখ করে ছলছল্।
কেন তার সাথে মেশা দীনুর বারণ
না বোঝে কারণ।


মাঘ মাস, বড় শীত পড়েছে সেবারে,—
হিমের তুহিন স্পর্শে কেঁপে সবে সারা একেবারে।
সন্ধ্যাবেলা অন্ধকারে আপনারে করিয়া গোপন—
চলে নিবারণ।
দেখেছে সে দীনুটারে—
কুটিরের একধারে—
ব’সে ব’সে আগুন পোহায়—
ঠক্ ঠক্ কাঁপে শীতে, ছেঁড়া এক জামা শুধু গায়।


চুপি চুপি নিয়ে তার পশমের গরম চাদর—
দীনুরে করিল দান জানায়ে আদর।
এই শীতে দিনু আহা কত কষ্ট পায়,
নিবারণ আরামেতে কি ক’রে ঘুমায়।

দীনু আর নিবারণে কি আর প্রভেদ—
কেন তার সাথে মেশা দীনুর নিষেধ!
সেও তো মানবশিশু তাহারি মতন,
ভেবে ভেবে সারা হয় শিশু নিবারণ।

পরদিন ভোরবেলা সারা পাড়াময়
উঠিল বিষম রোল, সোজা কথা নয়,
ভীষণ ব্যাপার,
চুরি গেছে বাবুদের ছেলের র‍্যাপার।
দীনু নাকি চুপি চুপি নিয়ে গেছে এসে কাল রাতে—
পড়েছে সে ধরা হাতে হাতে।

বাবুর হুকুমে এসে দারোয়ান বেদম গোঁয়ার—
বেচারী দীনুরে তেড়ে করিল প্রহার।
গায়েতে জড়ানো ছিল যেচে-দেওয়া বন্ধুর সে দান,
ছিনিয়ে নিল তা কেড়ে বাবুর হুকুমে দারোয়ান।

মাটিতে লুটিয়ে প’ড়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে দীনু কাঁদে,—
হায় হায় কোন্ অপরাধে
আজ এত সাজা হ’ল তার?
ভাবিয়া না পায় বারবার।

হেনকালে নিবারণ দীনুর রোদন শুনি’ কানে
ছুটিয়া আসিল সেইখানে।
ব্যাপার দেখিয়া তার দুই চোখে অশ্রু হ’ল জমা—
দীনুরে জড়ায়ে বুকে বলে—“ভাই, কর মোরে ক্ষমা।”