সুনির্মল বসুর শ্রেষ্ঠ কবিতা/বাজি-মাৎ

বাজি-মাৎ

খাট-পালঙের রাজার আছে মস্ত বড় বীর,
তাহার সাথে লড়তে এসে চক্ষু সবার স্থির।
কেউ পারে না তাহার সাথে—এম্‌নি পালোয়ান,
আছাড় মেরে দ্যায় সে ফেলে হ্যাঁচ্‌কা মেরে টান।
দেশ-বিদেশের কুস্তিগীরে সবাই মানে হার,
আজব প্যাঁচের ওস্তাদিতে কেউ পারে না আর।
গদি-পুরের শ্রেষ্ঠ জোয়ান, তোষক-পুরের বীর,
লেপ-কম্বল-পুরের যত ওস্তাদ্‌দের ভীড়,—
সবাই পড়ে সট্‌কে কেবল, হায় হায় মান যায়,
কেউ পারে না তাহার সাথে কুস্তি ও পাঞ্জায়।


জাজিম-গড়ের রাজার ছিল বিরাট তেজী লোক,
কুস্তি এবার লড়তে বুঝি তাহার হ’ল ঝোঁক।
খাট-পালঙের রাজার সভায় আসলো সে এইবার,
পাঁচ-মিনিটের ‘ঘ্যাচাং’ প্যাঁচে মানতে হ’ল হার।

ছিট্‌কে পড়ে, ছট্‌কে পড়ে, পট্‌কে পড়ে হায়,—
মুখ করে চুন, প্রাণ বাঁচাতে সট্‌কে সবাই যায়।
খাট-পালঙের রাজার জোয়ান বজরং নাম তার,
লোহার মত শক্ত শরীর, দেখতে কদাকার।
রাজা মশাই অবশেষে পিটিয়ে দিলেন ঢাক—
“বজরঙে যে হারিয়ে দেবে, ভাঙবে তাহার জাঁক,—
সভার মাঝে সবার কাছে জিতলে কোনো লোক,
হাজার মোহর তারেই দেব,—যেমন লোকই হোক।”
ঢ্যাঁড়া শুনে পিছোয় সবাই, এগোয় না কেউ আর,
বজরঙেরে হারিয়ে কে আর আনবে পুরস্কার?

চাটাই-পুরের রাজ্যে ছিল বটুকরামের দেশ,—
হ্যাংলা-পানা শরীর তাহার, স্ফুর্তি মনে বেশ।
চাটাই-পুরের রাজার কাছে প্রণাম ক’রে কয়,—
“বজরঙেরে হারিয়ে দেব আদেশ যদি হয়।”
চাটাই-পুরের রাজা শুনে হাসেন অবিশ্রাম,
বলেন, “মিছে প্রাণটা দিতে যাচ্ছ বটুকরাম!”
বটুক তবু অনেক ক’রে রাজার আদেশ লয়,
খাট-পালঙের রাজার সভায় সটান হাজির হয়।
তাহার কথায় হেসে সবার বন্ধ বা হয় দম,
লিক্‌লিকে এই বটুকরামের স্পর্ধা তো নয় কম!
যাহোক তবু রাজার কথায় কুস্তি শুরু হয়,
বজরং সিং তালটি ঠুকে’ আসলো যে সময়
হ্যাংলা বটুক তুললে তারে কাঁধেই অকস্মাৎ,—
ফেলল ছুঁড়ে আছাড় মেরে, বজরং চিৎপাত।
ব্যাপার দেখে’ সভার সবাই চমকে গেলে ঢোঁক,
জন্মে কভু দেখে নি কেউ এমনতর লোক।

হারিয়ে দিয়ে বজরঙেরে দাঁড়ায় বটুকরাম,
মেহন্নতে শরীর দিয়ে পড়ছে ঝ’রে ঘাম।
খাট-পালঙের রাজা দেখে’ তারিফ ক’রে ক’ন,
“তোমার আসল পরিচয়টা দাও তো বাছাধন!”
বটুক বলে, “চাটাই-পুরের রাজার ধোপা মুই,
ভারী ভারী শতরঞ্জি নিত্যি আমি ধুই,—
শতরঞ্জির মতন ভারী বজরং তো নয়,
তাই তো তারে তুলতে কাঁধে কষ্ট নাহি হয়;
যেমন ক’রে আছড়ে’ কাচি—শুনুন মহারাজ—
তেমনি ক’রে বজরঙেরে আছাড় মারি আজ।”
বটুকরামের কথা শুনে, রাখতে কথা তাঁর
রাজা তারে হাজার মোহর দিলেন পুরস্কার।
চাটাই-পুরের মান বাঁচালো রজক বটুকরাম,
সেই থেকে তার দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে গেল নাম॥