স্বামিজীর সহিত হিমালয়ে/গঙ্গাতীরস্থ বাড়ীখানি

প্রথম পরিচ্ছেদ

গঙ্গাতীরস্থ বাড়ীখানি

স্থান—বেলুড়ে গঙ্গাতীরে একখানি ছোট বাড়ী।
সময়—মার্চ হইতে ১১ই মে পর্য্যন্ত।

 গঙ্গাতীরস্থ বাড়ীখানির সম্বন্ধে স্বামিজী একজনকে বলিয়াছিলেন, “ধীরা মাতার ক্ষুদ্র বাড়ীখানি তোমার স্বর্গ বলিয়া মনে হইবে। কারণ ইহার আগাগোড়া সবটাই ভালবাসা মাথা।”

 বাস্তবিকই তাই। ভিতরে এক অবিচ্ছিন্ন মেলা-মেশার ভাব এবং বাহিরে প্রতি জিনিসটী সমান সুন্দর; শ্যামল বিস্তৃত শম্পরাজি, উন্নত নারিকেলবৃক্ষগুলি, বনমধ্যস্থ ছোট ছোট বাদামী রঙ্গের গ্রামগুলি—সবই সুন্দর! অদূরে এক গাছের উপর যেন সদাশিবের আশীর্ব্বাদ আমাদের নিকট আনিয়া দিবার জন্যই একটি নীলকণ্ঠ কুলায় নির্ম্মাণ করিয়াছিল, সেটীও সুন্দর। সকাল বেলা ছায়া বাড়ীর পিছন দিকে পড়িত, কিন্তু বৈকালে আমরা সাম্‌নের দিকে বসিয়া যেন সিংহগৌরবে গরীয়দী জননী জাহ্নবীর মানস পূজা করিতে এবং দক্ষিণেশ্বর দর্শন করিতে পাইতাম।

 যাঁহাদের মনে অতীতের স্মৃতি জাগরূক রহিয়াছে, এমন অনেকে মাঝে মাঝে আসিতেন এবং আমরা স্বামিজীর অষ্টবর্ষব্যাপী ভ্রমণের কিছু কিছু বিবরণ শুনিতে পাইতাম; গ্রাম হইতে গ্রামান্তরে গমনকালে তাঁহার নাম পরিবর্তনের কথা, তাঁহার নির্ব্বি কল্প সমাধির কথা এবং যাহা বাক্যের অতীত ও সাধারণ দৃষ্টির বহির্ভূত, যাহা কেবল প্রেমানুগত হৃদয়েরই অনুভবগম্য, পরার্থে স্বামিজীর সেই পবিত্র মর্ম্মবেদনার কথাও আমরা শ্রবণ করিতাম। আর স্বয়ং স্বামিজী তথায় আসিতেন এবং আসিয়া উমা-মহেশ্বরের ও রাধা-কৃষ্ণের গল্প বলিতেন এবং কত গান ও কবিতার আংশিক আবৃত্তি করিতেন।

 কোন একটা পৌর্ব্বাপর্য্যের ভাব না রাখিয়া, পর পর অনেকগুলি সুস্পষ্ট অথচ আলাদা আলাদা অনুভূতির উপর করাইয়া মানবচিত্তকে যে উচ্চতর অবস্থায় পরিণত করিবার প্রথম উপকরণ দেওয়া হয়, তাহা তিনি দিতে জানিতেন বলিয়া মনে হয়; কারণ ঐ ভাবে প্রথম উপকরণগুলি দিতে পারিলেই শিক্ষার্থীর মন আপনা হইতেই উহাদিগকে যথাসম্বন্ধ সাজাইবার প্রয়াসে প্ররোচিত হয়। তিনি ইহা জানুন আর নাই জানুন, অন্ততঃ এই শিক্ষাবিজ্ঞান-নীতি অনুসারেই তিনি অজ্ঞাতসারে কার্য্য করিতেন বেশীর ভাগ, তিনি আজ একটী, কাল একটী—এইরূপ করিয়া ভারতীয় ধর্মগুলিই আমাদের নিকট বর্ণনা করিতেন, তাঁহার যখন যেমন খেয়াল হইত, যেন তদনুসারেই কোন একটাকে বাছিরা লইতেন। কিন্তু তিনি কেবল যে ধর্ম্মবিষয়ক উপদেশই আমাদিগকে দিতেন, তাহা নহে। কখনও ইতিহাস, কখনও লৌকিক উপকথা, কখনও বা বিভিন্ন সমাজ, জাতিবিভাগ ও লোকাচারের বহুবিধ উদ্ভট পরিণতি ও অসঙ্গতি—এ সকলেরও আলোচনা হইত। বাস্তবিক, তাঁহার শ্রোতৃবৃন্দের মনে হইত যেন ভারতমাতা শেষ এবং শ্রেষ্ঠ পুরাণ-স্বরূপ হইয়। তাঁহার শ্রীমুখাবলম্বনে স্বয়ং প্রকটিত হইতেছেন।

 আর একটী বিষয়ে মনস্তত্ত্বের আর একটা গভীর রহস্য তিনি ঠিক ঠিক ধরিতে পারিয়াছিলেন। সেটী এই যে, যাহা আপাতদৃষ্টিতে আমাদের নিকট কঠিন বা অরুচিকর বোধ হয়, তাহাতে কখনও মৃদুতার আরোপ করিতে চেষ্টা না করা। ভারত-সংক্রান্ত বিষয়ে তিনি বরং যাহা কিছু পাশ্চাত্য মনের পক্ষে উপভোগ করা অসম্ভব হইবে বলিয়া বোধ হইত, সেগুলিকে শিক্ষার প্রারম্ভেই খুব করিয়া বাড়াইয়া আমাদের সমক্ষে উপস্থিত করিতেন। এইরূপে হয়ত তিনি হরগৌরী মিলনাত্মক এক কবিতা আবৃত্তি করিতেন—

কস্তূরিকাচন্দনলেপনায়ৈ।

শ্মশানভস্মাঙ্গবিলেপনায়,
সৎকুণ্ডলায়ৈ ফণিকুণ্ডলায়,
নমঃ শিবায়ৈ চ নমঃ শিবায়॥  
মন্দারমালাপরিশোভিতায়ৈ,
কপালমালাপরিশোভিতায়।
দিব্যাম্বরায়ৈ চ দিগম্বরায়,
নমঃ শিবায়ৈ চ নমঃ শিবায়॥  
চলৎক্কণৎকঙ্কণনুপুরায়ৈ,
বিভ্রাট্‌ফণাভাসুরনূপুরায়।
হেমাঙ্গদায়ৈ চ ফণাঙ্গদায়,
নমঃ শিবায়ৈ চ নমঃ শিবায়॥  
বিলোলনীলোৎপললোচনায়ৈ,
প্রফুল্লপঙ্কেরুহলোচনায়।
ত্রিলোচনায় চ বিষমেক্ষণায়
নমঃ শিবায়ৈ চ নমঃ শিবায়॥  

প্রপন্নভক্তে সুখদাশ্রয়ায়ৈ,

ত্রৈলোক্যসংহারক-তাণ্ডবায়।
কৃতস্মরায়ৈ বিকৃতস্মরায়,
নমঃ শিবায়ৈ চ নমঃ শিবায়॥  
চাম্পেয়গৌরার্দ্ধশরীরকায়ৈ,
কর্পূরগৌরার্দ্ধশরীরকায়।
ধর্ম্মিল্লবত্যৈ চ জটাধরায়,
নমঃ শিবায়ৈ চ নমঃ শিবায়॥  
অম্ভোধরশ্যামলকুন্তলায়ৈ,
বিভূতিভূষাঙ্গজটাধরায়।
জগজ্জনলৈ জগদেকপিত্রে,
নমঃ শিবায়ৈ চ নমঃ শিবায়॥  
সদা শিবানাং পরিভূষণায়ৈ,
সদা শিবানাং পরিভূষণায়।
শিবান্বিতায়ৈ চ শিবান্বিতায়,

নমঃ শিবায়ৈ চ নমঃ শিবায়॥  
তাঁহার জ্বলন্ত উৎসাহে অনুপ্রাণিত হওয়ায় আমরা এই সকলের মর্ম্মে প্রবেশ করিতে, এমন কি সেই প্রথমাবস্থাতেও অল্পস্বল্প অর্থবোধ করিতে সমর্থ হইতাম।

 আলোচনার বিষন্ন যাহাই হউক না কেন, উহা সর্ব্বদাই পরিণামে অদ্বর অনন্তের কথায় পর্য়্য‍বসিত হইত। বাস্তবিক জগৎকে এইরূপে ব্যাখ্যা করা আচার্য্যদেবের অদ্বৈত্যবাদে সম্যক্ ব্যুৎপত্তির শ্রেষ্ঠ নিদর্শন বলিয়া আমার মনে হয়। সাহিত্য, প্রত্নতত্ত্ব অথবা বিজ্ঞান—যে কোন তত্ত্বের বিচারেই তিনি প্রবৃত্ত হউন না কেন, সেটী যে সেই চরম অনুভূতিরই একটী দৃষ্টান্তমাত্র, তাহা তিনি সদাই আমাদের মনে বদ্ধমূল করিয়া দিতেন। তাঁহার চক্ষে কোন জিনিসই ধর্ম্মের এলাকার বহির্ভূত ছিল না। বন্ধন-মাত্রকেই তিনি অত্যন্ত ঘৃণার চক্ষে দেখিতেন এবং যাহারা ‘শৃঙ্খলকে পুণ্যের আবরণে ঢাকিতে চাহে তাহাদিগকে তিনি ভয়ানক লোক বলিয়া গণ্য করিতেন; কিন্তু তাই বলিয়া উচ্চদরের রসশিল্পের এবং এই বিষয়ের মধ্যে প্রকৃত সমালোচক যে ব্যবধান দেখিতে পান, তাহা কখনও তাঁহার দৃষ্টি এড়াইত না। একদিন আমরা কয়েক জন ইউরোপীয় ভদ্রলোককে নিমন্ত্রণ করিয়াছিলাম। স্বামিজী সেদিন পারসিক কবিতার বিস্তৃতভাবে আলোচনা করিয়াছিলেন:  “প্রিয়তমের মুখের একটা তিলের বদলে আমি সমরকন্দের সমস্ত ঐশ্বর্য্য বিলাইয়া দিতে প্রস্তুত!”—এই পদটী আবৃত্তি করিতে করিতে তিনি সহসা সোৎসাহে বলিয়া উঠিলেন, “দেখ, যে লোক একটা প্রেমসঙ্গীতের মাধুর্য্য বুঝিতে পারে নাই তাহার জন্য আমি এক কাণাকড়িও দিতাম না।” তাঁহার কথাবার্ত্তা সরদ উক্তিসমূহে পূর্ণ থাকিত। সেই দিনই অপরাহ্নে কোন রাজনৈতিক বিষয়ের বিচার করিতে করিতে তিনি বলিলেন, “দেখা যাইতেছে যে, একটা জাতিগঠনের পক্ষে সাধারণ প্রীতির ন্যয় একটা সাধারণ বিরাগেরও আবশ্যকতা আছে।”

 কয়েক মাস পরে তিনি বলিয়াছিলেন, “যাঁহার জগতে কোন বিশেষ কার্য্য করিবার আছে, তাঁহার কাছে আমি কখনও উমা এবং মহেশ্বর ভিন্ন অন্য দেবদেবীর কথা কহি না। কারণ মহেশ্বর এবং জগন্মাতা হইতেই কর্ম্মবীরগণের উদ্ভব।” তথাপি ভক্তিই যে এই সময়ের প্রত্যেক আলোচনার লক্ষীভূত ছিল, তাহা তিনি তখন জানিতে পারিতেন কি না, এ কৌতূহল কখনও কখনও আমার মনে উদিত হইয়াছে। ভাবের উচ্ছ্বাসে বাঁহাদের মানসিক শক্তিহ্রাসের সম্ভাবনা আছে তাঁহাদের জন্য এ সম্বন্ধে তাঁহার আশঙ্কা থাকিলেও, ভগবানের প্রতি উদ্দাম প্রেমে আত্মহারা হওয়া যে কি জিনিস, তিনি তাহার আভাস না দিয়া থাকিতে পারিতেন না। তাই তিনি আমাদের কাছে—

“প্রেমের রাজা কুঞ্জবনে কিশোরী,
প্রেমের দ্বারে আছে দ্বারী, করে মোহন বাঁশরী,
বাঁশী বল্‌চে রে সদাই, প্রেম বিলাবে কল্পতরু রাই,
কারু যেতে মানা নাই!
ডাক্‌চে বাঁশী—আয় পিপাসী জয় রাধে নাম গান ক’রে।”[]

এই সব গান সুর-সংযোগে গাহিতেন।

 তিনি তাঁহার বন্ধুরচিত[] গোপগোপীগণের উত্তর-প্রত্যুত্তর-সূচক ভাবগম্ভীর গীতটিও গাহিয়া শুনাইতেন—

“পরমাত্মন পীতবসন নবঘনশ্যামকায়,
কালা ব্রজের রাখাল ধরে রাধার পায়।
বন্দ প্রাণ নন্দদুলাল নমো নমো পদপঙ্কজে,
মরি মরি মরি বাকানয়ন গোপীর মন মজে।
পাণ্ডবসখা সারথি রথে, বাঁশী বাজায় ব্রজের ঘাটে পথে।
যজ্ঞেশ্বর বীতভয় হর যাদবরায়,
প্রেমে রাধা ব’লে নয়ন ভেসে যায়।”

 এমন একটি দিন (৯ই মে) কখনই ভুলিবার নহে। তরুতলে বসিয়া আমরা কথাবার্ত্তা কহিতেছিলাম, এমন সময় সহসা ঝড় আসিল। আমরা প্রথমে নদীর তীরে পোস্তায় ও পরে বারান্দায় উঠিয়া গেলাম। আর এক মুহূর্ত্তও বিলম্ব করা চলিত না। দশ মিনিটের মধ্যে গঙ্গার অপর পার আর দেখা গেল না। চতুর্দিক অন্ধকারাচ্ছন্ন হইল। শুধু মুষলধারে বৃষ্টি ও বজ্রপতন-শব্দ শুনিতে পাইতেছিলাম, আর থাকিয়া থাকিয়া ঘোর বিদ্যুৎ চমকাইতেছিল।

 তথাপি বাহ্য প্রকৃতির এই সকল আলোড়নের মধ্যে আমাদের ছোট বারান্দাটিতে বসিয়া বসিয়া আমরা ইহার চেয়ে ও এক গভীরতর অভিনয় তন্ময়ভাবে দেখিতেছিলাম। আমাদের ক্ষুদ্র রঙ্গমঞ্চের এক প্রান্ত হইতে অপর প্রান্ত পর্য্যন্ত একমাত্র অভিনেতা পাদচারণা করিতেছিল; একই কণ্ঠে সকল অভিনেতার ভূমিকা পরিগৃহীত হইয়াছিল এবং জীবের ভগবৎপ্রেমই আমাদের সমক্ষে অভিনীত নাটকীয় বিষয় ছিল। অবশেষে সেই ভাব আমাদের মধ্যে সংক্রামিত হওয়ায় সেই সময়ের জন্য এরূপ উজ্জিত প্রেমের উদ্দীপন হইল যে, বেগবতী স্রোতস্বতী তাহা নির্ব্বাপিত করিতে এবং প্রবল ঝঞ্ঝা তাহাকে সংক্ষুব্ধ করিতে পারিত না। “বিপুল জলরাশিও কি কখনও প্রেমের নির্ব্বাপণ করিতে পারে, অথবা প্রবল রঞ্ঝাবাত তাহাকে গ্রাস করিতে পারে?” ফলে এই জড়ে প্রাণসঞ্চারক নরদেব আমাদের নিকট বিদায় লইবার পূর্ব্বে আমরা সকলে তাঁহার চরণে প্রণত হইলাম এবং তিনিও আমাদের সকলকে আশীর্ব্বাদ করিলেন।

 ১৭ই মার্চ্চ। আমাদের কুটীরবাসের প্রারম্ভে একদিন স্বামিজী ধীরা মাতা এবং জয়া নাম্নী শিষ্যাদ্বয়কে পরমারাধ্যা শ্রীশ্রীমাতাঠাকুরাণীর নিকট লইয়া গেলেন; তিনি স্বামিজীর নিমন্ত্রণে তাঁহার পল্লীগ্রামের বাটী হইতে কলিকাতায় আসিয়াছিলেন। সেখান হইতে তাঁহারা একজন অভ্যাগতা মহিলাকে কয়েক ঘণ্টার জন্য সঙ্গে লইয়া ফিরিলেন। সেই দিনটা ইহার নিকট জীবনের এক মহামহোৎসবের দিন বলিয়া স্মৃতিপথে জাগরিত রহিয়াছে। সে দিনের ভাগীরথীর মধুর প্রভাব, আচার্যদেবের সহিত দীর্ঘ কথোপকথন, আর প্রভাতে জয়ার সনির্ব্বন্ধ ও সাদর অনুরোধে পরম নিষ্ঠাবতীগণেরও অগ্রগণ্য। সেই হিন্দুমহিলাকে তাঁহার শিষ্যাস্থানীয়া বিদেশিনীগণের সহিত একত্র ভোজনে সম্মত করাইয়া তাঁহার মহৎ অনুষ্ঠান এবং সেই দিনকার সকল মধুর পবিত্র বন্ধনের সূত্রপাত—এই সকলের কোনটীই সেই অভ্যাগতা মহিলার স্মৃতিপট হইতে মুছিয়া যাইবার নহে।

 ২৫শে মার্চ। এক সপ্তাহ পরে বুধবার অপরাহ্ণে সেই অভ্যাগতা পুনরার তথায় গমন করিলেন এবং শনিবার সন্ধ্যার ফিরিয়া আসিলেন। প্রাতে কুটীরে আসিয়া সকালের দিকে কয়েক ঘণ্টা তথায় অতিবাহিত করা, আবার বৈকালে পুনরার তথায় আগমন করা—ইহাই স্বামিজীর এই সময়ের নিয়ম ছিল। কিন্তু এইরূপ সাক্ষাতের দ্বিতীয় দিন সকালে শুক্রবার ঈশাহিগণের জ্ঞাপনোৎসবের[] দিন—তিনি ফিরিবার সময় আমাদের তিন জনকে সঙ্গে করিয়া মঠে লইয়া গেলেন এবং সেখানে ঠাকুরঘরে সংক্ষিপ্ত অনুষ্ঠানান্তর একজনকে ব্রহ্মচর্য্যব্রতে দীক্ষিত করিলেন। সেই প্রভাতটী জীবনে সর্ব্বাপেক্ষা আনন্দময় প্রভাত! পূজাশেষে আমরা উপরতলায় গেলাম। স্বামিজী যোগী শিবের ন্যায় জটা, বিভূতি ও হাড়ের কুণ্ডল পরিধান করিয়া একঘণ্টাকাল ভারতীয় বাযন্ত্র-সংযোগে ভারতীয় গীত গাহিলেন।

 তারপর সন্ধ্যার সময় গঙ্গাবক্ষে আমাদের নৌকায় বসিয়া তিনি আমাদের নিকট অকপটভাবে তাঁহার গুরুদেবের নিকট হইতে দায়রূপে প্রাপ্ত সেই মহৎকার্য্য সম্বন্ধে নানা সন্দেহ এবং ভাবনা-বিষয়ক অনেক কথা বলিলেন।

 আর এক সপ্তাহ পরেই তিনি দার্জিলিং যাত্রা করিলেন এবং প্লেগসংক্রান্ত ঘোষণা-শ্রবণে তাঁহার প্রত্যাবর্তনের দিবস পর্য্যন্ত আমরা ইতোমধ্যে আর তাঁহাকে দেখিতে পাই নাই।

 ৩রা মে। তারপর আমাদের মধ্যে দুইজন পরমারাধ্যা শ্রীশ্রীমাতাঠাকুরাণীর গৃহে তাঁহার সাক্ষাৎ পাইলেন। তখনকার রাজনৈতিক গগন তমসাচ্ছন্ন। একটা ঝড়ের সূচনা দেখা যাইতেছিল। সেই সময় প্রতি রজনীতে চন্দ্র আরক্ত কুরাসামগুলে পরিবৃত দৃষ্ট হইত। সাধারণের ধারণা—ইহা প্রজাগণের মধ্যে অশান্তির সূচক এবং ইতঃপূর্ব্বেই প্লেগ, আতঙ্ক ও দাঙ্গা-হাঙ্গামা নিজ নিজ ভীষণ মূর্ত্তি দেখাইতে আরম্ভ করিয়াছিল। আচার্য্যদেব আমাদের দুই জনকে লক্ষ্য করিয়া কহিলেন, “না কালীর অস্তিত্ব সম্বন্ধে কতকগুলি লোক ব্যঙ্গ করে। কিন্তু ঐ দেখ, আজ মা প্রজাগণের মধ্যে আবির্ভূতা হইয়াছেন। ভয়ে তাহারা কূলকিনারা দেখিতে পাইতেছে না এবং মৃত্যুর দণ্ডদাতা সৈনিকবৃন্দের ডাক পড়িয়াছে। কে বলিতে পারে যে, ভগবান শুভের ন্যায় অশুভ-রূপেও আত্মপ্রকাশ করেন না! কিন্তু কেবল হিন্দুই তাঁহাকে অশুভরূপেও পূজা করিতে সাহসী হয়।”

 তিনি ফিরিয়া আসিয়াছেন এবং যথাসম্ভব আবার পূর্ব্বের ন্যায় দিন কাটিতে লাগিল; যথাসম্ভব–কেন না মহামারী দেখা দিয়াছিল এবং জনসাধারণকে সাহস দিবার জন্য ব্যবস্থাও চলিতেছিল। যতদিন এই আশঙ্কা সব দিক আতঙ্কিত করিয়া রাখিয়াছিল, ততদিন স্বামিজী কলিকাতা পরিত্যাগ করিতে সম্মত হইলেন না। এই আশঙ্কা কাটিয়া গেল বটে, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে সেই সুখের দিনগুলিও অন্তর্হিত হইল। আমাদেরও যাত্রা করিবার সময় আসিল।

  1. কবি গিরিশচন্দ্র ঘোষ-প্রণীত ‘নিমাই সন্ন্যাস’।
  2. পরলোকগত নাট্যাচার্য্য গিরিশচন্দ্র ঘোষ।
  3. The Day of Annunciation―যেদিন দেবদূত আসিয়া ঈশা-জননী মেরিকে ‘তাঁহার গর্ভে ভগবান জন্ম লইবেন’ এই কথা জ্ঞাপন করেন।