স্বামিজীর সহিত হিমালয়ে/চেনার-তলে ছাউনী

দ্বাদশ পরিচ্ছেদ

চেনার-তলে ছাউনী

ব্যক্তিগণ: শ্রীমৎ স্বামী বিবেকানন্দ এবং একদল ইউরোপীয় নরনারী―ধীরা মাতা, জয়া এবং নিবেদিত তাহাদের অন্যতম।
স্থান: কাশ্মীর―শ্রীনগর।
সময়: ১৮৯৮ খৃষ্টাব্দের ১৪ই আগষ্ট হইতে ২০শে সেপ্টেম্বর।

 ১৪ই আগষ্ট—৩রা সেপ্টেম্বর। রবিবার প্রাতঃকাল; পরবর্ত্তী অররাহ্নে স্বামিজী আমাদের সনির্ব্বন্ধ অনুরোধে আমাদের সহিত চা পান করিতে আসিতে সম্মত হন। একজন ইউরোপীয়ের সহিত সাক্ষাৎ করা ইহার উদ্দেশ্য। ইহাকে বেদান্তের একজন অনুরাগী বলিয়া বোধ হইয়াছিল। এ বিষয়ে স্বামিজীর কিন্তু কোন কিছু উৎসাহ দেখা গেল না এবং মনে হয় এতদ্বারা তাঁহার অতি আগ্রহান্বিত শিষ্যগণকে এবম্বিধ সকল চেষ্টার সম্পূর্ণ নিষ্ফলতা প্রত্যক্ষ করিবার সুযোগ দেওয়াই সম্ভবতঃ তাঁহার স্বীকৃত হওয়ার আসল উদ্দেশ্য ছিল। তিনি উক্ত প্রশ্নকর্তাকে বুঝাইবার জন্য যৎপরোনাস্তি ক্লেশস্বীকার করিয়াছিলেন বটে, কিন্তু তাঁহার ক্লেশ-স্বীকার একেবারেই নিষ্ফল হইয়াছিল। অনান্য কথার সঙ্গে, আমার মনে আছে, তিনি এই কথা বলিয়াছিলেন, “আমি ত চাই যে নিম্নমভঙ্গ করা সম্ভবপর হউক, কিন্তু তা হয় কই? যদি সত্যসত্যই আমরা কোন নিয়মভঙ্গ করিতে সমর্থ হইতাম, তাহা হইলে ত আমরা মুক্তস্বভাব হইতাম। যাহাকে আপনি নিয়ম-ভঙ্গ বলেন, উহা ত অন্য এক প্রকারে নিয়ম পালন মাত্র।” তৎপরে তিনি তুরীর অবস্থা সম্বন্ধে কিছু বুঝাইতে চেষ্টা করিলেন। কিন্তু যাঁহাকে তিনি কথাগুলি বলিলেন, তাঁহার শুনিবার কান ছিল না।

 ১৬ই সেপ্টেম্বর—মঙ্গলবারের দিন তিনি আর একবার মধ্যাহ্ন-ভোজনে আমাদের ক্ষুদ্র ছাউনীটিতে আসিলেন। অপরাহ্ণে এরূপ জোরে বৃষ্টি হইতে আরম্ভ হইল যে, তাঁহার ফিরিয়া যাওয়া ঘটিল না। নিকটে একখানি টড্‌কৃত ‘রাজস্থান’ পরিয়াছিল, তাহাই উঠাইয়া লইয়া কথায় কথায় মীরাবাই-এর কথা পাড়িলেন। বলিলেন, “বাঙ্গালার আধুনিক জাতীয় ভাবসমূহের দুই-তৃতীয়াংশ এই বইখানি হইতে গৃহীত হইয়াছে। যাহার সকল অংশই উত্তম এমন টডের মধ্যেও, যিনি রাজী হইয়াও রাজপদ পরিত্যাগ করিয়া কৃষ্ণপ্রেমিকাগণের সঙ্গে ভূমণ্ডলে বিচরণ করিতে চাহিয়াছিলেন, সেই মীরাধাই-এর গল্পটী তাঁহার সর্ব্বাপেক্ষা প্রিয় ছিল। তিনি যে দৈন, প্রার্থনাপরতা এবং সর্ব্বজীবসেবা প্রচার করিয়া-ছিলেন এবং উহা যে শ্রীচৈতন্যপ্রচারিত ‘নামে রুচি, জীবে দয়া’র তুলনাযোগ্য, তাহাও উল্লেখ করিলেন। মীরাবাই স্বামিজীর অন্যতম মুখ্য পৃষ্ঠপোষিকা। বিখ্যাত দস্যুদ্বয়ের হঠাৎ স্বভাব-পরিবর্ত্তন এবং শ্রীকৃষ্ণবিগ্রহের দুই ভাগ হইয়া তাঁহাকে গ্রাস করা আর তাহাতেই তাঁহার দেহাবসান প্রভৃতি যে সকল গল্পের কথা লোকে অন্যান্য সুত্রে অবগত আছে, সে গুলিকে তিনি মীরাবাই-এর গল্পের অন্তর্ভুক্ত করিতেন। একবার তিনি মীরাবাই-এর একটা গীত আবৃত্তি এবং অনুবাদ করিয়া একজন স্ত্রীলোককে শুনাইতেছেন, শুনিয়াছিলাম। আহা, যদি ইহার সবটা মনে রাখিতে পারিতাম! তাঁহার অনুর্বাদের প্রথম কথাগুলি এই, “ভাই লাগিয়া থাক, লাগিয়া থাক, লাগিয়া থাক!” এবং তাহার শেষ এই ছিল– “সেই অঙ্কা বঙ্কা নামক দস্যু ভ্রাতৃদ্বয়, সেই নিষ্ঠুর কসাই সুজন এবং যে খেলার ছলে তাহার টিয়াপাখীকে কৃষ্ণনাম জপ করিতে শিখাইয়াছিল সেই গণিকা, ইহারা যদি উদ্ধার পাইয়া থাকে, তবে সকলেরই আশা আছে।[] আবার, আমি তাঁহাকে মীরাবাই-এর সেই অদ্ভুত গল্পটি বলিতে শুনিয়াছি। মীরাবাই বৃন্দাবনে পৌঁছিয়া জনৈক বিখ্যাত সাধুকে[] নিমন্ত্রণ করেন। বৃন্দাবনে পুরুষের সহিত স্ত্রীগণের সাক্ষাৎ নিষিদ্ধ, এই বলিয়া সাধু যাইতে অস্বীকার করেন। যখন তিনবার এইরূপ ঘটিল, তখন মীরাবাই, “বৃন্দাবনে কেহ পুরুষ আছে তাহা আমি জানিতাম না। আমার ধারণা ছিল যে, শ্রীকৃষ্ণই একমাত্র পুরুষরূপে বিরাজ করিতেছেন!” এই বলিয়া স্বয়ং তাঁহার নিকট গমন করিলেন এবং যখন বিস্মিত সাধুর সহিত তাঁহার সাক্ষাৎ হইল, তিনি ‘‘নির্ব্বোধ, তুমি নাকি নিজেকে পুরুষ বলিয়া অভিহিত কর?” এই বলিয়া স্বীয় অবগুণ্ঠন সম্পূর্ণরূপে উন্মোচন করিয়া ফেলিলেন। আর যেমন সাধু সভয়ে চীৎকার করিয়া তাঁহার সম্মুখে সাষ্টাঙ্গে প্রণিপাত করিলেন, অমনি তিনিও তাঁহাকে মাতা যেরূপে সন্তানকে আশীর্ব্বাদ করেন, সেইরূপে আশীর্ব্বাদ করিলেন।

 অদ্য স্বামিজী আকবরের প্রসঙ্গ উত্থাপন করিলেন এবং উক্ত বাদসাহের সভাকবি তানসেনের রচিত তাঁহার সিংহাসনাধিরোহণ-বিষয়ক একটা গীত আমাদের নিকট গাহিলেন।

 তৎপরে স্বামিজী নানা কথা কহিতে কহিতে ‘আমাদের জাতীয়-বীর’ প্রতাপসিংহের সম্বন্ধে বলিতে লাগিলেন। কেহ তাঁহাকে কখনও বশ্যতাস্বীকার করাইতে পারে নাই। হাঁ, একবার মুহূর্ত্তের জন্য তিনি পরাভবস্বীকার করিতে প্রলুব্ধ হইয়াছিলেন বটে। একদিন চিতোর হইতে পলায়নের পর মহারাণী স্বয়ং রাত্রের সামান্য খাবার প্রস্তুত করিয়াছেন, এমন সময়ে এক ক্ষুধিত মার্জ্জার ছেলেদের জন্য যে রুটীখানি নির্দিষ্ট ছিল তাহারই উপর ঝাপট মারিয়া সেখানি লইয়া গেল। মিবাররাজ স্বীয় শিশুসন্তানগুলিকে খাদ্যের জন্য কাঁদিতে দেখিলেন। তখন বাস্তবিকই তাঁহার বীর হৃদয় অবসন্ন হইয়া পড়িল। অদুরে স্বাচ্ছন্দ্য এবং শান্তির চিত্র দেখিয়া তিনি প্রলুব্ধ হইলেন এবং মুহূর্তের জন্য তিনি এই অসমান যুদ্ধ হইতে বিরত হইয়া আকবরের সহিত কুটুম্বিতা-স্থাপনের সঙ্কল্প করিয়াছিলেন; কিন্তু তাহা কেবল এক মুহূর্তেরই জন্য। সনাতন-বিশ্বনিয়ন্তা পরমেশ্বর তাঁহার নিজ জনকে রক্ষা করিয়া থাকেন। উক্ত চিত্র প্রতাপের মানসপট হইতে অন্তর্হিত হইতে না হইতেই এক রাজপুত নরপতির নিকট হইতে দূত আসিয়া তাঁহাকে সেই প্রসিদ্ধ কাগজপত্রগুলি দিল। তাহাতে লেখা ছিল, “বিধর্ম্মীর সংস্পর্শে যাঁহার শোণিত কলুষিত হয় নাই এরূপ লোক আমাদের মধ্যে মাত্র একজন আছেন। তাঁহারও মস্তক ভূমিস্পর্শ করিয়াছে, একথা যেন কেহ কখনও বলিতে না পারে।” পাঠ করিবামাত্র প্রতাপের হৃদয় সাহস এবং নবীভূত আত্মপ্রত্যয়ে সঞ্জীবিত হইয়া উঠিল। তিনি বীরগর্ব্বে দেশ হইতে শত্রুকুল নির্ম্মল করিয়া উদয়পুরে নিরাপদে প্রত্যাবর্তন করিলেন।

 তারপর অনুঢ়া রাজনন্দিনী কৃষ্ণকুমারীর সেই অদ্ভূত গল্প শুনিলাম। একাধিক নরপতি এক সঙ্গে তাঁহার পাণিগ্রহণ করিতে চাহিতেছিলেন। আর যখন তিনটী বৃহৎ বাহিনী পুরদ্বারে উপস্থিত হইল, তাঁহার পিতা কোন উপায়ান্তর না দেখিয়া তাঁহাকে বিষ দিতে মনস্থ করিলেন। কৃষ্ণকুমারীর খুল্লতাতের উপর এই ভার অর্পিত হইল। বালিকা যখন নিদ্রিতা সেই সময় খুল্লতাত উক্ত কার্য-সম্পাদনার্থ তাঁহার কক্ষে প্রবেশ করিলেন। কিন্তু তাঁহার সৌন্দর্য্য ও কোমল বয়স-দৃষ্টে এবং তাঁহার শিশুকালের মুখও মনে পড়ায়, তাঁহার যোদ্ধ হৃদয় দমিয়া গেল এবং তিনি তাঁহার নির্দ্দিষ্ট কার্য্য করিতে অক্ষম হইলেন। কৃষ্ণকুমারী কোন আওয়াজ শুনিতে পাইয়া জাগিয়া উঠিলেন এবং নির্দ্ধারিত সঙ্কল্পের বিষয় অবগত হইয়া হাত বাড়াইয়া বাটীটি লইলেন এবং হাসিতে হাসিতে সেই বিষ পান করিয়া ফেলিলেন। এইরূপ ভূরি ভূরি গল্প আমরা শুনিতে লাগিলাম। কারণ রাজপুত বীরগণের এবম্বিধ গল্প অসংখ্য।

 ২০শে সেপ্টেম্বর। শনিবারে স্বামিজী এবং সুং নামক একজন দুই দিনের জন্য আমেরিকার রাজদূত ও তাঁহার পত্নীর আতিথ্য-স্বীকার করিতে ডাল হ্রদে গমন করিলেন। তাঁহারা সোমবারে ফিরিয়া আসিলেন এবং মঙ্গলবারে স্বামিজী আমাদের নূতন মঠে (আমরা উহার ঐ আখ্যাই দিয়াছিলাম) আসিলেন এবং যাহাতে তিনি গাণ্ডেরবল যাত্রা করিবার পূর্ব্বে কয়েক দিন আমাদের সহিত বাস করিতে পারেন এই উদ্দেশ্যে তাঁহার নৌকাখানিকে আমাদের নৌকার খুব নিকটে লাগাইলেন।

 [গাণ্ডেরবল হইতে স্বামিজী অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহের মধ্যেই ফিরিয়া আসিলেন এবং বিশেষ কোন কারণবশতঃ তিনি যে কয়েক দিনের মধ্যেই বাঙ্গালা দেশে যাইবার সঙ্কল্প করিয়াছেন, তাহা সকলের নিকট প্রকাশ করিলেন। স্বামিজীর ইউরোপীয় সঙ্গিগণ ইতঃপূর্ব্বেই শীত পড়িতেই লাহোর, দিল্লী, আগ্রা প্রভৃতি উত্তর ভারতের মূখ্য নগরগুলি দেখিবার সঙ্কল্প করিয়াছিলেন। অতএব সকলেই একত্র লাহোরে প্রত্যাবর্ত্তন করা সাব্যস্ত করিলেন। এখানে স্বামিজী বাকি কয়জনকে উত্তর ভারতের স্থানাদি দর্শন করিবার সঙ্কল্প কার্য্যে পরিণত করিতে রাখিয়া সদলবলে কলিকাতায় ফিরিয়া আসিলেন।]

  1. সমগ্র মূল গীতটী এই—

    হরিসে লাগি রহোরে ভাই।
    তেরা বনত বনত বনি যাই॥
    অঙ্কা তারে বঙ্কা তারে তারে সুজন কসাই।
    সুগা পড়ায়কে গণিকা তারে তারে মীরাবাই॥
    দৌলত দুনিয়া মাল খাজনা বলিয়া বৈল চরাই।
    এক বাতকা টাণ্টা পড়ে তো খোঁজ খবর ন পাই॥
    ঐসী ভক্তি কর ঘট ভিতর ছোড় কপট চতুরাঈ।
    সেবা বন্দি ঔর অধীনতা সহজে মিলি রঘুরাই॥

  2. শ্রীচৈতন্যের প্রসিদ্ধ সন্ন্যাসী শিষ্য সনাতন। তিনি বাঙ্গালার নবাবের উজীরি-পদ পরিত্যাগ করিয়া সাধু হইয়াছিলেন।