স্বামিজীর সহিত হিমালয়ে/পাণ্ড্রেন্থানের মন্দির
অষ্টম পরিচ্ছেদ
পাণ্ড্রেস্থানের মন্দির
ব্যক্তিগণ: শ্রীমৎ স্বামী বিবেকানন্দ এবং একদল ইউরোপীয় নরনারী, ধীরামাতা, জয়া এবং নিবেদিতা তাঁহাদের অন্যতম।
সময়: ১৬ই হইতে ১৯শে জুলাই পর্য়্যন্ত।
স্থান: কাশ্মীর।
১৬ই জুলাই পর দিবস জনৈকা শিষ্যার স্বামিজীর সহিত একখানি ছোট নৌকা করিরা নদীবক্ষে গমনের সুযোগ ঘটিয়াছিল। নৌকা স্রোতের অনুকূলে চলিতেছে, আর তিনিও রামপ্রসাদের গানগুলি একটির পর একটা করিয়া গাহিয়া চলিয়াছেন এবং মধ্যে মধ্যে একটু আধটু অনুবাদ করিয়া দিতেছেন। যেমন—
“ভূতলে আনিয়ে মাগো কর্লি আমায় লোহা-পেটা,
(আমি) তবু কালী ব’লে ডাকিমা সাবাস আমার বুকের পাটা।
অথবা, “মন কেন রে ভাবিস্ এত,
যেন মাতৃহীন বালকের মত।” ইত্যাদি।
এবং তারপর শিশু কুপিত হইলে যেমন গর্ব্ব ও অভিমানভরে বলিয়া থাকে, সেই ভাবের একটা গান গাহিলেন। তাহার শেষভাগটী এই—
“আমি এমন মায়ের ছেলে নই যে,
বিমাতাকে মা বলিব।”
কস্তুরিকাচন্দনলেপনায়ৈ,
শ্মশানভস্মাঙ্গবিলেপনায়।
সৎকুণ্ডলায়ৈ ফণিকুণ্ডলায়,
নমঃ শিবায়ৈ চ নমঃ শিবায়॥
মন্দারমালাপরিশোভিতায়ৈ,
কপালমালাপরিশোভিতায়।
দিব্যাস্বরায়ৈ চ দিগম্বরায়,
নমঃ শিবায়ৈ চ নমঃ শিবায়॥
বিভূতিভূষাঙ্গজটাধরায়।
জগজ্জনথৈ জগদেকপিত্রে,
নমঃ শিবায়ৈ চ নমঃ শিবায়॥ ইত্যাদি।
কিশোরীর প্রেম নিবি আয়, প্রেমের জোয়ার বয়ে যায়;
বইছে রে প্রেম শতধারে, যে যত চায় তত পায়।
প্রেমের কিশোরী, প্রেম বিলাচ্ছেন সাধ করি,
প্রেমে প্রাণ মত্ত করে প্রেমতরঙ্গে প্রাণ মাতায়,
রাধার প্রেমে হরি বলে আয়, আয়, আয়॥
তিনি এত তন্ময় হইয়া গিয়াছিলেন যে, তাঁহার প্রাতরাশ প্রস্তুত হইবার অনেকক্ষণ পর পর্য্যন্ত পড়িয়া রহিল এবং অবশেষে “যখন এই সব ভক্তির প্রসঙ্গ চলিতেছে, তখন আর খাবারে কি দরকার?”―এই বলিয়া তিনি অনিচ্ছাপূর্ব্বক উঠিয়া যাইলেন এবং অতি সত্বরই ফিরিয়া আসিয়া সেই বিষয়ের পুনরালোচনায় প্রবৃত্ত হইলেন।
কিন্তু হয় এই সময়েই, না হয় অপর কোনও সময়ে তিনি বলিয়াছিলেন যে, যাহার নিকট হইতে তিনি বড় বড় কার্য্যের প্রত্যাশা রাখেন, তাহার নিকট তিনি রাধাকৃষ্ণের প্রসঙ্গ উত্থাপন করেন না। কঠোর এবং আগ্রহবান্ কর্ম্মীর জনক শিব এবং কর্ম্মীর তাঁহারই পদে উৎসৃষ্ট হওয়া উচিত।
পরদিন তিনি আমাদিগকে শ্রীরামকৃষ্ণের একটী চমৎকার উপদেশ শুনাইলেন, তাহাতে অপরের গুণদোষর্শিগণ মৌমাছি বা মাছির সহিত তুলিত হইয়াছে। যাহারা মধু অন্বেষণ করিয়া লয় তাহারাই মৌমাছি; আর যাহারা বাছিয়া বাছিয়া ঘায়ে বসে তাহারাই মাছি।
তৎপরে আমরা ইস্লামাবাদ অভিমুখে যাত্রা করিলাম। ঘটনাচক্রে ইহাই বাস্তবিক অমরনাথ-যাত্রা হইয়া দাড়াইল।
১৯শে জুলাই। প্রথম অপরাহ্নটীতে বিতস্তা নদীতীরে এক জঙ্গলের মধ্যে আমরা চির-অন্বেষিত পাণ্ড্রেন্থান মন্দির আবিষ্কার করিলাম। (পাণ্ড্রেন্থান কি পাণ্ড্রেস্থান——পাণ্ডবগণের স্থান)
মন্দিরটী গাঢ় ফেনায় ঢাকা এক পুষ্করিণীর মধ্য হইতে উঠিয়াছে। ইহা ভারী ভারী ধূসর চূণাপাথরের নির্মিত বহু প্রাচীন কালের একটি ক্ষুদ্র দেউল। ইহাতে একটী স্বল্পায়তন প্রকোষ্ঠ, তাহার পূর্ব্ব, পশ্চিম, উত্তর, দক্ষিণ—চারিদিকে চারিটী দুয়ার। বাহির হইতে দেখিতে ইহা চৌতারায় বসান চারিপার্শ্বে ফোকর-বিশিষ্ট একটী মাথাকাটা পিরামিডের মত সরু হইয়া উঠিয়াছে, তাহার উপরে আবার একটী ঝোপ জন্মিয়াছে। ইহার স্থাপত্যে ত্রিপত্র ও ত্রিভুজাকার খিলান পরস্পর এবং সরলরেখা-বিশিষ্ট সরদালের সহিত এমন একভাবে মিশান ছিল যে, সচরাচর সেরূপ দেখিতে পাওয়া যায় না। মন্দিরটী অদ্ভুত রকম দৃঢ়ভাবে নির্ম্মিত হইয়াছিল এবং এই সকল বিভিন্ন নির্ম্মাণপদ্ধতির মধ্যে যে পার্থক্যটুকু অবশ্যম্ভাবী, তাহা ভারী ভারী নক্সার কাজে কতকটা ঢাকা পড়িয়াছিল।
বনমধ্যস্থ পুকুরটীর ধারে পৌঁছিবার পর সেই ক্ষুদ্র মন্দিরটীর অভ্যন্তরে প্রবেশ করিয়া তাহার ভিতরের কারুকার্য্যগুলি ভাল করিয়া দেখিবার কোন উপায় না দেখিয়া আমরা সকলেই অত্যন্ত বিষণ্ণ হইলাম। কয়েকখানি পথনির্দেশক পুস্তকে সেগুলি নক্সা ও কারিগরী বিষয়ে ‘পুরাদস্তর প্রাচীন সভ্য যুগের’ অর্থাৎ যাবনিক ও রোমক বলিয়া উল্লিখিত হইয়াছিল।কিন্তু আমাদের হাজি অর্থাৎ মাঝিগণ একজন স্থানীয় লোককে লইয়া আসিল, সে আমাদিগকে একখানি নৌকা সংগ্রহ করিয়া দিবার ভার লইল। তখন আমাদের বিষাদ আনন্দে পরিণত হইল। লোকটী ফেনার নীচ হইতে একখানা নৌকা টানিয়া উঠাইল এবং উহাতে একটী শিকল বাঁধিয়া নিজে প্রায় এক কোমর জল ভাঙ্গিয়া আমাদিগকে এক এক করিয়া পুকুরটার চারিধারে ঘুরাইয়া লইয়া আসিতে লাগিল। এইরূপে আমরা অভিলাষানুযায়ী ভিতরে প্রবেশ করিতে সমর্থ হইলাম।
স্বামিজী ব্যতীত আমাদের সকলেরই পক্ষে ভারতীয় প্রত্নতত্ত্বে এই সবে হাতেখড়ি। সুতরাং তাঁহার দেখা শেষ হইবার পর তিনি আমাদিগকে কিরূপে ভিতরটা দেখিতে হইবে, তাহা শিখাইয়া দিলেন।
ছাদের ভিতর পিঠের মধ্যস্থলে একটী খোদিত বৃহৎ সূর্য্যমূর্ত্তি-বিশিষ্ট চক্র এক সমচতুষ্কোণের মধ্যে বসান আছে; তাহার চারিটী কোণ পূর্ব্ব, পশ্চিম, উত্তর ও দক্ষিণ দিকে। ইহাতে ছাদটীর চারি কোণে চারিটী সমান ত্রিভুজ রহিয়া গিয়াছে, সে গুলি সুচারুরূপে সম্পাদিত সর্প-বেষ্টনাবদ্ধ পুরুষ ও স্ত্রীমূর্ত্তিসকলের অল্প পল্ তোলা খোদাইয়ের কাজে ভরিয়া দেওয়া হইয়াছে। দেওয়ালগুলিতে খালি জায়গা পড়িয়া রহিয়াছে, সেস্থানে এক সারি স্তূপ অঙ্কিত ছিল বলিয়া মনে হয়।
বাহিরেও খোদাইএর কাজ ঠিক এই রকম করিয়া স্থানে স্থানে বিন্যস্ত হইয়াছে। ত্রিপত্র খিলানগুলির একটীতে—সম্ভবতঃ পূর্ব্ব দরজার উপরে যে খিলানটী তাহাতেই—বুদ্ধ দাঁড়াইয়া উপদেশ দিতেছেন, তাঁহার একটী হাত ঊর্দ্ধে উত্তোলিত—এই সুন্দর প্রতিমূর্ত্তিটী রহিয়াছে। দুই পার্শ্বে থান দুইটীর শিরোদেশ ব্যাপিয়া বৃক্ষতলে আসীনা এক রমণীমূর্ত্তি খোদিত আছে। মূৰ্ত্তিটী অনেকটা মুছিয়া গিয়াছে। ইহা বুদ্ধজননী মায়াদেবীর প্রতিমূর্ত্তি ভিন্ন আর কিছুই হইতে পারে না। অপর তিনটী দরজার খিলানে কোন নক্সা ছিল না, কিন্তু পুকুরপাড়ে যে চাবড়াখানি পড়িয়াছিল, সেখানে ইহাদেরই মধ্যে কোন একটী হইতে খসিয়া পড়িয়াছে বলিয়া বোধ হইল। ইহাতে অনিপুণভাবে অঙ্কিত এক রাজার মূর্ত্তি আছে; স্থানীয় লোক উহা সূর্য্যের প্রতিমূর্ত্তি বলিয়া নির্দ্দেশ করে। এই ক্ষুদ্র মন্দিরটির গাঁথুনি চমৎকার এবং উহা যে এতদিন ধরিয়া টিকিয়া রহিয়াছে, তাহা সম্ভবতঃ এই কারণেই। এক একখানি পাথরের চাঙ্গর এরূপভাবে কাটা হইয়াছে যে উহা দেওয়ালের এক একখানি ইষ্টকস্থানীয় না হইয়া মিস্ত্রী যে নক্সানুযায়ী গাঁথিবে স্থির করিয়াছে, তাহার এক একটি অংশের স্থান অধিকার করিয়াছে। একটা কোণা ঘুরিয়া গিয়া উহা দুইটী (এবং কোথাও বা তিনটী) বিভিন্ন দেওয়ালের অঙ্গীভূত হইয়াছে। এই ব্যাপারটি হইতেই মন্দিটী যে অতি প্রাচীন, এমন কি হয়ত মার্ত্তণ্ডের মন্দির অপেক্ষাও প্রাচীন, এইরূপ মনে হইল। মনে হইতেছিল, রাজের কাজ যত না হউক, যেন ছুতারের কাজ পাথরে সারাই মিস্ত্রীদের মাথায় ছিল। স্বামিজীর ধারণা হইয়াছিল যে, কোন পবিত্র কুঞ্জের স্মৃতিরক্ষার্থই এই মন্দিরটি নির্ম্মিত হইয়া থাকিবে এবং সম্ভবতঃ সেই কুণ্ডের জলই ছাপাইয়া মন্দির প্রাঙ্গণে আসিয়া ইহার চারি পাশের জলরাশিতে পরিণত হইয়াছে।স্বামিজীর চক্ষে স্থানটী অতি মধুর পূর্ব্বকথার উদ্দীপনা করিয়া দিল। ইহা বৌদ্ধধর্মের প্রত্যক্ষ নিদর্শনস্বরূপ এবং তিনি ইতঃপূর্ব্বে কাশ্মীরের ইতিহাসকে যে চারিটী ধর্ম্মযুগে বিভক্ত করিয়াছিলেন, ইহা তাহাদেরই অন্যতম।
(১) বৃক্ষ ও সর্পপূজার যুগ—এই সময় হইতেই নাগ-শব্দান্ত কুণ্ডনামগুলির প্রচলন, যথা বেরনাগ ইত্যাদি, (২) বৌদ্ধধর্ম্মের যুগ, (৩) সৌরোপাসনার আকারে প্রচলিত হিন্দুধর্ম্মের যুগ এবং (৪) মুসলমানধর্ম্মের যুগ। তিনি বলিলেন, ভাস্কর্য্যই বৌদ্ধধর্ম্মের বিশেষ শিল্প এবং সূর্য্যচিহ্নিত চক্র অথবা পদ্ম ইহার খুব মামুলি কারুকার্য্যস্থানীয়। সর্পসম্বলিত মূৰ্ত্তিগুলিতে বৌদ্ধধর্ম্মের পূর্ব্বেকার যুগের আভাস। কিন্তু সৌরোপাসনার কালে ভাস্কর্য্যের যথেষ্ট অবনতি হইয়াছিল, এই নিমিত্ত সূৰ্য্যমূৰ্ত্তিটী নৈপুণ্য-বর্জ্জিত।
তার পর আমরা বনমধ্যস্থ সেই ক্ষুদ্র মন্দিরটী ত্যাগ করিয়া আসিলাম। প্রায় অষ্টাদশ শতাব্দী পূর্ব্বে[১] যখন পৃথিবীতে বিরাট্ বিরাট্ ব্যাপার ঘটনোন্মুখ হইয়া উঠিয়াছিল, সেই সুদূর অতীতে মানুষের পূজা করিবার মত ইহার অভ্যন্তরে কি ছিল? আমরা নিশ্চয় করিয়া বলিতে পারি নাই, শুধু অনুমান করিতে পারিয়াছিলাম। ইত্যবসরে তথায় একটী জিনিস ছিল, যাহার সম্মুখে আমরা প্রণত হইতে পারিয়াছিলাম—উহা শিক্ষাদানরত বুদ্ধ। আমরা একটী চিত্র মানসনেত্রের সম্মুখে উপস্থাপিত করিতে পারিয়াছিলাম—সেটী সেই বিশাল দারুময় নগর এবং তাহার কেন্দ্রস্থলে এই মন্দিরটী। এই নগর বহু বহু বৎসর পরে অগ্নিসাৎ হয় এবং এখন প্রায় পাঁচ মাইল দূরে সরিয়া বসিয়াছে। সুতরাং একটী স্বপ্নরাজ্যের কল্পনা করিয়া আমরা দীর্ঘনিঃশ্বাস ত্যাগ করিয়া তরুরাজির মধ্য দিয়া নদীতীরে ফিরিয়া আসিলাম ।
তখন সূর্য্যাস্তের সময়—কি অপরূপ সূর্য্যাস্ত! পশ্চিমদিকের পৰ্ব্বতগুলি গাঢ় লালরঙ্গে ঝক্ঝক্ করিতেছে। আরও উত্তরে বরফ এবং মেঘে সেগুলি নীল দেখাইতেছিল। আকাশ হরিৎ এবং পীত, তাহার সহিত ঈষৎ লাল—উজ্জ্বল অগ্নিশিখার রঙ্গের এবং ড্যাফোডিল ফুলের মত হরিদ্রাবর্ণ; তাহার পিছনেই নীল এবং ওপ্যালের মত সাদা জমি (background)। আমরা দাড়াইয়া দেখিতে লাগিলাম এবং তৎপরেই ‘সুলেমানের সিংহাসন’ (যাহা ইতোমধ্যেই আমাদের প্রিয়পাত্র হইয়া উঠিয়াছিল, সেই ক্ষুদ্র তক্ত্) নজরে পড়িবামাত্র আচার্য্যদেব বলিয়া উঠিলেন, “মন্দিরস্থাপনে হিন্দু কি প্রতিভারই বিকাশ দেখায়! যেখানে চমৎকার দৃশ্য মিলে, সে সেই স্থানটীই বাছিয়া লয়! দেখ, এই তক্ত্ হইতে সমস্ত কাশ্মীরটী দেখিতে পাওয়া যায়। নীল জলরাশির মধ্য হইতে লোহিতাভ হরিপর্ব্বত উঠিয়াছে, যেন মুকুট পড়িয়া একটী সিংহ অৰ্দ্ধশায়িতভাবে অবস্থান করিতেছে। আর মার্ত্তণ্ডের মন্দিরের পাদমূলে একটী উপত্যকা রহিয়াছে!”
আমাদের নৌকাগুলিকে বনপ্রান্ত হইতে অনতিদূরে নোঙ্গর করা হইয়াছিল এবং আমরা দেখিতে পাইলাম যে আমাদিগের সদ্যআবিষ্কৃত নিস্তব্ধ দেবালয় এবং বুদ্ধমূর্তিটী স্বামিজীর মনে গভীর ভাবের উদ্রেক করিয়াছে। সেই দিন সন্ধ্যার সময় আমরা ধীরামাতার বজরায় একত্র হইলাম এবং তত্রত্য কথোপকথনের কিয়দংশ এখানে লিপিবদ্ধ হইল। ঈশাহী ধর্ম্মের ক্রিয়াকাণ্ড বৌদ্ধধর্ম্মের ক্রিয়াকাণ্ড হইতেই উদ্ভূত, আচার্য্যদেব এই মর্ম্মে বলিতেছিলেন কিন্তু আমাদের একজন এই মতটী আদৌ মানিতে চাহেন না।
উক্ত রমণী জিজ্ঞাসা করিলেন, “বৌদ্ধ কর্মকাণ্ডই বা কোথা হইতে আসিল?”
স্বামিজী সংক্ষেপে উত্তর দিলেন, “বৈদিক কর্ম্মকাণ্ড হইতে।” প্রশ্নকর্ত্রী পুনরায় বলিলেন, “অথবা, ইহা দক্ষিণ ইউরোপেও প্রচলিত ছিল বলিয়া এইরূপ সিদ্ধান্ত করাই ভাল নয় কি যে বৌদ্ধ, ঈশাহী এবং বৈদিক ক্রিয়াকাণ্ড সকলই এক সাধারণ ভূমি হইতে উদ্ভুত?”
স্বামিজী উত্তর দিলেন, “না, তাহা হইতেই পারে না! তুমি ভুলিয়া যাইতেছ যে, বৌদ্ধধর্ম্ম সম্পূর্ণভাবে হিন্দুধর্মেরই অন্তর্ভুক্ত ছিল! এমন কি, জাতিবিভাগের বিরুদ্ধে পর্য্যন্ত বৌদ্ধধর্ম্ম কিছু বলে নাই! অবশ্য, জাতিবিভাগ তখনও কোন নির্দিষ্ট রূপ লাভ করে নাই এবং বুদ্ধদেব আদর্শটীকে পুনঃস্থাপন করিতে প্রয়াসী হইয়াছিলেন মাত্র। মনু বলিতেছেন, যিনি এই জীবনেই ভগবৎসাক্ষাৎকার করেন, তিনিই ব্রাহ্মণ। বুদ্ধদেব এইটী সাধ্যমত কার্য্যে পরিণত করিতে চাহিয়াছিলেন মাত্র।”
প্রতিপক্ষ তখনও জিজ্ঞাসা করিতেছেন, “কিন্তু ঈশাহী এবং বৈদিক ক্রিয়াকাণ্ডের মধ্যে কি সম্বন্ধ? তাহারা এক, ইহা কখনও সম্ভব হইতে পারে? এমন কি, আমাদের পূজাপদ্ধতির যাহা মেরুদণ্ডস্বরূপ, আপনাদের ধর্ম্মে তাহার নামগন্ধও নাই!”
স্বামিজী বলিলেন, “নিশ্চরই আছে! বৈদিক ক্রিয়াকাণ্ডেও Mass আছে, তাহাই দেবতার উদ্দেশ্যে ভোগনিবেদন করা, আর তোমাদের Blessed Sacrament আমাদের প্রসাদস্থানীয়। শুধু গ্রীষ্মপ্রধান দেশের প্রথানুযায়ী উহা হাঁটু না গাড়িয়া, বসিয়া বসিয়া নিবেদন করা হয়। তিব্বতের লোক হাঁটু গাড়িয়া থাকে। এতদ্ভিন্ন বৈদিক ক্রিয়াকাণ্ডেও ধূপদীপদান এবং গীতবাদ্যের প্রথা আছে।”
প্রশ্নকর্ত্রী কতকটা একগুঁয়ের মত তর্ক করিলেন, “কিন্তু ঈশাহী ধর্ম্মের মত ইহাতে কোন প্রার্থনা আছে কি?” কেহ এই ভাবে আপত্তি তুলিলে স্বামিজী বরাবর তদুত্তরে কোন নিভীক আপাতবিরুদ্ধ কিন্তু অভ্রান্ত মত প্রয়োগ করিতেন এবং তাহার মধ্যে কোন অভিনব এবং অচিন্তিতপূর্ব্ব সামান্যাবিষ্কার নিহিত থাকিত।
প্রশ্নটিকে তিনি তীব্রভাবে সমালোচনা করিতে আরম্ভ করিলেন, “না; আর ঈশাহী ধর্ম্মেও কোনকালে ছিল না। এ ত ছাঁকা প্রটেষ্ট্যান্ট ধর্ম এবং প্রটেস্ট্যান্ট ধর্ম মুসলমানের নিকট হইতে, সম্ভবতঃ মূর জাতির প্রভাবের মধ্য দিয়া, ইহা গ্রহণ করিয়াছিল।
“পৌরোহিত্যের ভাব একেবারে ভূমিসাৎ করিয়া দেওয়া, সেটা একমাত্র মুসলমান ধৰ্ম্মই করিয়াছে। যিনি অগ্রণী হইয়া প্রার্থনা পাঠ করেন, তিনি শ্রোতৃবর্গের দিকে পিছন ফিরিয়া দাড়ান এবং শুধু কোরাণপাঠই বেদী, হইতে চলিতে পারে। প্রটেষ্ট্যান্ট ধৰ্ম্ম এই ভাবটিই আনিতে চেষ্টা করিয়াছে।
“এমন কি, tonsure পর্যন্ত ভারতবর্ষে প্রচলিত ছিল, উহাই আমাদের মুণ্ডন। জাষ্টিনিয়ান্ দুইজন সন্ন্যাসীর নিকট হইতে মুসার যুগে প্রচলিত বিধি-নিষেধ গ্রহণ করিতেছেন, আমি এইরূপ একখানি চিত্র দেখিয়াছি। তাহাতে সাধুদ্বয়ের মস্তক সম্পূর্ণ মুণ্ডিত। বৌদ্ধযুগের প্রাক্কালীন হিন্দুধর্মে সন্ন্যাসী ও সন্ন্যাসিনী দুই-ই বৰ্ত্তমান ছিল। ইউরোপ নিজ ধৰ্ম্মসম্প্রদায়গুলি থিবেইড[২] হইতে পাইয়াছে।”
প্রশ্ন—এই হিসাবে তাহা হইলে আপনি ক্যাথলিক ধর্ম্মের ক্রিয়াকাণ্ডকে আর্য্য ক্রিয়াকাণ্ড বলিয়া স্বীকার করেন?
উত্তর—হাঁ। প্রায় সমগ্র ঈশাহী ধৰ্ম্মই আর্য্যধর্ম্ম বলিয়া আমার বিশ্বাস। আমার মনে হয়, খৃষ্ট বলিয়া কখনও কেহ ছিল না। আমার ক্রীট দ্বীপের অদূরে সেই স্বপ্ন[৩] দেখা অবধি বরাবর এই সন্দেহ। আলেকজান্দ্রিয়ায় ভারতীয় এবং মিসরীয় ভাবের সংমিশ্রণ হয় এবং উহাই য়াহুদী ও যাবনিক (গ্রীক) ধর্ম্মের দ্বারা অনুরঞ্জিত হইয়া জগতে ঈশাহী-ধর্ম্ম নামে প্রচারিত হইয়াছে।
“জানই ত যে, ‘কার্য্যকলাপ’ এবং ‘পত্রাবলী’ (Acts and Epistles) ‘জীবনীচতুষ্টয় (Gospels) হইতে প্রাচীনতর এবং সেণ্ট জন্ একটা মিথ্যা কল্পনা। মাত্র একজন লোক সম্বন্ধে আমরা নিঃসন্দেহ—তিনি সেণ্ট পল। তিনিও আবার স্বচক্ষে ঘটনাগুলি দেখেন নাই এবং তিনি নিজে কার্যক্ষেত্রে যেরূপ দেখাইয়াছেন তাহাতে তাঁহাতে বকধার্ম্মিকত্বেরও (Jesuitry) অসদ্ভাব ছিল না—‘যেমন করিয়া পার আত্মার উদ্ধার কর’—এইরূপ নহে কি?
“না! ধর্ম্মাচার্য্যগণের মধ্যে কেবলমাত্র বুদ্ধ এবং মহম্মদই স্পষ্ট ঐতিহাসিক সত্তারূপে দণ্ডায়মান; কারণ, সৌভাগ্যক্রমে তাঁহারা জীবদ্দশাতেই শত্রু-মিত্র উভয়ই লাভ করিয়াছিলেন। শ্রীকৃষ্ণসন্বন্ধে আমার সন্দেহ আছে; যোগী, গোপ এবং পরাক্রান্ত ভৃপাল—এই সব একত্র হইয়া গীতাহস্তে একখানি নয়নাভিরাম মূর্তির সৃষ্টি করিয়াছে।
“রেনাঁর ঈশাজীবনী ত শুধু ফেনা। ইহা ষ্ট্রসের কাছে ঘেসিতে পারে না, ষ্ট্রসই সাচ্চা প্রত্নতত্ত্ববিৎ। ঈশার জীবনে দুইটি জিনিস জীবন্ত ব্যক্তিগত লক্ষণে ভূষিত—সাহিত্যের সর্ব্বাপেক্ষা সুন্দর উপাখ্যান, ব্যভিচার-অপরাধে ধৃত। সেই রমণী এবং কূপ-পার্শ্ববর্ত্তিনী সেই নারী।
“এই শেষোক্ত ঘটনাটীর ভারতীয় জীবনের সহিত কি অদ্ভুত সুসঙ্গতি! একটী স্ত্রীলোক জল তুলিতে আসিয়া দেখিল, কূপের খারে বসিয়া একজন পীতবাস সাধু তাঁহার নিকট জল চাহিলেন। তার পর তিনি তাহাকে উপদেশ দিলেন এবং তাহার মনের গোটাকয়েক কথা বলিয়া দিলেন, ইত্যাদি ইত্যাদি। শুধু ভারতীয় গল্পে উপসংহারটা এইরূপ হইবে যে, যখন উক্ত নারী গ্রামবাসিগণকে সাধু দেখিতে এবং সাধুর কথা শুনিবার জন্য ডাকিতে যাইল, সেই অবসরে সাধুটী সুযোগ বুঝিয়া পলাইয়া বনমধ্যে আশ্রয় লইলেন।
“মোটের উপর আমার মনে হয়, বুড়ো হিলেল ঠাকুরই (Rabbi Hillel) ঈশার উপদেশাবলির উদ্ভবকর্ত্তা, আর ন্যাজারীন নামধারী এক বহু প্রাচীন (কিন্তু স্বল্পজানিত) য়াহুদী সম্প্রদায় সহসা সেণ্ট পল কর্তৃক যেন বৈদ্যুতিক শক্তিতে অনুপ্রাণিত হইয়া এক পৌরাণিক ব্যক্তিকে পূজাম্পদ বস্তু বলিয়া যোগাইয়া দিয়াছে।
"পুনরুত্থান (Resurrection) জিনিসটা ত বসন্ত-দাহ (Spring Cremation) প্রথারই রূপান্তরমাত্র। যাহাই হউক না কেন, দাহপ্রথা শুধু ধনী যবন (গ্রীক) ও রোমকগণের মধ্যেই প্রচলিত ছিল, আর সূর্য্যঘটিত নব উপাখানটী সেই অল্পসংখ্যক লোকের মধ্যেই উহাকে রহিত করিয়া থাকিবে।
"কিন্তু বুদ্ধ! পৃথিবীতে যত লোক জন্ম গ্রহণ করিয়াছেন তন্মধ্যে তিনিই যে সর্ব্বশ্রেষ্ঠ, এ বিষয়ে অনুমাত্র সন্দেহ নাই। তিনি নিজের জন্য একটীবারও নিঃশ্বাস লয়েন নাই! সর্ব্বোপরি তিনি কখনও পূজা আকাঙ্ক্ষা করেন নাই। তিনি বলিয়াছিলেন, ‘বুদ্ধ কোন ব্যক্তি নহেন, উহা একটী অবস্থাবিশেষ। আমি দ্বার খুঁজিয়া পাইয়াছি। আইস, তোমরা সকলেই প্রবেশ কর।’
“তিনি পাপিনী অন্ত্রপালীর নিমন্ত্রণে গিয়াছিলেন। তিনি অন্ত্যজের গৃহে, উহাতে তাঁহার প্রাণনাশ হইবে জানিয়াও, ভোজন করিয়াছিলেন এবং মৃত্যুকালে তাঁহার অতিথিসৎকারককে এই মহামুক্তি-দানের জন্য ধন্যবাদ দিয়া তাঁহার নিকট লোক পাঠান। সত্যলাভের পূর্ব্বেও একটি ক্ষুদ্র ছাগশিশুর জন্য ভালবাসা ও দয়ায় কাতর! তোমাদের স্মরণ আছে, কিরূপে রাজপুত্র এবং সন্ন্যাসী হইয়াও তিনি নিজ মস্তক পর্য্যন্ত দিতে চাহিয়াছিলেন, যদি রাজা শুধু যে ছাগশিশুটিকে বলি দিতে উদ্যত হইয়াছিলেন সেটিকে মুক্তি দেন, এবং কিরূপে সেই রাজা তাঁহার অনুকম্পার নিদর্শনে মুগ্ধ হইয়া উক্ত ছাগশিশুকে প্রাণদান করেন। জ্ঞানবিচার এবং সহৃদয়তার এরূপ অপূর্ব্ব সংমিশ্রণ আর কোথাও দেখা যায় নাই! নিশ্চয়ই তাঁহার মত আর কেহ যে জন্মেন নাই, এ বিষয়ে দ্বিরুক্তি নাই!”
- ↑ আমরা যে সময় পাণ্ড্রেন্থান দেখি তখন উহাকে কনিষ্কের সমসাময়িক (১৫০ খ্রীষ্টাব্দ) বলিয়া ধরিয়া লইয়াছিলাম। উহা বাস্তবিকই অত পুরাতন কিনা আমি নিশ্চয় করিয়া বলিতে পারি না। —লেখিকা
- ↑ ষ্ট্যাসিউস—প্রণীত থীব্স্-সম্বন্ধীয় ল্যাটিন কাব্য খ্রীষ্টীয় প্রথম শকাব্দীতে রচিত। থীব্স্ প্রাচীন গ্রীসের এক অংশের সমৃদ্ধ রাজধানী ছিল। সিংহাসনার্থী ভ্রাতৃদ্বয়ের যুদ্ধই উক্ত গ্রন্থের বিষয়।
- ↑ ১৮৯৭ খ্রীষ্টাব্দের জানুয়ারী মাসে ভারত–প্রত্যাগমনের পথে নেপল্স্ হইতে পোর্ট সৈয়দ আসিবার সময় স্বামিজী স্বপ্ন দেখেন যে, এক শ্মশ্রুধারী বৃদ্ধ তাঁহার সম্মুখে উপস্থিত হইয়া তাঁহাকে বলিল, “এই ক্রীট দ্বীপ” এবং তিনি যাহাতে পরে উহাকে চিনিতে পারেন, এই জন্য উক্ত দ্বীপের একটী স্থান তাঁহাকে দেখাইয়া দিল। উক্ত স্বপ্নের মর্ম্ম এই ছিল যে, ঈশাহী ধর্ম্মের উৎপত্তি ক্রীট দ্বীপে এবং এতৎম্বন্ধে সে তাঁহাকে দুইটা ইউরোপীয় শব্দ শুনাইল,—তাহাদের মধ্যে একটা থেরাপিউটী’ (Therapeute)—এবং বলিল উভয়ই সংস্কৃতশব্দজ। থেরাপিউটী শব্দের অর্থ—থেরা অর্থাৎ বৌদ্ধ ভিক্ষুগণের পুত্রগণ (পিউটী, সংস্কৃত পুত্র-শব্দজ)। ইহা হইতে স্বামিজী যেন বুঝিয়া লন যে, ঈশাহীধর্ম্ম বৌদ্ধধর্ম্মের একদল প্রচারক হুইতে উদ্ভূত হইয়াছে, ইহাই তাহার অভিপ্রেত ছিল। ভূমির দিকে অঙ্গুলি নির্দ্দেশ করিয়া বৃদ্ধ আরও বলিল, “প্রমাণ সব এখানেই আছে, খুঁড়িলেই দেখিতে পাইবে!”
নিদ্রাভঙ্গে ইহা সামান্য স্বপ্ন নহে অনুভব করিয়া স্বামিজী শয্যাত্যাগ করিলেন এবং বাহির হইয়া ডেকের উপর আসিলেন। সেখানে তিনি, একজন কর্ম্মচারী তাঁহার পাহারা শেষ করিয়া ফিরিয়া আসিতেছেন, দেখিতে পাইলেন। জিজ্ঞাসা করিলেন, “কয়টা বাজিয়াছে? উত্তর হইল, “রাত্রি দ্বিপ্রহর।” পুনরায় জিজ্ঞাসা করিলেন, “আমরা এখন কোথায়?” তখন বিস্ময়বিহ্বল চিত্তে উত্তর শুনিলেন, ক্রীটের পঞ্চাশ মাইল দূরে।”
এই স্বপ্ন তাঁহার উপর যেরূপ প্রবল প্রভাব বিস্তার করিয়াছিল, তাহা দেখিয়া আচার্য্যদেব নিজেই নিজেকে হাস্যাস্পদ জ্ঞান করিতেন। কিন্তু তিনি কখনও ইহাকে দূর করিয়া দিতে পারেন নাই। শব্দদ্বয়ের মধ্যে দ্বিতীয়টী যে হারাইয়া গিয়াছে, ইহা বড়ই পরিতাপের বিষয়। স্বামিজী স্বীকার করিলেন যে, এই স্বপ্ন দেখিবার পূর্ব্বে কখনও তাঁহার ঈশা চরিত্রের সম্পূর্ণ ঐতিহাসিক সত্যতা বিষয়ে সন্দিহান হইবার খেওয়ালই হয় নাই। কিন্তু আমাদের স্মরণ রাখা উচিত যে, হিন্দু দর্শন-মতে ভাববিশেষের সর্ব্বাঙ্গসম্পূর্ণতাই আসল জিনিস, ইহার ঐতিহাসিক প্রামাণিকতা নহে। স্বামিজী বাল্যকালে একদা শ্রীরামকৃষ্ণকে এই বিষয়েই প্রশ্ন করিয়াছিলেন। তাঁহার গুরুদেব উত্তর দেন, “যাঁহাদের মাথা হইতে এমন সব জিনিস বাহির হইয়াছে তাঁহারা যে তাহাই ছিলেন, এ কথা কি তোমার মনে হয় না?”—লেখিকা