স্বামিজীর সহিত হিমালয়ে/বিতস্তাতীরে পাদচারণা ও কথোপকথন
নবম পরিচ্ছেদ
বিতস্তাতীরে পাদচারণা ও কথোপকথন
ব্যক্তিগণ: শ্রীমৎ স্বামী বিবেকানন্দ এবং কতিপয় ইউরোপীয় নরনারী, ধীরা মাতা, জয়া এবং নিবেদিতা তাঁহাদের অন্যতম।
স্থান: কাশ্মীর।
সময়: ১৮৯৮ খ্রীষ্টাব্দের ১৯শে হইতে ২৯শে জুলাই পর্য্যন্ত।
২০শে জুলাই। পরদিন আমরা অবন্তীপুরের বৃহৎ মন্দিরদ্বয়ের ধ্বংসাবশেষের নিকট উপস্থিত হইলাম। প্রতি ঘণ্টায় যেমন আমরা একটু একটু করিয়া ভিতরে প্রবেশ করিতে লাগিলাম অমনি নদীটী এবং পর্বতগুলিও অধিকতর সুন্দর দেখাইতে লাগিল। শস্যক্ষেত্র, বৃক্ষরাজি এবং তত্রত্য অধিবাসিগণের (আমরা তাহাদিগকে সম্পূর্ণরূপে স্বজন বলিয়া বোধ করিতেছিলাম) অব্যবহিত আকর্ষণের মধ্যে অবস্থিত থাকিয়া আমরা যে মধ্য এসিয়ার একটী নদীর উৎপত্তিস্থলের সমীপবর্ত্তী হইতেছি, তাহা মনেই পড়িত না। যাঁহারা যে কোনও ঋতুতে কাশ্মীর দেখিয়াছেন, তাঁহাদের মনে কালিদাসের বসন্ত-কাননের চিত্র রাশি রাশি সুখস্মৃতি জাগাইয়া দেয়।—সেই বন্য চেরিমুকুলের এবং বাদাম ও আপেল গাছের অপূর্ব্ব সৌন্দর্য্য, সেই অরণ্যানী—তাহারই এক দেবদারুমূলে ধূর্জ্জটী আসীন এবং গিরিরাজকুমারী উমা একগাছি পদ্মবীজের মালা অর্ঘ্যস্বরূপে হস্তে লইয়া প্রবেশ করিতেছেন; আর অদূরে কুসুমধনুঃশর লইয়া মনোহর কিশোর কন্দর্প দণ্ডায়মান। ইংলণ্ডের বসন্তের যে কিছু দেবদুর্লভ শোভা, অথবা Easterএর সময় নর্ম্যাণ্ডির অরণ্যের যে কিছু সৌন্দর্য্য, সবই কাশ্মীর উপত্যকার মাধুর্য্যে একত্রীভূত এবং বহু গুণে বর্ধিত।
সে দিন প্রাতঃকালে নদী প্রশস্ত, অগভীর এবং নিৰ্ম্মল ছিল। আমাদের দুইজন স্বামিজীর সহিত নদীর ধারে ধারে ক্ষেত্রের উপর দিয়া প্রায় তিন মাইল বেড়াইয়াছিলেন। স্বামিজী প্রথমে পাপবোধ সম্বন্ধে কথা আরম্ভ করিলেন—কিরূপে উহা মিসর, শেমবংশাধিষ্ঠিত জনপদসমূহ এবং আর্য্যভূমি এই তিনেরই সহিত সংশ্লিষ্ট। বেদে ইহার নিদর্শন পাওয়া যায়, কিন্তু উহা অতি অল্পক্ষণের জন্য। বেদে সয়তানকে ক্রোধের অধীশ্বর বলিয়া বর্ণনা করা হইয়াছে। পরে বৌদ্ধদের মধ্যে উহা কামের অধীশ্বর মার নামে পরিচিত, এবং ভগবান্ বুদ্ধের একটী সৰ্ব্বজনপ্রিয় নাম ‘মারজিৎ’। (সংস্কৃত অভিধান অমরকোষ দেখ—স্বামিজী উহা চারি বৎসর বয়সে আধ আধ ভাষায় আবৃত্তি করিতে শিখিয়াছিলেন!) কিন্তু সয়তান যেমন বাইবেলের হ্যামলেট্, হিন্দুশাস্ত্রে ক্রোধের অধীশ্বর কখনও সেরূপে সৃষ্টিকে দুই ভাগ করিয়া ফেলে না। সে সর্ব্বদাই পবিত্রতাভ্রংশের উদাহরণস্থল, কদাপি দ্বিত্বের নহে।
জরাতুষ্ট্র কোন প্রাচীনতম ধর্ম্মের সংস্কারক ছিলেন। তাঁহার মতে অর্ম্মাজ্দ্ এবং আহ্রিমান্ পর্য্যন্ত সৰ্ব্বশ্রেষ্ঠ নহে, তাঁহারা সর্ব্বশ্রেষ্ঠ দেবের বিকাশমাত্র। সেই প্রাচীনতর ধর্ম বৈদান্তিক না হইয়া যায় না। সুতরাং মিশরীয়গণ এবং শেমবংশধরগণ পাপবাদ ছাড়িতে চাহে না, আর আর্য্যগণ–যথা ভারতবাসী এবং যবনগণ—শীঘ্রই উহা হারাইয়া ফেলে। ভারতবর্ষে ন্যায়পরতা এবং পাপ, বিদ্যা ও অবিদ্যায় পরিণত হইল—উভয়কেই ছাড়াইয়া যাইতে হইবে। আর্য্যগণের মধ্যে পারসিক এবং ইউরোপীয়গণ ধৰ্ম্মচিন্তাংশে শেষবংশধরগণের লক্ষণাক্রান্ত হইল; এই হেতুই তাহাদের মধ্যে পাপবোধ।[১]
তৎপরে পুনরায় কথাবার্তার ভাব বদলাইয়া গেল এবং কেবল হাসিঠাট্টা, কৌতুক এবং গল্পগুজব চলিতে লাগিল। আমরা শুনিতে শুনিতে হাসিয়া অধীর হইতেছিলাম। এমন সময়ে নৌকা আসিয়া পৌঁছিল এবং সে দিনের মত কথাবার্ত্তা শেষ হইল।
সে-দিনকার সমস্ত বৈকাল এবং রাত্রি স্বামিজী পীড়িত হইয়া নিজ নৌকায় শুইয়াছিলেন। কিন্তু পরদিন যখন আমরা বিজবেহার মন্দিরে অবতরণ করিলাম—ইতোমধ্যেই তথার অমরনাথযাত্রীর ভিড় লাগিয়া গিয়াছে—তখন তিনি আমাদের সহিত কিয়ৎক্ষণের জন্য মিলিত হইতে সক্ষম হইয়াছিলেন। ‘শীঘ্র সারিয়া উঠা এবং শীঘ্র অসুখে পড়া’—চিরকালই তাঁহার বিশেষত্ব ছিল, একথা তিনিও নিজের সম্বন্ধে বলিতেন। উহার পর, দিবসের অধিকাংশ সময়ই তিনি আমাদের সহিত ছিলেন এবং অপরাহ্ণে আমরা ইাস্বামবাদ পৌঁছিলাম।
একটি আপেল-বাগানের ধারে নৌকাগুলি লাগান হইল। জলের কিনারা পর্য্যন্ত ঘাস জন্মিয়াছে, আর ময়দানের উপর আপেল, নাসপাতি এবং আলুবোখারা গাছ পর্য্যন্ত। ইতস্ততঃ ছড়াইয়া রহিয়াছে। এই সব গাছ হিন্দুরাজগণ প্রতি গ্রামের বহির্দ্দেশে রোপণ করা আবশ্যক মনে করিতেন। আমাদের মনে হুইল যে, বসন্তকালে এই স্থলটী নিশ্চয়ই আভিলিয়নের সেই দ্বীপ-উপত্যকারই প্রতিরূপ হইবে–“যেখানে শিলা, বৃষ্টি বা তুষারপাত হয় না, বায়ুও কদাপি সশব্দে প্রবাহিত হয় না, তথায় দুঃখ নাই, উহাতে গভীর ক্ষেত্র, রমণীয় ফলোদ্যান এবং শূন্যগর্ভ নিকুঞ্জসমূহ বর্তমান এবং উহা নিদাঘ্সাগরকিরীটী।”[২]
আমাদের মধ্যে দুইজন যে বজরাখানিতে থাকিতেন, তাহাকে অতদূর লইয়া যাইতে না পারায় উহা নদীর এক অতি গভীর এবং খরস্রোত অংশে দুই উচ্চ বেড়ার মধ্যে আসিয়া থামিল। উভয় পার্শ্বে নবীন ধান্যের অপরূপ হরিৎশোভা দেখিতে দেখিতে এক প্রান্ত হইতে অপর প্রান্ত পর্যন্ত পপ্লার-বীথীর মধ্য দিয়া পাদচারণা কি মনোরম বোধ হইতেছিল!
সেই দিন বৈকালে গোধূলির সময় একজন আপেল গাছগুলির তলায় উপবিষ্ট ক্ষুদ্র দলটীর মধ্যে আসিয়া দেখিলেন, যাহা ক্বচিৎ কখনও ঘটিবার সম্ভাবনা, তাহাই ঘটিয়াছে—আচার্য্যদেব ধীরা মাতা ও জয়ার সহিত নিজের সম্বন্ধে কথাবার্তা কহিতেছেন। তিনি দুই টুক্রা পাথর হাতে লইয়া বলিতেছিলেন, “সুস্থাবস্থায় আমার মন এটা ওটা সেটা লইয়া থাকিতে পারে, অথবা আমার সঙ্কল্লের জোর কমিয়া গিয়াছে মনে হইতে পারে, কিন্তু এতটুকু যন্ত্রণা বা পীড়া আসুক দেখি, ক্ষণিকের জ্যও আমি মৃত্যুর সাম্না-সাম্নি হই দেখি, অমনি আমি এই রকম শক্ত হইয়া যাই”–বলিয়া পাথর দুখানিকে পরস্পর ঠুকিলেন—“কারণ আমি ঈশ্বরের পাদপদ্ম স্পর্শ করিয়াছি।” এই চিত্তস্থৈর্য্য-প্রসঙ্গে স্বামিজীর ইংলণ্ডে ক্ষেতের উপর দিয়া একদিনের ভ্রমণের কথা একজনের মনে পড়িল। সে দিন একজন ইংরেজ পুরুষ, একজন ইংরেজ রমণী এবং তাঁহাকে এক ক্রুদ্ধ বৃষ তাড়া করিয়াছিল। ইংরেজ-পুরুষটী সটান দৌড় দিলেন এবং নিরাপদে পাহাড়ের অপর প্রান্তে গিয়া পৌঁছিলেন। স্ত্রীলোকটী যতদূর পারিলেন দৌড়াইয়া গেলেন; পরে আর এক পাও চলিবার সামর্থ্য না থাকায় মাটীতে বসিয়া পড়িলেন। ইহা দেখিয়া এবং তাঁহাকে সাহায্য করিতে অপারগ হইয়া স্বামিজী “আরে, যে দিক দিয়া হউক, পরিণাম ত এই”–এইরূপ ভাবিয়া বাহুদ্বয় বক্ষের উপর তির্যক্ভাবে রাখিয়া এবং রমণীকে পশ্চাতে রাখিয়া বৃষের সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইলেন। তিনি পরে বলিয়াছিলেন যে, তখন তাঁহার মন ষাঁড়টা তাঁহাকে কতটা দূরে নিক্ষেপ করিতে পারিবে এতৎ-সম্বন্ধে এক গণিতের হিসাব লইয়া ব্যস্ত ছিল। কিন্তু পশুটা হঠাৎ কয়েক পা দূরে থামিয়া গেল, তার পর মাথা তুলিয়া বিষণ্ণভাবে রণে ভঙ্গ দিল।
এইরূপ সাহস—যদিও তাঁহাকে এই সব ঘটনা মনে আনিতে দেখি নাই—তাঁহার বাল্যকালে আর একবার দেখা গিয়াছিল: কলিকাতার রাস্তায় একটা গাড়ীর ঘোড়া ছুটিয়া পলাইতেছিল, তিনি বিনা বাক্যব্যয়ে নিকটে যাইয়া উহাকে ধরিলেন, তাহাতে সে যে গাড়ীখানায় সংলগ্ন ছিল তাহার আরোহী স্ত্রীলোকটী প্রাণে বাঁচিল।
গাছগুলির নীচে ঘাসের উপর বসিয়া আমরা নানাকথা কহিতে লাগিলাম এবং দু-এক ঘণ্টা আধা-হাল্কা আধা-গম্ভীর কথাবার্ত্তা চলিল। বৃন্দাবনে বানরগুলা কিরূপ দুষ্টামি করিতে পারে, তাহার অনেক বর্ণনা শুনিলাম এবং আমরা খোঁচাইয়া খোঁচাইয়া জানিতে পারিলাম যে স্বামিজীর পরিব্রাজক জীবনে দুইটী বিভিন্ন ঘটনায় বিপদে যে সাহায্য আসিতেছে তাহা পূৰ্ব্ব হইতে তিনি জানিতে পারিয়াছিলেন এবং ভবিষ্যৎ দর্শন সত্য হইয়াছিল। ইহাদের মধ্যে একটী আমার মনে আছে। সম্ভবতঃ যে সময়ে তিনি অজগরব্রত অবলম্বন করিয়াছিলেন, ইহা সেই সময়কার ঘটনা। তিনি কয়েক দিন (হয়ত পাঁচ দিন) ধরিয়া কিছু খাইতে পান নাই। ভিনি এক রেলষ্টেশনে ক্লান্তিতে মৃতকল্প হইয়া পড়িয়া ছিলেন, এমন সময়ে সহসা তাঁহার মনে হইল যে, তাঁহাকে উঠিয়া কোন একটী রাস্তা দিয়া যাইতে হইবে, আর সেখানে তিনি একজন লোকের দেখা পাইবেন, সে তাঁহাকে সাহায্য করিবে। তিনি তদনুসারে কার্য্য করিলেন এবং এক থালা খাবার হাতে একজন লোকের দেখা পাইলেন। এই ব্যক্তি তাঁহার নিকটে আসিরা তাঁহাকে ভাল করিয়া নিরীক্ষণ করিল এবং জিজ্ঞাসা করিল, “যাঁহার নিকট আমি প্রেরিত হইয়াছি, আপনিই কি তিনি?”
তৎপরে একটি শিশু আমাদিগের নিকট আনীত হইল, তাহার হাত খুব কাটিয়া গিয়াছে। স্বামিজীও বৃদ্ধামহলে প্রচলিত একটা ঔষধ প্রয়োগ করিলেন—তিনি ক্ষতস্থানটী জল দিয়া ধুইয়া দিয়া রক্তপড়া বন্ধ করিবার জন্য এক টুক্রা কাপড় পোড়াইয়া তাহার ছাই উক্ত স্থানে চাপাইয়া দিলেন। গ্রামবাসিগণ আশ্বস্ত হইয়া শান্ত হইল এবং সেই রাত্রির মত আমাদের গল্প-গুজব বন্ধ হইল।
২৩শে জুলাই। পরদিন প্রাতঃকালে হরেক রকমের একদল কুলি আমাদিগকে মার্ত্তণ্ড-মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ দেখাইতে লইয়া যাইবার জন্য আপেল গাছগুলির নীচে একত্র হইয়াছিল। মার্তণ্ড-মন্দির এক অদ্ভুত প্রাচীন সৌধ ছিল। উহাতে স্পষ্টই মন্দিরের অপেক্ষা মঠের লক্ষণ অধিক ছিল। উহা এক অপূর্ব্ব স্থানে অবস্থিত এবং যে সকল বিভিন্ন যুগের মধ্য দিয়া উহা শ্রীবৃদ্ধিলাভ করিয়াছিল, তাহাদের বিভিন্ন নির্ম্মাণপদ্ধতির স্পষ্ট একত্র সমাবেশ-প্রযুক্তই উহা অতীব দর্শনীয় বস্তু হইয়াছিল। অপরাহ্ণে সূর্য্যকে পশ্চিমদিকে আমাদের ঠিক পশ্চাতে রাখিয়া যখন আমরা উহাতে প্রবেশ করিলাম, তখন সাম্নের থিলানশ্রেণীর অধোভাগে যে গাঢ় কৃষ্ণবর্ণ ছায়া পড়িয়াছিল তাহা আমি কখনও ভুলিতে পারিব না। একটীর পর একটী করিয়া তিনটী খিলান এবং তাহাদের সবচেয়ে পিছনকারটীর ভিতরেই উচ্চতার দুই-তৃতীয়াংশে এক গুরুভার সরলরেখাবিশিষ্ট বাতায়নশীর্ষ। সব খিলানগুলিই ত্রিপত্রাকার ছিল, কিন্তু মাত্র প্রথম ও দ্বিতীয়টীতেই আমরা উহা টের পাইয়াছিলাম, কারণ উহাদিগকে আমরা প্রবেশমুহূর্ত্তেই দেখিতে পাইয়াছিলাম। স্পষ্টতঃ পুণাকুণ্ডসকলের ধারে ভারী প্রস্তরখণ্ডনির্ম্মিত তিনটী আয়তাকার মন্দিররূপেই স্থানটীর প্রথম সূত্রপাত হইয়াছিল। এই তিনটি প্রকোষ্ঠের নির্ম্মাণপদ্ধতি সব সরলরেখাবিশিষ্ট (straight-lined) এবং উগ্রদর্শন (severe) ছিল। তিনটীর মধ্যে মাঝখানের এবং সর্ব্বাপেক্ষা পূর্ব্বদিকেরটী লইয়া কোনও পরবর্ত্তী রাজা ইহার চারি ধারে একটী দেয়ালের বেষ্টনী নির্ম্মাণ করিয়াছিলেন। আসল মন্দিরটীতে কোনরূপ হস্তক্ষেপ না করিয়া তিনি প্রত্যেক অনুচ্চ সরদালবিশিষ্ট দুয়ারে বাহিরের দিকে এক একটি ত্রিপত্রখিলান স্থাপন করিয়াছিলেন এবং তৎপরে ইহার সহিত সম্মুখভাগে একটি বৃহত্তর মন্দিরাংশ (Nave) জুড়িয়া দিয়াছিলেন। এক উচ্চ ত্রিপত্রখিলান তাহার প্রবেশমার্গ হইয়াছিল। প্রত্যেক সৌধ এত সর্ব্বাঙ্গসুন্দর এবং এই দুই নিৰ্ম্মাণযুগের উদ্দেশ্য এরূপ স্পষ্ট ছিল যে, অঙ্গসংস্থান দেখিয়া নিরবচ্ছিন্ন আনন্দ হইল, আর ইহা অঙ্কিত না করিয়া একজন ক্ষান্ত হইতে পারিল না। মধ্যস্থলের মন্দিরটির চারিপাশের ধর্ম্মশালা অথবা বারান্দাটি আকৃতিতে অদ্ভুতরূপে গথ-জাতীয় (Gothic) এবং যিনি উহা ও ভারতের উত্তরাংশে মুসলমান-রাজবংশীয় সমাধিগুলি দেখিয়াছেন, তাঁহার নিকট তৎক্ষণাৎ ইহাই মনে হয় যে, উক্ত বারান্দাটি একটা পুরা মঠ হিসাবেই কল্পিত হইয়াছিল এবং আমাদের (ইংরেজদের) শীতপ্রধান দেশে উহা ঐ উদ্দেশ্যে রাখা যাইতে না পারিলেও, উহার অস্তিত্ব সন্ন্যাসের আদিম বাসভূমি যে প্রাচ্য তাহাই দিবারাত্র স্মরণ করাইয়া দিতেছে। ক্ষণমাত্র বিলম্ব না করিয়াই স্বামিজী অবেক্ষণ ও উদ্দেশ্য-নিরূপণে যারপরনাই ব্যস্ত হইলেন এবং দেখাইয়া দিলেন যে, মন্দিরাভ্যন্তরে প্রবেশ করিবার মার্গ হইতে উহার মধ্যাংশের ভিতর দিয়া পশ্চিম দিকে যে কার্ণিশ চলিয়া গিয়াছে তাহার উপরিভাগে পূর্ব্বোক্ত খিলান দুইটির উচ্চ ত্রিপত্র, আবার একটি friezeও বর্ত্তমান; আবার দেবশিশুমূর্তি-বিশিষ্ট প্যানেলগুলি আমাদিগকে দেখাইয়া দিলেন। আমাদের দেখা শেষ হইবার পূর্ব্বেই তিনি দুইটি মুদ্রা কুড়াইয়া পাইয়াছিলেন। সূর্য্যাস্তের আলোতে অশ্বপৃষ্ঠে প্রত্যাবর্ত্তন অতীব রমণীয় হইয়াছিল। পূর্ব এবং পরদিনে যে সকল কথোপকথন হইয়াছিল তাহাদের কিছু কিছু অংশ এখনও মনে পড়িতেছে।
“কোন জাতই, তা যবনই (Greek) হউন বা অন্য কোন জাতিই হউন, কোন কালে জাপানীদের ন্যায় স্বদেশপ্রেমের পরাকাষ্ঠা দেখাইয়া যান নাই। তাঁহারা কথা লইয়া থাকেন না, তাঁহারা কাজে করেন—দেশের জন্য সর্ব্বস্ব বিসর্জ্জন দেন। আজকাল জাপানে এমন সব জমিদার আছেন যাঁহারা সাম্রাজ্যের একত্ব-বিধানকল্পে বিনা বাক্যব্যয়ে তাঁহাদের জমিদারী ছাড়িয়া দিয়া কৃষিজীবী হইয়াছেন।[৩] আর জাপানযুদ্ধে একটিও বিশ্বাসঘাতক পাওয়া যায় নাই। একবার সেটা ভাবিয়া দেখ!”
আবার কতকগুলি লোক ভাবপ্রকাশে অক্ষম—এই কথা-প্রসঙ্গে বলিলেন, “আমি বরাবর লক্ষ্য করিয়াছি যে, লাজুক ও চাপা লোকেরা উত্তেজিত হইলে সবচেয়ে বেশী আসুরিকভাবাপন্ন হইয়া থাকে।”
আর একবার, সন্ন্যাসজীবনের ও ব্রহ্মচর্য্যের বিধিনিদেশ-প্রসঙ্গে স্পষ্টই বলিয়াছিলেন, “যম্মাদ্ভিক্ষুর্হিরণ্যং রমেন গ্রাহ্যং চ স আত্মহা ভবেৎ”—যে সন্ন্যাসী সকামভাবে সুবর্ণ গ্রহণ করে, সে আত্মঘাতী ইত্যাদি।
২৪শে জুলাই। অন্ধকারময়ী রাত্রি এবং অরণ্যানী, দ্রুমরাজিতলে এক বৃহৎ সরল (pine) কাষ্ঠের অগ্নিকুণ্ড, দুই তিনটি তাঁবু অন্ধকারের মধ্যে শ্বেতকায় লইয়া দণ্ডায়মান, দূরে অগ্নিকুণ্ডপার্শ্বে উপবিষ্ট ভৃত্যগণের আক্বতি ও কণ্ঠস্বর এবং তিনজন শিষ্য সমভিব্যহারে আচার্যদেব–পরবর্ত্তী চিত্রটি এইরূপই। আপেল বাগানের নীচে দিয়া এবং মাঠের ধার দিয়া বেরনাগ যাইবার যে রাস্তা চলিয়াছে তাহার সম্বন্ধে, সেই মুষলধারে বৃষ্টি এবং বহুক্লেশোপার্জিত সূর্য্যকিরণে মধ্যাহ্নের কিছু পূর্ব্বে জলযোগ সম্বন্ধে এবং সরলবনসমাবৃত পাহাড়গুলির পাদদেশে অবস্থিত অষ্টভুজসরোবর বিশিষ্ট জাহাঙ্গীরের সেই বহু প্রাচীন রাজপ্রাসাদ সম্বন্ধে অনেক কথাই বলিতে পারা যায়। কিন্তু মধ্যাহ্নের পর যখন অবিরাম সারি বাঁধিয়া অর্ঘ্যহস্তে সমাগত দর্শক ও পূজার্থিগণ সকলে চলিয়া গেল এবং দীর্ঘকাল অপেক্ষার পর যখন আমরা ব্যতীত আর কেহ রহিল না—তখনকার সেই সময়টাই সেই দিনের মুকুটস্থানীয়। সহসা আচার্য্যদের আমাদের মধ্যে একজনের দিকে ফিরিয়া বলিলেন, “কই, তুমি ত আজকাল তোমার ইস্কুলের কোনও কথা বল না, তুমি কি মাঝে মাঝে উহার কথা ভুলিয়া যাও?” পরে বলিতে লাগিলেন, “দেখ, আমার ভাবিবার ঢের জিনিস রহিয়াছে। একদিন আমি মান্দ্রাজের দিকে মন দিই, আর সেখানকার কাজের কথা ভাবি। আর একদিন আমি সব মনটা আমেরিকা বা ইংলণ্ড, বা সিংহল, অথবা কলিকাতায় দিই। এক্ষণে আমি তোমার ইস্কুলের কথা ভাবিতেছি।”
ঠিক সেই সময়েই আচার্য্যদেব মধ্যাহ্ন-ভোজনের জন্য আহূত হইয়া উঠিয়া গেলেন এবং তিনি ফিরিয়া আসিলে পর তবে, তিনি যে সব কথা খুলিয়া জানিতে চাহিয়াছিলেন তাহা তাঁহাকে বলিবার সুযোগ মিলিয়াছিল।পরীক্ষা করিয়া দেখিবার নিমিত্ত একটি অস্থায়ী কার্য্য-প্রণালী যে অনেক চিন্তার পর স্থিরীকৃত হইয়াছে, উহার প্রারম্ভ যে সামান্য হইবে এবং সমন্বয় ও উদারতার ভাব অতিক্রম করিয়া সমগ্র শিক্ষাদানচেষ্টাটীকে যে ধর্ম্মজীবনের এবং শ্রীরামকৃষ্ণপূজার উপর প্রতিষ্ঠিত করিবার দৃঢ়সঙ্কল্প হইয়াছে—এই সমস্ত কথা তিনি মনোযোগের সহিত শুনিলেন।
তিনি বলিলেন, “কারণ তুমি উর্জ্জিত উৎসাহ বজায় রাখিবার জন্যই সাম্প্রদায়িক ভাব আশ্রয় করিবে, নয় কি? সমস্ত সম্প্রদায়ের পারে চলিয়া যাইবার জন্য তুমি একটী সম্প্রদায় সৃষ্টি করিবে। হাঁ, আমি বুঝিতে পারিয়াছি।”
কতকগুলি বাধা স্পষ্টতঃ থাকিবেই থাকিবে। নানা কারণে প্রস্তাবিত আয়তনে হয়ত অনুষ্ঠানটী প্রায় অসম্ভব শুনায়। কিন্তু এই মুহূর্ত্তে শুধু এইটুকু লক্ষ্য রাখিতে হইবে যেন অনুষ্ঠানটী ঠিক ঠিক ভাবে সঙ্কল্প করা হয় এবং কার্য্যপ্রণালী নির্দ্দোষ হইলে উপায়উপকরণাদি জুটিবেই জুটিবে।
সব শুনিয়া তিনি একটু চুপ করিয়া রহিলেন, পরে বলিলেন, “তুমি আমাকে ইহার সমালোচনা করিতে বলিতেছ, কিন্তু তাহা আমি করিতে পারিব না। কারণ আমি তোমাকে ঐশী শক্তিতে অনুপ্রাণিত—আমি যতটা অনুপ্রাণিত ঠিক ততটা অনুপ্রাণিত—বলিয়া মনে করি। অন্যান্য ধর্ম্মে এবং আমাদের ধর্ম্মে এইটুকুই প্রভেদ। অন্যান্য ধৰ্ম্মাবলম্বিগণ বিশ্বাস করেন যে, ঐ সকল ধর্ম্মের সংস্থাপকগণ ঐণী শক্তিতে অনুপ্রাণিত, আমরাও তাহাই করিয়া থাকি। কিন্তু আমিও ত তাহাই—তিনিও যতটা অনুপ্রাণিত আর তুমিও আমারই মত, আবার তোমার পরে তোমার বালিকারা ও তাহাদের শিষ্যাগণও তদ্রূপ হইবে। সুতরাং তুমি যাহা সর্ব্বাপেক্ষা ভাল বলিয়া বিবেচনা করিতেছ, আমি তাহাই করিতে তোমাকে সাহায্য করিব।”
তৎপরে ধীরা মাতা এবং জয়ার দিকে ফিরিয়া, যে শিষ্যাটি স্ত্রীগণের উন্নতি-বিধানকল্পে দণ্ডায়মানা হইবেন তাঁহার উপর তিনি পাশ্চাত্ত্যদেশে গমনকালে যে কি মহান্ দায়িত্ব অর্পণ করিয়া যাইবেন তৎসম্বন্ধে এবং উহা যে পুরুষগণের জন্য যে কাৰ্য অনুষ্ঠিত হইবে তদপেক্ষা গুরুতর দায়িত্বপূর্ণ হইবে, এ বিষয়ে তাঁহাদিগকে বলিতে লাগিলেন। এবং আমাদের মধ্যে উক্ত সেবিকাটির (worker) দিকে ফিরিয়া আরও বলিলেন, “হাঁ, তোমার বিশ্বাস আছে, কিন্তু তোমার যে জ্বলন্ত উৎসাহ দরকার তাহা তোমার নাই। তোমাকে ‘দন্ধেন্ধনমিবানলম্’ হইতে হইবে। শিব। শিব!”—এই বলিয়া মহাদেবের আশীর্ব্বাদ প্রার্থনা করিয়া তিনি আমাদিগের নিকট রাত্রির মত বিদায় লইলেন এবং আমরাও অনতিবিলম্বে শয়ন করিলাম।
২৫শে জুলাই। পরদিন প্রাতঃকালে আমরা তাঁবুগুলির মধ্যে একটিতে সকাল সকাল প্রাতরাশ সম্পন্ন করিয়া অচ্ছাবল পৰ্যন্ত চলিলাম। আমাদের মধ্যে একজন স্বপ্ন দেখিয়াছিলেন যে, কতকগুলি পুরাতন রত্ন হারাইয়া গিয়াছিল, সেগুলি পুনরায় পাওয়া গিয়াছে, তখন তাহাদের সবগুলিই উজ্জ্বল ও নূতন হইয়া গিয়াছে। কিন্তু স্বামিজী ঈষৎ হাস্য করিয়া এই গল্প বলা বন্ধ করিয়া দিলেন এবং বলিলেন, “অমন ভাল স্বপ্নের কথা বলিতে নাই!”অচ্ছাবলে আমরা জাহাঙ্গীরের আরও অনেক বাগান দেখিতে পাইলাম। তাঁহার প্রিয় বিশ্রামস্থান এইখানেই ছিল, না বেরীনাগে?
আমরা বাগানগুলির চারিধারে বেড়াইলাম এবং পাঠান খাঁর জেনানার সম্মুখে একটী স্থির জলাশয়ে স্নান করিলাম। পরে আমরা প্রথম বাগানটীতে মধ্যাহ্নের পূর্ব্বের জলযোগ সম্পন্ন করিলাম এবং বৈকালে অশ্বপৃষ্ঠে ইসলামাবাদে নামিয়া আসিলাম।
উক্ত জলযোগকালে যখন সকলে বসিয়াছিলাম তখন স্বামিজী তাঁহার কন্যাকে তাঁহার সঙ্গে অমরনাথ গুহায় যাত্রা করিবার এবং তথায় মহাদেবের চরণে উৎসৃষ্ট হইবার জন্য নিমন্ত্রণ করিলেন। ধীরা মাতা সহাস্যে অনুমতি দিলেন এবং পরবর্ত্তী অর্দ্ধঘণ্টা উল্লাস ও আনন্দ-জ্ঞাপনে অতীত হইল। ইতঃপূর্ব্বেই বন্দোবস্ত হইয়াছিল যে, আমরা সকলেই পহলগাম পর্য্যন্ত যাইব এবং সেখানে স্বামিজীর তীর্থযাত্রা হইতে প্রত্যাবর্ত্তন পর্যন্ত অপেক্ষা করিব। সুতরাং আমরা সেইদিন সন্ধ্যার সময় নৌকাগুলিতে পৌঁছিয়া জিনিস-পত্র গুছাইয়া লইলাম এবং পত্রাদি লিখিলাম। পরদিন বৈকালে বওয়ান যাত্রা করিলাম।
- ↑ যাঁহারা এই সকল কথা শুনিতেছিলেন তাঁহাদের মধ্যে একজন পরে দুইজন পার্শীকে সানন্দে স্বামিজীর পাদমূলে বসিয়া তাঁহার মুখে নিজ নিজ ধর্ম্মভাবসমূহের ইতিহাস শ্রবণ করিতে দেখেন। ইহাতে তিনি স্বামিজীর জ্ঞানের পরিসর ও যথাযথত্ব হৃদয়ঙ্গম করিবার অপূর্ব্ব সুযোগ পাইয়াছিলেন।—নিবেদিতা
- ↑ টেনিসনের Morte d′ Arthur নামক কবিতা হইতে।
- ↑ আমার মনে হয়, ইহা একটী ভ্রন। জাপানী সামুরাইগণ তাঁহাদের জমিদারী ছাড়িয়া দেন নাই, তাঁহাদের রাজনৈতিক বিশেষ বিশেষ অধিকারগুলি ছাড়িয়া দিয়াছিলেন মাত্র।—নিবেদিত।