হনুমানের স্বপ্ন ইত্যাদি গল্প/রাতারাতি

রাতারাতি

হরে আবার ছেলেধরার উপদ্রব শুরু হইয়াছে। বিকালে বংশলোচনবাবুর বৈঠকখানায় তাহারই কথা হইতেছে। বংশলোচনের ভাগনে উদয় মহা উৎসাহে হাত নাড়িয়া বলিতেছে —‘আজকের খবর শুনেছেন? পঞ্চাশটা ছেলে হারিয়েছে। কাল পঁচাত্তরটা। কিন্তু আশ্চর্য এই, যারা নিরুদ্দেশ হচ্ছে তাদের নামধাম কেউ টের পায় না। এদিকে লোকে খেপে উঠেছে, মোটর গাড়ি পোড়াচ্ছে, রাস্তার মানুষকে ধ’রে ধ’রে ঠেঙাচ্ছে, পুলিস কিছুই করিতে পারছে না। ওঃ, হুলস্থূল ব্যাপার!’

 বংশলোচনবাবু বলিলেন —‘কাগজে কি লিখেছে?’

 তাঁহার শালা নগেন বলিল ‘এই শুনুন না, আজকের ধূমকেতু খুব জোর লিখেছে। আমরা জানিতে চাই দেশের এই অরাজক অবস্থার জন্য দায়ী কে। অজ্ঞ লোকে রটাইতেছে বালি ব্রিজের বনিয়াদ পোক্ত করিবার জন্য দশ হাজার ছেলে পুঁতিবে। বিজ্ঞ লোকে বলিতেছেন ছেলেরা সংসারে বীতরাগ হইয়া বানপ্রস্থ অবলম্বন করিতেছে। কাহার কথা বিশ্বাস করিব? দেশনেতৃগণ এখন দলাদলি বন্ধ রাখুন, গভর্নমেণ্ট উঠিয়া পড়িয়া লাগুন, আমরা তারস্বরে প্রশ্ন করিতেছি তাহার উত্তর দিন কোন্ দুরাত্মা দেশমাতৃকাকে সন্তানহারা করিতেছে?’

 বংশলোচনের ছোট ছেলে ঘেণ্টু বলিল— ‘বাবা, ছেলেধরা বাবা ধরে? বল না বাবা?’

 উকিল বিনোদবাবু বলিলেন—‘তেমন তেমন বাবা হ’লে ধরে বই কি। কিন্তু তুমি ভেবো না খোকা, আমরা রক্ষা করব।’

 বৃদ্ধ কেদার চাটুজ্যে মহাশয় নিবিষ্ট হইয়া তামাক খাইতেছিলেন। নগেন তাঁহাকে বলিল— ‘চাটুজ্যে মশায়, আপনি সাবধানে চলাফেরা করবেন।’

 বংশলোচন। উনি তো প্রবীণ লোক, ওঁকে ধরবে কেন?

 নগেন। মনেও ভাববেন না তা। চ্যবনপ্রাশ খাইয়ে তরুণ বানাবে, তারপর চালান দেবে।

 উদয় সভয়ে বলিল ‘তরুণদেরই ধরছে বুঝি?’

 চাটুজ্যে হুঁকা রাখিয়া বলিলেন ‘উদো, তুই কি রকম লেখাপড়া শিখেছিস দেখি। জোয়ান যুবক আর তরুণ এদের মধ্যে তফাত কি বল্ তো।’

 উদয়। জোয়ান হচ্ছে যার গায়ে খুব জোর। যুবক মানে যুবা, যাকে বলে ইয়ং ম্যান। তরুণ হ’ল গিয়ে মানে যাকে বলে— দাঁড়ান, অভিধান দেখে বলছি—

 চাটুজ্যে। অভিধানে পাবি না, আজকাল মানে বদলে গেছে। আমি অনেক ভেবে চিন্তে যা বুঝেছি শোন্। যাঁর দাড়ি গোঁপ দু-ই আছে তিনি হলেন জোয়ান, যেমন রবি ঠাকুর, পি সি রায়। যার দাড়ি নেই শুধুই গোঁপ তিনি যুবক, যেমন আশু মুখুজ্যে, গান্ধীজী। আর যাঁর দাড়িও নেই গোঁপও নেই তিনি তরুণ, যেমন বঙ্কিম চাটুজ্যে, শরৎ চাটুজ্যে আর এই কেদার চাটুজ্যে।

 উদয়। আর আমি? নগেন মামা?

 চাটুজ্যে। তোরা হলি ওই তিনের বার, যাকে বলে অপোগণ্ড। ধরতে হয় তোদেরই ধরবে।

 উদয় চিন্তা করিয়া বলিল—‘আমি দাড়ি রাখতুম, কিন্তু বউ বলে’

 নগেন। খবরদার উদো, ফের যদি বউএর কথা পাড়বি তো কান ম’লে দেব।

 চাকর আসিয়া বংশলোচনের হাতে একটা টেলিগ্রাম দিয়া গেল। বংশলোচন দেখিয়া বলিলেন- ‘এ যে চাটুজ্যে মশায়ের নামে তার!’

 চাটুজ্যে। আমাকে তার করলে কে? দেখ তো প’ড়ে কি ব্যাপার।

 বংশলোচন। কার্তিক মিসিং—

 উদয়। অ্যাঁ, বলেন কি?

 বংশলোচন। চরণ ঘোষ টেলিগ্রাম করছেন মজিলপুর থেকে কাত্তিককে পাওয়া যাচ্ছে না, পুলিসে খবর দিতে বলছেন। পাঁচটার ট্রেনে চরণবাবু নিজেও আসছেন। ছ-টা তো বেজে গেছে, তা হ’লে এসে পড়লেন ব’লে। ওঁর কাছে সব শুনে পুলিসে খবর দেওয়া যাবে। কাত্তিকটি কে?

 চাটুজ্যে। চরণের বড় ছেলে, এখানে হস্টেলে থেকে পড়ে, প্রতি শনিবারে দেশে যায়। এখন তো কলেজ বন্ধ, মজিলপুরেই তার থাকবার কথা।

 নগেন। কাত্তিককে চুরি করবে এমন ছেলেধরা জন্মায় নি। ও সব বাজে খরব।

 চাটুজ্যে। চিনিস নাকি কাত্তিককে?

 নগেন। বিলক্ষণ চিনি, আমার সেজো শালা বাঁটলোর সঙ্গে এক ক্লাসে পড়ে। বিখ্যাত ছোকরা, শিশুকাল থেকেই বেশ চৌকস। যখন দশ বৎসর বয়েস তখন সে তার বান্ধবীদের বলত মেয়েগুলো আবার মানুষ! মাথায় এক গাদা চুল, আবার ফিতে বাঁধা, আবার শুধু শুধু দাঁত বার ক’রে হাসে। মারতে হয় এক ঘুষি! তারপর চোদ্দ বছর বয়সে সে তার প্রাণের বন্ধু বাঁটলোকে লিখলে— নারীর প্রেম? কখনই নয়। ভাই বাঁটলু, এ জগতে কারও থাকবার দরকার নেই, শুধু তুমি আর আমি। কিন্তু দু বছর যেতে না যেতে তার যৌবননিকুঞ্জের পাখি কা কা ক’রে উঠল। কাত্তিক তার কবিতার খাতায় লিখলে—নারী, বুঝিতে না পারি কবে, একান্ত আমারি তুমি হবে, কত দিনে ওগো কত দিনে, পারছি নে আর পারছি নে।

 বংশলোচন। এ সব তো ভাল কথা নয়। চাটুজ্যে মশায়, চরণবাবু ছেলের বিয়ে দেন না কেন?

 চাটুজ্যে। বলেছি তো অনেকবার, কিন্তু চরণ বড় একগুঁয়ে। অন্য বিষয়ে সেকেলে হ’লেও ছেলের বিয়ে দেবার বেলায় সে একেলে। বলে, লেখাপড়া সাঙ্গ করুক, রোজগার করুক, তার পর বিয়ে। তবে কাত্তিকের জন্যে কনে ঠিক করাই আছে, চরণের বাল্যবন্ধু রাখাল সিংগির মেয়ে। তের-চোদ্দ বছর আগে দুই বন্ধুতে কথা স্থির হয়। তার পর রাখালবাবু মারা গেলেন, কিছুকাল পরে তাঁর স্ত্রীও গত হলেন, মেয়েটার ভার নিলে তার মামা। মামা শুনেছি কোথাকার জজ, সম্প্রতি রিটায়ার করেছেন।

 নগেন। রাখাল সিংগির মেয়ে তো? কাত্তিক কখ‍্খনো তাকে বিয়ে করবে না, সে মেয়ে নাকি জংলী ভূত।

 এমন সময় চরণ ঘোষ আসিয়া পৌঁছিলেন। প্রৌঢ় ভদ্রলোক, মাথায় একটি ছোট টিকি, কাঁচা-পাকা ছাঁটা গোঁপ, গলায় কণ্ঠি, এক হাতে ছাতা, অন্য হাতে ছোট ব্যাগ। চরণ হাঁপাইতে হাঁপাইতে বলিলেন ‘পাজী হতভাগা!’

 চাটুজ্যে। তা হ’লে ছেলের খোঁজ পেয়েছ? দুর্গা দুর্গতিনাশিনী।

 চরণ। বকাটে মিথ্যুক ছুঁচো!

 চাটুজ্যে। বিপত্তৌ মধুসুদনম্, ভগবান রক্ষা করেছেন।

 চরণ। ব্যাটা আমার লেখাপড়া শিখছেন!

 বংশলোচন। চরণবাবু, একটু শান্ত হ’ন।

 চাটুজ্যে। আরে রাগ পরে ক’রো এখন। খবর কি আগে বল।

 চরণ। খবর আমার মাথা। এখন কলেজ বন্ধ, গুড ফ্রাইডের ছুটি, কার্তিক ক-দিন আমার কাছেই ছিল, আমরাও নিশ্চিন্ত, মজিলপুরে তো আর ছেলেধরার উপদ্রব নেই। কাল সকালে বললে ফিলসফির খান-দুই বই বাঁটলোর কাছে রয়েছে, কলকাতায় গিয়ে নিয়ে আসি। আমি বললুম যাবি আর আসবি, দুপুরের গাড়িতে ফিরে আসা চাই। বেলা শেষ হয়ে গেল কিন্তু কাত্তিক ফিরল না, রাত্রি কাবার হ’ল তবু ছেলের খবর নেই। তার মা কান্নাকাটি শুরু করলেন, কারণ পরশু নাকি কলকাতায় তেষট্টিটা ছেলে চুরি গেছে। অগত্যা তোমায় একটা জরুরী তার করে দিলুম, তারপর বিকেলের গাড়িতে চ’লে এলুম। প্রথমেই গেলুম বাঁটলোদের ওখানে। তার ছোট ভাই শাঁটলো বললে—বাঁটলো আর কাত্তিক কজন বন্ধুর সঙ্গে ওভারটুন হলে বক্তৃতা শুনতে গেছে। কিন্তু বাঁটলোর বোন বললে শোনেন কেন, সব মিথ্যে কথা, বাবুরা অ্যাংলোমোগলাই হোটেলে খেতে গেছেন, তার পর যাবেন সিনেমায়, তার পর অনেক রাত্রে ফিরে এসে দরজায় ধাক্কা লাগাবেন। হতভাগা, এই তোর ফিলসফির বই আনতে যাওয়া! এখন ছোঁড়াটাকে খুঁজে বার করি কি করে?

 বিনোদ। খবর যখন পেয়েছেন তখন আর খোঁজবার দরকার কি। ছেলে কলকাতায় এসেছে একটু ফুর্তি করতে, যথাকালে বাড়ি যাবে।

 চরণ। ফুর্তি বার করব। হতভাগা এখানে এসেছে ইয়ারকি দিতে, আর আমরা ভেবে মরছি। কান ধ’রে হিঁচড়ে টেনে নিয়ে যাব। চাটুজ্যে, চল।

 চাটুজ্যে। যাব কোথায়?

 নগেন। ধর্মতলার মোড়ে অ্যাংলো-মোগলাই। ট্যাকসিতে চ’ড়ে সোজা চ’লে যান দশ মিনিটে পৌঁছবেন।

 চরণ ঘোষ ও চাটুজ্যে মহাশয় বাহির হইলেন।


অ্যালো-মোগলাই হোটেলটি ছোট কিন্তু সুবিখ্যাত। আলোয় গন্ধে কলরবে ভরপুর। খোপে খোপে নানা লোক খাইতেছে, কেহ একলা, কেহ সদলে। দরজার পাশে একটা ডেস্কের সামনে ম্যানেজার কখনও বসিয়া কখনও দাঁড়াইয়া চারিদিকে নজর রাখিতেছে এবং মাঝে মাঝে হাঁকিতেছে—তিন নম্বরে এক প্লেট কোর্মা, ছ নম্বরে দুটো চা, চারটে কাটলেট শিগ‍্গির, পাঁচ নম্বরে আরো দুটো ডেভিল ইত্যাদি।

 চরণ ঘোষ ও চাটুজ্যে প্রবেশ করিলেন। চাটুজ্যে চুপি চুপি বললেন—‘আস্তে, চেঁচিও না— ঐ যে বাবাজীরা ঐখানে খাচ্ছেন।’

 চরণ ঘোষ নাক টিপিয়া বলিলেন ‘রাধামাধব, এমন জায়গায় ভদ্রলোক আসে। যতসব রাক্ষস জুটে অখাদ্য খাচ্ছে।’

 চাটুজ্যে। আরে চুপ চুপ। বেচারাদের অপরাধ নেই, হাজার বছর ধ’রে শুনে এসেছে এটা খেয়ো না, ওটা খেয়ো না। এখন যখন ভগবান সুবুদ্ধি আর সুবিধে দিয়েছেন তখন জন্মজন্মান্তরের অতৃপ্তি চটপট মিটিয়ে নিতে হবে। আহা, এদের ভোজন সার্থক হ’ক। এই যে এরা বাঘের মত গবগব ক’রে খাচ্ছে সেই সঙ্গে যেন বাঘের সদ্‌গুণও কিছু পায়। এদের গায়ে গত্তি লাগুক, মনে সাহস হ’ক, খোঁচা দিলে যেন খ্যাঁক করে নির্ভয়ে তেড়ে যেতে পারে।

 ম্যানেজার বলিল—‘আপনারা দাঁড়িয়ে রইলেন কেন, ওই দু নম্বরে বসুন দয়া করে।’

 চাটুজ্যে ঠোঁটে আঙুল দিয়া বলিলেন— ‘চুপ, আস্তে আস্তে।’

 ম্যানেজার সহাস্যে বলিল ‘লজ্জা কি মোসাই, এখানে কত বুড়ো থুথুড়ে জজ মেজিষ্টর মহামহোপাধ্যায় পায়ের ধুলো দেন। আপনারা বরঞ্চ পর্দাটা টেনে দিয়ে বসুন। কি খাবেন মোসাই?’

 চাটুজ্যে। অ, এখানে বুঝি অম্‌নি বসা যায় না?

 ম্যানেজার। হেঁ-হেঁ। খান-দুই কাটলেট দেব কি? অ্যাংলো-মোগলাইএর নবতম অবদান —মুবগির ফ্রেঞ্চ মালপো, কচি ভাইটো-পাঁটার ইষ্টু —দেখুন না একটু ট্রাই ক’রে।

 চাটুজ্যে। না বাপু, অবদান খাবার আর বয়স নেই।

 ম্যানেজার চরণ ঘোষের টিকি আর কষ্টি লক্ষ্য করিয়া বলিল —‘ঠাকুরমোসাই, আপনাকে খান-দুই ডবল ডিমের রাধাবল্লভি দেবে কি?’

 চরণ। দেবে আমার মাথা। ডাক ঐ রাক্ষসটাকে।

 ম্যানেজার। রাক্ষস-টাক্ষস এখানে পাবেন না মোসাই, সব জেণ্টেলম্যান।

 চাটুজ্যে। আরে কর কি চরণ, চুপ চুপ। নিজের ছেলেবেলার কীর্তিকলাপ সব ভুলে গেলে? সেই যে কাববের ঠোঙা নিয়ে গাব গাছে চ’ড়ে খেতে আর কোকিল ডাকতে তা কি মনে নেই? এখন না-হয় গোঁসাই মহারাজের কাছে মন্তর নিয়ে কণ্ঠি ধারণ করেছ, মাংসের গন্ধে কানে আঙুল দাও। ছেলের খাওয়া শেষ হ’ক, তার পর একটু আধটু ধমক দিও। আপাতত এদিকে চুপটি ক’রে ব’স, একটু শরবত খেয়ে ঠাণ্ডা হও, আর শ্রীমানরা কি আলোচনা করছেন তাই আড়ি পেতে শোন, বিস্তর জ্ঞান লাভ করবে। যদি কিছু অশ্রাব্য অলৌকিক কথা কর্ণগোচর হয় তখন না-হয় গলা খাঁকার দিয়ে আত্মপ্রকাশ করা যাবে। ওহে ম্যানেজার, দুটো ঘোল দাও তো।

 কার্তিক এবং তাহার তিন বন্ধু বাঁটলো গোপাল ও ঘনেন কিছু দূরে একটা পর্দার আড়ালে বসিয়া আছে। তাহাদের খাওয়া শেষ হইয়াছে, এখন তর্ক চলিতেছে।

 গোপাল। আইডিয়াল একটা চাই বই কি, নয়তো লাইফটা কমনপ্লেস মনোটোনস হয়ে পড়ে। আইডিয়াল হচ্ছে মাইণ্ডের জুস, তাতেই জীবন সরস থাকে।

 ঘনেন। মানলুম না। আইডিয়াল মানুষকে করে স্লেভ টু অ্যান আইডিয়া। আমি চাই ভ্যারাইটি, নো কমিটমেণ্ট। লোথারিওর সেই লাইনটা কি রে? টু পিক্‌ অ্যাণ্ড চূজ, প্লে ফাস্ট অ্যাণ্ড লূজ—তার পর কি যেন। বাঁটলো, তোৱ আইডিয়াল আছে নাকি?

 চরণ ঘোষ চুপি চুপি বলিলেন—‘এ সব কী বলছে হে চাটুজ্যে? কিছু বুঝতে পারছি না।

 চাটুজ্যে। চুপ চুপ।

 কার্তিক টেবিল চাপড়াইয়া বলিল —‘আইডিয়াল টাইডিয়াল বুঝি না। আমি চাই বাস্তবের একটা সিন‍্থেসিস —এমন নারী, যে বল্লরী বাঁড়ুজ্যের মতন রূপসী, মিসেস চৌবের মতন সাহসী, জিগীষা দেবীর মতন লেখিকা, মেজদির ননদের মতন রসিকা, লোটি রায়ের মতন গাইয়ে, ফাখ‍্তা খাঁএর মতন নাচিয়ে।’

 চাটুজ্যে বলিলেন ‘ব্বাস রে! এমন তিলোত্তমা আমাদের চোদ্দ পুরুষ কখন দেখে নি। চরণ, আর কথাটি নয়, বাবাজীকে এই অঘ্রান মাসেই ঝুলিয়ে দাও, নইলে বেচারা বাড়ি-বাড়ি হ্যাংলা দিষ্টি দিয়ে বেড়াবে।’

 চরণ ঘোষ লাফাইয়া উঠিয়া বলিলেন —‘দাঁড়াও, হ্যাংলাপনা ঘুচচ্ছি। এই কাত্তিকে, হতভাগা ইষ্টুপিড ছুঁচো, কি কচ্ছিস এখানে? ছেলে আমার লেখাপড়া শিখছেন! অধঃপাতে যাচ্ছেন! যত সব বকাটে ছোঁড়াদের সঙ্গে ’

 ঘনেন। খবরদার মশায় মুখ সামলে কথা কইবেন।

 চরণ। ছুঁচোটাকে পই পই ক’রে বললুম—যাবি আর আসবি। সন্ধ্যে হয়ে গেল, ছেলের দেখা নেই। রাত্তির কাবার হ’ল, ছেলে আর আসে না। ছেলেধরার খপ‍্পরেই প’ড়ল, না মোটর চাপা প’ড়ল, না পুলিসে ধ’রে নিয়ে গেল—কিছুই জানি না। বাড়ির সবাই ভেবে অস্থির, গর্ভধারিণী কেঁদেকেটে শয্যাশায়ী, আর ছেলে আমার হোটেলে ব’সে ইয়ারকি দিচ্ছেন! হতভাগা ছুঁচো ইষ্টুপিড। এই তোদের ইউনিভার্সিটির শিক্ষে? কি হয় সেখানে? যত সব জোচ্চোর মিলে ছেলেদের মাথা খায়। আর অধঃপাতের আড‍্ডা হয়েছে এই হোটেল, যত বেহায়া ছেলে বুড়ো জুটে গোগ্রাসে গোস্ত গিলছে। এই বাঁটলোটা হচ্ছে দলের সদ্দার বিশ্ববকাট, ওই গোপ‍্লাটা হচ্ছে জ্যাঠার চূড়ামণি, আর এই ঘনাটা একটা আস্ত বাঁদর।

 কার্তিক ঘাড় হেঁট করিয়া গালাগালি হজম করিতে লাগিল, কিন্তু বন্ধুরা রুখিয়া উঠিল। হোটেলের ম্যানেজার আস্তিন গুটাইতে লাগিল।

 বাঁটলো ছেলেটি অতি মিষ্টভাষী ও বিনয়ী। সে খুব মোলায়েম করিয়া বলিল ‘দেখুন চরণবাবু, নিজের ছেলেকে আপনি যা খুশি বলতে পারেন, কিন্তু আমরা কি করি না করি আপনার পিতার তাতে কি?’

 ম্যানেজার বলিল ‘জানেন, আপনাকে পুলিসে দিতে পারি?’

 চরণ ঘোষ ভেংচাইয়া বলিলেন— ‘দাও না দেখি।’

 ম্যানেজার। জানেন, এটা হচ্ছে অ্যাংলো-মোগলাই কেফ?

 বাঁঁটলো ভুল উচ্চারণ বরদাস্ত করিতে পারে না। বলিল ‘কেফ নয়, কাফে।’

 ম্যানেজার। ওই হ’ল। জানেন, এটা হেঁজিপেঁজি জায়গা নয়, এটা একটা রেস্‌পেক্‌টেবেল রেষ্টাউরেণ্ট?

 বাঁটলো। রেস্তোরাঁ।

 ম্যানেজার। এক-ই কথা। জানেন, এটা হচ্ছে শিক্ষিত লোকের রেণ্ডেজভোঁশ?

 বাঁটলে। রাঁদেভু।

 বার বার বাধা পাইয়া ম্যানেজার চটিয়া উঠিল। বলিল —‘আরে থাম ডেঁপো ছোকরা। ডেভিল মামলেট কোপ্তা কোর্মা দেরাই বেচে বুড়িয়ে গেলুম, আর ইনি এলেন উরুশ্চারণ শেখাতে।’

 বাঁটলো। গর্জন করিয়া বলিল ‘খদ্দেরকে অপমান? টেক কেয়ার, তোমার হোটেল বয়কট করব, কেবল কুকুরের ঠ্যাং আর সাপের চর্বি চালাচ্ছ।’

 ঘরের এক কোণে একটি বৃদ্ধ ভদ্রলোক বসিয়াছিলেন। ইনি একজন নীরব কর্মী, দুই প্লেট কোর্মা চুপচাপ শেষ করিয়া এখন রাই-সরিষা ও নেবুর রস দিয়া টোমাটো খাইতেছিলেন। বাঁটলোর কথায় চমকাইয়া উঠিয়া বলিলেন —‘কী ভয়ানক, সেইজন্যই তো আমি ওসব খাওয়া ছেড়ে দিয়েছি, কেবল জোচ্চুরি, ভাইটামিনের নামগন্ধ নেই।’

 হোটেলের ভোক্তার দল আতঙ্কে চঞ্চল হইয়া উঠিল। অনেকে খাওয়া ফেলিয়া উঠিয়া পড়িল। কেহ বলিল— ‘অ্যা, কুকুরের ঠ্যাং!’ কেহ বলিল ‘সর্বনাশ, ভাইটামিন নেই!’ ম্যানেজার ব্যস্ত হইয়া করজোড়ে বলিতে লাগিল—‘বসুন মোসাই বলুন, ওসব মিথ্যে কথায় কান দেবেন না আমার কি ধর্মভয় নেই!’

 চাটুজ্যে মহাশয় উঠিয়া চারিদিকে চাহিয়া বলিলেন—‘মহাশয়রা যদি অনুমতি দেন তো আমি ভাইটামিন সম্বন্ধে দু-চারটে কথা নিবেদন করি।’

 কয়েকজন প্রবীণ ভদ্রলোক চোপ চোপ করিয়া ধমক দিয়া গণ্ডগোল থামাইয়া দিলেন। তাহার পর চাটুজ্যে মহাশয়ের দিকে চাহিয়া বলিলেন ‘হাঁ, তার পর মশায়, ভাইটামিনের কথা কি বলছিলেন?’

 চাটুজ্যে বলিতে লাগিলেন—‘বাল্যে দুগ্ধ, যৌবনে লুচি-পাঁঠা, বার্ধক্যে একটু নিমঝোল আর প্রচুর হরিনাম —এই হ’ল আমাদের প্রাচীন শাস্ত্রসম্মত পথ্য। কিন্তু অ্যাদ্দিনে আমরা জানতে পেরেছি যে ওসব কেবল উদর পূরণের উপাদান মাত্র, ভাইটামিনই হচ্ছে আসল জিনিস, ভবনদীতে ভাসবার একমাত্র ভেলা, শিশু যুবা বৃদ্ধ সকলের পক্ষেই। অতএব ভাইটামিন যদি চান তো কাঁটাল খান।’

 টোমাটো-ভোজী বাবুটি বলিলেন —কাঁটাল?’

 চাটুজ্যে। আজ্ঞে হাঁ, কাঁটাল। কবি লিখেছেন—আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি, তোমার আকাশ তোমার বাতাস আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি, মরি হায় হায় রে। এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবেন নাকো মশায়। এই ধরুন, হিমালয় পর্বত, যার জোড়া দুনিয়ায় নেই। তার পর ধরুন রয়াল বেঙ্গল টাইগার কে লড়বে তার সঙ্গে সিংহ? সাধ্য কি। তার পর ধরুন কাঁটাল।

 টোমাটো-ভোজী। কাঁটাল কি একটা ফল হ’ল মশায়?

 চাটুজ্যে। আজ্ঞে হাঁ, বটানি প’ড়ে দেখবেন। ফলের রাজা হচ্ছে কাঁটাল, দু-মন পর্যন্ত ওজন হয়, আবার কাঁটালের রাজা ওতরপাড়ার বঞ্জুলবাবুদের গাছের রসখাজা। এক-একটি কোয়া এক-এক পো, কাঁচা সোনার বর্ণ, ভাইটামিনে টইটম্বুর। গালে দিয়ে বার-পাঁচেক এদিক ওদিক চালিয়ে রস অনুভব করুন, তার পর চক্ষু বুজে একটু চাপ দিন, অবলীলাক্রমে গন্তব্য স্থানে পৌঁছে যাবে। কোথায় লাগে আপনাদের কালিয়া কোপ্তা কোর্মা।

 টোমাটো-ভোজী। কোন্ ক্লাসের ভাইটামিন মশায়, —এ বি সি না ডি?

 চাটুজ্যে। এ-বি-সি-ডি, বি-এল-এ-ব্লে, সাই ফক্স মেট্ এ হেন্ যা বলেন, ডাক্তারী শাস্ত্রে কোনও বারণ নেই। হেন বস্তু নেই যা কাঁটালে পাবেন না। গুঁড়ি চিকন, তক্তা হবে, হোগ‍্নি কাঠ তার কাছে তুচ্ছ। পাতা পাকিয়ে নিন, হুঁকোয় পরাবার উত্তম নল হবে। আর ফলের তো কথাই নেই। কোলে তুলে নিয়ে বাজান, পাখওয়াজের কাজ করবে। কাঁচার কালিয়া খান, যেন পাঁঠা। বিচি পুড়িয়ে খান, যেন কাবুলী মেওয়া। পাকা কোয়ার রস গ্রহণ করে ছিবড়েটা চরকায় চড়িয়ে সুতো কাটুন, বেরোধে সিল্ক।

 টোমাটো-ভোজী মুখ বাঁকাইয়া বলিলেন ‘ননসেন্স।’

 চাটুজো। বিশ্বাস হ’ল না বুঝি? তবে মরুন ঐ কাঁচা টোমাটো খেয়ে। আমরা চললুম, নমস্কার। ওঠ হে চরণ।

 ম্যানেজার। ও মোসাই, দুটো ঘোলের দাম দিলেন না?

 চাটুজো। আরে মোলো, আবার দাম চায়? এত বড় একটা কুরুক্ষেত্র থামিয়ে দিলুম সেটা বুঝি কিছু নয়? আচ্ছা বাবা, নাও এই সিকি।

 চাট্টজো মহাশয় চরণ ঘোষকে একটু আড়ালে টানিয়া আনিয়া বলিলেন —‘ছেলেকে ধমক তো ঢের দিয়েছ, এইবার মিষ্টি কথায় শান্ত ক’রে ডেকে নিয়ে যাও। বাবা কাত্তিক, এস তো এদিকে একবার।’

 চরণ ঘোষ বলিলেন—‘শোন্‌ কাত্তিক, এই অঘ্রান মাস তোর বিয়ে দেব। সেই রাখাল সিংগির মেয়ে নেড়ী, ছোটবেলায় তাকে দেখেছিলি, মনে আছে তো?

 কার্তিক মুখ ভার করিয়া বলিল ‘নেড়ী-টড়ীকে আমি বিয়ে ক’রব না।’

 চরণ ঘোষ আবার খেপিয়া উঠিয়া বলিলেন ‘করবি না কি রকম? তোর ঘাড় ধ’রে বিয়ে দেব, অবাধ্য ইষ্টুপিড!’

 চাটুজ্যে। আ হা হা, কর কি চরণ, তোমার কিছু আক্কেল নেই? এই কি বিয়ের কথা বলবার সময়, না জায়গা? যাও, তুমি আর মিছে দেরি ক’রো না, ন-টার ট্রেন এখনও পাবে। কাত্তিক আজ বাঁটলোদের বাড়িতে থাকবে। বাবা কাত্তিক, তোমার সঙ্গে দুটো কথা আছে।

 চরণ ঘোষ গজগজ করিতে করিতে প্রস্থান করিলেন কার্তিক ও তাহার তিন বন্ধুর সঙ্গে চাটুজ্যে মহাশয় রাস্তায় আসিলেন।


নেন বলিল ‘এ অপমান কখনই সহ্য করা যায় না, আমরা বানের জলে ভেসে এসেছি নাকি? কাত্তিক, তোর বাপকে এক্ষুনি উকিলের চিঠি দে, পাঁচ-শ টাকার ড্যামেজ। মকদ্দমায় আমরা সাক্ষী হব।’

 গোপাল। বাপের নামে নালিশ দেখায় খারাপ, হাজার হ’ক বাপ তো বটে। বরং খবরের কাগজে ছাপিয়ে দে, সমস্ত ছেলের দল খেপে উঠবে, বাছাধন টের পাবেন।

 ঘনেন। উঁহু, তার চেয়ে জিগীষা দেবীর কাছে চল, তাঁকে ব’লে ক’য়ে আমরা একটা আশ্রম খুলব। কাগজে ছাপাব এস কে কোথায় আছ বাংলার ছেলেরা, নির্যাতিত উৎপীড়িত অসহায় বুভুক্ষু—

 বাঁটলো। ঐ সঙ্গে একটা মেয়েদের বিভাগও খোলা উচিত; কি বলিস কাত্তিক?

 কার্তিক করুণ স্বরে বলিল ‘বাঁটলো, হাইড্রোসায়ানিক অ্যাসিডের দাম কত রে?’

 বাঁটলো। বিস্তর দাম, তার চেয়ে কেরাসিন তেল ঢের সস্তা, দশ পয়সাতেই কাজ সাবাড়।

 কার্তিক। কিন্তু বড‍্ড জ্বালা করবে যে?

 বঁটিলো। সে কতক্ষণ? একবার মরতে পারলে মোটেই টের পাবি না।

 চাটুজে। মহাশয় কার্তিকের গায়ে হাত বুলাইয়া বলিলেন ‘ছি বাবা কাত্তিক, দুঃখু ক’রো না। একে বাপ, তায় বয়সে বড়, বললেই বা একটু কড়া কথা। বাপের সুপুত্তুর হ’লে সব দেবতা খুশী হন। এই দেখ, রামচন্দ্র পিতৃ-আজ্ঞায় বনে গিয়াছিলেন।’

 ঘনেন। জব্দও হয়েছিলেন তেম্‌নি। মাথায় জটা, গায়ে জামা নেই, পায়ে জুতো নেই, চোদ্দ বছর ভ্যাগাবণ্ড্, বউ গেল চুরি। চল্ রে কাত্তিক, আমরা একবার জিগীষা দেবীর বাড়ি গিয়ে তাঁর বাণী নিয়ে আসি।

 চাটুজ্যে। এত রাত্রে কেন আর তাঁকে বিরক্ত করা, তার চেয়ে এখন নিজের নিজের বাড়ি গিয়ে ঘুমও গে। বাণী নিতে হয় কাল নিও।

 ঘনেন। কোথায় রাত, এই তো সবে সাড়ে আটটা। আর করলাবাগান ফার্স্ট লেন তো পাশেই।

 চাটুজ্যে। আচ্ছা চল বাবা। বড়োদের রাজত্ব শেষ হয়েছে, এখন ছোকরাদের পিছু পিছু দৌড়নোই বুদ্ধিমানের কাজ।

 ঘনেন। আপনি আবার কি করতে যাবেন।

 বাঁটলো। চলুন না উনিও, একজন মুরুব্বী লোক ডেপুটেশনে থাকা ভাল।


জিগীষা দেবীর বসিবার ঘরটি ছোট। মাঝে একটিটেবিল, তাহার পাশে গোটা কয়েক চেয়ার এবং একটা বেঞ্চ। ছেলেরা এবং চাটুজ্যে মহাশয় ঘরে প্রবেশ করিলে নাকে ঝুমকো পরা একজন নেপালী দাসী তাঁহাদের সম্মুখে দাঁড়াইল।

 বাঁটলো বলিল ‘চাটুজ্যে মশায়, আপনি হচ্ছেন আমাদের দলের সর্দার, দিন আপনার কার্ড পাঠিয়ে।’

 চাটুজ্যে। কার্ড-ফার্ড আমার কোনও কালে নেই। ওগো ঝি, মাইজীকে গিয়ে খবর দাও কেদার চাটুজ্যে আর চার জন ছোকরা মোলাকাত করনে মাংতা।

 ঘনেন। ছোকরা নয়, বলুন তরুণ।

 চাটুজ্যে। হাঁ হাঁ, বোলো চারঠো তরুণ আর একঠো বুড‍্ঢা মাইজীর সাথ দেখা করেগা।

 দাসী চোখ কুঁচকাইয়া জিজ্ঞাসা করিল ‘মেম-সাবকা সাথ?’

 চাটুজ্যে। হাঁরে বাপু, জিঘাংসা দেবী।

 ঘনেন ধমকাইয়া বলিল ‘জিগীষা দেবী। চাটুজ্যে মশায়, আপনার ভীমরতি ধরেছে, ভদ্রমহিলার সামনে অসভ্যতা করবেন দেখছি।’

 চাটুজ্যে। দেখ্ ঘনা, তুই আমার কাছে সভ্যতার বড়াই করিস না। কটা মহিলা দেখছিস্ তুই? জানিস, আমার তিন খুড়শাশুড়ী, চার শালাজ, সাত শালী আর গিন্নী তো আছেনই, এই চল্লিশ বৎসর তাঁদের সঙ্গে কারবার ক’রে আসছি?

 দাসী খবর দিতে গেল। বাঁটলো বলিল—‘চাটুজ্যে মশায়, আপনি আমাদের ডেপুটেশনের মুখপাত্র, আমাদের বক্তব্যটা আপনিই বেশ গুছিয়ে বলবেন। ঘাবড়ে যাবেন না তো?’

 চাটুজ্যে। ঘাবড়াবার ছেলে কেদার চাটুজ্যে নয়।

 জিগীষা দেবী ঘরে প্রবেশ করিলেন। রাশভারি মহিলা, দশাসই চেহারা, পাউডারের প্রলেপ ভেদ করিয়া সুগোল মুখের নিবিড় শ্যামকান্তি উঁকি মারিতেছে। কালিদাস যদি দেখিতেন তো লিখিতেন—খড়িপড়া ছাঁচি কুমড়া ইব।

 জিগীষা দেবী বলিলেন ‘আমাকে এখনি একটা কমিটি-মিটিংএ যেতে হবে, আপনারা একটু তাড়াতাড়ি বক্তব্য শেষ করলে বাধিত হব।’

 বাঁটলো। বলুন চাটুজ্যে মশায়।

 চাটুজ্যে মহাশয় গলা সাফ করিয়া আরম্ভ কবিলেন—‘মা-লক্ষ্মী, এই যে দেখছেন চার জন ছোকরা, এরা হচ্ছে চারটি তরুণ। এটির নাম কাত্তিক, হীরের টুকরো ছেলে। এর বাপ চরণ ঘোষের হচ্ছে পিত্তির ধাত, তাই মেজাজটা একটু তিরিক্ষি। দু-সন্ধ্যে ত্রিফলার জল খায়, কিন্তু কিছুই হয় না। চরণ ঘোষ কাত্তিককে বলেছে ছুঁচো, তাতে এঁরা

 ঘনেন তাহার নোটবুক দেখিয়া বলিল —‘তিন বার ছুঁচো বলেছে।’

 চাটুজ্যে। ঠিক, তিন বারই ছুঁচো বলেছে বটে। তাতে এই বাবাজীরা সকলেই বড় মর্মাহত হয়েছেন। আমরা ছেলেবেলায় বাপ-জ্যাঠার গালাগাল বিস্তর খেয়েছি, সোনাপারা মুখ ক’রে সমস্ত সয়েছি। কিন্তু সে দিন আর নেই মশায়। তখন এই কলকাতায় ঘোড়ার ট্রাম চ’লত, ছেলেরা গোঁপ রাখত, কোটের ওপর উড়ুনি ওড়াত, মেয়েরা নোলক পরত আর নাইবার ঘরে লুকিয়ে গান গাইত, গবরমেণ্টকে লোকে তখন বলত সদাশয় সরকার বাহাদুর। যাক সে কথা। এখন আমি বলি কি—বাপ যদি ছেলেকে ছুঁচো ব’লেই থাকে তাতে ক্ষতিটা কি। ছুঁচো ভগবানের সৃষ্ট জীব, বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডে তার একটা মহৎ উদ্দেশ্য নিশ্চয়ই আছে। ছুঁচো তুচ্ছ প্রাণী নয়, ইঁদুরের চাইতে তার স্বভাব ভাল, মুখশ্রী ভাল, বুদ্ধিও বেশী। ইঁদুর সম্বন্ধে কবি বলেছেন— কাঠ কাটে বস্ত্র কাটে কাটে সমুদয়, কিন্তু ছুঁচোর এ বদনাম কেউ দিতে পারবে না। কি বলেন মা-লক্ষ্মী?

 জিগীষা দেবী ভ্রূ কুঞ্চিত করিয়া বলিলেন—‘তরুণের দলে আপনি কেন?’

 চাটুজ্যে মহাশয় একটু চিন্তা করিয়া উত্তর দিলেন— ‘সে একটা সমস্যা বটে, কিন্তু কথা হচ্ছে কি জানেন, আমি একজন প্রবীণ তরুণ।’

 বঁটিলো। ওঁর বয়স হয়েছে বটে, কিন্তু মনটি একদম কাঁচা।

 জিগীষা দেবী কিন্তু খুশী হইলেন না। চাটুজ্যে মহাশয় বিষয়টি পরিষ্কার করিবার জন্য বলিলেন—‘কি রকম জানেন? এই গুজরাটী ডাব আর কি, ওপরটা ঝুনো, ভেতরটা নেয়াপাতি।’

 ঘনেন তখন চটিয়া আগুন হইয়াছে। ধমকাইয়া বলিল—‘চুপ করুন চাটুজ্যে মশায়, কেবল আবোল-তাবোল বকছেন। আমাকে বলতে দিন।—দেখুন, আমরা বড়ই অপমানিত নির্যাতিত হয়েছি, একেবারে পাবলিক হোটেলে দু-শ লোকের সামনে। কেন? যেহেতু আমরা পরাধীন, অভিভাবকের অন্নদাস। এই অবস্থা আর সহ্য হয় না, নিজেদের একটা স্বাধীন আশ্রম বানাতে চাই। পিঁজরে-ভাঙা চন্দনা চায় পাখনা মেলে বাঁচতে রে, অরুণ-রাঙা মুক্তাকাশের তক্তাপোশে নাচতে রে। আপনি যদি একটু চেষ্টা করেন তবে অনায়াসে একটা আশ্রম গ’ড়ে উঠবে। এখন এ সম্বন্ধে একটি বাণী আমরা আপনার কাছে প্রার্থনা করি।’

 জিগীষা দেবী কিছুক্ষণ ধ্যানস্থ হইয়া রহিলেন, তাহার পর শিস দিয়া ডাকিলেন—‘সুষ্, সুষ্’

 একটি ছোট্ট প্রাণী গুটগুট করিয়া ঘরে আসিল। কুত্তা নয়। ইনি সুষেণবাবু, জিগীষা দেবীর স্বামী। রোগা, বেঁটে, চোখে চশমা, মাথায় টাক, কিন্তু গোঁপ জোড়াটি বেশ বড় এবং মোম দিয়া পাকানো। সতী সাধ্বী যেমন সর্বহারা হইয়াও এয়োতের লক্ষণ শাঁখা-জোড়াটি শেষ পর্যন্ত রক্ষা করে, বেচারা সুষেণবাবুও তেমনি সমস্ত কর্তৃত্ব খোয়াইয়া পুরুষত্বের চিহ্ণ স্বরূপ এই গোঁপ জোড়াটি সযত্নে বজায় রাখিয়াছেন। ঘরে আসিয়া ঘাড় নীচু করিয়া সবিনয়ে বলিলেন‘ডেকেছ?’

 জিগীষা দেবী ছেলেদের দেখাইয়া বলিলেন- ‘এঁরা বাণী নিতে এসেছেন।’

 সুষেণবাবু চোখ কপালে তুলিয়া বললেন ‘বানি? এই যে সেদিন ননি-সেকরা বিয়াল্লিশ টাকা নিয়ে গেল?’

 জিগীষা দেবী ভ্রূকুটি করিয়া বলিলেন, ‘ঈডিয়ট! সেকরার বানি নয়, আমার মুখের বাণী। যাও, সবুজ ফাউণ্টেন পেনটা আর এক শীট কাগজ নিয়ে এস।’

 সুষেণবাবু কাগজ কলম আনিলেন। জিগীষা দেবী খচখচ করিয়া কয়েকটা লাইন লিখিয়া বলিলেন—‘শুনুন। ওগো ছেলেরা, আমি বুঝেছি তোমাদের ব্যথা, কিন্তু জগৎ পারবে না তা বুঝতে, কারণ স্থবিরের প্রাচীন-প্রস্তর-যুগ শেষ হয় নি এখনও। প্রবীণের রক্ত আর তরুণের খুন, ধনীর রুধির আর শ্রমীর লেহু, রেড়ির তেল আর ঝরনার জল কখনই মিশ খায় না। অতএব তোমাদের হ'তে হবে স্বাবলম্বী স্বপ্রতিষ্ঠ। বানাও আশ্রম, গ্রামে গ্রামে, দেশে দেশে, নগরে নগরে। বানাও তারুণ্যের তপোবন, নবীন

তার নীড়, যৌবনেব দুর্গ। তোল চাঁদা—লাখ, দশ লাখ, কোটি। আপাতত এনে দাও আমাকে হাজার দশেক, তাতেই কাজ আরম্ভ হ’তে পারবে।’

 চাটুজ্যে মহাশয় বলিলেন—‘বাঃ অতি চমৎকার, খাসা। বাঁটলো, কাগজখানা যত্ন ক’রে রেখে দিস। তবে আজকের মতন আসি মা-লক্ষ্মী’

 বাঁটলো। অসময়ে অনেক উৎপাত করলুম, মাফ করবেন।

 জিগীষা। না না, উৎপাত কিসের। আচ্ছা এখন মিটিংএ যাচ্ছি, নমস্কার।

 জিগীষা দেবী প্রস্থান করিলেন। চাটুজ্যে মহাশয়রাও উঠিলেন, কিন্তু সুষেণবাবু বলিলেন— ‘আপনাদের কি বড‍্ড তাড়া? বসুন না একটু।’

 চাটুজ্যে। আপনিও একটা বাণী দেবেন নাকি?

 সুষেণবাবু একবার দরজার বাহিরে উঁকি মারিয়া বলিলেন—‘বাণী-ফানি আমি বুঝি না মশায়, ও হচ্ছে মেয়েলী ব্যাপার। আমি বুঝি শুধু কাজ। বলছিলুম কি —আপনারা কানাই ঘোষালকে চেনেন? চ্যাম্পিয়ন ওআনলেগার, সেনেট হাউসের চাতালে নাগাড় পঁচাত্তর ঘণ্টা এক পায়ে দাঁড়িয়েছিল? আমার খুড়তুতো ভাই হয়।’

 চাটুজ্যে। বটে?

 সুষেণ। হুাঁঁ। বলাই বাঁড়ুজ্যের নাম শুনেছেন? যে ছোকরা সেদিন গড়ের মাঠে তিনটে গোরাকে ছাতা-পেটা করছিল? আমার আপন মাসতুতো ভাই।  চাটুজ্যে। বলেন কি মশায়! আপনারা দেখছি বীরের বংশ, বড় সুখী হলুম আলাপ ক’রে। আর কিছু বলবার নেই তো? আচ্ছা, বসুন তা হ’লে, নমস্কার।

 সুষেণবাবু সহসা মুখখানি করুণ করিয়া বলিলেন— ‘পাঁচটা টাকা হবে কি? মাসকাবার হ’লেই শোধ ক’রে দেব।’

 বাঁটলো একটা আধুলি ফেলিয়া দিল। ছেলেদের দল ও চাটুজ্যে মহাশয় বাহিরে আসিলেন।


রাস্তায় আসিয়া চাটুজ্যে মহাশয় বলিলেন ‘আর ভাবনা কি, কেল্লা মার দিয়া। এখন চট্‌পট আশ্রমের টাকাটা যোগাড় ক’রে জিগীষা দেবীর হাতে দাও। আচ্ছা, আমি এখন চললুম। কাত্তিক, তুমি তা হ’লে আজ রাত্রে বাঁটলোদের বাড়ি থাকছ? বেশ, কাল সকালে আবার দেখা হবে।’

 চাটুজ্যে মহাশয় চলিয়া গেলে ঘনেন বলিল— তাই তো, দ-শ হা-জার টাকা! কিন্তু এর কমে আশ্রম হবেই বা কি ক’রে। অন্তত পঞ্চাশ জনের থাকবার জায়গা চাই, শোবার ঘর ডাইনিং রুম ড্রয়িং রুম লাইব্রেরি টেনিস কোর্ট সমস্তই চাই, জিগীষা দেবী খুব কম ক’রেই এস্টিমেট করেছেন। কিন্তু টাকা পাওয়া যায় কোথায়? বাঁটলো কি বলিস?’

 বাঁটলো। আমি বলি কি—কান্তিক আজ রাত্রে খুব ঠেসে খেয়ে নিয়ে কাল থেকে উপবাস আরম্ভ করুক, আর আমরা চারিদিকে সভা ক’রে বক্তৃতা দিই— হে দেশবাসী, এই যে একটি তরুণ আশ্রম বানাবার জন্য প্রাণ বিসর্জন দিতে বসেছে আর তোমরা হেসে খেলে বেড়াচ্ছ, এটা কি ঠিক? দাও দশ হাজার টাকা তুলে, তাহ’লেই বেচারা চাট্টি ভাত খাবে।

 ঘনেন। উপোস ক’রে কাজ উদ্ধার করা হচ্ছে মেহেদী ট্যাকটিক্স, আমার তাতে সিমপ্যাথি নেই।

 বাঁটলো। পুরুষোচিত পন্থা আছে, কিন্তু তাতে কিছু সময় লাগবে। কাত্তিক আমেরিকায় যাক, ঝাঁকড়া চুল রাখুক, স্বামীজী হয়ে জেঁকে বসুক। বিস্তর মেম ওর চেলা হবে, টাকাও আসবে ঢের। সেখানেই আশ্রম খোলা যাবে, আমরাও গিয়ে জুটব।

 কার্তিকের এসব যুক্তি পছন্দ হইল না। বলিল— ‘বাঁটলো, পিস্তলের দাম কত রে?’

 বাঁটলো ফেরিওয়ালার সুরে বলিল— ‘জাপানবালা দো আনা, জার্মানবালা দো আনা, সস্তাবালা দো আনা। পিস্তল কি হবে রে গাধা?

 কার্তিক উত্তেজিত হইয়া বলিল— ‘ডাকাতি করব, খুন করব, জেলে যাব, ফাঁসি যাব, আত্মীয় স্বজনের নাম ডোবাব, জগৎ আমার শত্রু, কোথাও আমার স্থান নেই।’

 বাঁটলো। আপাতত আমাদের বাড়িতে স্থান আছে। রাত্রিটা তো কাটিয়ে দে তার পর সকালবেলা মাথা ঠাণ্ডা হ’লে যা হয় করিস।

 গোপাল ও ঘনেন নিজের নিজের বাড়ি গেল। কার্তিক নীরবে বাঁটলোর সঙ্গে চলিল। বাড়ি আসিয়া বাঁটলো কার্তিককে বাহিরের ঘরে বসাইয়া তাহার শুইবার ব্যবস্থা করিতে উপরে গেল। কিন্তু ফিরিয়া আসিয়া দেখিল কার্তিক পালাইয়াছে।


রাত্রি দ্বিপ্রহর। বৃদ্ধ গোবিন্দবাবু দোতলার ঘরে খাটের উপর গভীর নিদ্রায় মগ্ন। সহসা তাঁহার চোখের উপর একটা তীব্র আলোক পড়ায় ঘুম ভাঙিয়া গেল। শুনিলেন, চাপা গলায় কে বলিতেছে ‘খবরদার, চেঁচালেই গুলি ক’রব। লোহার আলমারির চাবি —শিগগির।’

 গোবিন্দবাবু বুঝিলেন, আধুনিক চোর। একটা স্থবির চাকর ছাড়া বাড়িতে এখন দ্বিতীয় ব্যক্তি নাই, তিনি নিজেও কয়দিন হইতে বাতে পঙ্গু হইয়া আছেন। অগত্যা বলিলেন —‘চাবি তো আমার কাছে নেই, গিন্নীর কাছে, তিনি আবার চন্দননগরে তাঁর ভাইএর বাড়ি গেছেন’

 চোর। মনিব্যাগ? ঘড়ি-টড়ি? আংটি?

 গোবিন্দ। ঐ ডেসিং টেবিলটার টানার মধ্যে যা কিছু আছে। কিন্তু চেক বইখানা নিও না বাপু, সেটা তোমার কোনও কাজে লাগবে না।

 টর্চের আলো ঘরের চারিদিকে ঘুরাইয়া চোর টেবিল খুঁজিতে লাগিল। অন্ধকারে সহসা টেবিলটায় ধাক‍্কা খাইয়া মেজেতে বসিয়া পড়িয়া চোর বলিল—‘উঃ!’

 গোবিন্দবাবু বলিলেন—‘কি হ’ল?’

 সাড়া নাই। কিছুক্ষণ পরে চোর আবার ‘উঃ’ করিল। গোবিন্দবাবু ভাবিত হইলেন। খাটের পাশেই একটা বাতির সুইচ, সেটা টিপিয়া ঘর আলোকিত করিলেন। দেখিলেন, চোর টেবিলের পাশে মেজেতে বসিয়া আছে, তাহার কোমরে হাত, মুখে কাতর ভঙ্গী।

 গোবিন্দবাবু জিজ্ঞাসা করিলেন- ‘তোমারও বাত নাকি?’

 চোর। উঁহু। মাস-দুই আগে ডেঙ্গু হয়েছিল, তার পর থেকে মাঝে মাঝে একটুতেই খিল ধরে। উঃ, উঠতে পারছি না।

 গোবিন্দ। উঠতে পারবে একটু পরে। ওষুধপত্র খাচ্ছ?

 চোর। ডেঙ্গু যখন ছিল তখন খেতুম। এখন আর খাই না।

 গোবিন্দ। অন্যায় করছ, ডেঙ্গু বড় খারাপ ব্যারাম। দিন-কতক তুলসীপাতার রস দিয়ে কুইনীন খেয়ে দেখ দিকি, ভারি উপকারী। যদি এ সময় পুরী কি দেওঘর গিয়ে থাকতে পার তো আরও ভাল।

 চোর একটু হাসিয়া বলিল— ‘দেওঘর না শ্রীঘর?’

 গোবিন্দ। তাও তো বটে, বুড়ো মানুষ, ভুলেই গিয়েছিলুম যে তুমি একজন চোর। কিন্তু ভয় নেই, আইনআদলত আমার ভাল লাগে না সাজা যা দেবার আমিই দেব, তবে বাতে কাবু করেছে এই যা মুশকিল।

 চোর এইবার একটু সুস্থ হইয়া আস্তে আস্তে উঠিল।

 গোবিন্দবাবু। বলিলেন— ‘ব’স ঐ চেয়ারটায়।’

 তরুণ চোর। পিছনে ওলটানো বড় বড় চুল,নাক-টেপা চশমা, তাহাতে দু-ইঞ্চি চওড়া কাল ফিতা, কাবুলী ফ্যাশনে ধুতি পরা, গায়ে রেশমী পাঞ্জাবি, পায়ে ক্যাম্বিসের জুতা, হাতে রিষ্ট ওআচ ও পিস্তল।

 গোবিন্দ। ও পিস্তলটা কোথা থেকে পেলে?

 চোর। মুরগিহাটা থেকে, ছ-আনা দাম।

 গোবিন্দ। খেলনা? তবু ভাল, আর্মস অ্যাক্টে পড়বে না। স্বদেশী ডাকাত?

 চোর। ভবিষ্যতে তাই হয়তো হ’তে হবে। আপাতত ঝোঁকের মাথায়।

 গোবিন্দ। বাপ নেই?

 চোর। আছেন।

 গোবিন্দ। তাড়িয়ে দিয়েছেন?

 চোর। তিনি ঠিক তাড়ান নি, আমিই গৃহত্যাগ করেছি।

 গোবিন্দ। ও, বুদ্ধদেব শ্রীচৈতন্যের মতন! কি হয়েছে বাপু, বৈরাগ্য?

 চোর। বৈরাগ্য নয়, পৈতৃক জুলুম। বাবা হচ্ছেন সেকেলে জবরদস্ত পিতা। আজ সন্ধ্যাবেলা বন্ধুদের সঙ্গে অ্যাংলো-মোগলাই হোটেলে খাচ্ছি, হঠাৎ বাবা এসে খামকা যা-তা বলে গালাগালি দিলেন একেবারে দু-শ লোকের সামনে। তার পর বললেন এই কাত্তিক, অঘ্রান মাসে তোর বিয়ে, রাখাল সিংগির মেয়ের সঙ্গে। আমি জবাব দিলুম কখনই নয়।

 গোবিন্দ। আর অমনি সিঁদকাঠি নিয়ে বেরিয়ে পড়লে?

 চোর। আমার মনের অবস্থাটা আপনি বুঝতে পারছেন না সার। বাবা তো রেগে শেয়ালদ চ’লে গেলেন। আমি তখন ফিউরিয়স, বন্ধুরা নিয়ে গেল জিগীষা দেবীর কাছে— বিগ হামবগ। তার পর বাঁটলো আমাকে তাদের বাড়িতে নিয়ে গেল। থাকতে পারলুম না, চুপি চুপি পালিয়ে এলুম, একটা কিছু ভয়ংকর করতে চাই চুরি, ডাকাতি, খুন।

 গোবিন্দ। রাখাল সিংগির মেয়েটা বিশ্রী বুঝি?

 চোর। ভগবান জানেন আর বাবা জানেন। যার দেহের মনের কোনও সংবাদ আমি জানি না তাকে বিয়ে করি কি ক’রে বলুন তো? পাড়াগেঁয়ে বাপ-মার মেয়ে, বিদেশে মামার কাছে মানুষ হয়েছে, মামা শুনেছি একটি আস্ত পাগল, ভাগনীটিকে নাকি বন্য জন্তু বানিয়েছেন। আমার মানসী প্রিয়া অন্য প্যাটার্নের, সিন‍্থেসিস অভ পার্ফেক্শন।

 গোবিন্দ। কি রকম শুনি।

 চোর সোৎসাহে বলিল ‘শুনবেন?’ পাঞ্জাবির পাশের পকেট হইতে একটা মোটা খাতা টানাটানি করিয়া বাহির করিল।

 গোবিন্দ। কি ওটা, সিঁদকাঠি?

 চোর। উঁহু, কবিতার খাতা। শুনুন।—জানতে চাও কি হৃদয়রানী, অদেখা ঐ মূর্তিখানি, রূপে গুণে কাল্‌চরেতে কেমন হ’লে ধন্য মানি—

 গোবিন্দ। থাক থাক, আমি বুঝে নিয়েছি। সেই মেয়েটার নাম কি?

 চোর। ডাকনাম নেড়ী, ভাল নাম জানি না।

 গোবিন্দ। আর তোমার নাম?

 চোর। কার্তিক ঘোষ।

 গোবিন্দ। বল কি হে? কাত্তিক ঘোষের হৃদয়রানী হবে নেড়ী! নেলী হ’লেও বা কথা ছিল।

 নীচে মোটর থামার অস্ফুট আওয়াজ হইল, তাহার পর ঘরের বাহিরের বারান্দায় খুট খুট পদশব্দ। গোবিন্দবাবু হাঁকিলেন ‘কেরে নেড়ী এলি? এত রাত হ’ল যে?

 বীণাবিনিন্দিত কণ্ঠে উত্তর আসিল -‘মামা এখনও জেগে আছ? ওঃ, কি ভোজটাই খাইয়েছে, পঞ্চাশটা কোর্স, একেবারে টপিং!’

 একটি সালংকার। অনবদ্যাঙ্গী তরুণী ঘরে প্রবেশ করিয়া একজন অপরিচিত লোক দেখিয়া চিত্রার্পিতাবৎ দাড়াইল। চোর হাঁ করিয়া দেখিতে লাগিল।

 গোবিন্দবাবু বলিলেন— ‘হাঁ, তার পর কি বলছিল হে ছোকরা—রূপে গুণে কাল্‌চরেতে? রূপ তো দেখতেই পাচ্ছ। গুণ আর কাল্‌চর? নেড়ী, বানান কর তা প্রতিদ্বন্দ্বী।

 নেড়ী বলিল—‘পয় রফলা ভয় হস‍্সি’ ইত্যাদি। ইত্যবসরে চোর পিছন ফিরিয়া একটা ছোট আরশি পকেট হইতে বাহির করিয়া চট্ করিয়া মাথার চুল ঠিক করিয়া লইল।

 গোবিন্দ। দুইএর স্কোয়ার রুট কত হয় রে?

 নেড়ী। 1.41425...

 গোবিন্দ। বস্ বস্, ফিফ‍্থ প্লেস পর্যন্তই ঢের, কি বল হে ছোকরা। আচ্ছা নেড়ী, তোর মতে আধুনিক লেখকদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ কে?

 নেড়ী। যদি কঁতিনতাল অথর বল, তবে অঁরি মব্লার কাছে কেউ দাঁড়াতে পারে না। আধুনিক উপোসী সাহিত্যের ইনিই সবচেয়ে বড় এক্স্পনেণ্ট্। কেমন একটা করুণ বিশ্বলুট ভাব, যেন একটা দড়িছেঁড়া পিয়াসী বুভুক্ষা— ভারি মিষ্টি লাগে কিন্তু। আর, এঁর ঠিক উল‍্টো হচ্ছেন জাপানী রেনেসাঁসের কবি সিমাৎসু ফুজিয়ামা। এঁর লেখায় কেমন একটা ঔদরিক ঔদার্য, যেন একটা পূর্তির পুলক, যেন একটা হৃষ্ট হ্রেষা—ভারি অবাক লাগে কিন্তু।

 গোবিন্দ। আচ্ছা শেষের কবিতার শেষ কবিতার মোদ্দা কথাটা কি রে?

 নেড়ী। উৎকণ্ঠ আমার লাগি কেহ যদি প্রতীক্ষিয়া থাকে, সে-ই ধন্য করিবে আমাকে।

 গোবিন্দ। বাঃ। এইবার তুই একটা কিছু বাজা দিকি।

 নেড়ী একটা ব্যাঞ্জো লইয়া টুং টাং করিতে লাগিল। চোর গোবিন্দবাবুকে চুপি চুপি জিজ্ঞাসা করিল—‘নাইন্থ্ সিম‍্ফোনি বাজাচ্ছেন বুঝি?’

 গোবিন্দ। উঁহু, ওসব সেকেলে সুর নেড়ীর পছন্দ নয়, বোধ হয় শালা-লুট-লিয়া বাজাচ্ছে। নেড়ী, একটা রাশিয়ান ঠুংরি গা তো।

 নেড়ী। যাও, এখন আমি পারি না, ঘুম পায় না বুঝি? আচ্ছা মামা, ইনি কে তা তো বললে না।

 গোবিন্দ। ইনি একজন চোর। হঠাৎ কোমরে খিল ধরায় বাধা পেয়েছেন।

 নেড়ী লাফাইয়া বলিল—‘অ্যাঁ—চোর? এতক্ষণ ব’লতে হয়!’

 ঘরের কোণে গিয়া চটূ করিয়া টেলিফোনটা তুলিয়া লইয়া নেড়ী বলিল —‘পার্ক এট-সেভ‍্ন—হেলো বালিগঞ্জ থানা—’

 গোবিন্দ। খবরদার নেড়ী, টেলিফোন রেখে দে— স্থির হয়ে ব’স্।

 নেড়ী টেলিফোন রাখিয়া বলিল— ‘বারে, চোরকে অম্‌নি ছেড়ে দেবে? তোমার সেই কুকুর-মারা চাবুকটা কোথায়, আমিই না হয় ঘা-কতক লাগিয়ে দিই—’

 গোবিন্দ। এ আমার চোর, তুই মারবার কে!

 নেড়ী চঞ্চল হইয়া বলিল ‘তবে একটা দড়ি, বিছানা-বাঁধা স্ট্র্যাপ, কোথা আছে বল না মামা—বেঁধে ফেলি, নয়তো পালাবে—’


 চোর সবিনয়ে বলিল—‘আজ্ঞে না না, আমি পালাব না।’

 নেড়ী ব্যস্ত হইয়া দড়ি খুঁজিতে লাগিল, কিন্তু পাইল না।

 চোর। আমার এই রুমাল দেখুন তো, যদি কাজ চলে

 নেড়ী। নো, থ্যাংক্স,।

 নেড়ী তাহার শাড়ির আঁচল দিয়া চোরকে পিঠমোড়া করিয়া বাঁধিল, চোর সুবোধ বালকের ন্যায় স্থির হইয়া রহিল। নেড়ী বলিল—‘মামা, বেঁধে ফেলেছি, এইবারে থানায় টেলিফোন কর শিগ‍্গির।’

 গোবিন্দ। আমার এখন ওঠবার ক্ষমতা নেই। কিন্তু চোরের সঙ্গে তুইও যে বাঁধা পড়লি!

 নেড়ী অস্থির হইয়। বলিল— ‘আমি? কখ‍্নো নয়— উঃ আঁচলটা কি শক্ত, ছেঁড়া যায় না —একটা কাঁচি কাঁচি’

 চোর। দেখুন তো, আমার বুক-পকেটে আছে।

 নেড়ী চোরের পকেট তল্লাশ করিল কিন্তু কাঁচি পাইল না।

 চোর। আচ্ছা, পাশের পকেট দেখুন তো।

 সেখানেও কাঁচি নাই। নেড়ী বলিল—‘মিথ্যাবাদী জোচ্চোর!’

 চোর বলিল—‘আজ্ঞে না না। আচ্ছা আপনি বাঁধন খুলে দিন, আমি কথা দিচ্ছি পালাব না, অপন মাই অনার।’

 নেড়ী। আহা কি কথাই বললেন, চোরের আবার অনার!

 উপায়ান্তর না দেখিয়া নেড়ী বাঁধন খুলিয়া দিল।

 গোবিন্দবাবু বলিলেন ‘নেড়ী, যা লক্ষ্মীটি, খানকতক গরম গরম কাটলেট ভেজে আন, আর এক কাপ চা। পাশের ঘরে এঁর শোবার ব্যবস্থা ক’রে দে——এত রাত্রে বেচারা যায় কোথা।’

 নেড়ী মামার আজ্ঞা পালন করিতে গেল।

 গোবিন্দ। কেমন দেখলে কাত্তিক বাবাজী?

 কার্তিক। চমৎকার! আশ্চর্য! এক্স‍্কুইজিট!

 গোবিন্দ। মানসী প্রিয়ার সঙ্গে মিলছে?

 কার্তিক। হবহু। কিন্তু বাবা কি করবেন তাই ভাবছি। এ নেড়ী তো তাঁর মানসী নেড়ী নয়!

 গোবিন্দ। কোনও ভয় নেই তোমার, আমার শিক্ষায় মোটেই খুঁত পাবে না। এই নেড়ী যখন শ্বশুরবাড়ি যাবে, তখন লাল চেলি প’রে এক হাত ঘোমটা টেনে পঞ্চাশটা গুরুজনকে ঢিপ ঢিপ ক’রে প্রণাম করবে, রান্নাঘরে গিয়ে কোমর বেঁধে দু-শ লোকের শাকের ঘণ্ট রাঁধবে! আবার ওকে যদি সিমলা দিল্লিতে ভাইসরয়ের ডান্সে নিয়ে যাও তবে লাট-বেলাটের সঙ্গে অক্লেশে বার-কুড়িক নেচে দেবে, জার্মান কনসলের কানে চিমটি কাটবে, সার্ জম্বুস্বামী আয়ারের টিকি ধ’রে টানবে।

 কার্তিক। ওঃ।

 গোবিন্দ। কিহে, ভয় পেলে নাকি?

 কার্তিক। আজ্ঞে না, আনন্দ আনন্দ!

১৩৩৬-১৩৩৭