হেক্‌টর-বধ
অথবা
হোমেরের ঈলিয়াস্‌নামক কাব্যের উপাখ্যান ভাগ।
উপক্রমণিকা।
(১)

 পূর্ব্বকালে হেলাস্‌ অর্থাৎ গ্রীশ দেশীয় লোকের পৌত্তলিক ধর্ম্মে আস্থা ও বহুবিধ দেবদেবীর উপর বিশ্বাস ছিল। তাঁহাদিগের দেবকুলের ইন্দ্র জ্যুস্‌ লীড়া নাম্নী এক নরকুলনারীর উপর আসক্ত হওতঃ রাজহংসের রূপ ধারণ করিয়া তাহার সহিত সহবাস করিলে, লীড়া দুইটী অণ্ড প্রসব করেন। একটী অণ্ড হইতে দুইটী সন্তান জন্মে; অপরটী হইতে হেলেনী নাম্নী একটী পরমসুন্দরী কন্যার উৎপত্তি হয়। লাকীডীমন্ দেশের রাজা লীড়ার স্বামী এই তিনটী সন্তানকে দেবের ঔরসজাত জানিয়া অতিপ্রযত্নে প্রতিপালন করিতে লাগিলেন। যেমন কণ্বঋষির আশ্রমে আমাদের শকুন্তলা সুন্দরী প্রতিপালিত হইয়াছিলেন, সেইরূপ হেলেনী লাকীডীমন্‌ রাজগৃহে দিন২ প্রতিপালিত ও পরিবর্দ্ধিত হইতে লাগিলেন। আমাদিগের শকুন্তলা, দুর্ভাগ্যবশতঃ, খনিগর্ভস্থ মণির ন্যায় প্রতিপালক পিতার আশ্রমে অন্তর্হিতা ছিলেন, কিন্তু হেলেনীর রূপের যশঃসৌরভে হেলাস রাজ্য অতি শীঘ্রই পূর্ণ হইয়া উঠিল। অনেকানেক যুবরাজের এ কন্যারত্ন-লাভ-লোভে লাকীডিমন্‌ রাজনগরে সর্ব্বদা যাতায়াতে তথায় এক প্রকার স্বয়ম্বরের আড়ম্বর হইতে লাগিল। স্বয়ম্বরের প্রথা গ্রীশদেশে প্রচলিত ছিল না, থাকিলে বোধ হয়, মহাসমারোহ হইত।

 হেলেনী মানিল্যুস্‌ নামক এক রাজকুমারকে পতিত্বে বরণ করিলে পর, তাহার প্রতিপালয়িতা পিতা অন্যান্য রাজপুরুষদিগকে কহিলেন, হে রাজকুমারেরা! যখন আমার কন্যা স্বেচ্ছায় এই যুবরাজকে মাল্যদান করিল, তখন আপনাদের এ বিষয়ে কোন বিরক্তিভাব প্রকাশ করা উচিত হয় না, বরঞ্চ আপনারা দেবপিতা জ্যুস্‌কে সাক্ষী করিয়া অঙ্গীকার করুন, যে যদি কস্মিন্‌কালে এই নব বর বধূর কোন দুর্ঘটনা ঘটে, তবে আপনারা সকলেই তাহাদের পক্ষ হইয়া তাহাদিগকে বিপজ্জাল হইতে পরিত্রাণ করিবেন।

 রাজকুমারেরা রাজ বাক্য শ্রবণে অঙ্গীকারাবদ্ধ হইয়া স্ব২ দেশে প্রত্যাগমন করিলেন। মানিল্যুস্‌ আপন মনোরমা রমণীর সহিত লাকিডীমন্ রাজ্যের যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত হইয়া পরম সুখে কালযাপন করিতে লাগিলেন।


(২)

 আসিয়া খণ্ডের পশ্চিম ভাগের এক ক্ষুদ্র ভাগকে ক্ষুদ্র আসিয়া বলে। পূর্ব্বকালে সেই ভাগে ঈল্যুম অথবা ট্রয়নামে এক মহাপ্রসিদ্ধ নগর ছিল। নগরের রাজার নাম প্রিয়াম। রাণীর নাম হেকাবী। রাণী সসত্ত্বাবস্থায় আমাদিগের কুরুকুল-রাণী গান্ধারীর ন্যায় এই স্বপ্ন দেখিলেন, যে তিনি এমত এক অলাত প্রসবিলেন, যে তদ্দ্বারা রাজপুরী যেন এককালে ভস্মসাৎ হইল। নিদ্রাভঙ্গ হইলে রাণী স্বপ্ন-বিবরণ স্মরণ করিয়া মহাবিষাদে দিনপাত করিতে লাগিলেন। ক্রমে২ রাণীর স্বপ্ন-বৃত্তান্ত সমুদায় নগর মধ্যে আন্দোলিত হইতে লাগিল। যথাকালে রাণীও এক অতীব সুকুমার রাজকুমার প্রসব করিলেন। বিদুর প্রভৃতি কুরুকুল রাজমন্ত্রীর ন্যায় মহারাজ প্রিয়ামের অমাত্য বন্ধু এই সন্তানটীকে ভবিষ্যদ্বিপজ্জনক জানিয়া তাহাকে পরিত্যাগ করিতে পরামর্শ দেওয়াতে রাজা ধৃতরাষ্ট্রের অসদৃশে তাহাই করিলেন। অপত্য-স্নেহ রাজা প্রিয়ামকে স্বরাজ্যের ভাবী হিতার্থে অন্ধ করিতে পারিল না।

 সন্তানটী ভূমিষ্ঠ হইবা মাত্রই আরকিলস নামক একজন রাজদাস মহারাজের আদেশের বিপরীত করিল; অর্থাৎ শিশুটীর প্রাণদণ্ড না করিয়া তাহাকে রাজপুরীর সন্নিধানস্থ ঈডানামক এক পর্ব্বতে রাখিয়া আসিল। কোন এক মেষ পালক ঐ পরিত্যক্ত সন্তানকে পরম সুন্দর দেখিয়া আপন বন্ধ্যা স্ত্রীর নিকট তাহাকে সমর্পণ করিল। মেষপালকের স্ত্রী শিশু সন্তানটীকে পরম যত্নে স্বীয় গর্ভজাত পুত্রের ন্যায় প্রতিপালন করিতে লাগিল। আমাদিগের কৃত্তিকাকুলবল্লভ কার্ত্তিকেয়ের তুল্য রাজপুত্র মেষপালকের গৃহে দিন্‌২ রূপে ও বিবিধ গুণে বাড়িতে লাগিলেন। আমাদের দুষ্মন্তপুত্র পুরুর ন্যায় ইনিও অতি অল্প বয়সেই বনচর পশুদিগকে দমন করিতে লাগিলেন।

 মেষপালকেরা ইহার বাহুবলে স্বীয়২ মেষপালকে মাংসাহারী জন্তুগণ হইতে রক্ষিত দেখিয়া ইহার নাম স্কন্দর অর্থাৎ রক্ষাকারী রাখিলেন। ঐ ঈডা পর্ব্বত প্রদেশে এনোনী নাম্নী এক ভুবনমোহিনী সুরকামিনী বসতি করিতেন। সুরবালা রাজকুমারের অনুপম রূপ লাবণ্যে বিমোহিত হইয়া তাঁহার প্রতি একান্ত আসক্তা হইলেন, এবং তাঁহাকে বরণ করিয়া ঐ পর্বতময় প্রদেশে পরমাল্লাদে দিন যামিনী যাপন করিতে লাগিলেন।

(৩)

 গ্রীশদেশের এক অংশের নাম থেসেলী। সেই রাজ্যের যুবরাজ পিল্যুসের থেটীস্‌ নাম্নী সাগরসম্ভবা এক দেবীর সহিত পরিণয় হয়। থেটীস্‌ দেবযোনি, সুতরাং তাঁহার বিবাহ সমারোহে সকল দেব দেবী নিমন্ত্রিত হইয়া রাজনিকেতনে আবির্ভূত হয়েন। বিবাদদেবী নাম্নী কলহকারিণী এক দেবকন্যা আহূত না হওয়াতে মহারোষাবেশে বিবাদ উপস্থিত করিবার মানসে এক অদ্ভুত কৌশল করেন। অর্থাৎ একটী স্বর্ণফলে, যে রূপে সর্ব্বোৎকৃষ্টা, সেই এ ফলের প্রকৃত অধিকারিণী, এই কয়েকটা কথা লিখিয়া দেবীদলের মধ্যস্থলে নিক্ষেপ করেন। হীরী জ্যুসের পত্নী অর্থাৎ দেবকুলের ইন্দ্রাণী শচী, আথেনী, জ্ঞানদেবী অর্থাৎ স্বরস্বতী এবং অপ্রোদীতী, প্রেমদেবী অর্থাৎ রতি, এই তিন জনের মধ্যে এই ফলোপলক্ষে বিষম বিবাদ ঘটিয়া উঠিলে, তাহারা ঈডাপর্ব্বতে রাজনন্দন স্কন্দরের নিকট উপস্থিত হইলেন, এবং তৎসন্নিধানে আদ্যোপান্ত সমস্ত বৃত্তান্ত বর্ণন করিয়া তাঁহাকেই এ বিষয়ে নির্ণেতা স্থির করিলেন। হীরী কহিলেন, হে যুবক রাজকুমার! আমি দেবকুলেশ্বরী, তুমি এই ফল আমাকে দিয়া আমার প্রীতিভাজন হইলে আমি তোমাকে অসীম ধন ও গৌরব প্রদান করিব। যদ্যপিও তুমি মেষপালকদলের মধ্যে অবস্থিতি করিতেছ, তত্রাচ আমি ভস্মাবৃত অগ্নির ন্যায় তোমাকে প্রোজ্জ্বল ও শতশিখাশালী করিয়া তুলিব। আথেনী কহিলেন, আমি জ্ঞানদেবী। তুমি আমাকে উপাসনায় পরিতুষ্ট করিতে পারিলে বিদ্যা, বুদ্ধি, ও বলে নরকুলে শ্রেষ্ঠত্ব প্রাপ্ত হইবে। অপ্রোদীতী কহিলেন, আমি প্রেমদেবী, আমাকে প্রসন্ন করিলে, আমি নারীকুলের পরমোত্তমা নারীকে তোমার প্রেমাধিনী করিয়া দিব। যৌবনমদে উন্মত্ত রাজকুমার স্কন্দর কুক্ষণে ঐ ফলটী অপ্রোদীতী দেবীর হস্তে সমর্পণ করিলে অপর দেবীদ্বয় মহাক্রোধে অন্ধ হইয়া ত্রিদিবাভিমুখে গমন করিলেন।

 অপ্রোদীতী দেবী পরমহর্ষে ও অতি মৃদুস্বরে কহিলন, হে ছদ্মবেশি! তুমি মেষপালক নও। তুমি ভস্মলুপ্ত বহ্নি। ট্রয় মহানগরের মহারাজ প্রিয়াম্‌ তোমার পিতা। অতএব তুমি তৎসন্নিধানে গিয়া রাজপুত্রের উপযুক্ত পরিচর্য্যা যাচ্‌ঞা কর, আমার এ বর ফলদায়ক করিবার নিমিত্ত যাহা কর্ত্তব্য, পরে আমি তাহা কহিয়া দিব।

 রাজকুমার স্কন্দর দেবীর আদেশানুসারে রাজপুরীতে উত্তীর্ণ হইয়া স্বীয় পরিচয় প্রদান করিলে, বৃদ্ধরাজ প্রিয়াম্ তাহার অসামান্য রূপ লাবণ্যে ও বীরকৃতিতে পূর্ব্ব কথা বিস্মৃত হইলেন। কালনির্ব্বাপিত স্নেহাগ্নি পুনরুদ্দীপিত হইয়া উঠিল। সুতরাং রাজা নবপ্রাপ্ত পুত্রকে রাজসংসারে প্রবেশ করিতে আজ্ঞা দিলেন।

 কিয়দ্দিন পরে অপ্রোদীতী দেবীর আদেশ মতে রাজকুমার স্কন্দর বহুসংখ্যক সাগরযান নানা ধন ও পণ্য দ্রব্যে পরিপূরিত করিয়া লাকীডিমন্‌ নামক নগরাভিমুখে যাত্রা করিলেন। তথাকার রাজা মানিল্যুস্‌ অতিসম্মান ও সমাদরের সহিত রাজতনয়কে স্বমন্দিরে আহ্বান করিলেন। কিছুদিনের পর কোন বিশেষ কার্য্যানুরোধে তাহাকে দেশান্তরে যাইতে হইল। রাণী হেলেনী এ রাজ-অতিথির সেবায় নিয়ত নিযুক্ত রহিলেন।

 দেবী অপ্রোদীতীর মায়াজালে হতভাগিনী রাণী হেলেনী রাজ-অতিথি স্কন্দরের প্রতি নিতান্ত অনুরাগিণী হইয়া পতিব্রতা ধর্ম্মে জলাঞ্জলি দিয়া স্বপতি গৃহ পরিত্যাগ পূর্ব্বক তাহার অনুগামিনী হইলেন এবং তাঁহার পিতা রাজচুড়ামণি প্রিয়ামের রাজ্যে সেই রাজ্যের কালরূপে প্রবেশ করিলেন। রাজা মানিল্যুস্‌ শূন্যগৃহে পুনরাবর্ত্তন করিয়া স্ত্রীবিরহে একান্ত অধীর ও ক্ষিপ্তপ্রায় হইয়া উঠিলেন।

 এই দুর্ঘটনা হেলাস্‌ অর্থাৎ গ্রীশদেশে প্রচারিত হইলে, তদ্দেশীয় রাজাসমূহ পূর্ব্বকৃত অঙ্গীকার স্মরণ পূর্ব্বক সসৈন্যে মানিল্যুসের সাহায্যার্থে উপস্থিত হইলেন, এবং তাহার জ্যেষ্ঠভ্রাতা আর্‌গস্‌ দেশের অধীশ্বর আগেমেম্‌নন্‌কে সৈন্যাধ্যক্ষপদে অভিষিক্ত করিয়া ট্রয়নগর আক্রমণাভিলাষে সাগরপথে যাত্রা করিলেন। বৃদ্ধরাজ প্রিয়াম্‌ স্বীয় পঞ্চাশৎ পুত্রকে যুদ্ধার্থে অনুমতি দিলেন। মহাবীর হেক্‌টর (যাহাকে ট্রয়স্বরূপ লঙ্কার মেঘনাদ বলা যাইতে পারে) দেশ বিদেশীয় বন্ধুগণের এবং স্বীয় রাজসংসারস্থ সৈন্যদলের অধ্যক্ষপদ গ্রহণ করিলেন। দশ বৎসর উভয় দলে তুমুল সংগ্রাম হইল।

 যেমন গঙ্গা যমুনা এবং সরস্বতী এই ত্রিপথা নদীত্রয় পবিত্রতীর্থ ত্রিবেণীতে একত্রীভূতা হইয়া একস্রোতে সাগর-সমাগমাভিলাষে গমন করেন, সেইরূপ উপরি উল্লিখিত তিনটী পরিচ্ছেদসংক্রান্ত বৃত্তান্ত এস্থল হইতে একত্রীভূত হইয়া ইউরোপখণ্ডের বাল্মীকি কবিগুরু হোমেরের ঈলিয়াস্ স্বরূপ সঙ্গীত তরঙ্গময় সিন্ধুপানে চলিতে লাগিল।

 কবিগুরু হোমেরের জগদ্বিখ্যাত কাব্যে দশম বৎসরের বৃত্তান্ত বর্ণিত আছে। গ্রীকেরা ট্রয়ের নিকটস্থ এক নগর লুট করে, এবং তত্রস্থ পূজিত সূর্য্যদেবের ক্রীস্‌ নামক পুরোহিতের এক পরমসুন্দরী কুমারী কন্যাকে আপনাদের শিবিরে আনয়ন করে। অপহৃত দ্রব্যজাত বিভাগের সময় সেই অসামান্য রূপবতী যুবতী সৈন্যাধ্যক্ষ রাজচক্রবর্ত্তী আগেমেম্‌ননের অংশে পড়িলে, তিনি তাহাকে পরম প্রযত্নে ও সমাদরে স্বশিবিরে রাখিতেছেন; এমন সময়ে———