নরক বাস

নেপথ্যে


কোথা যাও মহারাজ!

সােমক


কে ডাকে আমারে
দেবদূত? মেঘলােকে ঘন অন্ধকারে
দেখিতে না পাই কিছু,―হেথা ক্ষণকাল
রাখ তব স্বর্গরথ।

নেপথ্যে


ওগাে নরপাল
নেমে এস! নেমে এস হে স্বর্গ-পথিক!

সোমক


কে তুমি কোথায় আছ?

নেপথ্যে


আমি সে ঋত্বিক
মর্ত্ত্যে তব ছিনু পুরােহিত।

সােমক


ভগবন্,
নিখিলের অশ্রু যেন করেছে সৃজন

বাষ্প হয়ে এই মহা অন্ধকার লােক,―
সূর্য্যচন্দ্রতারাহীন ঘনীভূত শােক
নিঃশব্দে রয়েছে চাপি দুঃস্বপ্ন মতন
নভস্তল,―হেথা কেন তব আগমন?

প্রেতগণ


স্বর্গের পথের পার্শ্বে এ বিষাদ লোক,
এ নরকপুরী। নিত্য নন্দন আলোক
দূর হতে দেখা যায়,―স্বর্গযাত্রীগণে
অহােরাত্রি চলিয়াছে, রথচক্রস্বনে
নিদ্রাতন্দ্রা দূর করি ঈর্ষা-জর্জ্জরিত
আমাদের নেত্র হতে। নিম্নে মর্ম্মরিত
ধরণীর বনভূমি,―সপ্ত পারাবার
চিরদিন করে গান―কলধ্বনি তার
হেথা হতে শুনা যায়।

ঋত্বিক


মহারাজ, নাম’
তব দেবরথ হতে।

প্রেতগণ


ক্ষণকাল থাম
আমাদের মাঝখানে। ক্ষুদ্র এ প্রার্থনা
হতভাগ্যদের! পৃথিবীর অশ্রুকণা
এখনাে জড়ায়ে আছে তােমার শরীর,
সদ্যছিন্ন পুষ্পে যথা বনের শিশির।

মাটির, তৃণের, গন্ধ, ফুলের, পাতার,
শিশুর, নারীর, হায়, বন্ধুর, ভ্রাতার
বহিয়া এনেছ তুমি। ছয়টি ঋতুর
বহুদিনরজনীর বিচিত্র মধুর
সুখের সৌরভ রাশি।

সােমক


গুরুদেব, প্রভো,
এ নরকে কেন তব বাস?

ঋত্বিক


পুত্রে তব
যজ্ঞে দিয়েছিনু বলি—সে পাপে এ গতি
মহারাজ!

প্রেতগণ


কহ সে কাহিনী, নরপতি,
পৃথিবীর কথা! পাতকের ইতিহাস
এখনো হৃদয়ে হানে কৌতুক উল্লাস।
রয়েছে তােমার কণ্ঠে মর্ত্ত্যরাগিণীর
সকল মূর্চ্ছনা, সুখদুঃখকাহিনীর
করুণ কম্পন। কহ তব বিবরণ
মানবভাষায়।

সােমক


হে ছায়া-শরীরীগণ
সোমক আমার নাম, বিদেহ-ভূপতি।

বহু বর্ষ আরাধিয়া দেব দ্বিজ যতী
বহু যাগ যজ্ঞ করি, প্রাচীন বয়সে
এক পুত্র লভেছিনু,―তারি স্নেহবশে
রাত্রিদিন আছিলাম আপনা-বিস্মৃত।
সমস্ত সংসার-সিন্ধু-মথিত-অমৃত
ছিল সে আমার শিশু। মাের বৃন্ত ভরি
একটি সে শ্বেতপদ্ম, সম্পূর্ণ আবরি
ছিল সে আমারে। আমার হৃদয়
ছিল তারি মুখ পরে―সূর্য্য যথা রয়
ধরণীর পানে চেয়ে। হিমবিন্দুটিরে
পদ্মপত্র যত ভয়ে ধরে রাখে শিরে
সেই মত রেখেছিনু তারে। সুকঠোর
ক্ষাত্রধর্ম্ম রাজধর্ম্ম স্নেহপানে মাের
চাহিত সরােষচক্ষে; দেবী বসুন্ধরা
অবহেলা-অবমানে হইত কাতরা,
রাজলক্ষ্মী হত লজ্জামুখী।
সভমাঝে
একদা অমাত্যসাথে ছিনু রাজকাজে
হেনকালে অন্তঃপুরে শিশুর ক্রন্দন
পশিল আমার কর্ণে। ত্যজি সিংহাসন
দ্রুত ছুটে চলে গেনু ফেলি সর্ব্বকাজ।

ঋত্বিক


সে মুহূর্ত্তে প্রবেশিনু রাজসভামাঝ
আশিষ করিতে নৃপে ধান্যদুর্ব্বা করে

আমি রাজপুরোহিত। ব্যগ্রতার ভরে
আমারে ঠেলিয়া রাজা গেলেন চলিয়া,
অর্ঘ্য পড়ি গেল ভূমে। উঠিল জ্বলিয়া
ব্রাহ্মণের অভিমান। ক্ষণকাল পরে
ফিরিয়া আসিলা রাজা লজ্জিত অন্তরে।
আমি শুধালেম তাঁরে, কহ হে রাজন্
কি মহা অনর্থপাত দুর্দ্দৈব ঘটন
ঘটেছিল, যার লাগি ব্রাহ্মণেরে ঠেলি
অন্ধ অবজ্ঞার বশে,―রাজকর্ম্ম ফেলি,
শুনি বিচারপ্রার্থী প্রজাদের যত
আবেদন, পররাষ্ট্র হতে সমাগত
রাজদূতগণে নাহি করি সম্ভাষণ,
সামন্ত রাজন্যগণে না দিয়া আসন,
প্রধান অমাত্য সবে রাজ্যের বারতা
না করি জিজ্ঞাসাবাদ, না করি শিষ্টতা,
অতিথি সজ্জন গুণীজনে―অসময়ে
ছুটি গেল অন্তঃপুরে মত্তপ্রায় হয়ে
শিশুর ক্রন্দন শুনি? ধিক্ মহারাজ,
লজ্জায় আনত শির ক্ষত্রিয় সমাজ
তব মুগ্ধব্যবহারে, শিশু-ভুজপাশে
বন্দী হয়ে আছ পড়ি দেখে সবে হাসে
শত্রুদল দেশে দেশে,―নীরব সঙ্কোচে
বন্ধুগণ সঙ্গোপনে অশ্রুজল মোছে।

সােমক


ব্রাহ্মণের সেই তীব্র তিরস্কার শুনি
অবাক্ হইল সভা।―পাত্রমিত্র গুণী
রাজগণ প্রজাগণ রাজদূত সবে
আমার মুখের পানে চাহিল নীরবে
ভীত কৌতূহলে। রােষাবেশ ক্ষণতরে
উত্তপ্ত করিল রক্ত;―মুহূর্ত্তেক পরে
লজ্জা আসি করি দিল দ্রুত পদাঘাত
দৃপ্ত রােষসর্পশিরে। করি প্রণিপাত
গুরুপদে — কহিলাম বিনম্র বিনয়ে―
ভগবন্, শান্তি নাই এক পুত্র লয়ে,
ভয়ে ভয়ে কাটে কাল। মােহবশে তাই
অপরাধী হইয়াছি—ক্ষমা ভিক্ষা চাই।
সাক্ষী থাক মন্ত্রী সবে, হে রাজন্যগণ
রাজার কর্ত্তব্য কভু করিয়া লঙ্ঘন
খর্ব্ব করিব না আর ক্ষত্রিয় গৌরব।

ঋত্বিক


কুণ্ঠিত আনন্দে সভা রহিল নীরব।
আমি শুধু কহিলাম বিদ্বেষের তাপ
অন্তরে পােষণ করি—এক-পুত্র-শাপ
দুর করিবারে চাও —পন্থা আছে তারো,―
কিন্তু সে কঠিন কাজ, পার কি না পার

ভয় করি। শুনিয়া সগর্ব্বে মহারাজ
কহিলেন—নাহি হেন সুকঠিন কাজ
পারি না করিতে যাহা ক্ষত্রিয় তনয়—
কহিলাম স্পর্শি তব পাদপদ্মদ্বয়।
শুনিয়া কহিনু মৃদু হাসি’,—হে রাজন্‌
শুন তবে। আমি করি যজ্ঞ-আয়ােজন,
তুমি হােম কর দিয়ে আপন সন্তান।
তারি মেদ-গন্ধ-ধূম করিয়া আঘ্রাণ
মহিষীরা হইবেন শত পুত্রবতী—
কহিনু নিশ্চয়।—শুনি নীরব নৃপতি
রহিলেন নত শিরে। সভাস্থ সকলে
উঠিল ধিক্কার দিয়া উচ্চ কোলাহলে।
কর্ণে হস্ত রুধি কহে যত বিপ্রগণ
ধিক্ পাপ এ প্রস্তাব।—নৃপতি তখন
কহিলেন ধীরস্বরে—তাই হবে প্রভু,
ক্ষত্রিয়ের পণ মিথ্যা হইবে না কভু।
তখন নারীর আর্ত্ত বিলাপে চৌদিক্‌
কাঁদি উঠে, —প্রজাগণ করে ধিক্ ধিক্‌,
বিদ্রোহ জাগাতে চায় যত সৈন্যদল
ঘৃণাভরে। নৃপ শুধু রহিলা অটল।
জ্বলিল যজ্ঞের বহ্নি। যজন সময়ে
কেহ নাই,—কে আনিবে রাজার তনয়ে
অন্তঃপুর হতে বহি। রাজভৃত্য সবে
আজ্ঞা মানিল না কেহ। রহিল নীরবে

মন্ত্রীগণ। দ্বাররক্ষী মুছে চক্ষুজল,
অস্ত্র ফেলি চলি গেল যত সৈন্যদল।
আমি ছিন্নমোহপাশ, সর্ব্বশাস্ত্র-জ্ঞানী,
হৃদয়-বন্ধন সব মিথ্যা বলে’ মানি,—
প্রবেশিনু অন্তঃপুরমাঝে। মাতৃগণ
শত-শাখা-অন্তরালে ফুলের মতন
রেখেছেন অতিযত্নে বালকেরে বেরি
কাতর উৎকণ্ঠাভরে। শিশু মােরে হেরি
হাসিতে লাগিল উচ্চে দুই বাহু তুলি;—
জানাইল অর্দ্ধস্ফুট কাকলী আকুলি’—
মাতৃব্যূহ ভেদ করে নিয়ে যাও মােরে।
বহুক্ষণ বন্দী থাকি খেলাবার তরে
ব্যগ্র তার শিশুহিয়া। কহিলাম হাসি
মুক্তি দিব এ নিবিড় স্নেহবন্ধ নাশি,
আয় মাের সাথে। এত বলি বল করি
মাতৃগণ অঙ্ক হতে লইলাম হরি
সহাস্য শিশুরে। পায়ে পড়ি দেবীগণ
পথ রুধি আর্ত্তকণ্ঠে করিল ক্রন্দন—
আমি চলে এনু বেগে। বহ্নি উঠে জ্বলি—
দাঁড়ায়ে রয়েছে রাজা পাষাণ পুত্তলি।
কম্পিত প্রদীপ্ত শিখা হেরি হর্ষ ভরে
কলহাস্যে নৃত্য করি’ প্রসারিত করে
ঝাঁপাইতে চাহে শিশু। অন্তঃপুর হতে
শতকণ্ঠে উঠে আর্ত্তস্বর। রাজপথে

অভিশাপ উচ্চারিয়া যায় বিপ্রগণ
নগর ছাড়িয়া। কহিলাম, হে রাজন্
আমি করি মন্ত্রপাঠ, তুমি এরে লও,
দাও অগ্নিদেবে।

সােমক


ক্ষান্ত হও, ক্ষান্ত হও
কহিয়োনা আর।

প্রেতগণ।


থাম থাম ধিক্ ধিক!
পূর্ণ মােরা বহু পাপে, কিন্তু রে ঋত্বিক
শুধু একা তাের তরে একটি নরক
কেন সৃজে নাই বিধি! খুঁজি যমলোক
তব সহবাসযােগ্য নাহি মিলে পাপী।

দেবদূত


মহারাজ এ নরকে ক্ষণকাল যাপি’
নিষ্পাপে সহিছ কেন পাপীর যন্ত্রণা?
উঠ স্বর্গরথে—থাক্ বৃথা আলােচনা
নিদারুণ ঘটনার।

সােমক


রথ যাও লয়ে
দেবদূত! নাহি যাব বৈকুণ্ঠ আলয়ে।
তব সাথে মাের গতি নরক মাঝারে

হে ব্রাহ্মণ! মত্ত হয়ে ক্ষাত্র-অহঙ্কারে
নিজ কর্ত্তব্যের ত্রুটি করিতে ক্ষালন
নিষ্পাপ শিশুরে মাের করেছি অর্পণ
হুতাশনে, পিতা হয়ে। বীর্য্য আপনার
নিন্দুকসমাজমাঝে করিতে প্রচার
নরধর্ম্ম রাজধর্ম্ম পিতৃধর্ম্ম হায়
অনলে করেছি ভস্ম। সে পাপ জ্বালায়
জ্বলিয়াছি আমরণ,―এখনো সে তাপ
অন্তরে দিতেছে দাগি নিত্য অভিশাপ।
হায় পুত্র, হায় বৎস নবনী-নির্ম্মল,
করুণ কোমল কান্তি, হা মাতৃবৎসল,
একান্ত নির্ভরপর পরম দুর্ব্বল
সরল চঞ্চল শিশু পিতৃ-অভিমানী
অগ্নিরে খেলনাসম পিতৃদান জানি
ধরিলি দু’হাত মেলি বিশ্বাসে নির্ভয়ে।
তার পরে কি ভর্ৎসনা ব্যথিত বিস্ময়ে
ফুটিল কাতর চক্ষে বহ্নিশিখাতলে
অকস্মাৎ। হে নরক, তােমার অনলে
হেন দাহ কোথা আছে যে জিনিতে পারে
এ অন্তরতাপ। আমি যাব স্বর্গদ্বারে।
দেবতা ভুলিতে পারে এ পাপ আমার,
আমি কি ভুলিতে পারি সে দৃষ্টি তাহার,
সে অন্তিম-অভিমান? দগ্ধ হব আমি
নরক অনলমাঝে নিত্য দিনযামী

তবু বৎস তাের সেই নিমেষের ব্যাথা,
আচম্বিত বহ্নিদাহে ভীত কাতরতা
পিতৃ মুখপানে চেয়ে,―পরম বিশ্বাস
চকিত হইয়া ভঙ্গ মহা নিরাশ্বাস,
তার নাহি হবে পরিশােধ।

(ধর্ম্মের প্রবেশ)


ধর্ম্ম


মহারাজ,
স্বর্গ অপেক্ষিয়া আছে তােমা তরে আজ,
চল ত্বরা করি।

সােমক


সেথা মাের নাহি স্থান
ধর্ম্মরাজ। বধিয়াছি আপন সন্তান
বিনা পাপে।

ধর্ম্ম


করিয়াছ প্রায়শ্চিত্ত তার
অন্তর নরকানলে। সে পাপের্য ভার
ভস্ম হয়ে ক্ষয় হয়ে গেছে। যে ব্রাহ্মণ
বিনা চিত্ত-পরিতাপে পরপুত্রধন
স্নেহবন্ধ হতে ছিঁড়ি করেছে বিনাশ
শাস্ত্রজ্ঞান-অভিমানে, তারি হেথা বাস
সমুচিত।

ঋত্বিক


যেয়োনা যেয়ােনা তুমি চলে’
মহারাজ! সর্পশীর্ষ তীব্র ঈর্ষ্যানলে
আমারে ফেলিয়া রাখি যেয়ােনা যেয়ােনা
একাকী অমরলোকে। নূতন বেদনা
বাড়ায়ােনা বেদনায় তীব্র দুর্ব্বিষহ,
সৃজিয়ােনা দ্বিতীয় নরক। রহ রহ
মহারাজ, রহ হেথা।

সােমক


র’ব তব সহ
হে দুর্ভাগা! তুমি আমি মিলি অহরহ
করিব দারুণ হােম, সুদীর্ঘ যজন
বিরাট নরক হুতাশনে। ভগবন্
যতকাল ঋত্বিকের আছে পাপভােগ
ততকাল তার সাথে কর মােরে যােগ—
নরকের সহবাসে দাও অনুমতি।

ধর্ম্ম


মহান্ গৌরবে হেথা রহ মহীপতি।
ভালের তিলক হােক্ দুঃসহ দহন,
নরকাগ্নি হােক্ তব স্বর্গ সিংহাসন।

প্রেতগণ


জয় জয় মহারাজ, পুণ্যফলত্যাগী!
নিষ্পাপ নরকবাসী! হে মহা বৈরাগী!

পাপীর অন্তরে কর গৌরব সঞ্চার
তব সহবাসে। কর নরক উদ্ধার।
বস আসি দীর্ঘ যুগ মহা শত্রু সনে
প্রিয়তম মিত্রসম এক দুঃখাসনে।
অতি উচ্চ বেদনার আগ্নেয় চূড়ায়
জ্বলন্ত মেঘের সাথে দীপ্ত সূর্য্যপ্রায়
দেখা যাবে তােমাদের যুগল মুরতি
নিত্যকাল উদ্ভাসিত অনির্ব্বাণ জ্যোতি।


৭ই অগ্রহায়ণ, ১৩০৪