কাহিনী (১৯১২)/লক্ষ্মীর পরীক্ষা

লক্ষীর পরীক্ষা

ক্ষীরো


ধনী সুখে করে ধর্ম্মকর্ম্ম
গরীবের পড়ে মাথার ঘর্ম্ম
তুমি রাণী, আছে টাকা শত শত,
খেলাছলে কর দান ধ্যান ব্রত;
তােমার ত শুধু হুকুম মাত্র;
খাটুনি আমারি দিবসরাত্র।
তবুও তােমারি সুযশ, পুণ্য,
আমার কপালে সকলি শূন্য।

নেপথ্যে


ক্ষীরি, ক্ষীরি, ক্ষীরাে!

ক্ষীরাে


কেন ডাকাডাকি,
নাওয়া খাওয়া সব ছেড়ে দেব না কি?

(রাণী কল্যাণীর প্রবেশ)


কল্যাণী


হল কি! তুই যে আছিস্ রেগেই।

ক্ষীরো


কাজ যে পিছনে রয়েছে লেগেই।
কতই বা সয় রক্তমাংসে,

কত কাজ করে একটা মান্‌ষে।
দিনে দিনে হল শরীর নষ্ট।

কল্যাণী


কেন, এত তাের কিসের কষ্ট!

ক্ষীরাে।


যেথা যত আছে রামী ও বামী
সকলের যেন গোলাম আমি।
হােক্ ব্রাহ্মণ, হোক্ শূদ্দুর,
সেবা করে মরি পাড়াসুদ্ধর।
ঘরেতে কারো ত চড়ে না অন্ন,
তােমারি ভাঁড়ারে নিমন্তন্ন।
হাড় বের হল বাসন মেজে
সৃষ্টির পান তামাক সেজে।
একা একা এত খেটে যে মরি
মায়া দয়া নেই?

কল্যাণী


সে দোষ তােরী।
চাকর দাসী কি টিঁকিতে পারে
তােমার প্রখর মুখের ধারে?
লােক এলে তুই তাড়াবি তাদের
লােক গেলে শেষে আর্ত্তনাদের
ধূম পড়ে যাবে,—এর কি পথ্যি
আছে কোনরূপ?

ক্ষীরাে


সে কথা সত্যি।
সয়না আমার,—তাড়াই সাধে!
অন্যায় দেখে পরাণ কাঁদে।
কোথা থেকে যত ডাকাত জোটে,
টাকাকড়ি সব দুহাতে লোটে।
আমি না তাদের তাড়াই যদি
তােমারে তাড়াত আমারে বধি’।

কল্যাণী


ডাকাত মাধবী, ডাকাত মাধু,
সবাই ডাকাত, তুমিই সাধু!

ক্ষীরো


আমি সাধু! মাগো, এমন মিথ্যে
মুখেও আনিনে, ভাবিনে চিত্তে।
নিই থুই খাই দু’হাত ভরি,
দুবেলা তােমায় আশিষ করি;
কিন্তু তবু সে দু’হাত পরে
দু মুঠোর বেশি কতই ধরে।
ঘরে যত আন মানুষ জনকে
তত বেড়ে যায় হাতের সংখ্যে।
হাত যে সৃজন করেছে বিধি,
নেবার জন্যে, জান ত দিদি!

পাড়াপড়শির দৃষ্টি থেকে
কিছু আপনার রাখ ত ঢেকে,
তার পরে বেশি রহিলে বাকি
চাকর বাকর আনিয়ো ডাকি।

কল্যাণী


একা বটে তুমি! তােমার সাথী
ভাইপো, ভাইঝি, নাতিনী নাতি,
হাট বসে গেছে সােনার চাঁদের,
দুটো করে হাত নেই কি তাঁদের?
তাের কথা শুনে কথা না সরে,
হাসি পায় ফের রাগও ধরে।

ক্ষীর


বেশি রেগে যদি কম হাসি পেত
স্বভাব আমার শুধরিয়ে যেত।

কল্যাণী


মলেও যাবে না স্বভাবখানি
নিশ্চয় জেনাে।

ক্ষীরাে


সে কথা মানি।
তাইত ভরসা মরণ মােরে
নেবে না সহসা সাহস করে।
ঐ যে তােমার দরজা জুড়ে
বসে গেছে যত দেশের কুড়ে।

কারো বা স্বামীর জোটে না খাদ্য,
কারাে বা বেটার মামীর শ্রাদ্ধ।
মিছে কথা ঝুড়ি ভরিয়া আনে,
নিয়ে যায় ঝুড়ি ভরিয়া দানে।
নিতে চায় নিক, কত যে নিচ্চে,
চোখে ধূলো দেবে, সেটা কি ইচ্ছে!

কল্যাণী


কেন তুই মিছে মরিস বকে?
ধূলো দেয়, ধূলো লাগে না চোখে।
বুঝি আমি সব―এটাও জানি
তারা যে গরীব, আমি যে রাণী।
ফাঁকি দিয়ে তারা ঘােচায় অভাব,
আমি দিই, সেটা আমার স্বভাব।
তাদের সুখ সে তারাই জানে,
আমার সুখ সে আমার প্রাণে।

ক্ষীরাে


নুন খেয়ে গুণ গাহিতে কভু,
দিয়ে থুয়ে সুখ হইত তবু।
সাম্‌নে প্রণাম পদারবিন্দে,
আড়ালে তােমার করে যে নিন্দে!

কল্যাণী


সাম্‌নে যা পাই তাই যথেষ্ট,
আড়ালে কি ঘটে জানেন কেষ্ট।

সে যাই হোক্‌গে, শুধাই তোরে
কাল বৈকালে বল্‌ত মোরে
অতিথি-সেবায় অনেকগুলি
কম পড়েছিল চন্দ্রপুলি,―
কেন বা ছিল না রস্‌করা!

ক্ষীরো


কেন কর মিছে মস্‌করা
দিদি ঠাকরুণ! আপন হাতে
গুণে দিয়েছিনু সবার পাতে
দুটো দুটো করে।

কল্যাণী


আপন চোখে
দেখেছি পায়নি সকল লোকে,
খালি পাত―

ক্ষীরো


ওমা তাইত বলি
কোথায় তলিয়ে যায় যে চলি
যত সামগ্রি দিই আনিয়ে।
ভোলা ময়রার সয়তানী এ।

কল্যাণী


এক বাটি করে দুধ বরাদ্দ,
আধ বাটি তাও পাওয়া অসাধ্য।

ক্ষীরো


গয়লা ত নন্ যুধিষ্ঠির।
যত বিষ তব কুদৃষ্টির
পড়েছে আমারি পোড়া অদৃষ্টে,
যত ঝাঁটা সব আমারি পৃষ্ঠে,
হায় হায়―

কল্যাণী


ঢের হয়েছে, আর না,
রেখে দাও তব মিথ্যে কান্না।

ক্ষীরো


সত্যি কান্না কাঁদেন যাঁরা
ঐ আসছেন ঝেঁটিয়ে পাড়া।

(প্রতিবেশিনীগণের প্রবেশ)


প্রতিবেশিনীগণ


জয় জয় রাণী হও চিরজয়ী!
কল্যাণী তুমি কল্যাণময়ী।

ক্ষীরো


ওগো রাণীদিদি, শোন্ ওই শোন্,
পাতে যদি কিছু হ’ত অকুলোন
এত গলা ছেড়ে এত খুলে প্রাণ
উঠিত কি তবে জয় জয় তান?

যদি দু চারটে চন্দ্রপুলি
দৈবগতিকে দিতে না ভুলি
তাহলে কি আর রক্ষে থাক্‌ত,
হজম করতে বাপকে ডাক্‌ত।

কল্যাণী


আজ ত খাবার হয় নি কষ্ট?

১মা


কত পাতে পড়ে হয়েছে নষ্ট,―
লক্ষ্মীর ঘরে খাবার ত্রুটি?

কল্যাণী


হ্যাঁগো, কে তোমার সঙ্গে উটি?
আগে ত দেখিনি!―

২য়া


আমার মধু,
তারি উটি হয় নতুন বধূ
এনেছি দেখাতে তোমার চরণে
মা জননী।

ক্ষীরো


সেটা বুঝেছি ধরণে।

২য়া


(বধূর প্রতি) প্রণাম করিবে এস এদিকে
এই যে তােমার রাণী দিদিকে।

কল্যাণী


এস কাছে এস, লজ্জা কাদের?
(আংটি পরাইয়া) আহা মুখখানি দিব্যি ছাঁদের
চেয়ে দেখ্ ক্ষীরি!

ক্ষীরাে


মুখটি ত বেশ,
তা চেয়ে তােমার আংটি সরেশ।

২য়া


শুধু রূপ নিয়ে কি হবে অঙ্গে
সােনা দানা কিছু আনেনি সঙ্গে।

ক্ষীরাে


যাহা এনেছিল সবি সিন্দুকে
রেখেছ যতনে, বলে নিন্দুকে।

কল্যাণী


এস ঘরে এস।

ক্ষীরো


যাও গো ঘরে
সােনা পাবে শুধু বাণীর দরে।

(কল্যাণী ও বধুসহ দ্বিতীয়ার প্রস্থান)

১মা


দেখ্‌লি মাগীর কাণ্ড এ কি!

ক্ষীরো


কারে বাদ্ দিয়ে কারে বা দেখি।

৩য়া


তা বলে এতটা সহ্য হয় না।

ক্ষীরাে


অন্যের বউ পরলে গয়না
অন্যের তাতে জ্বলে যে অঙ্গ।

৩য়া


মাসী জান তুমি কতই রঙ্গ,
এত ঠাট্টাও আছে তাের পেটে,
হাস্‌তে হাস্‌তে নাড়ী যায় ফেটে।

১মা


কিন্তু যা বল, আমাদের মাতা
নাই তাঁর মত এত বড় দাতা।

ক্ষীরাে


অর্থাৎ কি না এত বড় হাবা
জন্ম দেয়নি আর কারো বাবা।

৩য়া


সে কথা মিথ্যে নয় নিতান্ত।
দেখ্ না সেদিন কুশী ও ক্ষান্ত
কি ঠকান্‌টাই ঠকালে, মাগো!
আহা মাসী তুমি সাধে কি রাগো!
আমাদেরি গায়ে হয় অসহ্য।

৪র্থী


বুড়ো মহারাজা যে ঐশ্বর্য্য
রেখে গেছে সে কি এম্‌নি ভাবে
পাঁচ ভূতে শুধু ঠকিয়ে খাবে!

১মা


দেখ্‌লি ত ভাই কানা আন্দি
কত টাকা পেলে।

৩য়া


বুড়ি ঠান্‌দি
জুড়ে দিলে তার কান্না অস্ত্র
নিয়ে গেল কত শীতের বস্ত্র।

৪র্থী


বুড়ি মাগী তার শীত কি এতই।
কাঁথা হলে চলে নিয়ে গেল লুই।
আছে সেটা শেষে চোরের ভাগ্যে,
এ যে বাড়াবাড়ি।

১মা


সে কথা যাগ্‌গে।

৪র্থী


না না তাই বলি হয়ােনাকো দাতা,
তা বলে খাবে কি বুদ্ধির মাথা।
যত রাজ্যের দুঃখী কাঙাল
যত উড়ে মেড়া খোট্টা বাঙাল
কানা খোঁড়া নুলাে যে আসে মরতে
বাচ বিচার কি হবে না করতে?

৩য়া


দেখ্‌না ভাই সে গােপালের মাকে
দু টাকা দিলেই খেয়ে পরে থাকে
পাঁচ টাকা তার মাসে বরাদ্দ
এ যে মিছি মিছি টাকার শ্রাদ্ধ।

৪র্থী


আসল কথা কি, ভাল নয় থাকা
মেয়ে মান্‌সের এতগুলো টাকা।

৩য়া


কত লােকে কত করে যে রটনা,―

১মা


সেগুলো ত সব মিথ্যে ঘটনা।

৪র্থী


সত্যি মিথ্যে দেবতা জানে
রটেছে ত কথা পাঁচের কানে
সেটা যে ভাল না।

১মা


যা বলিস্ ভাই
এমন মানুষ ভূভারতে নাই।
ছোট বড় বোধ নাইক মনে,
মিষ্টি কথাটি সবার সনে।

ক্ষীরো


টাকা যদি পাই বাক্‌স ভরে
আমার গলাও গলাবে তোরে।
বাপু বল্লেই মিলবে স্বর্গ,
বাছা বল্লেই বলবি ধর্‌গো।
মনে ঠিক জেনো আসল মিষ্টি,
কথার সঙ্গে রূপোর বৃষ্টি।

৪র্থী


তাও বলি বাপু, এটা কিছু বেশি,
সবার সঙ্গে এত মেশামেশি।
বড় লোক তুমি ভাগ্যিমন্ত,
সেই মত চাই চাল চলন্ ত?

৩য়া


দেখ্‌লি সেদিন শশির বাঁ গালে
আপনার হাতে ওষুধ লাগালে!

৪র্থী


বিধু খোঁড়া সেটা নেহাৎ বাঁদর
তারে কেন এত যত্ন আদর?

৩য়া


এত লােক আছে কেদারের মাকে
কেন বল দেখি দিনরাত ডাকে!
গয়লাপাড়ার কেষ্টদাসী
তারি সাথে কত গল্প হাসি,
যেন সে কতই বন্ধু পুরােণাে!

৪র্থী


ওগুলো লােকের আদর কুড়োনো।

ক্ষীরো


এ সংসারের ঐত প্রথা,
দেওয়া নেওয়া ছাড়া নেইক কথা।
ভাত তুলে দেন মােদের মুখে
নাম তুলে নেন পরম সুখে।
ভাত মুখে দিলে তখনি ফুরােয়
নাম চিরদিন কর্ণ জুড়ােয়।

৪র্থী


ঐ বউ নিয়ে ফিরে এল নেকী।

(বধূসহ দ্বিতীয়ার প্রবেশ)


১মা


কি পেলিলো বিধু দেখি দেখি দেখি!

২য়া


শুধু এক জোড়া রতনচক্র।

৩য়া


বিধি আজ তোরে বড়ই বক্র।
এত ঘটা করে নিয়ে গেল ডেকে
ভেবে ছিনু দেবে গয়না গা ঢেকে।

৪র্থী


মেয়ের বিয়েতে পেয়ারী বুড়ি
পেয়েছিল আর তা ছাড়া চুড়ি।

২য়া


আমি যে গরীব নই যথেষ্ট
গরিবীয়ানায় সে মাগী শ্রেষ্ঠ।
অদৃষ্টে যার নেইক গয়না
গরীব হয়ে সে গরীব হয় না।

৪র্থী


বড় মান্‌ষের বিচার ত নেই।
কারেও বা তাঁর ধরে না মনেই
কেউ বা আবার মাথার ঠাকুর!

১মা


টাকাটা শিকেটা কুম্‌ড়ো কাঁকুড়
যা পাই সে ভাল, কে দেয় তাই বা!

২য়া


অবিচারে দান দিলেন নাই বা।
মাধাবাঁধা রেখে পায়ের নীচে
ভরি কত সােনা পেলেম মিছে।

ক্ষীরো


মা লক্ষ্মী যদি হতেন সদয়
দেখিয়ে দিতেম দান কারে কয়।

২য়া


আহা তাই হােক্, লক্ষ্মীর বরে
তাের ঘরে যেন টাকা নাহি ধরে।

১মা


ওলাে থাম্ তােরা, রাখ্ বকুনি—
রাণীর পায়ের শব্দ শুনি!

৪র্থী


(উচ্চৈঃস্বরে) আহা জননীর অসীম দয়া।
ভগবতী যেন কমলালয়া।

২য়া


হেন নারী আর হয়নি সৃষ্টি,
সবা পরে তাঁর সমান দৃষ্টি।

৩য়া


আহা মরি, তাঁরি হস্তে আসি
সার্থক হল অর্থরাশি।

(কল্যাণীর প্রবেশ)


কল্যাণী


রাত হল তবু কিসের কমিটি?

ক্ষীরো


সবাই তোমারি যশের জমিটি
নিড়োতেছিলেন, চষ্‌তেছিলেন,
মই দিয়ে কসে ঘষতেছিলেন,
আমি মাঝে মাঝে বীজ ছিটিয়ে
বুনেছি ফসল আশ মিটিয়ে।

কল্যাণী


রাত হল আজ যাও সবে ঘরে,
এই ক’টি কথা রেখো মনে করে।

আশার অন্ত নাইক বটে,
আর সকলেরি অন্ত ঘটে।
সবার মনের মতন ভিক্ষে
দিতে যদি হত, কল্পবৃক্ষে
ঘুণ ধরে যেত, আমি ত তুচ্ছ।
নিন্দে করলে যাব না মুচ্ছাে,
তবু এ কথাটা ভেবে দেখে দিখি—
ভাল কথা বলা শক্ত বেশি কি?

(প্রস্থান)


৪র্থী


কি বল্‌ছিলেম ছিল সেই খোঁজে।

ক্ষীরাে


না গাে না তা নয়, এটুকু সে বোঝে—
সাম্‌নে তােমরা যেটুকু বাড়ালে
সেটুকু কমিয়ে আন্‌বে আড়ালে।
উপকার যেন মধুর পাত্র,
হজম করতে জ্বলে যে গাত্র,
তাই সাথে চাই ঝালের চাট্‌নি
নিলে বান্দা কান্না কাট্‌নি।
যার খেয়ে মশা ওঠেন ফুলে,
জ্বালান্ তারেই গােপন হুলে।
দেবতারে নিয়ে বানাবে দত্যি
কলিকাল তবে হবে ত সত্যি!

৪র্থী


মিথ্যে না ভাই! সাম্‌লে চলিস্।
যাই মুখে আসে তাই যে বলিস্।
পালন যে করে সে হল মা বাপ,
তাহারি নিন্দে, সে যে মহাপাপ।
এমন লক্ষ্মী এমন সতী
কোথা আছে হেন পুণ্যবতী।
যেমন ধনের কপাল মস্ত
তেমনি দানের দরাজ হস্ত,
যেমন রূপসী তেমনি সাধ্বী,
খুঁত ধরে তাঁর কাহার সাধ্যি।
দিস্‌নেকো দোষ তাঁহার নামে।

৩য়া


তুমি থাম্‌লে যে অনেক থামে।

২য়া


আহা কোথা হতে এলেন গুরু,
হিতকথা আর কোরােনা সুরু।
হঠাৎ ধর্ম্মকথার পাঠটা
তােমার মুখে যে শােনায় ঠাট্টা।

ক্ষীরাে


ধর্ম্মও রাখাে, ঝগড়াও থাক্‌,
গলা ছেড়ে আর বাজিয়ােনা ঢাক।

পেট ভরে খেলে, করলে নিন্দে,
বাড়ি ফিরে গিয়ে ভজ গােবিন্দে।

(প্রতিবেশিনীগণের প্রস্থান)


ওরে বিনি, ওরে কিনি, ওরে কাশি!

(বিনি কিনি কাশীর প্রবেশ)


কাশী


কেন দিদি!

কিনি


কেন খুড়ি!

বিনি


কেন মাসী!

ক্ষীরাে


ওরে খাবি আয়।

বিনি


কিছু নেই ক্ষিধে।

ক্ষীরাে


খেয়ে নিতে হয় পেলেই সুবিধে।

কিনি


রসকরা খেয়ে পেট বড় ভার।

ক্ষীরো


বেশি কিছু নয়, শুধু গোটাচার
ভোলাময়লার চন্দ্রপুলি
দেখ দেখি ঐ ঢাকনা খুলি;―
তাই মুখে দিয়ে, দু’বাটি-খানিক
দুধ খেয়ে শোও লক্ষ্মী মাণিক।

কাশী


কত খাব দিদি সমস্ত দিন?

ক্ষীরো


খাবার ত নয় ক্ষিদের অধীন;
পেটের জ্বালায় কত লোকে ছোটে
খাবার কি তার মুখে এসে জোটে?
দুঃখী গরীব কাঙাল ফতুর
চাষাভূষো মুটে অনাথ অতুর
কারো ত ক্ষিদের অভাব হয় না,
চন্দ্রপুলিটা সবার রয় না।
মনে রেখে দিস যেটার যা’ দর,
খাবার চাইতে ক্ষিদের আদর।
হ্যাঁরে বিনি তোর চিরুণী রূপোর
দেখচিনে কেন খোঁপার উপর?

বিনি


সেটা ওপাড়ার ক্ষেতুর মেয়ে
কেঁদেকেটে কাল নিয়েছে চেয়ে।

ক্ষীরাে


ঐরে, হয়েছে মাথাটি খাওয়া।
তোমারো লেগেছে দাতার হাওয়া।

বিনি


আহা কিছু তার নেই যে মাসী!

ক্ষীরাে


তােমারি কি এত টাকার রাশি?
গরীব লােকের দয়ামায়া রােগ
সেটা যে একটা ভারি দুর্য্যোগ।
না না, যাও তুমি মায়ের বাড়িতে,
হেথাকার হাওয়া সবে না নাড়িতে।
রাণী যত দেয় ফুরােয় না, তাই
দান করে তার কোন ক্ষতি নাই।
তুই যেটা দিলি রইল না তাের
এতেও মনটা হয় না কাতর?
ওরে বােকা মেয়ে আমি আরো তোরে
আনিয়ে নিলেম এই মনে করে
কি করে কুড়োতে হইবে ভিক্ষে
মাের কাছে তাই করবি শিক্ষে।
কে জান্‌ত তুই পেট না ভরতে
উল্‌টো বিদ্যা শিখবি মরতে?
―দুধ যে রইল বাটির তলায়
ঐটুকু বুঝি গলেনা গলায়?

আমি মরে গেলে যত মনে আশ
কোরো দান ধ্যান আর উপবাস।
যতদিন আমি রয়েছি বর্ত্তে
দেব না কর্ত্তে আত্মহত্যে।
খাওয়া দাওয়া হল, এখন তবে
রাত ঢের হল শােওগে সবে।

(কিনি বিনি কাশীর প্রস্থান)

(কল্যাণীর প্রবেশ)


ওগো দিদি আমি বাঁচিনে ত আর।

কল্যাণী


সেটা বিশ্বাস হয় না আমার।
তবু কি হয়েছে শুনি ব্যাপারটা।

ক্ষীরো


মাইরি দিদি এ নয়ক ঠাট্টা!
দেশ থেকে চিঠি পেয়েছি মামার
বাঁচে কি না বাঁচে খুড়ীটি আমার,―
শক্ত অসুখ হয়েছে এবার
টাকাকড়ি নেই ওষুধ দেবার।

কল্যাণী


এখনো বছর হয়নি গত,
খুড়ির শ্রাদ্ধে নিলি যে কত।

ক্ষীরো


হাঁ হাঁ বটে বটে মরেছে বেটী,
খুড়ী গেছে তবু আছে ত জ্যেঠী।
আহা রাণী দিদি ধন্য তোরে
এত রেখেছিস্ স্মরণ করে।
এমন বুদ্ধি আর কি আছে!
এড়ায় না কিছু তোমার কাছে?
ফাঁকি দিয়ে খুড়ী বাঁচ্‌বে আবার
সাধ্য কি আছে সে তাঁর বাবার?
কিন্তু কখনো আমার সে জ্যেঠী
মরেনি পূর্ব্বে মনে রেখো সেটি।

কল্যাণী


মরেওনি বটে জন্মেওনি কভু।

ক্ষীর


এমন বুদ্ধি দিদি তোর, তবু
সে বুদ্ধিখানি কেবলি খেলায়
অনুগত এই আমারি বেলায়?

কল্যাণী


চেয়ে নিতে তোর মুখে ফোটে কাঁটা।
না বল্লে নয় মিথ্যে কথাটা?
ধরা পড় তবু হও না জব্দ?

ক্ষীরো


“দাও দাও” ও ত একটা শব্দ,
ওটা কি নিত্যি শোনায় মিষ্টি?

মাঝে মাঝে তাই নতুন সৃষ্টি
কর্ত্তেই হর খুড়ী জেঠীমার।
জান ত সকলি তবে কেন আর
লজ্জা দিচ্চ?

কল্যাণী


অম্‌নি চেয়ে কি
পাস্‌নি কখনো তাই বল্ দেখি?

ক্ষীরাে


মরা পাখীরেও শিকার করে’
তবে ত বিড়াল মুখেতে পােরে।
সহজেই পাই তবু দিয়ে ফাঁকি
স্বভাবটাকে যে শান দিয়ে রাখি।
বিনা প্রয়ােজনে খাটাও যাকে
প্রয়ােজন কালে ঠিক সে থাকে।
সত্যি বলচি মিথ্যে কথায়
তোমারাে কাছেতে ফল পাওয়া যায়।

কল্যাণী


এবার পাবে না।

ক্ষীরাে


আচ্ছা বেশ ত
সেজন্যে আমি নইক ব্যস্ত।

আজ না হয় ত কাল ত হবে,
ততখন মাের সবুব সবে।
গা ছুঁয়ে কিন্তু বলছি তােমার
খুড়ীটার কথা তুল্‌বনা আর।

(কল্যাণীর হাসিয়া প্রস্থান)

হরি বল মন! পরের কাছে
আদায় করার সুখও আছে,
দুঃখও ঢের! হে মা লক্ষ্মীটি
তােমার বাহন পেঁচা পক্ষীটি
এত ভালবাসে এ বাড়ির হাওয়া,
এত কাছাকাছি করে আসা-যাওয়া
ভুলে কোন দিন আমার পানে
তােমারে যদি সে বহিয়া আনে
মাথায় তাহার পরাই সিঁদুর,
জলপান দিই আশীটা ইদুর,
খেয়ে দেয়ে শেষে পেটের ভারে
পড়ে থাকে বেটা আমারি দ্বারে;
সােনা দিয়ে ডানা বাঁধাই, তবে
ওড়বার পথ বন্ধ হবে।

(লক্ষ্মী‌র আবির্ভাব)


কে আবার রাতে এসেছ জ্বালাতে,
দেশ ছেড়ে শেষে হবে কি পালাতে?
আর ত পারিনে!

লক্ষী


পালাব তবে কি?
যেতে হবে দূরে।

ক্ষীরো


রোস রোস দেখি!
কি পরেছ ওটা মাথার ওপর,
দেখাচ্ছে যেন হীরেব টোপর।
হাতে কি রয়েছে সোনার বাক্সে
দেখ্‌তে পারি কি? আচ্ছা, থাক্ সে।
এত হীরে সোনা কারো ত হয় না,―
ও গুলো ত নয় গিল্টি গয়না?
এগুলি ত সব সাঁচ্চা পাথর?
গায়ে কি মেখেছ, কিসের আতর?
ভুর ভুর করে পদ্মগন্ধ;
মনে কত কথা হতেছে সন্ধ।
বস বাছা, কেন এলে এত রাতে?
আমারে ত কেউ আসনি ঠকাতে?
যদি এসে থাক ক্ষীরিকে তা’হলে
চিন্‌তে পারনি সেটা রাখি বলে।
নাম কি তোমার বল দেখি খাঁটি।
মাথা খাও বোলো সত্য কথাটি।

লক্ষী


একটা ত নয়, অনেক যে নাম।

ক্ষীরো।


হাঁ হাঁ থাকে বটে স্বনাম বেনাম
ব্যবসা যাদের ছলনা করা।
কখনো কোথাও পড়নি ধরা?

লক্ষ্মী


ধরা পড়ি বটে দুই দশ দিন
বাঁধন কাটিয়ে আবার স্বাধীন।

ক্ষীরো


হেঁয়ালিটা ছেড়ে কথা কও সিধে,
অমন কল্লে হবে না সুবিধে।
নামটি তোমার বল অকপটে।

লক্ষ্মী


লক্ষ্মী।

ক্ষীরো


তেম্‌নি চেহারাও বটে।
লক্ষ্মী ত আছে অনেক গুলি,
তুমি কোথাকার বল ত খুলি!

লক্ষ্মী


সত্যি লক্ষ্মী একের অধিক
নাই ত্রিভুবনে।

ক্ষীরো


ঠিক ঠিক ঠিক!
তাই বল মাগো, তুমিই কি তিনি?
আলাপ ত নেই চিন্‌তে পারিনি।
চিন্‌তেম যদি চরণ জোড়া
কপাল হত কি এমন পোড়া?
এস, বস, ঘর কর’সে আলো।
পেঁচা দাদা মোর আছে ত ভালো?
এসেছ যখন, তখন মাতঃ
তাড়াতাড়ি যেতে পারবে না ত!
যোগাড় করচি চরণ সেবার;
সহজ হস্তে পড়নি এবার।
সেয়ানা লোকেরে কর না মায়া
কেন যে জানি তা বিষ্ণুজায়া।
না খেয়ে মরে না বুদ্ধি থাক্‌লে,
বোকারি বিপদ তুমি না রাখলে।

লক্ষ্মী


প্রতারণা করে পেট্‌টি ভরাও,
ধর্ম্মেরে তুমি কিছু না ডরাও?

ক্ষীরো


বুদ্ধি দেখ্‌লে এগোও না গো,
তোর দয়া নেই কাজেই মাগো।

বুদ্ধিমানেরা পেটের দায়
লক্ষ্মীমানেরে ঠকিয়ে খায়।

লক্ষ্মী

সরল বুদ্ধি আমার প্রিয়,
বাঁকা বুদ্ধিরে ধিক্‌ জানিয়ো

ক্ষীরো

ভাল তলোয়ার যেমন বাঁকা,
তেম্‌নি বক্র বুদ্ধি পাকা।
ও জিনিষ বেশি সরল হলে
নির্ব্বুদ্ধি ত তারেই বলে।
ভাল মাগো, তুমি দয়া কর যদি,
বোকা হয়ে আমি রব নিরবধি।

লক্ষ্মী

কল্যাণী তোর অমন প্রভু
তারেও দস্যু, ঠকাও তবু।

ক্ষীরো

অদৃষ্টে শেষে এই ছিল মোর
যার লাগি চুরি সেই বলে চোর।
ঠকাতে হয় যে-কপালদোষে
তোরে ভালবাসি বলেই ত সে।
আর ঠকাব না, আরামে ঘুমিয়ো;
আমারে ঠকিয়ে যেও না তুমিও।

লক্ষ্মী


স্বভাব তোমার বড়ই রুক্ষী।

ক্ষীরো


তাহার কারণ আমি যে দুঃখী।
তুমি যদি কর রসের বৃষ্টি
স্বভাবটা হবে আপ্‌নি মিষ্টি।

লক্ষ্মী


তোরে যদি আমি করি আশ্রয়
যশ পাব কি না সন্দেহ হয়।

ক্ষীরো


যশ না পাও ত কিসের কড়ি।
তবে ত আমার গলায় দড়ি।
দশের মুখেতে দিলেই অন্ন
দশমুখে উঠে ধন্য ধন্য।

লক্ষ্মী


প্রাণ ধরে দিতে পারবি ভিক্ষে?

ক্ষীরো


একবার তুমি কর পরীক্ষে।
পেট ভরে গেলে যা থাকে বাকি
সেটা দিয়ে দিতে শক্তটা কি!
দানের গরবে যিনি গরবিনী
তিনি হোন্ আমি, আমি হই তিনি,

দেখ্‌বে তখন তাঁহার চালটা,
আমারি বা কত উল্টো পাল্টা।
দাসী আছি, জানি দাসীর যা রীতি,
রাণী কর, পাব রাণীর প্রকৃতি।
তাঁরো যদি হয় মোর অবস্থা
সুযশ হবে না এমন সস্তা।
তাঁর দয়াটুকু পাবে না অন্যে
ব্যয় হবে সেটা নিজেরি জন্যে।
কথার মধ্যে মিষ্টি অংশ
অনেকখানিই হবেক ধ্বংস।
দিতে গেলে, কড়ি কভু না সর্‌বে,
হাতের তেলোয় কাম্‌ড়ে ধরবে।
ভিক্ষে করতে ধরতে দু’পায়
নিত্যি নতুন উঠ্‌বে উপায়।

লক্ষ্মী


তথাস্তু, রাণী করে দিনু তোকে,
দাসী ছিলি তুই ভুলে যাবে লোকে।
কিন্তু সদাই থেকো সাবধান
আমার না যেন হয় অপমান।


দ্বিতীয় দৃশ্য

রাণীবেশে ক্ষীরো ও তাহার পারিষদবর্গ।

ক্ষীরো


বিনি!

বিনি


কেন মাসী!

ক্ষীরো


মাসী কিরে মেয়ে!
দেখিনি ত আমি বোকা তোর চেয়ে।
কাঙাল ভিখিরি কলু মালী চাষী
তারাই মাসীরে বলে শুধু মাসী;
রাণীর বোন্‌ঝি হয়েছ ভাগ্যে,
জাননা আদব! মালতী,

মালতী


আজ্ঞে!

ক্ষীরো


রাণীর বোন্‌ঝি রাণীরে কি ডাকে
শিখিয়ে দে ঐ বোকা মেয়েটাকে।

মালতী


ছিছি শুধু মাসী বলে কি রাণীকে?
রাণী মাসী বলে রেখে দিয়ো শিখে।

ক্ষীরো

মনে থাক্‌বে ত? কোথা গেল কাশী!

কাশী

কেন রাণী দিদি।

ক্ষীরো

চার চার দাসী

নেই যে সঙ্গে?

কাশী

এত লোক মিছে

কেন দিনরাত লেগে থাকে পিছে?

ক্ষীরো

মালতী!

মালতী

আজ্ঞে!

ক্ষীরো

এই মেয়েটাকে

শিখিয়ে দে কেন এত দাসী থাকে।

মালতী

তোনরা ত নও জেলেনী তাঁতিনী,
তােমরা হও যে রাণীর নাতিনী।

যে নবাববাড়ি এনু আমি ত্যেজি
সেথা বেগমের ছিল পোষা বেজি
তাহারি একটা ছোট বাচ্ছার
পিছনেতে ছিল দাসী চার চার
তা ছাড়া সেপাই।

ক্ষীরো


শুলি ত কাশী!

কাশী


শুনেছি।

ক্ষীর


তাহ’লে ডাক্ তোর দাসী।
কিনি পোড়ামুখী!

কিনি


কেন রাণী খুড়ী?

ক্ষীরো


হাই তুল্লেম দিলিনে যে তুড়ি?
মালতী!

মালতী


আজ্ঞে!

ক্ষীরো


শেখাও কায়দা।

মালতী


এত বলি তবু হয় না ফায়দা।
বেগম সাহেব যখন হাঁচেন
তুড়ি ভুল হলে কেহ না বাঁচেন।
তখনি শূলেতে চড়িয়ে তারে
নাকে কাটি দিয়ে হাঁচিয়ে মারে।

ক্ষীরো


সোনার বাটায় পান দে তারিণী!
কোথা গেল মোর চামরধারিণী।

তারিণী


চলে গেছে ছুঁড়ি, সে বলে মাইনে
চেয়ে চেয়ে তবু কিছুতে পাইনে।

ক্ষীরো


ছোট লোক বেটী হারামজাদী
রাণীর ঘরে সে হয়েছে বাঁদি
তবু মনে তার নেই সন্তোষ
মাইনে পায় না বলে দেয় দোষ।
পিঁপ্‌ড়ের পাখা কেবল মরতে।
মালতী!

মালতী


আজ্ঞে!

ক্ষীরো


মাগীরে ধরতে
পাঠাও আমার ছ-ছয় পেয়াদা,
না না যাবে আরো দুজন জেয়েদা।
কি বল মালতী!

মালতী


দস্তুর তাই।

ক্ষীরো


হাতকড়ি দিয়ে বেঁধে আনা চাই।

তারিণী


ওপাড়ার মতি রাণীমাতাজির
চরণে দেখতে হয়েছে হাজির।

ক্ষীরো


মালতী!

মালতী


আজ্ঞে।

ক্ষীরো


নবাবের ঘরে।
কোন্ কায়দায় লোকে দেখা করে।

মালতী


কুর্ণিস্ করে ঢোকে মাথা নুয়ে,
পিছু হটে যায় মাটি ছুঁয়ে ছুঁয়ে।

ক্ষীরাে


নিয়ে এস সাথে, যাও ত মালতী,
কুর্ণিস্ করে আসে যেন মতি।

(মতিকে লইয়া মালতীর পুনঃ প্রবেশ)

মালতী


মাথা নীচু কর। মাটি ছোঁও হাতে,
লাগাও হাতটা নাকের ডগাতে।
তিন পা এগোও, নীচু কর মাথা।

মতি


আর ত পারিনে, ঘাড়ে হল ব্যথা।

মালতী


তিনবার নাকে লাগাও হাতটা।

মতি


টন্ টন্ করে পিঠের বাতটা।

মালতী


তিন পা এগােও, তিনবার ফের
ধূলো তুলে নেও ডগায় নাকের।

মতি


ঘাট হয়েছিল এসেছি এ পথ,
এর চেয়ে সিধে নাকে দেওয়া খৎ।
জয় রাণীমার, একাদশী আজি।

ক্ষীরো


রাণীর জ্যোতিষী শুনিয়েছে পাঁজি।
কবে একাদশী, কবে কোন্ বার
লোক আছে মোর তিথি গোন্‌বার।

মতি


টাকাটা শিকেটা যদি কিছু পাই
জয় জয় বলে বাড়ি চলে যাই।

ক্ষীরো


যদি নাই পাও তবু যেতে হবে,
কুর্ণিস্ করে’ চলে’ যাও তবে।

মতি


ঘড়া ঘড়া টাকা ঘরে গড়াগড়ি
তবু কড়াকড় দিতে কড়াকড়ি।

ক্ষীরো


ঘরের জিনিস ঘরেরি ঘড়ায়
চিরদিন যেন ঘরেই গড়ায়।
মালতী!

মালতী


আজ্ঞে!

ক্ষীরো


এবার মাগীরে
কুর্ণিস করে নিয়ে যাও ফিরে।

মতি


চল্লেম হবে।

মালতী


রােস, ফিরাে নাকো,
তিনবার মাটি তুলে নাকে মাখো।
তিন পা কেবল হটে যাও পিছু,
পােড়ো না উল্টে, মাথা কর নিচু।

মতি


হায়, কোথা এনু, ভরল না পেট,
বারে বারে শুধু মাথা হল হেঁট।
আহা কল্যাণী রাণীর ঘরে
কর্ণ জুড়ােয় মধুর স্বরে,―
কড়ি যদি দেন অমূল্য তাই,―
হেথা হীরে মােতি সেও অতি ছাই।

ক্ষীরো


সে-ছাই পাবার ভরসা কোরাে না।

মালতী


সাবধানে হঠ, উল্টে পােড়ো না।

(মতির প্রস্থান)


ক্ষীরো


বিনি!

বিনি


রাণী মাসী!

ক্ষীরো


একগাছি চুডি
হাত থেকে তোর গেছে না কি চুরি?

বিনি


চুরি ত যায় নি।

ক্ষীরো


গিয়েছে হারিয়ে?

বিনি


হারায় নি।

ক্ষীরো


কেউ নিয়েছে ভাঁড়িয়ে?

বিনি


না গো রাণী মাসী!

ক্ষীরো


এটাতো মানিস্
পাখা নেই তার! একটা জিনিষ
হয় চুরি যায়, নয় ত হারায়,
নয় মারা যায় ঠগের দ্বারায়;
তা না হলে থাকে, এ ছাড়া তাহার
কি যে হতে পারে জানিনে ত আর।

বিনি


দান করেছি সে।

ক্ষীরো


দিয়েছিস্ দানে?
ঠকিয়েছে কেউ, তারি হল মানে।
কে নিয়েছে বল?

বিনি


মল্লিকা দাসী।
এমন গরীব নেই রাণী মাসী।
ঘরে আছে তার সাত ছেলে মেয়ে
মাস পাঁচছয় মাইনে না পেয়ে
খরচ পত্র পাঠাতে পারে না
দিনে দিনে তার বেড়ে যায় দেনা,
কেঁদে কেঁদে মরে, তাই চুড়িগাছি
নুকিয়ে তাহারে দান করিয়াছি।
অনেক ত চুড়ি আছে মোর হাতে
একখানা গেলে কি হবে তাহাতে।

ক্ষীরো


বোকা মেয়েটার শোন ব্যাখ্যানা।
একখানা গেলে গেল একখানা,
সে যে একেবারে ভারি নিশ্চয়।
কে না জানে যেটা রাখ সেটা রয়,

যেটা দিয়ে ফেল সেটা ত রয় না,
এর চেয়ে কথা সহজ হয় না।
অল্পস্বল্প যাদের আছে
দানে যশ পায় লোকের কাছে;
ধনীর দানেতে ফল নাহি ফলে,
যত দেও তত পেট বেড়ে চলে,
কিছুতে ভরে না লোকের স্বার্থ,
ভাবে, আরো ঢের দিতে যে পার্‌ত।
অতএব বাছা হবি সাবধান,
বেশি আছে বলে করিসনে দান।
মালতী!

মালতী


আজ্ঞে!

ক্ষীরো


বোকা মেয়েটি এ,
এরে দুটো কথা দাও সম্‌জিয়ে।

মালতী


রাণীর বোন্‌ঝি রাণীর অংশ,
তফাতে থাক্‌বে উচ্চ বংশ;
দান করা-টরা যত হয় বেশি
গরীবের সাথে তত ঘেঁষাঘেঁষি।
পুরোণো শাস্ত্রে লিখেছে শোলোক,
গরীবের মত নেই ছোটলোক।

ক্ষীরো


মালতী!

মালতী


আজ্ঞে!

ক্ষীরো


মল্লিকাটারে
আর ত রাখা না।

মালতী


তাড়াব তাহারে;
ছেলেমেয়েদের দয়ার চর্চ্চা
বেড়ে গেলে, সাথে বাড়বে খরচা।

ক্ষীরো


তাড়াবার বেলা হয়ে আনমনা
বালাটা সুদ্ধ যেন তাড়িয়ো না।
বাহিরের পথে কে বাজায় বাঁশি
দেখে আয় মোর ছয় ছয় দাসী।

(তারিণীর প্রস্থান ও পুনঃ প্রবেশ)


তারিণী


মধুদত্তর পৌত্রের বিয়ে
ধুম করে’ তাই চলে পথ দিয়ে।

ক্ষীরো


রাণীর বাড়ির সাম্‌নের পথে
বাজিয়ে যাচ্চে কি নিয়ম মতে?
বাঁশির বাজনা রাণী কি সইবে?
মাথা ধরে’ যদি থাক্‌ত দৈবে?
যদি ঘুমোতেন, কাঁচা ঘুমে জেগে
অসুখ করত যদি রেগেমেগে?
মালতী!

মালতী


আজ্ঞে!

ক্ষীরো


নবাবের ঘরে
এমন কাণ্ড ঘট্‌লে কি করে?

মালতী


যার বিয়ে যায় তারে ধরে আনে,
দুই বাঁশিওয়ালা তার দুই কানে
কেবলি বাজায় দুটো দুটো বাঁশি;
তিন দিন পরে দেয় তারে ফাঁসি।

ক্ষীরো


ডেকে দাও কোথা আছে সর্দ্দার,
নিয়ে যাক্ দশ জুতোবর্দ্দার,

ফি লোকের পিঠে দশঘা চাবুক
সপাসপ্ বেগে সজোরে নাবুক।

মালতী


তবু যদি কারো চেতনা না হয়,
বন্দুক দিলে হবে নিশ্চয়।

১মা


ফাঁসি হল মাপ, বড় গেল বেঁচে,
জয় জয় বলে বাড়ি যাবে নেচে।

২য়া


প্রসন্ন ছিল তাদের গ্রহ,
চাবুক ক’ঘা ত অনুগ্রহ।

৩য়া


বলিস্ কি ভাই ফাঁড়া গেল কেটে,
আহা এত দয়া রাণীমার পেটে!

ক্ষীরো


থাম্ তোরা, শুনে নিজে গুণগান
লজ্জায় রাঙা হয়ে ওঠে কান।
বিনি!

বিনি


রাণী মাসী!

ক্ষীরো


স্থির হয়ে র’বি
ছট্‌ফট্ করা বড় বে-আদবী।
মালতী!

মালতী


আজ্ঞে!

ক্ষীরাে


মেয়েরা এখনো
শেখেনি আমিরী দস্তুর্ কোনাে।

মালতী


(বিনির প্রতি) রাণীর ঘরের ছেলেমেয়েদের
ছট্‌ফট্‌ করা ভারি নিন্দের।
ইতর লোকেরি ছেলেমেয়েগুলো
হেসে খুসে ছুটে করে খেলাধূলো।
রাজা রাণীদের পুত্র কন্য়ে
অধীর হয় না কিছুরি জন্যে।
হাত পা সাম্‌লে খাড়া হয়ে থাক
রাণীর সাম্‌নে নোড়ো চোড়ো নাক।

ক্ষীরো


ফের গোলমাল করচে কাহারা?
দরজায় মাের নাই কি পাহারা?

তারিণী


প্রজারা এসেছে নালিশ করতে।

ক্ষীরো


আর কি জায়গা ছিল না মরতে?

মালতী


প্রজার নালিশ শুন্‌বে রাজ্ঞী
ছোটলোকদের এত কি ভাগ্যি!

১মা


তাই যদি হবে তবে অগণ্য
নোকর চাকর কিসের জন্য?

২য়া


নিজের রাজ্যে রাখতে দৃষ্টি
রাজা রাণীদের হয় নি সৃষ্টি।

তারিণী


প্রজারা বল্‌চে কর্ম্মচারী
পীড়ন তাদের করচে ভারী।
নাই মায়া দয়া নাইক ধর্ম্ম,
বেচে নিতে চায় গায়ের চর্ম্ম।
বলে তারা, হায় কি করেছি পাপ,
এত ছোট মোরা, এত বড় চাপ।

ক্ষীরো


শর্সেও ছােট, তবু সে ভােগায়,
চাপ না পেলে কি তৈল যােগায়?
টাকা জিনিষটা নয় পাকা ফল,
টুপ্ করে খসে’ ভরে না আঁচল;
ছিঁড়ে নাড়া দিয়ে ঠেঙার বাড়িতে
তবে ও জিনিষ হয় যে পাড়িতে।

তারিণী


সেজন্যে না মা,—তােমার খাজনা
বঞ্চনা করা তাদের কাজ না।
তারা বলে যত আম্‌লা তােমার
মাইনে না পেয়ে হয়েছে গােঙার।
লুট্ পাট্ করে মারচে প্রজা,
মাইনে পেলেই থাক্‌বে সােজা।

ক্ষীরো


রাণী বটি, ওবু নইক বােকা,
পারবে না দিতে মিথ্যে ধোঁকা;
করবেই তারা দস্যুবৃত্তি,
মাইনেটা দেওয়া মিথ্যে মিথ্যি।
প্রজাদের ঘরে ডাকাতী করে
তা বলে করবে রাণীরো ঘরে?

তারিণী


তারা বলে রাণী কল্যাণী যে
নিজের রাজ্য দেখেন নিজে।
নালিশ শােনেন নিজের কানেই,
প্রজাদের পরে জুলুমটা নেই।

ক্ষীরো


ছােটমুখে বলে বড় কথাগুলা,
আমার সঙ্গে অন্যের তুলা?
মালতী!

মালতী


আজ্ঞে!

ক্ষীরাে


কি কর্ত্তব্য?

মালতী


জরিমানা দিক্‌ যত অসভ্য
একশো একশো।

ক্ষীরো


গরীব ওরা যে,
তাই একেবারে একশাের মাঝে
নব্বই টাকা করে দিনু মাপ।

১মা


আহা গরীবের তুমিই মা বাপ।

২য়া


কার মুখ দেখে উঠেছিল প্রাতে,
নব্বই টাকা পেল হাতে হাতে।

৩য়া


নব্বই কেন, যদি ভেবে দেখে,
আরো ঢের টাকা নিয়ে গেল ট্যাঁকে।
হাজার টাকার নশো নব্বই
চখের পলকে পেল সর্ব্বই।

৪র্থী


একদমে ভাই এত দিয়ে ফেলা,
অন্যে কে পারে, এ ত নয় খেলা!

ক্ষীরো


বলিস নে আর মুখের আগে,
নিজ গুণ শুনে সরম লাগে।
বিনি!

বিনি


রাণী মাসি!

ক্ষীরো


হঠাৎ কি হল!
ফোঁস্ ফোঁস্ করে কাঁদিস্ কেন লো?

দিন রাত আমি বকে বকে খুন,
শিখলিনে কিছু কায়দা কানুন?
মালতী!

মালতী


আজ্ঞে!

ক্ষীরো


এই মেয়েটাকে
শিক্ষা না দিলে মান নাহি থাকে।

মালতী


রাণীর বোন্‌ঝি জগতে মান্য,
বোঝ না এ কথা অতি সামান্য।
সাধারণ যত ইতর লোকেই
সুখে হাসে, কাঁদে দুঃখ শোকেই।
তোমাদেরো যদি তেম্‌নি হবে,
বড়লোক হয়ে হল কি তবে?

(একজন দাসীর প্রবেশ)


দাসী


মাইনে না পেলে মিথ্যে চাক্‌রী,
বাঁধা দিয়ে এনু কানের মাক্‌ড়ি।
ধার করে খেয়ে পরের গোলামী
এমন কখনো শুনিনি ত আমি।
মাইনে চুকিয়ে দাও, তা না হলে
ছুটি দাও আমি ঘরে যাই চলে।

ক্ষীরো


মাইনে চুকোনো নয়ক মন্দ,
তবু ছুটিটাই মোর পছন্দ।
বড় ঝঞ্ঝাট্ মাইনে বাঁটতে,
হিসেব কিতেব হয় যে ঘাঁটতে।
ছুটি দেওয়া যায় অতি সত্বর,
খুল তে হয় না খাতা পত্তর।
ছ-ছয় পেয়াদা ধরে আসি কেশ,
নিমেষ ফেল তে কর্ম্ম নিকেশ।
মালতী!

মালতী


আজ্ঞে!

ক্ষীরো


সাথে যাও ওর
ঝেড়ে ঝুড়ে নিয়ো কাপড় চোপড়,
ছুটি দেয় যেন দরোয়ান যত
হিন্দুস্থানী দস্তুর মত।

মালতী


বুঝেছি রাণীজি!

ক্ষীরো


আচ্ছা তাহ’লে
কুর্ণিস্ করে যাক্ বেটী চলে।

(কুর্ণিস্ করাইয়া দাসীকে বিদায়)

দাসী


দুয়ারে রাণী মা দাঁড়িয়ে আছে কে
বড় লোকের ঝি মনে হয় দেখে।

ক্ষীরো


এসেছে কি হাতী কিম্বা রথে?

দাসী


মনে হল যেন হেঁটে এল পথে।

ক্ষীরো


কোথা তবে তার বড়লোকত্ব?

দাসী


রাণীর মতন মুখটি সত্য।

ক্ষীরো


মুখে বড়লোক লেখা নাহি থাকে,
গাড়ি ঘোড়া দেখে চেনা যায় তাকে।

(মালতীর প্রবেশ)


মালতী


রাণী কল্যাণী এসেছেন দ্বারে
রাণীজির সাথে দেখা করিবারে।

ক্ষীরো


হেঁটে এসেছেন?

মালতী


শুন্‌চি তাইত!

ক্ষীরো


তাহ’লে হেথায় উপায় নাই ত।
সমান আসন কে তাহারে দেয়?
নীচু আসনটা সেও অন্যায়!
এ এক বিষম হল সমিস্যে,
মীমাংসা এর কে করে বিশ্বে?

১মা


মাঝখানে রেখে রাণীজির গদি
তাহার আসন দূরে রাখি যদি!

২য়া


ঘুরায়ে যদি এ আসনখানি
পিছন ফিরিয়া বসেন রাণী!

৩য়া


যদি বলা যায় ফিরে যাও আজ,
ভাল নেই বড় রাণীর মেজাজ।

ক্ষীরো


মালতী!

মালতী


আজ্ঞে

ক্ষীরো


কি করি উপায়?

মালতী


দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে যদি সারা যায়
দেখা শোনা, তবে সব গোল মেটে।

ক্ষীরো


এত বুদ্ধিও আছে তোর পেটে!
সেই ভাল। আগে দাঁড়া সার বাঁধি
আমার একশো পঁচিশটে বাঁদী।
ও হল না ঠিক,―পাঁচ পাঁচ করে
দাঁড়া ভাগে ভাগে—তোরা আয় সরে,—
না না এই দিকে,—না না কাজ নেই,
সারি সারি তোরা দাঁড়া সাম্‌নেই,—
না না তাহ’লে যে মুখ যাবে ঢেকে
কোনাকুনি তোরা দাঁড়া দেখি বেঁকে।
আচ্ছা তাহ’লে ধরে হাতে হাতে
খাড়া থাক্ তোরা একটু তফাতে।
শশি, তুই সাজ ছত্রধারিণী,
চামরটা নিয়ে দোলাও তারিণী!
মালতী!

মালতী


আজ্ঞে!

ক্ষীরো


এইবার তারে
ডেকে নিয়ে আয় মোর দরবারে।

(মালতীর প্রস্থান)

কিনি বিনি কাশী স্থির হয়ে থাকো,
খবর্দ্দার্ কেউ নোড়ো চোড়ো নাকো।
মোর দুই পাশে দাঁড়াও সকলে
দুই ভাগ করি।

(কল্যাণী ও মালতীর প্রবেশ)


কল্যাণী


আছ ত কুশলে?

ক্ষীরো


আমার চেষ্টা কুশলেই থাকি,
পরের চেষ্টা দেবে মোরে ফাঁকি,
এই ভাবে চলে জগৎ সুদ্ধ
নিজের সঙ্গে পরের যুদ্ধ।

কল্যাণী


ভাল আছ বিনি?

বিনি


ভালই আছি মা,
স্নান কেন দেখি সোনার প্রতিমা?

ক্ষীরো


বিনি করিস নে মিছে গোলযোগ,
ঘুচল না তোর কথা-কওয়া রোগ?

কল্যাণী


রাণী, যদি কিছু না কর মনে,
কথা আছে কিছু কব গোপনে।

ক্ষীরো


আর কোথা যাব, গোপন এই ত,
তুমি আমি ছাড়া কেহই নেই ত।
এরা সব দাসী, কাজ নেই কিছু,
রাণীর সঙ্গে ফেরে পিছু পিছু।
হেথা হতে যদি করে দিই দূর
হবে না ত সেটা ঠিক দস্তুর।
কি বল মালতী?

মালতী


আজ্ঞে তাইত।
দস্তুর মত চলাই চাই ত।

ক্ষীরো


সোনার বাটাটা কোথায় কে জানে!
খুঁজে দেখ্ দেখি।

দাসী


এই যে এখানে।

ক্ষীরো


ওটা নয়, সেই মুক্তো-বসানো
আরেকটা আছে সেইটেই আনো।

(অন্য বাটা আনয়ন)

খয়েরের দাগ লেগেছে ডালায়,
বাঁচিনে ত আর তোদের জ্বালায়!
তবে নিয়ে আয় চুনীর সে বাটা,
না না নিয়ে আয় পান্না-দেওয়াটা।

কল্যাণী


কথাটা আমার নিই তবে বলে।
পাঠান বাদ্‌শা অন্যায় ছলে
রাজ্য আমার নিয়েছেন কেড়ে,―

ক্ষীরো


বল কি! তাহ’লে গেছে ফুল্‌বেড়ে,
গিরিধরপুর, গোপাল নগর,
কানাইগঞ্জ—

কল্যাণী


সব গেছে মোর।

ক্ষীরো


হাতে আছে কিছু নগদ টাকা কি?

কল্যাণী


সব নিয়ে গেছে, কিছু নেই বাকি।

ক্ষীরো


অদৃষ্টে ছিল এত দুখ তাের!
গয়না যা ছিল হীরে মুক্তোর,
সেই বড় বড় নীলার কণ্ঠি
কানবালা যােড়া বেড়ে গড়নটি,
সেই যে চুনীর পাঁচনলীহার
হীরে-দেওয়া সীঁথি লক্ষ টাকার,
সেগুলো নিয়েছে বুঝি লুটে পুটে?

কল্যাণী


সব নিয়ে গেছে সৈন্যেরা জুটে।

ক্ষীরো


আহা তাই বলে ধনজনমান
পদ্মপত্রে জলের সমান।
দামী তৈজস ছিল যা পুরােণো
চিহ্নও তার নেই বুঝি কোনো?
সেকালের সব জিনিষপত্র
আসাসােটাগুলো চামরছত্র
চাঁদোয়া কানাৎ, গেছে বুঝি সব?
শাস্ত্রে যে বলে ধন বৈভব
তড়িৎ সমান, মিথ্যে সে নয়!
এখন তাহ’লে কোথা থাকা হয়?
বাড়িটা ত আছে?

কল্যাণী


ফৌজের দল
প্রাসাদ আমার করেছে দখল।

ক্ষীরো


ওম। ঠিক এ যে শোনায় কাহিনী,
কাল ছিল রাণী আজ ভিখারিণী।
শাস্ত্রে তাই ত বলে সব মায়া,
ধনজন তালবৃক্ষের ছায়া।
কি বল মালতী?

মালতী


তাইত বটেই
বেশি বাড় হলে পতন ঘটেই।

কল্যাণী


কিছু দিন যদি হেথায় তোমার
আশ্রয় পাই, করি উদ্ধার
আবার আমার রাজ্যখানি;
অন্য উপায় নাহিক জানি।

ক্ষীরো


আহা, তুমি রবে আমার হেথায়
এ ত বেশ কথা, সুখেরি কথা এ।

১মা


আহা কত দয়া।

২য়া


মায়ার শরীর।

৩য়া


আহা, দেবী তুমি, নও পৃথিবীর।

৪র্থী


হেথা ফেরেনাক অধম পতিত,
আশ্রয় পায় অনাথ অতিথ।

ক্ষীরো


কিন্তু একটা কথা আছে বোন!
বড় বটে মোর প্রাসাদ ভবন,
তেমনি যে ঢের লোকজন বেশি
কোন মতে তারা আছে ঠেসাঠেসি।
এখানে তোমার জায়গা হবে না
সে একটা মহা বয়েছে ভাবনা।
তবে কিছু দিন যদি ঘর ছেড়ে
বাইরে কোথাও থাকি তাঁবু পেড়ে—

১মা


ওমা সে কি কথা!

২য়া


তাহ’লে রাণীমা
রবে না তোমার কষ্টের সীমা।

৩য়া


যে-সে তাঁবু নয়, তবু সে তাঁবুই,
ঘর থাক্‌তে কি ভিজবে বাবুই?

৫মী


দয়া করে কত নাব্‌বে নাবোতে,
রাণী হয়ে কি না থাক বে তাঁবুতে?

৬ষ্ঠী


তোমার সে দশা দেখলে চক্ষে
অধীনগণের বাজবে বক্ষে।

কল্যাণী।


কাজ নেই রাণী সে অসুবিধায়,
আজকের তবে লইনু বিদায়।

ক্ষীরো


যাবে নিতান্ত! কি করব ভাই
ছুঁচ ফেলবার জায়গাটি নাই।
জিনিষপত্র লোক-লস্করে
ঠাসা আছে ঘর—কারে ফস্ করে
বসতে বলি যে তার যোটি নেই।
ভাল কথা! শোন, বলি গোপনেই,―
গয়নাপত্র কৌশলে রাতে
দু দশটা যাহা পেরেছ সরাতে
মোর কাছে দিলে রবে যতনেই।

কল্যাণী


কিছুই আনিনি, শুধু হের এই
হাতে দুটি চুড়ি, পায়েতে নূপুর।

ক্ষীরো


আজ এস তবে বেজেছে দুপুর;―
শরীর ভাল না, তাইতে সকালে
মাথা ধরে যায় অধিক বকালে।
মালতী!

মালতী


আজ্ঞে!

ক্ষীরো


জানে না কানাই
স্নানের সময় বাজবে শানাই?

মালতী


বেটারে উচিত করব শাসন।

(কল্যাণীর প্রস্থান)


ক্ষীরো


তুলে রাখ মোর রত্ন আসন,―
আজকের মত হল দরবার।
মালতী!

মালতী


আজ্ঞে!

ক্ষীরো


নাম করবার
সুখ ত দেখলি।

মালতী


হেসে নাহি বাঁচি,―
ব্যাং থেকে কেঁচে হলেন ব্যাঙাচি।

ক্ষীরো


আমি দেখ বাছা নাম-করাকরি,
যেখানে সেখানে টাকা-ছড়াছড়ি,
জড় করে’ দল ইতর লোকের
জাঁকজমকের লোক-চমকের
যত রকমের ভণ্ডামি আছে
ঘেঁসিনে কখনো ভুলে তার কাছে।

১মা


রাণীর বুদ্ধি যেমন সারালো,
তেম্‌নি ক্ষুরের মতন ধারালো।

২য়া


অনেক মুখে করে দান ধ্যান,
কার আছে হেন কাণ্ডজ্ঞান।

৩য়া


রাণীর চক্ষে ধূলো দিয়ে যাবে
হেন লোক হেন ধূলো কোথা পাবে?

ক্ষীরাে


থাম্ থাম্ তােরা রেখে দে বকুনি
লজ্জা করে যে নিজ গুণ শুনি।
মালতী!

মালতী


আজ্ঞে!

ক্ষীরো


ওদের গয়না
ছিল যা এমন কাহারো হয় না।
দুখানি চুড়িতে ঠেকেচে শেষে
দেখে আমি আর বাঁচিনে হেসে।
তবু মাথা যেন নুইতে চায় না,
ভিখ্ নেবে তবু কতই বায়না।
পথে বের হল পথের ভিখারী
ভুল্‌তে পারে না তবু রাণীগিরি।
নত হয় লোক বিপদে ঠেক্‌লে
পিত্তি জ্বলে যে দেমাক্ দেখলে।
আবার কিসের শুনি কোলাহল?

মালতী


দুয়ারে এসেছে ভিক্ষুকদল।
আকাল পড়েছে, চালের বস্তা
মনের মতন হয়নি সস্তা,

তাইতে চেঁচিয়ে খাচ্চে কানটা
বেতটি পড়লে হবেন ঠাণ্ডা।

ক্ষীরো


রাণী কল্যাণী আছেন দাতা,
মোর দ্বারে কেন হস্ত পাতা!
বলে দে আমার পাঁড়েজি বেটাকে
ধরে নিয়ে যাক্ সকল কটাকে
দাতা কল্যাণী রাণীর ঘরে,
সেথায় আসুক্ ভিক্ষে করে।
সেখানে যা পাবে এখানে তাহার
আরো পাঁচ গুণ মিল্‌বে আহার।

১মা


হা হা হা! কি মজা হবেই না জানি।

২য়া


হাসিয়ে হাসিয়ে মারলেন রাণী।

৩য়া


আমাদের রাণী এতও হাসান্।

৪র্থী


দু চোখ চক্ষু জলেতে ভাসান্।

(দাসীর প্রবেশ)


দাসী


ঠাক্‌রুণ এক এসেছেন দ্বারে
হুকুম পেলেই তাড়াই তাঁহারে।

ক্ষীরো


না না ডেকে দে না! আজ কি জন্য
মন আছে মোর বড় প্রসন্ন।

(ঠাকুরাণীর প্রবেশ)


ঠাকুরাণী


বিপদে পড়েছি তাই এনু চলে।

ক্ষীরো


সে ত জানা কথা! বিপদে না পলে
শুধু যে আমার চাঁদ মুখখানি
দেখতে আসনি সেটা বেশ জানি।

ঠাকুরাণী


চুরি হয়ে গেছে ঘরেতে আমার—

ক্ষীরো


মোর ঘরে বুঝি শোধ নেবে তার!

ঠাকুরাণী


দয়া করে যদি কিছু কর দান
এ যাত্রা তবে বেঁচে যায় প্রাণ।

ক্ষীরো


তোমার যা কিছু নিয়েছে অন্যে
দয়া চাও তুমি তার জন্যে!

আমার যা তুমি নিয়ে যাবে ঘরে
তার তরে দয়া আমায় কে করে?

ঠাকুরাণী


ধনসুখ আছে যার ভাণ্ডারে
দানসুখে তার সুখ আরো বাড়ে।
গ্রহণ যে করে তারি হেঁট মুখ,
দুঃখের পরে ভিক্ষার দুখ।
তুমি সক্ষম আমি নিরুপায়
অনায়াসে পার ঠেলিবারে পায়;
ইচ্ছা না হয় নাই কোরো দান
অপমানিতেরে কেন অপমান?
চলিলাম তবে, বল দয়া করে
বাসনা পূরিবে গেলে কার ঘরে?

ক্ষীরো


রাণী কল্যাণী নাম শোন নাই?
দাতা বলে তাঁর বড় যে বড়াই।
এইবার তুমি যাও তাঁরি ঘরে
ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে এস ভরে,
পথ না জান ত মোর লোকজন
পৌঁছিয়ে দেবে রাণীর ভবন।

ঠাকুরাণী


তবে তথাস্তু! যাই তাঁরি কাছে।
তাঁর ঘর মোর খুব জানা আছে।

আমি সে লক্ষ্মী, তাের ঘরে এসে
অপমান পেয়ে ফিরিলাম শেষে।
এই কথা ক’টি করিয়ো স্মরণ—
ধনে মানুষের বাড়ে নাক মন।
আছে বহু ধনী আছে বহু মানী
সবাই হয় না রাণী কল্যাণী।

ক্ষীরো


যাবে যদি তবে ছেড়ে যাও মােরে
দস্তুরমত কুর্ণিস্ করে।
মালতী! মালতী! কোথায় তারিণী!
কোথা গেল মাের চামরধারিণী!
আমার একশো পঁচিশটে দাসী!
তােরা কোথা গেলি বিনি কিনি কাশী!

(কল্যাণীর প্রবেশ)


কল্যাণী


পাগল হলি কি! হয়েছে কি তাের?
এখনো যে রাত হয়নিক ভাের!
বল্ দেখি কি যে কাণ্ড কল্লি?
ডাকাডাকি করে জাগালি পল্লী?

ক্ষীরাে


ওমা তাইত গা! কি জানি কেমন
সারারাত ধরে দেখেছি স্বপন।

বড় কূস্বপ্ন দিয়েছিল বিধি,
স্বপনটা ভেঙে বাঁচলেম দিদি।
একটু দাঁড়াও, পদধুলি লব;
তুমি রাণী আমি চিরদাসী তব।

২৯শে অগ্রহায়ণ, ১৩০৪