চিঠিপত্র (দশম খণ্ড, ১৯৬৭)/দীনেশচন্দ্র সেনকে লিখিত/৩২

৩২

[নভেম্বর ১৯০৫]

বোলপুর

প্রীতিসম্ভাষণমেতৎ

 স্বদেশী আন্দোলন ইতিহাসের গুটিকয়েক সূত্র:—

 প্রথম ইংরেজি শিক্ষার মত্ততায় বাঙালী ছাত্রদের মনে স্বদেশী-বিদ্বেষের উৎপত্তি হইয়াছিল। তখন শিক্ষাপ্রাপ্ত বাঙালী দেশের শিল্প সাহিত্য ইতিহাস ও ধর্ম্ম সম্বন্ধে নিজেদের দৈন্য কল্পনা করিয়া লজ্জাবোধ করিতেছিল এবং সকল বিষয়েই পাশ্চাত্ত্য অনুকরণই উন্নত culture বলিয়া স্থির করিয়াছিল।

 প্রাচীন ধর্ম্মশাস্ত্র সম্বন্ধে অজ্ঞতা ও অবজ্ঞা প্রযুক্ত অনেকে নাস্তিক ও অনেকে খৃষ্টান-ঘেঁষা হইয়া পড়িতেছিলেন।

 সেই সময়ে রামমোহন রায়ের শিষ্য দেবেন্দ্রনাথ ধর্ম্মব্যাকুলতা অনুভব করিয়া প্রাচীন শাস্ত্র অন্বেষণে প্রবৃত্ত হন। যদিচ প্রচলিত ধর্ম্ম-সংস্কার তিনি পরিত্যাগ করিয়াছিলেন, তথাপি স্বদেশের শাস্ত্রকেই দেশের ধর্ম্মোন্নতির ভিত্তিরূপে তিনি গ্রহণ করিয়াছিলেন।

 তিনিই তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় বেদ উপনিষদের আলোচনা ও বিলাতী বিজ্ঞানতত্ত্ব প্রভৃতির প্রচার বাংলা ভাষায় প্রবর্তন করেন। আদি ব্রাহ্মসমাজ বিদেশী ধর্ম্ম হইতে স্বধর্ম্মে ও বিদেশী ভাষা হইতে মাতৃভাষায় শিক্ষিত সম্প্রদায়কে আকর্ষণ করিবার চেষ্টা করেন।

 কেশববাবুরা যখন ব্রাহ্মসমাজে প্রবেশ করিয়া ব্রাহ্মধর্ম্মের সহিত হিন্দুসমাজের বিচ্ছেদ-সাধনের উপক্রম করিলেন তখন দেবেন্দ্রনাথ হিন্দুসমাজকে ত্যাগ করিলেন না— ব্রাহ্মধর্ম্মকে হিন্দু-সমাজেরই অঙ্গ বলিয়া গণ্য করিলেন। আধুনিক শিক্ষিত চিত্তকে স্বদেশের অভিমুখী করিবার এই প্রয়াস।

 দেবেন্দ্রনাথের পরিবারে আধুনিক শিক্ষার সহিত স্বদেশী ভাবের সমন্বয় চেষ্টা বরাবর কাজ করিতে লাগিল। হিন্দুমেলা এই স্বদেশী ভাবের আর একটি অভ্যুত্থান। দ্বিজেন্দ্রনাথ, গণেন্দ্রনাথ, নবগোপাল মিত্রকে সাহায্য করিয়া এই মেলার প্রতিষ্ঠা করেন। এখানে স্বদেশী শিল্পের, স্বদেশী মল্লবিদ্যার, স্বদেশী games এর প্রদর্শনী হইত—স্বদেশী গান গীত ও স্বদেশী কবিতা আবৃত্ত হইত।

 তাহার পর বঙ্কিমের বঙ্গদর্শন বাংলা সাহিত্যকে আধুনিকভাবে পরিপুষ্ট করিয়া দেশের শিক্ষিতগণকে মাতৃভাষায় জাতীয় সাহিত্য রচনায় উৎসাহিত করিয়া তুলিল। ইহার কিছুকাল পরে শশধরের প্রাদুর্ভাব উল্লেখযোগ্য। ইতিমধ্যে বৃদ্ধ রাজনারায়ণ বস্তুকে লইয়া আমাদের পরিবারে সাধারণের অগোচরে স্বদেশীভাবের বিশেষরূপ চর্চ্চা হইতেছিল। গোপনে স্বদেশী দেশালাই ও উৎকর্ষপ্রাপ্ত তাঁত প্রভৃতি নির্মাণের জন্য চেষ্টা চলিতেছিল। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ এই স্বদেশী ভাবের উত্তেজনাতেই খুলনা হইতে বরিশালে ষ্টীমার চালাইতে প্রবৃত্ত হইয়া ইংরেজ-কোম্পানির সহিত দারুণ প্রতিযোগিতায় প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন— তৎকালে ধরিশালে স্বদেশীর দল তাঁহার সাহায্যের জন্য যেরূপ প্রচণ্ড উৎসাহে যাত্রী সংগ্রহ ও যাত্রী ভাঙানর কাজে প্রবৃত্ত হইয়াছিল এরূপ Fuller-এর আমলে ঘটিলে কি বিপদ হইত অনুমান করিবেন।

 কনগ্রেস গবর্মেণ্টের নিকট আবেদনের দিকেই শিক্ষিত-সম্প্রদায়ের চেষ্টাকে প্রবৃত্ত করাইল।

 সাধনা পত্রে ও তাহার পরে অন্যত্র এইরূপ আবেদন নীতি ত্যাগ করিয়া আত্মশক্তি চালনার দিকে মন দিতে উপদেশ দেওয়া হইয়াছে এবং বলেন্দ্রনাথ এবং আমাদের পরিবারের অনেকে যোগ দিয়া স্বদেশী ভাণ্ডার প্রতিষ্ঠা করা হইয়াছে।

 এই স্বদেশী ভাণ্ডারের ভগ্নাবশেষের উপরে Indian Stores এর অভ্যুদয়।

 ইহার অনতিকাল পরেই Provincial Conference এ যাহাতে বাংলা ভাষায় দেশের আপামর সাধারণের নিকট স্বদেশের অভাব আলোচনা করা যায়— যাহাতে ইংরেজি ভাষায় কেবল রাজার নিকট আবেদনেই আমাদের কর্তব্য নিঃশেষিত না হয় রাজসাহী কনফারেন্সে সত্যেন্দ্রনাথের নায়কতায় প্রথম সেই চেষ্টা করা হইয়াছিল, পর বৎসর ঢাকাতেও সেই চেষ্টা করা যায়।

 স্বদেশী movement এর সঙ্গে এই সকল চেষ্টার ঘনিষ্ঠ যোগ আছে। ধর্ম্ম সম্বন্ধে যেমন আদি ব্রাহ্মসমাজ প্রাচীন শাস্ত্রের দিকে মনকে টানিয়াছিলেন Politics সম্বন্ধেও সেইরূপ কিছুদিন হইতে দেশের লোককে দেশের দিকেই টানিবার চেষ্টা চলিতেছিল। তৎকালে শিক্ষিত লোকেরা যেমন সহজে শাস্ত্রের দিকে স্বদেশী ধর্ম ও স্ব সমাজের দিকে ফিরিতে চাহেন নাই এখনকার দিনেও সেইরূপ শিক্ষিত agitation ওয়ালা সহজে আবেদনের পালা বন্ধ করিয়া স্বদেশের জনসাধারণের সম্মুখে দাঁড়াইতে প্রস্তুত হন নাই।

 নূতন পর্য্যায় বঙ্গদর্শনে এই আত্মশক্তি-চর্চ্চা ও স্বদেশী ভাবের দিকে দেশের চিত্ত আকর্ষণের জন্য উপদেশের প্রবর্তন করা হয় এবং বোলপুরের বিদ্যালয় স্থাপন ও শিক্ষার ভার নিজের হাতে ও স্বদেশী ভাবে প্রবর্তনের চেষ্টা। এ সম্বন্ধে বিদ্যাসাগর মহাশয় অগ্রণী। তিনি ইংরেজি ধরনের বিদ্যালয় দেশীয় লোকের দ্বারা চালাইতে সুরু করেন— আমার চেষ্টা যাহাতে বিদ্যাশিক্ষার আদর্শ যথাসম্ভব স্বদেশী রকম হয়।

 এইরূপ আন্দোলন যখন দেশে ভিতরে ২ চলিতেছে, তখন যোগেশ চৌধুরী কংগ্রেসে শিল্প-প্রদর্শনী খুলিয়া কংগ্রেসের আবেদন-প্রধান ভাবকে স্বদেশী ভাবে দীক্ষিত করিবার প্রথম চেষ্টা করেন— তাহার পর হইতে এই প্রদর্শনী বৎসরে ২ চলিতেছে।

 ইতিমধ্যে আশু চৌধুরী বর্দ্ধমান কনফারেন্সে পোলিটিক্যাল ভিক্ষাবৃত্তির বিরুদ্ধে তর্ক উত্থাপন করিয়া গালি খান। কিন্তু দেশ অন্তরে অন্তরে স্বদেশী ভাবে দীক্ষিত হইয়া আসিতেছিল। এমন সময়ে পার্টিশন ব্যাপার একটা উপলক্ষ্য মাত্র হইয়া এই স্বদেশী আন্দোলনকে স্পষ্টরূপে বিকশিত করিয়া তুলিল। বস্তুতঃ বয়কট করার ছেলেমানুষী ইহার প্রাণ নহে। ইতি ১লা অগ্রহায়ণ ১৩১২

আপনার
শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর