বিবিধ কথা/আচার্য্য কেশবচন্দ্র ও নবযুগ

আচার্য্য কেশবচন্দ্র ও বাংলার নবযুগ

 আচার্য্য কেশবচন্দ্রের বাৎসরিক স্মৃতি-সভায় আপনারা আমাকে কিছু বলিবার জন্য আহ্বান করিয়াছেন, ইহাতে আমি যেমন এক দিকে আমার প্রতি আপনাদের এই অনুগ্রহের জন্য কৃতজ্ঞ, তেমনই আর এক দিকে বড়ই সঙ্কোচ বোধ করিতেছি। কারণ কেশবচন্দ্রের মত একজন ধর্ম্মবীর মহাপুরুষের সম্বন্ধে আমার মত সাধনাহীন ব্যক্তির বলিবার কি-ই বা থাকিতে পারে? ধর্ম্ম-সাধন বা ধর্ম্ম-তত্ত্বের অনুশীলন আমি কখনও করি নাই। কেশব যে সাধনমন্ত্র প্রচার করিয়াছিলেন, সেই ভক্তির উৎসাহকে অগ্নিহোত্রীর মত যাঁহারা রক্ষা করিয়া আসিতেছেন—যাঁহারা কেবলমাত্র মত বা তত্ত্ব নহে, কেশবের জীবন-বেদের সেই অপৌরুষেয় আর্ষ দীপ্তিকে নিজ-জীবনে সঞ্চারিত করিয়াছেন, তাঁহাদের নিকট আমিই শিক্ষার্থী: কেশবের সেই নিগূঢ় ধর্ম্ম-তত্ত্বের সম্বন্ধে আমার বলিবার কিছুই নাই।

 কিন্তু ধর্ম্মপ্রচারক কেশবচন্দ্রের জীবন আর এক দিক দিয়া আলোচনা করিবার যোগ্য। এই জাতির গত-যুগের ইতিহাসে যে সমস্যা ও সঙ্কট ক্রমশ ঘনাইয়া উঠিয়াছিল,—কেশবচন্দ্র তাহারই একটি স্ফুলিঙ্গ। জাতির সেই ইতিহাস বুঝিতে হইলে, কেশবচন্দ্রকেও বুঝিতে হইবে, স্মরণ করিতে হইবে। আমাদের দেশে, আমাদের জাতীয় প্রকৃতির নিয়মে, সকল সমস্যার মূলে একটা আধ্যাত্মিক সঙ্কট-রূপেই দেখা দেয়, কেশবের মধ্যে ইহা বিশেষ করিয়া সেই আকারই ধারণ করিয়াছিল। যুগ ও জাতির প্রতিনিধিরূপে কেশব-জীবনের আদর্শ ও তাঁহার কর্ম্মপ্রচেষ্টা আমি যেরূপ বুঝিয়াছি, তাহাই আজ আপনাদের নিকট নিবেদন করিব।

 এ যুগের ধর্ম্মান্দোলনের সঙ্গে যে সমস্যা বিশেষ করিয়া জড়িত ছিল, যাহার সমাধান একটা সজ্ঞান সুস্পষ্ট অভিপ্রায়রূপে সেই আন্দোলনে শক্তি সঞ্চার করিয়াছিল, তাহা মুখ্যত মোক্ষলাভ নয়—জাতির জীবনকে নূতন করিয়া একটা নৈতিক ভিত্তির উপরে প্রতিষ্ঠিত করিবার প্রয়োজনচিন্তাই তাহার মূল। সমাজরক্ষা বা লোকসংস্থিতির জন্য যে নীতিমার্গ বা Law—তাহাই ছিল এ যুগের ধর্ম্মসমস্যা। এই ধর্ম্মকে নৃতন করিয়া উদ্ধার করা——তাহাকে যুগোপযোগী রূপ দিয়া জাতির জীবনে প্রতিষ্ঠিত করিয়া যুগ-সঙ্কটে পরিত্রাণলাভের উপায় আবিষ্কার করাই সেকালের বাঙালী মনীষিগণের একমাত্র ভাবনা ছিল। সকলের ধারণা এক ছিল না—আদর্শ পৃথক ছিল। কেশবচন্দ্র এই সমস্যার সমাধানে ভগবদ্‌ভক্তি ও বিশ্বাসের দ্বারা জাতির নৈতিক উন্নতিসাধনকেই শ্রেষ্ঠ উপায় বলিয়া মনে করিয়াছিলেন, তাঁহার চরিত্রে ও কর্ম্মজীবনে এই অভিনব আদর্শের অনুপ্রেরণা আপাতদৃষ্টিতে বিজাতীয় ভাবাপন্ন বলিয়া মনে হয়; কিন্তু একটু ভিতরে দৃষ্টি করিলে, তাহার মধ্যে বাঙালীর ভাব-প্রকৃতি ও বাঙালী-প্রতিভারই এক নূতন অভিব্যক্তি দেখা যায়। সে যুগের সংস্কার-আন্দোলনের ইতিহাসে কেশবচন্দ্রের এই বাঙালিয়ানাই আমাকে মুগ্ধ করে। পাশ্চাত্য সাহিত্যের প্রভাব বাঙালীর প্রতিভায় কি ভাবে প্রতিফলিত হইয়াছে, তাহা আমরা দেখিয়াছি; পাশ্চাত্য ধর্ম্মনীতি একজন বাঙালীর হৃদয়ে কিরূপ সাড়া জাগায়, কেশবচন্দ্রের প্রতিভায় তাহারও একটি বিশিষ্ট প্রমাণ পাওয়া গিয়াছে। কেশবচন্দ্র যে ধর্ম্ম প্রচার করিয়াছিলেন—যুগের প্রভাব ও জাতির প্রতিভা দুই-ই তাহাতে প্রতিফলিত হইয়াছে। এই দিক দিয়া কেশবকে বুঝিবার প্রয়োজন আছে।

 ধর্ম্ম-জিজ্ঞাসা ও ধর্ম্ম-সাধন, এবং ধর্ম্ম-প্রচার এক নহে; উভয়ের প্রয়োজন স্বতন্ত্র। যে কারণে যে ধর্ম্ম প্রচারযোগ্য হয়, জগতের ইতিহাসে তাহার একাধিক বড় দৃষ্টান্ত আছে। প্রাচীন কালে এই ভারতবর্ষেই সেইরূপ ধর্ম্ম ও তাহার প্রচার প্রথম প্রকটিত হয়। ধর্ম্ম যখন জাতি বা সমাজের কল্যাণকে অতিক্রম করিয়া ব্যক্তি বা সম্প্রদায়বিশেষের আধ্যাত্মিক সাধনার বস্তু হইয়া দাঁড়ায়, এবং তাহার সাধন-পন্থা ‘ক্ষুরস্য ধারা নিশিতা দুরত্যয়া’ বলিয়া বাস্তব জীবনের ক্ষেত্র হইতে একরূপ নির্ব্বাসিত হয়, তখনই লোকস্থিতিমূলক ধর্ম্মের প্রণয়ন ও প্রচার একান্ত আবশ্যক হইয়া উঠে। শাক্যমুনি ঐতিহাসিক কালের প্রথম ধর্ম্ম-প্রচারক। তাঁহার ধর্ম্ম গুহ্য সাধনার ধর্ম্ম নয়—জ্ঞান-যুক্তিমূলক পুরুষকারের ধর্ম্ম। লোকধর্ম্মের আর এক আদর্শ আছে, প্রাচীন সেমীয় জাতির মধ্যেই তাহার সমধিক বিকাশ ঘটিয়াছিল। এ ধর্ম্মও সমাজশাসনমূলক, লোকসংস্থিতিই ইহার মূলগত অভিপ্রায়। প্রাচীন ইহুদীয় ধর্ম্ম স্বজাতি বা গোষ্ঠীর জন্যই প্রণীত হইয়াছিল। রাজা বা পিতারূপে এক ঈশ্বরের ধারণা করিয়া প্রেরিতপুরুষগণ ঈশ্বরাদেশ প্রচার করিতেন; সেই আদেশপালনই ছিল সর্ব্বপ্রকার বিনাশ হইতে পরিত্রাণের একমাত্র উপায়। এই একেশ্বরবাদ, রুক্ষ কঠিন শাসনবাদ হইতে ক্রমে ঈশ্বরবাদের ভক্তি-ধর্ম্মে পরিণত হইয়াছিল, এবং স্বজাতি বা গোষ্ঠীর গণ্ডি অতিক্রম করিয়া সমগ্র মানব-গোষ্ঠীকে গ্রহণ করিয়াছিল। এ দেশীয় প্রাচীন আর্য্যগণের সমাজেও এক ধরনের ব্রহ্মবাদ প্রচলিত ছিল; তাহাও কেবল আর্য্যগোষ্ঠীর ইহলৌকিক ও পারলৌকিক কল্যাণের জন্য বিহিত হইয়াছিল, প্রচারযোগ্য ছিল না। কিন্তু এই অতি সহজ সরল —বায়ু ও আলোকের মত জীবনীয়—ব্রহ্মবাদ ভারতবর্ষের জল-মাটিতে অক্ষুণ্ণ থাকিতে পারে নাই, অদ্বৈত-তত্ত্ব ও নানা তান্ত্রিক সাধন-পদ্ধতি সেই আর্য্যধর্ম্মকে হিন্দুধর্ম্মে রূপান্তরিত করিয়াছে। ব্রহ্মতত্ত্বের সহিত বিশুদ্ধ ভক্তিধর্ম্ম মিলিত হইয়া নানা সম্প্রদায়ের—নানা তন্ত্রের সৃষ্টি করিয়াছে বটে, কিন্তু অদ্বৈতব্রহ্মবাদের ছায়া সুদূর প্রসারিত হইয়া, ধর্ম্মকে শেষ পর্য্যন্ত সুস্পষ্ট সামাজিক প্রয়োজনের ক্ষেত্র হইতে সরাইয়া, ব্যক্তি বা সম্প্রদায়ের আধ্যাত্মিক প্রয়োজন-সাধনেই বিশেষ করিয়া নিয়োজিত রাখিয়াছে। এই অত্যুচ্চ আধ্যাত্মিক আদর্শের প্রতি লক্ষ্য রাখিয়া যে সমাজবিধি প্রস্তুত হইয়াছিল, তাহা সেকালের জনসমাজের কীদৃশ কল্যাণ কি ভাবে সাধন করিয়াছিল তাহা বলা কঠিন—আজিকার আদর্শে তাহা নির্ণয় করাও বোধ হয় সঙ্গত হইবে না। কিন্তু পরবর্ত্তী কালে এই অধ্যাত্মসাধন ও সামাজিক হিতসাধনের মধ্যে সামঞ্জস্যের অভাব ছিল, তাহাতে সংশয় নাই। অপেক্ষাকৃত আধুনিক কালে, এই বাংলা দেশেই, প্রায় পাঁচ শত বৎসর পূর্ব্বে, যে নবধর্ম্মের অভ্যুদয় হইয়াছিল তাহাতেও এ সমস্যার সম্যক মীমাংসা হয় নাই। নিয়ম-ধর্ম্মের পরিবর্ত্তে, ধর্ম্মমূলক ভক্তিরসের প্লাবনে, জাতির প্রকৃতি আরও কোমল হইয়া পড়িয়াছিল, সমাজ আত্মস্থ না হইয়া কতকটা আত্মহারা হইয়াছিল। সমগ্র মুসলমান-অধিকারকালে, আত্মোন্নতি অপেক্ষা আত্মরক্ষার চেষ্টাই প্রবল হইতে দেখা যায়; সেকালে এই আত্মরক্ষার উপায় হইয়াছিল আত্মসঙ্কোচ। এই জন্যই চৈতন্যপ্রবর্ত্তিত ভক্তি-ধর্ম্ম সামাজিক সংস্কার ও সংগঠন-কর্ম্মে দুঃসাহসী হইতে পারে নাই।

 অতএব দেখা যাইতেছে, ধর্ম্মের যে আর এক আদর্শ আছে, লোকসংস্থিতিই যাহার মুখ্য অভিপ্রায়—যে ধর্ম্ম-নীতি ব্যবহারিক লোক যাত্রাকে নিয়ন্ত্রিত করিতে পারে, তাহা আমাদের দেশে বহুদিন প্রচারিত হয় নাই। আমরা ধর্ম্ম বলিতে ব্যক্তিগত মোক্ষসাধনার আদর্শই বুঝি; এই মোক্ষলাভের সাধনায় ব্যক্তির অধিকারভেদ মানি। প্রত্যেক জীবই কর্ম্ম অনুসারে অন্য হইতে স্বতন্ত্র, অতএব সাধন-মন্ত্র সকলের পক্ষে এক হইতে পারে না। মানুষমাত্রেই এক ধর্ম্ম-পরিবারভুক্ত বটে, কিন্তু তুল্যাধিকারসম্পন্ন নয়; একই গোষ্ঠীপতি ভগবানের সন্তান বলিয়া সকলেই একই সত্যের অধিকারী—এ ধারণা আমাদের নিকট নিতান্তই হাস্যকর। অধিকারভেদে একই সত্যের নানা রূপ—কোনটাই মিথ্যা নহে; মানসিক ও আধ্যাত্মিক উন্নতিহিসাবে যাহার যতটুকু অধিকার তাহাই তাহার পরম সত্য। এই তত্ত্বের আধ্যাত্মিক মর্ম্ম যতই গভীর হউক—এ আদর্শের মূলে যত গভীর সত্যই নিহিত থাক, ইহার ফলে যে সমাজ-ব্যবস্থার উদ্ভব হইয়াছে, তাহাতে সামাজিক নীতি-সত্যের সম্যক মর্য্যাদা রক্ষিত হয় নাই। যতদিন বাহিরের সঙ্গে সংঘাত গুরুতর হইয়া উঠে নাই—অহিন্দু সেমীয় সভ্যতার সহিত সংঘর্ষ ঘটে নাই, ততদিন এই বাস্তব-স্পর্দ্ধী অধ্যাত্ম-সাধনা কতকটা নির্ব্বিঘ্নেই চলিয়াছিল। কিন্তু পরে, বিধর্ম্মের প্রচণ্ড আঘাতে, বিজাতির প্রবলতর রাষ্ট্রীয় শক্তির উৎপাতে, যখন এ জাতির দুর্ব্বলতা প্রকাশ পাইল, তখন এই ধর্ম্ম বাহিরের জীবন ও সামাজিক নীতি-সত্যকে পাশ কাটাইয়া গুহ্য তান্ত্রিক সাধনমার্গে আত্মগোপন করিল; যে ধর্ম্ম সমাজকে ধরিয়া রাখে তাহার প্রতি উদাসীন হইয়া—আমরা জীবনে মিথ্যাচারী, এবং ধর্ম্মসাধনায় আধ্যাত্মিক হইয়া উঠিলাম।

 ইহার পর যাহা ঘটিল তাহা সকলেই জানেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর আরম্ভ হইতেই আমরা নিজেদের দুর্গতি সম্বন্ধে ক্রমশ সচেতন হইয়া উঠিলাম—যে সঙ্কট সম্বন্ধে এতদিন আমাদের কোনও চৈতন্যই ছিল না, তাহাই মর্ম্মান্তিক রূপে উপলব্ধি করিলাম। ইংরেজী সাহিত্য ও ইংরেজ চরিত্রের সংস্পর্শে আসিয়া আমরা সবচেয়ে বেশি করিয়া বুঝিলাম আমাদের নৈতিক দীনতা, জাতীয় চরিত্রের শোচনীয় অবনতি, বৃহৎকে ত্যাগ করিয়া ক্ষুদ্রের প্রতি আসক্তির জন্য আত্মার জড়তা। ইংরেজী শিক্ষা রীতিমত আরম্ভ হইবারও পূর্ব্বে এ চেতনা বাঙালীকে অধিকার করিয়াছে, নিজেদের হীন অবস্থার জন্য লজ্জিত হইবার মত আত্মজ্ঞান তাহার হইয়াছে। পুরাতন রাষ্ট্র-ব্যবস্থার উচ্ছেদে, এবং নূতন বিদেশী শক্তির সহিত কর্ম্মক্ষেত্রে ঘনিষ্ঠ পরিচয়ের ফলে, বাঙালী আবার ভাবিতে আরম্ভ করিল—এই ভাবনাই তাহার সুপ্ত মনীষা জাগাইল। কারণ, বাঙালী চরিত্রবলে যতই হীন হউক, তাহার ভাবগ্রাহিতা-শক্তি অসাধারণ, যুগান্তরের ভাব-সত্যকে সে অবিলম্বে জ্ঞান-গোচর করিতে পারে। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রাক্কালেই বাঙালী বুঝিতে সুরু করিল, যুগ-প্রয়োজন কি। রাজা রামমোহন রায় বাঙালীর হইয়া সর্ব্বপ্রথমে এ সম্বন্ধে সচেতন হইয়াছিলেন। ধর্ম্মের যে অপর অর্থ আমি ইতিপূর্ব্বে আপনাদের নিকটে উল্লেখ করিয়াছি, সেই অর্থে রামমোহন একটা ধর্ম্মের আবশ্যকতা অনুভব করিয়াছিলেন। বিচারবুদ্ধির তীক্ষ্ণ অস্ত্রাঘাতে, জাতির মনোভূমি হইতে সকল অন্ধবিশ্বাস, এবং ধর্ম্মসাধনার ক্ষেত্র হইতে সর্ব্বপ্রকার তন্ত্রমন্ত্র বা অলৌকিক অনুভূতির চর্চ্চা দূর করিয়া, তিনি একটি যুক্তিসম্মত, নীতিমূলক ধর্ম্ম দেশবাসীর জন্য প্রণয়ন করিতে চাহিয়াছিলেন। রামমোহনের এই উদ্যম ও তাহার অন্তর্গত অভিপ্রায় আজিও কেহ বুঝিতে সক্ষম বা সম্মত হয় নাই। রামমোহন যে একেশ্বরবাদের পক্ষপাতী ছিলেন, পারলৌকিক কল্যাণচিন্তাই তাহার মুখ্য কারণ নয়; সাধু-সন্ত বা ভক্তভাগবতগণ যে শ্রেণীর ধার্ম্মিক, রামমোহন নিজে সেরূপ ধার্ম্মিক ছিলেন না। রামমোহনের প্রতিভার প্রধান কৃতিত্বই এই যে, তিনি রাষ্ট্রে সমাজে ও শিক্ষায় একটা নূতন যুগোপযোগী আদর্শের সন্ধান করিয়াছিলেন—ভগবৎ-লাভের উৎকৃষ্টতর পন্থানির্দ্দেশ, নূতন করিয়া মোক্ষশাস্ত্র রচনা, তাঁহার অভিপ্রায় ছিল না; বলহীনকে পার্থিব জীবনে শক্তিমান করিয়া তোলাই তাঁহার একমাত্র লক্ষ্য ছিল। মধ্যযুগের ধার্ম্মিকতার আদর্শকেই সংস্কার করিয়া পুনঃ প্রতিষ্ঠিত করিতে তিনি চান নাই; জীবনে উন্নতি লাভ করিতে হইলে, জাতিহিসাবে রাষ্ট্রে ও সমাজে সুপ্রতিষ্ঠ হইতে হইলে, প্রত্যক্ষকে স্বীকার কর, এবং তজ্জন্য সহজ মানবীয় জ্ঞানবুদ্ধির আরাধনা কর—ইহাই ছিল তাঁহার ধর্ম্ম; পৌত্তলিক ধর্ম্মের ভাবসাধনায় যে বক্রকুটিল গহন-গূঢ় আরণ্য পথ মানুষকে সহজ সত্য ও সামাজিক শক্তিসাধনা হইতে দূরে লইয়া যায়, ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব খর্ব্ব করে, তাহাকে বর্জ্জন কর। শ্রীযুক্ত গিরিজাশঙ্কর রায় চৌধুরী মহাশয় তাঁহার অতি সুচিন্তিত ও পাণ্ডিত্যপূর্ণ গ্রন্থ “বিবেকানন্দ ও বাংলার ঊনবিংশ শতাব্দী”র এক স্থানে রামমোহন-সম্পর্কিত আলোচনায় রামমোহনের একখানি ইংরেজী পত্রের যে অংশটি উদ্ধৃত করিয়াছেন, তাহা অতিশয় অর্থপূর্ণ; আমিও এখানে তাহা উদ্ধৃত করা প্রয়োজন মনে করি। সে কয় ছত্র এইরূপ—

 I regret to say that the present system of religion adhered to by the Hindus is not well calculated to promote their political interest....It is, I think, necessary that some change should take place in their religion at least for the sake of their political advantage and social comfort.

 উক্ত গ্রন্থে প্রসঙ্গক্রমে রামমোহনের গ্রন্থ হইতে আর একটি উক্তি উদ্ধৃত হইয়াছে, তাহাও লক্ষ্য করিবার মত—

 Genuine Christianity is more conducive to the moral, social and political progress of a people than any other human creed.

 এ সকল হইতে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়, রামমোহন কেন ধর্ম্মসংস্কার করিতে চাহিয়াছিলেন। খ্রীষ্টান সাহিত্য ও খ্রীষ্টান চরিত্র এবং খ্রীষ্টান রাজশক্তির প্রভাব একালে বাঙালীর মনকে হঠাৎ একটা বড় ধাক্কা দিয়াছিল—তুলনায় নিজেদের হীনতাবোধ বড় বেশি করিয়া বাজিয়াছিল। বাঙালী নূতন করিয়া মানুষ হইতে চাহিল; এবং এক যুগের নিশান্তকালে, অরুণোদয়-প্রতীক্ষায়, পশ্চিমকেই পূর্ব্বদিক্‌-প্রান্ত বলিয়া তাহার দিঙ্‌মোহ হইয়াছিল। তথাপি রামমোহন একটা ধর্ম্মমত সঙ্কলন করিয়াছিলেন মাত্র—ধর্ম্ম-প্রচারক ছিলেন না; তিনি কোনও পৃথক সমাজস্থাপনের চেষ্টাও করেন নাই। রামমোহন চিন্তা করিয়াছিলেন, তর্ক করিয়াছিলেন, লেখালেখি করিয়াছিলেন। তিনি যুক্তিবাদী ছিলেন, কোনও ভক্তিবিশ্বাসের আবেগ তাঁহার ছিল না—তাঁহার ধর্ম্মও আবেগের ধর্ম্ম ছিল না। তাই তিনি নবযুগের একটা আদর্শ নির্দ্দেশ করিয়াছিলেন মাত্র, জাতির জীবনে বা তাহার হৃদয়ে তাহাকে প্রতিষ্ঠিত করিবার কোন চেষ্টাই তিনি করেন নাই। রামমোহন তাঁহার ব্যক্তিগত জীবনে যে নীতির অনুসরণ করিয়াছিলেন—অপক্ষপাত সহকারে তাঁহার জীবনবৃত্ত আলোচনা করিলে তাঁহার যে ব্যক্তিস্বরূপ আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়— তাহাতেই বুঝিতে পারি যে, তিনি ভক্তমণ্ডলীর অনুকরণীয় আদর্শরূপে নিজ জীবন যাপন করেন নাই। সেখানেও, তিনি বুদ্ধিমান ও শক্তিমান পুরুষের মত অটল অবিচলিতভাবে নিজের মনের মত জীবন যাপন করিয়াছিলেন, দেখিতে পাই। এই বীরমূর্ত্তি কোন সাধু, দরবেশ বা ভক্ত সন্ন্যাসীর মূর্ত্তি নহে। রামমোহনের যে অসাধারণ মনস্বিতা আমাদের বিস্ময় উৎপাদন করে, তাহাও, নব্যন্যায়ের স্রষ্টা বাঙালী ব্রাহ্মণ-পণ্ডিতের পক্ষে কিছুমাত্র অসম্ভব নহে। এই যে রামমোহন, ইঁহার পরিচয় সাম্প্রদায়িক ধর্ম্ম-কোলাহলে আচ্ছন্ন হইয়া আছে। রামমোহন বাঙালীর বরণীয় বটেন, কিন্তু কোনও ধর্ম্ম বা সম্প্রদায়-প্রতিষ্ঠার জন্য নয়—রামমোহনই এ যুগে সর্ব্বপ্রথম জাতির জড়বুদ্ধিকে সবলে আঘাত করিয়াছিলেন, স্বাধীন জ্ঞান-বুদ্ধির ক্ষেত্রে জনমনকে প্রবুদ্ধ করিতে চাহিয়াছিলেন।

 কিন্তু রামমোহনের চেষ্টা ফলবতী হয় নাই, ইহাও সত্য। তাঁহার বাণীকে এ জাতি জীবনের মধ্যে পায় নাই। আজ রামমোহনকে লইয়া আমরা যে গৌরব করিতেছি, তাঁহার স্মৃতিপূজার যে সাড়ম্বর আয়োজনে মাতিয়াছি, তাহার আরও সঙ্গত কারণ থাকিলে ভাল হইত। তাঁহার জীবন বা তাঁহার আদর্শ কোথাও সাক্ষাৎ ভাবে জাতিকে প্রভাবিত করে নাই, শতাব্দীব্যাপী সংগ্রামে আমাদের হৃদয়ের বলবৃদ্ধি করে নাই। তাঁহার মৃত্যুর অব্যবহিত পরে রামমোহনের নামে যে নূতন ধর্ম্মসমাজ প্রতিষ্ঠিত হইল, তাহার মন্ত্রও ঠিক রামমোহনের মন্ত্র নয়; সে সমাজ এক অভিজাত জ্ঞানী-সম্প্রদায়রূপে অচল হইয়া রহিল। কিন্তু নবযুগ বসিয়া ছিল না, বাঙালীর চিত্তক্ষেত্রে পাশ্চাত্য শিক্ষার হলকর্ষণ বন্ধ হয় নাই; বরং আরও গভীরভাবে সেই খনন কার্য্য চলিতে লাগিল। ইহারই ফলে ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে কেশবচন্দ্র সেন নামে আর এক বাঙালীর অভ্যুদয় হইল। কেশবের ধর্ম্ম-জীবনের উৎপত্তি ও বিকাশ এ যুগের পক্ষে আকস্মিক নয়, বরং সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। কেশবচন্দ্রের মধ্যে বাঙালী-প্রতিভার আর এক দিক নবযুগের সমস্যায় সাড়া দিয়াছিল। কেশব যুক্তিবাদী নহেন, ভক্তিবাদী; কেশব যে শক্তিবলে যুগ-সঙ্কট উত্তীর্ণ হইতে চাহিলেন, সে শক্তি আত্মিক বিশ্বাসের শক্তি, তাই কেশব রামমোহনের মত নীতিবাদী নহেন—নীতিধর্ম্মী; তিনি ধর্ম্ম-প্রণেতা নহেন—ধর্ম্ম-প্রচারক। তথাপি কেশব ও রামমোহনের লক্ষ্য এক—জাতির নৈতিক জীবনের সংস্কার-সাধন। রামমোহন যাহা বুদ্ধির সাহায্যে করাইতে চাহিয়াছিলেন, কেশব তাহাই করাইতে চাহিয়াছিলেন ধর্ম্ম-বিশ্বাসের বলে। রামমোহন খ্রীষ্টান ধর্ম্মনীতির শ্রেষ্ঠতা স্বীকার করিলেও, এবং সেমীয় একেশ্বরবাদের পক্ষপাতী হইলেও, তাঁহার ব্রাহ্মণ্য আভিজাত্য-সংস্কার ত্যাগ করিতে পারেন নাই—বেদান্ত উপনিষদের দোহাই না দিয়া পারেন নাই। এইখানেই তাঁহার ‘ভাবের ঘরে চুরি’ ছিল; তিনি ভিতরে যাহা বুঝিয়াছিলেন, বাহিরে তাহা খোলাখুলি স্বীকার করিতে রাজি ছিলেন না। এই আভিজাত্যাভিমানের বশেই—নিজধর্ম্মের পরিবর্ত্তে তিনি যে পরধর্ম্মের প্রতি আকৃষ্ট হইয়াছিলেন, তাহার প্রভাব স্বীকার না করিয়া, তিনি অতি প্রাচীন শাস্ত্র হইতে স্বপক্ষে প্রমাণ সংগ্রহ করিয়াছিলেন। কেশব এই আবরণটি উড়াইয়া দিলেন, নিজ ধর্ম্মবিশ্বাস অকপটে স্বীকার করিলেন। কেশব বিদ্রোহী নব্যবঙ্গের এক অভিনব মূর্ত্তি। কেশবের ধর্ম্ম-প্রতিভা ছিল, তাঁহার সমস্ত হৃদয়মন ভক্তির ভাবাবেশে ঝঙ্কৃত হইয়া উঠিত—সে সময়ে তাঁহার মুখে দিব্যপ্রভা ও কণ্ঠে দিব্যভারতীর উদয় হইত। পাশ্চাত্য যুক্তিবাদ যেমন রামমোহনের প্রতিভাকে স্ফুরিত করিয়াছিল, পাশ্চাত্য ধর্ম্মও তেমনই কেশবকে সঞ্জীবিত করিয়াছিল। এই দুই অগ্নি-পরীক্ষাই বাঙালীকে উত্তীর্ণ হইতে হইয়াছে; কেশবের প্রতিভা খাঁটি বাঙালীর প্রতিভা, কেশবের জয় ও পরাজয় সে যুগের বাঙালীর ইতিহাসে এক অবশ্যম্ভাবী ঘটনা।

 কেশবের প্রতিভায় তিনটি বিষয় লক্ষ্য করিবার আছে—(১) তাঁহার অভারতীয় ধর্ম্মপ্রেরণা; (২) ব্যক্তিগত বিবেকবুদ্ধি স্বীকার করিলেও কার্য্যত তিনি ভক্তিযোগী মিস্টিক; (৩) কঠিন মত-নিষ্ঠা অপেক্ষা উদার ভাবগ্রাহিতা। এই তিনটি লক্ষণে আমরা তাঁহার সাধন-জীবনের যুগোপযোগিতা বুঝিবার চেষ্টা করিব।

 কেশবের ধর্ম্মজীবনে আমরা পর-ধর্ম্মের প্রেরণা দেখিতে পাই। ইহুদীয় ধর্ম্মপ্রবক্তাগণ—ব্যাপ্‌টিস্ট জন (John the Baptist), সেণ্ট পল, ও যীশু—যে একজন ঈশ্বরপিপাসু হিন্দুসন্তানের ধর্ম্মগুরু হইলেন, কেশবের ধর্ম্মজীবনে ইহা কি কেবল একটা দৈব ঘটনা? ইহার মূলে কি বাঙালী চরিত্রের বৈশিষ্ট্য এবং যুগপ্রভাব ও যুগ-সমস্যার একটা ইঙ্গিত ছিল না? ইংরেজী সাহিত্য, দর্শন ও ইতিহাসের সহিত ঘনিষ্ঠ পরিচয়ের প্রভাব ইহার মূলে ছিল, সন্দেহ নাই—কিন্তু বাঙালীর ভাব-প্রকৃতি ইহার জন্য সমধিক দায়ী। সে যুগের ধর্ম্মহীন নীতিহীন সমাজের পরিণাম-চিন্তা কেশবকে যে ভাবে ব্যাকুল করিয়াছিল, তেমন আর কোনও ভাবুক বাঙালীকে করে নাই। অতিশয় স্পর্শকাতর চিত্ত ও অতিশয় কল্পনা-প্রবণ হৃদয়ে যদি আধ্যাত্মিক সঙ্কট উপস্থিত হয়, যদি তাহার সঙ্গে আন্তরিকতা, আত্মপ্রত্যয় ও চরিত্রবল থাকে, তবে সে যুগের পক্ষে যেরূপ ধর্ম্মপ্রেরণা স্বাভাবিক, কেশবচন্দ্রের মধ্যে তাহারই বিকাশ হইয়াছিল। যে খ্রীষ্টীয় ধর্ম্মনীতির প্রতি রামমোহনের শ্রদ্ধার কথা পূর্ব্বে উল্লেখ করিয়াছি, কেশবচন্দ্রকেও সেই ধর্ম্মনীতি বিশেষপবে আকৃষ্ট করিয়াছিল। ইহা হইতে সে যুগের বাঙালীর প্রতিভা কোন্ প্রধান সমস্যার সমাধান-চিন্তায় উদ্বুদ্ধ হইয়াছিল তাহা আজ বিশেষ করিয়া স্মরণ রাখিতে হইবে। আমার মনে হয়, পাশ্চাত্য ধর্ম্মশাস্ত্র নয়, ইংরেজী সাহিত্যও নয়, ইংরেজের যে চরিত্রবল—বিজেতা জাতির যে পৌরুষময় প্রাণের স্ফূর্ত্তি সেকালে সমগ্র ভারতবাসীকে মুগ্ধবিস্ময়ে অভিভূত করিয়াছিল—যাহার প্রভাবে ইংরেজ শুধুই রাজ্যজয় করে নাই, বহু শতাব্দীর অনাচারকলুষিত নৈতিক দুর্দ্দশাগ্রস্ত জাতির হৃদয়ে আধিপত্য স্থাপন করিয়াছিল—সে যুগের বাঙালী মনীষী ও বাঙালী ভাবুক তাহাকেই বরণ করিয়া, আত্মসাৎ করিয়া, জাতির জীবনে নব আদর্শরূপে স্থাপন করিতে চাহিয়াছিলেন। কেশব এদেশে ইংরেজ-অধিকারের ইতিহাস জানিতেন; তাহার কারণও যেমন বুঝিয়াছিলেন, তেমনই তাহার সুফললাভের আশাও করিয়াছিলেন। তিনি বিশ্বাস করিয়াছিলেন, ইহা অপ্রত্যাশিত ও আকস্মিক বলিয়াই, ইহার মূলে মঙ্গলময় বিধাতার শুভ অভিপ্রায় আছে। যে ধর্ম্মনীতির প্রেরণায় ইংরেজ জাতি বড় হইয়াছে——ইংরেজের দৃষ্টান্তে ও সাহচর্য্যে তাহারই সারতত্ত্ব আমাদের জীবনে গ্রহণ করিতে পারিলেই আমাদের পরিত্রাণ আশু ও সহজ হইবে। ইংরেজের ভারত-বিজয়ের ফলে জাতির একটা মহৎ কল্যাণ সাধিত হইবে—এমন ধারণা সেকালে সকল শিক্ষিত বাঙালীর ছিল, বাঙালী একটা বড় আশা করিয়াছিল। বঙ্কিমচন্দ্রও এ আশা করিতেন। ইংরেজের প্রতি এই শ্রদ্ধা, বিজাতির প্রতি এই মনোভাব—ভাবনা ও কল্পনাশক্তির ফলে বাঙালীই সর্ব্বাগ্রে পোষণ করিয়াছিল; ইহারই ফলে, পাশ্চাত্য শিক্ষাদীক্ষার প্রভাবে বাঙালীই আধুনিক ভারতে যুগান্তর আনিয়াছে। কেশবের মধ্যে সেই বাঙালিয়ানারই বিকাশ হইয়াছিল ধর্ম্ম-প্রেরণার দিক দিয়া।

 কেশবের ধর্ম্ম-প্রেরণার মূলে ছিল পাপ-বোধ। অতি অল্প বয়সেই জাতির বহুকালসঞ্চিত পাপের পরিণাম-চিন্তা তাঁহাকে ব্যাকুল করিয়াছিল। বৈষ্ণবকুলে জন্মগ্রহণ করিয়া তিনি প্রকৃতিতে বৈষ্ণব ছিলেন; কিন্তু চৈতন্য-প্রবর্ত্তিত ধর্ম্মে পাপ ও পাপমুক্তির তত্ত্ব গ্রাহ্য হইলেও, সে ধর্ম্মের সাধনায় আর সে সরলতা ছিল না, জটিল রসতত্ত্ব ও নানা তান্ত্রিক সাধন-পদ্ধতির দ্বারা তাহা আচ্ছন্ন হইয়া পড়িয়াছিল। কেশব বুঝিয়াছিলেন, মানুষকে মানুষহিসাবেই উন্নত হইতে হইলে ঈশ্বরের সঙ্গে সাক্ষাৎ ব্যক্তি-সম্বন্ধ স্থাপন করিতে হইবে, সহজ স্বাভাবিক মানবীয় চেতনাকে অতিক্রম করিলে চলিবে না। সে সম্বন্ধ আপামরসাধারণের পক্ষে একই ভাবে ও একই কারণে সহজ হওয়া চাই। এই সম্বন্ধস্থাপনের উপায়—জ্ঞান নয়, ধ্যান নয়, গুরুদীক্ষাও নয়—প্রার্থনা। এই প্রার্থনাই গুরু—ভগবান ও মানুষের মধ্যে সহজ যোগস্থাপনের একমাত্র সেতু। এই প্রার্থনার উপযোগী চিত্তের অবস্থা— পাপ-বোধ, দুর্ব্বল অসহায় মানুষের ভয়-ব্যাকুলতা। চিত্তের এই অবস্থা ও এই প্রার্থনা-তত্ত্ব কেশবের জীবনে স্বতঃস্ফূর্ত্ত হইয়াছিল, পূর্ব্ব হইতেই তাঁহার মনকে খ্রীষ্ট্রীয় সাধন-পদ্ধতির অনুকূল করিয়াছিল। কেশবের নীতি-নিষ্ঠায় ভক্তের আত্মসমর্পণ ছিল, যুক্তিবাদীর অহঙ্কার ছিল না। প্রথম হইতেই এই নৈতিক চিত্তশুদ্ধির প্রয়োজন তিনি অনুভব করিয়াছিলেন, তাই খ্রীষ্টীয় সাধুর উক্তি—“Repent ye, for the Kingdom of Heaven is at hand”—তাঁহাকে এমন গভীর ভাবে বিচলিত করিয়াছিল।

 কেশব রামমোহন-পন্থী ছিলেন না—ইহার পরেও তাহা বলা বোধ হয় নিষ্প্রয়োজন। কেশব সজ্ঞানে ভক্তি-সাধনা করিতেন বটে—প্রচারক কেশব তাঁহার নব ধর্ম্ম-মন্দিরের ভিত্তিমূলে সদাজাগ্রত জিজ্ঞাসাকে স্থান দিয়াছিলেন বটে, কিন্তু মন্দিরের অভ্যন্তরে তিনি বিশ্বাসকেই সর্ব্বোচ্চ পীঠমণ্ডপে আসন দিয়াছিলেন; তিনি সকল জিজ্ঞাসার উত্তর চাহিতেন ভাগবতী প্রেরণার সমীপে। বাঙালীর সন্তান, ঊনবিংশ শতাব্দীর সেই যুগে—নূতনতর জাতীয় সমস্যার সঙ্কটে, এবং এক অভিনব শিক্ষাদীক্ষার আবহাওয়ায়—যে নূতনতর ভক্তের বেশে আবির্ভূত হইতে পারে, কেশব ছিলেন তাহাই; নদীয়ার জলমাটিতে জুডিয়ার ধর্ম্মবীজ যে ফুল ফুটাইতে পারে, কেশবের ধর্ম্মজীবন সেই ফুল। কিন্তু নূতন জ্ঞান-বিজ্ঞানের যুগে অবিমিশ্র ভক্তিকেও মিশ্ররূপ ধারণ করিতে হয়; কেশবের জীবনে সে দ্বন্দ্ব ছিল। তিনি সেই দ্বন্দ্বকে জ্ঞানত অস্বীকার করিয়াছিলেন; কিন্তু যিনি তাঁহার সমগ্র চরিত আলোচনা করিবেন, তিনিই দেখিতে পাইবেন, সে যুগের ধর্ম্মান্দোলনের পূর্ব্বোত্তর ধারায় ইহাই কেশব-জীবনের বিশেষত্ব। এই জন্যই সে যুগের সংস্কারপন্থীদের মধ্যে একমাত্র কেশবের প্রতিভাকেই সত্যকার ধর্ম্মপ্রতিভা বলা যাইতে পারে। কারণ, ধর্ম্ম কেবল নীতির শাসন নয়; অথবা ঈশ্বর নামক কোনও কল্পিত সত্তাকে যুক্তিবিচারের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত করিয়া, পরে নিজের বিবেক নামক অহংকারের সহিত তাহাকে যুক্ত করিয়া আত্মপ্রসাদ লাভ করার পন্থাও নয়। ইহারই বিরুদ্ধে কেশব তাঁহার জ্বলন্ত বিশ্বাসকে ভক্তিরসধারায় প্রবাহিত করিয়াছিলেন। কিন্তু তাঁহার প্রকৃতিতে জ্ঞান ও ভক্তির দ্বন্দ্ব ছিল; না থাকিলে তাঁহার জীবন এমন কর্ম্মময় হইত না; বুঝি বা, তিনি নব ধর্ম্মনির্মাণে আশানুরূপ সিদ্ধিলাভে বঞ্চিত হইতেন না। এই ভক্তি যেমন তাঁহাকে নিজ ধর্ম্মজীবনে জয়ী করিয়াছিল, তেমনই ধর্ম্মপ্রচারের স্ববিরোধী অধ্যবসায়ে তাঁহাকে ক্লান্ত শ্রান্ত ও বিফলমনোরথ করিয়াছে। কেশব জ্ঞান, ভক্তি ও কর্ম্মের সমন্বয় চাহিয়াছিলেন; প্রকৃতি জ্ঞানপ্রধান না হইলে এমন সমন্বয় হয় না। কেশবের প্রকৃতি ছিল ভক্তিপ্রধান, তাই এইরূপ সমন্বয়ের আকাঙ্ক্ষা তাঁহার প্রতিভার নিদর্শন হইলেও, তিনি তাহা সাধন করিতে পারেন নাই। বড় ভক্ত বড় বীরও বটেন; কেশবও বীর ছিলেন—তিনি ছিলেন উৎসাহ ও কর্ম্মবীর্য্যের অবতার। কিন্তু ধর্ম্মকে যে রূপে ও উপায়ে তিনি বহিঃসংসারে প্রতিষ্ঠিত করিতে চাহিয়াছিলেন, তাহার জন্য অন্যবিধ প্রতিভার প্রয়োজন। যে আসলে বৈষ্ণব—তাহার শাক্ত অভিমান চলে না; কিন্তু যে শাক্ত তাহার পক্ষে বৈষ্ণব-রীতি দুরূহ নয়। কেশব যে জ্ঞানী শাক্ত ছিলেন না, আমি তাহা বলিতেছি না, কিন্তু ভক্তিই ছিল তাঁহার প্রধান সম্বল, তাই দ্বন্দ্ব কখনও ঘুচে নাই। ‘Am I an Inspired Prophet?’—নামক সুবিখ্যাত বক্তৃতায় এই অন্তগূঢ় দ্বন্দ্বের সুস্পষ্ট আভাস আছে। তিনি বলিতেছেন—

 Pantheism and mysticism are things of Asia, while positivism and all the sciences of the day belong to Europe. My Church is an Asiatic Church. I am in my very bones and blood, in the very constituation of my soul, essentially an Asiatic. As an Asiatic, I would encourage and vindicate devotion to the extent of mystic communion. But here you will probably say there is no harmonious development. It is all prayer and contemplation, and no work. I say there is harmony. If I am mystical, am I not practical too? I am practical as an Englishman. If I am Asiatic in devotion, I am a European in practical energy. My creed is not dreamy sentimentalism, not quietism, not imagination. Energy, yes, energy—I have that in a great measure in my character and in my church.

 কেশবের চরিত্রে এই শিশুর মত সারল্য ও আত্মপ্রত্যয় বড়ই উপভোগ্য। “Am I not practical too?”—সেদিন কেশবের এই উক্তি তাঁহার শ্রোতৃবর্গ কি ভাবে গ্রহণ করিয়াছিলেন জানি না; কিন্তু এতদিন পরে আজ আমরা দূর কণ্ঠের এই আকুল প্রশ্ন শুনিয়া বেদনা অনুভব করি। কেশব নিজের সম্বন্ধে যে কর্ম্মবীর্য্যের কথা বলিয়াছেন, তাহা খুবই সত্য,—যে জ্বলন্ত বিশ্বাস ও নৈতিক উৎসাহ তাঁহার কর্ম্মজীবনে আমরা দেখিতে পাই, তাহাতেই তিনি আমাদের দেশের নবযুগকে একটি বিশেষ দিক দিয়া অগ্রসর করিয়া দিয়াছিলেন। কিন্তু শেষ পর্য্যন্ত তিনি ‘মিষ্টিক’—ঊনবিংশ শতাব্দীতেও খ্রীষ্ট ও চৈতন্যের বংশধর। ইহাই তাঁহার আত্মার স্বধর্ম্ম; তিনি যদি নিজ জীবনে সিদ্ধিলাভ করিয়াই সন্তুষ্ট থাকিতেন, তবে কথাই ছিল না। কিন্তু তিনি তাহা পারেন নাই; জাতির পরিত্রাণের জন্য যুগোচিত ধর্ম্মচিন্তা তাঁহাকে ব্যাকুল করিয়াছিল; ইহাই তাঁহার মহত্ব, এই জন্যই তিনি সে যুগের একজন স্মরণীয় পুরুষ। বর্ত্তমান যুগ ক্রমশই গণতন্ত্রের দিকে চলিয়াছে। একেশ্বরবাদ একদিন মানুষের ভ্রাতৃত্ববন্ধন দৃঢ় করিয়াছিল, কিন্তু তাহার মূলে ছিল ঈশ্বরাদেশের কঠিন শাসন। ভক্ত কেশব এই শাসনকে স্বাধীন আত্মার সানন্দ স্বীকৃতির সহিত যুক্ত করিয়া লইলেও তিনি মানুষকে বড় করেন নাই, বরং সর্ব্বত্র সকল কর্ম্মে, মিস্টিক যোগীর মত, আত্মলব্ধ ঈশ্বরাদেশকেই শিরোধার্য্য করিয়াছেন। ইহাই চিরযুগের ভক্ত সাধকগণের চরিত্র-নীতি। কিন্তু এ যুগের সাধনায় এই মধ্যযুগীয় ধর্ম্মনীতি কতদূর সাফল্যলাভ করিতে পারে, কেশবের আজন্ম সাধনার পরিণাম লক্ষ্য করিলেই তাহা বুঝা যায়।

 কেশবচন্দ্রের ধর্ম্মজীবনের যে তৃতীয় লক্ষণটির কথা বলিয়াছি, তাহা এই যে, ধর্ম্মবিষয়ে কেশব মতবাদী না হইয়া ভাবগ্রাহী ছিলেন—নিজ হৃদয়ের বিকাশকামনায় তিনি সর্ব্বমত ও সর্ব্বতন্ত্র হইতে সুপথ্য সংগ্রহ করিতেন; ভাবুক ভাবপ্রবণ কেশব ধর্ম্মপ্রেরণার ক্ষেত্রে একরূপ কবি ছিলেন। তাঁহার প্রাণের মধ্যে নিরন্তর একটি ভাবাগ্নি প্রজ্জ্বলিত ছিল, তাহাতে তিনি কখনও কোথায়ও সাধনজীবনে স্থাণু হইয়া থাকিতে পারিতেন না। তিনি তাঁহার ‘জীবন-বেদ’ নামক গ্রন্থের এক প্রসঙ্গে বলিতেছেন—

 হে আত্মন্! ধর্ম্মজীবনের বাল্যকালে কি মন্ত্রে দীক্ষিত হইয়াছিলে? আত্মা উত্তর দেয়, অগ্নিমন্ত্রে। আমি অগ্নিমন্ত্রের উপাসক, অগ্নিমন্ত্রেরই পক্ষপাতী। অগ্নিমন্ত্র কি? শীতলতা বুঝিতে হইলে উত্তাপ বুঝিতে হয়।

 কি মনের চারিদিকে, কি সামাজিক অবস্থার চারিদিকে সততই উৎসাহের অগ্নি জ্বালিয়া রাখিতাম। একদলের কাছে সেবা করিলাম, আর একটি দল কবে হইবে; দশটি দল প্রস্তুত করিলাম, আর দশটি দল কবে প্রস্তুত করিব; কতকগুলি লোকের সহিত আলাপ করিলাম, আর কতকগুলি লোকের সঙ্গে কিসে আলাপ করিতে পারিব; কতকগুলি শাস্ত্র সঙ্কলন করিয়া সত্য সংগ্রহ করিলাম, পাছে সেই সত্যগুলি লইয়া থাকিলে সেগুলি পুরাতন হইয়া পড়ে, এই জন্য অপর কতকগুলি পড়িয়া সত্য সংগ্রহ করিব, কেবল এই চেষ্টাই ছিল। ইহাই উত্তাপের অবস্থা।

 এই যে উত্তাপের অবস্থা, ইহাই কেশব-চরিত্রের সর্ব্বপ্রধান বৈশিষ্ট্য। জ্ঞানবুভুক্ষা ও ভক্তিরসের নিয়ত উচ্ছ্বাস, একই জীবনে এই দুইয়ের অপূর্ব্ব দ্বন্দ্ব—ইহাই নবযুগের বাঙালীর নবসৃষ্টি-কামনার অবস্থা; ইহাই এ জাতির প্রতিভার নিদান। ইহা আর্য্যও নয়, সেমিটিকও নয়, ইহা বাঙালীর শোণিত ও বাংলার জলমাটির বিশিষ্ট গুণ। ইহারই বলে আমরা নবযুগের নূতন কাল্‌চার সৃষ্টি করিয়াছি—রাষ্ট্রে, সমাজে ও সাহিত্যে, বিষম আদর্শের মিলন ঘটাইয়া, সমগ্র ভারতের ইতিহাসে নূতন অধ্যায় যোজনা করিয়াছি। কেশবচন্দ্রে সেই সংস্কৃতিশীলতার এক অপূর্ব্ব বিকাশ লক্ষিত হয়। ভাবুকতাপ্রবণ বাঙালীর নিকটে কোনও ভাবসত্যই বর্জ্জনীয় নহে। বাঙালীর নবজাগ্রত উচ্ছৃঙ্খল আবেগ কেশবের সত্যপিপাসা ও বলিষ্ঠ ধর্ম্মচেতনায় সংহত ও সংযত হইয়া জাতীয় জাগরণের একটা দিক নির্ণয় করিয়া দিল। আমার মনে হয়, কেশবচরিত্রের এই দিকটি বাঙালী জাতির নবজাগৃতির ইতিহাসে বিশেষ করিয়া অনুধাবনযোগ্য।

 আমার বক্তব্য শেষ হইয়া আসিয়াছে, তথাপি উপসংহারে আরও কয়েকটি কথা বলিব। সমগ্র ঊনবিংশ শতাব্দী ধরিয়া বাঙালী আর কোনও চিন্তা করে নাই—নূতন যুগের নূতন অবস্থার সঙ্গে, নৈতিক, মানসিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সামঞ্জস্য সাধনই, তাহার সকল কর্ম্ম-চিন্তা, সকল ভাবুকতার মূলে ছিল। জাতির অধঃপতনও যেমন গভীর, পরিত্রাণের আদর্শও তেমন উচ্চ। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম পাদে রামমোহনের মনীষা সেই সমস্যাকে প্রথম প্রত্যক্ষ করিয়াছিল, ইহাই রামমোহনের কৃতিত্ব। কিন্তু আমাদের বুদ্ধির জড়তা প্রদর্শন, যুক্তিবিচারের প্রয়োজনীয়তা প্রতিপাদন ছাড়া তিনি অধিক কিছু করিতে পারেন নাই। কেবল যুক্তিবিচারসিদ্ধ মতবাদের দ্বারাই একটা জাতির হৃদয় বা চরিত্রের পরিবর্ত্তন হয় না—চাই প্রেম, চাই তপস্যা; জীবনে তাহারই অগ্নি প্রজ্বলিত করিয়া সেই আলোক মানুষের প্রাণে ও মনে বিকীর্ণ করা। কেশব দ্বিতীয় যুগের যুগন্ধর; তিনি নবজীবন সৃষ্টির কাজে আত্মোৎসর্গ করিয়াছিলেন—তিনি সে যুগের প্রথম প্রেমিক। কিন্তু কেশবের প্রেমও জাতীয় জীবন-যজ্ঞে পূর্ণাহুতির সিদ্ধিলাভ করিল না। ধর্ম্ম-প্রচারক কেশবচন্দ্রের মন্ত্র জাতীয় জাগরণের প্রথম প্রহরেই নিস্তেজ হইয়া পড়িল। কেশব নিজেও শেষে সকল বিধি, সকল বিধান উত্তীর্ণ হইয়া, নিজের প্রচার-ধর্ম্ম ও ধর্ম্ম-প্রচারেরও বহু উর্দ্ধে প্রয়াণ করিয়াছিলেন। তথাপি ইহা স্বীকার করিতে হইবে, জাতীয় জীবনযজ্ঞে প্রথম অগ্ন্যাধান করিয়াছিলেন কেশব। তাঁহার প্রচার কর্ম্মের অপূর্ব্ব উন্মাদনা, নূতন ভাবচিন্তাকে বাহিরের আচার-অনুষ্ঠানে রূপ দিবার আশ্চর্য্য সৃজনীশক্তি, এবং সর্ব্বোপরি তাঁহার ব্যক্তিত্ব—কেশববিরোধী সম্প্রদায়কেও অনুপ্রাণিত করিয়াছে; তাঁহার কর্ম্মপদ্ধতি কত কর্ম্মীকে পথ দেখাইয়াছে। সে যুগের যে বাঙালী কবি মহাকাব্য রচনা করিয়া যশস্বী হইয়াছিলেন, আমার মনে হয় তিনিও কেশবীয় ভাবের ভাবুক। “এক ধর্ম্ম, এক জাতি, এক ভগবান”—এই মহাবাক্য প্রচারকল্পে, যিনি নূতন করিয়া, বাঙালীর জন্য মহাকাব্য রচনা করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন—সেই কবি নবীনচন্দ্রও কেশবের বাণী হইতেই প্রেরণা লাভ করিয়াছিলেন বলিয়া মনে হয়। আরও মনে হয়, কেশবের অব্যবহিত পরবর্ত্তী কালে যে আর এক মহাপুরুষ এই জাতির জীবন-যজ্ঞে শেষ আহুতি দিয়াছিলেন, সেই বীর-সন্ন্যাসী স্বামী বিবেকানন্দও, তাঁহার প্রচারপ্রণালী ও কর্ম্মপদ্ধতিতে কেশবের দ্বারা প্রভাবিত হইয়াছিলেন। যে অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষার কথা কেশব তাঁহার ‘জীবন-বেদে’ উল্লেখ করিয়াছেন, কর্ম্মোন্মাদনার সেই উত্তাপ বিবেকানন্দের ভাবের সেই উৎসাহ, জীবনেও অপরিমিত। বিবেকানন্দ কেশবের পরবর্ত্তী হইলেও অনুবর্ত্তী নহেন, তাঁহার গুরুমন্ত্র ও তাঁহার বাণী স্বতন্ত্র; কিন্তু তাঁহার কর্ম্মজীবনের আদর্শে কেশবের ছায়া কতকটা সংক্রামিত হওয়া অসম্ভব নহে।

ফাল্গুন, ১৩৪০

[ঢাকা নববিধান ব্রহ্মমন্দিরে কেশব-স্মৃতিসভায় প্রদত্ত বক্তৃতা]