বিবিধ কথা/শ্রীরামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ

শ্রীরামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ

প্রথম প্রসঙ্গ—শ্রীরামকৃষ্ণ

 ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণের মানবত্বের কথা—তাঁহার মানব-প্রেমের কথা ভাবিতেছিলাম। এই প্রেম জগতে অনেকবার শরীরী হইয়া দেখা দিয়াছে, কিন্তু এবার তাহাতে কিছু নূতনত্ব আছে। বুদ্ধ জগতের প্রথম প্রেমিক; জীবদুঃখে কাতর হইয়া তিনি এই দুঃখের নিদান ও তাহার আত্যন্তিক উচ্ছেদের যে উপায় আবিষ্কার করিয়াছিলেন, তাহাতে এই জন্ম-জরা-মৃত্যুর সংসারকে অসার বুঝিয়া আত্মারও উচ্ছেদসাধন পরম পুরুষার্থ বলিয়া নির্দ্ধারিত হইয়াছিল; তাঁহার মতে সৃষ্টি শুধু যে ‘মিথ্যাভূতা’ তাহা নয়, তাহা ‘সনাতনী’ও নয়—দ্বৈত অদ্বৈতের কোনটাই তত্ত্ব নয়; আত্যন্তিক দুঃখনিবৃত্তির জন্য সকল সংস্কারের নির্ব্বাণ-সাধনাই একমাত্র পন্থা। বুদ্ধ যত বড় প্রেমিক, তত বড় সন্ন্যাসী। এই বাণী মানুষের অহঙ্কার-নাশে সহায়তা করিয়াছিল, এবং ইহারই প্রেরণায় জীবনের মহত্তর আদর্শ, মনুষ্যত্বের বৃহত্তর আশ্বাস, একদা ভারতীয় সমাজে নবজীবন সঞ্চার করিয়াছিল। কিন্তু আত্মা মরে নাই, বরং এই উন্মাদনার স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়ার ফলে আত্মা ও অনাত্মার দেহতত্ত্বকে আরও কঠিনভাবে স্বীকার করিতে হইয়াছিল। অনাত্মার উপরে আত্মাকে প্রতিষ্ঠিত করিবার প্রয়োজন গুরুতর হইয়া উঠিয়াছিল। অতঃপর ভারতের বাহিরে জগতের দ্বিতীয় প্রেমিক খ্রীষ্ট, এবং ভারতের ভিতরে কোনও মহাপুরুষ, ভাগবত প্রেম-ধর্ম্মের মহিমা ঘোষণা করিলেন। শঙ্করের অদ্বৈত-আত্মতত্ত্বের আস্তিকতা বৌদ্ধ শূন্যবাদ নিরসন করিলেও, মানুষের প্রাণ সেই উত্তুঙ্গ তুষারশিখরবিচ্ছুরিত শীতল জ্যোতির আশ্বাসে আশ্বস্ত হইতে পারে নাই। এই ভাগবত ধর্ম্মেরই নানা মন্ত্র মানুষের দুঃখনিবৃত্তির সাধনোপায় হইয়াছিল। তথাপি এক দিকে জ্ঞান ও অপর দিকে প্রেম, এই দুইয়ের দ্বন্দ্ব চিরকাল মানুষের অধ্যাত্মচেতনায় জাগিয়া রহিল। মাত্র একবার ভারতীয় হিন্দু-প্রতিভার উৎকৃষ্ট-নিদর্শন-স্বরূপ গীতোক্ত কর্ম্মসন্ন্যাসবাদে এই দ্বন্দ্ব সমাধানের এক অপূর্ব্ব পন্থা উঁকি দিয়াছিল—বুদ্ধপ্রচারিত ধর্ম্মনীতির এক নূতন অর্থবাদ হইতেই এই কর্ম্মসন্ন্যাস-মন্ত্রের উদ্ভব হইয়াছিল বলিয়া মনে হয়।

 কিন্তু তথাপি সমস্যার মূল যেন দৃষ্টির বাহিরেই রহিয়া গেল। খ্রীষ্টের ভক্তি-ধর্ম্ম, বৈষ্ণবের জ্ঞানভক্তিবাদ—দ্বৈত এবং বিশিষ্টাদ্বৈত— কিছুতেই মানুষের মনুষ্যত্ব-বোধ পরিতৃপ্ত হয় নাই; যুগবিশেষের যুগধর্ম্মরূপে এই সকল উপদেশ যতই কার্য্যকরী হউক, যুগান্তরের ক্রমবর্দ্ধমান মানবীয় চৈতন্যে যে আধ্যাত্মিক সঙ্কট ঘনীভূত হইয়া উঠিতেছে, মানুষের দেহমন যে তীব্রতর চেতনায় অশান্ত হইয়া উঠিতেছে, তাহাতে খ্রীষ্টের—“Render unto Caesar what is Caeser’s due”—এই নীতি অনুযায়ী সংসারের সঙ্গে তেমন সহজ বোঝাপড়া আর সম্ভব নহে। আধ্যাত্মিক সঙ্কট অপেক্ষা আধিভৌতিক সঙ্কটই এখন মানুষকে এমন কোণঠেসা করিয়াছে যে, ইহকালই তাহার সর্ব্বস্ব হইয়া উঠিয়াছে; অথচ তাহাতেও বাঁচিবার আশা নাই। আজ যে ভগবৎ-মুখী হইয়া বসিয়া থাকে, সে হয় ক্লীব, নয় অন্ধ। মধ্যযুগের আদর্শ আজ অচল। অথচ ধর্ম্মহীন হইলে মানুষ বাঁচিবে না। তবে উপায়?

 উপায় সর্ব্বযুগে যাহা ছিল এই যুগেও তাহাই,—মানুষকে বাঁচিতে হইলে জীবনেরই আরাধনা করিতে হইবে,—বৃহত্তর জীবনের। এক কথায়, প্রেমই সেই সঞ্জীবনী অমৃতবল্লরী। যুগে যুগে ইহাই মানুষকে বাঁচাইয়াছে; আত্মোৎসর্গ না করিয়া আত্মলাভ নাই। কিন্তু এ যুগে সে প্রেরণা আসিবে কোথা হইতে? প্রেমের নূতনতর ভিত্তিভূমি কি হইবে? ভগবানে আত্মসমর্পণ যে প্রেমের আদর্শ, সে প্রেমে আজ কেহ সাড়া দিবে না—আজিকার মানুষ অহৈতুকী প্রেমেরও হেতু জিজ্ঞাসা করে। খ্রীষ্টান বা বৈষ্ণব—কোন theology-তেই সে বিশ্বাস করে না; কোন তত্ত্ববাদ তাহাকে প্রেমিক করিয়া তুলিবে না। অথচ তাহাকে বাঁচিতে হইবে—মানুষের একমাত্র ধর্ম্ম যে প্রেম, তাহার দ্বারা মৃত্যুকে জয় করিতে হইবে।

 সমগ্র ঊনবিংশ শতাব্দী ধরিয়া পৃথিবীময় মানবের নবজাগরণ হইয়াছিল—প্রাচীন সংস্কার জীর্ণ-নির্ম্মোকের মত মানুষের মন হইতে খসিয়া পড়িতেছিল। এক নূতন বুভুক্ষা এই নব জাগ্রত মানবসমাজকে অধীর করিয়া তুলিয়াছিল। এ বুভুক্ষার মূলে ছিল মানুষের অতি তীব্র মনুষ্যত্ব-চেতনা। এই বুভুক্ষা-প্রশমনকল্পে কত মনীষীর মনীষা ব্যর্থ হইল—কত পথ্যের ব্যবস্থা হইল, কিন্তু পাকপ্রণালী আবিষ্কৃত হইল না। সমাজে ও রাষ্ট্রে কত ভাঙা-গড়া, সমাজনীতি ও রাজনীতির কত নিত্য নূতন মতবাদ, শাস্ত্র ও গুরুবাদের পরিবর্ত্তে বিবেক বা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের জয়ধ্বজা, নবধর্ম্মতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা—এই ক্ষুধার কত লক্ষণই কত দিকে প্রকাশ পাইতে লাগিল; মানুষ যেন কস্তুরী-মৃগের মত নিজ নাভিগন্ধে দিশাহারা হইয়াছিল। যে ধর্ম্ম এতকাল সমাজকে ধরিয়া রাখিয়াছিল, তাহা আর যথেষ্ট নয়—তাহার উপর যে জোড়াতালি চলিতেছিল তাহাতে এই ক্ষুধা আরও বিকৃত হইয়া পড়িতেছিল; মনুষ্যত্বের নামে ব্যক্তির আত্মপরায়ণতা প্রশ্রয় পাইয়া মহাবিনাশের পথ প্রস্তুত করিতেছিল।

 এমনই কালে এই বাংলা দেশের জল মাটিতেই প্রেমের এক নূতন তত্ত্ব মূর্ত্তি পরিগ্রহ করিল। মানুষের প্রতি অসীম শ্রদ্ধা—যে শ্রদ্ধা অতি অধমকেও আত্মবিশ্বাসী করিয়া তোলে—তাহাই হইল এই নব-মানবপ্রেমের আদি প্রেরণা।

 বুদ্ধ যাহাকে অস্বীকার করিয়া মানুষকে নির্ব্বাণমুক্তির অভয়লাভ করিতে বলিয়াছেন, খ্রীষ্ট তাহাকেই সঞ্জীবিত করিয়া ক্ষমা ও তিতিক্ষার অনুশীলনে পাপমুক্তির আশ্বাস দিয়াছিলেন। চৈতন্য অহৈতুকী শুদ্ধা প্রীতির সাধনা করিতে বলিয়াছিলেন—কামকেই ইন্দ্রিয়লোক হইতে অতীন্দ্রিয়লোকে প্রতিষ্ঠিত করিয়া প্রেমের সন্ন্যাস প্রচার করিয়াছিলেন। কেহই মানুষকে বড় করেন নাই, মানুষের মনুষ্যত্বের দায়কে সাক্ষাৎভাবে তুচ্ছ করিতে শিখাইয়াছিলেন। উভয়েরই শিক্ষায় পাপবোধ ও প্রায়শ্চিত্তের প্রয়োজন বড় হইয়া আছে; মানুষ কেবলমাত্র মানুষহিসাবে অসৎ—সেই এক পরম সৎকে বিশ্বাস বা তাহার প্রতি অহৈতুকী প্রেমের দ্বারা শুচি হইতে পারিলে, তবে সে ভবভয় হইতে মুক্তি লাভ করিবে। কিন্তু এবার প্রেমের নূতন অর্থ হইল—মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা, জীবের মধ্যেই শিবের সাক্ষাৎকার। মুক্তির সবচেয়ে বড় আদর্শ হইল জীবন্মুক্তি—এই মানুষের সংসারে, জীবরূপেই যে শিবত্বের উপলব্ধি করিয়াছে —মুক্তিকেও যে তুচ্ছ করিয়াছে, সেই প্রকৃত মুক্ত।

 শ্রীচৈতন্য ‘জীবে দয়া, নামে রুচি’ উপদেশ করিয়াছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণ তাহাতেও সন্তুষ্ট নহেন। তিনি পৃথক ‘নামে রুচি’র আবশ্যকতা রাখেন নাই,—কারণ সেই নাম বস্তু হইতে পৃথক নয়, ভগবান ঐ জীবের মধ্যেই আছেন। এই ‘জীবে দয়া’র কথা বলিতে বলিতে একবার তিনি সমাধিস্থ হইয়া পরে সমাধিভঙ্গে মৃদুস্বরে বলিয়াছিলেন—“জীবে দয়া?—দয়া?—বলিতে লজ্জা হয় না? তুমি কীটাণু-কীট! তুমি দয়া করিবার কে? না! না! দয়া অসম্ভব। জীবকে দয়া নয়—শিবরূপে সেবা কর।”

 আমার মনে হয়, ইহাই শ্রীরামকৃষ্ণ প্রচারিত নব ধর্ম্মের সার-সত্য। মানুষকেই নব মহিমায় প্রতিষ্ঠিত করা,—পাপবোধ হইতে মুক্ত করিয়া তাহার ভিতরে যে পরম বস্তু রহিয়াছে তাহারই সহিত পরিচয়সাধন করাইয়া, ক্ষুদ্র ‘আমি’কে ব্যষ্টিদেহ হইতে উদ্ধার করিয়া বিরাট সমষ্টিদেহে স্পন্দিত করিয়া তোলা—ইহাই এই নব অবতারের অবতারত্বের হেতু। জীব ও ব্রহ্মের অভেদ-তত্ত্ব এমন করিয়া আর কেহ প্রচার করেন নাই। পরমহংসদেবের ‘কালী’ এই জীব হইতে শিবে, এবং শিব হইতে জীবে গতায়তির সেতু। জ্ঞানের অদ্বৈতসিদ্ধির শেষে, সচ্চিদানন্দকে আত্মসাৎ করিবারও পরে, যে-প্রেম মহাপুরুষেরই মোহরূপে মুক্তি অপেক্ষাও গরীয়ান—বৈষ্ণব নয়, পূরা অদ্বৈতীর পক্ষেই সৃষ্টির যে রসরূপ আস্বাদন করা সম্ভব—কালী তাহারই প্রতীক। যে প্রেম অদ্বৈতকে অক্ষুণ্ণ রাখিয়াই, বহুর মধ্যে একের উপলব্ধি, বন্ধনের মধ্যেই মুক্তি, শিবরূপে জীবের পূজা সম্ভব করিয়া তোলে—এ সেই প্রেম। জগতের আর কোনও প্রেমিক এমন প্রেম প্রচার করেন নাই।

 শ্রীরামকৃষ্ণের শতবার্ষিক উৎসব উপলক্ষ্যে যে কয়টি কথা আমার মনে হইয়াছে তাহা লিপিবদ্ধ করিবার পূর্ব্বে আমি আর একটি কথা বলিব। আমাদের পঞ্জিকায় মহাপুরুষগণের আবির্ভাব ও তিরোভাবের যে পর্ব্বদিবস ও তাহার পালন-বিধি নির্দ্দিষ্ট হইয়া থাকে, আমার মনে হয় ভক্তের পক্ষে তাহা অপেক্ষা সুন্দর বিধি আর কিছু হইতে পারে না। তথাপি সেই নিত্য বর্ষকৃত্য ছাড়াও এমন একটা নৈমিত্তিক উপলক্ষ্য সৃষ্টি করিয়া মহোৎসবের অনুষ্ঠান নানা দিক দিয়া প্রয়োজনীয় বোধ হইতে পারে। মহাপুরুষের মহিমাকীর্ত্তন ও নাম-প্রচারের সুযোগ যতই পাওয়া যায় ততই ভাল, এবং এইরূপ বৃহত্তর অনুষ্ঠানে উৎসাহ সঞ্চার অধিক মাত্রায় হওয়াই স্বাভাবিক—সেই অবকাশে কিছু ভাল কাজ করিয়া লওয়াও সম্ভব।

 এ যুক্তি মানি। তথাপি আর এক কারণে মন সায় দেয় না। ইহার মধ্যে যেন একটা ক্ষুদ্র ব্যবসায়-বুদ্ধি, হাট-বাজারের বিজ্ঞাপন-নীতি, আধুনিক মনের শ্রদ্ধাহীনতা রহিয়াছে। ক্ষুদ্র কালের শতাব্দীগণনায় কেবল ইতিহাসগত হইয়া থাকিবার মত যে নয়, মহামন্বন্তরের তরঙ্গচূড়ায় যাহার আবির্ভাব—যুগ-চিহ্নিত কালের উপরে যে চরণ রাখিয়াছে মাত্র, কাল যাহার বাণী-বিগ্রহ গর্ভে ধারণ করিয়াছে, এখনও প্রসব করে নাই—বুদ্ধকে প্রসব করিতে তিন শত বৎসর লাগিয়াছিল, খ্রীষ্টকেও ততোধিক—সেই মহাপুরুষের শতবার্ষিকীর অর্থ কি? আমাদের সংস্কার অনুসারে তিনি আসিয়াছিলেন, তিনি ভূতকালের অধিবাসী; তাঁহার আসা যে এখনও শেষ হয় নাই, কেবল আরম্ভ হইয়াছে মাত্র, ইহা আমরা বুঝি না; তাই অপরাপর মৃত ব্যক্তির উদ্দেশে শতবার্ষিকী-অনুষ্ঠানের মত তাঁহারও স্মৃতি-তর্পণ আবশ্যকীয় বলিয়া মনে করি।

 শ্রীরামকৃষ্ণ যে শ্রেণীর মহাপুরুষ— অবতারবাদে বিশ্বাস থাক বা না থাক—তাঁহাদের সংখ্যা অতিশয় অল্প। সমস্ত পৃথিবীকে দেশ, এবং সহস্র বৎসরকে কাল ধরিলে—এমন মহাপুরুষ সবকালে একটিও মেলে কিনা সন্দেহ। অন্ধ-ভক্তির কথা নয়, অন্ধ সাম্প্রদায়িক অশ্রদ্ধার কথাও নয়, সর্ব্বপ্রকার অভিমান ও স্বার্থসংস্কার মুক্ত হইয়া যিনিই এই মহাপুরুষের সমীপবর্ত্তী হইবেন তাঁহারই প্রতীতি হইবে যে, এই নরদেহধারী ‘ব্যক্তি’ আর সকল ব্যক্তি হইতে স্বতন্ত্র; এ যেন এক মহাশক্তি ও মহাসত্যের প্রকাশ; বিশ্বরহস্যের অন্তস্তল হইতে উৎসৃষ্ট—কাল ও মহাকালের সংঘর্ষে উৎক্ষিপ্ত—একটি জ্যোতিস্ফুলিঙ্গ। ভূত-ভবিষ্যৎ-বর্ত্তমান সমগ্র কালধারায় ইহাকে প্রসারিত করিয়া দেখিতে না পারিলে, ইহার আয়তন সম্যক দৃষ্টিগোচর হয় না। এই আবির্ভাব যাহারই হউক, যে বাণী এই মূর্ত্তি পরিগ্রহ করিয়াছে তাহা যে কালাতীত এবং অপৌরুষেয়, তাহাতে সন্দেহ নাই। আবার কালাতীতকে কালের মধ্যে প্রকাশ হইতে দেখি, ইহাও সত্য; ইহার কারণ কি?

 অবতারবাদী হিন্দু বলিবে—‘যদা যদাহি ধর্মস্য গ্লানিঃ’; অবতারে বিশ্বাসী না হইলেও সেই বাক্যের এই অংশটুকু যে সত্য, তাহা বর্ত্তমান কালে প্রমাণ করিতে হইবে না। মানবেতিহাসের নানা যুগে বহু যুগন্ধর পুরুষের আবির্ভাব হইয়াছে—সেই সকল আবির্ভাব, ‘ধর্ম্মস্য গ্লানিঃ’ নয়, কালধারার সুস্থগতির ফলেই হইয়া থাকে—তাহা কালাতীতের আবির্ভাব নয়। কিন্তু ‘ধর্ম্মস্য গ্লানিঃ’ যাহাকে বলে, তাহার লক্ষণ একালে যেমন প্রকট হইয়া উঠিয়াছে, ঠিক এই অবস্থা আর কখনও হয়তো হইয়া থাকিবে, কিন্তু তাহা মানুষের স্মরণাতীত, সে মন্বন্তর প্রাগৈতিহাসিক। ইহা সাধারণ কালধর্ম্ম নয়—ইহা অকাল; মহাকালরূপী মহোরগ যেন নিজ বিষে জর্জ্জরিত হইয়া নিজের পুচ্ছ দংশন করিতেছে! মানুষের মনুষ্যত্ব এমন ভাবে আর কখনও সঙ্কটাপন্ন হইয়াছে বলিয়া মনে পড়ে না। ইহাকে সংশোধন করিবার জন্য, যাহা কালাতীত শাশ্বত তাহাকেই প্রয়োজন। “তদাত্মানং সৃজাম্যহং”—অবতার বলিতে হয় বল, না বলিলেও ক্ষতি নাই, কিন্তু শ্রীরামকৃষ্ণের মধ্যে যাহার প্রকাশ তাহা সেই ‘আত্মা’—কালের মধ্যে কালাতীতের আবির্ভাব। ইহা ব্যক্তি নয়—বাণী, ঘটনা নয়—প্রকাশ। ইহার প্রচার আছে—সন-তারিখ নাই। শতবার্ষিকী অনুষ্ঠান যাহাদের জন্য হইয়া থাকে এবং হওয়া প্রয়োজন শ্রীরামকৃষ্ণ তাহাদের পর্য্যায়ভুক্ত নহেন। তাঁহার আবির্ভাব ও তিরোভাবের পুণ্যতিথি যদি পালন করিতে হয়, তবে বর্ষ-পঞ্জিকা আছে, তাহাই যথেষ্ট।

 শ্রীরামকৃষ্ণ সম্বন্ধে কোনও নূতন কথা বলিবার অধিকার বা যোগ্যতা আমার নাই—আমি তাঁহার সম্বন্ধে পরোক্ষভাবে যেটুকু জ্ঞান লাভ করিয়াছি, তাহা হইতেই দুই একটি কথা বলিব। সৌভাগ্যের বিষয় এই যে, শ্রীরামকৃষ্ণের বাণী বা তাঁহার লীলাপ্রসঙ্গ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এত ভক্ত, ভাবুক ও মনীষী কর্ত্তৃক লিপিবদ্ধ হইয়াছে যে, সে সম্বন্ধে কোনরূপ ক্ষোভের কারণ আর নাই। আমি বর্ত্তমান প্রসঙ্গে, সেই বহুপ্রচারিত ও সুপরিজ্ঞাত তথ্যরাশি হইতে যে কয়েকটির প্রতি বিশেষ করিয়া পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করিতে চাই, তাহার জন্য ভগিনী নিবেদিতার অপূর্ব্ব গ্রন্থ The Master as I saw Him, এবং মঃ রোম্যাঁ রোলাঁর সাহিত্যিক প্রতিভা ও মনীষার অভিনব নিদর্শন— তাঁহার দুইখানি উপাদেয় গ্রন্থের শরণাপন্ন হইব। ইহার কারণ, এই দুইজনেরই রচনার একটি পৃথক বিশিষ্ট মূল্য আছে। নিবেদিতার গ্রন্থ প্রায় পঁচিশ বৎসর যাবৎ আমার নিত্যসঙ্গী—এখনও পুরাতন হয় নাই। তাহার মধ্যে যে প্রাণ ও মন সর্ব্বত্র স্পন্দিত হইতেছে, তাহা জ্যোৎস্না-নিশীথের তারাখচিত আকাশের মত—তেমনই বিরাট গম্ভীর ও জ্যোতির্ম্ময়; সে আকাশের দিকে যখনই চাহিয়াছি, তখনই নিজ জীবনের ক্ষুদ্রতা ও অক্ষমতা ক্ষণকালের জন্য বিস্মৃত হইয়া চন্দ্রতারকার সভাতলে আসন পাতিয়াছি। গুরু-বিবেকানন্দের লোকোত্তর চরিত্র বুঝিবার ও বুঝাইবার সে কি আন্তরিক প্রয়াস—সেই মহনীয় পুরুষের দিব্যমূর্ত্তি আপনার চিত্রফলকে প্রতিবিম্বিত করিবার জন্য জ্ঞান ভক্তি ও প্রেমের সকল শক্তি একযোগে প্রয়োগ করার সে কি নিরন্তর সাধনা! নিবেদিতার রচনায় যেমন স্ফুটচন্দ্রতারকা বিভাবরীর গম্ভীর-মনোহর রূপ ফুটিয়া উঠিয়াছে, তেমনই মঃ রোলাঁর গ্রন্থ দুইখানিতে প্রভাতকিরণোজ্জ্বল নির্ম্মলনীল মানস-আকাশের—সদাজাগ্রত, আত্মসচেতন, অথচ ভাবগ্রাহী হৃদয়ের সুভঙ্গিম প্রতিচ্ছবি ফুটিয়া উঠিয়াছে। আমার আলোচনার পক্ষে এই দুইজনের উক্তিই যথেষ্ট। স্বামিজী বা পরমহংসদেবের সম্বন্ধে প্রবন্ধ-রচনা কিংবা বক্তৃতা করা যে কত সহজ, তাহা ইহা হইতে বুঝা যাইবে।

 একালের ও সেকালের শিক্ষিত সমাজের মধ্যে শ্রীরামকৃষ্ণ সম্বন্ধে সাধারণত যে ধারণার আভাস পাই, তাহারই বিষয়ে কিছু বলিব। শ্রীরামকৃষ্ণ অপেক্ষা বিবেকানন্দের মূর্ত্তিই সাধারণের চক্ষে বৃহত্তর হইয়া বিরাজ করে; ভক্তগণের কথা স্বতন্ত্র, কিন্তু স্বামিজীর প্রবল ব্যক্তিত্বই যে সাধারণকে অধিক আকষ্ট করে, এবং শ্রীরামকৃষ্ণের মূর্ত্তি মন্দিরের অন্ধকারে দেববিগ্রহের মত কতকটা রহস্যাবৃত হইয়া আছে, ইহা অস্বীকার করা যায় না। যে শক্তি বজ্রকেও স্থিরমুষ্টিবদ্ধ করিয়া রাখে, অথচ দেখিলে মনে হয় সে মুষ্টি দৃঢ়বদ্ধ নয়, সে যে কত বড় শক্তি, তাহা আমরা ধারণাও করিতে পারি না। আমরা জানি, বিবেকানন্দ শ্রীরামকৃষ্ণের শিষ্য—তাঁহারই বাণী তিনি প্রচার করিয়াছিলেন। তবু দুইজনে কি প্রভেদ! একজন—পুরুষ-সিংহ, জগতের মহত্তম মহাকাব্যের নায়ক হইবার উপযুক্ত; তাঁহার চক্ষে জ্বলদর্চ্চি, কণ্ঠে পাঞ্চজন্য। আর একজন শান্ত, আনন্দময়; নেত্র ভাবস্তিমিত, অর্দ্ধনিমীলিত—অধরে করুণার সুধাহাস্য-জ্যোতি; মৃদুকণ্ঠ, স্খলিতবাক্! উভয়ের প্রকৃতির এই পার্থক্যের কথা মঃ রোলাঁ বড় সুন্দর করিয়া বলিয়াছেন। তাঁহার মতে—

 The great disciple was both physically and morally his (Ramakrishna’s) direct antithesis....The Paramahamsa the Indian Swan—rested his great white wings on the sapphire lake of eternity, beyond the veil of tumultuous days.... Vivekananda could only attain his heights by sudden flights amid tempests.... Even in moments of rest upon its bosom the sails of his ship were filled with every wind that blew. Earthly cries, the sufferings of the ages, fluttered around him like a flight of famished gulls.—The Life of Vivakananda. P. 4.

 এখানে গুরু ও শিষ্যের মধ্যে প্রকৃতিগত যে বৈষম্যের উল্লেখ রহিয়াছে তাহা যথার্থ হইলেও, এই উক্তির মধ্যে আর একটি অর্থ রহিয়াছে, এবং তাহা সুস্পষ্ট। মঃ রোলাঁ পরমহংসদেবকে এই মর্ত্ত্যজীবনের অবিদ্যাসম্ভূত ঝড়ঝঞ্ঝার বহু ঊর্দ্ধে, নীলকান্ত অমৃতহ্রদের উপরে, তাঁহার বৃহৎ শুভ্রপক্ষ বিস্তার করিয়া ভূমানন্দে বিভোর থাকিতে দেখিয়াছেন; অপর পক্ষে, শিষ্য বিবেকানন্দ পৃথিবীর ঝড়ঝঞ্ঝা বুকে করিয়া আর্ত্তত্রাণ-ব্রতে আত্মোৎসর্গ করিয়াছিলেন বলিয়া তাঁহাকে তাঁহার গুরুর ‘direct antithesis’ বা সম্পূর্ণ বিপরীত প্রকৃতি বলিয়া ধারণা করিয়াছেন। আমাদের দেশের শিক্ষিত সাধারণও এ কথায় সায় দিবে। একজন সম্বন্ধে মঃ রোঁলা বলিতেছেন—“his life had been spent in the serene fulness of the cosmic joy”; আর একজন জীবনে বিশ্রাম চান নাই— “He was energy personified and action was his message to man”। এই দুই চরিত্রের কোনটি আধুনিক মানুষের শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা অধিক অর্জ্জন করিবে, তাহা অনুমান করা দুরূহ নয়। কিন্তু গুরু ও শিষ্যের মধ্যে যে প্রভেদ তাহা যদি এইরূপই হয়, তাহা হইলে শিষ্য প্রচারিত গুরুর সেই বাণীও অর্থহীন হইয়া পড়ে। অতএব এই উক্তি, বা সাধারণের এই ধারণা কি অর্থে কতখানি সত্য, তাহারই আলোচনা করিব।

 শ্রীরামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের কাহিনী যাঁহারা পড়িয়াছেন তাঁহারা জানেন, এমনই একটি শিষ্য লাভ করিবার জন্য একদা শ্রীরামকৃষ্ণ কিরূপ আকুল হইয়াছিলেন। নরেন্দ্রকেই—এই antithesis-কেই—তাঁহার প্রয়োজন ছিল, এবং তাহাকে লাভ করা সহজ হয় নাই। ঘোরতর জ্ঞানপিপাসা ও তত্ত্বজিজ্ঞাসার সঙ্গে নরেন্দ্রের প্রকৃতিতে ছিল দুর্জয় স্বাতন্ত্র্য-কামনা। এ প্রকৃতি আমাদের দেশে বড় ভয়ের কারণ, ইহারাই অবশেষে সর্ব্বত্যাগ করিয়া দুর্গম পথে অন্তর্দ্ধান করে; ইহারাই স্নেহ প্রেম মমতার সকল মিনতি অগ্রাহ্য করিয়া সেইখানে প্রয়াণ করিতে চায়, যেখানে আছে, মঃ রোলাঁর ভাষায়—“the sapphire lake of eternity beyond the veil of tumultuous days”। তরুণ নরেন্দ্রকে দেখিবামাত্র শ্রীরামকৃষ্ণ তাহা বুঝিয়াছিলেন, তাহার ললাটের সেই শৈব-দীপ্তি তাঁহাকে আশান্বিত করিয়াছিল—সেই তেজকে তিনি নিজ করপুটে ধারণ করিয়া জগতের হিতার্থে নিয়োগ করিতে চাহিয়াছিলেন। ভাস্কর যেমন তাহার স্বপ্নকে রূপ দিবার জন্য সুদৃশ্য ও সুদৃঢ় পাষাণ-ফলক খুঁজিয়া বেড়ায়, এবং মনোগত মূর্ত্তির সহিত অবয়ব ও আয়তন মিলিলে, আনন্দের সীমা থাকে না—শ্রীরামকৃষ্ণ নরেন্দ্রকে পাইয়া তেমনই আশ্বস্ত হইয়াছিলেন। কঠিন প্রস্তর যেমন ছেদনীকে প্রতি পদে প্রতিহত করিয়া লাবণ্যের কোমলতা অর্জ্জন করে—বিবেকানন্দও গুরুর হাতে তেমনই ভাবে গড়িয়া উঠিয়াছিলেন। তিনি সহজে শ্রীরামকৃষ্ণের নিকটে আত্মসমর্পণ করেন নাই। মঃ রোঁলা তাঁহার যে অন্তর্দ্বন্দ্বের কথা বার বার উল্লেখ করিয়াছেন—সে ঝড় তুলিয়াছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ; সে ঝড় ধারণ করিবার উপযুক্ত মহাসাগর তিনি এই শিষ্যের মধ্যে চাক্ষুষ করিয়াছিলেন।

 গুরুশিষ্যের মধ্যে সেই সংগ্রামের কথা এবং সেই সংগ্রামে শিষ্যের পরাজয়, আত্মদান ও আত্মাহুতির মর্ম্ম যে না বুঝিয়াছে, সে এই মহানাটকের অপূর্ব্ব রসাস্বাদনে বঞ্চিত হইয়াছে। নরেন্দ্র প্রথমে আর কোনও কথা শুনিবে না, কেবল জানিতে চায়—তিনি সেই ‘বস্তু’ দেখিয়াছেন ও দেখাইতে পারেন কি না! যখন আর সংশয় রহিল না যে, এই নিরক্ষর অর্দ্ধোন্মাদ ব্রাহ্মণ সত্যই সেই মহাধনে ধনী, তখন আরও বিস্ময়ের কারণ হইল এই যে, জ্ঞান-অজ্ঞানের পারে যে পৌঁছিয়াছে সে আবার কিসের আকাঙ্ক্ষায় আকুল হৃদয়ে সাশ্রুনয়নে কি খুঁজিয়া বেড়ায়? পরব্যোমে স্থিত চিদ্‌ঘন আনন্দ-সত্তার আস্বাদন লাভ করিয়াও সে আবার কথা কয়!—তাহাকেও তুচ্ছ করিয়া মানুষের সঙ্গ চায়! এত বড় ত্যাগ ত্যাগাভিমানী নরেন্দ্রও কল্পনা করে নাই; ভারতের অতীত মহাপুরুষগণের মধ্যে, কৃষ্ণ বুদ্ধ চৈতন্যের মধ্যেও, ত্যাগের এ আদর্শ তাহার চোখে পড়ে নাই। আত্মযোগ-সাধনায় যে সিদ্ধ, যে জ্ঞানমার্গী, অদ্বৈতের উপাসক, তাহার একি মতিবিভ্রম!—সে এই বহুকে, এই সৃষ্টিকে, এই মায়া-স্বপ্নের ছায়াবুদ্বুদ-রাশিকে এমন করিয়া আগুলিয়া রাখিতে চায় কেন? নরেন্দ্র বুঝিতে পারে না, কেবল দেখে। এই বিস্ময় হইতেই তাহার প্রাণে যে দ্বন্দ্বের সূত্রপাত হইল, তাহারই পরিণামে নরেন্দ্রের বিবেকানন্দরূপে জন্মান্তর ঘটিল। ক্রমে জ্ঞানীশ্রেষ্ঠ শ্রীরামকৃষ্ণের এই দুর্ব্বলতাকে সে আর এক চক্ষে দেখিতে লাগিল, এবং পরিশেষে, যে প্রেম জ্ঞানেরই পরম পরিণাম, যে প্রেম একই কালে আত্মোৎসর্গ ও আত্মোপলব্ধির পরাকাষ্ঠা—যাহার বিহনে জ্ঞানের ‘সচ্চিদ্’ অসম্পূর্ণ, নীরস—‘আনন্দ’ একটা তত্ত্বগত শূন্যবাদ মাত্র—সেই মহাপ্রেমের পদতলে শিষ্য আপনাকে লুটাইয়া দিল। শ্রীরামকৃষ্ণের ইষ্টদেবতা ‘কালী’কে তিনি প্রথমে বুঝিতে চাহেন নাই; বৈষ্ণবের সাধন-বিগ্রহ রাধার মত, শ্রীরামকৃষ্ণের নব ব্রহ্ম-সাধনার সেই সাধন-বিগ্রহ—যাহাকে তিনি স্বীয় উপলব্ধির অতল হইতে উদ্ধার করিয়া নবরূপে প্রতিষ্ঠিত করিয়াছিলেন—সেই ‘কালী’কে তিনি আদৌ স্বীকার করেন নাই। এই প্রসঙ্গে ভগিনী নিবেদিতাকে তিনি বলিয়াছিলেন—

 How I used to hate Kali and all her ways! That was the ground of my six years’ fight—that I would not accept Her. But I had to accept Her at last!

—এ পরাজয় ঘটিল কেমন করিয়া? তিনি নিজেই তাহা বলিতেছেন।—

 Ramakrishna Paramahamsa dedicated me to Her. ...I loved him, you see, and that was what held me. I saw his marvellous purity... I felt his wonderful love.... His greatness had not dawned on me then. The Master as I saw Him. P. 214.

—‘I felt his wonderful love’—ইহাই আসল কথা। গুরুর নিকটে ইহাই তাঁহার প্রথম ও প্রধান দীক্ষালাভ।

দ্বিতীয় প্রসঙ্গ—বিবেকানন্দ

 ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভ হইতেই ভাবপ্রবণ বাঙালীর চিত্তে পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞান উগ্র মদিরার মত সঞ্চারিত হইতেছিল, এবং ক্রমশ উহার বিষক্রিয়াই প্রবল হইয়া উঠিল। আশ্চর্য্যের বিষয়, শতাব্দীর শেষে, যখন সেই বিষের প্রভাব প্রায় চরমে উঠিয়াছে, তখন এক বাঙালী সন্তানের অপরিমেয় প্রাণশক্তি ও সর্ব্বগ্রাসী মনীষা তাহাকে হজম করিয়া, সেই বিধর্ম্মের বিষকে স্বধর্ম্মের রসায়নে শোধন করিয়া সঞ্জীবনী সুধারসে পরিণত করিল—বিবেকানন্দের জীবনে সেই শক্তির স্ফুরণ হইল কেমন করিয়া তাহাই আমরা এখানে প্রত্যক্ষ করিতেছি। বুদ্ধিমান বিজেতা জাতির বিষয়-জ্ঞান ও কূটনীতির সাফল্যদর্শনে যে পরধর্ম্মপ্রীতি, ও তৎসহ নবলব্ধ বিদ্যার যে অভিমান, তাহাই বাঙালীকে আত্মভ্রষ্ট করিতেছিল, এবং স্বাধীন যুক্তিবাদ বা বিবেকের ছদ্মবেশে যে অতিশয় স্বার্থপর অথচ সুকল্পিত ব্যক্তি-ধর্ম্ম সমাজে এক ভয়াবহ আদর্শকে উদ্ধত করিয়া তুলিতেছিল— বিবেকানন্দও প্রথম বয়সে সেই আদর্শে আকৃষ্ট হইয়াছিলেন। ইহাও বিশ্বাস করি যে, শেষ পর্য্যন্ত তিনিও বিজয়কৃষ্ণের মত এই ঘূর্ণাবর্ত্ত হইতে দূরে নিক্ষিপ্ত হইতেন—সেই অতুলনীয় হৃদয়-বল ও কর্ম্মশক্তি শিলাময় শিবত্বে নির্ব্বাণ লাভ করিত, ইস্পাত আবার খনিগর্ভে লুকাইত। কিন্তু ইস্পাত আগুনের মুখে পড়িল—তাহার প্রকৃতির মধ্যে এমন কিছু মিশিয়া গেল যাহাতে জগতের লৌহশৃঙ্খল ছেদন করিবার মত একখানি সুতীক্ষ্ণ আয়ুধ নির্ম্মাণ করা সম্ভব হইল। সে যুগের সেই তথাকথিত উচ্চ-আদর্শে-লুব্ধ অথচ নিরতিশয় অতৃপ্ত, শতাব্দীব্যাপী মন্থনের শেষে মন্থনোদ্ভূত বিষপানে কাতর—নবযুগের এই নচিকেতা—মৃত্যুর মুখে অমৃতের বাণী শুনিতে চাহিয়াছিল; কিন্তু মৃত্যুপুরে—সংসারের বাহিরে—তাহাকে যাইতে হয় নাই; জীবনের পথেই সে তাহাকে শরীরীরূপে প্রত্যক্ষ করিয়াছিল। কেমন করিয়া তাহার সেই উদ্ধত প্রশ্ন স্তম্ভিত হইয়াছিল, উত্তরকালে তাহাই স্মরণ করিয়া স্বামিজী বলিয়াছিলেন— “I felt his wonderful love”। মঃ রোলাঁ যে বলিয়াছেন—

 The sails of his ship were filled with every wind that blew, earthly cries, the sufferings of the ages, fluttered round him like a flight of famished gulls.

—ইহা যে কি কারণে ঘটিয়াছিল, তাহা স্বামিজী নিজে যেমন জানিতেন আর কেহ তেমন জানিবে না।

 যাঁহারা বিবেকানন্দের জীবন-কাহিনী পড়িয়াছেন, তাঁহারা একটি বিষয় অবশ্যই লক্ষ্য করিয়াছেন—সে জীবনে সর্ব্বদাই যেন একটা বন্ধনবেদনা ছিল। সত্য বটে—মঃ রোলাঁর ভাষায়—

 His super-powerful body and too vast brain were the predestined battle-field for all the shocks of his storm-tossed soul. The present and the past, the East and the West, dream and action struggled for supremacy....And his days were numbered. Sixteen years passed between Ramakrishna’s death and that of his great disciple—years of conflagration. He was less than forty years of age when the athlete lay stretched upon the pyre.

—কিন্তু যে ঝড় ও আগুন তাঁহার জীবনের এক মুহূর্ত্তকে বিশ্রাম দেয় নাই—কর্ম্মের সেই অসীম উন্মাদনার মধ্যেই কত ব্যক্তি তাঁহার ভাবভঙ্গিতে একটা অন্তগূঢ় অনাসক্তি ও বাস্তব-বিস্মৃতির প্রয়াস লক্ষ্য করিয়াছেন। কাজ যেন আর কাহার—তাঁহার নয়! প্রাণ কেবলই ছুটি চাহিতেছে, আত্মার অন্তস্তলে “অকূল শান্তি, বিপুল বিরতি”র কামনাই জাগিতেছে। কিন্তু উপায় নাই; যেন কাহার প্রেমে তিনি বাঁধা পড়িয়াছেন, নিজ জীবনের পরমপুরুষার্থ তাঁহারই পদে নিবেদন করিয়াছেন। শিব ছিলেন তাঁহার ইষ্টদেবতা, সন্ন্যাস ছিল তাঁহার আজন্মের আদর্শ, নির্ব্বিকল্প সমাধির অমৃতরস ছিল তাঁহার একমাত্র লোভের বস্তু; কিন্তু এ সকলই তুচ্ছ করিয়া তিনি সেই উন্মাদ ব্রাহ্মণের প্রেমে আপনাকে বিকাইয়াছিলেন। সে যে কত বড় শক্তি—যে শক্তি এই পুরুষকে এমন করিয়া বাঁধিয়া রাখিয়া যাইতে পারে, তাহা হয়তো তিনিই জানিতেন, আমরা কল্পনা করিতেও পারি না। স্বামিজীর সেই কথা—“No, the thing that made me do it is a secret that will die with me”—এইখানে স্মরণযোগ্য। ইহার মধ্যে যে ইঙ্গিত রহিয়াছে, তাহার অর্থ আরও স্পষ্ট হয় যখন তাঁহারই মুখে শুনি—“And Ramakrishna made me over to her (Kali). Strange! He lived only two years after doing that and most of the time he was suffering.” (The Master as I saw Him. P. 215)—যেন শ্রীরামকৃষ্ণ নিজের সমস্ত শক্তি শিষ্যের ভিতরে ঢালিয়া দিয়াছিলেন—এ যেন একরূপ ‘পরকায় প্রবেশ’! শ্রীরামকৃষ্ণের মৃত্যু-সময়ে আমরা এইরূপ একটি ঘটনার কথা শুনিয়া থাকি—“আমি আমার সব তোমাকে দিলাম, আমি নিঃস্ব হইলাম” বলিয়া মহাপুরুষ কাঁদিয়া ফেলিয়াছিলেন। স্বামী বিবেকানন্দের জীবনে, তাঁহার সেই উদ্দাম অগ্নিবেগের অন্তরালে যে একটি বন্ধন-পীড়ার আভাস বারবার পাওয়া যায় ভগিনী নিবেদিতাও তাহা লক্ষ্য করিয়াছেন। তাঁহার গ্রন্থের এক স্থানে তিনি বলিতেছেন—

 It seemed almost as it were by some antagonistic power, that he was ‘bowled along from place to place being broken the while’, to use his own graphic phrase. “Oh, I know I have wandered over the whole earth”, he cried once, “but in India I have looked for nothing, save the cave in which to meditate!

 “রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ”-কাহিনীর এই প্রসঙ্গে আমার বক্তব্যের কথা পূর্ব্বেই বলিয়াছি। বিবেকানন্দের প্রকৃতি যে তাঁহার গুরু হইতে ভিন্ন তাহা সত্য, কিন্তু আরও সত্য এই যে, এই ভেদ সত্ত্বেও, তিনি গুরুরই বশ্যতা স্বীকার করিয়াছিলেন—তিনি যে মহাব্রত গ্রহণ করিয়াছিলেন তাহা গুরুরই আদেশে, এবং শেষ পর্য্যন্ত গুরুই যেন তাঁহাকে আচ্ছন্ন করিয়া রাখিয়াছিলেন। নরেন্দ্র দত্তের যাহা কিছু তাহা যেন শ্রীরামকৃষ্ণের দ্বারা আচ্ছন্ন হইয়াই জগতের সমক্ষে বিবেকানন্দরূপে আত্মপ্রকাশ করিয়াছিল। কারণ বিবেকানন্দ নামক যে মহাপুরুষের সাক্ষাৎ পরিচয় আমরা জগৎবাসী পাইয়াছি, তাহাতে পরমহংসদেব হইতে বিশিষ্ট একটি প্রকৃতির লক্ষণ থাকিলেও, সেই দ্বন্দ্বকে অর্থাৎ নিজের বিরুদ্ধ আদর্শকে স্বামিজী যেন সর্ব্বদা সাবধানে দমন করিয়াছিলেন; বরং, সেই দ্বন্দ্ব সম্বন্ধে সজ্ঞান ছিলেন বলিয়াই গুরুর আদর্শকেই সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত করিবার জন্য নিজ দেহ-মন-প্রাণের সকল শক্তি এমন করিয়া তাহাতে সমর্পণ করিয়াছিলেন; এই দ্বন্দ্বই যেন তাঁহার শক্তি-স্ফুরণের সহায়তা করিয়াছিল। মঃ রোলাঁ তাঁহার গ্রন্থে স্বামিজীর একখানি পত্র উদ্ধৃত করিয়াছেন— একবার অতিশয় ক্লান্ত অবসন্ন অবস্থায়, সকল কর্ম্মের অবসান, পূর্ণ নির্ব্বাণ কামনা করিয়া স্বামিজী লিখিয়াছিলেন—

 Pray for me that my work stops for ever and my whole soul be absorbed in the Mother....The battles are lost and won! I have bundled my things and am waiting for the great Deliverer. Shiva, O Shiva, carry my boat to the other shore!...That is my true nature! Works and activities, doing good and so forth are all superimpositions....Bonds are breaking, love dying, work becoming tasteless; the glamour is off life....The old man is gone for ever. The guide, the Guru, the leader has passed away.

 দেখা যাইতেছে শ্রীরামকৃষ্ণের প্রবল প্রভাবও তাঁহার সেই স্বকীয় প্রকৃতিকে সম্পূর্ণ জয় করিতে পারে নাই। গুরুর মৃত্যুর পরেও, তাঁহার দেহের সেই অলৌকিক তড়িৎ-স্পর্শ লাভের পরেও, স্বামিজী পওহারী বাবার নিকট দীক্ষাগ্রহণ করিতে উদ্যত হইয়াছিলেন। মঃ রোলাঁ ইহার উল্লেখ করিয়াছেন—

 The latter (Pavhari Baba) would have satisfied his passion for the Divine gulf, wherein the individual}} soul renounces itself and is entirely absorbed without any thought of return....Naren was for twenty-one days within an ace of yielding. But for twenty-one nights the vision of Ramakrishna came to draw him back. Finally after an inner struggle of the utmost intensity, whose viscissitudes he always consistently refused to reveal, he made his choice for ever. He chose the service of God in man.

 সেই গুরুতর আধ্যাত্মিক সঙ্কটে শ্রীরামকৃষ্ণই তাঁহাকে রক্ষা করিয়াছিলেন; তিনি আত্মসাধনা করিয়া ত্রৈলঙ্গ স্বামী হইবেন, না, জগতের সেবা করিয়া স্বামী বিবেকানন্দ হইবেন—সে প্রশ্নের মীমাংসা কাহার দ্বারা হইয়াছিল, এই ঘটনাই তাহার সাক্ষ্য দিতেছে। ক্রমাগত একুশ রাত্রি ধরিয়া স্বপ্নে গুরুর সেই করুণ মূর্ত্তি দেখিয়া তিনি অবশেষে সেই মহাপ্রেমিকের পদতলে জন্মের মত আত্মনিবেদন করিয়াছিলেন।

 নরেন্দ্র কেমন করিয়া বিবেকানন্দ হইলেন সে আলোচনা সংক্ষেপে করিলাম। মঃ রোলাঁ বিবেকানন্দকে তাঁহার গুরুর ‘direct antithesis’ বলিয়াছেন তাহা সত্য; তাঁহার পূর্ব্বে ভগিনী নিবেদিতাও এই ধরনের কথা বলিয়াছেন, কিন্তু সেই ভেদের মধ্যেই অভেদ-তত্ত্বের —‘শ্রীরামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ’রূপ যুগ্মসত্তার—কথঞ্চিৎ উপলব্ধি না হইলে, আমরা শ্রীরামকৃষ্ণের বাণী হৃদয়ঙ্গম করিতে পারিব না। বিবেকানন্দের সেই বিপরীত প্রকৃতিকে উপাদানরূপে গ্রহণ করিয়া অবতারকল্প মহাপুরুষ ‘আত্মানং সৃজাম্যহং’—সঙ্কল্প করিয়াছিলেন। ধ্যানী মহাপুরুষের প্রকৃতিতে প্রেমের যে উৎকণ্ঠা জাগিয়াছিল তাহার উপযুক্ত দেহ-মন তিনি পাইয়াছিলেন বিবেকানন্দে। আবার যুগধর্ম্মের প্রবল প্রভাব যাহার প্রকৃতিগত জ্ঞান-পিপাসা ও আত্মোপলব্ধির আকাঙ্ক্ষাকে এমন করিয়া উদ্বুদ্ধ করিলেও, ‘শান্তং শিবং অদ্বৈতং’কে লাভ করিবার জন্যই যে অতিশয় উৎকণ্ঠিত হইয়াছিল, সেও সেই মহাপুরুষের মধ্যে তাহা প্রত্যক্ষ করিয়া তাঁহার সেবায় নিজের সকল শক্তি উৎসর্গ করিয়াছিল। উভয়ের প্রকৃতিতে যে প্রভেদ লক্ষ্য করা যায়, তাহার উল্লেখ ভগিনী নিবেদিতা ও মঃ রোলাঁ উভয়েই একটু বিশেষভাবে করিয়াছেন। ভগিনী নিবেদিতা বলিয়াছেন—

 Sri Ramkrishna had been, as the Swami himself said once of him, “like a flower” living apart in the garden of a temple, simple, half naked, orthodox, the ideal of the old time in India, suddenly burst into bloom, in a world that had thought to dismiss its very memory. It was at once the greatness and the tragedy of my own master’s life that he was not of this type. His was the modern mind in its completeness. In his consciousness, the ancient light of the mood in which man comes face to face with God might shine, but it shone on all those questions and all those puzzles which are present to the thinkers and workers of the modern world.—The Master as I saw Him. Pp. 124-25.

 অর্থাৎ, শ্রীরামকৄষ্ণ যেন এই চিন্তাব্যাধিগ্রস্ত, শঙ্কাসংশয়ক্লিষ্ট আধুনিক সমাজে নিরুদ্বেগ নিশ্চিন্ত আনন্দের উৎসস্বরূপ ছিলেন—একটি ফুলের মত তিনি এই কণ্টকারণ্যে ফুটিয়া উঠিয়াছিলেন; তিনি ছিলেন আত্মানন্দী পুরুষ, বাহিরের অন্ধকার তাঁহার অন্তর্গহনের জ্যোতিঃশিখা ম্লান করিতে পারে নাই। সেই আলোকে বিবেকানন্দও চক্ষু মেলিয়াছিলেন—কিন্তু কেবল চক্ষে আলো নয়, এযুগের অনলকুণ্ড তাঁহার বক্ষে অহরহ জ্বলিয়াছিল—তাঁহার চক্ষের সে আলোক জগতের সকল সমস্যা ও সংশয়সঙ্কটের উপর প্রতিফলিত হইয়াছিল। মঃ রোলার কথাগুলি পূর্ব্বে উদ্ধৃত করিয়াছি। উভয়েই গুরুশিষ্যের মধ্যে এই প্রভেদ লক্ষ্য করিয়াছেন, কিন্তু কেহই বুঝিতে পারেন নাই যে, গুরুশিষ্যে এখানে প্রভেদ নাই। একজন জীবনের ভিতর দিয়া, বাস্তব অভিজ্ঞতার ভাবনাবেদনা দিয়া যাহা বুঝিয়াছিলেন এবং বুঝিয়া প্রচণ্ড হৃদয়াবেগে অধীর হইয়া কর্ম্মপ্রবাহে ঝাঁপাইয়া পড়িয়াছিলেন—আর একজন ব্রহ্মসাক্ষাৎকারের ফলেই তাহা উপলব্ধি করিয়াছিলেন, সে উপলব্ধি আরও গূঢ়, আরও গভীর; এবং গভীর ও সীমাহীন বলিয়াই তাহা কোন কর্ম্মবিধিকে আশ্রয় করিতে পারে নাই; সেই জন্যই একটি নদীপ্রবাহে নিজের সেই তটহীন প্রেমকে প্রবাহিত করিবার জন্য তিনি ব্যাকুল হইয়াছিলেন। নরেন্দ্রের উদ্ধত জ্ঞানাভিমান ও প্রচণ্ড স্বাতন্ত্র্য স্পৃহা তাঁহার বড় ভাল লাগিয়াছিল; কিন্তু তিনি আপনার কথাটি তাহাকে বুঝাইতে পারিতেছেন না দেখিয়া বলিয়াছিলেন—“নরেন যেদিন, জগতের দুঃখ-দারিদ্র্য স্বচক্ষে দেখিবে সেইদিন উহার সব অভিমান চূর্ণ হইবে, সারা প্রাণ অসীম করুণায় গলিয়া যাইবে।” ইহারই উল্লেখ করিয়া মঃ রোলাঁ বলিতেছেন—

 This meeting with suffering and human misery...I was to be the flint upon the steel, whence a spark would fly to set the whole soul on fire. And with this as its foundation-stone, pride, ambition and love, faith, science and action, all his powers and all his desires were thrown into the mission of human service and united into one single flame.—The Life of Vivekananda. Pp. 10-11.

 শ্রীরামকৃষ্ণের ঐ ভবিষ্যদ্বাণী এবং পরে তাহার এই সার্থকতা কি নিঃসংশয়ে প্রমাণ করে না যে, বিবেকানন্দের জীবনে গুরুর অভিপ্রায়ই পূর্ণ হইয়াছিল? অতঃপর ভগিনী নিবেদিতার মুখে যখন শুনি—

 That sudden revelation of the misery and struggle of humanity as a whole, which has been the first result of the limelight irradiation of facts by the organisation of knowldge, had been made to him also, as to the European mind. We know the verdict that Europe has passed on it all. Our art, our science, our poetry, for the last sixty years or more, are filled with the voices of our despair. A world summed up into the growing satisfaction and vulgarity of privilege, and the growing sadness and pain of the dispossessed; and a will of man too noble and high to condone the evil, yet too feeble to avert or arrest it, this is the spectacle of which our greatest minds are aware. Reluctant, wringing her hands, it is true, yet seeing no other way, the culture of the West can but stand and cry, “To him that hath shall be given, and from him that hath not shall be taken away even that which he hath. Vae Victis! Woe to the vanquished!”

 Is this also the verdict of the eastern wisdom? If so, what hope is there for humanity? I find in my master’s life an answer to this question.—The Master as I saw Him. Pp. 125-26.

—তখন বিশ্বাস না হইয়া পারে না যে, বিবেকানন্দ-রূপ অশ্বত্থবৃক্ষের বীজ তাঁহার গুরু শ্রীরামকৃষ্ণের চেতনা-গহনেই নিহিত ছিল। ভাবনা চিন্তা, আবেগ ও কল্পনা, ভূয়োদর্শন ও মনীষা, এই সকলের সাহায্যে একজনের জীবনে যে বাণীকে আমরা বীরবীর্য্য ও কর্ম্মশক্তিতে মূর্ত্ত হইতে দেখি, সেই বাণীর এক অলৌকিক অপৌরুষেয় অভিব্যক্তি আর একজনের মধ্যে পূর্ব্বেই হইয়াছিল। বিবেকানন্দের পৌরুষ, প্রতিভা ও মহাপ্রাণতার যে প্রত্যক্ষ পরিচয়ে আমরা মুগ্ধ হই, তাহার মূল উৎস যিনি, তিনি পাণ্ডিত্য, প্রতিভা বা মনীষার কোন পরিচয় দেন নাই; অথবা, আমরা যাহাকে কর্ম্মানুষ্ঠান বলি তাহাও করেন নাই। তাই আধুনিক শিক্ষিত সমাজ গুরু ও শিষ্যের মধ্যে একটি ভেদরেখা টানিবেই। কিন্তু সেই ভেদ রক্ষা করা সম্ভব কি না, আমি এ প্রবন্ধে তাহারই কিঞ্চিৎ আলোচনা করিলাম। উভয়ের প্রকৃতিগত পার্থক্য কেহই অস্বীকার করিবেন না, কিন্তু এই পার্থক্য সত্ত্বেও ‘শ্রীরামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ’ একটি অখণ্ড অভিন্ন তত্ত্ব হইয়া আছে। মানুষের দৃষ্টি—সে যত বড় মানুষ‍ই হউক—পূর্ণ নহে; জ্ঞান বা ভক্তি দুইয়ের কোনটাই শেষ পর্য্যন্ত মানুষের স্বাভাবিক হৃদয়-দৌর্ব্বল্য হইতে মুক্ত নহে। তাই ভগিনী নিবেদিতার মত মহীয়সী মহিলাও তাঁহার নিজের গুরুর জন্য একটু পৃথক্ গৌরব দাবি করিয়াছেন—

 I see in him the heir to the spiritual discoveries and religious struggles of innumerable teachers and saints in the past of India and the world, and at the same time the pioneer and prophet of a new and future order of development.

 কে বলিবে এ গৌরব তাঁহার গুরু বিবেকানন্দের প্রাপ্য নয়? কিন্তু বিবেকানন্দ কি শ্রীরামকৃষ্ণ হইতে স্বতন্ত্র? তবে তাঁহাকে আড়ালে রাখিলেন কেন? বুঝি তাঁহারও দোষ নাই; গুরুশিষ্যের এই সম্বন্ধ সত্যই রহস্যময়, আরও রহস্য এই যে, সে সম্বন্ধ বুঝিতে পারিলেও বারবার ভুল হয়—বিবেকানন্দের ব্যক্তিত্ব এত প্রবল যে, মানুষ আমরা এইরূপ প্রকট ব্যক্তিত্বের মহিমায় অভিভূত না হইয়া পারি না।

 সে সম্বন্ধের কথা শ্রীরামকৃষ্ণ নিজেই একবার এক অপরূপ স্বপ্নভাষায় বিবৃত করিয়াছিলেন। মিষ্টিসিজ্‌ম কাহাকে বলে জানি, কিন্তু মিষ্টিকের অনুভূতি কেমন তাহা জানি না। তথাপি এই কথাগুলিতে যে তত্ত্ব যেভাবে প্রকাশ পাইয়াছে তাহাই যদি মিষ্টিকের রীতি হয়, তবে বলিব, অপরোক্ষ অনুভূতির যে সত্য তাহা প্রকাশ করিবার ইহাই প্রকৃষ্ট রীতি। এ রীতি দার্শনিক বা সাহিত্যিক রীতি নয়—এমন কি, ভাবকে রূপ দিবার যে বিশিষ্ট বাক্-পদ্ধতিকে আমরা কাব্য বলিয়া থাকি ইহা সেই কবিকর্ম্মও নহে। কবির ভাষায় ইহারই নাম—‘সৃষ্টি যেন স্বপ্নে চায় কথা কহিবারে’, অথচ সে কথা ‘অব্যক্ত ধ্বনির পুঞ্জ’ নয়—অব্যক্তকে বাক্যগোচর করিয়াছে। এ প্রসঙ্গে আমি এ পর্য্যন্ত যত কথা বলিয়াছি শ্রীরামকৃষ্ণের এই উক্তিই তাহার শেষ কথা, তাই ইহা দ্বারাই প্রবন্ধের উপসংহার করিব। এখানেও আমি অনুবাদের অনুবাদ দিলাম; দেখা যাইবে যে, শত অনুবাদেও এই দিব্য বারতার দীপ্তি এতটুকু স্নান হয় নাই। নরেন্দ্রের সহিত প্রথম সাক্ষাতের উল্লেখ করিয়া শ্রীরামকৃষ্ণ বলিয়াছিলেন—

 একদিন সমাধির অবস্থায় আমার মন একটি আলোকময় পথ ধরিয়া ঊর্দ্ধ হইতে ঊর্দ্ধতর লোকে উঠিতে লাগিল। নক্ষত্রলোক পার হইয়া, সুক্ষ্মতর বিজ্ঞানলোক পার হইয়া আমি উঠিতে লাগিলাম, পথের দুই পার্শ্বে যত দেবদেবীর মানস-মূর্ত্তি দেখিতে দেখিতে এমন দূরতম স্থানে পৌছিলাম যেখানে একটি জ্যোতির রেখা দ্বারা দ্বৈত ও অদ্বৈতের সীমা চিহ্নিত রহিয়াছে। সে সীমাও পার হইয়া আমি অখণ্ডের ঘরে পৌঁছিলাম, দেবতারাও সেখানে দৃষ্টিপাত করিতে সাহস করেন না। কিন্তু পরমুহূর্ত্তেই দেখিলাম সেই জ্যোতির্লোকে সাত জন ঋষি সমাধিস্থ হইয়া আছেন। তাঁহাদিগকে দেখিলে মনে হয়, জ্ঞানে প্রেমে ত্যাগে ও শুচিতায় তাঁহাদের সমকক্ষ কেহ নাই। বিস্ময়ে বিহ্বল হইয়া আমি তাঁহাদের মাহাত্ম্যের কথা ভাবিতেছি, এমন সময়ে দেখিলাম, সেই নিস্তরঙ্গ প্রভারাশির এক অংশ জমাট হইয়া একটি দেবশিশুর আকার ধারণ করিল। অতঃপর সেই শিশু সপ্তঋষির একজনের গলায় তাহার সুন্দর বাহু দুইটি জড়াইয়া অমৃত-নিস্যন্দী কলকণ্ঠে তাঁহার ধ্যানভঙ্গ করিতে চাহিল; তাহার মোহন স্পর্শে ঋষির নিস্পন্দভাব ঘুচিল, তিনি অর্দ্ধনিমীলিত নেত্রে সেই শিশুর অপূর্ব্ব মুখকান্তি নিরীক্ষণ করিতে লাগিলেন। ঋষির সেই ভাববিভোর দৃষ্টি দেখিয়া মনে হইল, ঐ শিশুই যেন তাঁহার বক্ষের মণি। তখন শিশুও পরম আহ্লাদে তাঁহাকে বলিল—“আমি যাইতেছি, তুমিও আইস।” ঋষি বাক্যস্ফূর্ত্তি করিলেন না, কিন্তু তাঁহার সস্নেহদৃষ্টি সম্মতিজ্ঞাপন করিল, এবং শিশুর পানে চাহিয়া থাকিতেই তিনি পুনঃ সমাধিমগ্ন হইলেন। আমি সবিস্ময়ে দেখিলাম তাঁহার অঙ্গ হইতে একটি অংশ বিচ্ছিন্ন হইয়া আলোকশিখারূপে পৃথিবীতে অবতীর্ণ হইতেছে। নরেনকে দেখিবামাত্র আমি তাহাকে সেই ঋষি বলিয়া চিনিয়াছিলাম।

 এই অপরূপ কাহিনীর মধ্যে শ্রীরামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ-তত্ত্বের পরমরহস্য নিহিত রহিয়াছে। ইহার ব্যাখ্যা অসম্ভব—অর্থে নয়, ভাবে তাহা হৃদয়ঙ্গম করিতে হয়। কিন্তু ইহা হইতেই অনেকের মনে হইয়াছে, এই গাঢ় নিদ্রার গূঢ় স্বপ্নে শ্রীরামকৃষ্ণ শিষ্যের যে পরিচয় পাইয়াছিলেন, তাহাতে তিনি যেন শিষ্যকেই তাঁহার গুরু বলিয়া বুঝিয়াছিলেন। এমন ভুল আর হইতে পারে না। বিবেকানন্দ যদি সেই ঋষি হন, এবং শ্রীরামকৃষ্ণকেই সেই শিশু বলিয়া বুঝিতে হয়, তাহা হইলে এই স্বপ্ননাট্যের নায়ক যে সেই শিশু তাহাতে সন্দেহ নাই। আরও দেখা যাইতেছে, সেই ঋষি মহাজ্ঞানী, আর সেই শিশু প্রেমের অমৃত-পুত্তলি,—জ্ঞানকে প্রেম স্পর্শ করিতেছে এবং সেই স্পর্শে নিস্পন্দ সাগর রসতরঙ্গে উদ্বেল হইয়া উঠিতেছে, যাহা চিদ্‌ঘন তাহাই আনন্দে বিগলিত হইতেছে। ইহার মধ্যে কে বড়, কে ছোট, অথবা কাহাকে বাদ দিয়া কে স্বয়ম্পূর্ণ, তাহা নির্ণয় করা দুঃসাধ্য। জ্ঞান সেই প্রেমকে তাহার অন্তরের ধন বলিয়া চিনিতে পারে, এবং তাহাতেই যেন গভীরতর আত্মোপলব্ধির আবেশে পুনরায় সমাধি-মগ্ন হয়। এই সমাধি-স্বপ্নে শ্রীরামকৃষ্ণ আপনাকে আপনি দেখিতেছেন, অথচ সে দেখার মধ্যে অহংজ্ঞান নাই। এমন আত্মহারা আত্মপরিচয়-দান মানুষের কাহিনীতে দুর্লভ। আপনারই গৌরব অপরে সমর্পিত হইতেছে—প্রেম শিশুরূপে জ্ঞানের কণ্ঠলগ্ন হইতেছে; তাহাতে যেমন আত্মাভিমান নাই, তেমনি আত্মসঙ্কোচও নাই। ‘আমি যাইতেছি তুমিও আইস’—ইহা মিনতি না আদেশ? মানুষের ভাষায় তাহা বুঝানো যায় না।

 সেই ঊর্দ্ধলোকের দৃশ্য নিম্নে পৃথ্বীতলেও অভিনীত হইয়াছিল। নরেন্দ্র এখানেও সেই শিশুর প্রতি তেমনই মুগ্ধনেত্রে চাহিয়াছিলেন। সেই মুখ তিনি জীবনে বিস্মৃত হইতে পারেন নাই, এবং বারংবার বলিয়াছিলেন—‘I felt his wonderful love.’

 সেই শিশুর স্পর্শেই ক্ষণকালের জন্য ঋষির সমাধি ভঙ্গ হইয়াছিল; তারপর আবার সেই সমাধি!—কতকালের জন্য, কে জানে?

মাঘ, ১৩৪২