শেষ সপ্তক/চুয়াল্লিশ

চুয়াল্লিশ

আমার শেষবেলাকার ঘরখানি
বানিয়ে রেখে যাব মাটিতে,
তার নাম দেব শ্যামলী।
ও যখন পড়বে ভেঙে
সে হবে ঘুমিয়ে পড়ার মতাে,
মাটির কোলে মিশবে মাটি;
ভাঙা থামে নালিশ উঁচু ক'রে
বিরােধ করবে না ধরণীর সঙ্গে;
ফাটা দেয়ালের পাঁজর বের ক'রে
তার মধ্যে বাঁধতে দেবে না
মৃতদিনের প্রেতের বাসা।

সেই মাটিতে গাঁথব
আমার শেষ বাড়ির ভিত
যার মধ্যে সব বেদনার বিস্মৃতি,
সব কলঙ্কের মার্জনা,
যাতে সব বিকার সব বিদ্রুপকে
ঢেকে দেয় দূর্বাদলের স্নিগ্ধ সৌজন্যে-

যার মধ্যে শত শত শতাব্দীর
রক্তলােলুপ হিংস্র নির্ঘোষ
গেছে নিঃশব্দ হয়ে।

সেই মাটির ছাদের নীচে বসব আমি
রােজ সকালে শৈশবে যা ভরেছিল
আমার গাঁটবাঁধা চাদরের কোণা
এক-এক মুঠো চাঁপা আর বেল ফুলে,
মাঘের শেষে যার আমের বােল
দক্ষিণের হাওয়ায়
অলক্ষ্য দূরের দিকে ছড়িয়েছিল
ব্যথিত যৌবনের আমন্ত্রণ।

আমি ভালাে বেসেছি
বাংলাদেশের মেয়েকে
যে দেখায় সে আমার চোখ ভুলিয়েছে
তাতে আছে যেন এই মাটির শ্যামল অঞ্জন,
ওর কচি ধানের চিকন আভা।
তাদের কালাে চোখের করুণ মাধুরীর উপমা দেখেছি
ওই মাটির দিগন্তে
নীল বনসীমায় গােধূলির শেষ আলােটির
নিমীলনে।

প্রতিদিন আমার ঘরের সুপ্ত মাটি
সহজে উঠবে জেগে
ভোরবেলাকার সােনার কাঠির
প্রথম ছোঁওয়ায়;
তার চোখ-জুড়ানাে শ্যামলিমায়
স্মিত হাসি কোমল হয়ে ছড়িয়ে পড়বে
চৈত্ররাতের চাঁদের
নিদ্রাহারা মিতালিতে।

চিরদিন মাটি আমাকে ডেকেছে
পদ্মার ভাঙনলাগা
খাড়া পাড়ির বনঝাউবনে,
গাঙশালিকের হাজার খােপের বাসায়,
সর্ষে-তিসির দুইরঙা খেতে,
গ্রামের সরু বাঁকা পথের ধারে,
পুকুরের পাড়ির উপরে।

আমার দু চোখ ভ'রে
মাটি আমায় ডাক পাঠিয়েছে
শীতের ঘুঘুডাকা দুপুরবেলায়
রাঙা পথের ও পারে,
যেখানে শুকনাে ঘাসের হলদে মাঠে

চরে বেড়ায় দুটি-চারটি গােরু
নিরুৎসুক আলস্যে
লেজের ঘায়ে পিঠের মাছি তাড়িয়ে,
যেখানে সাথিবিহীন
তালগাছের মাথায়
সঙ্গ-উদাসীন নিভৃত চিলের বাসা।

আজ আমি তােমার ডাকে
ধরা দিয়েছি শেষ বেলায়।
এসেছি তােমার ক্ষমাস্নিগ্ধ বুকের কাছে,
যেখানে একদিন রেখেছিলে অহল্যাকে
নবদূর্বাশ্যামলের
করুণ পদস্পর্শে
চরম মুক্তি-জাগরণের প্রতীক্ষায়,
নব জীবনের বিস্মিত প্রভাতে।