শেষ সপ্তক/পঁয়তাল্লিশ

পঁয়তাল্লিশ

শ্রীযুক্ত প্রমথনাথ চৌধুরী
কল্যাণীয়েষু

তখন আমার আয়ুর তরণী
যৌবনের ঘাট গেছে পেরিয়ে।
যে-সব কাজ প্রবীণকে প্রাজ্ঞকে মানায়
তাই নিয়ে পাকা করছিলেম
পাকা চুলের মর্যাদা।

এমন সময়ে আমাকে ডাক দিলে
তােমার সবুজ-পত্রের আসরে।
আমার প্রাণে এনে দিলে পিছুডাক;
খবর দিলে,
নবীনের দরবারে আমার দুটি মেলে নি।
দ্বিধার মধ্যে মুখ ফিরালেম
পেরিয়ে-আসা পিছনের দিকে।
পর্যাপ্ত তারুণ্যের পরিপূর্ণ মূর্তি
দেখা দিল আমার চোখের সম্মুখে।

ভরা যৌবনের দিনেও
যৌবনের সংবাদ
এমন জোয়ারের বেগে এসে লাগে নি আমার লেখনীতে।
আমার মন বুঝল
যৌবনকে না ছাড়ালে
যৌবনকে যায় না পাওয়া।

আজ এসেছি জীবনের শেষ ঘাটে।
পুবের দিক থেকে হাওয়ায় আসে
পিছুডাক,
দাঁড়াই মুখ ফিরিয়ে।
আজ সামনে দেখা দিল
এ জন্মের সমস্তটা।

যাকে ছেড়ে এলেম
তাকেই নিচ্ছি চিনে।
সরে এসে দেখছি
আমার এত কালের সুখদুঃখের ওই সংসার,
আর তার সঙ্গে
সংসারকে পেরিয়ে কোন্ নিরুদ্দিষ্ট।
ঋষিকবি প্রাণপুরুষকে বলেছেন,
‘ভুবন সৃষ্টি করেছ

তােমার এক অর্ধেককে দিয়ে,
বাকি আধখানা কোথায়
তা কে জানে।'
সেই একটি আধখানা আমার মধ্যে আজ ঠেকেছে
আপন প্রান্তরেখায়;
দুই দিকে প্রসারিত দেখি দুই বিপুল নিঃশব্দ,
দুই বিরাট আধখানা-
তারই মাঝখানে দাঁড়িয়ে
শেষ কথা বলে যাব,
‘দুঃখ পেয়েছি অনেক,
কিন্তু ভালাে লেগেছে,
ভালাে বেসেছি।'