অদ্ভুত ফকির/নবম পরিচ্ছেদ

নবম পরিচ্ছেদ।

 আবদুল কাদের হঠাৎ গৌরীশঙ্কর ওরফে হরশঙ্করকে বন্দী করিতে দেখিয়া শুন্তিত হইল। জিজ্ঞাসা করিল, “হুজুর! আপনার কথা কিছুই বুঝিতে পারিলাম না। আপনি কেমন করিয়া জানিতে পারিলেন যে, ইনি গৌরীশঙ্কর নহেন—হরশঙ্কর। আর কিরূপেই বা স্থির করিলেন যে, হরশঙ্করই গৌরীশঙ্করকে হত্যা করিয়াছে?

 আবদুলের কথায় আমি অত্যন্ত বিরক্ত হইলাম। বলিলাম, “তোমার মত লোককে পুলিসের কার্য্যে নিযুক্ত করা সম্পূর্ণ অন্যায়। যাহারা ঘুষ লইয়া সত্য গোপন করিতে চেষ্টা করে, তাহাদের মত লোককে যত শীঘ্র পারা যায় এই কার্য্য হইতে বিদায় দেওয়া উচিত। তুমি ইতিপূর্ব্বে আমাকে বারম্বার তোমার বেতন বৃদ্ধির জন্য অনুরোধ করিয়াছিলে; কিন্তু এখন ভাবিয়া দেখ দেখি, তোমার বেতন বৃদ্ধি কি হ্রাস হওয়া উচিত। যাহা হউক, এ ক্ষেত্রে আমি তোমার কোন অপকার করিতে ইচ্ছা করি না। কিন্তু সাবধান, যদি ভবিষ্যতে আর কখনও তোমায় এরূপ কার্য্য করিতে দেখিতে পাই, তাহা হইলে আমি নিশ্চয়ই তোমায় দূর করিয়া দিব।”

 আবদুল আযর দ্বিরুক্তি করিল না। সে ঘাড় হেঁট করিয়া ছিল, লজ্জায় মাথা তুলিতে পারিল না।

 আমি তাহাকে তদস্থ দেখিয়া বন্দীর দিকে লক্ষ্য করিয়া বলিলাম, “হরশঙ্কর! তোমার বাহাদুরী আছে। তুমি পৈতৃক সম্পত্তি বা উত্তরাধিকারী হইবার জন্য যে উপায় অবলম্বন করিয়াছিলে, তাহা অতি চমৎকার। জানি না, অন্য কোন লোকের হাতে পড়িলে কি হইত। কিন্তু আমার মত লোকের চক্ষে ধূলি দিতে চেষ্টা করাই তোমার বাতুলের কার্য্য হইয়াছে। যখনই তুমি আমার নিকট ফকিরের মৃত্যুর কথা বলিয়াছ, তখন হইতেই তোমার উপর আমার সন্দেহ হইয়াছে। যে সকল কথা বলিয়াছ, তাহা নিশ্চয়ই শোকোদ্দীপক সন্দেহ নাই; কিন্তু সেই সেই কথা বলিলে লোকের মনে যেরূপ দুঃখের উদয় হওয়া উচিত অর্থাৎ সেই সকল কথা সত্য হইলে লোকে যেরূপ আন্তরিক বলিতে পারে, তুমি সেরূপ হৃদয়ের সহিত ঐ সকল কথা বলিতে পার নাই। তুমি যেন রঙ্গমঞ্চে অভিনয় করিয়াছিলে। কিন্তু সে অভিনয়েও তুমি তাদৃশ কৃতাকার্য্য হইতে পার নাই—কথাগুলি করুণাত্মক বটে কিন্তু তোমার বর তেমন করুণ ছিল না।”

 আমি চুপ করিলাম। দেখিলাম, হরশঙ্কর আমার দিকে চাহিয়া একমনে আমার কথাগুলি শুনিতেছে। জিজ্ঞাসা করিলাম, “কেমন, আমার কথা সত্য কি না? তাহার পর যখন দামোদর কুটীরের মধ্যস্থ পায়ের দাগ ও ফকিরের পা এই দুইটার দিকে বার বার বৃষ্টি নিক্ষেপ করিতেছিল, তখন আমার আর এক সন্দেহ হয়। আমি দেখিলাম, তোমার পায়ের সহিত ফকিরের পা ও কুটীর মধ্যস্থ সেই পায়ের দাগ ঠিক এক। তখনই আমি তোমার আর ফকিরের প্রত্যেক অঙ্গ তুলনা করি—দেখিলাম, যদিও তোমাদের মুখের কোন সাদৃশ্য নাই, তথাপি অন্যান্য অঙ্গের বেশ মিল আছে। আমি কিন্তু তখন তোমার মুখে তোমাদের যমজ ভাইএর গল্প শুনি নাই। যখনই সে কথা শুনিলাম, তখনই আমার পূর্ব্ব সন্দেহ আরও দৃঢ়ীভূত হইল। অবশেষে যখন তোমরা কুটীর হইতে বাহির হইয়া আমার অপেক্ষা করিতেছিলে, সেই সময় আমি এই লোটা ও মাটীর এই সরা দেখিতে পাই। লেটার জল ও সরায় কি এক প্রকার রং ছিল। তখন আমি পুনরায় ফকিরের দেহ পরীক্ষা করি—দেখিলাম, তাহার মুখে ও সর্ব্বাঙ্গে ঐ রং-মাখান। যদিও তখন রং বেশ শুকাইয়া গিয়াছিল, তবুও দেখিলে বোধ হইল, যেন সম্প্রতি রং করা হইয়াছে। এই সকল দেখিয়া আমার সন্দেহ আরও বৃদ্ধি হইল; কিন্তু তখন কোন কথা না বলিয়া এগুলি আরও লুক্কায়িত রাখিলাম ও তোমাদের সহিত যোগ দিলাম। রাত্রিকালে তোমার মুখে সমস্ত কথা শুনিয়া স্পষ্টই বুঝতে পারিলাম, উহা তোমারই কাজ। তখন আর আমার কোন সন্দেহ রহিল না। তুমিই যে সেই ফকির, আর তুমিই যে গৌরী বাবুকে খুন করিয়াছ তাহা বেশ জানিতে পারিলাম। কুটীরে যে পায়ের দাগ দেখা গিয়াছিল, তাহা তোমারই পায়ের দাগ। তুমিই গৌরীশঙ্করকে তোমার কুটীরে ডাকিয়া আনিয়াছিলে, পরে সুবিধা পাইয়া এই নির্জন কুটীরের মধ্যে সেই ভয়ানক লাঠীর সাহায্যে তাহাকে হত্যা করিয়াছ। পরে সেই লোটার জলে আপনার দেহের রং তুলিয়া মুখের ভঙ্গী বদলাইয়া স্বয়ং গৌরীশঙ্কয়ের পোষাক পরিয়া গৌরীশঙ্কর সাজিয়াছ এবং প্রকৃত গৌরীশঙ্করকে তোমার পোষাকে অর্থাৎ ফকিরের পোষাক পরাইয়া উহার মুখ তোমার মত পরিবর্ত্তিত করিয়া উহাকে ফকির সাজাইয়া ফেলিয়া রাখিয়াছ এবং নিজে গৌরীশঙ্করের পরিবারবর্গের নিকট গৌরীশঙ্কররূপে স্থান পাইবার প্রত্যাশা করিয়াছ, কিন্তু এখনও পর্য্যন্ত সাহস করিয়া অন্তঃপুরে প্রবেশ করিতে সমর্থ হও নাই, হত্যার পর হইতেই দূরে দূরে রহিয়াছ। তোমার মনে পাপ, উভয় ভ্রাতা দেখিতে একরূপ হইলেও তোমার মনে ভয়, পাছে অন্তঃপুরের সকলে তোমাকে চিনিয়া ফেলে। তোমার ইচ্ছা ছিল, যে পর্য্যন্ত এই মকর্দ্দমা শেষ না হইয়া যায়, সেই পর্য্যন্ত তুমি অন্তঃপুরে প্রবেশ করিবে না, ও পরিশেষে ক্রমে ক্রমে তোমার অনুপস্থিতি কালের ভিতরের সমস্ত অবস্থা জানিয়া লইয়া, তোমার সংকল্পিত কার্য্যক্ষেত্রে প্রবেশ করিবে। এইরূপে কিছু দিবস অতিবাহিত করিতে পারিলে, আর তোমাকে চিনিবার ভয় থাকিবে না। এই সরাখানিতে যে রং রহিয়াছে, ঐরংই তোমার মুখে ছিল, এখন গৌরীশঙ্করের মুখে মাখাইয়া উহাকে ফকির সাজাইয়াছ। ধন্য তোমার বুদ্ধি। একাকৃতি যমজ ভাই বলিয়াই তুমি এই চাতুরী প্রকাশ করিতে পারিয়াছ?”

 আমার কথা শুনিয়া আবদুল অতি বিনীতভাবে জিজ্ঞাসা করিল, “ইনি যদি হরশঙ্করই হন, আর যদি গৌরীশঙ্করকে হত্যা করাই ইহার উদ্দেশ্য হয়, তবে ইনি প্রথম হইতে ইহাঁর উপকার করিলেন কেন?”

 আ। গৌরীশঙ্করকে ভুলাইবার জন্য তাঁহাকে সদুপদেশ দিয়া তাঁহার আর্থিক অবস্থা ও জমীদারীর আয়ের উন্নতি করিয়া তাঁহার বিশ্বাসের পাত্র হইয়াছিলেন; এবং তাঁহার অনুপস্থিতিতে যাহা যাহা ঘটিয়াছিল তাহার সমস্ত জানিয়া লইয়াছিলেন।

 আবদুল পুনরায় জিজ্ঞাসা করিল, “হুজুর, আর একটী জিজ্ঞাস্য আছে। হরশঙ্কর কি কেবল পৈত্রিক সম্পত্তি লাভের আশায় ভ্রাতৃহত্যা করিল? এই সামান্য জমীদারীর জন্যই হরশঙ্কর এত ভয়ানক পাপকর্ম্মে লিপ্ত হইল?

 আমি হাসিয়া উত্তর করিলাম, “না, কেবল পৈত্রিক বিষয়ের লোভেই হরশঙ্কর নরহত্যা করে নাই। আরও একটা গুরুতর কারণ ছিল। হরশঙ্কর পিতৃহত্যা করে নাই, গৌরীশঙ্করই প্রকৃত পিতৃঘাতী। কিন্তু দোষ পড়ে হরশঙ্করের উপর। হরশঙ্কর সে সময় তাহা প্রমাণ করিতে পারে নাই; সে দ্বিরুক্তি না করিয়া বিশ বৎসর কারা-যন্ত্রণা ভোগ করিল। সেই প্রতিশোধ লইবার জন্যই সে প্রত্যাগমন করিয়া গৌরীশঙ্করকে হত্যা করিয়াছে। গৌরীশঙ্কর এমন কৌশল করিয়া পিতৃহত্যা করিয়াছিল যে, তখন তাহার উপর কেহই সন্দেহ করে নাই। সকলেই হরশঙ্করকে দোষী বলিয়া সাব্যস্ত করিয়াছিল। সেই জন্যই গৌরীশঙ্কর সে যাত্রা বাঁচিয়া গিয়াছিল। গৌরীশঙ্করের পাপের কথা এক হরশঙ্কর ভিন্ন আর কেহই জানিত না। কিন্তু তখন তাহার কথায় কেহই বিশ্বাস করিবে না বলিয়া, সে সেকথা প্রকাশ করে নাই। মনে মনে প্রতিহিংসা লইবার প্রতিজ্ঞা করিয়া সে আণ্ডামান দ্বীপে নির্ব্বাসিত হইয়াছিল। এখন বুঝিতে পারিলে, হরশঙ্কর কি ভয়ানক লোক!”

 আমার কথায় আবদুল আর কোন উত্তর করিল না। আমার অনুমান কতদুর সত্য তাহা নিশ্চয়রূপে জানিবার নিমিত্ত, আবদুল ও ঐ বাড়ীর সমস্ত লোককে সঙ্গে লইয়া, যে স্থানে সেই ফকিরের মৃতদেহ ছিল, সেইস্থানে গমন করিলাম। তখনও ঐ দেহের পরীক্ষা হয় নাই। পরীক্ষাকারী ডাক্তারকে আমার অনুমানের কথা বলিলে, তিনি ঐ মৃতদেহের সমস্ত অঙ্গ উত্তমরূপে ধৌত করিয়া ঐ ধৌতজল পৃথক রাখিয়া দিলেন। মৃতদেহ উত্তমরূপে ধৌত হইলে ঐ মৃতদেহের আকৃতি সম্পূর্ণরূপে পরিবর্ত্তিত হইয়া গেল। তখন সকলেই উহাকে গৌরিশঙ্কর বলিয়া চিনিতে পারিলেন ও সকলেই বুঝিতে পারিলেন, আমাদিগের অনুমান সম্পূর্ণরূপে সত্য।

 ঐ মৃতদেহ-ধৌত জল ও কুটীর হইতে প্রাপ্ত সেই তরল-পদার্থ রাসায়নিক পরীক্ষায় স্থির হইল যে, উহাতে একই পদার্থ মিশ্রিত আছে।

 পরিশেষে হরশঙ্কর সমস্ত কথাই স্বীকার করিল। বিচারে তাহার ফাঁসীর হুকুম হইল।

সমাপ্ত।



শ্রবণ মাসের সংখ্যা

“লুকোচুরি

যন্ত্রস্থ।