অদ্ভুত ফকির/প্রথম পরিচ্ছেদ

অদ্ভুত ফকির।

প্রথম পরিচ্ছেদ।

 দারুণ শীত। আকাশে মেঘের লেশ মাত্র নাই। নির্ম্মল সুনীল অম্বরে থাকিয়া দিনমণি প্রখর-কিরণজাল বিকীরণ করিতেছেন। উত্তরে বাতাস শন্ শন্ শব্দে প্রবাহিত হইয়া শীত প্রপীড়িত শতগ্রন্থি-ছিন্ন-বসন-পরিহিত মানবগণকে কাঁপাইয়া তুলিতেছে। জানু, ভানু, কৃষাণু আশ্রয় করিয়া শীতার্ত্ত দীন-দরিদ্রগণ কোনরূপে শীত নিবারণ করিতেছে। আমি সেই সময় অফিসঘরে বসিয়া আছি।

বেলা আট‍্টা বাজিয়া গিয়াছে; বিশেষ কোন কাজ না থাকায়, আমি একখানি সংবাদ-পত্র দেখিতে ছিলাম, এমন সময়ে একজন কনষ্টেবল আসিয়া সংবাদ দিল, আলিপুরে সরকারদের বাগানে একজন ফকিরের মৃতদেহ পাওয়া গিয়াছে, সাহেবের হুকুম, আমাকে তাহার অনুসন্ধানের জন্য এখনই সেখানে যাইতে হইবে।

 কনষ্টেবলকে আমি দুই একটা কথা জিজ্ঞাসা করিয়া জানিলাম, সে হত্যাকাণ্ডের বিষয় বিশেষ কিছুই জানে না। আলিপুরের সরকারের বিখ্যাত লোক; তাঁহাদের বাড়ী ও বাগান আমার বিলক্ষণ জানা ছিল। কাজেই কনষ্টেবলকে বিদায় দিলাম।

 আলিপুরের সরকারের বিখ্যাত ধনবান পরিবার। তাঁহাদের নাম ডাক যথেষ্ট। বাড়ীতে সকল প্রকার ক্রিয়া-কলাপের অনুষ্ঠান হইয়া থাকে। কিন্তু এ পর্য্যন্ত আমার সহিত তাঁহাদের কোনরূপ পরিচয় হয় নাই।

 অর্দ্ধ ঘণ্টার মধ্যে একখানি গাড়ী আনাইয়া তাহাতে আরোহণ পূর্ব্বক গন্তব্যস্থানে যাইতে লাগিলাম। বেলা প্রায় নয়টা বাজিলেও পথে অধিক লোকের সমাগম নাই। পথের উভয় পার্শ্বের মাঠ সকল ফল-পুষ্পে সুশোভিত বৃক্ষশ্রেণী দ্বারা পরিপূর্ণ। কৃষকগণ মাঠে গোচারণ ও বৃক্ষপরিচর্য্যায় নিযুক্ত।

 প্রায় আধ ঘণ্টা শকটারোহণে গমন করিবার পর আমরা সরকারদিগের বাড়ীর নিকটবর্ত্তী হইলাম। দেখিলাম, নিকটস্থ মাঠ সকলে বৃক্ষাদির নামগন্ধও নাই, তদ্ভিন্ন মাঠগুলির অবস্থা দেখিলে বোধ হয়, যেন কাহারও সে দিকে ভ্রুক্ষেপ নাই।

 আমি দেখিলাম, সেই সকল মাঠের নিকটবর্ত্তী অন্যান্য মাঠ সকল বেশ উর্ব্বরা, সেখানে সকল বৃক্ষই ফল-পুষ্পে সুশোভিত, অথচ এই মাঠগুলির অবস্থা অতি শোচনীয়। ইহার কারণ কি, জানিবার জন্য আমার কৌতূহল জন্মিল। আমি আমার সমভিবাহারী আবদুল কাদের নামক কর্ম্মচারীকে জিজ্ঞাসা করিলাম, আবদুল কাদের! এই মাঠগুলির অবস্থা এমন কেন? দেখ দেখি, ইহার নিকটস্থ মাঠগুলি কেমন সুন্দর? আর এ গুলির অবস্থা দেখিয়া সত্যই আমার বড় কষ্ট হইতেছে। তুমি এদিকে আর কখনও আসিয়াছিলে কি?”

 আবদুল ঈষৎ হাসিয়া উত্তর করিল, “হুজুর! আপনার আশীর্ব্বাদে এ অঞ্চলের এমন গ্রাম নাই যেখানে এ অধীন প্রত্যহ না আইসে। আমি বেশী কথা বলিতে ইচ্ছা করি না। হুজুরের সময় অতি মূল্যবান তাহা আমি বেশ জানি। কিন্তু এ অঞ্চলের এমন কোন বাড়ী ঘর মাঠ বা বৃক্ষ নাই, যাহা আমি না জানি। সেদিনের সেই অদ্ভুত হত্যাকাণ্ডের ব্যাপার,—”

 বাধা দিয়া আমি আবদুলকে বলিলাম, “থাক্ থাক্, আর সে কথা তুলিবার প্রয়োজন নাই। এই সকল মাঠের এমন অবস্থা কেন, যদি তোমার জানা থাকে, তবে অতি অল্প কথায় বল।

 আবদুল ঈষৎ হাসিয়া অতি আগ্রহ সহকারে বলিল, “দুই কথায় আমি আপনাকে সমস্তই বুঝাইয়া দিতেছি। আপনার মত বিচক্ষণ লোককে অধিক কথা বলিবার আবশ্যক হয় না। আপনার মত জ্ঞানী কয়জন আছে? আমি কি জানি না যে, আপনার সময়ের মূল্য কত? কতকগুলা অনাবশ্যকীয় কথা বলিয়া আপনার মূল্যবান সময় নষ্ট করা—”

 আমি আর সহ্য করিতে পারিলাম না। এদিকে আমাদের গাড়ীও সরকারদিগের বাড়ীর দরজায় আসিল দেখিয়া বলিলাম, “থাক আবদুল! আর তোমার দুই কথায় বুঝাইবার প্রয়োজন নাই। আমরা কার্য্যস্থানে আসিয়া পড়িয়াছি।”

 আবদুল আমার কথায় কিছুমাত্র লজ্জিত হইল না। সে নিস্তব্ধভাবে গাড়ী হইতে অবতরণ করিল। আমিও নামিয়া পড়িলাম। দেখিলাম, একজন প্রৌঢ় দ্রুতপদসঞ্চারে আমার দিকে আসিতেছেন। নিকটে আসিলে দেখিলাম, তাঁহার বয়স চল্লিশ বৎসর। তাঁহার দেহ নাতিদীর্ঘ নাতিখর্ব্ব, বর্ণ গৌর কিন্তু লাবণ্যহীন, চক্ষু আয়ত, কিন্তু উজ্জ্বলতাশূন্য, মস্তকে দুই এক গাছি পক্ক কেশ দেখা দিয়াছে। তাঁহার পরিধানে একখানি সাদাধুতি, গাত্রে একটা ক্ষুদ্র পিরান, পায়ে এক জোড়া চটী জুতা, হন্তে এক গাছি লাঠী, চক্ষে সোণার চশমা। তাঁহাকে দেখিয়া বোধ হইল, তিনি সুখের ক্রোড়ে পালিত হইলেও কষ্টের হাত হইতে অব্যাহতি পান নাই। তাঁহার ললাটে চিন্তা-রেখা সুস্পষ্টরূপে প্রতীয়মান হইতেছিল।

 জিজ্ঞাসা করিয়া জানিলাম, তিনিই বাড়ীর মালিক, সরকার বংশের বংশধর, নাম গৌরীশঙ্কর। সরকারদিগের বাড়ীখানি প্রকাণ্ড ও দ্বিতল। অট্টালিকার সম্মুখেই এক প্রকাও উদ্যান। সেই উদ্যানের ভিতর একখানি সামান্য কুটীরে এক ফকির বাস করিতেন। সেদিন প্রত্যুষে তাঁহারই মৃতদেহ দেখিতে পাওয়া যায়।

 প্রথম সম্ভাষণের পর আমি গৌরীশঙ্করকে ঐ হত্যাকাণ্ডের কথা জিজ্ঞাসা করিলাম। গৌরীশঙ্করের সঙ্গে দুই তিনজন ভৃত্য আসিয়াছিল। গৌরীশঙ্কর একবার আমার মুখের দিকে আর একবার সেই ভৃত্যদিগের দিকে চাহিলেন দেখিয়া, আমি তাঁহার মনোগত অভিপ্রায় বুঝিতে পারিলাম। বলিলাম, “আপনি যথার্থ অনুমান করিয়াছেন। সকল কথা সকলের সমক্ষে বলা বিচক্ষণ ব্যক্তির উচিত নহে।”

 গৌরীশঙ্কর আমার সঙ্কেতবাক্য বুঝতে পারিলেন এবং তখনই তাহাদিগকে তথা হইতে বিদায় দিলেন। পরে আমাদের উভয়কে একটী নির্জন গৃহে লইয়া গিয়া প্রথমে অতি সমাদরে বসিতে অনুরোধ করিলেন।