অদ্ভুত ভিখারী/তৃতীয় পরিচ্ছেদ

তৃতীয় পরিচ্ছেদ।


 নরেন্দ্রকৃষ্ণ কহিলেন, “মহাশয়! ঈশ্বর আপনার মঙ্গল করিবেন। আমি লজ্জার ভয়ে প্রাণ পর্য্যন্ত বিসর্জ্জন করিতেও প্রস্তুত ছিলাম, আজ যদি নরেন্দ্রবাবুকে খুন করিয়াছি বলিয়া আপনারা আমার ফাঁসির হুকুম দিতেন, তাহা হইলেও আমি কোন বাক্যব্যয় করিতাম না। আমি প্রাণান্তেও পুত্রগণকে আমার প্রকৃত অবস্থার বিষয় জ্ঞাপন করিতে সক্ষম নহি। এখন আমার যাহা ব্যক্তব্য তাহা আপনাদের সকলের সাক্ষাতে বলিতেছি শ্রবণ করুন। আমার এই গুপ্তকথা আর কেহই ইতিপূর্ব্বে জানিতেন না। আজ আপনারা এই তিনজনে প্রথমে আমার এই অদ্ভুত কাহিনী শ্রবণ করিতেছেন। আমার পিতা কোন একটি গবর্ণমেণ্ট বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। তিনি একজন পণ্ডিত লোক। আমিও পিতার কৃপায় যথেষ্ট বিদ্যা শিক্ষা করিয়াছিলাম। বিদ্যা শিক্ষা করিলেই যে অর্থ উপার্জ্জন হয়, এমন কোন কথা নাই। আমি যদিও যথেষ্ট বিদ্যালাভ করিয়াছিলাম, তথাপিও অনেকদিন পর্যন্ত একটা পয়সার মুখ দেখিতে পাই নাই। অবশেষে অনেক কষ্টের পর একখানা খবরের কাগজের সম্পাদকপদে প্রতিষ্ঠিত হইলাম। একদিন আমি এই সংবাদ পাইলাম যে, যে লোক ভিক্ষাবৃত্তি সম্বন্ধে একটী উৎকৃষ্ট প্রবন্ধ রচনা করিতে পারিবেন, তিনি পুরষ্কৃত হইবেন। আমি সেই সুযোগ ত্যাগ করিতে পারিলাম না। মনে করিলাম, কেবল স্বকপোলকল্পিত কতকগুলি আবর্জ্জনা না লিখিয়া প্রকৃত তথ্য অনুসন্ধান করিয়া এই কার্য্যে নিযুক্ত হওয়াই কর্ত্তব্য। আমি পূর্ব্বে একটি সখের থিয়েটারে কার্য্য করিতাম। ছদ্মবেশ আমার চির অভ্যস্ত ছিল। ছদ্মবেশে আমি এমন সিদ্ধহস্ত ছিলাম যে, আমাকে আমার অত্যন্ত আত্মীয়, এমন কি, আমার পিতা মাতা পর্য্যন্ত চিনিতে পারিতেন না। প্রবন্ধ লিখিবার সময় আমার সেই সকল বিষয় স্মরণ হইল। আমি তখন ছদ্মবেশ ধারণ করিলাম। এক অদ্ভুত আকৃতি করিয়া রাজধানীর প্রশস্ত পথে আসিয়া দণ্ডায়মান হইলাম। যে অকৃতিতে আমি সকলের দয়া উদ্রেক করিয়াছিলাম, তাহার আর অধিক কি বর্ণনা করিব। আমার সেই অদ্ভুত কদাকার মূর্ত্তি আপনারা স্বচক্ষেই দেখিতে পাইয়াছেন। সেই কদাকার মূর্ত্তিতে আমি সকলেরই দয়ার পাত্র হইলাম। প্রায় ছয় সাত ঘণ্টা এইরূপে দণ্ডায়মান থাকিবার পর আমি কার্য্যস্থানে আসিলাম। দেখিলাম যে, সেই একদিনেই আমি প্রায় কুড়ি টাকা উপায় করিয়াছি। তাহার পর আমি প্রবন্ধ লিখিলাম। সেইদিন নিজে ভিক্ষুক সাজিয়া যাহা যাহা করিয়াছি, যে যে বিষয় অবলোকন করিয়াছি, কি কৌশলে সাধারণের দয়ার পাত্র হইয়াছিলাম, এই সমস্ত ব্যাপার প্রবন্ধে লিখিলাম। আমার প্রবন্ধই সকলের অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ হইল। আমি পুরষ্কার পাইলাম। আর আমার নিজের ভিক্ষাবৃত্তির বিষয় স্মরণপথে আনিবার চেষ্টা করিলাম না।

 কিছুদিন এইরূপে অতিবাহিত হইল, পরে একদিন আমার এক বন্ধু আমার নিকট উপস্থিত হইল। পূর্ব্বে আমি তাহার নিকট হইতে প্রায় আড়াই শত টাকা কর্জ্জ লইয়াছিলাম, তখনও পরিশোধ করিতে পারি নাই। বলিতে গেলে, আমার দেনার বিষয় আমার একেবারে মনেই ছিল না। বন্ধুবর আসিয়া আমার নিকট হইতে অর্থ চাহিলেন। আমার হস্তে তখন এক কপর্দ্দক ছিল না। অথচ বন্ধুর বিশেষ প্রয়োজন। কি করি, তাহার নিকট হইতে সাত দিনের সময় লইলাম।

 সেইদিন আবার আমার ভিক্ষাবৃত্তির কথা মনে পড়িল। আমি তখনই আমার প্রভুকে বলিয়া কার্য্য হইতে কিছুকাল অবসর গ্রহণ করিলাম। তারপর আবার সেইরূপ ছদ্মবেশ ধারণ করিলাম ও পুনরায় সহরে গিয়া ভিক্ষাবৃত্তি অবলম্বন করিলাম। আপনারা সহজেই অনুমান করিতে পারিবেন, কেন আমি এরূপ ঘৃণাষ্কর কার্যে লিপ্ত হইলাম। যখন আমি কঠোর পরিশ্রম করিয়া এক মাসের পর মোট ত্রিশটী টাকা পাই এবং বিনা পরিশ্রমে একদিনে প্রায় ২০ কুড়ি টাকা উপায় করিতে পারি, তখন কেন আমি পরিশ্রম করিয়া অল্প অর্থ উপার্জ্জন করিতে পাইব, কিরূপেই বা আমি অনায়াসলব্ধ দৈনিক ২০ কুড়ি টাকার লোভ সম্বরণ করিব। অনেক ভাবিয়া চিন্তিয়া আমি শেষোক্ত লভ্যজনক কার্য্যেই নিযুক্ত হইলাম।

 কেবল একটী লোক আমার এই কার্য্য জানিত। সে সেই গুলির আড্ডার সর্দ্দার। সেই আমায় দয়া করিয়া তাহার আড্ডার মধ্যে একটী কামরা আমায় থাকিতে দিয়াছিল। অবশ্য আমি তাহাকে তাহার ঘরের ভাড়া স্বরূপ কিছু কিছু দিতাম এবং আমার এই গুপ্তকথা পাছে প্রকাশ করে এজন্যও তাহাকে আমার লভ্যের কিয়দংশ দিতাম। সুতরাং সে কাহাকেও আমার গোপনীয় রহস্য প্রকাশ করিত না।

 অতি অল্প দিনের মধ্যেই আমি দেনা শোধ করিলাম বটে কিন্তু আমার এই লাভজনক ব্যবসা আর পরিত্যাগ করিতে পারিলাম না। শীঘ্রই দেখিলাম যে, আমার যথেষ্ট অর্থ সঞ্চিত হইয়াছে এবং দিন দিন আমি ধনবান হইতেছি। তখন আমি বিবাহ করিলাম ও কিছুদিন পরে আমার সন্তান-সন্ততি হইতে লাগিল। আমার স্ত্রী এ বিষয়ে কিছুই জানিত না। আমি তাহাকে এ সকল কথার কিছুই বলি নাই, তবে মধ্যে মধ্যে আমার সহরে আসিতে হইত বলিয়া আমার স্ত্রীকে বলিতাম যে, সহরে আমার বিশেষ কার্য্য উপলক্ষে সময়ে সময়ে যাইতে হয়। গত সোমবার আমার দৈনিক ভিক্ষাবৃত্তির পর যেমন আমি গুলির আড্ডায় আগমন করিয়া আমার ছদ্মবেশ পরিত্যাগ করিয়াছি, অমনি আমার স্ত্রীর সহিত আমার সাক্ষাৎ হয়। কিজন্য আমার স্ত্রী ঐ স্থান দিয়া যাইতেছিল, তাহা ইতিপূর্ব্বেই আপনারা জ্ঞাত আছেন এবং কিজন্য আমি খুনী বলিয়া ধৃত হই, তাহাও আপনাদিগের অজ্ঞাত নহে।

 আমার স্ত্রীকে দেখিয়া আমি অতীব আশর্য্যান্বিত হইলাম এবং তখনই অদৃশ্য হইলাম। আমি জানিলাম যে, আমার স্ত্রী সহজে ছাড়িবার নহে সুতরাং আমিও পুনরায় ছদ্মবেশ পরিধান করিয়া রহিলাম এবং পরে ধরা পড়িলাম। কারণ আমার পুত্র সেই ঘরে প্রবেশ করিবার পূর্ব্বে আমি সমুদায় পোষাক জলে ফেলিয়া দিতে পারি নাই। কেবল উপরের জামাটার পকেট তাম্রমুদ্রায় পূর্ণ করিয়া নদীগর্ভে ফেলিয়া দিয়াছিলাম। যদি আমার পুত্রের আসিতে বিলম্ব হইত, তাহা হইলে আমি অপর পোষাকগুলির অবস্থাও সেইরূপ করিতাম। কিন্তু অদৃষ্টের ভোগ কোথায় যাইবে। আমি অপর পোষাকগুলির বন্দোবস্ত করিবার পূর্ব্বেই আমার পুত্র আসিয়া সেইস্থানে উপস্থিত হইল এবং আমার পোষাকগুলি দেখিতে পাইয়া আমাকেই তাহার পিতার হত্যাকারী বলিয়া মনে করিয়া আমায় পুলিসের হস্তে সমর্পণ করিল। এই আমার ইতিহাস। এখন আপনারা ইহার যেরূপ বিচার করিবেন, আমি তাহাই অবনত মস্তকে গ্রহণ করিব। আর একটী কথা বলিতে ভুলিয়া গিয়াছি, যখন দেখিলাম যে, আমার আর নিষ্কৃতি নাই, তখন আমি কোন একটী লোকের হস্তে আমার আংটী ও একখানি পত্র দিয়া আমার স্ত্রীর নিকট পাঠাইয়া দিতে অনুরোধ করি। বোধ হয়, আমার স্ত্রী সে পত্র পান নাই, সেইজন্যই এত গোলযোগ ঘটিয়াছে।

 আমার বন্ধু বলিলেন, “তোমার সেই পত্র কেবলমাত্র গতকল্য তোমার স্ত্রীর হস্তে পতিত হইয়াছে।”

 নরেন্দ্র। কি ভয়ানক! তবে ত আমার স্ত্রী এক সপ্তাহ কাল ভয়ানক কষ্টে দিনযাপন করিয়াছে। হায়! হায়! আমার পাপে তাহাকে এত কষ্ট সহ্য করিতে হইল। ভগবান! আমি কি পাপে এত শাস্তি পাইলাম তাহা বলিতে পারি না।

 আমি। তুমি ত জান যে পুলিস, আড্ডার সর্দ্দারের উপর বিশেষ সন্দেহ করিয়াছিল। পুলিস ইহাও সাব্যস্ত করিয়াছিল যে, তোমার ন্যায় একজন অক্ষম লোকে অপরের সাহায্য ব্যতীত কোন লোককে হত্যা করিতে পারে না; তোমার নিশ্চয়ই একজন সঙ্গী ছিল। আর ইহাও আমাদিগের বিশ্বাস হইয়াছিল যে, আড্ডার কোন গুলিখোর তোমার ভয়ানক কার্য্যে সাহায্য করিতে পারিবে না। কারণ, তাহা হইলে অনেকেই তোমাদের কার্য্য লক্ষ্য করিবে। অতএব সেই আড্ডার সর্দ্দার ভিন্ন আর কোন্ লোক এ কার্য্যে হস্তক্ষেপ করিতে পারে? এইজন্য পুলিস সেই আড্ডাধারীকে সন্দেহ করিয়াছিল, কিন্তু তাহার বিপক্ষে কোন প্রমাণ না পাওয়াতে উহাকে সাক্ষাৎ সম্বন্ধে হাজতে দিতে পারে নাই। সুতরাং তাহারা ভিতরে ভিতরে সর্দ্দারের কার্য্যপ্রণালী লক্ষ্য করিতেছিল এবং সেই কার্য্যের জন্য অনেক লোকও নিযুক্ত করিয়াছিল। এই হেতু সর্দ্দার তোমার প্রদত্ত পত্র যথাসময়ে ডাকঘরে দিতে পারে নাই। আমার বোধ হয়, সে নিজেও এ কার্য্য করিতে সক্ষম হয় নাই, অপর কাহারও হস্তে দিয়াছিল। সে হয়ত পত্র

ডাকে দিতে বিলম্ব করে। সেই জন্যই তোমার স্ত্রী যথাসময়ে তোমার পত্র পান নাই।

 আমি নরেন্দ্র বাবুকে এই কথা বলিলে আমার বন্ধু বলিলেন, “ঠিক কথা! এ বিষয়ে আমার কোন সন্দেহ নাই। এখন আমার একটী কথা আছে। যদি পুলিস অনুগ্রহ করিয়া এই সম্বন্ধে আর কোন গোলযোগ না করিতে স্বীকৃত হয়, তাহা হইলে তুমিও আর কখনও ভিক্ষুকের কার্য্য করিতে পারিবে না। ছদ্মবেশ ধারণ করিয়া ভিক্ষুকতা দ্বারা অর্থ উপার্জ্জন করিতে চিরকালের জন্য বঞ্চিত হইলে।”

 আমি আসামীকে লক্ষ্য করিয়া কহিলাম, “নরেন্দ্র বাবু! আমি আপনাকে মুক্তি দিলাম। এ বিষয়ে আর কোন গোলযোগ হইবে না। আপনি ভদ্রলোক, সামান্য ভ্রমের জন্য অনেক কষ্ট সহ্য করিলেন। এমন কি, যদি এই ভয়ানক রহস্যভেদ এত সহজে না হইত, তাহা হইলে আপনাকে হয়ত জীবন পর্য্যন্ত বিসর্জ্জন দিতে হইত। আপনি যদি আপনার স্ত্রীকে এই বিষয় ইতিপূর্ব্বে জানাইতেন, তাহা হইলে কখনও এরূপ গোলযোগ ঘটিত না। স্বামী স্ত্রীর মধ্যে এরূপ গোপনীয় বিষয় থাকা উচিত নহে। আপনি মুক্তি পাইলেন, অদ্য আপনাকে এখন আর একটী কার্য্য করিতে হইবে। আপনি বাটী প্রত্যাগমন করিয়া আপনার স্ত্রীকে এই বিষয় সত্য করিয়া বলিবেন,—ইহাই আমার আন্তরিক অভিপ্রায়।”

 “আপনার কথা শিরোধার্য। কিন্তু জানিবেন যে, এ সকল কথা বলিতে আমার যৎপরোনাস্তি অপমান বোধ করিতে হইবে।”

 তখন আমার বন্ধু আমার দিকে লক্ষ্য করিয়া বলিলেন, “আজ আপনি যেরূপ অসাধারণ ক্ষমতার পরিচয় দিলেন, তাহা ইতিপূর্ব্বে কখনও শ্রুতিগোচর হয় নাই। আজ আপনি কেবল যে পুলিসের কার্য্য করিলেন, এমন নহে, একটী পরিবারের সুখের কারণ হইলেন। একবার ভাবিয়া দেখুন, যদি আজ এ ভয়ানক অদ্ভুত রহস্যভেদ না হইত, যদি আজ নরেন্দ্র বাবু যে অপরাধে অপরাধী বলিয়া ধৃত হইয়াছেন, তাহাতে সম্পূর্ণ নির্দ্দোষী হইয়াও শাস্তি গ্রহণ করিতে বাধ্য হইতেন, তাহা হইলে কি হইত? ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিই যে, তিনি তোমার মত বিচক্ষণ ব্যক্তিকে এমন কার্য্যে নিযুক্ত করিয়াছেন। ঈশ্বরের নিকট শেষ প্রার্থনা এই যে, তিনি যেন আপনাকে দীর্ঘজীবী করিয়া সর্ব্বদা সুস্থশরীর ও স্বচ্ছন্দমনে জীবন অতিবাহিত করিতে দেন।”

 আমার বন্ধু, আসামী ও আমি তথা হইতে বাহির হইলাম। দ্বারেই গাড়ী ছিল, সকলে আরোহণ করিয়া অনতিবিলম্বে নরেন্দ্র বাবুর বাটীতে উপুস্থিত হইলাম।

 প্রথম আনন্দ উচ্ছ্বাস অতীত হইলে আমার বন্ধু, নরেন্দ্র বাবু ও তাহার স্ত্রীকে সঙ্গে লইয়া নির্জ্জনে গমন করিলেন। আমিও তাহাদের অনুসরণ করিলাম। তথায় আমার বন্ধু নরেন্দ্র বাবুর ছদ্মবেশের সেই অদ্ভুত রহস্য তাহার স্ত্রীকে বিশেষরূপে বর্ণনা করিয়া উভয়ের মধ্যে যাহাতে শান্তি স্থাপিত হয়, তাহার উপায় করিলেন। এই স্থানে আমাদিগের কার্য্যেরও শেষ হইল।

 আমরা সেই স্থান হইতে বহির্গত হইয়া আমাদিগের আপন আপন স্থানে গমন করিলাম। এই মোকদ্দমার কথা সবিশেষ যিনি যিনি শ্রবণ করিয়াছিলেন, তিনিই পুলিসকে প্রথম গালি না দিয়া ক্ষান্ত হন নাই; কিন্তু সংবাদপত্রে সকল কথা প্রকাশ হয় না।

সমাপ্ত।

(চিত্র)


⇒ বৈশাখ মাসের সংখ্যা,

“লাস কৈ?”

(অর্থাৎ অন্তর্হিত লাসের অদ্ভুত রহস্য)

যন্ত্রস্থ।