অদ্ভুত ভিখারী/প্রথম পরিচ্ছেদ
অদ্ভুত ভিখারী।
প্রথম পরিচ্ছেদ।
জ্যৈষ্ঠ মাস প্রায় শেষ হইয়া গিয়াছে। দারুণ গ্রীষ্মের প্রকোপে গত তিন চারি রাত্রি নিদ্রা হয় নাই। আজ এক পশলা বৃষ্টি হওয়ায় প্রকৃতি যেন কতকটা শীতল হইয়াছে। রাত্রি ১০টা বাজিয়া গিয়াছে। আমি আফিসে বসিয়া সমস্ত দিবস যে সকল কার্য্যে ঘুরিয়া বেড়াইয়াছি, তাহার ডায়েরি লিখিতেছি, এরূপ সময় সংবাদ আসিল যে, চারি দিবস হইল সহরতলীতে একটী অদ্ভুত রকমের হত্যা হইয়াছে, মৃতদেহ পাওয়া যায় নাই কিন্তু হত্যাকারী ধৃত হইয়াছে।
এই সংবাদ পাইবামাত্র সেই রাত্রির বিশ্রাম-সুখের আশা পরিত্যাগ করিতে হইল। যে স্থানে এই হত্যাকাণ্ড সম্পন্ন হইয়াছে, সেই স্থানে গিয়া উপস্থিত হইলাম। এই স্থানটী সহরতলীর মধ্যে হইলেও শহরের ন্যায় অনেক লোকের বসবাস আছে। যে বাড়ীতে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হইয়াছে, উহা ইষ্টকনির্ম্মিত একটি দ্বিতল গৃহ। ঐ গৃহের নিম্ন দিয়া একটা ক্ষুদ্র নদী প্রবাহিত। গৃহটী দ্বিতল হইলেও উপরে কেবল মাত্র একটী ভিন্ন ঘর নাই, কিন্তু নিম্নে চারিখানি ঘর আছে। ঐ ঘরগুলি একজনের অধিকারভুক্ত, তিনি নিজে একজন প্রসিদ্ধ গুলিখোর; নিম্নের ঐ ঘর চারিটীতে তাহারই কার্য্যের উপযোগী একটা গুলির আড্ডা খুলিয়া তিনি সেই স্থানেই বাস করিয়া থাকেন।
আমি সেই স্থানে উপস্থিত হইয়া একজন পুলিস-কর্ম্মচারীকে ঐ অনুসন্ধানে নিযুক্ত দেখিতে পাইলাম। বহুদিবস পূর্ব্বে আমরা অনেকগুলি পুলিস-কর্ম্মচারী একটী হত্যা-মোকদ্দমার অনুসন্ধানে নিযুক্ত ছিলাম, ইনিও আমাদিগের সহিত সেই অনুসন্ধান করিতে প্রবৃত্ত হন। মৃতদেহ দেখিয়া আমরা প্রথমতঃ কিছুই স্থির করিতে পারি না যে, কিরূপে উহাকে হত্যা করা হইয়াছে; কারণ উহার শরীরে কোনরূপ দাগ বা জখম ছিল না, বা বিষাদি ভক্ষণের কোনরূপ চিহ্নও পরিলক্ষিত হয় না। কিরূপে উহাকে হত্যা করা হইল, তাহা স্থির করিবার নিমিত্ত আমাদিগের মধ্যে অনেক তর্ক বিতর্ক হইতেছিল, সেই সময় ঐ কর্ম্মচারী বলিয়া উঠেন যে, গলা টিপিয়া উহাকে মারিয়া ফেলা হইয়াছে। প্রকৃতপক্ষে, ডাক্তারের পরীক্ষায়ও তাহাই সাব্যস্ত হয়। সেই সময় হইতে আমরা সকলেই উহাকে ডাক্তার বলিয়া ডাকিতে আরম্ভ করি ও ক্রমে উনি ডাক্তার নামেই পরিগণিত হইয়া পড়েন। সুতরাং ডাক্তার বলিয়াই আমি উহাকে অভিহিত করিব।
অনুসন্ধান উপলক্ষে ঐ স্থানে উপস্থিত হইয়া দেখিলাম, ডাক্তার ঐ অনুসন্ধানে নিযুক্ত আছেন, কিন্তু সেই সময় একখানি ভাড়াটিয়া গাড়ীতে উঠিবার উপক্রম করিতেছেন, আমাকে দেখিবামাত্র তিনি গাড়ীতে না উঠিয়া একটু দাঁড়াইলেন ও কহিলেন, “আপনি আসিয়াছেন, ভালই হইয়াছে। আমি যে স্থানে যাইতেছি, আপনিও সেই স্থানে আমার সঙ্গে আগমন করুন, নিজ কানে সমস্ত কথা না শুনিলে বিশেষ কিছুই স্থির করিয়া উঠিতে পারিবেন না।”
আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “হত হইয়াছে কে?”
ডাক্তার। নরেন্দ্রকৃষ্ণ নামক একটা বাবু।
আমি আশ্চর্য্য হইয়া ডাক্তারকে পুনরায় জিজ্ঞাসা করিলাম, “নরেন্দ্রকৃষ্ণ বাবু কে? তার কি হইয়াছিল? আমাকে সে সকল কথা কিছুই ত বলিলে না?”
ডাঃ। বলিব। তুমি আমার সঙ্গে যাইবে কি?
আমি। আবশ্যক হইলে কাজেই যাইতে হইবে।
ডাঃ। প্রথমত এই স্থানের অবস্থাগুলি একবার দেখিয়া লও; রাস্তায় যাইতে যাইতে সমস্ত অবস্থা বলিব। আমাদের প্রায় তিন ক্রোশ যাইতে হইবে। এই বলিয়া সেই স্থানের সমস্ত অবস্থা আমাকে দেখাইয়া তিনি একখানা গাড়ীতে উঠ্লেন। বলা বাহুল্য, আমিও তাহার সহিত সেই গাড়ীতে উঠিলাম। প্রায় এক ঘণ্টা গমন করিবার পর আমার বন্ধু দূরে দুটী আলোক আমাকে দেখাইয়া বলিল, “ঐযে দুটী আলোক দেখিতে পাইতেছ, বোধ হয় ঐখানেই আমাদিগকে যাইতে হইবে। আর দশ পনের মিনিটের মধ্যেই আমরা ঐ স্থানে উপস্থিত হইব।”
আমি বলিলাম, “ডাক্তার। আমরা ত এসে পড়্লুম, কিন্তু এখনও আমি সমন্ত অবস্থা জানতে পারি নাই। বলবে কখন?”
“এই যে বলি। আমি যতদূর শুনিয়াছি, তাহাতে এইমাত্র অবগত হইতে পারিলাম যে, খৃষ্টীয় ১৮৮৪ সালে নরেন্দ্রকৃষ্ণ নামে এক অতি ভদ্রলোক এই স্থানে আসিয়া বাস আরম্ভ করে। তাহার যথেষ্ট সম্পত্তি ছিল বলিয়া সকলেই অনুমান করিত। যাহা হউক, ক্রমে ক্রমে সেই নরেন্দ্রকৃষ্ণ সকলের প্রিয়পাত্র হয় এবং অতি অল্প কাল পরেই স্থানীয় এক ভদ্রলােকের কন্যাকে বিবাহ করিয়া সুখে স্বচ্ছন্দে সংসার-যাত্রা নির্ব্বাহ করিতে থাকে। নরেন্দ্রকৃষ্ণ যে কি কার্য্য করিত, তাহা কেহই জানিত না। তবে বড় বড় বণিকদিগের সহিত তাহার সদ্ভাব ছিল। তিনি প্রত্যহ প্রাতে সহরে যাইতেন এবং সন্ধ্যার সময়ে আবার স্বস্থানে ফিরিয়া আসিতেন। সকলে অনুমান করিত, তিনি দালালী করিয়া থাকেন। তিনি একজন সৎ লোক ও অতি শান্ত। তাহার পুত্রগণ ও স্ত্রী তাহার প্রতি বিশেষ অনুরক্ত। এখন তাহার বয়স প্রায় ৩৭ বৎসর এইরূপ শুনিয়াছি।
গত সােমবার নরেন্দ্রকৃষ্ণ বাবু অন্যান্য দিবস অপেক্ষা কিছু অধিক প্রাতে সহরে গমন করেন। যাইবার সময় এই বলিয়া যান, দুইটী কার্য্যোপলক্ষে তাঁহাকে এরূপ প্রাতে যাইতে হইতেছে। ফিরিবার সময় কনিষ্ঠ পুত্রের জন্য এক বাক্স খেলিবার কাঠের পুতুল আনিবেন।
.