মনন ও করণ

 পূর্ব্বে বাঙ্গলা মাসিকপত্রে উদ্ভিদ্‌-জীবন লইয়া যে একটি প্রবন্ধ লিখিয়াছিলাম, তাহাতে বলিয়াছিলাম যে, উদ্ভিদ্‌-জীবন মানব জীবনেরই ছায়া মাত্র। সেই প্রবন্ধটি লিখিতে এক ঘণ্টারও অধিক সময় লাগে নাই। কিন্তু সেই বিষয়টির কিয়দংশ মাত্র প্রতিষ্ঠা করিতে বহু বৎসর গিয়াছে। অতি সামান্য দ্রব্য গঠন করিতে অনেক চেষ্টা, অনেক অধ্যবসায়, অনেক পরিশ্রম এবং অনেক কলকারখানার আবশ্যক। কিন্তু মন কোন বাঁধন মানে না। উচ্ছৃঙ্খল চিন্তা নিমেষে স্বর্গ, মর্ত্ত্য এবং পাতাল পরিভ্রমণ করিয়া আসে। মুহূর্ত্তে স্বকল্পিত সত্য-মিথ্যা মিথ্যাঘটিত নূতন রাজ্য সৃজন করে এবং সে রাজ্য স্থাপনে যদি কেহ বাধা দেয় তাহা হইলে মানস-সম্ভব অক্ষৌহিণী সৈন্য ও অগ্নিবান সাহায্যে বিপক্ষ নাশ করিয়া একাধিপত্য স্থাপন করে।

 কিন্তু কার্য্য-জগতের কথা অন্যরূপ; এখানে পদে পদে বাধা। সমস্ত জীবনের চেষ্টা দিয়াও নিজের জীবন শাসন করিতে পারিলাম না, ইহা জানিয়াও নিজের কর্ত্তব্য ভুলিয়া পরের কর্ত্তব্য নির্দ্ধারণ করিবার বাসনা দূর হয় না। কঠিন পথ ত্যাগ করিয়া যাহা সহজ এবং যাহা কথা বলিয়াই নিঃশেষিত হয়, সেইদিকে ইচ্ছা স্বতঃই ধাবিত হয়।

 মনন ও করণ ইহার মধ্যে কত প্রভেদ! কার্য্যের গতি শম্বুকের গতি হইতেও মন্থর। কর্ম্ম-রাজ্যের কঠিন পথ দিয়া মন সহজে চলিতে চাহে না। এজন্য পথ-নির্দ্দেশকের অভাব নাই; কিন্তু পথের যাত্রী কই এই ভবের বাজারে?

‘সকল বিক্রেতা হেথা, ক্রেতা কেহ নাই।’

 বঙ্গজননীকে উচ্চ সিংহাসনে অধিষ্ঠিত দেখিবার ইচ্ছা সকলেরই আছে; কিন্তু তাহার উপায় উদ্ভাবন সম্বন্ধে স্বয়ং কষ্ট স্বীকার না করিয়া পরস্পরকে কেবলমাত্র তাড়না করিলে কোনো ফল পাইব না, এ কথা বাহুল্য। এই উদ্দেশ্যে প্রধানতঃ বঙ্গসন্তানদের বিবিধ ক্ষেত্রে কৃতিত্ব ও তাহাদের আত্মসম্মান-বোধ জাগরণ আবশ্যক; কিন্তু একথা অনেক সময় ভুলিয়া যাই। কর্ম্মক্ষেত্রে অপরে কি পথ অবলম্বন করিবে তাহা লইয়াই কেবল আলোচনা করি। কেহ কেহ দুঃখ করিয়াছেন যে, বঙ্গের দুই একটি কৃতী সন্তান তুচ্ছ যশের মায়াতে প্রকৃষ্ট পথ ত্যাগ করিয়াছেন। সেই মায়াবশেই বাঙ্গালী বৈজ্ঞানিক স্বীয় আবিষ্কার বিদেশী ভাষায় প্রকাশ করিবার লোভ সংবরণ করিতে পারিলেন না। যদি এই সকল তত্ত্ব কেবল বাঙ্গালা ভাষায় প্রকাশিত হইত তাহা হইলে বিদেশীরা অমূল্য সত্যের আকর্ষণে এদেশে আসিয়া বাঙ্গলা ভাষা শিখিতে বাধ্য হইত এবং প্রাচ্যের নিকট প্রতীচ্য মস্তক অবনত করিত।

 ইংরেজী ভাষায় বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ প্রকাশ সম্বন্ধে ইহা বলিলেই যথেষ্ট হইবে যে, আমার যাহা কিছু আবিষ্কার সম্প্রতি বিদেশে প্রতিষ্ঠা লাভ করিয়াছে, তাহা সর্ব্বাগ্রে মাতৃভাষায় প্রকাশিত হইয়াছিল এবং তাহার প্রমাণার্থ পরীক্ষা এদেশে সাধারণ-সমক্ষে প্রদর্শিত হইয়াছিল। কিন্তু আমার একান্ত দুর্ভাগ্যবশতঃ এদেশের সুধীশ্রেষ্ঠদিগের নিকট তাহা বহুদিন প্রতিষ্ঠালাভ করিতে সমর্থ হয় নাই। আমাদের স্বদেশী বিশ্ববিদ্যালয়ও বিদেশের হল্-মার্কা না দেখিতে পাইলে কোন সত্যের মূল্য সম্বন্ধে একান্ত সন্দিহান হইয়া থাকেন। বাঙ্গলা দেশে আবিষ্কৃত, বাঙ্গলা ভাষায় লিখিত তত্ত্বগুলি যখন বাঙ্গলার পণ্ডিতদিগের নিকট উপেক্ষিত হইয়াছিল তখন বিদেশী ডুবুরিগণ এদেশে আসিয়া যে নদীগর্ভে পরিত্যক্ত আবর্জ্জনার মধ্যে রত্ন উদ্ধার করিতে প্রয়াসী হইবেন, ইহা দুরাশা মাত্র।

 যে সকল বাধার কথা বলিলাম, তাহার পশ্চাতে যে কোন এক অভিপ্রায় আছে তাহা এতদিনে বুঝিতে পারিয়াছি। বুঝিতে পারিয়াছি, সত্যের সম্যক্‌ প্রতিষ্ঠা প্রতিকূলতার সাহায্যেই হয়, আর আনুকুল্যের প্রশ্রয়ে সত্যের দুর্ব্বলতা ঘটে। বৈজ্ঞানিক সত্যকে অশ্বমেধের যজ্ঞীয় অশ্বের মতো সমস্ত শত্রুরাজ্যের মধ্য দিয়া জয়ী করিয়া আনিতে না পারিলে যজ্ঞ সমাধা হয় না। এই কারণেই আমি যে সত্য-অন্বেষণ জীবনের সাধনা করিয়াছিলাম তাহা লইয়া গৌরব করা কর্ত্তব্য মনে করি নাই; তাহাকে জয়ী করাই আমার লক্ষ্য ছিল। আজিকার দিনে বৈজ্ঞানিক সত্যের বিরাট রণক্ষেত্র পশ্চিম দেশে প্রসারিত। পূর্ব্বে যুদ্ধক্ষেত্রে বাঙ্গালীর যেরূপ দুর্নাম ছিল, বিজ্ঞানক্ষেত্রেও ভারতবাসীদের সেইরূপ নিন্দা ঘোষিত হইত। তাহার বিরুদ্ধে যুঝিতে যাইয়া আমি বারংবার প্রতিহত হইয়াছিলাম। মনে করিয়াছিলাম, এ-জীবনে ব্যর্থতাই আমার সাধনার পরিণাম হইবে। কিন্তু ঘোরতর নিরাশার মধ্যেও আমি অভিভব স্বীকার করি নাই। তৃতীয়বার পশ্চিম-সমুদ্র পার হইলাম এবং বিধাতার বরে সার্থকতা লাভ করিতে পারিলাম। এই সুদীর্ঘ পরিণামে যদি জয়মাল্য আহরণ করিয়া থাকি তবে তাহা দেশলক্ষ্মীর চরণেই নিবেদন করিতেছি।

 সত্য বটে, আমাদের পূর্ব্বপুরুষগণ যে সকল অমর তত্ত্ব রাখিয়া গিয়াছেন, তাহা দুই চারিজন বিদেশী কষ্ট স্বীকার করিয়া বুঝিতে চেষ্টা করিয়াছেন। সে কারণে প্রতীচ্য বর্ত্তমান যুগের প্রাচ্যের নিকট মস্তক অবনত করিয়াছে, এরূপ কোনো লক্ষণ দেখি না। গ্রীক এবং ইউরোপীয় সভ্যতা প্রাচীন মিশর-সভ্যতার নিকট বহু ঋণে ঋণী; কিন্তু সেই মিশর জাতীয় বংশধর ফেলাহীন আজ জগতে ঘৃণ্য। হে বেদ-উপনিষদ রচয়িতার বংশধর, হে ভারতীয় ফেলাহীন, আজ তোমার স্থান কোথায়?

 হায় আলনস্কর, তোমার দিবাস্বপ্ন কি কোনোদিন ভাঙ্গিবে না? তোমার পণ্যদ্রব্য শুধু গিল্টি ও কাচ। স্বর্ণ ও হীরক বলিয়া তাহা বিক্রয় করিবে মনে করিয়াছিলে এবং অলীক ধনে আপনাকে ধনী মনে করিয়া ভাগ্যলক্ষ্মীকে পদাঘাত করিলে। দর্শকগণের উপহাস এত অল্পদিনেই ভুলিয়াছ? কি বলিতেছে? তোমার পূর্ব্বপুরুষগণ ধনী ছিলেন, তাঁহারা পুষ্পক রথে বিমানে বিহার করিতেন! মূঢ়, তবে কি করিয়া সেই সস্পদ হারাইলে? চাহিয়া দেখ- দূরে যে ধবল পর্ব্বত দেখিতেছ তাহা নরকঙ্কালে নির্ম্মিত। তুমি যাহাদিগকে ম্লেচ্ছ বলিয়া মনে কর, উহা তাহাদেরই অস্থিস্তূপ। দেখ, কাহারা সেই অস্থিনির্ম্মিত সোপান বাহিয়া গিরিশৃঙ্গে উঠিয়াছে এবং শূন্যে ঝাঁপ দিয়া নীলাকাশে তাহাদের আধিপত্য বিস্তার করিয়াছে। উড্ডীয়মান শ্যেনপক্ষীশ্রেণী বলিয়া যাহা মনে করিয়াছ, দেখিতে দেখিতে সেগুলি মেঘের অন্তরালে অন্তর্হিত হইল। অবাক হইয়া তুমি ঊর্দ্ধে চাহিয়া আছ। অকস্মাৎ মেঘরাজ্য হইতে নিক্ষিপ্ত বহ্নিশেল তোমার চতুর্দ্দিকে পৃথিবী বিদীর্ণ করিল। কোথায় তুমি পলায়ন করিবে? গহ্বরে প্রবেশ করিয়াও নিস্তার নাই। বিষ-বাহক বাষ্পে তোমাকে সে স্থান হইতেও বাহির হইতে হইবে।

 কথার গ্রন্থিবন্ধনে আমরা যে জাল বিস্তার করিয়াছি, সেই জালে আপনারাও আবন্ধ হইয়াছি। সে জাল কাটিয়া বাহির হইতে হইবে। মাতৃদেবীকে অযথা সভাস্থলে আনিয়া তাঁহার অবমাননা করিও না। হৃদয়-মন্দিরেই তাঁহার প্রকৃত পীঠস্থান; জীবন-উৎসর্গই তাঁহার পূজার উপকরণ।