অমৃত-দ্বীপ/প্রথম পরিচ্ছেদ
প্রথম পরিচ্ছেদ
শত্রুর উপরে শত্রু
জাহাজ ভেসেছে নীল জলে। এ জাহাজ একেবারেই তাদের নিজস্ব।
অমৃত-দ্বীপে যাবার সমস্ত জলপথটাই তাদের ম্যাপে আঁকা ছিল। সেই ম্যাপ দেখেই বোঝা যায়, কোন বাণিজ্য-তরী বা যাত্রী-জাহাজই ও-দ্বীপে গিয়ে লাগে না, ‘চার্টে’ ও-দ্বীপের কোন উল্লেখই নেই।
কাজেই বিমল ও কুমারের প্রস্তাবে একখানা গোটা জাহাজই ‘চার্টার’ বা ভাড়া করা হয়েছে। এটাও তাদের পক্ষে নতুন নয়। কারণ এই রকম একখানা গোট। জাহাজ ভাড়া ক’রেই তারা আর; একবার “লষ্ট্ আট্ট্লাণ্টিস্”-কে পুনরাবিষ্কার করেছিল।[১]
জয়ন্ত, মাণিক ও সুন্দরবাবুর এ অভিযানে যোগ দেবার ইচ্ছা ছিল না। বিমল ও কুমার একরকম জোর ক’রেই তাদের সঙ্গে টেনে এনেছে।
কাজে-কাজেই তাদের পুরাতন ভৃত্য ও দস্তুরমত অভিভাবক রামহরিও যথেষ্ট বিরক্তি প্রকাশ ক’রেও অন্যান্য বারের মত এবারেও শেষ-পর্য্যন্ত সঙ্গ নিতে ছাড়ে নি।
এবং এমন ক্ষেত্রে তাদের চির-অনুগত চতুষ্পদ যোদ্ধা বাঘাও যে সঙ্গে সঙ্গে লাঙ্গুল আস্ফালন ক’রে আসতে ছাড়বে না, সে কথা বলাই বাহুল্য।
তাদের পুরাতন দলের মধ্যে কেবল বিনয়বাবু আর কমলকে এবারে সঙ্গীরূপে পাওয়া গেল না। বিনয়বাবু এখন ম্যালেরিয়ার তাড়নায় কুইনিন ও আদার কুচির সদ্ব্যবহারে ব্যস্ত এবং কমল দেবে এবার মেডিকেল কলেজের শেষ পরীক্ষা।
জাহাজখানির নাম “লিট্ল ম্যাজেষ্টিক”। আকারে ছোট হ’লেও যাত্রীদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের জন্যে এর মধ্যে চমংকার সাজানো-গুছানো ‘লাউঞ্জ’, ‘ডাইনিং সেলুন’, ‘প্রমেনেড ডেক’ ও ‘পাম-কোট’ প্রভৃতিরও অভাব ছিল না। এ-রকম জাহাজ ‘চার্টার’ করা বহুব্যয়সাধ্য বটে, কিন্তু বিমল ও কুমার যে অত্যন্ত ধনবান এ-কথা সকলেই জানেন। তার উপরে জয়ন্তও বিনা পয়সার অতিথি হ’তে রাজি হয় নি এবং সেও রীতিমত ধনী ব্যক্তি।
জাহাজ তখন টুংহাই বা পূর্ব্বসাগর প্রায় পার হয়ে রিউ-কিউ দ্বীপপুঞ্জের কাছ দিয়ে প্রশান্ত মহাসাগরের দিকে অগ্রসর হ’চ্ছে।
উপরে, নীচে চারিদিকে ছড়িয়ে আছে কেবল অনন্ত নীলিমা-কাছে চঞ্চল, দূরে প্রশান্ত।
এই নীলিমার জগতে এখন নূতন বর্ণ সৃষ্টি করছে নিম্নে শুধু শুভ্র ফেনার মালা এবং শূন্যে শুভ্র সাগর-বিহঙ্গের দল। প্রকৃতির রঙের ভালায় এখন আর কোন রং নেই।
প্রাকৃতিক সঙ্গীতেও এখানে নব নব রাগিণীর ঝঙ্কার নেই। না আছে উচ্ছ্বসিত শ্যামলতার মর্ম্মর, না আছে গীতকারী পাখীদের সুরের খেলা, বইছে কেবল হু-হু শব্দে দুরন্ত বাতাস এবং জাগছে কেবল আদিম সাগরের উচ্ছল কল্-কল্ মন্ত্র——এ-দুই ধ্বনিরই সৃষ্টি পৃথিবীর প্রথম যুগে, যখন সবুজ গাছ আর গানের পাখীর জন্মই হয় নি।
খোলা ‘প্রমেনেড ডেকে’র উপরে পায়চারি করতে করতে মাণিক বললে, “আমাদের সমুদ্র যাত্রা শেষ হ’তে আরো কত দেরি বিমলবাবু?”
বিমল বললে, “আর বেশী দেরি নেই। চার ভাগ পথের তিন ভাগই আমরা পার হয়ে এসেছি। ম্যাপখানা আমার মুখস্থ হয়ে গেছে। আরো কিছু দূর এগুলেই বোনিন্ দ্বীপপুঞ্জের কাছে গিয়ে পড়ব। তাদের বাঁয়ে রেখে আমাদের অগ্রসর হ’তে হবে প্রায় পূর্বব-দক্ষিণ দিকে। তারপরই অমৃত-দ্বীপ।”
মাণিক বললে, “দ্বীপটি নিশ্চয়ই বড় নয়। কারণ তাহ’লে নাবিকদের ‘চার্টে’ তার উল্লেখ থাকত। এখানকার সমুদ্রে এমন অজানা ছোট ছোট দ্বীপ দেখছি তো অসংখ্য। অমৃত-দ্বীপকে আপনি চিনবেন কেমন ক’রে?”
—“ম্যাপে অমৃত-দ্বীপের ছোট্ট একটা নক্সা আছে, আপনি কি ভালো ক’রে দেখেন নি? সে দ্বীপের প্রথম বিশেষত্ব হচ্ছে, তার চারিপাশই পাহাড় দিয়ে ঘেরা— পাহাড় কোথাও কোথাও দেড়-দুই হাজার ফুট উঁচু। তার দ্বিতীয় বিশেষত্ব, দ্বীপের ঠিক উত্তর-পশ্চিম কোণে পাহাড়ের উপরে আছে ঠিক পাশাপাশি পাঁচটি শিখর। সবচেয়ে উঁচু শিখরের উচ্চতা দুই হাজার তিন শো ফুট। এ-রকম দ্বীপ দূর থেকে দেখলেও চেনা শক্ত হবে না।”—ব’লেই ফিরে দাঁড়িয়ে বিমল চোখে দূরবীণ লাগিয়ে সমুদ্রের পশ্চিম দিকে তাকিয়ে কি দেখতে লাগল।
সুন্দরবাবু বললেন, “হুম্! আচ্ছা বিমলবাবু, আমরা যাচ্ছি তো পূর্ব্বদিকে। অথচ আজ ক’দিন ধ’রেই আমি লক্ষ্য করছি, আপনি যখন-তখন চোখে দূরবীণ লাগিয়ে পশ্চিম দিকে কি যেন দেখবার চেষ্টা করছেন! এর মানে কি?”
জয়ন্ত এতক্ষণ পরে মুখ খুলে বললে, “এর মানে আমি আপনাকে বলতে পারি। বিমলবাবু দেখছেন আমাদের পিছনে কোন শত্রুজাহাজ আসছে কি না!”
—“এখানে আবার শত্রু আসবে কে?”
—“কেন, কলকাতাকে যারা ড্রাগনের দুঃস্বপ্ন দেখিয়েছিল, আপনি এরি মধ্যে তাদের কথা ভুলে গেলেন নাকি?”
—“কী যে বল তার ঠিক নেই! সে দল তো ছত্রভঙ্গ হয়ে গেছে।”
—“কেমন ক’রে জানলেন?”
—“পালের গোদা কুপোকাৎ হ’লে দল কি আর থাকে?”
দূরবীণ নামিয়ে বিমল বললে, “আমার বিশ্বাস অন্য রকম। সে দলের প্রত্যেক লোকই মরিয়া, তারা সকলেই অমৃত-দ্বীপে যাবার জন্যে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। কিন্তু ও-দ্বীপের ঠিকানা তারা জানে না, কারণ ম্যাপখানা আছে আমাদের হাতে। আমরা যে তাদের দেশের কাছ দিয়ে অমৃত-দ্বীপে যাত্রা করেছি, নিশ্চয়ই এ-সন্ধান তারা রাখে। যারা লাউ-ৎজুর মূর্ত্তি আর ঐ ম্যাপের লোভে সুদূর চীন থেকে বাংলাদেশে হানা দিতে পেরেছিল তারা যে আর একবার শেষ চেষ্টা করে দেখবে না, এ-কথা আমার মনে হয় না।”
সুন্দরবাবু বললেন, “হুম্, শেষ-চেষ্টা মানে? আপনি কি বলতে চান, তাদের জাহাজের সঙ্গে আমাদের জলযুদ্ধ হবে?”
—“আশ্চর্য্য নয়।”
সুন্দরবাবু বিস্ফারিত চক্ষে ও উত্তেজিত কণ্ঠে বললেন, “আশ্চর্য্য নয় মানে? জলযুদ্ধ অম্নি হ’লেই হ’ল? আমাদের সেপাই কোথায়? কামান কোথায়? আমরা ঘুসি ছুঁড়ে লড়াই করব নাকি?”
কুমার হেসে বললে, “কামান নেই বা রইল, আমাদের সকলেরই হাতে আছে অটোমেটিক বন্দুক। আর আমাদের সেপাই হচ্ছি আমরাই।”
সুন্দরবাবু অধিকতর উত্তেজিত হয়ে আরো কি বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু হঠাৎ বিকট স্বরে “হুম্” শব্দ ক’রে মস্ত এক লাফ মেরে পাঁচ হাত তফাতে গিয়ে পড়লেন।
মাণিক বললে, “কি হ’ল সুন্দরবাবু, কি হ’ল? আপনার ভুঁড়িটা কি ফট্ ক’রে ফেটে গেল?”
সুন্দরবাবু ক্রুদ্ধ স্বরে বললেন, “যাও, যাও! দেখতে যেন পাও নি, আবার ন্যাকামি করা হচ্ছে! কুমারবাবু, আপনার ঐ হতচ্ছাড়া কুকুরটাকে এবার থেকে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখবেন। আমাকে দেখলেই ও-বেটা কোত্থেকে ছুটে এসে ফোঁশ্ ক’রে আমার পায়ের ওপরে নিঃশ্বাস ফেলে কি শোঁকে, বলতে পারেন মশাই?”
মাণিক বললে, “আপনার পাদপদ্মের গন্ধ বাঘার বোধ হয় ভালো লাগে।”
—“ইয়ার্কি কোরো না মাণিক, তোমার ইয়ার্কি বাঘার ব্যবহারের চেয়েও অভদ্র। ঐ নেড়ে-কুত্তোটাকে আমি কিছুতেই সহ্য করতে পারব না, চলুম আমি এখান থেকে।”
সুন্দরবাবু লম্বা লম্বা পা ফেলে অদৃশ্য হ’লেন, বাঘা বিলক্ষণ অপ্রতিভভাবে ফ্যাল্-ফ্যাল্ ক’রে তাকিয়ে রইল। এ লোকটি যে তাকে দু-চোখে দেখতে পারে না, এটা সে খুবই বোঝে। তাই বাঘার কৌতূহল হয়, সুন্দরবাবুকে কাছে পেলেই সে তাঁর পা শুঁকে দেখে। মানুষের চরিত্র পরীক্ষা করবার এর চেয়ে ভদ্র উপায় পৃথিবীর কোন কুকুরই জানে না।
পরদিন প্রভাতে ‘ব্রেক্ফাষ্টে’র পর বিমল ও কুমার জাহাজের ডেকে উঠে গেল। জয়ন্ত লেব্লাকের লেখা একখানা ডিটেক্টিভ উপন্যাস নিয়ে ‘লাউঞ্জে’ গিয়ে আরাম করে বসল, মাণিকও তার দৃষ্টান্ত অনুসরণ করলে।
সুন্দরবাবু বিরক্তি-ভরে বললেন, “জাহাজে উঠে পর্য্যন্ত দেখছি, বিমলবাবু আর কুমারবাবু অদৃশ্য শত্রুর কাল্পনিক ছায়া দেখবার জন্যে ব্যতিব্যস্ত, আর তোমরা গাঁজাখুরি ডিটেক্টিভের গল্প নিয়েই বিভোর। কারুর সঙ্গে দুটো প্রাণের কথা বলবার ফাঁক নেই!”
জয়ন্ত জবাব দিলে না। মাণিক বললে, “আচ্ছা, এই রইল আমার বই! এখন প্রকাশ করুন আপনার প্রাণের কথা।”
সুন্দরবাবু নিম্নস্বরে বললেন, “কথাটা কি জানো? এই অমৃতদ্বীপ, অমর-লতা, জলে-স্থলে-শূন্যে চিরজীবী মানুষের অবাধ গতি, এ-সব কি তুমি বিশ্বাস কর ভায়া?”
-“আমার কথা ছেড়ে দিন। আগে বলুন, আপনার কি মত?”
-“হুম্, আমার কেমন সন্দেহ হচ্ছে! বিমল আর কুমার বাবুর মাথায় তোমাদেরও চেয়ে বোধ হয় বেশী ছিট্ আছে!”—ব’লেই সুন্দরবাবু ফোঁঁশ, ক’রে একটা নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন।
—“হঠাৎ অমন দীর্ঘশ্বাস ফেললেন কেন?”
—“কি জানো ভায়া, প্রথমটা আমার কিঞ্চিৎ লোভ হয়েছিল। এখন মনে হচ্ছে, সবই ভুয়ো! যা নয় তাই!”
—“কিসের লোভ সুন্দরবাবু?”
—“ঐ অমর-লতার লোভ আর কি! ভেবেছিলুম দু-একটা অমৃত-ফল খেয়ে যমকে কলা দেখাব। কিন্তু এখন যতই ভেবে দেখছি ততই হতাশ হয়ে পড়ছি। আমরা ছুটেছি মরীচিকার পিছনে, কেবল কাদা ঘেঁটেই ফিরে আসতে হবে।”
—“তাহ’লে আপনি কেবল অমর হবার লোভেই বিমলবাবুদের অতিথি হয়েছেন?” —“না বলি আর কেমন করে? অমর হ’তে কে না চায়?”
—“অমর হওয়ার বিপদ কত জানেন?”
—“বিপদ?”
—“হ্যাঁ। দু-একটার কথা বলি শুনুন। ধরুন, আপনি অমর হয়েছেন। তার পর কুমারবাবুর কুকুর বাঘা হঠাৎ পাগ্লা হয়ে গিয়ে আপনাকে কামড়ে দিলে। তখন কি হবে?”
—“হুম্, কী আবার হবে? আমি হাইড্রোফোবিয়া রোগের চিকিৎসা করাব!”
—“চিকিৎসায় রোগ যদি না সারে, তাহ’লে? আপনি অমর, সুতরাং মরবেন না। কিন্তু সারাজীবন—অর্থাৎ অনন্তকাল আপনাকে ঐ বিষম রোগের যন্ত্রণা ভোগ করতে হবে।—অর্থাৎ সারা-জীবন চেঁচিয়ে মরতে হবে পাগ্লা কুকুরের মতন ঘেউ-ঘেউ ক’রে!”
—“তাই তো হে, এ-সব কথা তো আমি ভেবে দেখি নি!”
—“তার পর শুনুন। আপনি অমর হ’লেও আপনার দেহ বোধ করি অস্ত্রে অকাট্য হবে না। কেউ যদি খাঁড়া দিয়ে আপনার গলায় এক কোপ, বসিয়ে দেয়, তাহলে কি মুস্কিল হতে পারে ভেবে দেখেছেন কি? আপনি অমর। অতএব হয় আপনার মুণ্ড, নয় আপনার দেহ, নয়তো ও-দুটোই চিরকাল বেঁচে থাকবে। কিন্তু সেই কন্ধকাটা দেহ আর দেহহীন মুণ্ড নিয়ে আপনি অমরতার কি সুখ ভোগ করবেন?”
—“মাণিক, তুমি কি ঠাট্টা করছ?”
—“মোটেই নয়। অমর হওয়ার আরো সব বিপদের কথা শুনতে চান?”
— “না, শুনতে চাই না। তুমি বড্ড মন খারাপ ক’রে দাও। অমৃত-ফল পেলেও আমি আর খেতে পারব কিনা সন্দেহ।”
জয়ন্ত এতক্ষণ কেতাবের আড়ালে মুখ লুকিয়ে হাসছিল। এখন কেতাব সরিয়ে বললে, “সুন্দরবাবু, অমৃত-দ্বীপের কথা হয়তো রূপকথা ছাড়া আর কিছুই নয়। কিন্তু আজকের শুক্নো বৈজ্ঞানিক জগতে সরস রূপকথার বড়ই অভাব হয়েছে। সেই অভাব পূরণের কৌতূহলেই আমরা বেরিয়েছি অমৃত-দ্বীপের সন্ধানে। সুতরাং অমর-লতা না পেলেও আমরা দুঃখিত হব না। অন্তত যে ক’দিন পারি রূপকথার রঙিন কল্পনায় মনকে স্নিগ্ধ ক’রে তোলবার অবকাশ তো পাব! আর ওরই মধ্যে থাকবে যেটুকু অ্যাড্ভেঞ্চার, সেটুকুকে মস্ত লাভ ব’লেই মনে করব!”
এমন সময়ে একজন নাবিক এসে খবর দিলে, বিমল সবাইকে এখনি ডেকের উপরে যেতে বলেছে।
সকলে উপরে গিয়ে দেখলে, ডেকের রেলিংয়ের উপরে ঝুঁকে বিমল দাঁড়িয়ে রয়েছে, তার চোখে দূরবীণ।
জয়ন্ত জিজ্ঞাসা করলে, “বিমলবাবু কি আমাদের ডেকেছেন?” *
বিমল ফিরে বললে, “হ্যাঁ জয়ন্তবাবু! পশ্চিম দিকে তাকিয়ে দেখুন।”
পশ্চিম দিকে চেয়েই জয়ন্ত দেখতে পেলে, একখানা জাহাজ তাদের দিকে বেগে এগিয়ে আসছে।
বিমল বললে, “আমি খুব ভোরবেলা থেকেই ও জাহাজখানাকে লক্ষ্য করছি। প্রথমটা ওর ওপরে আমার সন্দেহ হয় নি। কিন্তু তার পরে বেশ বুঝলুম, ও আসছে আমাদেরই পিছনে। জানেন তো এখানকার সমুদ্রে চীনে-বোম্বেটেদের কি-রকম উৎপাত খুব সম্ভব, আমাদের শত্রুরা কোন বোম্বেটে জাহাজের আশ্রয় নিয়েছে। দূরবীণ দিয়ে দেখা যাচ্ছে, ও-জাহাজখানায় লোক আছে অনেক-আর অনেকেরই হাতে রয়েছে বন্দুক। আমাদের কাপ্তেন-সায়েবের সঙ্গে আমি আর কুমার পরামর্শ করেছি। কাপ্তেন বললেন, জলে ওরা আক্রমণ করলে আমাদের পক্ষে আত্মরক্ষা করা সহজ হবে না।”
—“তাহ’লে উপায়?”
—“দক্ষিণ দিকে তাকিয়ে দেখুন।”
দক্ষিণ দিকে মাইল-দুয়েক তফাতে রয়েছে ছোট্ট একটি তরুশ্যামল দ্বীপ।
—“আমরা আপাতত ঐ দ্বীপের দিকেই যাচ্ছি! আশা করি শত্রুদের জাহাজ আক্রমণ করবার আগেই আমরা ঐ দ্বীপে গিয়ে নামতে পারব। তার পর পায়ের তলায় থাকে যদি মাটি, আর একটা যুৎসই স্থান যদি নির্ব্বাচন করতে পারি, তাহলে এক হাজার শত্রুকেও আমি ভয় করি না। আপনার কি মত?”
জয়ন্ত বললে, “বিমলবাবু, এ অভিযানের নায়ক হচ্ছেন আপনি। আমরা আপনার সহচর মাত্র। আপনার মতেই আমাদের মত।”
সুন্দরবাবু নীরস স্বরে বললেন, “তাহ’লে সত্যি-সত্যিই আমাদের যুদ্ধ করতে হবে?”
কুমার বললে, “তা ছাড়া আর উপায় কি? বিনা যুদ্ধে ওরা আমাদের মুক্তি দেবে ব’লে বোধ হয় না। তবে আশার কথা এই যে, আমরা ওদের আগেই ডাঙায় গিয়ে নামতে পারব।”
সুন্দরবাবু বিষণ্ণভাবে বললেন, “এর মধ্যে আশা করবার মত কিছুই আমি দেখতে পাচ্ছি না। ঐ চীনে বোম্বেটে-বেটারাও তো দলে দলে ডাঙায় গিয়ে নামবে?”
—“ভুলে যাবেন না, আমরা থাকব ডাঙায়, গাছপালা বা ঢিপিঢাপা বা পাথরের আড়ালে লুকিয়ে। আমাদের এই অটোমেটিক বন্দুকগুলোর সুমুখ দিয়েই নৌকোয় ক’রে ওদের ডাঙার ওপরে উঠতে হবে। আমাদের এক-একটা অটোমেটিক বন্দুক প্রতি মিনিটে কত গুলি বৃষ্টি করতে পারে জানেন তো? সাতশো! আধুনিক বিজ্ঞানের অদ্ভুত মারণাস্ত্র!”
সুন্দরবাবু ভয়ে ভয়ে বললেন, “কিন্তু এ-ভাবে মানুষ খুন ক’রে শেযটা আইনের পাকে আমাদেরও বিপদে পড়তে হবে না তো?”
কুমার হেসে বললে, “সুন্দরবাবু, এ জায়গা হচ্ছে অরাজক। এই বোম্বেটেদের জল-রাজ্যে একমাত্র আইন হচ্ছে— হয় মারো, নয় মরো।”
সুন্দরবাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “হুম্!”
বিমল তখন আবার চোখে দূরবীণ লাগিয়ে শত্রু-জাহাজের গতিবিধি লক্ষ্য করছিল। কিন্তু সে জাহাজ তখন এত কাছে এসে পড়েছে যে আর দূরবীণের দরকার হয় না। খালি চোখেই বেশ দেখা যাচ্ছে, তার ডেকের উপরে দলে দলে চীনেম্যান ব্যস্ত, উত্তেজিত ভাবে এদিকে-ওদিকে আনাগোনা বা ছুটাছুটি করছে!
হঠাৎ বিমল দূরবীণ নামিয়ে আবার ফিরে দাঁড়াল। তার মুখ বিবর্ণ, দৃষ্টি ভয়-চকিত।
বিমলের মুখে-চোখে ভয়ের চিহ্ন! এটা যে অসম্ভব! কুমার রীতিমত অবাক্ হয়ে গেল।
জয়ন্ত বিস্মিত স্বরে বললে, “কি হ’ল বিমলবাবু, আপনার মুখচোখ অমনধারা কেন?”
বিমল দূরবীণটা জয়ন্তের হাতে দিয়ে গম্ভীর স্বরে বললে, “শত্রুজাহাজের পিছনে চেয়ে দেখুন, বোম্বটেদেরও চেয়ে ভয়াবহ এক শত্রু আমাদের গ্রাস করতে আসছে! আমি এখন ‘ব্রিজে’র ওপরে কাপ্তেনের কাছে চললুম, আরো তাড়াতাড়ি ঐ দ্বীপে গিয়ে উঠতে না পারলে আর রক্ষা নেই!”
সুন্দরবাবু আঁৎকে উঠে বললেন, “বোম্বেটেরও চেয়ে ভয়াবহ শত্রু? ও বাবা, বলেন কি?”
—“হ্যাঁ, হ্যাঁ, সুন্দরবাবু! এমন আর এক শত্রু আমাদের আক্রমণ করতে আসছে, যার নামে ভয়ে কাঁপে সারা দুনিয়া! তার সামনে আমাদের অটোমেটিক বন্দুকও কোন কাজে লাগবে না!”
—এই ব’লেই বিমল জাহাজের ‘ব্রিজে’র দিকে ছুটল দ্রুতপদে।
- ↑ “নীলসায়রের অচিন্ পুরে” নামক উপন্যাস দ্রষ্টব্য।