অলৌকিক নয়, লৌকিক (তৃতীয় খণ্ড)/দ্বিতীয় পর্ব/অধ্যায়: দুই


অধ্যায় দুই


সেঞ্চুরি—১

সূচি :

 ১। কবিতা—৩ : ফরাসি বিপ্লব।

 ২। কবিতা—৪ : নেপোলিয়নের আবির্ভাব।

 ৩। কবিতা—১০ : হেনরি III-র মৃত্যু।

 ৪। কবিতা—১৭ : খরা ও বন্যা।

 ৫। কবিতা—২৩ : ওয়াটারলু’র যুদ্ধ।

 ৬। কবিতা—২৬ : কেনেডি হত্যা।

 ৭। কবিতা—৩৪ : হিটলার।

 ৮। কবিতা—৩৫ : হেনরি II-র মৃত্যু।

 সেঞ্চুরি-১ হল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এতে বেশ কিছু বিখ্যাত ঘটনার ব্যাখা আছে। তাই সেঞ্চুরি—১ থেকে আটটি কবিতার বিশ্লেষণ করলাম। অন্যান্য সেঞ্চুরিতে এত ঘটনার ঘনঘটা নেই। তাই অন্যান্য সেঞ্চুরি থেকে গোটা পাঁচেক করে কবিতার বিশ্লেষণ করেছি।

সেঞ্চুরি এক

 ভূমিকাতেই বলেছি, কলেবর ও দামের কথা ভেবে আমি নস্ট্রাডামুসের সমস্ত শ্লোকের ব্যাখ্যা এই বইতে হাজির করলাম না। তবে যে-সব পৃথিবী কাঁপানো শ্লোকের ব্যাখ্যা হাজির করব, আশা করি তা থেকেই পাঠক-পাঠিকাদের নস্ট্রাডামুস-রহস্য ভেদ করা কঠিন হবে না।

 প্রথম সেঞ্চুরির কবিতা বা শ্লোক এক আর দুই সম্বন্ধে গোড়াতেই আলোচনা করেছি। তাই ওই দুটো বাদ দিয়ে পরবর্তী শ্লোকগুলোতে চলে যাচ্ছি।

কবিতা—৩ (সেঃ – ১)

Quand la licture du tourbillon versee.
Et serout faces de leurs manteaur convers:
La republique par gens noubeaur vexce,
Lors blance & rouges jugerout a l'envers.

 এর অর্থ :

ঘুর্ণিঝড়ে যখন বিছানাপত্তর ওলটপালট হয়ে যাবে,
তখন মানুষজন কাপড় দিয়ে মুখ ঢাকবে :
নতুন রাজ্যে অশান্তি লেগে থাকবে,
আর লাল-সাদারা এলোমেলো রাজ্যশাসন করবে।

 ব্যাখ্যাকারদের ব্যাখা : ফরাসি বিপ্লব

 ব্যাখ্যাকার এরিকা চিটহ্যামের মতে এখানে নাকি ফরাসি বিপ্লবের কথা বলা হয়েছে। ঘূর্ণিঝড় মানেই ফরাসি বিপ্লব। আর কাপড় দিয়ে মুখ ঢাকবে বলতে নাকি নস্ট্রাডামুস বলতে চেয়েছিলেন, লোকজনের মুণ্ডু গিলোটিনে কেটে ফেলা হবে! (বুঝুন ব্যাপার) আর ফরাসি বিপ্লবের সময়ে রাজ্যে অশান্তি তো ছিলই।

 যুক্তিবাদী বিশ্লেষণ :

 এই কবিতাটা আর যুক্তিবাদী বিশ্লেষণ নাই বা করলাম। পাঠকরা তো দেখতেই পাচ্ছেন ব্যাখ্যাকারের ব্যাখ্যাটা কেমন বীভৎসরকম হাস্যকর। বিছানাপত্তর এলোমেলো করা ঘূর্ণিঝড় মানেই ফরাসি বিপ্লব? আর কাপড় দিয়ে মুখঢাকা মানেই গিলোটিনে মানুষের মুণ্ডু কাটা যাবে! হায়!! লাল-সাদারা তাহলে কে?

সত্যি বলতে কি, মাথায় একটু বুদ্ধি থাকলে, আর একটু
ইতিহাস জানা থাকলে, নস্ট্রাডামুসের যে কোনো
কবিতার যা খুশি ব্যাখ্যা করে, ইতিহাসের যে
কোনো একটা ঘটনার সঙ্গে জুড়ে দেওয়া
যায়। আর ব্যাখ্যাকাররা
সেটাই করছেন॥

কবিতা—৪ (সেঃ—১)

Par l'univers sera faict un monarque,
Qu’en paix & vre ne sera longuement,
Lors se perldra la fiscature barque,
Sera regie en plus grand detriment.

 এর অর্থ :

পৃথিবীর কোনো এক জায়গায় শাসন করবে এক রাজা,
যে শান্তি পাবে না,
আর তার রাজ্যকালও হবে ছোট্ট
শান্তি আসবে না তার রাজত্বে।

 ব্যাখ্যাকারের ব্যাখ্যা : নেপোলিয়ানের আবির্ভাব শ্লোকে সূচিত হয়েছে। সবচেয়ে খ্যাতনামা ব্যাখ্যাকার এরিকা’র মতে এই কবিতাতে নেপোলিয়ানের কথাই বলা হয়েছে। কেন না নেপোলিয়ান মাত্র দশ বছর রাজত্ব করেছিলেন। তিনি নিজে শাস্তি পাননি, প্রজাদেরও পেতে দেননি।

 যুক্তিবাদী বিশ্লেষণ :

 প্রথম দর্শনে এই ব্যাখ্যা পাঠকদের ঘাবড়ে দিতেই পারে। কিন্তু ভেবে দেখুন তো, পৃথিবীর বেশিরভাগ রাজাই তো অল্প কয়েক বছর (চার-পাঁচ বছর) রাজত্ব করে সিংহাসন হাতছাড়া করেছেন। বেশিরভাগ রাজাই তো শান্তি পাননি, প্রজাদেরও শান্তি দেননি। এতে বিশেষভাবে নেপোলিয়নের নাম আসছে কেমন করে? নেপোলিয়ন তো বরং বেশ অনেক বছরই রাজত্ব করেছিলেন, এই সব অসংখ্য ছোট ছোট রাজাদের তুলনায়। তাহলে?

কবিতা – ১০ (সেঃ—১)

Serpens transmis dans la caige de fer,
Ou enfans septaines du Roy sont pris :
vieux & peres sortiront bas de l’enfer,
Ains mourir voir de fruict mort & cris.

 অর্থাৎ :

লোহার ভল্টে রাখা হবে এক কফিন
মৃত রাজা তার মৃত ছয় বোনের দেখা পাবে সেখানেই :
পাতাল থেকে উঠে আসবে পূর্বপুরুষরা,
তাদের বংশধরদের এ-হেন মৃত্যুতে শোক করতে।

 ব্যাখ্যাকারের ব্যাখ্যা : তৃতীয় হেনরির মৃত্যু  এরিকার মতে এই কবিতাতে রাজা তৃতীয় হেনরির মৃত্যুর কথাই বলা হয়েছে। হেনরির ছিল ছয় ভাই-বোন। ‘পাতাল থেকে উঠে আসবে পূর্বপুরুষরা’ লাইনটা’ একটু গোলমাল বাধিয়েছে, এরিকা স্বীকার করেছেন।

 যুক্তিবাদী বিশ্লেষণ :

 শেষ দুটো লাইন অবাস্তব। ও লাইন দুটো নিয়ে আর কিছু বললাম না। প্রথম আর দ্বিতীয় লাইন দুটো দেখা যাক। তৃতীয় হেনরি এবং তার ছয় ভাইবোনের জন্ম নস্ট্রাডামুসের চোখের সামনেই। এমনকী নস্ট্রাডামুস তাদের বাড়িতে গেছিলেনও, এই সাত শিশুর ঠিকুজি, কুষ্ঠি তৈরি করতে (আগেও বলেছি) তাই এদের নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করাটা আশ্চর্যজনক কিছু ব্যাপার নয়। ভবিষ্যদ্বাণীতে বলা আছে তৃতীয় হেনরি তাঁর ভাইবোনদের মধ্যে সবার শেষে মারা যাবেন। এটাও ঠিক নয়। তৃতীয় হেনরি সবার শেষে মারা যাননি॥

কবিতা—১৭ (সেঃ – ১)

Par quarante ans l’Iris n’ apparoistra,
Par quarante ans tous jours sera veu :
La terre aride en siccite croistra,
Et grans deluges quand sera aperceu.

 এর অর্থ :

চল্লিশ বছর ধরে আকাশে দেখা যাবে না রামধনু,
তারপর চল্লিশ বছর ধরে রোজ দেখা যাবে রামধনু :
শুকনো পৃথিবী আস্তে আস্তে সবুজ হয়ে উঠবে,
তারপর চারদিক ভেসে যাবে বন্যায়।

 ব্যাখ্যাকারের ব্যাখ্যা : খরা ও বন্যা

 এরিকা স্বীকার করেছেন যে, তিনি এই কবিতার ব্যাখ্যা দিতে অক্ষম। পৃথিবীর কোথাও চল্লিশ বছর খরার পর টানা চল্লিশ বছর বন্যার খবর পাওয়া যায়নি। অতএব....

কবিতা—২৩ (সেঃ—১)

Au mois troisiesme se levant le soleil,
Sanglier, Liepard au champ Mars pour combattre
Liepard laisse, an ciel extend son oeil,
Un aigle outour du Soleil voit s’esbattre.

 অর্থাৎ :

তৃতীয় মাসে, সূর্যোদয়ের সময়ে
শুয়োর আর চিতাবাঘ
ক্লান্ত চিতাবাঘ স্বর্গের দিকে তাকাবে,
দেখবে একটা ঈগলপাখি সূর্যের আশেপাশে খেলে বেড়াচ্ছে।

 ব্যাখ্যাকারের ব্যাখ্যা : ওয়াটারলু’র যুদ্ধ

 এরিকা দেবীর মতে এই কবিতাতে নেপোলিয়ানের ‘ওয়াটারলু’র যুদ্ধের কথা বলা হয়েছে। তাঁর মতে শুয়োর মানে হ'ল পারস্যের রাজা — ব্লচার। চিতাবাঘ বলতে নাকি ব্রিটিশদের কথা বলা হয়েছে। আর ঈগলপাখি মানেই নাকি ফরাসি শক্তি। ওয়াটারলু'র যুদ্ধ হয়েছিল ১৮১৫ সালের জুন মাসে। কবিতার প্রথম লাইনে নাকি এই তারিখটারও উল্লেখ আছে।

 “তৃতীয় মাস, সূর্যোদয়ের সময়ে”—মানেই জুন মাসে। কেন? তারও এক জব্বর ব্যাখ্যা করেছেন এরিকা দেবী। সূর্যোদয় মানেই মার্চ মাস; কেননা মার্চ মাসে পৃথিবীর সর্বত্র দিন-রাত্রি সমান দৈর্ঘ্যের হয়। “তৃতীয় মাসে” মানে মার্চ মাসের থেকে গুনতে আরম্ভ করে তৃতীয় মাস; অর্থাৎ—জুন মাস।

 যুক্তবাদী বিশ্লেষণ :

 যুক্তিবাদী পাঠকরা, এরিকা চিটহ্যাম-এর ব্যাখ্যা পড়ে কি সত্যিই আপনাদের মনে হচ্ছে যে, এই কবিতাতে নস্ট্রাডামুস নেপোলিয়ানের ওয়াটারলু'র যুদ্ধের কথা বলতে চেয়েছিলেন? শুয়োর মানে পারস্যের রাজা, চিতাবাঘ মানে ইংরেজরা, আর ঈগল মানে ফরাসিরা? এটা কি চ্যাংড়ামো নাকি? এই উদ্ভট ব্যাখ্যার কোনো ভিত্তিই নেই। আর তারিখের ব্যাখ্যাটার তো কোনো মাথামুন্ডুই নেই। ‘সূর্যোদয়’ কথাটার অর্থ কোন যুক্তিতে মার্চ মাস? পৃথিবীর সর্বত্র সমান দৈর্ঘ্যের দিন-রাত্রি হওয়া মানেই “সূর্যোদয়”? এই যদি হয়, তবে তো সেপ্টেম্বর মাসের কথাও তোলা যায়। কারণ সেপ্টেম্বর মাসেও পৃথিবীর সর্বত্র দিন-রাত্রির দৈর্ঘ্য সমান। সেপ্টেম্বর থেকে গুনতে শুরু করে তৃতীয় মাস হয় ডিসেম্বর। তাহলে এরিকা দেবী কী করে জোর গলায় বলতে পারলেন যে এখানে ডিসেম্বর নয়, জুন মাসের কথাই বলা হয়েছে? জবাব নেই।

কবিতা—২৬ (সেঃ-১)

Le grand du fouldre tumbe d’heure diurne,
Mal & predict par porteur postulaire :
Suivant presage tumbe d’heure nocturne,
Conflict Reims, Londres, Etrusque pestifere.

 অর্থাৎ :

মস্ত মানুষটা একদিন মারা পড়বে বজ্রপাতে,
একজন আবেদনকারী আগেই এ বিষয়ে সাবধান করবে,
সাবধানবাণী অনুসারে আরও একজন মরবে রাতে,
দ্বন্দ্ব দেখা দেবে ফ্রান্স, ইংল্যান্ড ও ইতালিতে।

 ব্যাখ্যাকারের ব্যাখ্যা : কেনেডি হত্যার পূর্বাভাস

 এরিকা জানিয়েছেন, এই শ্লোকে নস্ট্রাডামুস নাকি আমেরিকার রাষ্ট্রপতি জন এফ. কেনেডির হত্যার কথাই বলতে চেয়েছেন। আরও একজন মরবে বলে যে বলা হয়েছে, সে নাকি জন এফ. কেনেডির ভাই রবার্ট এফ. কেনেডি। “একজন আবেদনকারী আগেই ও বিষয়ে সাবধান করবে”—এই লাইনটার ব্যাখ্যা করতে গিয়ে এরিকা একটু বেশিই গোঁজামিল দিয়ে ফেলেছেন। বলেছেন—কেনেডি মারা যাবার আগে একাধিকবার তাঁকে হত্যা করার চেষ্টা হয়েছিল। আর ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, ইতালিতে মারামারি লাগবে বলে যে শেষ লাইনে উল্লেখ করা হয়েছে, তার মানে নাকি এই যে, এই ঘটনাতে সারা বিশ্বে হইচই পড়ে যাবে?

 যুক্তিবাদী বিশ্লেষণ :

 এরিকার ব্যাখ্যার লাইন থেকেই গোঁজামিল শুরু। কেনেডি কিন্তু বজ্রপাতে মারা যান নি। তাঁকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। ভবিষ্যদ্বাণীর দ্বিতীয় লাইনেরও কোনো সুষ্ঠু ব্যাখ্যা পাওয়া গেল না। এমন কোনো আবেদনকারীর খবরই আজ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি, যে কেনেডিকে মৃত্যু বা হত্যার ষড়যন্ত্র সম্বন্ধে সাবধান করেছিল। তৃতীয় লাইনটার ব্যাখ্যা মোটেই সন্তোষজনক নয়। “আরও একজন মরবে রাত্রে”–এই লাইনটা পড়ে মনে হচ্ছে নস্ট্রাডামুস সেই রাতেই অন্য কারো মারা যাবার কথা বলেছিলেন। কিন্তু কেনেডির ভাই রবার্ট, এফ, কেনেডি মারা গেছিলেন পাঁচ বছর পরে। এক ভোরবেলায়। “আরও একজন মরবে” বলাতে এরিকা জন-এর ভাইয়ের কথাই বা ভাবলেন কেন? জনের ভাই-ই যে মরবে, এমন কথা তো কবিতাতে বলা নেই? চতুর্থ লাইনটাও আর একটা বিদঘুটে গোঁজামিল। ফ্রান্স, ইংল্যান্ড আর ইতালিতে দ্বন্দ্ব দেখা দেবার কথা বলা হয়েছে কবিতাতে। হইচই পড়ে যাবে বলা হয়নি। নস্ট্রাডামুস স্পষ্টতই ‘Conflict’ কথাটা ব্যবহার করেছেন। ‘কনফ্লিক্ট’ মানে কোনো অর্থেই 'হইচই' নয়। আর ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, ইতালি মানেই কি সারা পৃথিবী?

 অবশেষে আর একটা কথা না বলে পারছি না। এরিকাদেবী এই কবিতাতে কেনেডির নাম বিশেষভাবে পেলেন কোথায়? এই কবিতাতে যে রাজীব গান্ধীর হত্যার কথা বলা হয়নি, তা কি প্রমাণ করতে পারবেন? এই কবিতার বিশাল মানুষটি রাজীব হলেও তো মেলে বেশি, যিনি বজ্রপাতের মতো এক বিস্ফোরণে মৃত্যু বরণ করেছিলেন। মৃত্যুর কয়েক ঘন্টা আগে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা দপ্তর তামিলনাড়ুর গোয়েন্দা দপ্তরকে সচেতন করে দিয়েছিল—ওখানে রাজীবের জীবনের ওপর আক্রমণ হতে পারে বলে। সে রাতে আরও একজন উল্লেখযোগ্য মানুষ মারা গিয়েছিলেন; তিনি হলেন হত্যাকারী মেয়েটি। রাজীবের মৃত্যুতে ফ্রান্স, ইংল্যান্ড ও ইতালিসহ পৃথিবীর বহুদেশের রাষ্ট্রনায়ক ও বুদ্ধিজীবীদের মধ্যেই দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছিল—ভারতবর্ষে গণতন্ত্র টিকবে তো? লক্ষণীয়, ইতালিতেই রাজীব গান্ধীর শ্বশুরবাড়ি। দেখা যাচ্ছে এভাবে নস্ট্রাডামুসের যে কোনো কবিতার যা খুশি ব্যাখ্যা করে ইতিহাসের যে কোনও ঘটনার সঙ্গে ইচ্ছে মতো জুড়ে দেওয়াটা কোনো কঠিন কাজ নয়।

কবিতা—৩৪ (সেঃ—১)

L’oiseau de proie volant a la semestre,
Avant conflict faict aux Francois pareure :
L’un bon prendra l’um ambigue sinistre,
La partie foible tiendra par bon augure.

 মানে :

অপরাজেয় পাখি বাঁদিক দিয়ে উড়ছে,
ফরাসিদের সঙ্গে যুদ্ধের আগে নেবে প্রস্তুতি :
কারো কারো কাছে সে হবে নায়ক, অন্যদের কাছে খলনায়ক,
দুর্বল-শক্তি তাকে শুভ বলে মনে করবে।

 ব্যাখ্যাকারের ব্যাখ্যা : হিটলার

 এরিকার এই কবিতার ব্যাখ্যা প্রথম নজরে আচ্ছা-আচ্ছা লোকের মাথা ঘুরিয়ে দিতে পারে। এরিকা বলেছেন, এখানে হিটলারের কথা বলা হয়েছে। ‘অপরাজেয় পাখি’টি হল হিটলার। ফরাসিদের সঙ্গে তাঁর যুদ্ধ হয়েছিল। চতুর্থ লাইনটা ইতিহাস-বিরোধী হয়ে গেছে। কিন্তু বুদ্ধিমতী এরিকা তারও ব্যাখ্যা করে ফেলেছেন। বলেছেন যে, চতুর্থ লাইনে ‘দুর্বল-শক্তি’ বলতে জার্মানদের কথা বোঝাতে চেয়েছেন নস্ট্রাডামুস। (জার্মানদের এরিকা দুর্বল-শক্তি কেমন করে মনে করলেন জানি না। হিটলারের সময়ে জার্মানি এক মহাশক্তি ছিল বলেই তো জানি!)

 যুক্তিবাদী বিশ্লেষণ :

 এ কবিতার ব্যাখ্যায় প্রথমেই একটা মারাত্মক গোলমাল রয়ে গেছে। নস্ট্রাডামুস কিন্তু তাঁর সমস্ত সেঞ্চুরিতে যতবার ‘অপরাজেয় পাখি’ কথাটা ব্যবহার করেছেন, ততবারই এরিকা নেপোলিয়নের প্রসঙ্গ টেনেছেন। এরিকা বলেছেন যে, ‘অপরাজেয় পাখি’ মানেই নেপোলিয়ন। তাহলে এই ৩৪নং কবিতাতে ‘অপরাজেয় পাখি’ নেপোলিয়ন না হয়ে হিটলার হল কেন? দ্বিতীয় লাইনটার জন্য?

 হিটলার কেন? ইংরেজরা নয় কেন? ইংরেজরাও তো ছিল অপরাজেয়। ইংরেজরা ফরাসিদের সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন একাধিকবার। ইংরেজরা কারো কারো কাছে ছিল নায়ক, কারো কাছে খলনায়ক। এদেশের ‘বাবু’ সম্প্রদায়রা ইংরেজদের মনে করতেন নায়ক, আবার এদেশেরই বিপ্লবীদের কাছে তারা ছিল খলনায়ক। ‘দুর্বল-শক্তি তাকে শুভ বলে মনে করবে’—এটাও ইংরেজদের ক্ষেত্রে ঘটানো যায়। গরণ ইংরেজরা এমন অনেক দুর্বল রাজ্য দখল করেছিল, যারা ইংরেজদের ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল। তাদের কাছে ইংরেজরা অবশ্যই শুভ বলে বিবেচিত হয়েছিল।

 তাহলে এই কবিতাতে যে ইংরেজদের কথা বলা হয়নি, এরিকা দেবী তা জোরগলায় বলেন কী করে? পাঠকরা, একটু ইতিহাস ঘাঁটাঘাঁটি করলে অন্য কারোর সঙ্গেও এই কবিতাটা আপনারা জুড়ে দিতে পারবেন। নস্ট্রাডামুসের কবিতাগুলির মজা এইখানেই৷৷

কবিতা—৩৫ (সেঃ—১)

এই কবিতাটার বিস্তৃত ব্যাখ্যা করা হয়েছে এই বইয়ের ৩১২ পৃষ্ঠাতে, তাই আর দ্বিতীয়বার আলোচনায় গেলাম না। তবে চতুর ব্যাখ্যাকারদের দৌলতে কবিতাটা সত্যিই মাথা ঘুরিয়ে দিতে পারে। এই কবিতাতে হেনরি-IIর মৃত্যুর ভবিষ্যদ্‌বাণী করা আছে বলে দায়ী করা হয়েছে ।