অলৌকিক নয়, লৌকিক (তৃতীয় খণ্ড)/প্রথম পর্ব/অধ্যায়: তিন
অধায় : তিন
নিয়তিবাদের আঁতুড় ঘর : অশিক্ষা-অনিশ্চয়তা-পরিবেশ
নিয়তিবাদের শিকড় যখন অশিক্ষা
গীতা যে উঠোনে পিঁড়ি পেতে বসেছিলেন, সেটাকে ‘বারো বস্তি এক উঠোন’ বললেই বোধহয় ঠিক হয়। গীতার চুল বেঁধে দিচ্ছিলেন একটি মহিলা। গীতার আশে-পাশে আরো জনা দশকে মহিলা ভিড় করে এসে দাঁড়িয়েছেন। এঁরাও বারো বস্তিরই বাসিন্দা, এঁদের কয়েকজনের কোলে-কাঁখে হাড় জিরজিরে পেট-ফোলা শিশু ৷ অপুষ্টি ও অতিমাত্রায় পরিশ্রম হাত ধরাধরি করে মহিলাদের যৌবনকে বরণ করেছে।
“লেখাপড়া শিখে কী করব? চাকরি করতে তো আর আমরা যাব না। ভাগ্যে আমাদের যা লেখা আছে, তা লেখাপড়া শিখে কি খণ্ডাতে পারব?” গীতার চুল বেঁধে দিচ্ছিলেন যে রুগ্ণ প্রবীণা মহিলা, তিনিই আমাদের উদ্দেশে কথাগুলো বললেন।
ঘটনাটা ১৯৮৮-র। আমরা কয়েকজন গিয়েছিলাম কলকাতার বউবাজার অঞ্চলের কিছু বস্তিতে। ঘুরে ঘুরে চেষ্টা করেছিলাম এই অঞ্চলের এটি মহিলাগোষ্ঠীর মধ্যে লেখাপড়া শেখার ইচ্ছে জাগিয়ে তুলতে। উদ্দেশ্য ছিল, ওদের লেখাপড়া শেখার ও পাশাপাশি কুসংস্কারমুক্ত করার চেষ্টা। আর তখনই অনেকেই এই ধরনের প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছেন আমাদের দিকে। এই মহিলারা রাতের ঘুমকে বাক্সবন্দি করে বউবাজার স্ট্রিট ও তার আশেপাশের গলিগুলোর পুরুষমানুষগুলোর দিকে নজর রাখেন। বিকেল না হতেই রাস্তাগুলোয় বাড়ি ফেরত উথাল-পাথাল মানুষের ঢেউ, চলেছে শিয়ালদা স্টেশনের দিকে। শুধু মানুষ আর মানুষ। রঙ মেখে নিজের শরীরটাকে আকর্ষণীয় করতে যতটা সম্ভব দামী পোশাক পরেন এঁরা। দেখে বোঝার উপায় থাকে না, বাড়িতে এঁরাই পরেন একটুকরো ত্যানা কাপড়। এঁদের বাড়ির ছেলেরা মায়েরা দুধ না ছাড়তেই নেমে পড়ে পেট চালাবার যুদ্ধে। এত নিপীড়ন ও বঞ্চনার পরও এঁদের কারও কোনও অভিযোগ দেখিনি সমাজের কারও প্রতি। নিজেরই ভাগ্যফল বলে সব কিছুকে মেনে নিয়েছেন।
১৯৮৭-র আর একটি ঘটনা। ঘটনাস্থল বিহারে সিংভূম জেলার বান্দিজারি গ্রাম। ওই গ্রামে অজানা রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছিল বহু মানুষ। খবর পেয়ে গিয়েছিলাম। দেখেছিলাম গ্রামবাসীদের পান করার একমাত্র জল তীব্র দুর্গন্ধে ভরা, রঙ কালচে শ্যাওলা মতন। এমন সর্বনাশা মড়কের খবর আমাদের কাছে পৌঁছলেও সরকারি প্রশাসনের কানে পৌঁছয়নি। টিকিটের দেখা মেলেনি স্থানীয় বিধায়ক ও সাংসদের। তৈরি নরকে একটি করে তাজা মানুষ অজানা রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রতিবাদহীনভাবে মৃত্যুকে বরণ করেছে। গ্রামের মানুষ রোগীদের দূরের হাসপাতালে পাঠানোর প্রয়োজনীয়তাও অনুভব করেননি। ধরেই নিয়েছিলেন, ভাগ্যে যাঁদের মৃত্যু লিখেই রেখেছেন ‘বোঙ্গা’, তাঁকে বাঁচাবার সাধ্য কোনও মানুষেরই নেই।
সুন্দরবনের ভয়ঙ্কর সৌন্দর্য নিয়ে ঘরে বসে কাব্য করা যতটা সোজা, সুন্দরবনের মানুষগুলোর ভয়ঙ্কর দারিদ্র্য ও লাঞ্ছনাভরা জীবন নিয়ে কাব্য করা ততটাই কঠিন। এখানকার মহিলা পুরুষ মা বাচ্চারা পর্যন্ত কাকভোরেই নদী আর খাঁড়িগুলোতে নেমে পড়ে মাছ ধরতে। দিনান্তে তাই বেচে জোটে একবেলা পান্তার খোরাকি। মাছ ধরতে গিয়ে কখনও কখনও ধরা পড়ে কামটের কামড়ে। ধারাল ক্ষুর দিয়ে কাটার মতই জলের তলায় নিঃসাড়ে পা কেটে নিয়ে যায় হাঙর, স্থানীয় মানুষেরা যাকে বলে কামট। এর পর কেউ কেউ পা হারিয়ে জান বাঁচায়, কেউ কেউ মারা যায় অবিরাম রক্তক্ষরণে। কাছাকাছি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে রক্ত নেই, তাই কামটের কামড়ের পর মৃত্যুটাই এখানে স্বাভাবিক। যদিও কামটে কামড়ের ঘটনা এখানে আকছারই ঘটেছে, কিন্তু তবুও সরকার পর উদাসীন। আর স্থানীয় মানুষগুলো? না, ওরা কোনও দাবি তোলে না, অভিযোগহীন এই মানুষগুলো ভাগ্যের হাতেই ছেড়ে দিয়েছে নিজেদের জীবন।
একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে সাপে কাটা রোগীদের ক্ষেত্রে। প্রতি বছরই সাপের কামড়ে মারা যায় এই অঞ্চলের বহু মানুষ। প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে সাপে কাটা রোগীদের জন্য প্রয়োজনীয় ইনজেক্শন না থাকায় মানুষগুলো বাধ্য হয়ে শেষ চেষ্টা করতে ওঝা-গুণিনদের শরণাপন্ন হয়। বিষাক্ত সাপ ঠিক মত বিষ ঢাললে তাকে বাঁচনোর সাধ্য ওঝা, গুণিনের হয় না। রোগী মরে। দারিদ্র্যের নগ্ন লাঞ্ছনায় নুয়ে মানুষগুলো ‘জন্ম-মৃত্যু-বিয়ে সবই ভাগ্যের লিখন, ধরে নিয়ে ক্ষোভের পরিবর্তে শোক পালন করে।
হিঙ্গলগঞ্জের মাস্টারমশাই শশাঙ্ক মণ্ডল ক্ষোভের সঙ্গে জানিয়েছিলেন, “সুন্দরবনে বাঘ সংরক্ষণের সরকার যত সচেষ্ট, মানুষ সংরক্ষণের তার এক শতাংশ চিন্তাও সরকারের নেই।”
সত্যিই নেই। বাঘ পুষতে, তাদের সময়মত খাবার জোটাতে কত পরিকল্পনা, কত অফিস, কত, কর্মচারী। আর মানুষগুলোর জন্যে? সুন্দরবনের হত-দরিদ্র ক্ষুধার্ত জেলে, মউলে ও বাউলেরা জঙ্গলে যায় বাঁচতে। এর জন্য বন দপ্তরের পাশ নিতে হয়। কাঠ কাটা ও মধু সংগ্রহের জন্য পাশ। তারপর এরা অনেকেই বাঁচতে পারে না বাঘের থাবা থেকে। গোসাবা, কাটাখালি গ্রামে এমন একটি পরিবার পাওয়া যাবে না, যে পরিবার থেকে কেউ বাঘের পেটে যায়নি।
বাঘের থাবা থেকে যারা বেঁচে ফেরে তাদের জন্য থাবা মেলে বসে থাকে সুন্দরবনের ডাকাত ও মহাজনরা।
গোসাবার ফতেমা বিবি যৌবনে তাঁর স্বামীকে হারিয়েছেন বাঘের থাবার তলায়। সব হারিয়েও ফতেমা বিবির চোখ শশাঙ্ক মাস্টারের মতন জ্বলে ওঠে না ক্ষোভে। কপাল চাপড়ে নিজের ভাগ্যকেই দোষারোপ করে বিলাপ করেন, চোখের জল ফেলে।
এইসব বঞ্চিত মানুষগুলো অদৃষ্টবাদী হয়েছে অজ্ঞতা থেকে। সমাজে তাদের অধিকারের সীমা না জানায় আর্থিক পরিবেশ বা আর্থসামাজিক পরিবেশই কিন্তু এই দারিদ্র্য ও সেই কারণে অজ্ঞতার জন্য দায়ী।
অনিশ্চয়তা আনে ভাগ্য নির্ভরতা
ভূপাল ভৌমিক আমার সঙ্গে কলেজে পড়ত একই ইয়ারে। দীর্ঘদেহী। অসুরের মতন স্বাস্থ্য! স্বামী বিবেকানন্দের ছবির মতো দৃষ্টি। কথা বলত চোখে চোখ রেখে, উত্তমকুমারের মতো ভরাট গলায়। কথায় তেজ ছিল। তেজ ছিল পড়াশুনোতেও৷ কলেজের ইলেকশনে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল এস এফ আই এবং পি এস ইউ। আমাদের ক্লাশে এস এফ আই ভূপালকে প্রার্থী করার বহু চেষ্টা করেছিল। ভূপাল কি সব নীতির প্রশ্ন নিয়ে পি এস ইউ নেতা মিহির সেনগুপ্তের সঙ্গে একমত হতে না পেরে দু-দলের বিরোধিতা করে নির্দল প্রার্থী হল। এক ভোটে হেরেছিল। ভূপালের স্বপ্ন ছিল অধ্যাপক হবে। ইউনির্ভাসিটির শেষ পরীক্ষাতেও ভাল রেজাল্ট করেও ভূপাল ওর স্বপ্নকে সার্থক করতে পারল না। ভূপাল ওর চোখের সামনে ওর চেয়ে নিরেস রেজাল্ট করা সহপাঠী ও বন্ধুদের কাজ জুটিয়ে নিতে দেখল। অনেকেই মফস্বল কলেজের অধ্যাপক, মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির একজিকিউটিভ, সাংবাদিক, নিদেন ব্যাঙ্ক বা ইন্সিওরেন্স কোম্পানির কেরানির কাজ জুটিয়ে নিয়েছিল খুঁটি বা ঘুষের জোরে। ভূপাল একটু একটু করে নিরাশায় ভেঙে পড়েছিল। ও প্রায়ই বলত, “আমার ভাগ্যটাই খারাপ। আমার হবে না। কিছু হবে না।” ভূপাল শেষ পর্যন্ত পাগল হয়ে গিয়েছিল। স্থান হয়েছিল পাগলা গারদে।
আমার এক আত্মীয় বি কম পাশ এবং ধারাবাহিকভাবে শেষ সুযোগটি পর্যন্ত চার্টার্ড অ্যাকাউনটেন্সি পরীক্ষায় ফেল। এক মন্ত্রীর কল্যাণে জুট কর্পোরেশনে মোটামুটি ভাল পদে কাজ পেলেন। তিনি নদীয়ার একটি শহরে যখন পোস্টেড ছিলেন, তখন সপ্তাহে একটি দিন অফিস যেতেন এবং অ্যাটেনডেন্স খাতায় সারা সপ্তাহের সই করে আসতেন। দেশে যখন তীব্র বেকার সমস্যা, বহু শিক্ষিত বেকার যখন এমপ্লয়মেন্ট কার্ড করে ইন্টারভিউ দিতে দিতে চাকরি পাওয়ার বয়েস পেরিয়ে যাচ্ছেন, ডুবে যাচ্ছেন হতাশায়, তখন একটা অতি সাধারণ শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে এমন একটি মোটা মাইনের ফাঁকি মারা সুখের চাকরি পেয়ে আমার আত্মীয়টি নিজেকে প্রচণ্ড ভাগ্যবান বলে গর্ব করতেন।
আমার এক স্নেহভাজন ক্যারাটে জুডো ও যোগ ব্যায়ামের প্রশিক্ষক হঠাৎ এক মন্ত্রীর কৃপায় সল্ট লেকে একটা প্লট পেয়ে যাওয়ার ভাবতে শুরু করেছিলেন, ভাগ্যটা ওঁর খুবই ভাল হচ্ছে।
এবার আসুন একটু সাহিত্যজগতে বিচরণ করা যাক। অনুমান করুন তো, কে সেই বাংলা সাহিত্যের দিকপাল অসাধারণ সাহিত্যিক যিনি ১৯৭৬ সালে আমেরিকার বালটিমোরে অনুষ্ঠিত ৩য় বিশ্ব কবি সম্মেলনে ১৯৭৭-এ অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে ৪২-তম বিশ্ব সাহিত্য সম্মেলনে, ১৯৭৭-এ ফিলিপাইনে প্রশান্ত মহাসাগরীয় লেখক সম্মেলনে, ১৯৭৮-এ কোরিয়ার সিওল-এ ৪র্থ বিশ্ব কবি সম্মেলনে এবং ১৯৮১-তে সানফ্রানসিসকোতে ৫ম বিশ্ব কবি সম্মেলনে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন?
আপনাদের চোখের সামনে নিশ্চয়ই অনেক নামই ভেসে উঠছে, প্রেমেন্দ্র মিত্র, অরুণ মিত্র, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, দিব্যেন্দু পালিত, রমাপদ চৌধুরী, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়, দেবেশ রায়, বিমল কর, নবনীতা দেবসেন ইত্যাদিদের নাম। না হলো না। আপনাদের অনুমান মিলল না। উনি হলেন বিশ্বজয়ী সাহিত্যিক সুধীর বেরা। ওঁর নাম শোনেননি মনে হচ্ছে? তবে ওঁর বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থগুলোর নাম জানাচ্ছি, ‘লগ্ন’ ‘শাহানা’, ‘সূর্যনাগ’, ‘অন্যদিন’ ও ‘অভিজ্ঞান'। কী? এইসব কাব্যগ্রন্থগুলোর নাম কোনদিনই শোনেননি। দেখেননি? পড়েননি? আমিও শুনিনি, দেখিনি, পড়িনি। সুধীর বেরার লেখা একটি জ্যোতিষ বিষয়ক চটি পুস্তিকা ‘নস্ট্রাডামের ভবিষ্যৎবাণী'-তে ছাপা সুবিশাল জীবনীপাঠে এসব অমূল্য তথ্য জানতে পেরেছি। আরো জানতে পেরেছি তিনি ছিলেন ১৯৭১ থেকে ১৯৭৭ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় সদস্য এবং ১৯৭৫-এর সুপ্রিম কোর্টে প্রধানমন্ত্রীর নির্বাচনী আপিল মামলায় শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর অন্যতম কৌসুলি। জানি না রাজনীতির কল্যাণেই সাহিত্যিক হিসাবে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ পেয়েছিলেন কি না? তেমনটি ঘটে থাকলে অবশ্য ভাগ্যে বিশ্বাসী, জ্যোতিষশাস্ত্রে বিশ্বাসী হয়ে পড়াটাই স্বাভাবিক।
আমাদের মতন সামাজিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে পিছিয়ে
পড়া দেশগুলোতে, যেখানে পদে পদে অনিশ্চয়তা,
সেখানে মানুষ ভাগ্যে বিশ্বাসী হবে, দৈবকে
আশ্রয় করে বাঁচতে চাইবে,
এটাই স্বাভাবিক।
একদিকে লক্ষ কোটি মানুষ যেমন জীবনযুদ্ধে বার বার ব্যর্থ হয়ে অদৃষ্টে বিশ্বাসী হয়ে পড়ে, অন্যদিকে তেমনই শাসকগোষ্ঠীর কৃপায়, অথবা যে কোনও প্রকার ঘুষের বিনিময়ে যখন কিছু সাধারণ মানুষ হঠাৎ অর্থে, সন্মানে অসাধারণ হয়ে ওঠে, তখন তারাও একে নিজেদের সৌভাগ্য বলেই মনে করতে থাকে।
আমাদের সমাজব্যবস্থায় বহুক্ষেত্রেই পুরুষকার অর্থাৎ কর্মপ্রয়াস শুধুমাত্র ক্লান্ত ও পর্যুদস্ত হয়। আর সেই সময় পরিবেশগতভাবে প্রাপ্ত বিশ্বাসের ভিত্তিতে জীবনযুদ্ধে বঞ্চিত, পর্যুদস্ত মানুষগুলো এর জন্য আমাদের সমাজের অন্যায়, অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে না দাঁড়িয়ে সেগুলোকে ‘ভাগ্যের মার' বলে গ্রহণ করে। দৃষ্টি ফেরানো যাক খেলোয়াড়, অভিনেতা, সংগীতশিল্পী, আইনজীবী, রাজনীতিবিদদের দিকে। দেখবেন এঁদের বেশিরভাগই আন্তরিকতার সঙ্গেই ভাগ্যে বিশ্বাসী। এই ভ্রান্ত বিশ্বাস এসেছে এঁদের জীবনযুদ্ধের অনিশ্চয়তা থেকে। কর্মজীবনের উত্থান-পতনকে এঁরা ভাগ্য বলেই ধরে নেন। বহুদিন রানের মধ্যে না থাকা ব্যাটসম্যান রান পেলে নিজের ভাগ্যের চাকা ঘুরছে বলে ধরে নেন। অতি সাধারণ আর্থিক অবস্থা থেকে যখন কোনও অভিনেতা বা অভিনেত্রীর উত্তরণ ঘটে সুপাস্টারে, তখন বিশাল নাম, বিপুল বৈভবের সুখে ডুবে যেতে যেতে সবকিছুরই স্বপ্নের মতন মনে হয়। হঠাৎ পাওয়া যে সুযোগের হাত ধরে এতখানি উঠে আসা (তা সে যত কঠিন কঠোর সংগ্রামের জের হিসেবেই আসুক না কেন) তাকে একটি ‘ঘটনা’ বলে মেনে না নিয়ে ‘ভাগ্য’ বলে মানতেই মন চায়।
একালের সুপারস্টার মিঠুন চক্রবর্তী আজ চূড়ান্ত অদৃষ্টবাদী। যে সংগ্রামী মিঠুন এক সময় নিজেকে মার্ক্সবাদী বলে সোচ্চারে পরিচয় দিতেন, সুপারস্টার হয়ে ওঠার কারণ হিসেবে ভাগ্যকে চিহ্নিত করলেন। পেলে থেকে পি. কে, সোবার্স থেকে শচিন, মাইকেল জ্যাকসন থেকে উদিতনারায়ণ, এঁদের প্রত্যেকেরই একটি বিষয়ে প্রগাঢ় বিশ্বাস, আর তা হলো 'ভাগ্য'। এঁদের প্রত্যেকের ক্ষেত্রেই ভাগ্য-বিশ্বাস এসেছে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাময় জীবনের অনিশ্চয়তা থেকে।
আমাদের দেশের সমাজব্যবস্থার দিকে তাকিয়ে দেখুন, এখানে পদে পদে অনিশ্চয়তা। দেশের বেশিরভাগ মানুষ ভয়ংকর দারিদ্র্যের শিকার। ওদের যেদিন পেটে ঢোকাবার মতন কোনও বস্তু জোটে (তা সে কোনও বাড়ির এঁটো-পচা খাবার, শামুক, গুগলি, কাকের মাংস, পাত্তা, রুটি, মুরগির নাড়ি-ভুঁড়ি যাই হোক না কেন) সেদিন জানে না, পরের দিন খেতে পাবে কি না, অথবা কতদিন পরে আবার খাবার জুটবে?
দারিদ্র্য ও অপুষ্টির সঙ্গে হাত ধরাধরি আপনি যখন আপনার ছেলেটিকে স্কুলে পাঠান, স্কুল থেকে কলেজে পাঠান, তখন নিশ্চয়ই অনেক সুখস্বপ্ন থাকে। কলেজের পড়া শেষ হলে স্বপ্নের ছেলে হারিয়ে যায় কোটি কোটি বেকারের ভিড়ে। বছর ঘোরে, আরো বেশি বেশি করে তরুণ-তরুণী আপনার ছেলের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের সঙ্গী হয়। কবে, চাকরি হবে, আদৌ চাকরি হবে কি না, এসব প্রশ্নের উত্তর দেওয়া কারও পক্ষেই সম্ভব নয়। যেখানে বেকারের তুলনায় চাকরিতে নিয়োগের সংখ্যা অতি নগণ্য, সেখানে জীবন চরম অনিশ্চিত হতে বাধ্য।
অনিশ্চিত জীবনে কিছু পাওয়াকে মানুষ ‘ভাগ্য’ বলে ভুল
করে। এই অজ্ঞতা সব সময় কিন্তু শিক্ষার সঙ্গে
সম্পর্কিত নয়। বহু শিক্ষিত মানুষও অনিশ্চিত
পেশার সঙ্গে যুক্ত থাকলে ভাগ্য
বিশ্বাসী হয়ে পড়ে।
অর্থনীতির দিক থেকে পিছিয়ে পড়া দেশগুলোতে পদে পদে অনিশ্চয়তা বেশি বলেই অদৃষ্টবাদী মানুষের সংখ্যাও বেশি। কিন্তু যে সব উন্নতদেশে মানুষ প্রচেষ্টার দ্বারা তার জীবন ধারণের দাবিগুলোকে মেটাতে সক্ষম, সে সব দেশে অদৃষ্ট বিশ্বাসী মানুষের সংখ্যাও কম। সেইসব উন্নত দেশের অদৃষ্টবাদীদের মধ্যে একটা বিরাট অংশই খেলোয়াড়, অভিনেতা, সংগীতশিল্পী ইত্যাদি প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক অনিশ্চিত পেশার মানুষ।
পরিবেশ আমাদের জ্যোতিষ-বিশ্বাসী করেছে
শ্রদ্ধেয় মেঘনাথ সাহার বক্তব্য থেকে জানতে পারি, তাঁর সংগৃহীত তথ্য অনুসারে আমাদের দেশের শতকরা ৯৯ ভাগ পুরুষ ও ১০০ ভাগ মহিলা ফলিত জ্যোতিষে বিশ্বাসী। ইউরোপে ফলিত জ্যোতিষে আস্থাবান পুরুষের সংখ্যা শতকরা ৫ জন ও মহিলার সংখ্যার শতকরা ৩৩ জন।
তারপর অনেক বছর অতীত হয়েছে। উন্নত দেশগুলোতে বিজ্ঞানের দ্রুত উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে সমাজ-সংস্কৃতির পরিবেশও প্রভাবিত হয়েছে। পরিবেশগতভাবে সে-সব দেশের মানুষ আরো বেশি বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিনিষ্ঠ হয়ে ওঠার সুযোগ পেয়েছে। ফলে অন্ধবিশ্বাসের কাছে আত্মসমর্পণ করার মতন মানুষের সংখ্যাও কমার কথা। কিন্তু সব সময় সব কিছু সরল নিয়ম চলে না। মানুষের স্বাভাবিক চিন্তা বিভ্রান্ত হয় প্যারাসাইকোলজিস্টদের দ্বারা, বিজ্ঞানের বিরুদ্ধে বিজ্ঞানকে কাজে লাগানো কিছু মানুষের দ্বারা। এই বিজ্ঞানবিরোধিতা ঠেকাবার রাস্তাও সঙ্গে সঙ্গে খুঁজে নিচ্ছে বিজ্ঞানমনস্ক যুক্তিবাদী মানুষরাই।
আমাদের দেশের মানুষদের মধ্যে জ্যোতিষ-বিশ্বাসীর শতকরা আনুমানিক হার নিয়ে কোনও গবেষণা এখনও পর্যন্ত হয়নি। তবে অতি সামান্যভাবে আমাদের সমিতি প্রধানত পশ্চিমবঙ্গের ওপর কিছু অনুসন্ধান চালিয়েছে। অবশ্য আমাদের অনুসন্ধানগুলোর মতামত সংগৃহীত হয়েছিল আমাদের সমিতি পরিচালিত কুসংস্কার বিরোধী শিক্ষণ-শিবিরে অংশগ্রহণকারীদের মধ্য থেকে।
আমাদের সমিতির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের তরফ থেকে প্রতি মাসে অন্তত একটি করে কুসংস্কার-বিরোধী শিক্ষণ-শিবির পরিচালনা করা হয় গ্রামে-গঞ্জে, আধা-শহরে এবং শহরে। এ-ছাড়া সপ্তাহের মঙ্গল ও শনিবার কলকাতায় স্টাডি ক্লাস চলে। যাঁরা আগ্রহ নিয়ে শিক্ষণ-শিবিরে বা ক্লাসে নিজেকে যুক্তিবাদী আন্দোলনকর্মী হিসেবে তৈরি করার মানসিকতা নিয়ে আসেন, তাঁদের মধ্যে অনেকেই যে সাধারণ মানুষের চেয়ে যুক্তিতে কিছুটা এগিয়ে থাকবেন, কুসংস্কার থেকে কিছুটা হলেও মুক্ত থাকবেন—এটা নিশ্চয় প্রত্যাশিত। ১৯৮৭ থেকে ১৯৯০ এই ৫ বছরে এই এগিয়ে আসা মানুষদের মধ্যে থেকে ৩০০০ জনের কাছে একটি ছাপান মতামত-জ্ঞাপনপত্র হাজির করেছিলাম। একটু জানিয়ে রাখি, এঁদের মধ্যে বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ ছিলেন। ছিলেন অধ্যাপক, শিক্ষক, ছাত্র, সাংস্কৃতিককর্মী, শ্রমিক, কৃষক, লেখক, সাংবাদিক, চিকিৎসক ইত্যাদি। মতামত জ্ঞাপনপত্রের একটি প্রতিলিপি এখানে তুলে দিলাম :—
প্রশ্ন পড়ে ‘হ্যাঁ' বা 'না' উত্তর চিহ্ন দিতে হবে।
১। ঈশ্বরজাতীয় কারও অস্তিত্ব বাস্তবিকই আছে কি? হ্যাঁ/না।
২। ঈশ্বরজাতীয়রা কি কখন কখন মানুষের ওপর ভর করেন? হ্যাঁ/না।
৩। প্ল্যানচেটের সাহায্যে কি আত্মা আনা সম্ভব? হ্যাঁ/না।
৪। ভূত আছে কি? হ্যাঁ/না।
৫। ভূত কি কখনো কখনো মানুষের ওপর ভর করে? হ্যাঁ/না।
৬। আত্মা কি অমর? হ্যাঁ/না।
৭। কারো পক্ষে কি জাতিস্মর হওয়া সম্ভব? হ্যাঁ/না।
৮। তুকতাকের বাস্তব অস্তিত্ব আছে কি? হ্যাঁ/না।
৯। মন্ত্রে কি অলৌকিক কোনও কিছু ঘটানো সম্ভব? হ্যাঁ/না।
১০। অতীতের কোনও অবতারের অলৌকিকক্ষমতা ছিল কি? হ্যাঁ/না।
১১। বর্তমানের কেউ কেউ কি অলৌকিকক্ষমতার অধিকারী? হ্যাঁ/না।
১২। জ্যোতিষশাস্ত্রের সাহায্যে হাত দেখে বা জন্ম ছক দেখে কি কিছু কিছু ক্ষেত্রে সঠিক ভবিষ্যদ্বাণী করা সম্ভব? হ্যাঁ/না।
১৩। ‘ভাগ্য’ বলে কিছু আছে কি? হ্যাঁ/না।
১৪। গ্রহ-নক্ষত্ররা কি ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করে? হ্যাঁ/না।
১৫। ঠিক গ্রহরত্ন পরলে কি ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব? হ্যাঁ/না।
১৬। ধাতু, শিকড় বা মাদুলি ধারণ করে কি ভাগ্য পাল্টান সম্ভব? হ্যাঁ/না।
১৭। তামা কি বাত কমাতে সাহায্য করে? হ্যাঁ/না।
১৮। মন্ত্রশক্তির সাহায্যে সাপের বিষ কি নামানো যায়? হ্যাঁ/না।
১৯। বাটি চালান, কঞ্চি চালান, নখদর্পণ বা চাল পড়া খাইয়ে কি চোর ধরা যায়? হ্যাঁ/না।
২০। ‘টেলিপ্যাথি’র অস্তিত্ব বাস্তবিক আছে কি? হ্যাঁ/না।
১২, ১৩, ১৪, ১৫ এবং ১৬ নম্বর প্রশ্নগুলো সরাসরি জ্যোতিষশাস্ত্র সংক্রান্ত। এই পাঁচাটি প্রশ্নের অন্তত একটিতে 'হ্যাঁ'-এর পক্ষে মত প্রকাশ করেছিলেন ২১৪৫ জন। অর্থাৎ শতকরা ৭১.৪০ জন।
যুক্তিবাদী আন্দোলন এগিয়ে আসা মানুষদের মধ্যে যদি শতকরা ৪৪ জন অদৃষ্টবাদে বিশ্বাসী হন এবং শরীরে ধাতুর প্রভাব বিষয়ে শতকরা ৭১ জন ভুল ধারণা পোষণ করে থাকেন, তবে সাধারণ মানুষদের ক্ষেত্রে অদৃষ্টবাদে বিশ্বাসী এবং শরীরে ধাতুর প্রভাব বিষয়ে বিশ্বাসীর সংখ্যা যে এর চেয়ে অনেক বেশি হবে, সেটা অনুমান করে নিতে পারি।
এবার একটু অনুসন্ধানের প্রসঙ্গে আসা যাক। আমাদের চালানো অনুসন্ধান থেকে দেখেছি বিজ্ঞানের শিক্ষক, বিজ্ঞানের অধ্যাপক, চিকিৎসক এবং অন্যান্য বিভিন্ন পেশার অনেক মানুষও অদৃষ্টবাদের পক্ষে কোনও না কোনওভাবে মত প্রকাশ করেছিলেন। এমন বিজ্ঞান-বিরোধী অদৃষ্টবাদী চিন্তা ওইসব বিজ্ঞান পেশার মানুষদের কেন প্রভাবিত করল? ওঁরা তো শিক্ষার সুযোগ লাভে বঞ্চিত মানুষ নন? ওঁরা তো অনিশ্চিত পেশার সঙ্গেও যুক্ত নন? তবে?
এই ‘তবের’ একটিই উত্তর—পরিবেশই এইসব বিজ্ঞান পেশার মানুষদের অদৃষ্টবাদী করেছে।
সাধারণভাবে দারিদ্র্য, শিক্ষার সুযোগ না পাওয়ার অজ্ঞতা এবং অনিশ্চিত জীবনযাত্রার জন্য মূলত দায়ী আমাদের বর্তমান সমাজের প্রচলিত আর্থিক ব্যবস্থা অর্থাৎ আর্থসামাজিক পরিবেশ। অর্থ-স্বাচ্ছন্দের মধ্যে গড়ে ওঠা উচ্চশিক্ষিত মানুষরা যখন অন্ধ বিশ্বাস-কুসংস্কারের দাস হয়, তখন এমনতর ঘটনার জন্য অবশ্যই দায়ী ওইসব উচ্চশিক্ষিত মানুষদের পারিপার্শ্বিকতার প্রভাব। মানুষের ওপর পারিপার্শ্বিকতার প্রভাব বা পরিবেশগত প্রভাব নিয়ে সুদীর্ঘ আলোচনা যেহেতু দ্বিতীয় খণ্ডে করা হয়েছে, তাই এই খণ্ডে আবার সেই একই প্রসঙ্গ নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা নিতান্তই প্রয়োজনহীন। তবে তৃতীয় খণ্ডেই যাঁরা ‘অলৌকিক নয়, লৌকিক’ বইটির সঙ্গে প্রথম পরিচিত হলেন, তাঁদের বোঝার সুবিধের জন্যে অতি সংক্ষেপে মানুষের ওপর পরিবেশের প্রভাব নিয়ে আলোচনা সেরে দিচ্ছি।
মানবজীবনে পরিবেশের প্রভাব
উন্নততর দেশগুলির মনোবিজ্ঞানী ও চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা মানবজীবনের ওপর দীর্ঘ পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে বর্তমানে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন—মানুষের বংশগতসূত্রে প্রাপ্ত অধিকাংশ বৈশিষ্ট্যই পরিবেশ দ্বারা প্রভাবিত।
আমরা যে দু’পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াই, হাঁটি, পানীয় পশুর মত জিব দিয়ে গ্রহণ না করে পান করি, কথা বলে মনের ভাব প্রকাশ করি—এসবের কোনটাই জন্মগত নয়। এইসব অতি সাধারণ মানব-ধর্মগুলো আমরা অনুশীলন দ্বারা অর্জন করেছি। শিখিয়েছে আমাদের আশেপাশের মানুষগুলোই, অর্থাৎ আমাদের সামাজিক পরিবেশ।
মানবশিশু মানুষের প্রজাতি হিসেবে পাওয়া জিনের প্রভাবে মানবধর্ম বিকশিত হওয়ার পরিপূর্ণ সম্ভাবনা নিয়ে জন্মায়। সেই সম্ভাবনাকে বাস্তব রূপ দেয় মা-বাবা, ভাই বোন, আত্মীয়-বন্ধু, সহপাঠী, খেলার সঙ্গে, শিক্ষক, অধ্যাপক, প্রতিবেশী, পরিচিত ও আশেপাশের মানুষরা, অর্থাৎ আমাদের সামাজিক পরিবেশ।
আপনার-আমার পরিবারের কোনও শিশু সভ্যতার আলো
না দেখে আন্দামানের অধিবাসী জারোয়াদের মধ্যে
বেড়ে উঠলে তার আচার-আচরণে, মেধায়
জারোয়াদেরই গড় প্রতিফলন
দেখতে পাব।
আবার একটি জারোয়া শিশুকে শিশুকাল থেকে আমাদের সামাজিক পরিবেশ মানুষ করলে দেখতে পাব শিশুটি বড় হয়ে আমাদের সমাজের আর দশটা ছেলে-মেয়ের গড় বিদ্যে বুদ্ধি ও মেধার পরিচয় দিচ্ছে।
বিজ্ঞানীরা বর্তমানে সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন, বিগত বহু বছরের মধ্যে মানুষের শারীবৃত্তীয় কোনও উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয়নি। এই কম্পিউটর যুগের আধুনিক সমাজের মানবশিশুর সঙ্গে বিশ হাজার বছর আগের ভাষাহীন, কাঁচামাংসভোজী সমাজের মানবশিশুর মধ্যে জিনগত বিশেষ কোনও পার্থক্য ছিল না।
সেই আদিম যুগের শিশুকে এ যুগের অতি উন্নততর
বিজ্ঞানে অগ্রবর্তী কোনও সমাজের গড়
মানুষদের মতোই বিদ্যে-বুদ্ধির
ধিকারী হত।
কিন্তু এই কথার অর্থ এই নয় যে বংশগতি সূত্রে প্রাপ্ত বৈশিষ্ট্যকে পরিবেশ দ্বারা প্রভাবিত করা যায়। আর তাই মানুষের পরিবর্তে একটি বনমানুষ বা শিম্পাঞ্জিকে শিশুকাল থেকে আমাদের সামাজিক পরিবেশে বড় করলেও এবং আমাদের পরিবারের শিশুর মতোই লেখাপড়া শেখাবার সর্বাত্মক চেষ্টা চালালেও তাকে আমাদের সমাজের স্বাভাবিক শিশুদের বিদ্যে, বুদ্ধি, মেধার অধিকারী করতে পারব না। কারণ ওই
বনমানুষ বা শিম্পাঞ্জির ভেতর বংশগতির ধারায় বংশক্রমিক
গুণ না থাকায় তা অনুকূল পরিবেশ পেলেও
বিকশিত হওয়া কোনওভাবেই সম্ভব নয়।
এই সংক্ষিপ্ত আলোচনার সূত্র থেকে আরা দুটি সিদ্ধান্তের কথা জানতে পারলাম, এক, মানবগুণ-বিকাশে জিনের প্রভাব বিদ্যমান। দুই, মানুষের জিনের অধিকাংশ বৈশিষ্ট্য পরিবেশ দ্বারা প্রভাবিত।
পরিবেশকে আমরা অবশ্য দু’ভাগে ভাগ করতে পারি। এক, প্রাকৃতিক পরিবেশ। দুই, সামাজিক পরিবেশ।
সামাজিক পরিবেশকে আবার দু-ভাগে ভাগ করা যায়। এক, আর্থ-সামাজিক (Socio-economic) এবং দুই, সমাজ-সাংস্কৃতিক (Socio-culture)।
প্রাকৃতিক পরিবেশের প্রভাব
প্রাকৃতিক পরিবেশের প্রভাব আমাদের বিভিন্ন শারীরিক বৈশিষ্ট্য দিয়েছে। আমরা যে অঞ্চলে বাস করি তার উচ্চতা, তাপাঙ্ক, বৃষ্টিপাত, নদী, সমুদ্র, পাহাড় বা মরুভূমি ইত্যাদির প্রভাব কম-বেশি পড়েই থাকে।
সমুদ্রকূলের মানুষেরা নৌ-চালনা, মাছ-ধরা, মুক্তোর চাষ, সমুদ্র থেকে আহরণ করা নানা জিনিস ক্রয়-বিক্রয় ইত্যাদির সঙ্গে যুক্ত থাকে। সমুদ্র ছেঁকে এ-সব তুলে আনতে যে শ্রম ও ঝুঁকির মুখোমুখি হয় তাই মানুষগুলোকে সাহসী করে তোলে। পলিতে গড়া জমির কৃষকদের চেয়ে রুখো জমির কৃষকেরা বেশ পরিশ্রমী। গ্রীষ্মপ্রধান আর্দ্র অঞ্চলের মানুষদের পরিশ্রম করার ক্ষমতা নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলের পরিশ্রম করার ক্ষমতা নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলের মানুষদের তুলনায় কম। বেঁচে থাকার সংগ্রাম মরু ও মেরু অঞ্চলের মানুষদের করেছে কঠোর সংগ্রামী। চরম প্রাকৃতিক পরিবেশের মানুষদের বেঁচে থাকার সংগ্রামেই দিন-রাতের প্রায় পুরোটা সময়ই ব্যয়িত হয়। ফলে তাদের পক্ষে বুদ্ধি ও মেধাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য বিনিয়োগ করার মতো সময়টুকু থাকে না।
আবার যে অঞ্চল পেট্রলের ওপর ভাসছে, সে অঞ্চলের মানুষদের পায়ের তলাতেই গলানো সোনা। আয়াসহীনভাবে কিছু মানুষ এত প্রাচুর্যের অধিকারী যে, ফেলে ছড়িয়েও শেষ করতে পারে না তাদের সুবিশাল আয়ের ভগ্নাংশটুকু। ওরা শ্রম কেনে বিপুল অর্থের বিনিময়ে। ফলে এই অঞ্চলের কিছু মানুষ প্রকৃতির অপার দাক্ষিণ্যে ধনকুবের বনে গিয়ে ভোগসর্বস্ব হয়ে পড়ে।। শাসক ও মালিকগোষ্ঠীর এমন স্বভাবের ফলে মানসিক প্রগতি এই অঞ্চলের মানুষদের অধরাই থেকে যায়।
প্রতিকূল প্রাকৃতিক পরিবেশে বেড়ে ওঠা মানুষদের যে কোনও প্রাকৃতিক পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নেবার ক্ষমতা অন্যদের তুলনায় বেশি থাকে। আবার খরা, বন্যা, ভূমিকম্প ইত্যাদির মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয় দীর্ঘস্থায়ী হলে বিপর্যয়ে বিপন্ন মানুষদের অনেকেই কষ্টকর এই চাপের মুখে মানসিক রোগের শিকার হয়ে পড়েন। অথবা মানসিক কারণেই রক্তচাপ বৃদ্ধি, বুক ধড়ফড়, শ্বাসকষ্ট, হাঁপানি, আন্ত্রিক ক্ষত ইত্যাদি রোগে আক্রান্ত হন।
আর্থসামাজিক পরিবেশ
বিশ্বের মধ্যে দুর্নীতিতে ভারত এখন ১ নম্বরে। এ কথা বলেছে ‘ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরাম’ তাদের ২০০৫ সালের পরিসংখ্যান অনুসারে। শুধু ঘুষ দিয়ে কাজ করাতে ভারতে খরচ হয় বছরে ২১০০ কোটি টাকা।
ভারতের ক’জন শিল্পপতি পৃথিবীর ১০০ জন ধনীর মধ্যে
স্থান পেয়েছে, তা দিয়ে দেশের জনসংখ্যার
শতকরা ৭৫ ভাগ মানুষের
পেট ভরবে না।
ইউ. এন. ও-র ২০০৫-এর ‘হিউম্যান ডেভালপমেন্ট রিপোর্ট অনুসারে ভারতের অবস্থান ১৭৭টি দেশের মধ্যে ১২৭ নম্বরে।
মানবোন্নয়ন সূচক নির্ধারণ করতে তিনটি বিষয়ের উপর নির্ভর করতে হয়, আয়ু, শিক্ষা ও আর্থিক অবস্থা। এক সময় মাথাপিছু জাতীয় আয়কেই দেশের উন্নয়নের মাপকাঠি ধরা হতো। ইউ. এন. ও’র অর্থনীতিবিদরা লক্ষ্য করেছিলেন যে, মাথাপিছু জাতীয় আয় দিয়ে দেশের আমজনতার প্রকৃত আর্থ-সামাজিক অবস্থা ধরা যায় না। আরব দেশগুলোর খনিজ তেল বেচে মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ এতটাই ধনী যে, দেশের মাথাপিছু আয় অত্যন্ত বেশি। অথচ সাধারণ মানুষের প্রকৃত অবস্থা কী—মাথাপিছু আয় থেকে তার কোনও চিত্র-ই পাওয়া যায় না। সাধারণ মানুষদের প্রকৃত অবস্থা জানতে তিনটি বিষয়ের ক্ষেত্রেই সর্বনিম্ন সর্বোচ্চ মান নির্ধারিত থাকে। তিনটি বিষয় নিয়েই প্রত্যেকটি প্রদেশের উপর গভীর অনুসন্ধান চালানো হয়। স্বাস্থ্য বলতে যেমন—শিশুমৃত্যুর হার, গড় আয়ু, চিকিৎসার সুযোগ কতটা পাওয়া যায়, নারীরা চিকিৎসার কতটুকু সুযোগ পান ইত্যাদি। শিক্ষার বেলায় দেখা হয় অক্ষরজ্ঞান, স্কুলে ভর্তি হয় কতজন, স্কুল-ছুট হয়ে পড়ে কতজন, শিক্ষাক্ষেত্রে নারী-পুরুষে বৈষম্য-সংস্কার ইত্যাদি। আর্থিক অবস্থা বিচারের ক্ষেত্রে দেখা হয় দারিদ্র্যসীমার নীচের মানুষদের অবস্থা শহরবাসী ও গ্রামবাসীদের মধ্যে আয়ের বৈষম্যের পরিমাণ ইত্যাদি বহুতর বিষয়।
রাষ্ট্রপুঞ্জের এ-বছরের মানব উন্নয়ন রিপোর্টের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য দিক তুলে ধরছি, যা একজন সচেতন দেশবাসীর জেনে রাখা উচিত।
- রাষ্ট্রসংঘের ১৭৭টি সদস্য দেশের মধ্যে ভারতের অবস্থান ১২৭ নম্বরে। গত বছরেও ভারতের অবস্থান ছিল ১২৭ নম্বরে।
- প্রতি ১১ জনের মধ্যে ১ জন শিশু ৫ বছর বয়সের মধ্যে মারা যায়।
- প্রতি ৪ জন বালিকার মধ্যে ১ জন প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি হয়নি। প্রতি ১০ জন বালকের মধ্যে ১ জনের বেশি প্রাইমারি স্কুলের মুখ দেখেনি।
- পৃথিবীর ৫ জন শিশু পরিবারে পালিত হয়। শতকরা ৫৮ জন শিশু ভিক্ষা করে, শিশু শ্রমিক হিসেবে, অপরাধ জগতের সঙ্গে যুক্ত হয়ে অথবা দেহ বিক্রি করে বেঁচে আছে।
- ভারতের শিশুদের তুলনায় বাংলাদেশের শিশুদের মানসিক বিকাশ-ধারা অনেক উন্নত।
- একজন ভারতীয়ের গড় আয়ু আমেরিকানদের তুলনায় ১৪ বছর কম।
- ২০০০ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত যে হারে এ দেশের মানবোন্নয়ন হয়েছে সেই হারে উন্নয়ন বজায় রাখলে ১০০ বছর লাগবে বর্তমানের উচ্চ মানবোন্নয়ন দেশগুলোর পর্যায়ে পৌঁছতে।
- এ দেশের শতকরা ২৭ ভাগ গ্রামের মানুষ দারিদ্রসীমার নিচে অবস্থান করছে। পশ্চিমবঙ্গে এই হার শতকরা ৩০ ভাগ।
- এদেশের শতকরা ৭৩ ভাগ গ্রামের মানুষ গরিব। পশ্চিমবঙ্গে এই হার শতকরা ৭৭ ভাগ।
- চরম দারিদ্র্যে ভোগা রাজ্যগুলোর তালিকায় পশ্চিমবঙ্গের স্থান অত্যন্ত উঁচুতে। তিন দশক বামফ্রন্ট সরকার রাজত্ব করার পরও এই রাজ্য দরিদ্রতম প্রদেশগুলোর অন্যতম।
- স্বাধীনতার পরের ২৫ বছরে শহরবাসীদের সঙ্গে গ্রামবাসীদের বৈষম্য প্রকট থেকে প্রকটতর হয়েছে। ঔপনিবেশিক আমল থেকেই শহর ও গ্রামের বৈষম্য এই বাংলায় প্রকট ছিল। বর্তমানে এই বৈষম্য বেড়েছে বই কমেনি।
- রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে দক্ষিণবঙ্গের অনাহারে থাকা আমলাশোল গ্রামের-ই প্রতিচ্ছবি উত্তরবঙ্গের বন্ধ চা-বাগানে। অনাহারে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেই চলেছে।
- পশ্চিমবঙ্গ বিষয়ে এই রিপোর্টের অংশ তৈরি হয়েছে রাষ্ট্রপুঞ্জ ও পশ্চিমবঙ্গ সরকারের যৌথ প্রয়াসে।
মানবোন্নয়নের এই ভয়াবহ চিত্র ধরার উদ্দেশ্য দেশের বাস্তব অবস্থার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া। এই রিপোর্টেই বলা হয়েছে—ভারত সরকার দেশের সার্বিক উন্নয়ন নিয়ে যে দাবি করে তা সত্যের চেয়ে অনেক দূরে।
গণতন্ত্রের অন্যতম আবশ্যিক শর্ত হল — সরকার কাজ করবে জনগণের জন্য। ‘জনগণের জন্য’ শব্দের অর্থ, অবশ্যই সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জন্য। পশ্চিমবাংলায় গ্রামে বাস করেন ৭২ শতাংশ লোক—এটাও তাদের মনে রাখতে হবে। সচ্চিদানন্দ দত্তরায়, প্রাক্তন অধিকর্তা, পশ্চিমবঙ্গ ফলিত অর্থনীতি ও পরিসংখ্যানে ব্যুরো। তাঁর লিখিত বক্তব্য (আনন্দবাজার, ২২ সেপ্টেম্বর ২০০৫) থেকে পশ্চিমবঙ্গ বিষয়ে একটা পরিষ্কার চিত্র উঠে আসে যে, সরকার জনগণের জন্য কতটা করেছে। শ্রীদত্তরায় জানাচ্ছেন, “পশ্চিমবঙ্গে গ্রামে বাস করেন ৭২ শতাংশ লোক। কিন্তু আয় বৃদ্ধির ক্ষেত্রে তাঁদের প্রাপ্তি মাত্র ২০ শতাংশ।” একই শ্রীদত্তরায় ২০ ডিসেম্বর ২০০৫-এর আনন্দবাজার পত্রিকায় বলেছেন, গ্রাম বাংলায় এখনও ৭৭% গরিব। সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে গ্রামে গরিবের সংখ্যা ৭৩% (গ্রাম ও শহরের মানুষদের মধ্যে কী ভয়ংকর অসাম্য! ভাবা যায়?)।
২২ সেপ্টেম্বর ২০০৫-এর আনন্দবাজার থেকে অর্থনীতিবিদ শ্রীদত্তরায়ের আরও কিছু বক্তব্য তুলে দিচ্ছি। খাদ্য-স্বাস্থ্য-শিক্ষা বিষয়ে পশ্চিমবঙ্গ সরকার কতটা করেছেন? শ্রীদত্তরায় জানাচ্ছেন, “দরিদ্র বিচারে প্ল্যানিং কমিশন যে মাপকাঠি ব্যবহার করেন, তাতে গ্রামদেশে মাথাপিছু দৈনিক ২৪০০ ক্যালরিযুক্ত খাদ্যের প্রয়োজনীয়তা স্বীকৃতি। এই নিরিখে ১৯৭৩-৭৪-এ পশ্চিমবঙ্গের গ্রামাঞ্চলে ৭৩ শতাংশ অধিবাসী দারিদ্রপীড়িত ছিলেন বলে কমিশনের হিসাব।” ১৯৮৩-র সমীক্ষা অনুসারে ৭৭ শতাংশ পশ্চিমবঙ্গবাসী দারিদ্রপীড়িত ছিলেন। ১৯৯৯-২০০০ সালে এই হার অপরিবর্তিত। ২০০৫ সালেও তা-ই শ্রীদত্তরায়ের প্রশ্ন, তবে কি ভূমিসংস্কার মধ্যপথে পরিত্যক্ত?
২০০৫-এর মাঝামাঝি সময়ে পশ্চিমবাংলার মুখ্যমন্ত্রী ও তাঁর দল জানাল, পশ্চিমবাংলায় এখনও সাড়ে চার হাজার গ্রাম আছে, যেগুলো অতি দরিদ্র। সে কারণেই মাওবাদীরা ওসব গ্রামে প্রভাব ফেলতে পারছে। স্বাধীনতার ৫৮ বছর পর এবং বাম-জমানার প্রায় তিন দশক শাসনের পরও গরিবি হটল না? তাহলে সরকার কাদের জন্যে? গ্রামাঞ্চলের সংখ্যাগুরু মানুষদের জন্য নয়? শহরের মুষ্টিমেয় মধ্যবিত্ত বাবুদের জন্য?
পশ্চিমবাংলার জনগণের (জন্য) সরকার স্বাস্থ্য বিষয়ে কতটা করতে পেরেছে—আসুন একটু দেখি। মুদিয়ালি কমিটি সুপারিশ করেছিল, প্রতি হাজার জনে ১টি হাসপাতাল-শয্যার। এই রাজ্যে ৩৪১টি ব্লকের মধ্যে মাত্র ২০ ব্লক সুপারিশ কার্যকর করতে পেরেছে। ২১৫ টি ব্লকে প্রতি ৪ হাজার জনে ১টি শয্যা এবং ৭১টি ব্লকে ৮ হাজার জনে ১টি শয্যার ব্যবস্থা আছে। এই রাজ্যের স্বাস্থ্যের ভয়াবহ চিত্রটির তথ্যসূত্র : বিভিন্ন জেলার ডিস্ট্রিক্ট স্ট্যাটিস্টিকাল হ্যান্ডবুক, ২০০২।
আসুন চোখ রাখি রাজ্যের শিক্ষা ব্যবস্থায়। অমর্ত্য সেনের তৈরি প্রতীচী ট্রাস্টের তরফ থেকে এক সমীক্ষা চালানো হয়েছিল রাজ্যের বিভিন্ন জেলায়। তাতে দেখা যাচ্ছে—প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ছাত্র সংখ্যা বেড়েছে। প্রাথমিক স্কুলের সংখ্যা গত কয়েক বছরে দু-হাজার কমেছে। তৃতীয় বা চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে যাদের গৃহশিক্ষক নেই, তাদের শতকরা ৯৩ জন নিজের নামটুকুও লিখতে শেখেনি। কেন্দ্রীয় সরকারের ন্যাশনাল ইনস্টিউট অফ এডুকেশন প্ল্যানিং অ্যান্ড অ্যাডমিনিস্ট্রেশন একটি রিপোর্ট তৈরি করেছেন ২০০৫ সালে। তথ্য সংগ্রহ করেছেন পশ্চিম বাংলার রাজ্য সরকারের কাছ থেকে। তাতে জানানো হয়েছে কলকাতার প্রাথমিক শিক্ষার অবস্থা। শতকরা ১২.৩ ভাগ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রথম থেকে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত ক্লাশ চলে একটি মাত্র ঘরে। মেয়েদের জন্য আলাদা শৌচাগার আছে এই শহরের মাত্র ২২ ভাগ স্কুলে। ১৪০০ স্কুলের মধ্যে ১৭০টিতে শিক্ষক আছেন ১ জন করে। শিক্ষকদের মধ্যে মাধ্যমিক পাশ না করা শিক্ষকের সংখ্যা ১১৬। দেশের চারটি মহানগর বা মেট্রো সিটির মধ্যে শিক্ষাক্ষেত্রে সবার শেষে আছে কলকাতা। মিত্র কমিশন সুপারিশ করেছিলেন—প্রাথমিক শিক্ষকদের যোগ্যতা হোক বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি। কেন আজ পর্যন্ত সেই সুপারিশ গ্রহণ করা হয়নি? বিশাল সংখ্যক বেকার স্নাতকরা কি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার থেকে বেকার থাকাটা শ্রেয় মনে করবে বলে-ই মাধ্যমিক পাশ না করা প্রার্থীদের শিক্ষক করা হচ্ছে? নাকি দলীয় কর্মীদের কথা ভেবে-ই এমন ব্যবস্থা?
হাঁড়ির একটা ভাত টিপলে সব ভাতের হাল বোঝা যায়। পশ্চিমবাংলার শিক্ষার চালচিত্র থেকে দেশের অবস্থা অনুমান করা একটুও শক্ত নয়।
আমাদের মত দরিদ্র ও উন্নতশীল দেশে সাধারণ মানুষের জীবনধারণের প্রতিটি পদক্ষেপে যেখানে রয়েছে অনিশ্চয়তা, বঞ্চনা, শোষণ, দুর্নীতি, স্বজনপোষণ ও অত্যাচার, সেখানে মানুষের জীবনে আর্থসাজাজিক পরিবেশের প্রভাব যথেষ্ট শক্তিশালী, এটা সমাজবিজ্ঞানী মাত্রেই স্বীকার করেন। এখানে স্রেফ বেঁচে থাকার তাগিদে মানুষকে নানা অসামাজিক ও অপরাধমূলক কাজে নামতে হয়। মেয়েদের নিজেকে বাঁচতে, সংসারকে বাঁচাতে ইজ্জত বেচতে হয়। এদেশের বহু মানুষের কাছে বিশুদ্ধ জল পান চরম বিলাসিতা। এ-দেশে এখনও অচ্ছুতরা বর্ণহিন্দুদের কুয়ো ছোঁয়ার দুঃসাহস দেখালে তাদের ধড় থেকে মাথা যায় কাটা। হরিজন নারীকে জীবনসঙ্গিনী করার অপরাধে বর্ণহিন্দুর চাকরি যায় বা বেঁচে থাকার অধিকারটুকু পর্যন্ত কেটে নেওয়া হয়। রাজনীতিকের জাদুকাঠির ছোঁয়া না পেলে ঋণ-মেলায় ঋণ মেলে না, সরকারি চাকরি অধরাই থেকে যায়। চাকরি সুযোগ সীমিত, বেকার অসীম । ফলে কাজ পেতে খুঁটি ধরাই সেরা যোগ্যতা বলে বিবেচিত হয়। তবুও এর পরও চাকরি পাওয়া ছেলেটি ও তাদের পরিবারের সকলেই মনে করে—কাজ পাওয়াটাই বিশাল ভাগ্য, মানতে ফল, অবতারের আশীর্বাদের কেরামতি, গ্রহরত্নের ভেল্কি।
যে দেশের পঙ্গু অর্থনীতি গ্রামে গ্রামে চিকিৎসার সুযোগ পৌঁছে দিতে পারে না, সে দেশের গ্রামবাসীরা রোগ ও মৃত্যুকে অদৃষ্টের লিখন বলে মেনে নিক—এটাই চাইবে রাষ্ট্রক্ষমতা, সরকার। আর তেমনটাই মেনে নিচ্ছে অসহায় গ্রামের মানুষরা। গরিব ঘরের মানুষের বিনে মাইনের স্কুলে সন্তান পড়াবার সাধ থাকলেও সাধ্যে কুলোয় না। ঘরের ছেলে কাজে না গিয়ে স্কুলে গেলে রোজগার করবে কে? শিশু-শ্রমের ওপরও প্রায় সমস্ত দরিদ্র পরিবারকেই কিছুটা নির্ভর করতে হয়। আবার পাশাপাশি এও সত্য—আব্রু রক্ষা করে স্কুলে যাওয়ার মতো সাধারণ পেশাটুকুও অনেকের জোটে না। পড়াশুনো ও বাইরের খবরাখবর রাখতে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা পড়ার সুযোগ যেহেতু দরিদ্রের ক্ষেত্রে খুবই কম, তাই শুধুমাত্র এই আর্থ-সামাজিক কারণেই দরিদ্র গ্রামবাসী ও শহরের বস্তিবাসীদের মধ্যে মেধা বুদ্ধি, মননশীলতা খুবই কম। গ্রামের কিশোরীদের চেয়ে শহরের গরিব কিশোরীদের অবস্থা অনেক বেশি খারাপ। এখানে একটা ঘর নামক নরকে বহু মানুষকে গাদাগাদি হয়ে ভোরের সূর্যের প্রতীক্ষা করতে হয়। ফলে অনেক সময় এরা নারী-পুরুষের গোপন ক্রিয়াকলাপ দেখে কৈশোরেই যৌন আবেগ দ্বারা চালিত হয়। আবার অনেক সময় ইচ্ছে না থাকলেও আর্থিক লালসার শিকার হতে হয়। কৈশোর পা দিয়েই অনেককে বেঁচে থাকার জন্যই যোগ দিতে হয় নানা অবৈধ কাজে। এইসব পিছিয়ে পড়া মানুষগুলো এমনতর জীবনযাত্রা ইচ্ছে করে বেছে নেয়নি, সমাজের অর্থনৈতিক কাঠামোই তাদের এমনতর জীবনযাত্রা গ্রহণ করতে বাধ্য করেছে।
আর্থসামাজিক পরিবেশ যে সাধারণ মানুষকে কী বিপুলভাবে
প্রভাবিত করে সে বিষয়ে সাধারণত মনোবিজ্ঞানীরা মুখ
খুলতে চাননি। যখন খুলেছেন, তখন মানবজীবনে
আর্থসামাজিক পরিবেশের প্রভাবকে লঘু
করে দেখাতে প্রয়াসী হয়েছেন।
সমাজ-সাংস্কৃতিক পরিবেশ
প্রতিটি সমাজ ও তার সংস্কৃতি জন্ম থেকেই শিশুর উপর প্রভাব বিস্তার করে। সমাজ সংস্কৃতির প্রভাবেই মানবিক আচার-আচরণ, মানবিক হৃদয়বৃত্তি বিকশিত হতে থাকে। শিশুকে হাঁটতে শেখানো হয়, শিশু হাঁটতে দেখে, তাই হাঁটে। শিশু কী ভাবে হাতকে ব্যবহার করে খাদ্য গ্রহণ করবে, কী ভাষায় কথা বলবে, সব নির্ভর করে মা-বাবা ও তার আশেপাশের আপনজনদের উপর। শিশু যদি কোন কারণে মানবসমাজে প্রতিপালিত না হয়ে পশুসমাজে বেড়ে ওঠে, তাহলে দেখা যাবে সে পশুর মতই হামা দিয়ে হাঁটবে। হাতকে ব্যবহার না করে পাত্র থেকে সরাসরি মুখ দিয়ে খাদ্য গ্রহণ করবে। জলপানের জন্য জিভকে কাজে লাগাবে।
শিশু বয়সে বা কৈশোরে মানুষ তার মা-বাবার ব্যক্তিত্ব ও মানসিকতার দ্বারা পরিচালিত হয়। মা-বাবার ধর্মীয় বিশ্বাস, আঞ্চলিকতা, গোষ্ঠীপ্রীতি, শ্রেণি-চেতনা, প্রাদেশিকতা, যুক্তিবাদী চেতনা, মূল্যবোধ, নীতিবোধ, সাহিত্য-প্রীতি, সংগীত-প্রীতি, অঙ্কন-প্রীতি, অভিনয় প্রীতি, দয়া, নিষ্ঠুরতা, ঘরকুনো মানসিকতা, সমাজসেবায় আগ্রহ, নেশা-প্রীতি, অসামাজিক কাজকর্মের প্রতি আগ্রহ, ভীরুতা, সাহসিকতা, অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয়তা, রাজনৈতিক সচেতনতা, সমাজ সচেতনতা, মিথ্যে বলার প্রবণতা ইত্যাদি সন্তানকে প্রভাবিত করে।
শিশু বড় হতে থাকে। পাঠাভ্যাস গড়ে উঠলে বিদ্যালয়ের শিক্ষক, সহপাঠীদের চিন্তাভাবনা, আচার-ব্যবহার, ভাললাগা না লাগা প্রভাবিত করতে থাকে। বেড়ে ওঠা শিশুটির ওপর অনবরত প্রভাব ফেলতে থাকে পরিবারের লোকজন, আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশী, বন্ধু, পাঠ্য বই, পত্র-পত্রিকা, টেলিভিশন, সিনেমা, যাত্রা, থিয়েটার, ক্লাব, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি। কিশোর বয়েসে সে তার ঘনিষ্ঠ মানুষজনের চোখ ও কান দিয়ে দেখে ও শোনে। তার পরিচিত গোষ্ঠীর মূল্যবোধের সঙ্গে জাতীয় স্বার্থের সংঘাত হলে সে নিজের গোষ্ঠীস্বার্থে বিরোধিতা করতে পারে। ধর্মীয় উন্মত্ততা, জাত-পাতের সংকীর্ণতা, অতীন্দ্রীয়তার প্রতি বিশ্বাস, ঈশ্বরজাতীয় কোনও কিছুর অস্তিত্বে বিশ্বাস জ্যোতিষশাস্ত্রে বিশ্বাস, মন্ত্র-তন্ত্রের ক্ষমতায় বিশ্বাস, ভূত নামের কোনও কিছুর অদ্ভুত সব কাজকর্মের প্রতি বিশ্বাস, তাবিজ-কবজে বিশ্বাস ইত্যাদি প্রধানত গড়ে ওঠে আশেপাশের সামাজিক পরিবেশ থেকে পারিপার্শ্বিক মানুষগুলোর বিশ্বাসের পরিমণ্ডল থেকে।
শিশুকাল থেকে আমরণ আমাদের প্রভাবিত করে আমাদের সমাজ, আমাদের সংস্কৃতি। ফলে আমরা সাধারণভাবেই সেই সমাজ ও সংস্কৃতির অংশীদার হয়ে পড়ি।
আমাদের খাওয়াদাওয়ার অভ্যাস, শিক্ষা-চেতনার
স্ফূরণ, রাজনৈতিক মতবাদ-কোনও কিছুই
শূন্য থেকে আসে না। এর প্রত্যেকটি
গড়ে ওঠে সমাজ-সংস্কৃতিক
প্রভাবের ফলেই।
এ যুগের অনেকেই প্রথাগত উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত। এঁদের অনেকে বিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা ইত্যাদি করেছেন। ডক্টরেট ডিগ্রি পেয়ে বিজ্ঞানী হয়েছেন। চিকিৎসক পেশায় সফল হয়ে চিকিৎসা-বিজ্ঞানী নামে প্রচারিত হচ্ছেন। এঁদের অনেকেই বিজ্ঞানের কোনো বিভাগকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করলেও মনে-প্রাণে বিজ্ঞানী হতে পারেননি। পারেননি বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিকে গ্রহণ করতে পরীক্ষা, পর্যবেক্ষণের পরই কোনও মনতে গ্রহণ বা বর্জন করতে। এঁরা আমাদের সমাজের আপনার আমারই বাড়ির ছেলে। শিশুকালে হাতেখড়ি হয়েছে সরস্বতীকে আরাধনা করে। মা-বাবা, আত্মীয়স্বজন, পরিচিতদের দেখেছে ঈশ্বরজাতীয় কারো কাছে পরম ভক্তিতে আভূমি নত হতে। পড়ার বইয়ে বার বার ঘুরেফিরে এসেছে পুরাণের গল্পের মধ্যে কাল্পনিক অলৌকিক কাহিনি। দেখেছে জ্যোতিষকোষ্ঠী হাতের রেখার প্রতি পরিচিত মানুষদের গভীর বিশ্বাস। শিক্ষাক্ষেত্রে প্রভাব ফেলেছে ঈশ্বর, আল্লা ও পরম পিতার প্রতি প্রার্থনা। এমনি আরও নানা রকমের অন্ধ-বিশ্বাস ও সংস্কারের মধ্যে বেড়ে ওঠার সূত্রে বিশ্বাস করেছে বহু অলীকে। কিন্তু লেখাপড়ায় ভালো হওয়ার সুবাদে আপনি-আমি ছেলের ভবিষ্যতের কথা ভেবে, তাকে বিজ্ঞান শাখায় পড়তে উৎসাহিত করেছি। সন্তান আমাদের বিজ্ঞান শাখায় পড়াশুনা করেছে। পড়াশোনায় সফল হয়ে বিজ্ঞানকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছে; যেমনভাবে পেশা হিসেবে কেউ গ্রহণ করে আলু-পটলের ব্যবসাকে। কিন্তু বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিকে তারা কখনই নিজেদের জীবনে গ্রহণ করেনি। আর্থ-সামাজিক পরিবেশই এমন সব অনেক বড় বড় বিজ্ঞান পেশার কিন্তু বিজ্ঞানে অবিশ্বাসী মানুষ বা অমানুষ তৈরি করেছে। ‘অমানুষ’ কথাটা একটু কড়া হলেও সুচিন্তিতভাবেই লিখতে হল। যে নিজেকে বিজ্ঞানীর পূজারী বলে জাহির করে এবং একই সঙ্গে পরীক্ষা, পর্যবেক্ষণের পথ পরিত্যাগ করে অন্ধ-বিশ্বাসকে আঁকড়ে ধরে, তাকে ‘অমানুষ’ নিশ্চয়ই বলা চলে। কারণ তার গায়ে ‘বিজ্ঞানী’ তকমা আঁটা থাকায় তার ব্যক্তি-বিশ্বাস সাধারণ মানুষের ব্যক্তি-বিশ্বাসের চেয়ে অনেক বেশি ধ্বংসাত্মক ভূমিকা নেয়। মানুষের প্রগতির পক্ষে, বিকাশের পক্ষে বিশাল বাধা হয়ে দাঁড়ায়। জনগণ স্বভাবতই যা ভাবে তা হল এত বড় বিজ্ঞানী কি আর ভুল কথা বলছেন? ঠিক এই সময় ভ্রান্ত চিন্তার পরিমণ্ডল থেকে সাধারণ মানুষকে বের করে আনতেই প্রয়োজন নতুন বলিষ্ঠ যুক্তিযুক্ত চিন্তার পরিমণ্ডল সৃষ্টি করা। এই সময়ই প্রয়োজন বিভ্রান্তিকর কুযুক্তির প্রভাব থেকে মুক্ত করতে সুযুক্তির সঙ্গে সাধারণ মানুষদের পরিচয় ঘটিয়ে দেওয়া। মানুষ সাধারণভাবে যুক্তির দিকেই ধাবিত হয়। সুযুক্তির সঙ্গে পরিচিত হলে কুযুক্তি তারা বর্জন করেই। দীর্ঘদিনের প্রচলিত বহু ভ্রান্ত চিন্তা ও ধারণাকেই বর্তমানে শোষক ও শাসকশ্রেণি বজায় রাখতে সচেতন।
ওদের মালিকানাধীন পত্র-পত্রিকায়, টি-ভিতে বিজ্ঞানীবিরোধী বক্তব্যকে বিজ্ঞানের বক্তব্য বলে প্রচার করে। অলৌকিকতার পক্ষে প্রচার চালায়। রামদেব থেকে রামকৃষ্ণকে নিয়ে নাচন-কোদন করে।
যে ভ্রান্ত চিন্তা প্রতিটি বঞ্চনার জন্য অদৃষ্টকে দোষারোপ
করে, সে ভ্রান্ত চিন্তা মানুষের মধ্যে থাকলে
লাভ তো বঞ্চনাকারীদের।
তাই তো বঞ্চনাকারী শোষক ও তাদের তল্পিবাহক শাসকরা মুখে যতই সাধারণ মানুষদের কুসংস্কার মুক্ত করার আহ্বান জানাক না কেন, কাজে বঞ্চিত মানুষদের কুসংস্কারে আবদ্ধ রাখতেই চাইবে। তাদের সমস্ত ক্ষমতা ও প্রচারের সাহায্যে সব সময়ই জনসাধারণের মগজ ধোলাই করে।
কুসংস্কার-মুক্তির আন্দোলনের সাফল্য কখনই সরকারি সহযোগিতায় আসবে না। বরং এই আন্দোলনকে নানা পর্যায়ে বাধা দেবে সরকার। ওদের মালিকানাধীন পত্র-পত্রিকায়, টিভি-তে বিজ্ঞান বিরোধী বক্তব্যকে বিজ্ঞানের বক্তব্য বলে প্রচার করে। রামদেব থেকে রামকৃষ্ণের মতো হি-জি-বি-জি-দের নিয়ে নাচান-কোদন করে।
আমাদের দেশের শিশু যখন যুবক ও প্রৌঢ়ত্বে পা রেখে তাদের আজন্ম লালিত ধর্মীয় ধারণা ও অন্ধবিশ্বাসগুলো একইভাবে অনড় থাকে যদিও এঁদের কেউ কেউ ব্যবহারিক জীবনে যা পেশাগতভাবে। ‘বিজ্ঞানী’, ‘বুদ্ধিজীবী’ ইত্যাদি বিশেষণে পরিচিত হতে থাকেন। তাই বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় ও বিজ্ঞান-পেশার মানুষদের মধ্যেও দেখা যায় যুক্তির শিথিলতা অথবা যুক্তিহীনতা। এঁদের অনেকেরই আঙুলে, গলায়, দুষ্পাঠ্যজুতে, শোভা পায় গ্রহরত্ন, ধাতুর বালা বা আংটি, শিকড় বা তাবিজ কবচ। ধারণ করার কারণ জিজ্ঞেস করলে এঁদের অনেকেই লজ্জায় স্বীকার করতে চান না—ভাগ্য ফেরাতে পরেছেন। প্রেসটিজ বজায় রাখতে সকলেই হাত বাড়ায় অজুহাতের দিকে। এঁরা নিজেদের ‘প্রেজেন্ট’ করেন বিদ্যাসাগরের সুবোধ বালক হিসেবে—‘যাহা দেয়, তাহাই পরে’। এ-সব হাবি-জাবি জিনিস পরতে এঁদের নাকি অনুরোধ জানিয়েছিলেন মাতা, মাতামহী, পিতা পিতামহ, আত্মীয়, বন্ধু, প্রেমিক, পত্নী ইত্যাদিরা। আর স্রেফ, ওদের দুঃখ দিতে না চাওয়ার জন্যই পরা। এঁরা এতই কোমল হৃদয় প্রাণী যে ভয় হয়, কেউ জুতোর মালা পরাতে চাইলে প্রার্থীর হৃদয় রাখতে টপ্ করে না জুতোর মালাই গলায় গলিয়ে ফেলেন। কেউ কেউ আবার এই যুক্তি দেন—“বলল, তাই পরে ফেললাম। দেখি না, যদি কাজ হয় ভাল, না হলেও ক্ষতি তো নেই।” এই স্বচ্ছতাহীন দ্বিধাগ্রস্ত মানুষগুলো এটা বোঝে না যে, এতেও ক্ষতি হয়। প্রথমেই অর্থ ক্ষতি তো অবশ্যই। তারপর যে ক্ষতি তা সমাজের ক্ষতি। মানুষ যেহেতু সামাজিক জীব তাই এই দ্বিধাগ্রস্ততা, অস্বচ্ছতা যা অদৃষ্টবাদকে সমর্থনেরই নামান্তর, তা প্রভাবিত করবে তাঁরই পরিবারের শিশুটিকে, আশেপাশের মানুষজনকে।
সাংস্কৃতিক পরিবেশ পাল্টানো যায়
সাংস্কৃতিক পরিবেশ পাল্টাতে হলে আমজনতার চেতনাকে পাল্টাতে হবে। তাদের চেতনাকে উন্নত করতে হবে। চেতনাকে তারাই উন্নত করতে পারে, যাদের চেতনা উন্নত নিজে মুক্তমনের অধিকারী যুক্তিমনস্ক মানুষ না হলে সাধারণকে এমন আদর্শে প্রাণিত করা যায় না।
সাংস্কৃতিক পরিবেশকে পাল্টাবার দায়িত্ব ‘প্রগতিবাদী’ বলে দাবি করা রাজনৈতিক দলগুলো নেবে—এমনটাই প্রত্যাশিত ছিল। কিন্তু প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। ওরা আমজনতার চেতনা-স্তরে নামিয়ে আনতে সক্রিয় থেকেছে। শনি-শীতলার পুজো থেকে দুর্গা-কালী পুজো, সব হুজুগেই ওরা শামিল। ওরা পৈতেতে আছে, শ্রাদ্ধে আছে। এদের পার্টিবাজি সাধারণের মধ্যে ভয়, অবিশ্বাস ও ঘৃণা তৈরি করেছে। ফলে আজ ‘রাজনীতি’ শব্দটি ‘দুর্নীতি’র সমার্থক হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভয় দেখিয়ে নির্বাচন জেতা যায়, কিন্তু সাধারণ মানুষের সাংস্কৃতিক চেতনা পাল্টানো যায় না। সমাজ-সাংস্কৃতিক পরিবেশ পাল্টানো যায় না।
এই বঙ্গের সবচেয়ে বড় ও ক্ষমতাবান রাজনৈতিক দলের সবাই কিন্তু এখনও পচে যায়নি। সাম্যের সমাজ গড়ার স্বপ্ন দেখা কিছু ক্যাডার-লিডার যে ও দলে আছে—জানি। ওঁরা ছাত্র-রাজনীতিকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করলে অনেক বড় মাপের কাজ হয়। ছাত্র-ইউনিয়ন দাবি তুলুক—“তাগা-তাবিজ, রত্ন উপবীতধারী অধ্যাপকের বিজ্ঞান ক্লাস নেওয়ার কোনও অধিকার নেই, কুসংস্কারে ডুবে থাকব। বিজ্ঞান-বিরোধিতা করব, আবার বিজ্ঞান ক্লাস নেব—এই দ্বিচারিতা চলধে না।” এইসব দ্বিচারী অধ্যাপকদের ক্লাস বয়কট করা শুরু করুক ছাত্ররা।
মার্ক্সবাদী পার্টির ভিতর থেকেই দাবি উঠুক—একই সঙ্গে মার্ক্সবাদী পার্টির নেতা হব, আবার কুসংস্কারে, জাত-পাতে বিশ্বাস রাখব, এ চলতে দেওয়া হবে না।
দল থেকে আবর্জনা ঝেঁটিয়ে বিদায় করতে না পারলে ভণ্ডামির দায়ে মানুষের গভীর অবিশ্বাস ও ঘৃণা ছাড়া কিছুই পাওয়া যাবে না।