অলৌকিক নয়, লৌকিক (প্রথম খণ্ড)/অধ্যায়: এক


অধ্যায়: এক

প্রস্তাবনা

আকস্মিকতার চেয়ে ধারাবাহিকতাই বেশি

মে, ২০০৬ জিনতত্ত্বের সবচেয়ে বড় আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে সামগ্রিক জেনেটিক কোড জানা সম্পূর্ণ করলেন বিজ্ঞানীরা। ক্রোমোজম ১-এর সিকুয়েন্সিং বাকি ছিল। এবার সেটির কাজ শেষ হলো। এর ফলে ক্যানসার, অলজাইমারস্ ও পারকিনসনসের মতো অন্তত ৩৫০টি রোগের গোপন রহস্য জানা সম্ভব হবে। এইসব রোগের আরোগ্য এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা। বিশ্বখ্যাত জিনতত্ত্বের বিজ্ঞানীরা মানব সভ্যতাকে এক লাফে এগিয়ে দিলেন অনেকটা।

 একই বছরে বিভিন্ন ভারতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত একটি খবর।

বিহার বিধানসভার অধ্যক্ষের পত্নীর মৃত্যু,
আবার ফাঁসলেন রামদেব

 হিন্দি ভাষার জনপ্রিয় ম্যাগাজিন ‘সরস সলিল’-এর জুন ২০০৬ সংখ্যায় একটি খবর প্রচণ্ড হৈ-চৈ ফেলে দিয়েছে।

 খবরে বলা হয়েছে, রামদেব মার্চ ২০০৬-এ তাঁর পাটনায় শিবির বসান। শিবিরে বিহার বিধানসভার অধ্যক্ষ উদয় নারায়ণ চৌধুরীর ক্যানসার রোগে আক্রান্ত পত্নীর চিকিৎসা শুরু করেন। কিছু ‘জড়িবুটি’-র সঙ্গে প্রাণায়াম এবং মন্ত্র ছিল রামদেবের ‘অব্যর্থ’ চিকিৎসার অঙ্গ।

 ২৫ মার্চ ২০০৬ পাটনা-শিবির শেষ হয়। তার দশ দিন পর (অর্থাৎ ৪ এপ্রিল ২০০৬) অধ্যক্ষ-পত্নী ভরোনিকা চৌধুরীর মৃত্যু হয়।

 এই ঘটনা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল গ্যারাণ্টি দিয়ে ১০ হাজার ক্যানসার রোগী সারিয়ে তোলার রামদেবের দাবি কী বিশাল ভণ্ডামী।

 ৭ জানুয়ারি ২০০৬ বাবা রামদেবকে জিজ্ঞেস করেছিলাম (‘NDTV’ ইণ্ডিয়া’র মুকাবিলা অনুষ্ঠানে), আপনি ‘যোগ সাধনা’ বইতে লিখেছেন ‘প্রাণ মুদ্রা’য় যে কোনও চোখের রোগ সারে। আপনার বাঁ চোখ পিট্‌পিট্‌ করা রোগটা সারাচ্ছেন না কেন? আমার প্রশ্নের উত্তরে গালাগাল দিয়েছেন। রামদেব জানালেন, ‘খেচরী মুদ্রা’ জানেন। যোগের আকর-গ্রন্থ ‘হঠযোগ প্রদীপিকা’ তুলে ধরে বললাম, এতে লেখা আছে, ‘খেচরী মুদ্রা’ জানলে ক্ষুধা, তৃষ্ণা, মৃত্যু নেই। আপনি কি অমর থাকবেন? উত্তরে জানালেন, অবশ্যই অমর থাকবেন। আপনি সত্যি বলছেন, না কি মিথ্যে? খেচরী মুদ্রা জানার পর আপনাকে খাদ্য-পানীয় কেন গ্রহণ করতে হয়? উত্তর দিলেন না বাবা রামদেব। প্রশ্ন করেছিলাম, হাতের নখে নখ ঘষলে টেকো মাথায় চুল গজায় বলে আপনি দাবি করেছেন। এ দাবি কি সত্যি? রামদেবের কথা—হাজার হাজার টাকে এভাবে চুল গজিয়েছে। চ্যালেঞ্জ করতেই রামদেব তােতলাতে তােতলাতে পিছু হটলেন।

विधानसभा अध्यक्ष की पत्नी की मौतः

फिर फंसे रामदेव

पने पठना शिविर के दौरान बाबा रामदेव ने बिहार विधानसभा अध्यक्ष उदय नारायण चौधरी की कैंसर से पीड़ित पत्नी वरोनिका चौधरी को कुछ जड़ीबूटियों के साथ प्राणायाम का ‘अचूक’ मंत्र दिया, फिर भी 25 मार्च को शिविर खत्म होने के 10 दिनों के अंदर ही उन की मौत हो गई।

 वरोनिका चौधरी की मौत 4 अप्रैल, 2006

 আবার ফাঁসলেন’ কথার অর্থ—তার আগেও ফেঁসেছিলেন, NDTV ইণ্ডিয়া’র ‘মুকাবিলা’ অনুষ্ঠানে আমারই কাছে। তারিখটা ছিল ৭ জানুয়ারি, সাল ২০০৬। রাত ১০টা থেকে ১১-৩০ পর্যন্ত পাক্কা দেড় ঘণ্টার অনুষ্ঠানে রামদেবের ভণ্ডামী, অজ্ঞতা, মিথ্যাচারিতা সবই কিমা-কিমা করেছি। গােটা বিষয়টা বিস্তৃত জানতে পড়তে পারেন, ‘মনের নিয়ন্ত্রণ-যােগ-মেডিটেশন’ গ্রন্থটি)।

 একবিংশ শতাব্দিতে, সেলফোন, মাইক্রোচিপ্‌স, স্যাটেলাইট, ইণ্টারনেটের যুগে আগস্ট ২০০৬ দেবমূর্তির ‘দুধপান’ নিয়ে হুজুগে মাতলাে ‘শিক্ষিত’ ভারতবাসী। এগার বছর আগে একই ঘটনা ঘটেছিল। তখন শুধু গনেশমূর্তি দুধ খেয়েছিল। সেবার সারাদিন ঘুরে ঘুরে গনেশের দুধ পান দেখে বিকেলে ‘দ্য টেলিগ্রাফ’ পত্রিকার দপ্তরে বসে লেখটা শেষ করেই দৌড়েছিলাম ‘বিড়লা মিউজিয়ম’-এ। সেখানে দূরদর্শনের Live অনুষ্ঠানে গনেশের দুধ খাওয়ার পিছনে হাতে-কলমে বােঝাতে আমি ছাড়াও ছিলেন একাধিক বিজ্ঞানী। ২২ সেপ্টেম্বর, ১৯৯৫-এ ‘দ্য টেলিগ্রাফ’ পত্রিকায় আমার তাতে ‘দুধ পান রহস্য’ উন্মােচন করা লেখাটি বিশাল গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশিত হয়েছিল। কিন্তু তার এগারাে বছর পর আবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি! একে কী বলবাে—আকস্মিকতা? নাকি ধারবাহিকতা?

 বর্তমান ভারতে একই সঙ্গে ধর্মের রমরমা ও যুক্তিবাদের দ্রুত অগ্রগতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এদেশে বিশ্বায়ন এসে পড়েছে। তারই সঙ্গে তাল রেখে যখন এদেশেরই একটা অংশ তাল মেলাচ্ছে, তখন আর একটা অংশ আকণ্ঠ ডুবে রয়েছে অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারে।

 ২০ আগস্ট ২০০৬ সন্ধে থেকে ও ২১ আগস্ট সন্ধে পর্যন্ত দেবমূর্তিরা ‘দুধপান’ করেছেন। ১১ বছর আগে ‘দুধ পান’ গুজবের উৎস ছিল দিল্লি। এবার গাজিয়াবাদ। গাজিয়াবাদ থেকে দ্রুত গুজব ছড়িয়ে পড়ে দিল্লি, চণ্ডীগড়, লুধিয়ানা, জয়পুর, এলাহাবাদ, কাশী, পাটনা, কলকাতা সহ আরও বিভিন্ন শহরে। হাজারে হাজারে মানুষ মন্দিরে হাজির হন দুধ-চামচে নিয়ে। এদের মধ্যে প্রথাগত ভাবে শিক্ষিতের সংখ্যা বিপুল।

 ২০ আগস্ট রাত ১০টা নাগাদ প্রথম ফোন করে আমার প্রতিক্রিয়া জানতে চান ‘স্টার নিউজ’-এর প্রতিনিধি। ১০টা ১৫-তে আমাকে ফোনে ধরলেন ‘স্টার-আনন্দ’-এর প্রতিনিধি। তাঁর সঙ্গে আমার ফোনের কথোপকথন প্রচারিত হলো। বললাম, ১১ বছর আগের অভিজ্ঞতার কথা। জানালাম, গনেশ বা অন্য দেবমূর্তির দুধপানের মধ্যে অলৌকিক কিছু নেই। আপনাদের তোলা যে ছবি দেখাচ্ছেন, তাতে দেখা যাচ্ছে সমস্ত দুধই শ্বেতপাথরের দেবমুর্তির গা বেয়ে নেমে যাচ্ছে। মুর্তির তলা বেয়ে সিঁড়ি পর্যন্ত ভেসে যাচ্ছে দুধে। ভক্তরা দুধভরা চামচ ধরছেন মূর্তির ভেজা শুঁড়ে বা ঠোঁটে। শুঁড়ের বা ঠোঁটের একটি জলবিন্দু চামচের দুধকে আকর্ষণ করছে। এটা তরল পদার্থের ধর্ম। তারপর মাধ্যাকর্ষণের পৃষ্ঠটানে আকর্ষিত হয়ে দুধের কিছুটা ভেঁজা শরীর বেয়ে নেমে যাচ্ছে তলায়। ওমনি ভক্তরা চামচকে বেশি করে হেলিয়ে ধরছেন। চামচের দুধ যতই কমতে থাকে, ততই চামচ আরও বেশি করে হেলিয়ে ধরেন ভক্তরা। ভক্তি থেকে অবচেতন মন চামচে হেলাতে শুরু করতেই পারে। এটা খুবই স্বাভাবিক মানসিক প্রতিক্রিয়া। আবার কেউ নিজেকে জাহির করতে ইচ্ছে করেও হেলাতে পারে।

 সেদিন রাতেই আনন্দবাজারের প্রতিনিধি এ বিষয়ে আমার সাক্ষাৎকার নিলেন। পরদিন ভোরে আমাকে ঘুম থেকে তুললেন ‘স্টার আনন্দ’। ফোনে সাক্ষাৎকার। বললাম, যে পদার্থ যত বেশি, তরল অর্থাৎ সান্দ্রতা বেশি, সে-পদার্থকে তত বেশি তাড়াতাড়ি আকর্ষণ করবে দেবমূর্তির শরীরে লেগে থাকা তরলবিন্দু। কেরসিন থেকে হুইস্কি, ফলিডল থেকে সাবানজল দেবতারা সব পান করবে। শুধু খেতে পারবে না লাড্ডু, পেঁড়া, আপেল এইসব না-তরল পদার্থ। |

 ২১ আগস্ট দুপুরে ‘স্টার আনন্দ’-এর ঋতব্রত এলেন। সঙ্গে ফটোগ্রাফার। ওদের কাজ শেষ করেই ‘তারা’-র ওবি ভ্যানের সঙ্গে মন্দির পরিক্রমা শুরু করলাম। ‘তারা’র প্রতিনিধি অয়নদেবের এক প্রশ্নের উত্তর জানালাম, যেসব পদার্থ বিজ্ঞানী বলেছেন, কাঁচ, চিনেমাটি, ধাতুর তৈরি মূর্তি দুধপান করবে না; তাঁরা যদি হাতে কলমে পরীক্ষা করতেন তো দেখতেন ওইসব ধাতুমূর্তিও দুধ খায়। ওঁদের বক্তব্য ছিল, যে-সব মূর্তির গায়ে খালি চোখে দেখা যায় না, এমন ছোট ছোট ছিদ্র থাকে, তারাই শুধু ‘দুধপান’ করে। এটা দুধপানের অন্যতম শর্ত। ছিদ্রগুলোতে দুধ ঢুকে যায়, তাইতেই চামচের দুধ কমে। ছিদ্রগুলো দুধে ভর্তি হয়ে গেলে মূর্তি খাওয়া বন্ধ করে।

 অয়নদেবকে আমি দেখালাম চিনেমাটির মূর্তি থেকে ধাতুর মূর্তিও দুধপান করছে হৈ-হৈ করে।

 রাতে ‘এখন বাংলা’ এবং তারপর ‘তারা’র স্টুডিওতে হাজির হলাম। সেখানে সঞ্চালক ও দর্শকদের প্রশ্নের উত্তরের ফাঁকে ফাঁকে দেখাতে হলো, ঘোড়া থেকে সাপ সব্বাই দুধ, ঠাণ্ডা পানীয়, কেরসিন—সব পান করছে। খাচ্ছে না শুধু আপেল-আঙুর।

 দেবমূর্তিরা যখন ‘দুধপান’-এ ব্যস্ত, তখনই আরব সাগরের জল মিষ্টি হয়ে গেছে—গুজবে সারা মুম্বাই নাচলো। সুফি সন্ত মকদুম শাহের কৃপায় নাকি এমনটা ঘটেছে। সর্বরোগহর এই মিষ্টি জল বোতলবন্দি করতে হুড়োহুড়ি পড়ে গেল। লবণাক্ত সমুদ্রের জলে লবণের পরিমাণ কমে সাদা জল (plain water) হয়ে যায় জলে ফ্লোরাইড ও ক্লোরাইডের যৌগ বৃদ্ধি হলে। এই প্রাকৃতিক ঘটনার মধ্যে অপ্রাকৃতিক ঘটনাকে আবিষ্কার করার মতো অপ্রকৃতিস্থ শিক্ষিত মানুষের আজও অভাব ঘটেনি ভারতে।

 মোবাইল ভূত থেকে লাইট ভূতের আঁচড়ে দেওয়ার মত ঘটনায় পশ্চিমবঙ্গ তোলপাড় হয়। ভূতের ভয়ে বর্ধমানের ‘বেনাগ্রাম’-এর সব মানুষ গ্রাম ছেড়ে পালায়।

 এতসব তোলপাড় করা ঘটনা দেখে মনে হয় ভারতের শিক্ষিতরা কি মধ্যযুগের দিকে ফিরছেন? এতসব অলৌকিক কাণ্ডকারখানাগুলো সবই কি আকস্মিক? নাকি এটাই ‘মূর্খ’-ভারতের ধারাবাহিকতা?

মানুষ ও দেবতা

এককালে অসহায় মানুষ প্রকৃতির শক্তিকে ভয় ও শ্রদ্ধা করেছে। জল, ঝড়, বৃষ্টি, নদী, সমুদ্র, বন্যা, আগুন, পাহাড়-পর্বত, মাটি সমস্ত কিছুরই প্রাণ আছে বলে বিশ্বাস করেছে, বসিয়েছে দেবত্বের আসনে। সুর্য, চন্দ্র, পৃথিবী, বৃহস্পতি, শনি প্রভৃতি জড় নক্ষত্র ও গ্রহগুলোর পুজো করেছে জীবন্ত দেবতা হিসেবে। মানুষের জীবনে সম্পদ হিসেবে প্রবেশ করেছে বৃক্ষ, অরণ্য, গরু, ছাগল, শুয়োর আরও নানা ধরনের গৃহপালিত জন্তু। এরাও দেবতা হিসেবে পুজো পেয়েছে। শিক্ষা ও বিজ্ঞানের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে অনেক মানুষের কাছেই এইসব দেবতারা দেবত্ব হারালেও সবার কাছে হারায়নি।

 প্রাচীন মানুষ জীবাণুর অস্তিত্ব সম্বন্ধে জ্ঞাত না থাকার দরুন অসুখকে কখনও বলেছে পাপের ভোগ, কখনও বা বলেছে অশুভ শক্তির ফল। তন্ত্র-মন্ত্র, মাদুলি, যাগ-যজ্ঞ, জলপড়া, তেলপড়া, ঝাড়ফুঁক, স্বপ্নাদিষ্ট ওষুধ রোগের চিকিৎসা হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। আজও এই ধরনের চিকিৎসা পদ্ধতি অনুন্নত দেশে এবং কিছু কিছু পিছিয়ে থাকা সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রচলিত রয়েছে। রোগ না সারলে কারণ হিসেবে কাউকে ডাইনি ঘোষণা করে হত্যা করার ইতিহাস ক্ষীণতর হলেও স্তব্ধ হয়নি।

 মানুষ গোষ্ঠীবদ্ধ হয়েছে। গোষ্ঠীর শক্তিমান ও বুদ্ধিমানকে বরণ করেছে নেতার পদে। শক্তিমান হয়েছে শাসক, বুদ্ধিমান হয়েছে ধর্মীয় নেতা। ধর্মীয় নেতারা বুদ্ধির জোরে শাসকদের ওপরও প্রভুত্ব করতে চেয়েছে। নিজেদের ঘোষণা করেছে ঈশ্বরের প্রেরিত দূত হিসেবে, ঈশ্বরের সন্তান হিসেবে, নবরূপে ঈশ্বর হিসেবে। বিভিন্ন কৌশল সৃষ্টি করে সেইসব কৌশলকে সাধারণের সামনে হাজির করেছে অলৌকিক ক্ষমতা হিসেবে। নিজেদের এইসব অলৌকিক কীর্তিকথা প্রচারের জন্য কখনও সাহায্য নিয়েছে কিছু সুবিধাভোগী সম্প্রদায়ের, কখনও বা কিছু অন্ধ বিশ্বাসীদের। পরবর্তীকালে সেইসব অলৌকিক কীর্তিকথার কিছু কিছু পল্লবিত হয়ে কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছে।

 এই সব ধর্মগুরুরা নিজস্ব ধারণাগুলোকে ঈশ্বরের মত বলে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছে এবং অনেক ক্ষেত্রে সফলও হয়েছে, যদিও পরবর্তীকালে বিজ্ঞানের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে এইসব অভ্রান্ত ঈশ্বরের মতগুলো একে একে ভ্রান্ত বলে প্রমাণিত হয়েছে।

 ধর্মীয় শাসকেরা যে-সব ধর্মগ্রন্থ রচনা করে গেছে, সেগুলো বিভিন্ন ধর্মে বিশ্বাসী মানুষেরা অভ্রান্ত সত্য হিসেবেই গ্রহণ করেছে। যুক্তি দিয়ে বিচার না করেই সংখ্যাগুরু মানুষ যুগ যুগ ধরে মেনে চলেছে ধর্মীয় ধারণাগুলোকে। শাসক সম্প্রদায় ও পুরোহিত সম্প্রদায় পরস্পরের সহযোগী ও পরিপূরক হয়ে শোষণ করেছে অন্ধ-বিশ্বাসী সাধারণ মানুষদের।

 বিশ্বের বহু দেশেই বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় শিশুমনেই রোপিত হচ্ছে অবাস্তব অলৌকিক ধ্যান-ধারণার বীজ। দেব-দেবী ও সাধক-সাধিকাদের মনগড়া অলৌকিক কাহিনি পড়ে ও শুনে যে বিশ্বাস শিশু মনে অঙ্কুরিত হচ্ছে, তাই পরিণত বয়সে বিস্তার লাভ করছে বৃক্ষরূপে।

যুক্তিবাদী, মুক্তচিন্তার সেইসব মানুষ

 খ্রিস্টজন্মের ৫০০ বছর আগে পিথাগোরাস, এনাকু, সিমেণ্ডের মতো গ্রীক অনুসন্ধিৎসু পণ্ডিতেরা জানিয়েছিলেন, পৃথিবী সূর্যের একটি গ্রহ, সূর্যকে ঘিরে পৃথিবী ও অন্য গ্রহগুলো ঘুরছে। বিনিময়ে ধর্ম-বিরোধী, ঈশ্বর-বিরোধী, নাস্তিক মতবাদ প্রকাশের অপরাধে এঁদের বরণ করতে হয়েছিল অচিন্তনীয় নির্যাতন, সত্যের ওপর অসত্যের নির্যাতন, ধর্মের নির্যাতন।

 এই মতকে ২০০০ বছর পরে পুস্তকাকারে তুলে ধরলেন পোল্যাণ্ডের নিকোলাস কোপারনিকাস। তাঁরই উত্তরসুরি হিসেবে এলেন ইতালীর জিয়োর্দানো ব্রুনো, গ্যালিলিও গ্যালিলেই। প্রতিষ্ঠা করতে চাইলেন বৈজ্ঞানিক সত্যকে—সূর্যকে ঘিরে আবর্তিত হচ্ছে পৃথিবীসহ গ্রহগুলো।


ব্রুনো

 সে-যুগের শিক্ষাক্ষেত্রেও ছিল প্রচণ্ড ধর্মীয় প্রভাব। ধর্মীয় বিশ্বাসকেই অভ্রান্ত বলে মেনে নিয়ে শিক্ষা দেওয়া হতো। সাধারণের মধ্যেও ধর্মান্ধতা ছিল গভীর ও ব্যাপ্ত। বাইবেল-বিরোধী মত প্রকাশের জন্য মহামান্য পোপ ক্ষিপ্ত হলেন, ক্ষিপ্ত হলো ধর্মর্যাজক ও ধর্মান্ধ মানুষগুলো। ব্রুনো বন্দি হলেন। ধর্ম-বিরোধী মত পোষণের অপরাধে ব্রুনোকে আটকে রাখা হয়েছিল এমন এক ঘরে, যার ছাদ ছিল সীসেতে মোড়া। গ্রীষ্মে ঘর হতো চুল্লি, শীতে বরফ। এমনি করে দীর্ঘ আট বছর ধরে তার উপর চলেছে ধর্মীয় নির্যাতন।  ১৬০০ খ্রিস্টাব্দে পবিত্র ঈশ্বর-প্রেমীরা তথাকথিত সত্যের পূজারিরা ব্রুনোকে শেষবারের মতো তাঁর মতবাদকে ভ্রান্ত বলে স্বীকার করতে বলল। অসীম সাহসী ব্রুনো সেই প্রস্তাব প্রচণ্ড ঘৃণার সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করলেন। বাইবেল বিরোধী অসত্য ভাষণের জন্য ব্রুনোকে প্রকাশ্য স্থানে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হলো। অনুমান করে নিতে অসুবিধে হয় না, সেদিনের দর্শক হিসেবে উপস্থিত মূর্খ জনতা লেলিহান আগুনে এক সত্যের পূজারিকে ধ্বংস হতে দেখে যথেষ্ট উল্লসিত হয়েছিল।

 গ্যালিলিও গ্যালিলেইকেও ধর্মান্ধদের বিচারে অধার্মিক ও অসত্য মতবাদ প্রচারের অপরাধে জীবনের শেষ আট বছর বন্দি জীবন কাটাতে হয়েছে।

 কিন্তু এত করেও সর্বশক্তিমান ঈশ্বর ও ঈশ্বরের পুত্রেরা সূর্যের চারপাশে পৃথিবীর ঘোরা বন্ধ করতে পারেনি।

 খ্রিস্টজন্মের প্রায় ৪৫০ বছর আগে আনাক্সাগোরাস বলেছিলেন, চন্দ্রের নিজস্ব কোনও আলো নেই। সেইসঙ্গে আরও বলেছিলেন, চন্দ্রের হ্রাস-বৃদ্ধির কারণ। চন্দ্রগ্রহণের কারণও তিনি ব্যাখ্যা করতে সমর্থ হয়েছিলেন।

 আনাক্সাগোরাসের আবিষ্কারের প্রতিটি সত্যই ছিল সেদিনের ধর্ম-বিশ্বাসীদের চেখে জঘন্য রকমের অসত্য। ঈশ্বর বিরোধিতা, ধর্ম বিরোধিতা ও অসত্য প্রচারের অপরাধে দীর্ঘ ও নিষ্ঠুর নির্যাতনের পর তাঁকে দেশ থেকে নির্বাসিত করা হয়।

 এত করেও কিন্তু সেদিনের ঈশ্বরের পুত্রেরা সত্যকে নির্বাসনে পাঠাতে পারেনি। তাদের ঈশ্বরের অভ্রান্ত বাণীই আজ শিক্ষিত সমাজে নির্বাসিত।

 ষোড়শ শতকে সুইজারল্যাণ্ডের বেসেল বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়নশাস্ত্র ও ভেষজবিদ্যার অধ্যাপক ডাক্তার ফিলিপ্রাস অ্যাউরেওলাস প্যারাসেলসাস ঘোষণা করলেন—মানুষের অসুস্থতার কারণ কোনও পাপের ফল বা অশুভ শক্তি নয়, রোগের কারণ জীবাণু। পরজীবী এই জীবাণুদের শেষ করতে পারলেই নিরাময় লাভ করা যাবে।

 প্যারাসেলসাস-এর এমন উদ্ভট ও নতুন তত্ত্ব শুনে তাবৎ ধর্মের ধারক-বাহকেরা ‘রে-রে’ করে উঠলেন। এ কী কথা! রোগের কারণ হিসেবে ধর্ম আমাদের যুগ যুগ ধরে যা বলে এসেছে, তা সবই ওই একজন উন্মাদ অধ্যাপকের কথায় মিথ্যে হয়ে যাবে? শতাব্দীর পর শতাব্দী পবিত্র ধর্মনায়কেরা যা বলে গেছেন, ধর্মগ্রন্থগুলোতে যা লেখা রয়েছে লক্ষ-কোটি মানুষ যা বিশ্বাস করে আসছে, সবই মিথ্যে? সত্যি শুধু প্যারাসেলসাস-এর কথা?

 সমাজের পক্ষে ক্ষতিকারক ধর্ম-বিরোধী মতবাদ প্রচারের জন্য প্যারাসেলসাসকে হাজির করা হলো ‘বিচার’ নামের এক প্রহসনের মুখোমুখি। ধর্মান্ধ বিচারকরা প্যারাসেলসাসকে ঈশ্বর প্রণীত অভ্রান্ত সত্যকে অসত্য বলার অপরাধে মৃত্যুদণ্ড দিল। প্যারাসেলসাস সেদিন নিজের জীবন বাঁচাতে প্রিয় জন্মভূমি ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছিলেন।

 সেদিনের ধর্মীয় সত্য আজ বিজ্ঞানের সত্যের কাছে পিছু হটতে বাধ্য হয়েছে। মিথ্যে হয়ে গেছে ধর্মের ধারণা, ঈশ্বরের বাণী।

 হিন্দু ধর্মের ধারণায় ব্রহ্মা তাঁর শরীরের এক একটি অঙ্গ থেকে এক এক শ্রেণির জীব সৃষ্টি করেছেন। এমনি করেই একদিন সৃষ্টি হয়েছিল মানব, মানবীর। বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডের তাবত জীব ব্রহ্মারই সৃষ্টি বলে হিন্দু ধর্ম বিশ্বাসীরা মনে করেন।

 খ্রিস্টীয় মতে কিন্তু বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডের তাবৎ জীবের স্রষ্টা পরমপিতা জিহোবা। পরমপিতা এক জোড়া করে বিভিন্ন প্রাণী সৃষ্টি করে ছেড়ে দিয়েছিলেন পৃথিবীর বুকে। এমনি করেই একদিন জিহোবা সৃষ্টি করেছিলেন এক জোড়া মানুষ—আদম ও ঈভ।

 বিভিন্ন প্রাণী বা মানুষের উৎপত্তির কোনও ধর্মীয় ধারণাই আজ আর বিজ্ঞান শিক্ষিত মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়, আজ আমরা জানতে পেরেছি, কোনও প্রাণীই ঈশ্বরের দ্বারা সৃষ্ট হয়ে হঠাৎ করে পৃথিবীর বুকে আবির্ভূত হয়নি। হাজির হয়েছে কোটি কোটি বছরের দীর্ঘ বিবর্তনের মধ্য দিয়ে।

 আধুনিক জীবাশ্ম বিজ্ঞানীদের মতে পৃথিবীতে জীবনের প্রথম বিকাশ ঘটে আজ থেকে প্রায় সাড়ে তিনশ’ কোটি বছর আগে অর্থাৎ, পৃথিবীর জন্মের একশ’ কোটি বছর পরে। জীব-বিজ্ঞানের ভাষায় তাদের বলা হয় ‘প্রোকারিয়টস’ (prokaryotes)—জীবাণুবিশেষ প্রাণী। তাদের ধরনধারণটা ছিল কতকটা আধুনিক ব্যাকটিরিয়ার মতো। এক একটি জীবকোষ এক একটি প্রাণী। এই জীবকোষে নিউক্লিয়াসের মতো সুস্পষ্ট কোনও অঙ্গ ছিল না। এই এককোষী প্রাণীই বিবর্তনের মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে বিকশিত হয়ে উঠল বহুকোষী প্রাণীতে। দীর্ঘ পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে সৃষ্টি হয়েছে বর্তমানের প্রতিটি শ্রেণীর প্রাণী এবং মানুষও তার বাইরে নয়।

 প্রাণের উৎস চারটে জিনিস। এক: এক ধরনের কিছু প্রোটিন, যাকে বিজ্ঞানের পরিভাষায় বলা হয় ‘নিউক্লিয়োটাইড’ (Nucleotide)। দুই: কিছু অ্যাসিড, বিজ্ঞান যার নাম দিয়েছে ‘নিউক্লিক অ্যাসিড’ (Nucleic acid)। তিন: বিশেষ তাপমাত্রা, চার: বিশেষ পরিবেশগত চাপ। এই চারটি জিনিসের মিলনে সৃষ্টি হয়েছিল প্রাণ।
ডারউইন

 পৃথিবীর জন্ম থেকেই নিউক্লিয়োটাইডনিউক্লিক অ্যাসিডের অস্তিত্ব পৃথিবীতে ছিল। বিভিন্ন সময় এরা মিলিতও হয়েছে, কিন্তু পরিবেশগত চাপ ও তাপের অভাবে প্রাণ সৃষ্টি হয়নি। পৃথিবী সৃষ্টির প্রায় একশো কোটি বছর পরে পৃথিবী একটা চরম অবস্থার মধ্যে ছিল। প্রতিনিয়ত প্রচণ্ড ঝড়, বৃষ্টি, বজ্রপাত, আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত, ভুমিকম্পের ফলে অশান্ত পৃথিবীতে যে পরিবেশগত তাপ ও চাপ সৃষ্টি হয়েছিল, তারই মধ্যে হঠাৎ একসময় নিউক্লিয়োটাইড ও নিউক্লিক অ্যাসিড মিলিত হয়ে সৃষ্টি করেছিল প্রাণ।

 প্রাণীদের ক্রমবিবর্তনের ইতিহাস প্রথম তুলে ধরেছিলেন চার্লস ডারউইন। দীর্ঘ বছরগুলোর অক্লান্ত পরিশ্রমে ডারউইন সৃষ্টি করলেন তাঁর সনাতন ধর্ম-বিরোধী সৃষ্টি ও বিবর্তন তত্ত্ব।

 বিভিন্ন জীবাশ্মের আবিষ্কার ও তাদের প্রাচীনত্ব নির্ণয় করে বিজ্ঞান ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্বের হারানো সুত্র বা ‘মিসিং লিংক’কে জোড়া লাগিয়ে সম্পূর্ণ রূপ দিল।

 যদিও ডারউইন ছিলেন গত শতকের মানুষ, তবু তাঁকে ধর্মান্ধদের হাতে অত্যাচারিত হতে হয়েছে প্রায় মধ্যযুগীয় প্রথায়।

 প্রাচীন অতীতে মানুষ দরিয়ায় নৌযান ভাসাতে শিখল। দিক নির্ণয়ের জন্য অনুভব করলো নক্ষত্র চেনার প্রয়োজনীয়তা। কেবলমাত্র অনুন্নত গণিত শাস্ত্রের উপর নির্ভর করে সীমিত জ্ঞান নিয়ে মানুষ গ্রহ, নক্ষত্রের বিষয়ে যা জেনেছিল তাতে অনেক ক্ষেত্রেই ছিল অসম্পূর্ণতা ও ভ্রান্ত ধারণা আর্যভট্ট, ভাস্কর, হিপার্কস-এর জ্যোতিষচর্চায় গণিত থাকলেও টেলিস্কোপের অভাবে পুরোপুরি বিজ্ঞান ছিল না। অর্থাৎ সেই সময়কার জ্যোতির্বিদ্যা বিজ্ঞানের পর্যায়ে উন্নত হতে পারেনি। বরাহমিহির থেকে টলেমির মত আকাশ পর্যবেক্ষকদের জন্যে তখন জ্যোতির্বিদ্যা (Astronomy) ও ফলিত জ্যোতিষ-এর (Astrology) মধ্যে স্পষ্ট পার্থক্য ছিল না।

 বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে আবিষ্কৃত হলো দূরবীক্ষণ, উন্নত হলো গণিত শাস্ত্র। বহু পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে বিজ্ঞানরূপে প্রতিষ্ঠিত হলো বর্তমান জ্যোতির্বিদ্যা। পরিত্যক্ত হলো ফলিত জ্যোতিষ বা জ্যোতিষশাস্ত্ররূপে অ-বিজ্ঞান।

উন্নত দেশগুলোর সংখ্যাগুরু মানুষ আজ বুঝতে শিখেছেন,
মানুষের সুখ-দুঃখের হেতু আকাশের গ্রহগুলোর
মধ্যে নিহিত নেই, রয়েছে আমাদের
সৃষ্ট সমাজ ব্যবস্থার মধ্যে।

 বিশ্বের খ্যাতিমান ১৮৬ জন যুক্তিবাদী বিজ্ঞানী (এঁদের মধ্যে ১৮ জন নোবেল বিজয়ী) ১৯৭৫-এর সেপ্টেম্বরে নিউ ইয়র্কের ‘দি হিউম্যানিস্ট’ পত্রিকায় এক ইস্তাহারে বলেছিলেন, “আমরা অত্যন্ত বিচলিত, কারণ বিভিন্ন প্রচারমাধ্যম, নামী সংবাদপত্র, বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও পুস্তক প্রকাশক পর্যন্ত ঠিকুজী-কোষ্ঠী, রাশিবিচার, ভবিষ্যদ্বাণীর পক্ষে ক্রমাগত প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন। যেখানে যুক্তি-বিচারের কোনও স্থান নেই। এতে মানুষের মধ্যে অযৌক্তিক ধ্যান-ধারণা অন্ধ বিশ্বাস বেড়েই যায়। আমরা বিশ্বাস করি, জ্যোতিষীদের ভণ্ডামির বিরুদ্ধে সরাসরি দৃঢ়ভাবে চ্যালেঞ্জ জানানো সময় এসেছে।”

 মজার কথা, বিজ্ঞানীরা যখন চ্যালেঞ্জ জানানোকে স্বাগত জানাচ্ছেন, একান্ত প্রয়োজনীয় সামাজিক কর্তব্য বলে মনে করছেন এবং তাঁদের আহ্বানের সঙ্গে সহমত হয়ে ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি সরাসরি চ্যালেঞ্জ জানিয়ে প্রথম সারির নামী-দামী বহু সংখ্যক জ্যোতিষীদের পরাজিত, পর্যুদস্ত করেই চলেছে তখন পরাজিত পর্যুদস্ত জ্যোতিষীসহ অনেক জ্যোতিষীই বিজ্ঞান-সম্মত উপায়ে ভাগ্য গণনার বিজ্ঞাপন দিয়ে চলেছে। ফলিত জ্যোতিষের মতো অ-বিজ্ঞানকে হাতিয়ার করে জেনে বুঝে লোক ঠকিয়ে চলেছে।

আমরা কোথায় আছি

 আমাদের মতো সামাজিক ও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে পিছিয়ে পড়া সংস্কারবদ্ধ দেশে পদে পদে যেখানে অনিশ্চয়তা সেখানে বেশির ভাগ সাধারণ মানুষ দুঃখ-কষ্টের হাত থেকে পরিত্রাণ পেতে প্রতিকারের একমাত্র ধ্বজাধারী জ্যোতিষী বা অবতারদের দ্বারস্থ হবেন, এটাই স্বাভাবিক।
মেঘনাদ সাহা

 বিজ্ঞানের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে ধর্মীয় ভ্রান্ত ধারণাগুলো একে একে পচা-গলা অঙ্গের মতোই খসে খসে পড়ছে। শিক্ষা ও বিজ্ঞানের সঙ্গে সঙ্গে বিজ্ঞানমনস্ক মানসিকতাও একটু একটু করে গড়ে উঠছে। তবুও এ-কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, অনুন্নত দেশের তুলনায় অনেক কম হলেও উন্নততর দেশেও অবৈজ্ঞানিক, যুক্তিহীন, ভ্রান্ত ধর্মীয় ধারণাগুলো এখনও বর্তমান।

 শ্রদ্ধেয় বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহার বক্তব্য থেকে আমরা জানতে পারি তাঁর সংগৃহীত তথ্য অনুসারে সে সময়ে আমাদের দেশের শতকরা ৯৯ ভাগ পুরুষ ও শতকরা ১০০ ভাগ মহিলা ফলিত জ্যোতিষে বিশ্বাসী। ইউরোপে ফলিত জ্যোতিষে পুর্ণ আস্থাবান পুরুষের সংখ্যা শতকরা ৫ এবং মহিলার সংখ্যা শতকরা ৩৩ জন।

 এই পরিসংখ্যান থেকে অনুমান করতে অসুবিধে হয় না, যুক্তিহীন কুসংস্কার ভারতীয় সমাজে কেমনভাবে জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসে রয়েছে। অতি দুঃখের কথা এই যে, প্রতিটি দেশ যখন বিভিন্ন বিষয়ে উন্নতিকে দ্রুততর করতে চাইছে, তখন আমরা অতীত সংস্কৃতির দোহাই দিয়ে সনাতন সংস্কারের আবর্তে থাকতে চাইছি।

এ-যুগের অনেকেই বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশুনো করলেও বা
বিজ্ঞানের কোনও বিভাগকে পেশা হিসেবে গ্রহণ
করলেও মনে-প্রাণে বিজ্ঞানী হতে পারেননি,
পারেননি বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিকে
গ্রহণ করতে।

 এঁরা প্রায়শই একদিকে যুক্তিহীন ধর্মীয় ধ্যান-ধারণাগুলোকে আঁকড়ে ধরে রেখেছেন, আর এক দিকে লেখাপড়ায় সুপুত্র হয়ে ডাক্তারি বা ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে ছাত্র-জীবনে ছেদ টেনেছেন, অথবা বিজ্ঞানের অন্য কোনও বিভাগে সাফল্যের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়ে কর্মজীবনে আর্থিক সফলতা পেয়েছেন।

 আমার এক পরিচিত এক ডাক্তারকে দেখেছি, একটা স্ট্রোক হওয়ার পর তাঁর হাতে ও গলায় একাধিক মাদুলী শোভা পাচ্ছে।

 আমার এক পরিচিত বিজ্ঞান পেশার প্রতিবেশীকে জানি, যাঁর পালিয়ে যাওয়া কিশোরী কন্যাটিকে ফেরত পাওয়ার জন্য ঈশ্বরের কাছে মানত করেছিলেন।

 এক কেমিস্ট্রির অধ্যাপককে জানি, যিনি বিশ্বাস করেন, তাঁর গুরুদেব মাধ্যাকর্ষণ শক্তিকে উপেক্ষা করে ধ্যানে শূন্যে ভেসে থাকতে পারেন।

 বর্তমানের নামী-দামি অবতারদের জীবনী পড়লে বিজ্ঞান শিক্ষায় শিক্ষিত অনেকেরই নাম পাবেন, যাঁরা এই সব অবতারদের অলীক অলৌকিক ক্ষমতার পক্ষে মত প্রকাশ করেছেন। তাঁরা এই সব মত প্রকাশ করেছেন কখনও অন্ধবিশ্বাসে, কখনও বা অলৌকিক (?) ঘটনাটির পিছনে লুকোনো বাস্তব কারণ বুঝতে না পারার দরুন। অহংবোধের ফলে এইসব শিক্ষিত মানুষ একবারও ভাবতে পারেন না, তাঁদের বোধশক্তির বাইরেও যুক্তিগ্রাহ্য কারণ থাকতে পারে। বিশ শতকের শেষ মাথায় এসেও ভারতবর্ষের শিক্ষিত, বিজ্ঞান-শিক্ষিত, মাকর্সবাদে-দীক্ষিত অনেকেই যুক্তিহীন, অবৈজ্ঞানিক চিন্তাধারা বহন করে চলেছেন।

 সমাজে প্রতিষ্ঠিত শিক্ষিত অথচ যুক্তিহীন মানুষের তালিকা দিতে গেলে একটা ছোট-খাটো বই হয়ে যাবে।

 কিছু কিছু বিজ্ঞান-পেশার ব্যক্তি আছেন, যাঁরা তাঁদের আজন্ম লালিত ধর্মীয় ধারণাগুলোকে বিজ্ঞানের কাছে নতজানু হতে দেখে ধর্মতত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত এবং অতীন্দ্রিয়তার অস্তিত্ব প্রমাণের জন্য মিথ্যা ও শঠতার আশ্রয় নিতে পিছ-পা নন। ধর্মতত্ত্ব ও অতীন্দ্রিয়তাকে বিজ্ঞানসম্মত বলে প্রচার করার অক্লান্ত চেষ্টা করে চলেছেন পরামনোবিজ্ঞানী (Para-psychologist) নামের অ-মনোবিজ্ঞানীরা। আজ পর্যন্ত তাঁদের এই চেষ্টা, শুধুমাত্র প্রচারের স্তরেই রয়ে গেছে, পরামনোবিদ্যা প্রকৃতিবিজ্ঞানের মর্যাদা পায়নি। পরামনোবিজ্ঞানীরা প্রকৃতিবিজ্ঞানের (মেথডলজি) অনুসরণ করে বিজ্ঞানের দরবারে অতীন্দ্রিয় ক্ষমতা, প্ল্যানচেট, জাতিস্মর মানুষের অস্তিত্ব প্রমাণের জন্য নানাধরনের কূট কৌশলের আশ্রয় নিয়েছেন। যদিও সেইসব কৌশলের একটিও বিজ্ঞানের দরবারে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। গ্রহণযোগ্য হয়নি কোনও যুক্তিবাদী মানুষের কাছে। কারণ, পরামনোবিজ্ঞানীদের দেওয়া প্রতিটি পরীক্ষার ক্ষেত্রেই ছিল কৌশল গ্রহণের সুযোগ।

 ভারতীয় সমাজকে কুসংস্কারের অন্ধকার থেকে বিজ্ঞানের আলোতে আনার জন্য যখন বুদ্ধিজীবী ও যুক্তিবাদীদের প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি, তখন এক শ্রেণির কুসংস্কারাচ্ছন্ন ‘বুদ্ধিজীবী’ মানুষই অতীন্দ্রিয়তাকে, অবতারবাদকে, জন্মান্তরকে, জ্যোতিষশাস্ত্রকে প্রতিষ্ঠিত করে প্রগতির চাকাকে উলটো দিকে ঘোরাতে চাইছেন।

 শিক্ষার ডিগ্রিধারী সংস্কারবদ্ধ মানুষ, অবতারদের কৌশলকে ব্যাখ্যা করতে না পারা সমাজে প্রতিষ্ঠা পাওয়া আত্মগর্বী মানুষ, কৌশলে অতীন্দ্রিয়তাকে প্রতিষ্ঠা করতে চাওয়া বিজ্ঞান শাখার মিথ্যাচারী মানুষগুলোই আজকের সমাজে যুক্তিবাদী ও বিজ্ঞানমনস্ক মানুষগড়ার কাজে সবচেয়ে বড় বাধা।

আমাদের দেশে স্বল্প শিক্ষিত, ডিগ্রিহীন, সংস্কারমুক্ত, যুক্তিবাদী,
স্বচ্ছ বৈজ্ঞানিক মানসিকতার মানুষ আমি দেখেছি। আবার
একই সঙ্গে দেখেছি ‘যুক্তিবাদী’, ‘বিজ্ঞানমনস্ক’ এবং
সংগ্রামী বলে স্ব-বিজ্ঞপিত কিছু সমাজশীর্ষ
মানুষের ঈর্ষার নানা রূপ। ঈর্ষা তাঁদের
কখনও নিয়োজিত করছে যুক্তিবাদী
মানুষের সংস্কারমুক্তির সংগ্রামের
বিরুদ্ধে, কখনও বাধ্য করছে
যুক্তিহীনতাকে আশ্রয়
করতে।

 জানি, প্রতিটি ক্ষেত্রেই শেষ পর্যন্ত অনিবার্যরূপে যুক্তিবাদী মানসিকতা যুক্তিহীনতার বিরুদ্ধে জয়ী হবেই। বিরোধীরা এই জয়কে বিলম্বিত করতে পারে মাত্র, আজ পর্যন্ত স্তব্ধ করতে পারেনি এবং পারবেও না। ইতিহাস অন্তত এই শিক্ষাই দিয়েছে।